জাকাত সংশ্লিষ্ট ভুলভ্রান্তি দ্বিতীয় কিস্তি

জাকাত সংশ্লিষ্ট ভুলভ্রান্তি দ্বিতীয় কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

৭। প্রাপ্য ঋনের উপর যাকাতঃ

কারো সম্পদ যদি ঋণ হিসেবে অন্যের কাছে থাকে, তবে ফিরিয়ে না পাওয়া পর্যন্ত তাতে যাকাত আবশ্যক নয়। কেননা তা তার হাতে নেই। কিন্তু ঋনগ্রস্ত ব্যক্তি যদি সম্পদশালী লোক হয়, তবে প্রতি বছর তাকে (ঋণদাতাকে) যাকাত বের করতে হবে। নিজের অন্যান্য সম্পদের সাথে তার যাকাত আদায় করে দিলে যিম্মামুক্ত হয়ে যাবে। অন্যথায় তা ফেরত পাওয়ার পর হিসেব করে বিগত প্রত্যেক বছরের যাকাত আদায় করতে হবে। কেননা তা সম্পদশালী লোকের হাতে ছিল। আর তা তলব করাও সম্ভব ছিল। সুতরাং ঋণদাতার ইচ্ছাতেই চাইতে দেরী করা হয়েছে। কিন্তু ঋণ যদি অভাবী লোকের হাতে থাকে। অথবা এমন ধনী লোকের হাতে যার নিকট থেকে উদ্ধার করা কষ্টকর, তবে তার উপর প্রতি বছর যাকাত আবশ্যক হবে না। কেননা তা হাতে পাওয়া তার জন্য অসম্ভব। কারণ আল্লাহ বলেন,

﴿وَإِن كَانَ ذُو عُسۡرَةٖ فَنَظِرَةٌ إِلَىٰ مَيۡسَرَةٖۚ﴾

“যদি অভাবী হয় তবে তাকে সচ্ছলতা পর্যন্ত অবকাশ দিবে। (সূরা আল-বাকারা ২:২৮০)

অতএব, তার জন্য সম্ভব নয়, সম্পদ পূণরুদ্ধার করা এবং তা দ্বারা উপকৃত হওয়া। কিন্তু পূণরুদ্ধার করতে পারলে বিদ্বানদের মধ্যে কেউ বলেন, তখন থেকে নতুন করে বছর গণনা শুরু করবে। আবার কেউ বলেন, বিগত এক বছরের যাকাত বের করবে এবং পরবর্তী বছর আসলে আবার যাকাত আদায় করবে। এটাই অত্যধিক সতর্ক অভিমত। (ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, প্রশ্ন নম্বর ৩৫৭) 

 

৮। প্লট বা ফ্লাটের যাকাতের বিধানঃ

বর্তমানে আমাদের সমাজের অনেকেই নিজের বসবাসের জন্য প্লট বা ফ্লাট ক্রয় করে থাকে। কেউ কেউ আবার একধীক প্লট বা ফ্লাটও ক্রয় করে থাকে। যদি তাদের নিয়ত হয়ে থাকে নিজেদের বসবাসের জন্য তবে তকে আর প্লট বা ফ্লাট যাকাত দিতে হবে না। এমন কি নিজে একটিতে থেকে অন্যটি ভাড়া দিলেও যাকাত দিতে হবে না। তখন অন্য ফ্লাটের ভাড়া থেকে যে আয় আসে তার উপর যাকাত দিতে হবে। কিন্তু যদি ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে প্লট বা ফ্লাট ক্রয় করা হয়, তাহলে প্রতিবছর প্লট বা ফ্লাটের বাজারমূল্য বিবেচনা করে যাকাত দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ—কেউ যদি পাঁচ লাখ টাকায় পাঁচটি প্লট ক্রয় করে, তারপর এক বছরের মাথায় ওই প্লটের বাজারমূল্য সাত লাখ টাকা হয়ে যায়, তাহলে তাকে সাত লাখ টাকার যাকাত দিতে হবে। কেউ কেউ মনে করে, প্লট বা ফ্লাট উপর কোন অবস্থায়ই যাকাত দিতে হবে না তাদের এই ধারনা মারাত্বক ভুল।

৯। ভাড়া বা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত গাড়ীতে যাকাতঃ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মুসলিমের উপর তার ঘোড়া ও গোলামের কোন যাকাত নেই। (সহিহ বুখারি ১৩৭৮ ইফাঃ, সহিহ মুসলিম ২১৪৫) নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত গাড়ীতে যাকাত নাই কারন সংসারিক অন্যান্য মালের মত অন্য গাড়িও নিয়মত ব্যবহার হয়। গাড়ি ক্রয় করে, অনেকে ভাড়ার কাজে গাড়ী ব্যবহার করে। এই কাজটি ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত আসবাব পত্রের মত, কাজেই এই গাড়ির মুল্যের উপর কোন যাকাত দিতে হবে না। তবে গাড়ির প্রাপ্ত ভাড়া যদি নিসাব পরিমাণ হয় বা তা অন্য অর্থের সাথে মিলিত করে তা নিসাব পরিমাণ পৌঁছে এবং এক বছর অতিক্রান্ত হয় তবে তাতে যাকাত দিতে হবে। অনুরূপভাবে ভাড়ায় ব্যবহৃত জমি বা ভূমিতে যাকাত নেই। তার প্রাপ্ত ভাড়া থেকে যাকাত দিতে হবে। (ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, প্রশ্ন নম্বর ৩৬৯) 

 

১০। প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর যাকাতের বিধানঃ

সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাধ্যতামূলকভাবে চাকরিজীবীর বেতনের যে অংশ কেটে রাখে তাকে প্রভিডেন্ট ফান্ড বলা হয়।  প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য বাধ্যতামূলক যে পরিমাণ টাকা কর্তন করে রাখা হয়, সে ইচ্ছা করে ঐ টাকা তুলতে পারবেনা। তাই কোন ভাবেই সে ঐ টাকার মালিক হবে না। টাকার মালিক না হওয়ার কারনে, যাকাত প্রদার তার উপর ওয়াজিব থাকে না। তাই সরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডে অর্থ থাকাকালে তার ওপর যাকাত দিতে হবে না। এ কারণে ওই ফান্ডের টাকা পাওয়ার পর বিগত বছরের যাকাতও দিতে হবে না। প্রভিডেন্ট ফান্ডে বাধ্যতামূলক অংশের অতিরিক্ত আরো টাকা নিজ থেকে কাটানো জায়েয নেই। কেউ কাটালে এ টাকার যাকাত দিনে হবে কারন এই টাকার মালিক সে নিজে। যেহেতু মালিক হিসাবে সে নিজ ইচ্ছায় নিজের টাকা জমা রেখেছে। তাই এই টাকার উপর তার যাকাত ওয়াজিব হবে। আবার যদি কেউ ঐ প্রভিডেন্ট ফান্ডের সঞ্চিত অর্থ অন্য কোনো ইনস্যুরেন্স কম্পানিতে স্থানান্তর করিয়ে নেয়, সে ক্ষেত্রে ওই অর্থ স্বতন্ত্রভাবে যাকাতযোগ্য মালের সঙ্গে যোগ হয়ে নিসাব পরিমাণ হলে যথানিয়মে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/২৬০)

১১। যাকাত দেওয়ার সময় কি বলে দিতে হবে?

সাধারণত যে সকল লোক যাকাত গ্রহণে অভ্যস্ত তাদেরকে যাকাত দেওয়ার সময় কোনো কিছু না বলাই উচিৎ। কেননা সেতো সময় সময় যাকাত নেয়, তাকে আর মনে করে দেয়ার অর্থ হলো, তার প্রতি দয়া প্রদর্শনের খোঁটা দেওয়া হয়। আল্লাহ বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُبۡطِلُواْ صَدَقَٰتِكُم بِٱلۡمَنِّ وَٱلۡأَذَىٰ﴾

“হে ঈমানদারগণ খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের সাদ্কা বা দানসমূহকে বিনষ্ট করে দিও না।” (সূরা আল-বাকারা ২:২৬৪)

নিকট আত্মীয় যারা যাকাত প্রাপ্ত শ্রেণীভুক্ত, তাদের জাকার প্রাপ্তির হক বেশী। এমনকি মাঝে মাঝে তাদের সাধারণ দানও করা হয়। তাদের যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে না বলাই ভাল, কারন তারা ভাববে আমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে অপমান করা হলো। কিন্তু সমাজের কিছু লোক আছে যারা সাধারণত যাকাতের টাকা গ্রহন করেন না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা যাকাত গ্রহনের মত হক দার হয়েছে। তাহলে যাকাত দেওয়ার সময় তাকে বলে দিতে হবে যে, এটা যাকাত। যাতে করে বিষয়টি তার নিকট সুস্পষ্ট হয়। ফলে সে ইচ্ছা হলে যাকাত গ্রহণ করবে ইচ্ছা হলে প্রত্যাখ্যান করবে।

১২। রমজান মাসে যাকাত আদায় নির্দষ্ট করাঃ

সাধারণত যারা যাকাত আদায় করে তাদের অধিকাংশই ব্যবসায়ি বা চাকুরিজীবি। তাদের মুলধন বা জমান টাকা প্রতি মাসেই বৃদ্ধিপায়। যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদ বা টাকা পূর্ণ বছর মালিকের অধিনে থাকত হয়। সেই হিবাবে প্রতি মাসেই কিছু না কিছু টাকার যাকাত ওয়াজিব হয়। কিন্তু এইভাবে প্রতি মাসের হিসাব রাখা খুবই একটি জটিল বিষয়। এক্ষেত্রে সুন্দর পন্থা হচ্ছে, প্রথম মাসের লাভের টাকা বা বেতন যদি এক বছর অতিবাহিত হয়, তবে তার সাথে সংশ্লিষ্ট করে সবগুলোর মাসের আয়ের যাকাত আদায় করে দিবে। যে মাসের আয়কে প্রথম ধরা হলো তার বছর পূর্ণ হলেও অন্য মাসের আয়ের কিন্তু বছর পূর্ণ হয় নাই। প্রথম মাসের যাকাত সময় মত হলেও অন্য মাসের যাকাত কিন্তু অগ্রীম প্রদান করা হবে। এই ভাবে যাকাত দিলে আর প্রতি মাসের আয় বা বেতন আলাদা হিসাব রাখার প্রয়োজন নেই। যাকাত প্রদানের জন্য রমাজান মাস নির্দিষ্ট নয়। বরং ওয়াজির হওয়ার সাথে সাথে যাকাত দিতে হবে। অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ সম্পদে বছর পূর্ণ হলেই যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। রামাযানের জন্য অপেক্ষা করবে না। যাকাতের নির্দিষ্ট সময় হিসাব রাখতে হয় কিন্তু দান সাদকার জন্য নির্ধারিত কোনো সময় নেই। বছরের প্রতিদিনই দান সদকার সময়। কিন্তু লোকেরা রামাযান মাসে দান সাদকা ও যাকাত প্রদান পছন্দ করে। কেননা সময়টি ফযীলত পূর্ণ। দান ও বদান্যতার সময়। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বাধিক দানশীল। রামাযান মাসে তিনি আরো বেশি দানশীল হতেন যা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমনিত। এই ফজিলত বিবেচনা করে অনেক রমজাম মাসকে আয়ের প্রথম মাস ধরে হিসাব করে যাকাত বের করেন। এবং প্রতি বছর রমাজান মাসে যাকাত প্রদান করে থাকে। এইভাবে যাকাত প্রদান করায় কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি কেউ শুধু রমাজান মাসকেই যাকাত আদায়ের মাস মনে করে আমল করে তবে বিদআত হবে। কারন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবী (রাঃ) বা আমাদের সালাফগনের কেউ রমজান মাসকে নির্দিষ্ট করেন নাই। ইসলামি বিধানের একটা হিকমা আছে। আমাদের জানা আবশ্যক যে, রামাজান মাসে যদি সবাই যাকাত প্রদান করে তবে অন্য মাসে গরীব মানুষ ভীষন অসুবিধায় পতিত হবে। ফজিলত অনেকাংশে মানুষের অসহায়তার উপর নির্ভর করে। যদি কোন ব্যক্তির অবস্থা খুবই অসহায় থাক, তবে সে সময়ই দান করা বা যাকাত প্রদান করা উত্তম। যেমন রামাযান ছাড়া অন্য সময় যদি ফকীর মিসকীনদের অভাব প্রকট আকার ধারণ করে বা দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা যায়, তবে সে সময় দান করার ছাওয়াব রামাজান মাসে দান করার চাইতে নিঃসন্দেহে বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফকীর মিসকীনদের অবস্থা রামাযান ছাড়া অন্যান্য মাসে বেশি শোচনীয় থাকে। রামাযান মাসে দান সাদকা বা যাকাতের ব্যাপকতার কারণে তারা সে সময় অনেকটা অভাবমুক্ত হয়। কিন্তু বছরের অবশিষ্ট সময়ে তারা প্রচণ্ড অভাব ও অনটনের মাঝে দিন কাটায়। সুতরাং বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য করা উচিৎ। তবে কেউ যদি নিছক রমাজান মাসেই যাকাত প্রদান করে তবে অসুবিধা হবে না।

শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) বলেন, “যদি শাবান মাসে যাকাত আদায়ের জন্য বছর পূর্ণ হয়, তবে শাবান মাসে যাকাত বের করে কয়েক দিন বিলম্ব করে রমজান মাসে আদায় করলে কোনো অসুবিধা নেই। ওয়াজিব হওয়ার পর বিলম্ব করা জায়েয নয়। অবশ্য কেউ যদি রামাজানে অগ্রীম যাকাত বের করে তবে তা জায়েয।

১৩। বছরের মাঝে সর্ব নিম্ম পরিমানকে যাকাত নির্ধারণ করাঃ 

কেউ কেউ বর্তমানে প্রচার করছে যে, যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে বছরের শুরু ও শেষ উভয় সময়ের মধ্যে সম্পদের যে পরিমাণ সর্বনিম্ন সে হিসাবে যাকাত ওয়াজিব হয়। অতএব যাকাতদাতাকে এই সর্বনিম্ন পরিমাণ সম্পদের যাকাত দিতে হবে। বছরের শেষে এই পরিমাণের চেয়ে সম্পদ বেশি থাকলেও। তাদের প্রচারিত মাসআলাটি সঠিক নয়। যাকাত নির্ধারিত হয় বছরের নির্দষ্ট সময়ের সাথে, বছরের সর্বনিম্ন পরিমাণ সম্পদের সাথে নয়। বছরের শুরুতে ও মাঝে সম্পদ কম থাকুক বা বেশি তা জানার দরকার নাই। বছরের যে নির্দষ্ট সময় যাকাত প্রদান করার কথা সেই সময়ের মোট সম্পদের উপর যাকাত দিতে হবে। যেমনঃ বছরের শুরুতে মুহাম্মাদ আলী সাহেবের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকার সম্পদ ছিল। বছরশেষে দেখা গেল, তার সম্পদের পরিমাণ পঞ্চান্ন হাজার টাকা। তাহলে এখন তাকে পঞ্চান্ন হাজার টাকার যাকাত আদায় করতে হবে। বছরের শুরু কিংবা শুরু-শেষের মাঝে সর্বনিম্ন পরিমাণের হিসাবে নয়।

১৪। যাকাত থেকে বাচতে সম্পদের মালিকানা হস্থান্তর করাঃ

সম্পদের যাকাত হতে হলে পূর্ণ এক বছর সম্পদে তার মালিকের নিকট থাকতে হবে। একজন ব্যক্তি নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক, তার উপর যাকাত ওয়াজিব। কিন্তু সে যাকাত থেকে বাচতে প্রতারণার আশ্রয় গ্রহন। তার সমস্ত সম্পদ এক বছর হওয়ার আগে তার স্ত্রীর বা অন্য কাউকে দান করে দেয় বা তার স্ত্রীর ব্যাংক একাউন্টের হস্তান্তর করে, যার ফলে সম্পদ তার নিকট এক বছর সময় থাকল না। আবার স্ত্রীর সম্পদ এক বছর হওয়ার আগে তার স্বামী বা অন্য কাউকে দান করে দেয় বা তার স্বামী ব্যাংক একাউন্টের হস্তান্তর করে, যার ফলে সম্পদ তার নিকটও এক বছর সময় থাকল না। এভাবে মহার আল্লহর সাথে প্রতারণা করে, যাকাত থেকে বেচে থেকে, যাকাত আদায় না করার চেয়েও বেশী অপরাধ। এখান দুটি অপরাধ। প্রথমটি হলো, মহার আল্লহর সাথে প্রতারণা করা। আর দ্বিতীয়টি হলো, যাকাতের নিসাব হওয়া পরও আদায় না করা। আল্লাহ আমাদের এই রকম প্রতারণা করা থেকে হিফাজাত করুন।

১৫। যাকাত থেকে বাচতে নাবালেগ সন্তানকে সম্পদ দানঃ

চার ইমামের মতে যাকাত ওয়াজিব হবার জন্য বালেগ হওয়া, বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া ও সামর্থ্য থাকা জরুরী। সুতরাং শিশু ও পাগলের সম্পদে যাকাত ওয়াজিব হবে না। কারণ হাদীসে বলা হয়েছে,“তিন ব্যক্তির জন্য কোন দায়িত্ব-কর্তব্য নেই।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা যেনার অপরাধে জনৈকা উম্মাদিনীকে ধরে এনে উমার (রাঃ)-এর নিকট হাযির করা হয়। তিনি এ ব্যাপারে লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে পাথর মেরে হত্যা করার নির্দেশ দেন। এ সময় আলী (রাঃ) তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন এর কি হয়েছে? উপস্থিত লোকেরা বললো, সে অমুক গোত্রের উম্মাদিনী (পাগল মহিলা), সে যেনা করেছে। উমার (রাঃ) তাকে পাথর মেরে হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি বললেন, তোমরা তাকে নিয়ে ফিরে যাও। অতঃপর তিনি উমারের নিকট এসে বললে, হে আমীরুল মু‘মিনীন! আপনি কি জানেন না, তিন ধরণের লোকের উপর থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছেঃ (১) পাগল, যতক্ষণ না সুস্থ হয়, (২) নিদ্রিত ব্যক্তি, যতক্ষণ না জাগ্রত হয় এবং (৩) নাবালেগ শিশু, যতক্ষণ না বালেগ হবে। তিনি বললেন, হ্যাঁ। আলী (রাঃ) বলেন, তাহলে তাকে পাথর মারা হবে কেন? তিনি বলেন, কোনো কারণ নেই। আলী (রাঃ) বলেন, তবে তাকে ছেড়ে দিন। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি তাকে ছেড়ে দিলেন এবং ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চারণ করলেন। (সুনানে আবু দাউদ ৪৩৯৯ তাহকীক কৃত, হাদিসের মান সহিহ)

ইমামদের মতে সমর্থ বা সক্ষম হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে তার নিজ ও পরিবার-পরিজনের সাংবৎসরিক প্রয়োজন পূরণের পরিমাণ ধন-সম্পদের মালিক অথবা কাজের মাধ্যমে বা কোন শিল্পকর্মের মাধ্যমে তার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়। এই সুযোগে কোনো কোনো মানুষ সম্পর্কে শোনা যায়, তারা যাকাত থেকে বাঁচার জন্য না-বালেগ সন্তানদেরকে সম্পদের মালিক বানিয়ে দেয়। এটি একটি গর্হিত আমল ও কঠিন কবীরা গুনাহ।

যাকাত ইসলামের অন্যতম প্রধান রোকন। যাকাত সম্পদের হক। কারো কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকার পরও যাকাত আদায় না করা বা আদায় না করার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নেয়া মারাত্বক নিন্দনীয় ও অত্যন্ত গর্হিত কাজ। শরীয়তের দৃষ্টিতে তা সম্পূর্ণ নাজায়েয এবং আল্লাহকে ধোঁকা দেয়ার শামিল।

সম্পদ আল্লাহ তাআলার দান। পৃথিবীতে কেউই সম্পদ নিয়ে আসে না; আল্লাহ দান করেন। সুতরাং আল্লাহর দেয়া সম্পদ আল্লাহর হুকুম আদায়ে ব্যয় করতে কার্পণ্য করা উচিত নয়। মুমিন আল্লাহর দেয়া সম্পদ থেকে আল্লাহর হুকুমে ব্যয় করতে কার্পণ্য করে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَلاَ يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللّهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُواْ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاللّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

অর্থঃ আল্লাহ তাদেরকে নিজের অনুগ্রহে যা দান করেছেন তাতে যারা কৃপণতা করে এই কার্পন্য তাদের জন্য মঙ্গলকর হবে বলে তারা যেন ধারণা না করে। বরং এটা তাদের পক্ষে একান্তই ক্ষতিকর প্রতিপন্ন হবে। যাতে তারা কার্পন্য করে সে সমস্ত ধন-সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ী বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেন আসমান ও যমীনের পরম সত্ত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা কর; আল্লাহ সে সম্পর্কে জানেন। ( সুরা ইমরান ৩:১৮০)

সুতরাং আমরা যাকাত আদায়ে অবহেলা করব না বা যাকাত থেকে বাঁচার জন্য কোন প্রকারের প্রতারণার আশ্রয় নিব না। যাকাত থেকে বাচার জন্য নয়, অন্য যে কো কারনে সন্তানকে সম্পদের মালিক বানান যায়।  তবে মনে রাখাতে মহান আল্লাহ নিকট প্রতারণ করে বাচা যাবে না, তিনি মনের খবরও জানেন। তাই যাকাতের ভয়ে সন্তানকে নামেমাত্র মালিক বানালেও যাকাত মাফ হবে না। আল্লাহু আলাম

১৬। যাকাতের হিসাব যথাযথভাবে না করাঃ

অজ্ঞতার কারনে অনেক যাকাতের হিসাব যথাযথভাবে করে না। সকলে জানেন যাকাতের জন্য সম্পদ এর বছর অতিক্রান্ত হতে হবে। তাদের ধারনা, প্রতিটি টাকায় এক বছর অতিক্রান্ত হলেই, সে টাকার যাকাত দেয়া যাবে। এটা জরুরী নয়। যে দিন যাকাতবর্ষ পূর্ণ হবে সে দিনের সকল সম্পদ হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে। এমনকি একদিন আগে যে টাকা হাতে এসেছে এরও যাকাত দিতে পারেন। তার জন্য সারা বছর আর অপেক্ষা করতে হবে না। তা হলেতো প্রতি মাসেই যাকাতের টাকা হিসাব করে দিতে হবে।

অনেক আবার ইংরেজী বছর হিসাব করে যাকাত প্রদান করে থাকেন। তাদের এই হিসাব ভুল যাকাতের হিসাব করতে হবে চন্দ্রবর্ষ অনুাযয়ী। প্রতি বছর চন্দ্রবর্ষ দশ দিন করে এগিয়ে আসে। তিন বছর পর এক মাস এগিয়ে আসে তাই যাকাত চন্দ্র বর্ষ অনুাযয়ী না দিলে প্রতি ৩৬ বছরে এক বছর বাদ পড়ে যাবে। অনেক ইংরেজী বছর হিসাব করে যাকাত প্রদান করে থাকেন, যা নিতান্তই ভুল। করণীয় হল, চিন্তা ভাবনা করে, হিসাব করে, চন্দ্রবর্ষ অনুাযয়ী যাকাত বর্ষ ঠিক করা।

অনেক যাকাতের হিসাব যথাযথভাবে না করে অনুমান ভিত্তিক করে থাকেন। অনুমান ভিক্তিক যাকাতের হিসাব কখই ঠিক হবে না। কম বেশী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই তার যাকাতও যথাযথ আদায় হবে না। কাজেই উপরের বর্ণিত চার প্রকারের সম্তদের সঠিক হিসাব করে যাকাতের পরিমান নির্ধারন করে আদায় করতে হবে। হিসাবে কম বেশী করা কবিরা গুনাহ। নামায যেমন অনুমান করে পড়া যায় না। তেমনি যাকাতও অনুমান করে আদায় করা যায় না। এতে যাকাত অনাদায়ী থেকে যেতে পারে। তাই যথাযথ হিসাব করে যাকাত আদায় করা জরুরী। নিজে না জানলে বা না বুঝলে নিকটবর্তী আলেমদের সাথে কথা বলে সঠিক হিসাব নিশ্চিত করুন। সার কথা যাকাতের হিসাবে কোন প্রকার গোজামিল দেয়া যাবে না। আপনার যাকাতের হিসেব হবে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও সঠিক।

১৭। যাকাতকে ট্যাক্স মনে করাঃ

অনেক মুসলিম ভাই এতই অজ্ঞ যে যাকাতকে ট্যাক্স মনে করে থাকে। যাকাতকে ট্যাক্স মনে করা সম্পূর্ণ মূর্খতা। যাকাতের সাথে ট্যাক্সের বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। এ দুটির মাঝে বিশাল পার্থক্য আছে। যাকাত হলো মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিধান, যা আদায় করা একটি ফরজ ইবাদাত। ট্যাক্স হল রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত কর, যা জনগনের কাছ থেকে রাষ্ট্র আদায় করে বিনিময়ে রাষ্ট্র জনগনের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকত্সা, বাসস্থান, নিরাপত্তা ইত্যাদির দিয়ে থাকে।

যাকাতের প্রদানের খাত ফকীর, মিসকীন, অসহায়দের, অথচ ট্যাক্সের সুবিধা ভোগ করে সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গদের। এ দুটির মাঝে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। যাকাতের মাধ্যমে আখলাকের পরিশুদ্ধি ও সম্পদের পবিত্রতা অর্জন করা উদ্দেশ্য হয়। সমাজের মধ্যে ধনী গরীদের ব্যবধান কমতে থাকে, এর সাথে ট্যাক্সের কোন মিল নেই। ট্যাক্স আসে ইনকামের উপর (ইনকাম ট্যাক্স)। অথচ যাকাত আসে যাকাতযোগ্য সকল সম্পদের উপর। একজন সম্পদশালী ব্যক্তি যদি হাজার কোটি টাকার মালিক হয় কিন্তু তার চলতি বছর কোন ইনকাম না হয়, তবে কোন ট্যাক্স দিতে হবে না। পক্ষান্তরে যাকাত হবে তার মোট সম্পদের উপর চলতি বছর কোন আয় নাই, কিন্তু তিনি নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক তবে তাকে যাকাত দিতে হবে।

 যদি কোন ব্যক্তি তায় দায়বদ্ধতা থেকে রাষ্ট্রের অনুকুলে ট্যাক্স প্রদান করে, তবে তার যাকাত আদায় হবে না। তাকে আলাদভাবে সম্পদের হিসাব করে যাকাত দিতে হবে। তাই যারা নিয়মিত ট্যাক্স দেন, তাদের উচিত নিয়মিত আল্লাহ প্রদত্ত বিধান মেনে ইবাদতে নিয়তে নিয়মিত যাকাত প্রদান করা।  অনেক শিক্ষিত কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ লোককে যাকাতের কথা বললে পাল্টা প্রশ্ন করে সরকারকে ট্যাক্সতো দিয়েছি আবার যাকাত কিসের?

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment