সফরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানঃ তৃতীয় কিস্তি

সফরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানঃ তৃতীয় কিস্তি

কাপড়ের তৈরী মোজার উপর মাসেহ করার বিধান

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

সফরের কষ্টের কথা বিবেচনা করে ইসলাম সফর বা ভ্রমণকারীর জন্য ইসলামী বিধানে কিছুটা রুখসত বা ছাড় দিয়েছে। সালাত মহান আল্লাহ এমন এক আদেশ যাকে কোন অবস্থায়ই পরিত্যাগ করা যাবে না, তাই সে সফরে থাকুক আর বাড়িতে থাকুন। কিন্তু মহান আল্লাহ সফরের সময় সালাতের ব্যাপারে আমাদের প্রতি কিছুটা সহনশীলতা প্রদর্শণ করেছেন। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হওয়া সত্বেও সফর বা ভ্রমণকরীর জন্য চার রাকআত বিশিষ্ট সালাতকে কসর করে বা কমিয়ে দুই রাকআত করেছেন। শুধু সালাত নয় সফরে আরও কয়েকটি হুকুমের ব্যাপারে মহান আল্লাহ কিছুটা ছাড় বা রুখসত প্রদান করেছেন। সফরে থাকা কালিন সময়ে সফরকারিকে মুসাফির বলা হয়। মুসাফির ব্যক্তি সব সময় চারটি রুখসত বা ছাড়ের অধিকারী হবে। সে চারটি রুখসত হলঃ

১। সালাতকে কসর করে আদায়

২। সালাতকে জমা করা।

৩। সফরে তিন দিন ও তিন রাত্রি পর্যন্ত মোজার উপর মাসেহ করা

৪। সফর অবস্থায় রমযানের সিয়াম ভঙ্গ করা

কাপড়ের তৈরী মোজার উপর মাসেহ করার বিধান কি?

মোজার উপর মাসেহ করা সম্পর্রে কারো কোন দ্বিমত নেই। এ সম্পর্কে অসংখ্যা সহিহ হাদিস বিদ্যমান। প্রায় সত্তর জনের সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহু মোজা মাসাহ সংক্রান্ত হাদীস বর্ণনা করেছেন। কসর সালাত ও তাইয়ামুমের মত মোজার উপর মাসেহ করার বিধান মহার আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতে মুহাম্মাদির উপর জন্য বিশেষ এহসান।

আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন তাঁর দেওয়া সুবিধাদি গ্রহণ করা। যেমনিভাবে তিনি অপছন্দ করেন তাঁর শানে কোনো পাপ সংঘটন করা”।(ইবন খুযাইমাহ ৯৫০, ২০২৭)।

আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ ও ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেন তাঁর দেওয়া সুবিধাদি গ্রহণ করা। যেমনিভাবে তিনি পছন্দ করেন তাঁর দেওয়া ফরযগুলো পালন করা”। ( ইবন হিব্বান ৩৫৬৮)।

ঈদের দিনে রোজা রাখা হারাম কারন ঈদের দিন আল্লাহ আনন্দ করার হুকুম দিয়েছেন। তাই শরীয়তের বিধান জেনে  যখন যা সহজ্জ তার জন্য তাই করা উত্তম। অতএব, যে ব্যক্তি মোজা পরিধান করাবস্থায় রয়েছে এবং তার মোজায় মোজা মাসাহ’র শর্তগুলোও পাওয়া যাচ্ছে তার জন্য উচিত মোজা না খুলে মোজার উপর মাসাহ করা। কারণ, তাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের অনুসরণ ও অনুকরণ করা হবে।

এই সহজ্জ বিধান কে  সুন্নাহ সম্মতভাবে আদায় করতে গিয়ে একটি বিতর্ক চলছে তা হল মোজার ধরণ নিয়ে মুজা কি চামড়ার হবে, নাকি কাপড়ের হলেও চলবে।

চমাড়ার মোজার উপর মাসাহ করা নিয়ে কোন মতভেদ বা ইকতিলাব নেই। এ ব্যাপার সকল উম্মত একমত বা ইজমা হয়েছে। কাপড়ের মোজার উপর মাসাহ করা নিয়ে কোর মতভেদ বা ইকতিলাব আছে। তাই বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষের আলেমদের মতামত তুলে ধরব যাতে সহজে সঠিক মত গ্রহন করা সহজ্জ হয়।

যারা কাপড়ের মোজার উপর মাসাহ করাকে জায়েয মনে করে নাঃ

উপমহাদেশের প্রায় সকল হানফী মাযহাবের অনুসারী আলেমগন চমাড়ার মোজার উপর মাসাহ করা শরীয়ত সম্মত বললেও কাপড়ের মোজার উপর মাসাহ করাকে জায়েয মনে করে না। তাদের প্রায় সকল আলেমের ঐক্যমত হলঃ

“আমাদের দেশের প্রচলিত কাপড়ের মোজার উপর মাসেহ করা কিছুতেই জায়েজ নয়”

যেমন কওমী মাদ্রাদার আলের যারা হানাফি মাযহারভুক্ত তাদের কতৃর্ক প্রকাশিত মাসিক আল কাউসার পত্রিকার ১৮০৩ নম্বর প্রশ্ন ছিলঃ

প্রশ্নঃ এক খতীব সাহেবকে জুমআর বয়ানে বলতে শুনেছি যে, মোজার উপর মাসেহ বৈধ হওয়ার জন্য তা চামড়ার হওয়া জরুরি নয়। বরং আমাদের দেশে প্রচলিত সব ধরনের মোজার উপর মাসেহ করা জায়েয। চাই তা সুতার হোক বা পশমের হোক বা অন্য কোনো কিছুর হোক। জানতে চাই, তার এ কথা কতটুকু সঠিক? (মুহাম্মাদ মাহমুদ হাসান, ধানমণ্ডি, ঢাকা থেকে)

উত্তরঃ

খতীব সাহেবের ঐ কথা ঠিক নয়। চামড়ার মোজার উপর মাসেহ জায়েয আছে। কিন্তু চামড়া ছাড়া সুতা বা পশমের তৈরি যেসব মোজা সচরাচর পাওয়া যায় এর উপর মাসেহ সহীহ নয়। তবে সুতা বা পশমের মোজায় নিম্নোক্ত শর্তগুলো পাওয়া গেলে তার উপর মাসেহ জায়েয হবে। শর্তগুলো হচ্ছে :
ক) মোজা এমন মোটা ও পুরু হওয়া যে, জুতা ছাড়া শুধু মোজা পায়ে দিয়ে তিন মাইল পর্যন্ত হাঁটা যায়। এতে মোজা ফেটে যায় না এবং নষ্টও হয় না।

খ) পায়ের সাথে কোনো জিনিস দ্বারা বাঁধা ছাড়াই তা লেগে থাকে এবং তা পরিধান করে হাঁটা যায়। 
গ) মোজা এমন মোটা যে, তা পানি চোষে না এবং তা ভেদ করে পানি পা পর্যন্ত পৌঁছায় না।
ঘ) তা পরিধান করার পর মোজার উপর থেকে ভিতরের অংশ দেখা যায় না। সচরাচর ব্যবহৃত সুতা বা পশমের মোজায় যেহেতু এসব শর্ত পাওয়া যায় না তাই এর উপর মাসেহ জায়েয হবে না।

হানফী মাযহারের আরেক জন আলেম মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী যিনি তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা এর পরিচালক। তিনি ও উক্ত শর্ত ৪ টি ঊল্লেখ করেন অতপর বলেন, সুতরাং পরিস্কার হয়ে গেল যে, আমাদের দেশের প্রচলিত কাপড়ের পাতলা মোজার উপর মাসাহ করা কিছুতেই জায়েজ নয়।

হানফী মাযহারের আরেক বিশ্ব বিখ্যাত আলেম মুফতি ত্বকি উসমানি। তিনি করাচি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘আল বালাগ’ এর জমাদিউল উলা ১৩৯৭ হি. সংখ্যায় ‘প্রচলিত মোজার উপর মসেহ’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশ করেন।  যেখানে তিনিকাপড়ের মোজার উপর মাসাহ করাকে নাজায়েয বলেছেন। এবং যারা এর মাসাহ করার পক্ষে তাদের সমালোচনা করেছেন। বিশেষত জামায়াত ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা জনাব মাওলানা মওদুদী রাহিমাহুল্লার সমালোচনা করেন যিনি কাপড়ের মোজার উপর মাসাহ করাকে জায়েয বলেছেন।

মন্তব্যঃ আর কোন রেফারেন্স দেয়ার দরকার নেই কারন উপমহাদেশের হানফী মাযহাবের অনুসারী আলেমগন কাপড়ের মোজার উপর মাসাহ করাকে জায়েয মনে করে না।  এ কথা বলে তাকে অভিযোগ করলে তিনি স্বীকার করেন ও এর সমর্থনে যুক্তি পেশ করেন।

যারা কাপড়ের মোজার উপর মাসাহ করাকে জায়েয মনে করেঃ

বর্তমানে সৌদি আরবের সকল আলেম যাদের আমরা সালাফি বলে চিনি। আমাদের দেশে যারা আহলে হাদিস নামে পরিচিত তারা সকলে কাপড়ের মোজার উপর মাসাহ করাকে জায়েয মনে করে থাকে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাইয়েম এবং ইবনে হাজ্ম এই মতেরই অনুসারী। এরা সকলে “যে কোনো মোজার উপর মসেহ জায়েয বলে ফতোয়া দিয়েছেন। তাদের দলিলঃ হল এই হাদিস যা ইমাম তিরমিজী উল্লখ করেছেন। হাদিসটি হলঃ

 *وَعَنْهُ قَالَ تَوَضَّاَ النَّبِىِّ ﷺ وَمَسَحَ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ وَالنَّعْلَيْنِ. رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ وأَبُوْ دَاوٗدَ وَابْنُ مَاجَةَ*

অনুবাদঃ মুগীরা ইবনু শু‘বা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অজু করলেন এবং জুতার সাথে ‘জাওরাব’ ও পা’ দু’টোর উপরের দিকও মাসাহ করলেন। (আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ ও ইবনু মাজাহ্, ছাহীহ: আবূ দাঊদ ১৫৯, তিরমিযী ইঃ ফাঃ ৯৯, ইবনু মাজাহ্ ৫৫৯, ইরওয়া ১০১, মিশকাতুল মাসাবীহ/মিশকাত: ৫২৩; ইমাম আবূ ঈসা তিরমিযী বলেনঃ এই হাদিসটি হাসান ও সহীহ। একাধিক আলিমের অভিমত এই। হাদিসের মানঃ ছাহীহ)


হাদীছটির ব্যাখ্যা: جَوْرَبَيْنِ ‘জাওরাবায়ন’ শব্দটি جَوْرَبْ ‘জাওরাব’-এর দ্বিবচন। এর অর্থ কাপড়ের মোজা। বর্ণিত হাদীসে প্রমাণ হয় যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাওরাবায়ন বা পায়ের ঢাকনীর উপর মাসাহ করেছেন। সেটা চাই পশমী হোক বা চুলের হোক। আর চামড়ার হোক বা পস্নাস্টিকের হোক। মোটা হোক বা পাতলা হোক সেটার উপর মাসাহ করা জায়িয আছে। জাওরাবায়ন জুতার ন্যায় যা জমিন হতে পাকে রক্ষা করে। সেটার উপর মাসাহ করা উত্তম। ইমাম ইবনু হাযম সেটা মোটা হওয়ার জন্য শর্ত করেছেন। অনেক সাহাবায়ি কিরাম এর ওপর ‘আমাল করেছেন। হাদীছটিকে ইমাম তিরমিযী  রহঃ ছহীহ বলেছেন।


প্রশ্নঃ এক ভাই জানতে চেয়েছেন ওজুর সময় মুজার ওপর পা মাসেহ করা জায়েজ কিনা? আমরা জানি আমাদের রাসূল (সা:) চামড়ার মুজার ওপর মাসাহ করতেন। এখন প্রশ্ন হল নরমাল সব মুজার ওপর মাসেহ করা যাবে কি না? রেফারেন্স সহ জানালে উপকৃত হব।

উত্তরঃ মোজার উপর মাসেহ করা জায়েয় চাই তা চামড়ার তৈরি হোক বা সুতার তৈরী হোক। সাহাবীগণ অনেকেই কাপড়ের তৈরী মোজা পরিধান করতেন আর তার উপর মাসেহ করতেন।

উল্লেখ্য যে, আরবীতে চামড়ার তৈরী মোজাকে ‘খুফ’ আর সুতার তৈরী মোজাকে ‘জাওরাব’ বলা হয়। উভয় প্রকার মুজার উপর মাসেহ করা বৈধ।

চামড়ার মোজার উপর মাসেহ করা সর্ব সম্মতক্রমে বৈধ। তবে সুতার তেরী মোজার উপর মাসেহ করা বৈধ কি না- এ বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও সঠিক মত হল, জায়েয।

*বিস্তারিত*
সাধারণভাবে সকল ধরণের জাওরাব (সুতার তৈরী মুজা) এর উপর মাসাহ বৈধ, এমনকি যদি তা খুব পাতলা হয় তবুও: এটাই ইবনু হাযম ও ইবনু তাইমিয়ার স্পষ্ট মাযহাব। আর এ মতকেই ইবনু উছাইমীন ও আল্লামা শানক্বীতী পছন্দ করেছেন।

[আল-মুহালস্না (২/৮৬), আল-মাসায়িলুল মারদিনিয়্যাহ (৫৮ পৃ.), মাজমূ’ আল-ফাতাওয়া (২১/১৮৪), আল-মুমতি’ (১/১৯০), আযওয়াউল বায়ান (২/১৮, ১৯), এখানে এ বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা রয়েছে।] 
*এটাই অধিক প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত।*

এখানে জাওরাবের উপর মাসাহ বৈধ মর্মে বর্ণিত শেষ দু‘টি অভিমতের প্রবক্তাগণ নিম্নোক্ত দলিল গুলোকে দলিল হিসাবে দাড় করান। যথাঃ

عَنِ الْمُغِيرَةِ بْنِ شُعْبَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ تَوَضَّأَ وَمَسَحَ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ، وَالنَّعْلَيْنِ

(১) মুগীরা বিন শোবা (রাঃ) বর্ণিত হাদীস: ‘নিশ্চয় রাসূল (ﷺ) একবার ওযূ করলেন এবং জাওরাব ও দু জুতার উপর মাসাহ করলেন। (এ হাদীসকে আলবানী সহীহ বলেছেন, আবূ দাউদ (১৫৯), তিরমিযী (৯৯), আহমাদ (৪/২৫২), এ ব্যাপারে বিস্তারিত ‘আল-ইরওয়া (১০১)-দ্রষ্টব্য।)

عَنِ الأزرق بن قيس قال رأيت أنس بن مالك أحدث فغسل وجهه ويديه ومسح برأسه ، ومسح على جوربين من صوف فقلت : أتمسح عليهما ؟ فقال : إنهما خفان ولكنهما من صوف

(২) আয়রাক্ব ইবনে কায়েস (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি আনাস ইবনে মালিককে লক্ষ্য করেছি, তিনি বায়ু নিঃসরণ হলে তাঁর চেহারা ও দুহাত ধৌত করতেন এবং পশমের তৈরি জাওরাবের উপর মাসাহ করতেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি জাওরাবের উপর মাসাহ করলেন? তিনি বললেন, এ দু’টি মোজা যা পশমের তৈরি। [এ হাদীসকে আহমাদ শাকির সহীহ বলেছেন; আলকূনী (১/১৮১) দাওলাবী প্রণীত।]

এখানে আনাস (রাঃ) খাফ বা মোজা চামড়ার তৈরি হওয়ার ব্যাপারে আম (ব্যাপক), সে কথা স্পষ্ট করেছেন। উল্লেখ্য যে, তিনি আরবী ভাষাবিদদের অন্যতম একজন সাহাবী ছিলেন।

(৩) জাওরাবের উপর মাসাহ করার হাদীস ১১ জন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। যাদের মধ্যে উমার তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ বিন উমর, আলী, ইবনে মাসউদ আনাস প্রমুখ সাহাবী অন্যতম। তাদের সমসাময়িক কোন সাহাবী তাদের বিরোধিতা করেন নি। বরং, সকলে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। পরবর্তীতে জমহুর উলামা পাতলা জাওরাবের উপর মাসাহ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা তা দ্বারা ফরযের স্থান আচ্ছাদিত হয় না। অথচ এটা মাসাহ বৈধ হওয়ার জন্য শর্ত নয় যা ইতিপূর্বে আলোচনা হয়েছে।

বর্তমানে চামড়ার তেরী মোজার তুলনায় সুতার তৈরী মোজার প্রচলন বেশি। সেহেতু মোজার উপর মাসেহ করার জন্য চামড়ার তেরী হওয়ার শর্তারোপ করা ইসলাম প্রদত্ব প্রশস্ত বিধানকে সংকুচিত করে দেয়ার শামিল। (আল্লাহু আলাম)। (উত্তর দিয়েছেন শাইখ আব্দূল্লাহ হাদি)

শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) প্রশ্ন করা হয়েছিল, পাতলা বা ছেঁড়া মোজাতে মাসেহ করার বিধান কি?

বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, ছেঁড়া মোজা এবং বাইরে থেকে চামড়া দেখা যায় এমন পাতলা মোজার উপর মাসেহ করা জায়েয। যে অঙ্গের উপর মাসেহ হবে তাকে পরিপূর্ণরূপে ঢেকে রাখতে হবে এটা উদ্দেশ্য নয়। কেননা পা তো আর সতর নয়। মাসেহ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওযুকারী ব্যক্তির উপর সহজ্জতা ও হাল্কা করা। অর্থাৎ- আমরা প্রত্যেক ওযুর সময় মোজা পরিধানকারীকে মোজা খুলে পা ধৌত করতে বাধ্য করব না। বরং বলব, এর উপর মাসেহ করাই আপনার জন্য যথেষ্ট। আর এই সহজ্জতার উদ্দেশ্যেই মোজার উপর মাসেহ শরীয়ত সম্মত করা হয়েছে। অতএব কোন পার্থক্য নেই চাই মোজা ছেঁড়া হোক বা ভাল হোক, পাতলা হোক বা মোটা হোক। (গ্রন্থের নামঃ ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, বিভাগের নামঃ পবিত্রতা, ক্রমিন নং ১৪৫)।

সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী রাহিমাহুল্লাহঃ

সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী রাহিমাহুল্লাহ হানাফি আলেম হয়েও মতামত দিয়েছেন, সব ধরনের মোজার উপর মসেহ করা চলে, তাই তা সুতি হোক কিংবা পশমি হোক রামপুর (ভারত) থেকে প্রকাশিত মাসিক যিন্দেগীর ১৯৬৭ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করা হলে তিনি আবার সুন্দর করে তার উত্তর প্রদান করেন যা রাসায়েল ও মাসায়েল ৬ষ্ঠ খন্ড “মোজার উপর মসেহ করার বিধান” শিরনামে উল্লখ করা হয়েছে নিম্ম তা হুবহু তুলে ধরা হলঃ

প্রশ্নঃ রাসায়েল ও মাসায়েল ২য় খণ্ডে এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, সকল ধরনের মোজার উপর মসেহ করা চলে, তাই তা সুতি হোক কিংবা পশমি হোক রামপুর (ভারত) থেকে প্রকাশিত মাসিক যিন্দেগীর ১৯৬৭ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করে বলা হয়েছে যে, সুতি হোক, পশমি হোক, পাতলা মোজার উপর মসেহ করা চলবেনা। কেননা পবিত্র কুরআন ও উৎকৃষ্ট মানের সহীহ হাদিসের দ্বারা প্রমাণিত বিধিকে দুর্বল হাদিসের ভিত্তিতে শিথিল করা যায়না। হযরত মুগীরা ইবনে শুবার যে হাদিসটি বুখারি ও মুসলিম উভয় গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে এবং যা অত্যন্ত সহীহ হাদিস, তাতে একমাত্র চামড়ার মোজার উপরে মসেহ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর অপর যে হাদিসটিতে জাওরাইন (সুতি ও পশমি মোজা) শব্দটি সংযোজিত হয়েছে, হাদিস শাস্ত্রের ইমামগণ তাকে দুর্বল বলে রায় দিয়েছেন। 

বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে এরূপ যুক্তিও উত্থাপন করা হয়েছে যে, ‘জওরাব’ ও চামড়ার তৈরি হয়ে থাকে বিধায় ‘জওরাব’ ও এক ধরনের খুফ্‌ (চামড়ার মোজা) সুতরাং হয় চামড়ার মোজার উপরই মসেহ জায়েয মেনে নিতে হবে, নচেত জাওরাব যদি চামড়ার না হয়, তবে তাকে এমন শর্ত আরোপ করতে হবে যাতে তা খুফ্‌ তথা চামড়ার মোজার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। অন্যথায় চামড়ার মোজা ছাড়া আর কোনো মোজার উপর মসেহ করা জায়েয হবে না।


যিন্দেগীর উক্ত সংখ্যায় যে বিতর্ক, প্রশ্ন ও আপত্তি তোলা হয়েছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তরজমানুল কুরআনে বিষয়টি নিয়ে পুনরায় আলোচনা আসা জরুরী হয়ে পড়েছে। যে কোনো মোজার উপর যে মসেহ করা চলে, সে সম্পর্কে প্রাচীন ইমামদের কোনো উক্তি থাকলে সেটাও তুলে দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।

জবাবঃ  চামড়ার মোজার উপর মসেহ জায়েয হওয়ার ব্যাপারে সুন্নি ইমামরা প্রায় সকলেই একমত। তবে জাওরাব তথা চামড়ার তৈরি নয় এমন মোজার উপর মসেহ করার জন্য ফেকাহবিদগণ কিছু শর্ত আরোপ করেছেন। যেমন তা মোটা হওয়া চাই, গাঢ় ও পুরু হওয়া চাই, পানি নিরোধক হওয়া চাই এবং তাতে জুতার সমপরিমাণ চামড়াযুক্ত থাকা চাই। তবে প্রাচীন ফেকাহবিদদের কেউ কেউ আবার সকল ধরনের মোজার উপর মসেহ করাকে জায়েয মনে করেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাইয়েম এবং ইবনে হাজ্‌ম এই মতেরই প্রবক্তা। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ফতোয়া গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে সুতি হোক, পশমি হোক, চামড়াযুক্ত হোক বা না হোক- যে কোনো মোজার উপর মসেহ জায়েয বলে একটি ফতোয়া লিপিবদ্ধ রয়েছে। রসূল সা. চামড়ার তৈরি নয় এমন মোজার উপরও মসেহ করতেন এই মর্মে যেসব হাদিস বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে, সে সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া বলেনঃ

এই হাদিসগুলোর বক্তব্য হাদিসবেত্তাদের মানদণ্ডে সহীহ প্রমাণিত না হলেও স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধির দৃষ্টিতে এই বক্তব্য সঠিক। মাসাহের প্রয়োজন উভয় ক্ষেত্রেই সমান। উভয় ক্ষেত্রেই মাসাহের প্রয়োজন ও যৌক্তিকতা একই রকম। কাজেই এ দুটোর মধ্যে বৈষম্য করা সমমানের জিনিসকে অসম বলারই নামান্তর এবং সুবিচারের পরিপন্থী।

অনুরূপভাবে, চামড়া বেশি টেকসই হয়ে থাকে এবং তাতে পানি ঢোকে না এ যুক্তিও তাঁর মতে গুরুত্ববহ নয়। তিনি বরঞ্চ মনে করেন, সুতি বা পশমি মোজায় পানি শোষণ ও ভেতরে পানি প্রবেশ করা পবিত্রতার প্রয়োজনে অধিকতর অগ্রগণ্য এবং কর্তব্য। এসব মোজার পাতলা বা ঢিলে হওয়া অথবা বাঁধার প্রয়োজন না হওয়ায় তাঁর মতে অসুবিধার কিছু নেই।

আবু দাউদ শরিফের ব্যাখ্যা সম্বলিত গ্রন্থে মসেহ সংক্রান্ত হাদিসের পর্যালোচনা করতে গিয়ে হাফেয ইবনে কাইয়েমও এই অভিমতই ব্যক্ত করেছেন। এসব হাদিসের সনদ যে নির্ভরযোগ্য নয়, সে কথা তিনি স্বীকার করেছেন। তবে তার বিভিন্ন জবাবও দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, সুতি ও পশমি মোজায় মসেহ বৈধ হওয়ার ব্যাপারটা শুধুমাত্র রসূল স.-এর প্রত্যক্ষ বক্তব্য বা আচরণ সম্বলিত হাদিসের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং ১৩ জন সাহাবির কার্যধারা থেকেও তা সমর্থিত। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল র. এই হাদিসগুলোকে দুর্বল আখ্যায়িত করা সত্বেও সুতি ও পশমি কাপড়ের মোজার উপর মসেহকে বৈধ বলে রায় দিয়ে সুবিচার ও ইনসাফের পরিচয় দিয়েছেন। সাহাবাদের কার্যধারা ও সুস্পষ্ট যৌক্তিকতার আলোকেই তিনি এরূপ রায় দিয়েছেন। আসলে ‘জাওরাবাইন’ তথা সুতি ও পশমি মোজা এবং ‘খুফ্‌ফাইন’ তথা চামড়ার মোজার এমন কোনো কার্যকর পার্থক্য নেই, যা শরিয়তের বিধানে পার্থক্য সুচিত করতে পারে। ইবনে কায়েম অনেক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এতে তিনি সুতি ও পশমি মোজার উপর মাসাহের শর্তাবলীর সমালোচনা করেছেন এবং এ জাতীয় মোজার উপর মাসাহের বৈধতা সম্বলিত হাদিসগুলোতে সনদ ও যুক্তির বিচারে যে খুঁত ধরা হয়েছে, তা খণ্ডন করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি পরিহাসচ্ছলে একটা তীর্যক মন্তব্যও ছুড়ে দিয়েছেন যে, কোনো কোনো ফেকাহ শাস্ত্রবিদদের কাছে চামড়ার মোজার সাথে সুতি ও পশমির মোজাকেও মসেহযোগ্য ধরা গ্রহণযোগ্য হয়নি। অথচ এ ধরনের কোনো সংযোজন যখন তাদের ফেকাহ শাস্ত্রীয় মতামতের পক্ষে যায়, তখন সেটাকে তারা নি:সংকোচে গ্রহণ করেন।

“ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের দাবি এই যে, আপনি নিজের পণ্য যে পাল্লা দিয়ে মাপেন, আপনার বিরুদ্ধবাদীর পণ্যও সেই পাল্লা দিয়েই মাপবেন। নেয়া ও দোয়ার পাল্লা আলাদা রাখবেন না।”

ইবনে হাজমও তদীয় গ্রন্থ মুহাল্লাতে বিশদ আলোচনা করে ও সকল হাদিস উদ্ধৃত করে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, পায়ে  চামড়া, সুমি, পশমি, বা অন্য কোনো কাপড়ের তৈরি যাই পরা হোক না কেন, তাতে মসেহ চলবে। এতো সব ইতিবাচক মতামত ও বক্তব্য বর্তমান থাকা অবস্থায় কেউ যদি পূর্ববর্ণিত ফকীহদের উল্লেখিত শর্তাবলী সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ ও সর্বপ্রকারের মোজার উপর মসেহ করাকে বৈধ মনে করে, তবে তার বক্তব্য সহজে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

এরপর আরো কয়েকটি কথা বলা সমীচীন মনে করছি। প্রথম কথা হলো, সুতি ও পশমি মোজার উপর মসেহ জায়েয এই মর্মে মুগীরা ইবনে শুবা রা. বর্ণিত হাদিসটি ইমাম তিরমিযী সহীহ ও উত্তম বলেছেন। এই হাদিসটিকে একই সাহাবি বর্ণিত চামড়ার মোজায় মসেহ সংক্রান্ত হাদিসের বিপরীত বলে অগ্রাহ্য করা যায়না। এতোটুকু বৈপরিত্য মেনে নেয়া যেতো যদি মাসাহের ঘটনা এক আধবার ঘটতো। ওযু করা ও পবিত্রতা অর্জন করা নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। তাই উভয় ধরনের মোজায় মসেহ করার প্রয়োজনীয়তা স্বভাবতই একাধিকবার দেখা দেয়ার কথা। তাছাড়া হযরত মুগীরা দীর্ঘদিন যাবত রসূল সা.-এর সাথে থেকেছেন। তাই তার এই দু’ধরণের বর্ণনায় রসূল সা.-এর বিভিন্ন সময়কার কার্যধারার প্রতিফলন ঘটেছে ধরে নিতে অসুবিধে কোথায়? সুতি ও পশমি মোজার উপর মসেহ সম্পর্কে রসূল সা. -এর আরো বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোনো বিশেষ ধরনের মোজা নয় বরং যে কোনো ধরনের মোজার উপরই মসেহ জায়েয। তাই মসেহকে শুধুমাত্র চামড়ার মোজার সাথে নির্দিষ্ট করা এবং সুতি বা পশমির মোজা হলে তাকেও চামড়ার মোজা সদৃশ্য ঘন ও পুরু ইত্যাদি হওয়ার শর্তযুক্ত করার কোনো প্রয়োজন নেই।

কথাটা আরো একটু সহজ্জবোধ্য করার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। সোনা ও রূপার যাকাতের সর্বনিম্ন পরিমাণ আলাদা আলাদা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। তন্মোধ্যে রূপার নিসাব সম্বলিত হাদিস সবচেয়ে বিশুদ্ধ। কিন্তু সোনার নিসাব সংক্রান্ত হাদিস সনদের দিক দিয়ে অত্যন্ত দুর্বল। ছয়টি সহীহ হাদিস গ্রন্থের মধ্যে কেবলমাত্র আবু দাউদ শরিফে সোনার নিসাব ২০ দিনার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই হাদিসের বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততা বিতর্কিত। তা সত্ত্বেও দুনিয়ার অধিকাংশ মুসলমান সোনা ও রূপার আলাদা আলাদা নিসাবই মেনে চলে। নিসাব সংক্রান্ত এই হাদিসকে গ্রহণ করলে নিসাবের চেয়ে কম পরিমাণে যাকাত থেকে অব্যাহতি মেলে, ঠিক যেমন মাসাহের হাদিস গ্রহণ করলে মসেহ করে পা ধোয়ার হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। নিসাবের প্রশ্নটা যাকাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত সম্পাদনের সাথে জড়িত। এখন সোনার নিসাব সংক্রান্ত হাদিসটি যদি গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়, তাহলে কুরআনের কঠোর সতর্কবাণী অনুযায়ী যাকাত না দিয়ে স্বর্ণের একটা তারও রাখা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে। আর যদি (একই কারণে অর্থাৎ হাদিসটি দুর্বল হলে অগ্রাহ্য করার কারণে) সোনাকে রূপার সমপর্যায়ের ধাতু ধরে নিয়ে সোনার নিসাব ও রূপার নিসাবের সমান মনে করা হয়, (যেমন সুতি ও পশমি মোজাকে চামড়ার মোজার সমপর্যায়ের ধরা হয়) তাহলে একতোলা সোনার উপরও যাকাত দেয়া বাধ্যতামূলক হবে। কিন্তু চামড়ার মোজা ও কাপড়ের মোজার উপর মসেহ করার অনুমতিকে যদি পৃথক পৃথক অনুমতি মেনে নেয়া হয় এবং একটির সাথে অন্যটিকে জড়িয়ে ফেলা না হয়, তাহলে মোজা মোটা বা পাতলা যাই হোক, বিধি অপরিবর্তিতই থাকবে। কোনো জিনিসের পুরু বা পাতলা হওয়াটা আপিক্ষিক গুণ বা অবস্থা মাত্র, মূল জিনিসের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। মোটা বা পাতলা যাই হোক চামড়া চামড়াই এবং পশম পশমই। আজকাল যে ধরনের পাতলা ও কোমল চামড়ার পায়তাবা পরে কেউ কেউ মসেহ করে থাকেন, সে মসেহ জায়েয হলে সুতি পশমি ও নাইলনের মোজায় মসেহ করা নাজায়েয কেন হবে?
আরবিতে খুফ্‌ ও (জাওরাব) বলতে যে মোজা বুঝায়, সেই উভয় মোজাই চামড়ার হয়ে থাকে- এ কথা ঠিক নয়। প্রচলিত আরবিতে খুফ্‌ বলতে চামড়ার মোজা এবং জাওরাব বলতে চামড়া ছাড়া অন্যান্য মোজা বুঝায়। তবে লিসানুল আরব, কামুস ও তাজুল আরুসে এই দুটো শব্দের আভিধানিক অর্থ বলা হয়েছে ‘পায়ের পোশাক।’ চামড়ার তৈরি না অন্য কিছুর তৈরি, এই দু’টি শব্দের আসল আভিধানিকদের কাছে কোনো ধরাবাধা ব্যাপার নয়। তাজুল আরুস এবং লিসানুল আরবে এ কথাও বলা হয়েছে যে, জাওরাব আসলে ফার্সী শব্দ ‘গোরব’-এর আরবি রূপ। আর ফার্সী আভিধানে গোরব অর্থ হলো পশম বা সুতার মোজা। আরবি ভাষায় খুফ্‌ শব্দ দ্বারা জাওরাব এবং জাওরাব দ্বারা খুফ্‌ বুঝানোও বিচিত্র নয়। ইমাম দুলাবী স্বীয় গ্রন্থ ‘আসমা ও কুনাতে’ হযরত আনাস সম্পর্কে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি স্বীয় পশমি মোজায় মসেহ করে বললেন “এ দুটো হচ্ছে পশমের তৈরি খুফ্‌”।’

এ থেকে বুঝা গেলো যে, পশমি মোজাকে হযরত আনাস একশ্রেণীর খুফই বলেছেন। তিনি এ কথা বলেননি যে, এটা খুফ তো নয়, তবে অত্যাধিক মোটা ও পুরু বলে এটা খুফেরই পর্যায়ভুক্ত এবং এ কারণেই তার উপর মসেহ বৈধ। [তরজমানুল কুরআন, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮]

মন্তব্যঃ উপমাদেশের হানাফি আলেমগন যে মতামত দিয়েছেন, যেমনঃ মোজামোটা ও পুরু হওয়া, মোজা পায়ে দিয়ে ৩/৪ মাইল পর্যন্ত হাঁটা যাবে, পায়ের সাথে লেগে থাকা, পানি চোষে না বা ভেদ করে পানি ঠোকে না ইত্যাদি। সঠিক কথা বলতে, এই ধরনের কোন শর্ত মোজার উপর মাসাহ করার জন্য আরোপ করা হয়নি। তবে হ্যা, সালাফদের অনেক মোজা মোটা হওয়ার কথা বলেছেন।

 তিরমিজিতে মুগীরা ইবনু শু‘বা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যায় সুফইয়ান ছাওরী, ইবনু মুবারাক, শাফিঈ, আহমদ ও ইসহাক (রহঃ) ও এই অভিমত পোষণ করেন, তারা বলেনঃ কাপড়ের মোযা যদি মোটা হয় তাহলে পায়ে চপ্পল না থাকলেও তাতে মাসেহ করা যাবে। (ইসলামি ফাউন্ডেশন, তিরমিজী হাদিস ৯৯ এর ব্যাখ্যা)।

যেহেতু মুজার উপর হাদিসে কোন শর্ত আরোপ করেনি তাহলে আমরা কেন করব। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা করছেন তার অনুসরণই একমাত্র শ্রেষ্ঠ মানদন্ড। বর্তমান সময়ে লোকেরা কাপড়ের তৈরী মোজাই পরিধান করে থাকে। সুতরাং হাদীছে যেহেতু বিনা পার্থক্যে মোজার উপর মাসেহ করা বৈধ রাখা হয়েছে, তাই সকল প্রকার মোজার উপর মাসেহ করাই বৈধ। তা চামড়ার তৈরী হোক বা সুতার তৈরী হোক। পরিভাষায় যাকে মোজা বলা হয় তার উপরই মাসেহ করা বৈধ। ইসলাম মানুষের উপর সহজ্জ করতে উৎসাহ দিয়েছে এবং কঠোরতা করতে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং দলিল বিহীন কোন কঠিন মাসআলা মানুষের চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়।

তার পরও একটা কথা থাকে। মাসায়েলের ক্ষেত্রে এ উম্মতের প্রশস্ততা আছে। একই বিষয় একাধিক মতামত থাকতে পারে। যার মতামত কুরআন সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী তাই সবার অনুসরণ করা উচিত। তবে অন্যমতকেও সম্মানের চোখে দেখা উচিত, কারন ইসলামি শরীয়তের মৌলিক বিষয়ে বাতিল ফির্কা ছাড়া কার মাঝে বিভেধ নেই। (সব বিষয় আল্লাহই ভাল জানেন)। আমিন।।।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “সফরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানঃ তৃতীয় কিস্তি

Leave a comment