আল্লাহ তা’য়ালা আটটি কারনে বিপদ দেন

১। মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যঃ

মহান আল্লাহ আমাদের সবল পরীক্ষার জন্য বিপদ প্রদান করেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ

**أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُواْ الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللّهُ الَّذِينَ جَاهَدُواْ مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ*
অর্থঃ তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জেহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্য্যশীল। [ সুরা ইমরান ৩:১৪২ ]

মন্তব্যঃ কার মাঝে কতটা সবর আছে তাও পরীক্ষা করা হবে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ

فَإِذَا مَسَّ الْإِنسَانَ ضُرٌّ دَعَانَا ثُمَّ إِذَا خَوَّلْنَاهُ نِعْمَةً مِّنَّا قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ بَلْ هِيَ فِتْنَةٌ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
অর্থঃ মানুষকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে আমাকে ডাকতে শুরু করে, এরপর আমি যখন তাকে আমার পক্ষ থেকে নেয়ামত দান করি, তখন সে বলে, এটা তো আমি পূর্বের জানা মতেই প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না। [ সুরা যুমার ৩৯:৪৯ ]

আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘মু’মিন পুরুষ ও নারীর জান, সন্তান-সন্ততি ও তার ধনে (বিপদ-আপদ দ্বারা) পরীক্ষা হতে থাকে, পরিশেষে সে আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে নিষ্পাপ হয়ে সাক্ষাৎ করবে।’’ (তিরমিযী, হাসান সহীহ) তিরমিযী ২৩৯৯, আহমাদ ৭৭৯৯, ২৭২১৯)।

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’মুমিনের দৃষ্টান্ত হল এক শস্যক্ষেতের নরম চারাগাছের মতো। শস্যক্ষেতকে যেভাবে বাতাস সবসময় ঝুকিয়ে রাখে, ঠিক এভাবে মুমিনকে বিপদ-আপদ দোলায়, বালা-মুসীবত ঘিরে থাকে। আর ফাসিকের দৃষ্টান্ত হল, শক্ত ভুমির উপর শক্তভাবে সোজা হয়ে দাঁড়ানো গাছের মতো। যাকে আল্লাহ যখন ইচ্ছা ভেঙ্গে দেন। (বুখারী ৫৬৪৪, ৭৪৬৬; মুসলিম ৬৯৮৫-(৫৮/২৮০৯); তিরমিযি ২৮৬৬; মিশকাতুল মাসাবীহ ১৫৪২)।

২। মর্জাদা বৃদ্ধির জন্যঃ

বিপদ প্রদানের মাধ্যমে মু’মিনের মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। এছাড়া আল্লাহ তাঁর কিছু প্রিয় বান্দাকে পরীক্ষায় ফেলেন, যাতে করে পরকালে তার মর্যাদা ও জান্নাতের নেয়ামত বৃদ্ধি করেন। অনেক সময় আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে যে মর্যাদা দিতে চান তা ঐ বান্দা তার আমল দ্বারা অর্জন করার মতো হয়না। তখন আল্লাহ তাকে পরীক্ষায় ফেলেন, যদি সে এতে ধৈর্যধারণ করে তাহলে আল্লাহ তাকে ঐ মর্যাদায় উন্নীত করেন। এই প্রকারের বিপদ দ্বারা আল্লাহ তার নবী রাসূলদের পরীক্ষা করেছেন। যেমনঃ
ইয়াকুব আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সন্তান ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হারিয়ে যখন শোকে বিহ্বল, তখনও তিনি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ মতোই ধৈর্যের শরণাপন্ন হন। মহান আল্লাহ বলেনঃ

**وَجَآؤُوا عَلَى قَمِيصِهِ بِدَمٍ كَذِبٍ قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ أَنفُسُكُمْ أَمْرًا فَصَبْرٌ جَمِيلٌ وَاللّهُ الْمُسْتَعَانُ عَلَى مَا تَصِفُونَ*
অর্থঃ এবং তারা তার জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে আনল। বললেনঃ এটা কখনই নয়; বরং তোমাদের মন তোমাদেরকে একটা কথা সাজিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এখন ছবর করাই শ্রেয়। তোমরা যা বর্ণনা করছ, সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্য স্থল। [ সুরা ইউসুফ ১২:১৮ ]।
ইয়াকুব আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চরম বিপদে চরমভাবে সবর করে আল্লাহর রহমতে পরীক্ষায় পাশ করলেন আর আল্লাহ তাহার মর্জাদা বাড়িয়ে দিলেন। দুনিয়ার জীবনে দেখি কোন ছাত্র ক্লাসের কোন পরীক্ষায় পাশ করলে তাকে পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশন প্রদান করা হয়। ঠিক তেমনি ভাবে মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিপদে সবর করলে মুমিনের মর্জাদা বৃদ্ধি হবে এটাই যৌক্তিক।

৩। হিদায়েত প্রদানের জন্যঃ

আখেরাতে শাস্তি খুবই ভয়াবহ। এই শাস্তি থেকে আল্লাহ তার বান্দাকে বাচাতে দুনিয়াতে সামান্য শাস্তি প্রদান করে থাকেন যাতে সে দ্বীনের দিকে ফিরে আসে এবং সঠিক দ্বীনের বুঝ পেয়ে যায়।

মহান আল্লাহ বলেন,
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
অর্থঃ স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে। [ সুরা রূম ৩০:৪১ ]

মহান আল্লাহ আরও বলেন,
**وَلَقَدْ أَرْسَلنَا إِلَى أُمَمٍ مِّن قَبْلِكَ فَأَخَذْنَاهُمْ بِالْبَأْسَاء وَالضَّرَّاء لَعَلَّهُمْ يَتَضَرَّعُونَ
আর আমি আপনার পূর্ববর্তী উম্মতদের প্রতিও পয়গম্বর প্রেরণ করেছিলাম। অতঃপর আমি তাদেরকে অভাব-অনটন ও রোগ-ব্যধি দ্বারা পাকড়াও করেছিলাম যাতে তারা কাকুতি মিনতি করে। [ সুরা আন’য়াম ৬:৪২ ]

মন্তব্যঃ মুমিন বান্দা যখন আল্লাহকে ভুলে বিপথে চলতে শুরু করে। তখন আল্লাহ তাকে বিপদ প্রদান করে ফলে সে বিপদ থেকে পরিত্রানের আশায় মহান আল্লাহর ইবাদতে লেগে যায়। এভাবেই বিপদে পতিত মুমিন হিদায়াতের নুর দেখে পথ চলতে চলতে হিদায়েতে আসল ঠিকানায় পৌছে যায়।

৪। গুনাহ মাপের জন্যঃ

মহান আল্লাহ বিপদ প্রদানের মাধ্যমে মু’মিনের গুনাহ ক্ষমা করা হয়। কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত মুমিমের বিপদ আসে তার গুনাহ মাপের জন্য। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ
অর্থঃ তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন। [ সুরা শূরা ৪২:৩০ ]

১। আবু মুসা আল আশ’আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’বড় হোক কিংবা ছোট হোক, বান্দা যেসব দুঃখ কষ্ট পায়, নিশ্চয়ই তা তার অপরাধের কারনে। তবে আল্লাহ যা ক্ষমা করে দেন তা এর চেয়েও অনেক বেশী। অতঃপর তিলাওয়াত করলেন, (وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ) ‘তোমাদের উপর যেসব বিপদ-আপদ নিপতিত হয়, তা তোমাদের কর্মফলের কারনে, আর আল্লাহ ক্ষমা করে দেন অনেক অনেক বেশী’ (শুরা ৪২/৩০)’’ তিরমিযি; মিশকাতুল মাসাবীহ ১৫৫৮ (আলবানি সহীহ বলেছেন)।

২। আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘’মুসলিম ব্যক্তির উপর যে সকল বিপদাপদ আসে এর দ্বারা আল্লাহ তার পাপ দূর করে দেন। এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে ফুটে এর দ্বারাও’’। (বুখারী- ৫৬৪০; মুসলিম-৬৪৫৫)।

৩। আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘’কোনো ঈমানদার ব্যক্তির দেহে একটি কাঁটা বিদ্ধ হলে কিংবা তার চেয়ে অধিক ক্ষুদ্র কোনো মুসীবত আপতিত হলে তার পরিবর্তে আল্লাহ তায়ালা তার একটি গুনাহ মাফ করে দেন। (মুসলিম ৬৪৫৭, ৬৪৫৯, ৬৪৬০)।

৪। আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন এই আয়াত (يَعْمَلْ سُوءًا يُجْزَ بِهِ) ‘যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করে, তার প্রতিফল সে ভোগ করবে’ (নিসা ৪:১২৩)। অবতীর্ণ হল তখন কতিপয় মুসলিম ভয়ানক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ ‘’তোমরা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো এবং সঠিক পন্থা গ্রহন করো। একজন মুসলিম তার প্রত্যেকটি বিপদের পরিবর্তে এমনকি সে আছাড় খেলে কিংবা তার শরীরে কোনো কাঁটা বিদ্ধ হলেও তাতে তার গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। (মুসলিম ৬৪৬৩)।

৫। আবূ সাঈদ (রাঃ) ও আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মুসলিমকে যে কোন ক্লান্তি, অসুখ, চিন্তা, শোক এমন কি (তার পায়ে) কাঁটাও লাগে, আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে তার গোনাহ সমূহ ক্ষমা ক’রে দেন।’’ (বুখারী ৫৬৪১-৫৬৪২, মুসলিম ৬৭৩৩)।

৬। ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খিদমতে উপস্থিত হলাম। সে সময় তিনি জ্বরে ভুগছিলেন। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার যে প্রচণ্ড জ্বর!’ তিনি বললেন, ‘‘হ্যাঁ! তোমাদের দু’জনের সমান আমার জ্বর আসে।’’ আমি বললাম, ‘তার জন্যই কি আপনার পুরস্কারও দ্বিগুণ?’ তিনি বললেন, ‘‘হ্যাঁ! ব্যাপার তা-ই। (অনুরূপ) যে কোন মুসলিমকে কোন কষ্ট পৌঁছে, কাঁটা লাগে অথবা তার চেয়েও কঠিন কষ্ট হয়, আল্লাহ তা‘আলা এর কারণে তার পাপসমূহকে মোচন করে দেন এবং তার পাপসমূহকে এভাবে ঝরিয়ে দেওয়া হয়; যেভাবে গাছ তার পাতা ঝরিয়ে দেয়। (সহীহুল বুখারী ৫৬৪৮, ৫৬৪৭, ৫৬৬০, ৫৬৬১, ৫৬৬৭ মুসলিম ২৫৭১, আহমাদ ৩৬১১, ৪১৯৩, ৪৩৩৩, দারেমী ২৭৭১; রিয়াযুস স্বালেহীন ১১/৩৬)।

০৫। মঙ্গল বা ভাল করার জন্যঃ

আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকে দুঃখ-কষ্টে ফেলেন।’’ (সহীহুল বুখারী ৫৬৪৫, আহমাদ ৭১৯৪, মুওয়াত্তা মালেক ১৭৫২; রিয়াযুস স্বালেহীন ১১/৩৬)।

আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যখন আল্লাহ তাঁর বান্দার মঙ্গল চান, তখন তিনি তাকে তাড়াতাড়ি দুনিয়াতে (পাপের) শাস্তি দিয়ে দেন। আর যখন আল্লাহ তাঁর বান্দার অমঙ্গল চান, তখন তিনি তাকে (শাস্তিদানে) বিরত থাকেন। পরিশেষে কিয়ামতের দিন তাকে পুরোপুরি শাস্তি দেবেন।’’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘‘বড় পরীক্ষার বড় প্রতিদান রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা যখন কোনো জাতিকে ভালবাসেন, তখন তার পরীক্ষা নেন। ফলে তাতে যে সন্তুষ্ট (ধৈর্য) প্রকাশ করবে, তার জন্য (আল্লাহর) সন্তুষ্টি রয়েছে। আর যে (আল্লাহর পরীক্ষায়) অসন্তুষ্ট হবে, তার জন্য রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি’। ( মুসলিম ২৩৯৬, ইবনু মাজাহ ৪০৩;রিয়াযুস স্বালেহীন ১১৯/৪৪)।

মুহাম্মাদ ইবন খালিদ (রহঃ) হতে তাঁর পিতা ও দাদার সুত্রে বর্ণিত। তিনি (দাদা) রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাহচর্য লাভ করেছেন। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ ‘’কোনো ব্যক্তির জন্য বিনাশ্রমে আল্লাহর পক্ষ হতে মর্যাদার আসন নির্ধারিত হলে আল্লাহ তাঁর দেহ, সম্পদ অথবা সন্তানকে বিপদ্গ্রস্ত করেন। অতঃপর সে তাতে ধৈর্য ধারন ধারন করলে শেষ পর্যন্ত বরকতময় মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত উক্ত মর্যাদার স্তরে উপনীত হয়’’ আবু দাউদ ৩০৯০ (আলবানি সহীহ বলেছেন)

৬। দুনিয়াতেই সামান্য শাস্তি দিয়ে আখেরাতের শাস্তি মাপ করে দেওয়ার জন্যঃ

দুনিয়াতে পাপের শাস্তি সাধারনত আল্লাহ প্রদান করেন না। কারন মানুষকে তার পাপের পরিপূর্ন শাস্তি আখেরাত কিয়ামতের ময়দানে সবার সামনে প্রদান করবেন। কিছু বান্দাকে তাদের আমলের জন্য মহান আল্লাহ ভালবাসেন, তাদের দ্বারা যখন কোন পাপাচার সংঘটিত হয় তখন তাদের গুনাহর কারনে দুয়াবি কিছু শাস্তি প্রদার করে আখেরাতে পুরস্কারের ব্যাবস্থা করবেন। তবে শর্থ হল এই দুনাবি সামান্য শাস্তিকে মেনে নিয়ে সবর করতে হবে। হা-হুতাস, কান্না-কাটি, না শুকরিয়া, হতাশা ইত্যাদি প্রকাশ করলে নেকির পরিবর্তে গুনাহ হবে। দুনিয়ার এই সামান্য শাস্তি প্রদানের কথা মহান আল্লাহ কুরআনে এরশাদ করেন। তিনি বলেন,

মহান আল্লাহ বলেন,
**وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُونَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ*
অর্থঃ গুরু শাস্তির পূর্বে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে। [ সুরা সাজদা ৩২:২১ ]

মন্তব্যঃ এই আয়াতে “হালকা শাস্তি” দ্বারা পার্থিব জীবনের বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, রোগ-শোক ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া সুনানে নাসায়ীতে রয়েছে, হালকা শাস্তির অর্থ হলো দুর্ভিক্ষ। [তাফসীর ইবনে কাসীর থেকে নেওয়া]

বান্দার কৃতকর্মের শাস্তি হিসাবে কখনও তার উপর বিপদ নিপতিত হয় যেন তারা আল্লাহ্‌র দিকে ফিরে আসে।

৭। আল্লাহ কোনো বান্দার কল্যাণ চাইলে তাকে দুনিয়াতে বিপদগ্রস্ত করেনঃ

যদি কোন মুমিকে প্রশ্ন করা হয় সত্যিকারের কৃতকার্য ব্যাক্তি কে? সে বললে মহান আল্লাহ যার প্রতি পরকালে কিয়ামতের ময়দানে সন্ত্বষ্ট থাকবে, সেই প্রকৃত কৃতকার্য ব্যাক্তি। যাকে আল্লাহ বেশী ভাল বাসের তাকে বিপদ দিয়ে সবর করার তৌফিক দান করেন। কারন বিপদে সবরের প্রতিদান আখেরাতে প্রদান করা হবে যার ফল স্থায়ী। এখানে বলা হয়ে থাকে, দুনিয়াতে বিপদগ্রস্ত ছিল এমন মুমিন ব্যক্তিদেরকে আখেরাতে মহান আল্লাহ তায়ালা বিশাল নেয়ামত দান করবেন, যা দেখে দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগকারী মানুষেরা আফসোস করতে থাকবে।

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘’আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে বিপদগ্রস্ত করেন’’। (বুখারী ৫৬৪৫; মিশকাতুল মাসাবীহ ১৫৩৬; রিয়াদুস সালিহীন ৪০)

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘’আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো বান্দার কল্যাণ করতে ইচ্ছা করেন, তখন তাড়াতাড়ি দুনিয়াতে তাকে বিপদে নিক্ষেপ করেন। আর যখন তিনি কোনো বান্দার অকল্যাণ করতে ইচ্ছা করেন, তখন তাকে (দুনিয়াতে) তার পাপের শাস্তি প্রদান করা হতে বিরত থাকেন। তারপর কিয়ামতের দিন তিনি তাকে পুরোপুরি শাস্তি দিবেন’’। (তিরমিযি ২৩৯৬; মিশকাতুল মাসাবীহ ১৫৬৫, আলবানি সহীহ বলেছেন)।

৮। দুনিয়াতে কোন জাতীকে সমূলে ধংশের জন্যঃ

যুগে যুগে মানুষের হিদায়েতের জন্য মহান আল্লাহ নবী রাসূলদের পাঠিয়েছেন। কিন্তু যখন সেই জাতীর লোকজন নবী রাসূলদের অনুসরণের পরিবর্তে তাদের সাথে খারাপ আচরন এবং অত্যাচার করছে। তাদের এই খারাপ আচরনের শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ তাদের দুনিয়া থেকে ধ্বংশ করার জন্য গজব নাজিল করেছেন। এবং মহান আল্লাহ সেই জাতীকে সমূলে ধ্বংশ করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আরাফের ৯০ থেকে ৯৬ আয়াতটির অর্থের প্রতি একটু নজর দেই। মহান আল্লাহ আরও বলেনঃ

وَقَالَ ٱلۡمَلَأُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِن قَوۡمِهِۦ لَٮِٕنِ ٱتَّبَعۡتُمۡ شُعَيۡبًا إِنَّكُمۡ إِذً۬ا لَّخَـٰسِرُونَ ( ٩٠ ) فَأَخَذَتۡہُمُ ٱلرَّجۡفَةُ فَأَصۡبَحُواْ فِى دَارِهِمۡ جَـٰثِمِينَ ( ٩١ ) ٱلَّذِينَ كَذَّبُواْ شُعَيۡبً۬ا كَأَن لَّمۡ يَغۡنَوۡاْ فِيهَا‌ۚ ٱلَّذِينَ كَذَّبُواْ شُعَيۡبً۬ا كَانُواْ هُمُ ٱلۡخَـٰسِرِينَ ( ٩٢ ) فَتَوَلَّىٰ عَنۡهُمۡ وَقَالَ يَـٰقَوۡمِ لَقَدۡ أَبۡلَغۡتُڪُمۡ رِسَـٰلَـٰتِ رَبِّى وَنَصَحۡتُ لَكُمۡ‌ۖ فَكَيۡفَ ءَاسَىٰ عَلَىٰ قَوۡمٍ۬ كَـٰفِرِينَ ( ٩٣ ) وَمَآ أَرۡسَلۡنَا فِى قَرۡيَةٍ۬ مِّن نَّبِىٍّ إِلَّآ أَخَذۡنَآ أَهۡلَهَا بِٱلۡبَأۡسَآءِ وَٱلضَّرَّآءِ لَعَلَّهُمۡ يَضَّرَّعُونَ ( ٩٤ )ثُمَّ بَدَّلۡنَا مَكَانَ ٱلسَّيِّئَةِ ٱلۡحَسَنَةَ حَتَّىٰ عَفَواْ وَّقَالُواْ قَدۡ مَسَّ ءَابَآءَنَا ٱلضَّرَّآءُ وَٱلسَّرَّآءُ فَأَخَذۡنَـٰهُم بَغۡتَةً۬ وَهُمۡ لَا يَشۡعُرُونَ ( ٩٥ ) وَلَوۡ أَنَّ أَهۡلَ ٱلۡقُرَىٰٓ ءَامَنُواْ وَٱتَّقَوۡاْ لَفَتَحۡنَا عَلَيۡہِم بَرَكَـٰتٍ۬ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ وَلَـٰكِن كَذَّبُواْ فَأَخَذۡنَـٰهُم بِمَا ڪَانُواْ يَكۡسِبُونَ ( ٩٦ )
অর্থঃ তার সম্প্রদায়ের কাফের সর্দাররা বললঃ যদি তোমরা শোয়ায়েবের অনুসরণ কর, তবে নিশ্চিতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনন্তর পাকড়াও করল তাদেরকে ভূমিকম্প। ফলে তারা সকাল বেলায় গৃহ মধ্যে উপুড় হয়ে পড়ে রইল। শোয়ায়েবের প্রতি মিথ্যারোপকারীরা যেন কোন দিন সেখানে বসবাসই করেনি। যারা শোয়ায়েবের প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল, তারাই ক্ষতিগ্রস্থ হল। অনন্তর সে তাদের কাছ থেকে প্রস্থান করল এবং বললঃ হে আমার সম্প্রদায়, আমি তোমাদেরকে প্রতিপালকের পয়গাম পৌছে দিয়েছি এবং তোমাদের হিত কামনা করেছি। এখন আমি কাফেরদের জন্যে কেন দুঃখ করব। আর আমি কোন জনপদে কোন নবী পাঠাইনি, তবে (এমতাবস্থায়) যে পাকড়াও করেছি, সে জনপদের অধিবাসীদিগকে কষ্ট ও কঠোরতার মধ্যে, যাতে তারা শিথিল হয়ে পড়ে। অতঃপর অকল্যাণের স্থলে তা কল্যাণে বদলে দিয়েছে। এমনকি তারা অনেক বেড়ে গিয়েছি এবং বলতে শুরু করেছে, আমাদের বাপ-দাদাদের উপরও এমন আনন্দ-বেদনা এসেছে। অতঃপর আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি এমন আকস্মিকভাবে যে তারা টেরও পায়নি। আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেযগারী অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানী ও পার্থিব নেয়ামত সমূহ উম্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের বদলাতে। [ সুরা আরাফ ৭:৯০-৯৬ ]

মন্তব্যঃ এরূপভাবে মহান আল্লাহ কওমে আদ, কওমে সামুদ, কওমে হুদ, কওমে লুদ, কওমে নুহ, বনী ঈসরাইল-সহ অনেক জাতীকে ধ্বংশের ইতিহাস বর্নণা করেছে।

আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলেনঃ হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও। যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকেদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। যখন কোন জাতি ওজন ও পরিমাপে কারচুপি করে তখন তাদের উপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, কঠিন বিপদ-মুসীবত এবং যাকাত আদায় করে না তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠি চতুস্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকতো তাহলে আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না। যখন কোন জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাশীন করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ সবকিছু কেড়ে নেয়। যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা করে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে গ্রহণ করে না, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেন। [ইবনে মাজাহ হাদিস ৪০১৯’ হাদিসটি ইমাম ইবনু মাজাহ এককভাবে বর্ণনা করেছেন। সহীহাহ। তাহকীক আলবানীঃ হাসান]।

বিপদে করনীয়ঃ

১। আল্লাহ আদেশের কথা মনে করে দুনিয়ারকে তুচ্ছ আর আখিরাতকে সত্য ও স্থায়ী জ্ঞান করে সবর করা।

২। বিপদে পড়লে কখনোই হতাশ হওয়া যাবেনা।

৩। বিপদেও শোকর আদায় করা কারন এর থেকে বড় বিপদ হতে পারত।

৪। আল্লাহ আমাকে ভাল বাসের বলেই আমাকে বিপদ প্রদান করছেন (কারন বিপদে সবর করলে মর্জাদা বৃদ্ধি পায়)।

৫। এটা আল্লাহ বিধান বা ভাগ্য মনে করে বিপদকে মেনে নিয়ে প্রয়োজনী আমল করা।

৬। বিপদ-আপদকে আল্লাহর রহমত মনে করতে হবে। তা নিজের পাপের কারণে ঘটেছে ভেবে আল্লাহর কাছে বিনয়ী হতে হবে। পরিত্রাণের জন্য দুয়া করতে হবে।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment