সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের কুরআনের অনুবাদ পড়া কতটুকু যৌক্তিক?????

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

সমাজের এক শ্রেণীর আলেম আছে যারা কুরআনের অর্থ বুঝে পড়তে নিষেধ করে থাকে। অনেক সময় বলে থাকেন কুরআনের অর্থ বুঝে পড়তে হলে পনের প্রকার এলম থাকতে হবে। যাদের এই এলম নেই, তারা কুরআনের অর্থসহ তিলাওয়াত করতে পারবে না। সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদেরও কঠোরভাবে কুরআনের অর্থসহ তিলাওয়াত করতে নিষেধ করেন। তাদের এই নিষেধাজ্ঞা কতটুকু যৌত্তিক?

উত্তরঃ কোন বিষয় বুঝতে গেলে, সে বিষয় সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান থাকা দরকার। আপনি যত ভাল শিক্ষকই হোন না কেন, নিরক্ষর অজ্ঞ লোককে আপনি কোন শ্রণীর অংক বুঝাতে পারবেন না। জ্ঞান দানের জন্য উপযুক্ত পাত্রের প্রয়োজন হয়। আবার ভাল মেধাবী শিক্ষার্থী হলেও হবে না, বিষয়ের প্রতিও নজর রাখতে হবে। মেধাবী শিক্ষার্থী ডাক্তারি পাশ করেছেন অনায়াসে, তাকে ইজ্ঞিনিয়ারিং এর কোন জ্ঞান দিলে কত টুকু বুঝবে? তা যে কেউ বলতে পারবে। কাজেই বিষয় এবং শিক্ষার্থী দুটির মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে।

এবার তাহলে আমাদের বিষয়টিতে আসি। আমাদের বিষয় হল আল কুরআন আর শিক্ষার্থী হল সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোক।

প্রথমে আল কুরআনের বিষয় বস্তু উল্লেখ করব। তাহলেই পাঠক কুরআনের শিক্ষার্থী নির্বাচন করতে পারবেন।

কুরআনের প্রধান বিষয় বস্তু হল আল্লাহ একত্বাবাদ বা তাওহীদ। কুরআনে প্রতিটি সূরায় তাওহীদ বর্ণনার পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি আয়াতের শেষে আল্লাহর পরিচয় দিয়েছেন। পঁচিশ জন নবী আলোচনার পাশাপাশি চৌদ্দটি জাতীর বিবরণ আছে অসংখ্য আয়াতে। আল্লাহর আদেশ নিষেধ মুলক আয়াত প্রায় দুই হাজারের মত।  এছাড়াও জান্নাত, জাহান্নাম, রিসালত, আখেরাত, আল্লাহর কিতাব, ফিরেস্তা, তাকদির, কিয়ামত, সালাত, সাওম, হজ্জ্ব, যাকাত, দুয়া মুনাজাত, যিকির, তাওবা, বান্দার হক, বন্ধু নির্বাচন,  নারী, বিবাহ, তালাক, মোহর, জিনা, পর্দা, উত্তারাধিকারির সম্পদ, হালাল, হারাম, মদ, সুদ, ঘুষ, জিহাদ, খেলাফত, মুমিন, ইয়াহুদি, খৃষ্টান, মুশরিক, মুনাফিকদের চরিত্র ইত্যাদি। এই বিষয়গুলি বুঝার জন্য কোন বিষেশ এলমের প্রয়োজন নেই। তবে কিছু কিছু আয়াত আছে যে গুলো বুঝার জন্য শানে নুজুল, সময়, কারন সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, একজন আদর্শ মুমির বান্দা হিসাবে পৃথিবীতে চলতে গেলে যা যা দরকার তার সবই আছে।  অর্থাৎ মানুষের হোদায়াত পাওয়া ও পথ দেখার জন্য যেসব জিনিসের প্রয়োজন তার প্রত্যেটির বিস্তারিত বিবরণ মহান আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

لَقَدۡ كَانَ فِى قَصَصِہِمۡ عِبۡرَةٌ۬ لِّأُوْلِى ٱلۡأَلۡبَـٰبِ‌ۗ مَا كَانَ حَدِيثً۬ا يُفۡتَرَىٰ وَلَـٰڪِن تَصۡدِيقَ ٱلَّذِى بَيۡنَ يَدَيۡهِ وَتَفۡصِيلَ ڪُلِّ شَىۡءٍ۬ وَهُدً۬ى وَرَحۡمَةً۬ لِّقَوۡمٍ۬ يُؤۡمِنُونَ (١١١)

অর্থঃ পূর্ববর্তী লোকদের এ কাহিনীর মধ্যে বুদ্ধি ও বিবেচনা সম্পন্ন লোকদের জন্য শিক্ষা রয়েছে৷ কুরআনে এ যা কিছু বর্ণনা করা হচ্ছে এগুলো বানোয়াট কথা নয় বরং এগুলো ইতিপূর্বে এসে যাওয়া কিতাবগুলোতে বর্ণিত সত্যের সমর্থন এবং সবকিছুর বিশদ বিবরণ, আর যারা ঈমান এসেছে তাদের জন্য হেদায়াত ও রহমত৷ (সুরা ইউসুফ ১২:১১১)।

আবার কখন কখন আবার শুধু শিরোনাম দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, সালাত কায়েম করো, যাকাত দাও এবং যারা আমার সামনে অবনত হচ্ছে তাদের সাথে তোমরাও অবনত হও, (২:৪৩)। কিন্তু সালাত ও যাকাত ইসলামের গুরুত্বপূর্ন ইবাদাত হলেও শুধু শিরোনামের মত উল্লেখ করা হইয়াছে। এই শিরনামের বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনিতে বা হাদিস সমুহে। হাদিস সমুহ আল্লাহর এক প্রকার অহী। আল্লাহ বলেন,

 لَأَخَذۡنَا مِنۡهُ بِٱلۡيَمِينِ (٤٥) ثُمَّ لَقَطَعۡنَا مِنۡهُ ٱلۡوَتِينَ (٤٦) فَمَا مِنكُم مِّنۡ أَحَدٍ عَنۡهُ حَـٰجِزِينَ (٤٧)

অর্থ: যদি এ নবী নিজে কোন কথা বানিয়ে আমার কথা বলে চালিয়ে দিতো। তাহলে আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম। এবং ঘাড়ের রগ কেটে দিতাম৷ তোমাদের কেউ-ই (আমাকে ) এ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারতো না৷ (সুরা হাক্ক ৬৯:৪৫-৪৭)। 

হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ তার লিখিত প্রসিদ্ধ কিতাব “ফওজুল কবির”-এ কুরআনের আলোচ্য বিষয় বস্তুসমুহ মোট পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন।

১। ইলমুল আহকাম বা সাংবিধানিক জ্ঞানঃ ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রিয় জীবনের সকল বিধি নিষেধ এবং ফরজ, ওয়াজির, হালাল, হারামসহ সকল আদেশ  নিষেধ।

২। ইলমুল মুখাদামা বা ন্যায়শাস্ত্রঃ ইয়াহুদি, খৃষ্টান, মুশরিক ও মুনাফিক এই চার দলের ভ্রান্ত মতবাদ সংক্রান্ত।

২। ইলমুল তাজকির বা স্রষ্টাতত্ত্বঃ তাওহীদ বা একত্ববাদের সকল বিষয় আলোচনা।

২। ইলমুল তাজকির বিলআইয়ামিল্লাহ বা সৃষ্টিতত্ত্বঃ আল্লাহর সৃষ্টি বস্তুর অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা।

২। ইলমুল তাজকির বিল মাইত বা পরকাল জ্ঞানঃ আখেরাত বা পরকাল সংক্রান্ত শাস্তি ও পুরস্কারের আলোচনা।

এক অনুসন্ধানে দেখা যায় কুরআনে মোট আদেশমূলক আয়াতের সংখ্যা এক হাজার, নিষেধমূলক আয়াতের সংখ্যা এক হাজার, ভীতিমূলক আয়াতের সংখ্যা এক হাজার, প্রতিজ্ঞামূলক আয়াতের সংখ্যা এক হাজার, দৃষ্টান্তমূলক আয়াতের সংখ্যা এক হাজার, ইতিহাসমূলক আয়াতের সংখ্যা এক হাজার, প্রশংসামূলক আয়াতের সংখ্যা আড়াই শত, উদ্দেশ্যমূলক আয়াতের সংখ্যা আড়াই শত, পুর্ণতামূলক আয়াতের সংখ্যা এক শত।

এই সকল বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিলে দখা যাবে, অদৃশ্যের বর্ণনার পাশাপাশি, মানব জীবনের জীবন ঘনিষ্ট সকল বিষয় উঠে এসেছে মহা গ্রন্থ আর কুরআনে। বিশ্ব জাহানের সকল জ্ঞানের উত্স হল আল কুরআন। সকল জ্ঞানের উত্স থেকে নাজিল করা জ্ঞান, যা অবশ্যই আদম সন্তানের দ্বীন, দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণ করার একক ক্ষমতা রাখে। কুরআন কোন একক শ্রেণী পেশার জন্য নাজির হয় নি।

যেমন প্রতিবেশী হিন্দুদের কথাই ধরুন। সমাজ বইয়ে পড়েছিলাম। উপমহাদেশে এক সময় নিম্ম বর্ণের হিন্দুদের জন্য তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ পড়া নিষেধ ছিল। তাদের গ্রন্থ উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত। তাই  নিম্ম বর্ণের কোন হিন্দু তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে কিছু পড়লে বা কিছু শুনলে তাদের শাস্তি প্রদান করা হত।

কুরআন যেহেতু সব শ্রেণী পেশার জন্য নাজিল হয়েছে। আর তিনি নাজিল করেছেন তিনি তো সকল সৃষ্টির মন মানুষিকতা বুঝেই নাজিল করেছেন। মহান আল্লাহ উপদেশ গ্রহণের জন্য কুরআনকে সহজ করে দিয়েছেন। তাই কুরআনের পঠন, পাঠন, তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন এবং কুরআনের অনুশাসন মেনে চলাকে আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন বলে সূরা আল-কামারে মোট চারবার ঘোষণা দিয়েছেন। এবং বলেছেন,

وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ

অর্থঃ আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, উপদেশ গ্রহণ করার কেউ আছে কি? (সূরা কামার ৫৪:১৭,২২,৩২,৪০)।

হাজার হাজার হাফেজ দেখলেই মনে হবে আল কুরআনের শব্দমালা কত সহজেই তিলাওয়াত ও হিফয করা যায়। কুরআনের ভাষা খুবই সহজ সাবলিল, মাধুর্যপূর্ণ, নিখুদ ও সহজেই বোধগম্য। অথচ লেখাগুলি কাব্যিক ছন্দে। পৃথিবীর কোন কেউ এমন করে রচনা করতে পারবেনা, (২:২৩-২৪: ১৭:৮৮)। যে বা যারাই কুরআনের জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয় আল্লাহ তাদের জন্য তা নিতান্তই সহজ করে দেন। কুরআনের অর্থগত দিকটাও চমত্কার। এমন অনেক অনারব অমুসলিম আছে যাদের আরবি সম্পর্কে নুন্যতম ধারনা নেই। অনুবাদ পড়ে কুরআনের ভুল ধরার চেষ্টা করে, নিজেই কুরআনের কাছে আত্বসমার্পণ করে মুসলিম হয়েছেন।

মহান আল্লাহ বলেন,

فَإِنَّمَا يَسَّرۡنَـٰهُ بِلِسَانِكَ لَعَلَّهُمۡ يَتَذَڪَّرُونَ (٥٨)

অর্থঃ ‘অতঃপর আমি তো তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা দুখান ৪৪:৫৮)।

মহান আল্লাহ বলেন,

فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ الْمُتَّقِينَ وَتُنْذِرَ بِهِ قَوْماً لُدّاً

 অর্থঃ আর আমি তো তোমার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি এর দ্বারা মুত্তাকীদের সুসংবাদ দিতে পার এবং হঠকারীদেরকে ভয় দেখাতে পারো৷ (সূরা মারইয়াম ১৯:৯৭)।

কুরআনের কুরআনের বিষয় বস্তু ও আল্লার নাজির কৃত আয়াত দ্বারা এ কথা বুঝা গেল এক জন সাধারন আদম সন্তান থেকে শুরু করে, মহা জ্ঞানীও কুরআনকে সহজে বুঝতে পারবে। তাছাড়া এ মহান গ্রন্থ আল্লাহ সকল বিশ্ববাসির জন্য নাজিল করেছে। মহান আল্লাহ বলেন,

 هَـٰذَا بَلَـٰغٌ۬ لِّلنَّاسِ وَلِيُنذَرُواْ بِهِۦ وَلِيَعۡلَمُوٓاْ أَنَّمَا هُوَ إِلَـٰهٌ۬ وَٲحِدٌ۬ وَلِيَذَّكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَـٰبِ (٥٢

 অর্থঃ এটি একটি পয়গাম সব মানুষের জন্য এবং এটি পাঠানো হয়েছে এ জন্য যাতে এর মাধ্যমে তাদেরকে সতর্ক করা যায় এবং তারা জেনে নেয় যে, আসলে আল্লাহ মাত্র একজনই আর যারা বুদ্ধি-বিবেচনা রাখে তারা সচেতন হয়ে যায়৷  (সুরা ইব্রাহীম ১৪:৫২)।

মহান আল্লাহ বলেন,

تَبَارَكَ ٱلَّذِى نَزَّلَ ٱلۡفُرۡقَانَ عَلَىٰ عَبۡدِهِۦ لِيَكُونَ لِلۡعَـٰلَمِينَ نَذِيرًا (١)

 অর্থ: বড়ই বরকত সম্পন্ন তিনি যিনি এ ফুরকান যাতে সে সারা বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হয়৷ তারঁ বান্দার ওপর নাযিল করেছেন। (সুরা ফুরকান ২৫:১)। 

মহান আল্লাহ বলেন,

هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ

 অর্থঃ এটা সব মানুষের জন্য দূরদৃষ্টির আলো এবং যারা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে তাদের জন্য হিদায়াত ও রহমত৷(সুরা জাসিয়া ৪৫:২০)।

মহান আল্লাহ বলেন,

 هَـٰذَا بَيَانٌ۬ لِّلنَّاسِ وَهُدً۬ى وَمَوۡعِظَةٌ۬ لِّلۡمُتَّقِينَ (١٣٨)

 অর্থঃ এটি মানব জাতির জন্য একটি সুস্পষ্ট সর্তকবাণী এবং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশ৷ (সুরা আল ইমরান ৩:১৩৮)। 

কুরআনের বিষয় বস্তু আর আল্লাহ বনী একথার সাক্ষ্য দেয় যে, সর্বজনিন ও সকল মানব জাতির জন্য নাজিলকৃত কুরআনের বানী কঠিন ও দুর্ভেদ্য নয়।

এবার আসুন শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে। শিক্ষার্থী হল সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোক। সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত সকল মানুষই কি কুরআনের অর্থ বুঝার বা জানার চেষ্টা করে? একটা উদাহরন দিলেই ব্যপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে। আমার নিজের গ্রামে দুইটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাই স্কুল, একটি হিফজ খানাসহ কওমী মাদ্রাসা আছে যেখানে দাওরা হাদিস পর্যান্ত পড়ান হয়। এবং প্রায় আড়াই হাজারের মত ভোটার আর নামাজ ফরজতো আরও বেশী জনের উপর। তিন/চারটি সমজিদ আছে কিন্তু জুমার সালাত হয় মাদ্রাসা সংলগ্ন মসজিদে। মাদ্রাসা সংলগ্ন মসজিদে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ছাড়া নিয়মিত জামাতে সালাত আদায় করে প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ জনের মত। বাকি মসজিদে পাঁচ থেকে দশ জনের মত। এই হল একটি আদর্শ গ্রামের নামাজিদের চিত্র। গ্রাম বাংলার চিত্র আরও করুন। বেশীর ভাগ গ্রামে মসজিদই নেই। আবার যেখানে মসজিদ আছে, নিয়মিত আযানই হয় না। ইসলামী ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে শতকরা পাঁচ জন লোক নিয়মিত সালাত আদায় করে। এই শতকরা পাঁচ জন লোকের মধ্যে আছেন, কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসাই, খেটে খাওয়া মানুষ, শিক্ষক, ছাত্র, চাকুরি জীবি এমনকি বেকার শ্রণীও। এদের মধ্যে আবার সহিহ করে কুরআন পড়তে পারা লোকের সংখ্যা শতকরা দশ জন হবে কি না সন্দেহ আছে। সহিহ করে কুরআন পড়তে পারা শতকরা দশ জনের নয় জনই হবে সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোক (মাদ্রাসায় পড়া আলেম ও ছাত্র বাদে)। সমাজে যারা নিরক্ষর তারাই কৃষক, শ্রমিক  বা ব্যবসাসহ নানান কাজের সাথে সারা দিন ব্যস্ত থাকেন। অর্থসহ কুরআন পড়াতো দুরের কথা কেউ নিয়মিত তিলাওয়াত করতে পারে কিনা সন্দেহ। তাহলে সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোক (শিক্ষক, ছাত্র, চাকুরি জীবি), যারা রুটিন মত কাজ করে এবং নিয়মিত সালাতও আদায় করে তাদেরই একটা অংশ নিয়মিত তিলাওয়াত পাশাপাশি অর্থসহ কুরআন পড়ার বা বুঝার চেষ্টা করে। এই সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষগুলিই দেশ চালাচ্ছে, ডাক্তারি করছে, বড় বড় ইমারতের ডিজাইন দিচ্ছে, সফট ওয়ার বানাচ্ছে, নতুন নতুন আবিস্কার করছে। অথচ আল্লাহ প্রদত্ত সার্বজনিন আদেশ, নিষেধ, আইন কানুন, ইতিহাস সম্ভলিত গ্রন্থ পড়লে গোমড়া হবে।

অনেক বিধর্মীর আছে আরবি কি বুঝেনা। তাদের নিজের ভাষায় কু্রআন পড়েই ইসলাম গ্রহন করেছে। অনেক নন মুসলিম গবেষক, বিজ্ঞানি, ডাক্তার আছে, যারা শুধু ভুল ধরার জন্যই কুরআন নিয়ে গবেষণা করে নিজের ভুল বুঝতে পেরে মুসলিম হয়েছে। জ্ঞানী মুসলিম কি করে কু্রআন পড়ে গোমরা হবে?

তাহলে বুঝতে পারলাম বিষয় (কুরআন) আর শিক্ষার্থী (সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত ) দুটিই উপযুক্ত। সমাজে যে সকল আলেম এই রকম ফতোয়া দিবে তাদের কথায় কান দিবেন না। সময় সুযোগ হলে বুঝাতে চেষ্টা করবেন।

তবে কুরআনে এমন কিছু ব্যতিক্রমি আয়াত আছে যেগুলির সরল অনুবাদই মুখ্য নয়, বিশেষ অর্থ আছে। তাই কুরআন বুঝে পড়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে, তা না হলে ভুল ত্রুটি হয়ে যেতে পারে।  কখনো পাঠক বুঝে থাকতে পারেন এমন অর্থ যা বুঝানো কুরআনের উদ্ধেশ্য নয়। এমনটি সাহাবাগণের কারো কারো ক্ষেত্রে ঘটেছিল। যেমনঃ আল্লাহ তাআলা বলেন,

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ

অর্থঃ তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের উলামা ও দরবেশদেরকে নিজেদের খোদায় পরিণত করেছে৷ (সুরা তওবা- ৯:৩১)। হাদীসে বলা হয়েছে হযরত আদী ইবনে হাতেম নবী (সা) এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন খৃস্টান। ইসলাম গ্রহণ করার সময় তিনি নবী (সা) কে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন হচ্ছে, কুরআনের এ আয়াতটিতে (সুরা তওবা- ৯:৩১) আমাদের বিরুদ্ধে উলামা ও দরবেশদেরকে খোদা বানিয়ে নেবার যে দোষারূপ করা হয়েছে তার প্রকৃত তাৎপর্য কি৷ জবাবে তিনি বলেন, তারা যেগুলোকে হারাম বলতো তোমরা সেগুলোকে হারাম বলে মেনে নিতে এবং তারা যেগুলোকে হালাল বলতো তোমরা সেগুলোকে হালাল বলে মেনে নিতে, একথা কি সত্য নয়৷ জবাবে হযরত আদী বলেন , হাঁ, একথা তো ঠিক, আমরা অবশ্যি এমনটি করতাম। রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ব্যাস, এটিই তো হচ্ছে তোমাদে প্রভু বানিয়ে নেয়া। (আহম্মদ, তিরমিজ, তাফসিরে ইবনে কাসির)। 

আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন যার হিসাব নেয়া হবে তার আযাব হবে।’’ আমি বললাম, আল্লাহ কি বলেন নি,   ﴿فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَاباً يَسِيراً﴾  ‘‘অতঃপর অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব নিকাশ করা হবে।’’ (সূরা ইনশিকাক ৮৪:৮)। তিনি বললেন, ‘‘এটা সে হিসাব নয়, বরং এটা শুধু উপস্থাপন মাত্র। কিয়ামতের দিন যার হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নেয়া হবে, তার আযাব হবে।’’ (সহীহ বুখারী – ৪৫৫৮; , সহীহ মুসলিম – ৫১২২)।

 এখানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আয়েশা রা. হিসাবের সাধারণ ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছিলেন যা কম বেশী সব ধরনের হিসাবকে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট করে দিলেন যে, আয়াতে উল্লিখিত হিসাব মানে হল, মুমিন ব্যক্তির কাছে তার আমল উপস্থাপন, যাতে সে আল্লাহর সে অনুগ্রহ অনুধাবন করতে পারে যা তিনি দুনিয়ায় তার দোষ গোপন করার মাধ্যমে এবং আখিরাতে ক্ষমা করার মাধ্যম করেছিলেন। (হাফিয ইবন হাজার, ফাতহুল বারী – ৬০৫৬)।

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. বলেন, যখন অবতীর্ণ হল ﴿الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ﴾  ‘‘যারা ঈমান এনেছে এবং নিজেদের ঈমানকে যুলম দ্বারা মিশ্রিত করেনি।’’ আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে তার নিজের উপর যুলম করে নি? তিনি বললেন, ‘‘আয়াতটির ব্যাপারে তোমরা যা বলছ বিষয়টি তেমন নয়, বরং যুলম মানে এখানে শির্ক। তোমরা কি শোননি লুকমান তার ছেলেকে বলছিলেন,

 ﴿لا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ﴾ “হে বৎস, তুমি আল্লাহর সাথে শরীক করো না, নিশ্চয় শির্ক বড় যুলম।’’ (সূরা লুকমান ৩১:১৩)। সহীহ বুখারী – ৩১৭৫;  সহীহ মুসলিম -১৭৮)।

আমার জানা মতে আজ পর্যান্ত যতগুলি কুরআনের অনুবাদ ছাপা হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সাথে টিকা সংযোজিত আছে। যাতে এই ধরনের কোন আয়াতের জন্য পাঠককে দিধা দন্ধে পড়তে না হয়। কাজেই ভয়ের কিছু নেই। এই সমস্যা সমাধানর জন্য ভাল অনুবাদকের অনুবাদ (টিকাসহ) ক্রয় করা পড়তে থাকবেন।

সকল মানুষের চিন্তা, চেতনা, বুঝার ক্ষমা ও আকীদা এক নয়। সে অনুবাদের ভাবার্থ নিজের চিন্তা চেতনা ও আকীদার দ্বারা বিচার বিবেচনা করে আয়াতটি অর্থ তার অনুকুলে নিয়ে বুঝে তাকে। এবং পূর্ব থেকেই একটি বিষয় স্থির হয়ে আছে, যে কোন ভাবেই সে নিজের ধারণাটি কুরআনের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। এটাই শুধু অনুবাদ পড়ার ক্ষেত্র আসল ত্রুটি। কিন্তু শুধু এই কারনে সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত লোকটিকে কুরআন বুঝে পড়া থেকে দুরে রাখা যাবে না। তাকে সাজেশন করতে হবে। এই সকল ব্যপারে কোন ভাল মানের তাফসিরের (ইবনে কাসির) সাহা্য্য নিয়ে আসল অর্থ গ্রহন করা। আর তা সম্ভব না হলে, ভাল কোন আলেমের সাথে দেখা করে বিষয়টি জেনে নেওয়া। এই অজিহাতে কুরআন বুঝে পড়া থেকে দুরে থাকা কতটুকু যৌক্তিক।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)