কুরবানির হুকুম

কুরবানির হুকুম

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

কুরবানি করা মুলত একটি ওয়াজিব ইবাদত। ইসলামি শরীয়তের অধিকাংশ মুজতাহীদ আলেম সামর্থবান মুসলিমের উপর বছরে একবার পশু কুরবানি করাকে ওয়াজিব আমল বলছেন। আমাদের চার ইমামের প্রসিদ্ধ তিন ওয়জিব বলেছেন। তারা হলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহঃ), ইমাম মালেক (রহঃ) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ)। তবে ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এর প্রসিদ্ধ মত হলো, কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ইহা ছাড়া ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস ও ইমাম তাইমিয়া ওয়াজিব বলেছেন। বর্তমানের যুগের অন্যতম সৌদী ফিকাহবীদ আলেম শাইখ ইবনে উসাইমীন (রহঃ) উভয় পক্ষের দলিলঃ-প্রমাণ উল্লেখ করার পর বলেন, এ সকল দলিলঃ-প্রমাণ পরস্পর বিরোধী নয় বরং একটা অন্যটার সম্পূরক। তার মতে,  যারা কুরবানিকে ওয়াজিব বলেছেন তাদের প্রমাণাদি অধিকতর শক্তিশালী।

যারা কুরবানি ওয়াজিব বলেন তাদের দলিলঃ হলোঃ

আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন,

* فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ*

অর্থঃ তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং (পশু) কুরবানি কর। (সূরা কাউছার ১০৮:২)

মন্তব্যঃ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যে কোন নির্দেশ পালন করা ওয়াজিব। তিনি যেহেতু বলেছেন কুরবনি করে তাই করা ওয়াজিব। আমাদের প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নিয়মিত কুরবানি করেছেন যা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত। তিনি কুরবানি করার পাশাপাশি আমাদের ও করতে  আদেশ করেছেন। তার দলিল পাওয়া যায় নিচের সহিহ হাদিসে।

মিখনাফ ইবনে সুলাইম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা আরাফাতের ময়দানে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট অবস্থানরত ছিলাম। তখন তিনি বলেনঃ হে জনগণ! প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর একটি কোরবানী ও একটি আতীরা রয়েছে। তোমরা কি জানো আতীরা কী? তা হলো, যাকে তোমরা রাজাবিয়া বলো। (ইবনে মাজাহ ৩১২৫, তিরমিজি ১৫১৮, আবু দাউদ ২৭৮৮)

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের কাছেও না আসে। (ইবনে মাজাহ ৩১২৩)মন্তব্যঃ এই দুটি হাদিসের আলোচকে বুঝায় যায কুরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব আমল। যারা কুরবানি পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি উপরের হাদিস একটি সতর্ক বাণী। তাই কুরবানি ওয়াজিব।

অপর পক্ষে যারা কুরবানীকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বলেছেন তাদের দলিলঃ

উম্মু সালামাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যখন (যিলহাজ্জ মাসের) প্রথম দশদিন উপস্থিত হয় আর কারো নিকট কুরবানীর পশু উপস্থিত থাকে, যা সে যাবাহ করতে চায়, তবে সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে। (সহিহ মুসলিম ৫০১২, আবু দাউদ ২৭৯১)

নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামএর স্ত্রী উম্মু সালামাহ্‌ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে লোকের কাছে কুরবানীর পশু আছে সে যেন যিলহাজ্জের নতুন চাঁদ দেখার পর ঈদের দিন থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে।(সহিহ মুসলিম ৫০১৫)

মন্তব্যঃ এই হাদিস দুটিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,  ‘যে কুরবানি করার নিয়ত করে বা কুরবানি করতে চায়’ কথা দ্বারা বুঝে আসে এটা ওয়াজিব নয়। অপর পক্ষে, আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতের মাঝে যারা কুরবানি করেনি তাদের পক্ষ থেকে কুরবানি করেছেন। তার এ কাজ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে কুরবানি ওয়াজিব নয়।

হজ্জের সাথে কুরবানীর হুকুমঃ

বইয়ের শুরুতে দেখতে পেয়েছি হজ্জ তিন প্রকার। তামাত্তু হজ্জ, কেরান হজ্জ এবং ইফরাদ হজ্জ।  এই তিন প্রকারের মধ্যে তামাত্তু হজ্জ এবং কেরান হজ্জে গমনকারীদের উপর কুরবানী ওয়াজিব। যারা হজ্জের নিয়তে ইহরাম বেধে মক্কায় প্রবেশ করে কিন্তু তাদের সাথে হাদী থাকে না। তারা প্রথমে উমরা করে হালল হয়ে যায় এবং আবার ইহরাম বেধে হজ্জ করে এদের হজ্জকে তামাত্তু হজ্জ বলা হয়। অর্থাৎ একই সফরে পৃথকভাবে প্রথমে উমরা ও পরে হজ্জ আদায় করাকে তামাত্তু হজ্জ বলে। অপর পক্ষে যারা হাদী নিয়ে হজ্জে নিয়তে মক্কায় আসেন এবং একই ইহরামে উমরা ও হজ্জ আদায় করে থাকেন, তাদের হজ্জকে কেরান হজ্জ বলা হয়। অর্থাৎ একই সফরে এক ইহরামে উমরা ও হজ্জ আদায় করা কে কেরান হজ্জ বলে। কেরান হজ্জযাত্রীতো হাদি নিয়েই আসে এবং এই হাদী কুরআনী দেয়া তাদের উপর ওয়াজিব। তামাত্তু ও কেরান হাজ্জিদের ইহরাম ত্যাগ করা আগে কুরবাণী দেয়া ওয়াজিব।

দলিল নিম্মের হাদিসঃ

‘আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে বের হলাম এবং একে হাজ্জের সফর বলেই আমরা জানতাম। আমরা যখন (মক্কা্য়) পৌঁছে বাইতুল্লাহ-এর তাওয়াফ করলাম তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিলেনঃ যারা কুরবানীর পশু সঙ্গে নিয়ে আসেনি তারা যেন ইহরাম ছেড়ে দেয়। তাই যিনি কুরবানীর পশু সঙ্গে আনেননি তিনি ইহরাম ছেড়ে দেন। আর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মিণীগণ তাঁরা ইহরাম ছেড়ে দিলেন। ‘আয়িশাহ্ (রাযি.) বলেন, আমি ঋতুমতী হয়েছিলাম বিধায় বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করতে পারিনি। (সহিহ বুখারি ১৫৬১ নম্বর হাদিসের প্রথম আংশ)

জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ হাজ্জের ইহরাম বেঁধেছিলেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তালহা (রাঃ) ব্যতীত কারো সাথে কুরবানীর পশু ছিল না। আর ‘আলী (রাঃ) ইয়ামান হতে এলেন এবং তাঁর সঙ্গে কুরবানীর পশু ছিল। তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিষয়ে ইহরাম বেঁধেছেন, আমিও তার ইহরাম বাঁধলাম। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ইহরামকে ‘উমরায় পরিণত করতে এবং তাওয়াফ করে এরপরে মাথার চুল ছোট করে হালাল হয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। তবে যাদের সঙ্গে কুরবানীর জানোয়ার রয়েছে (তারা হালাল হবে না)। তাঁরা বললেন, আমরা মিনার দিকে রওয়ানা হবো এমতাবস্থায় আমাদের কেউ স্ত্রীর সাথে সহবাস করে এসেছে। এ সংবাদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট পৌঁছলে তিনি বললেনঃ যদি আমি এ ব্যাপার পূর্বে জানতাম, যা পরে জানতে পারলাম, তাহলে কুরবানীর জানোয়ার সঙ্গে আনতাম না। আর যদি কুরবানীর পশু আমার সাথে না থাকত অবশ্যই আমি হালাল হয়ে যেতাম। আর ‘আয়িশাহ্ (রাযি.)-এর ঋতু দেখা দিল। তিনি বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ব্যতীত হাজ্জের সব কাজই সম্পন্ন করে নিলেন। রাবী বলেন, এরপর যখন তিনি পাক হলেন এবং তাওয়াফ করলেন, তখন বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনারা তো হাজ্জ এবং ‘উমরাহ উভয়টি পালন করে ফিরছেন, আমি কি শুধু হাজ্জ করেই ফিরব? তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আবদুর রাহমান ইবনু আবূ বাকর (রাঃ)-কে নির্দেশ দিলেন তাকে সঙ্গে নিয়ে তান‘ঈমে যেতে। অতঃপর যুলহাজ্জ মাসেই হাজ্জ আদায়ের পর ‘আয়িশাহ্ (রাযি.) ‘উমরাহ আদায় করলেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন জামরাতুল ‘আকাবায় কঙ্কর মারছিলেন তখন সুরাকা ইবনু মালিক ইবনু জু‘শুম (রাঃ)-এর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ হাজ্জের মাসে ‘উমরাহ আদায় করা কি আপনাদের জন্য খাস? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ না, এতো চিরদিনের (সকলের) জন্য। (সহিহ বুখারি ১৭৮৫)

হাদী কুরবানী করতে সমর্থ না হলে করনীয়ঃ

হজ্জের সময়ের মিকাত হলো, পহেলা শাওয়াল থেকে জিলহজ্জ মাসের ০৯ তারিখ পর্যান্ত যে কোন দিন। এই সময়ের আগে বা পরে আসলে হজ্জের ইহরান বেধে মক্কা প্রবেশ করা যাবে না। শুধু উমরার ইহরাম বাধা যাবে। আর এই সময় মাঝে আসলে হজ্জ ও উমরা উভয়ের নিয়তে মক্কা প্রবেশ করা যাবে। কেননা, মহান আল্লাহই হজ্জের তারিখ নির্দষ্ট করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,

 الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَّعْلُومَاتٌ فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ الْحَجَّ فَلاَ رَفَثَ وَلاَ فُسُوقَ وَلاَ جِدَالَ فِي الْحَجِّ وَمَا تَفْعَلُواْ مِنْ خَيْرٍ يَعْلَمْهُ اللّهُ وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى وَاتَّقُونِ يَا أُوْلِي الأَلْبَابِ

অর্থঃ হজ্জ্বে কয়েকটি মাস আছে সুবিদিত। এসব মাসে যে লোক হজ্জ্বের পরিপূর্ণ নিয়ত করবে, তার পক্ষে স্ত্রীও সাথে নিরাভরণ হওয়া জায়েজ নয়। না অশোভন কোন কাজ করা, না ঝাগড়া-বিবাদ করা হজ্জ্বের সেই সময় জায়েজ নয়। ( সুরা বাকারা ২:১৯৭)

ইব্‌নু ‘উমর (রাঃ) বলেন, হজ্জ-এর মাসগুলো হলঃ শাওয়াল, যিলক্বাদ এবং যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন। ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ সুন্নাত হল, হজ্জের মাসগুলোতেই যেন হজ্জের ইহ্‌রাম বাঁধা হয়।

আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ) বলেনঃ যদি কেউ হজ্জের মাসে অর্থাৎ শাওয়াল, যিলকা’দা, যিলহজ্জ মাসে হজ্জের পূর্বে উমরা আদায় করিয়া মক্কায় এতদিন অবস্থান করে, যতদিনে সে হজ্জই আদায় করিতে পারে, তাহার এই হজ্জ তামাত্তু বলিয়া গণ্য হইবে এবং সামর্থ্য অনুযায়ী তাহার উপর কুরবানী করা জরুরী হইবে। যদি কুরবানী করার সামর্থ্য তাহার না থাকে তবে মক্কায় অবস্থানকালে তিনদিন এবং বাড়ি ফিরিয়া আর সাতদিন তাহাকে রোযা রাখিতে হইবে। মালিক (রহঃ) বলেনঃ উক্ত হুকুম তখনই প্রযোজ্য হইবে যখন উমরা সমাপন করিয়া হজ্জ পর্যন্ত মক্কায় অবস্থানরত থাকিবে এবং হজ্জও করিবে। মালিক (রহঃ) বলেনঃ মক্কার বাসিন্দা কোন ব্যক্তি অন্য কোথাও গিয়া বসতি স্থাপন করিল। হজ্জের মাসে সে উমরা করিতে আসিয়া মক্কায় অবস্থান করিয়া হজ্জ সমাধা করিল। তাহার এই হজ্জ হজ্জে তামাত্তু বলিয়া গণ্য হইবে। এই ব্যক্তির উপর কুরবানী করা জরুরী হইবে। কুরবানী করিতে না পারিলে তাহাকে রোযা রাখিতে হইবে। মক্কার অপরাপর স্থায়ী বাসিন্দার মত তাহার হুকুম হইবে না। (মুয়াত্তা মালিক ৭৬০, হজ্জ অধ্যায়, পরিচ্ছেদ ১৯, রেওয়াত ৬৫ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ কোন ব্যক্তি যদি শাওয়াল মাস আসার পূর্বেই উমরার ইহরাম করে এবং (বাকি সময়টা) মক্কায় অবস্থান করে সেই বছরেই হাজ্জও করে তাহলে তার প্রতি হাদী (কুরবানী) যবহ করা ওয়াজিব হবে না। কারণ, সে তামাত্তুকারী নয়। কেননা সে হাজ্জের মাস আসার পূর্বেই উমরার ইহরাম করেছে। হাজ্জে তামাত্তু ও কেরান হাজ্জির জন্য হাদী (কুরবানী) যবহ করা ওয়াজিব হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে যে, সে যেন মক্কা বা হারামের এলাকার অধিবাসী না হয়। সুতরাং যারা মক্কা বা হারামের এলাকার অধিবাসী তাদের উপর হাদী (কুরবানী) যবহ করা ওয়াজিব নয়। যার দলিল মহান আল্লাহর বাণী,

**(فَمَن تَمَتَّعَ بِالْعُمْرَةِ إِلَى الْحَجِّ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلاثَةِ أَيَّامٍ فِي الْحَجِّ وَسَبْعَةٍ إِذَا رَجَعْتُمْ تِلْكَ عَشَرَةٌ كَامِلَةٌ ذَلِكَ لِمَن لَّمْ يَكُنْ أَهْلُهُ حَاضِرِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ )البقرة **

যে কেউ উমরাহকে হাজ্জের সঙ্গে মিলিয়ে উপকার লাভ করতে উচ্ছুক, সে যেমন সম্ভব কুরবানী দিবে এবং যার পক্ষে সম্ভব না হয়, সে ব্যক্তি হাজ্জের দিনগুলোর মধ্যে তিনদিন এবং গৃহে ফেরার পর সাতদিন, এ মোট দশদিন সিয়াম পালন করবে। এটা সেই লোকের জন্য, যার পরিবারবর্গ মসজিদে হারামের বাসিন্দা নয়। (সুরা বাকারা ২:১৯৬)

মক্কা বা হারামের বাইরের কোন শহর যদি কেউ হজ্জ করতে আসে আর যদি তারা তামাত্তু বা কেরান হজ্জের নিয়ত করে, তবে তাদের প্রতি হাদী (কুরবানী) করা ওয়াজিব। কারণ, তারা মসজিদে হারামের বাসিন্দা নয়। তবে যদি মক্কার অধিবাসী বিদ্যার্জনের জন্য বা অন্য কোন উদ্দেশে মক্কার বাইরে সফর করে, অতঃপর হাজ্জে তামাত্তু বা কেরানের নিয়তে মক্কা ফিরে আসে তাহলে তার প্রতি হাদী (কুরবানী) করা ওয়াজিব হবে না। কারণ, এক্ষেত্রে তার বাসস্থানকে কেন্দ্র করতে হবে, আর তা হলো মক্কা মুকার্রামাহ।

মন্তব্যঃ তামাত্তু হজ্জ এবং কেরান হজ্জ আদায়কারী যদি হাদী (কুরবানীর পশু) না পায় বা তার খরচ-খরচা এবং বাড়ি ফিরে আসার মত পয়সার অতিরিক্ত কুরবানী ক্রয় করার পয়সা না থাকে তাহলে তার প্রতি হাদী (কুরবানী) ওয়াজিব হবে না, বরং তার সিয়াম পালন করা আবশ্যক হবে। যার দলিল মহান আল্লাহর বাণী,

**(فَمَن تَمَتَّعَ بِالْعُمْرَةِ إِلَى الْحَجِّ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلاثَةِ أَيَّامٍ فِي الْحَجِّ وَسَبْعَةٍ إِذَا رَجَعْتُمْ تِلْكَ عَشَرَةٌ كَامِلَةٌ ذَلِكَ لِمَن لَّمْ يَكُنْ أَهْلُهُ حَاضِرِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ )البقرة **

যে কেউ উমরাহকে হাজ্জের সঙ্গে মিলিয়ে উপকার লাভ করতে উচ্ছুক, সে যেমন সম্ভব কুরবানী দিবে এবং যার পক্ষে সম্ভব না হয়, সে ব্যক্তি হাজ্জের দিনগুলোর মধ্যে তিনদিন এবং গৃহে ফেরার পর সাতদিন, এ মোট দশদিন সিয়াম পালন করবে। এটা সেই লোকের জন্য, যার পরিবারবর্গ মসজিদে হারামের বাসিন্দা নয়। (সুরা বাকারা ২:১৯৬)

তাশরীক্বের দিনগুলিতে কি এই সিয়াম পালন করা যাবে?

হ্যা, তাশরীক্বের দিনগুলিতে এই সিয়াম আদায় করা জায়েয। তাশরীক্বের দিনগুলো হলো, আরবী যিলহাজ্জ মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ। তামাত্তু ও কিরান হজ্জযাত্রীগণ এই দিনে হাদি কুরবাণীর কাফ্ফারা হিসাবে সিয়াম পালন করতে পারলেও সাধারণত কোন হাজ্জিকে এই দিনে সিয়াম পালনের অনুমতি প্রদান করা হয় নাই। এই দিনে সিয়াম জায়েয হওয়ার দলিলঃ

*** আয়িশাহ্ (রাযি.) ও ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তাঁরা উভয়ে বলেন, যাঁর নিকট কুরবানীর পশু নেই তিনি ব্যতীত অন্য কারও জন্য আইয়্যামে তাশরীকে সওম পালন করার অনুমতি দেয়া হয়নি। (সহিহ বুখারী ১৯৯৭-১৯৯৮)

তামাত্তু এবং কিরান হজ্জযাত্রী ব্যাক্তি যদি বুঝতে পারে যে, হজ্জের সময় তিনি হাদি কুরবাণী দিতে পারবেন না। অর্থাৎ হজ্জের অন্যতম ওয়াজিব কাজ কুরবানী তিনি আদায় করতে সমর্থ হবেন না। এই ব্যাক্তি ইচ্ছা করলে উমরার ইহরাম বাঁধার পরে, হজ্জের কার্যক্রম শুরুর আগেই তিনটি সিয়াম পালন করতে পারে। এইকথার দলিলঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাণী,

*** ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামত পর্যন্ত হাজ্জের মধ্যে উমরাও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। (সুনানে তিরমিজি ৯৩২)

*** ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ এ সেই ‘উমরা যা থেকে আমরা উপকৃত হয়েছি। কাজেই যার সাথে কুরবানীর পশু নেই সে সবকিছু থেকে সম্পূর্ণ হালাল হয়ে যাবে। আর ‘উমরা কিয়ামাত পর্যন্ত হজের (হজ্জের) মধ্যে প্রবেশ করলো।(সুনানে আবু দাউদ ১৭৯০)

মন্তব্যঃ যদি উমরার অবস্থায় তিনটি সিয়াম পালন করে তাহলে সে হাজ্জের দিনেই সিয়াম পালন করল। তবে ঈদের দিনে এই সিয়াম পালন করবে না।

*** আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, দু’ (দিনের) সিয়াম ও দু’ (প্রকারের) ক্রয়-বিক্রয় নিষেধ করা হয়েছে, ঈদুল ফিতর ও কুরবানীর (দিনের) সিয়াম এবং মুলামাসা ও মুনাবাযা (পদ্ধতিতে ক্রয়-বিক্রয়) হতে। (সহিহ বুখারি ১৯৯৩)

উকবা ইবনু আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমাদের মুসলিম জনগণের ঈদের দিন হচ্ছে আরাফার দিন, কুরবানীর দিন ও তাশরীকের দিন। এ দিনগুলো হচ্ছে পানাহারের দিন।  (তিরমিজি ৭৭৩)

আর এই সিয়ামগুলি পরস্পর রাখা এবং বিরতি দিয়েও রাখা জায়েয। তবে তাশরীক্বের দিনগুলির পরে রাখবে না। আর অবশিষ্ট সাতটি সিয়াম নিজ গৃহে ফিরার পরে মন চাইলে বিনা বিরতিতে অথবা বিরতি দিয়ে আদায় করবে। কারণ, আল্লাহ পাক এই সিয়াম ওয়াজিব করেছেন, কিন্তু এক নাগাড়ে সিয়াম পালনের শর্তারোপ করেননি।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “কুরবানির হুকুম

Leave a comment