ছোট শির্কের উদাহরন (দ্বিতীয় পর্ব)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

 *** লোক দেখান আল্লাহর ছাড়া অন্যের সন্তষ্টির জন্য জাকাত বা দান ছদগা করা

শুধু লোক দেখাবার জন্য সে যেসব জাকাত বা দান ছদগা করা হয়। সেগুলো সুস্পষ্টভাবে একথাই প্রকাশ করে যে, সৃষ্টিকেই সে স্রষ্টা মনে করে এবং তার কাছ থেকেই নিজের দানের প্রতিদান চায়। আল্লাহর কাছ থেকে সে প্রতিদানের আশা করে না। একদিন সমস্ত কাজের হিসেব-নিকেশ করা হবে এবং প্রতিদান দেয়া হবে, একথাও সে বিশ্বাস করে না। প্রবল বর্ষণে যেমন পাথরের উপরের মাটি ধুয়ে পরিস্কার করে দেয়, লোক দেখান আল্লাহর ছাড়া অন্যের সন্তষ্টির জন্য জাকাত বা দান ছদগা ও নেকিহীন পরিছন্ন দান হিসাবে পরিগনিত হয়। তার এই দান অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া নেয়ামতকে তাঁর পথে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ব্যয় করার পরিবর্তে মানুষের সন্তুষ্টি লাভের জন্য ব্যয় করে অথবা আল্লাহর পথে কিছু অর্থ ব্যয় করলে ব্যয় করার সাথে কষ্টও দিয়ে থাকে, সে আসলে অকৃতজ্ঞ এবং আল্লাহর অনুগ্রহ বিস্মৃত বান্দা। আর সে নিজেই যখন আল্লাহর সন্তুষ্টি চায় না তখন তাকে অযথা নিজের সন্তুষ্টির পথ দেখাবার আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। তাই তো মহান আল্লাহ বলেন,

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُبۡطِلُواْ صَدَقَـٰتِكُم بِٱلۡمَنِّ وَٱلۡأَذَىٰ كَٱلَّذِى يُنفِقُ مَالَهُ ۥ رِئَآءَ ٱلنَّاسِ وَلَا يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأَخِرِ‌ۖ فَمَثَلُهُ ۥ كَمَثَلِ صَفۡوَانٍ عَلَيۡهِ تُرَابٌ۬ فَأَصَابَهُ ۥ وَابِلٌ۬ فَتَرَڪَهُ ۥ صَلۡدً۬ا‌ۖ لَّا يَقۡدِرُونَ عَلَىٰ شَىۡءٍ۬ مِّمَّا ڪَسَبُواْ‌ۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِى ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡكَـٰفِرِينَ (٢٦٤)

অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা বলে বেড়িয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান খয়রাতকে সেই ব্যক্তির মতো নষ্ট করে দিয়ো না যে নিছক লোক দেখাবার জন্য নিজের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, অথচ সে আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে না এবং পরকালেও বিশ্বাস করে না ৷ তার ব্যয়ের দৃষ্টান্ত হচ্ছেঃ একটি মসৃণ পাথরখন্ডের ওপর মাটির আস্তর জমেছিল৷ প্রবল বর্ষণের ফলে সমস্ত মাটি ধুয়ে গেলো৷

এখন সেখানে রয়ে গেলো শুধু পরিষ্কার পাথর খন্ডটি ৷ এই ধরনের লোকেরা দান  খয়রাত করে যে নেকী অর্জন করে বলে মনে করে তার কিছুই তাদের হাতে আসে না ৷ আর কাফেরদের সোজা পথ দেখানো আল্লাহর নিয়ম নয়। (বাকারা ২:২৬৪) 

কাউকে খুশী করা, কারো প্রশংসা বা বাহ বাহ কুড়ানোর জন্য অনেকেই জাকাত দেন/দান করে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে ছাওয়াবের নিয়তে যে কোনো ভাল কাজ করা ইবাদতেরই অংশ। আর ইবাদত পাওয়ার একমাত্র যোগ্য সত্তাই হচ্ছেন, মহান  রাব্বুল আলামীন। যে জন্য যে সকল ভাল কাজের সামান্য হলেও লোক দেখান বা প্রশংসা কুড়ানোর আশা বিদ্যমান থাকে, তা মূলত বাতিল। লোক দেখানো  অর্থ ব্যয় না করে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার জন্যই অর্থ ব্যয় করলে আল্লাহ তাকে পুরাপুরি প্রতিদান দিবেন। মহান আল্লাহ তায়ালান বলেনঃ

۞ لَّيۡسَ عَلَيۡكَ هُدَٮٰهُمۡ وَلَـٰڪِنَّ ٱللَّهَ يَهۡدِى مَن يَشَآءُ‌ۗ وَمَا تُنفِقُواْ مِنۡ خَيۡرٍ۬ فَلِأَنفُسِڪُمۡ‌ۚ وَمَا تُنفِقُونَ إِلَّا ٱبۡتِغَآءَ وَجۡهِ ٱللَّهِ‌ۚ وَمَا تُنفِقُواْ مِنۡ خَيۡرٍ۬ يُوَفَّ إِلَيۡڪُمۡ وَأَنتُمۡ لَا تُظۡلَمُونَ (٢٧٢)

অর্থঃ মানুষকে হিদায়াত দান করার দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পিত হয়নি ৷ আল্লাহ যাকে চান তাকে হিদায়াত দান করেন ৷ তোমরা যে ধনসম্পদ দান খয়রাত করো, তা তোমাদের নিজেদের জন্য ভালো ৷ তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার জন্যই তো অর্থ ব্যয় করে থাকো ৷ কাজেই দানখয়রাত করে তোমরা যা কিছু অর্থ ব্যয় করবে , তার পুরোপুরি প্রতিদান দেয়া হবে এবং এ ক্ষেত্রে কোন ক্রমেই তোমাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হবে না। (সুরা বাকারা ২:২৭২)

লোক দেখান অনিচ্ছাকৃত দান মুনাফিকের লক্ষন। মুনাফিকেরা আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য দান করত না। মনে গহিনে দানের প্রতিরোধ স্পস্ট তারপরও দান কারণ লোক দেখান (রিয়া)। আল্লাহ কাছে তাদের দেয়া সম্পদ গৃহীত হবে না। মহান আল্লাহ তায়ালান বলেন,

 وَمَا مَنَعَهُمۡ أَن تُقۡبَلَ مِنۡہُمۡ نَفَقَـٰتُهُمۡ إِلَّآ أَنَّهُمۡ ڪَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَبِرَسُولِهِۦ وَلَا يَأۡتُونَ ٱلصَّلَوٰةَ إِلَّا وَهُمۡ ڪُسَالَىٰ وَلَا يُنفِقُونَ إِلَّا وَهُمۡ كَـٰرِهُونَ (٥٤)

অর্থঃ তাদের দেয়া সম্পদ গৃহীত না হবার এ ছাড়া আর কোন কারণ নেই যে, তারা আল্লাহ ও তার রসূলের সাথে কুফরী করেছে, নামাযের জন্য যখন আসে আড়মোড় ভাংতে ভাংতে আসে এবং আল্লাহর পথে খরচ করলে তা করে অনিচ্ছাকৃতভাবে।( সুরা তাওবা- ৯:৫৪)।  মহান আল্লাহ তায়ালান আরও বলেন:

 وَٱلَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمۡوَٲلَهُمۡ رِئَآءَ ٱلنَّاسِ وَلَا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَلَا بِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأَخِرِ‌ۗ وَمَن يَكُنِ ٱلشَّيۡطَـٰنُ لَهُ ۥ قَرِينً۬ا فَسَآءَ قَرِينً۬ا (٣٨)

অর্থঃ আর আল্লাহ তাদেরকেও অপছন্দ করেন, যারা নিজেদের ধনসম্পদ কেবল মাত্র লোকদেরকে দেখাবার জন্য ব্যয় করে এবং আসলে না আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে আর না আখেরাতের দিনের প্রতি৷ সত্য বলতে কি, শয়তান যার সাথী হয়েছে তার ভাগ্যে বড় খারাপ সাথীই জুটেছে৷ (সুরা নিসা ৪:৩৮)

লোক দেখান অনিচ্ছাকৃত আল্লাহর ছাড়া অন্যের সন্তষ্টির জন্য জাকাত বা দান ছদগা করা যে ছোট শির্ক এতে কারো কোন দ্বিমত আছে বলে বলে যানা যায় না। এ ব্যপারে উম্মতের বঈজমা হয়েছে।

 

*** কোরবানি ক্ষেত্রে যে সব ছোট শির্কে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা: 

শুধুই প্রশংসা বা বাহ বাহ কুড়ানোর জন্য হাটের সবচেয়ে বড় গরুটা আমার চাই দাম যা লাগে সমস্যা নাই। দাম বেশী হলেও সমস্যা নাই, মানুষতো প্রশংসা করল বা বাহ বাহ দিন তাতেই বা কম কিসে। অথবা শুধুই মাংশ খাওয়ার ইচ্ছা।

এটা একটা প্রমাণিত কথা যে, পশু উৎসর্গ করে জবেহ করা ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে করা শিরকে আকবর। আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন,

قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَا وَمَمَاتِيْ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ

অর্থঃ বল, নিশ্চয় আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু, জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ্‌র জন্য নিবেদিত। তাঁর কোন শরীক নেই, আর আমি এর প্রতি আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলমান। (সুরা আন আম ১৬২১৬৩)আল্লাহ্‌ তা’আলা আরো বলেন,

إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ

অর্থঃ আমি অবশ্যই তোমাকে (হাউজে) কাওসার দান করেছি, সুতরাং তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে নামায আদায় কর এবং কুরবানী কর। (সুরা আল কাওছার ১ & )

 

*** ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে যে সব ছোট শির্কে পতিত হওয়ার সম্ভাবনাঃ 

আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেন :

ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ دَرَجَـٰتٍ۬‌ۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٌ۬ (١١)

অর্থ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহ যাদেরকে জ্ঞান দান করেছেন তাদেরকে উচ্চমর্যাদায় উন্নীত করবেন। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত। (সুরা মুজাদালাহ ৫৮:১১)

আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম (জ্ঞান) অর্জন করার উদ্দেশ্যে পথ চলবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দিবেন। (তিরমিযী হা-২৬৪৬; ইখনু মাজাহ হা-২২৩; সহিহুল জামে‘ হা-৬২৯৮, সনদ সহিহ)।

রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ‘আলেমরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দিনার বা দিরহামের উত্তরাধিকারী করেন না। বরং তারা ইলমের উত্তরাধিকারী করেন। ফলে যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করল সে বৃহদাংশ গ্রহণ করল। (সহিহুল বুখারী হা/৭১)। আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন।’ (ইবনু মাজাহ হা/২২৩; সহিহুল জামে‘ হা/৬২৯৭, সনদ সহিহ।)

অতএব দ্বীনি ইলম অর্জন করা সবার জন্য খুবই জরুরি ও উপকারি। ইহার ফজিরত ও উপকার বলার অপেক্ষা রাখে না। কখন কখন দ্বীনি ইলম অর্জন করা ফরজে আইন হয়ে যায়। যেমন, আমলকারি যে আমল করবে, সে সম্পর্কে ইলম অর্জন ফরজে আইন। ইলম অর্জন ইবাদাত তাই গাইরুল্লার  উদ্দেশ্যে ইলম করা শির্ক। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ইলম অর্জন করতে হবে। পার্থিব কোনো উদ্দেশ্যে তা অর্জন করা যাবে না। অনেক টাকা পয়সা আয় করার জন্য ইলম অর্জন করে থাকে। আবার কেউ দুনিয়ার সুনাম সুখ্যাতি পাওয়ার আসায় ইলম অর্জন করে। সে ভাবে লোকে তাকে জ্ঞানি মনে করে সম্মান করবে। আলেম বলে সম্ভোধন করবে। কেই যদি এমনি ভাবে নিয়ত করে যে, আমি ইলম অর্জন করলে লোকে তাকে আলেম বলবে, ক্বারি বলবে, হাফিজ বলবে তবে তা শির্ক হবে। পার্থিব সুনাম-সুখ্যাতির উদ্দেশ্যে দ্বীনী ইলম অর্জন করা হলে তার পরিণাম হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। হাদীস শরীফে এসেছে যে, জাহান্নামে সর্বপ্রথম নিক্ষিপ্ত তিন ব্যক্তির একজন হবে ঐ আলিম, যে লোকের কাছে আলিম হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার জন্য ইলম চর্চা করেছে।

হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে দুনিয়াবী স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এমন ইলম শিখল, যা শুধু আল্লাহর জন্যই শেখা হয় সে কিয়াতমতের দিন জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। (আবু দাউদ : ৩৬৬৪)।

কাজেই ইলম অর্জনের প্রতিদান মহান আল্লাহর নিকট থেকে নিতে হলে শুধু মহান আল্লাহ উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করতে হবে। অর্থ, সুনাম, সুখ্যাতির নিয়ত পরিহার করতে হবে। তবেই শির্ক থেকে বাচতে পারব।

 

*** জিকিরের ক্ষেতে যে সব ছোট শির্কে পতিত হওয়ার সম্ভাবনাঃ 

জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সান্বিধ্য লাভ হয়। জিকির একটি ইবাদাত। আর এই নফল ইবাদাতটি করার জন্য স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা মুসলিম ব্যক্তিকে সকাল বিকাল জিকির করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

 يَـٰٓأَيُّہَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ ذِكۡرً۬ا كَثِيرً۬ا (٤١) وَسَبِّحُوهُ بُكۡرَةً۬ وَأَصِيلاً (٤٢)

অর্থঃ মুমিনগণ তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর। এবং সকাল বিকাল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা কর। (সূরা আহযাব ৩৩:৪১,৪২)

 নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর এই আদেশ পালন করছেন। সাহাবাদের (বাজিঃ) নিজ হাতে শিক্ষাদান করেছেন এবং তারা ও জিকির করেছেন। কাজেই তাদের ইবাদতের পদ্দতির বাহিরে নতুন কোন পদ্দতি আবিস্কার করলে হয় শির্ক হবে না হয় বিদআত হবে।  আল্লাহ তাকে স্মরন করার পদ্দতি বর্নণা করে বলেন,

 وَٱذۡكُر رَّبَّكَ فِى نَفۡسِكَ تَضَرُّعً۬ا وَخِيفَةً۬ وَدُونَ ٱلۡجَهۡرِ مِنَ ٱلۡقَوۡلِ بِٱلۡغُدُوِّ وَٱلۡأَصَالِ وَلَا تَكُن مِّنَ ٱلۡغَـٰفِلِينَ (٢٠٥) 

অর্থঃ হে নবী! তোমার রবকে স্মারণ করো সকাল সাঁঝে মনে মনে কান্নাজড়িত স্বরে ও ভীতি বিহ্বল চিত্তে এবং অনুচ্চ কণ্ঠে৷ তুমি তাদের অন্তরভুক্ত হয়ো না যারা গাফলতির মধ্যে ডুবে আছে৷ (সুরা আরাফ ৭:২০৫)

আবূ মূসা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা কোন এক সফরে নবী (সা)-এর সঙ্গে ছিলাম। আমরা উঁচু স্থানে উঠার সময় তাকবীর বলতাম। তখন নবী (সা) বললেন : তোমরা তোমাদের নফসের উপর একটু সদয় হও। কেননা, তোমরা ডাকছ না বধির কিংবা অনুপস্থিত কাউকে। বরং তোমরা ডাকছ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা এবং ঘনিষ্ঠতমকে। (সহিহ বুখারী; খন্ড-৯; হাদিস ৪৮৪)।

লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে সশব্দে জিকির করা যে রিয়া বা ছোট শির্ক তাতে কেউ সন্দেহ করে না। এমনকি সশব্দে জিকির করার পক্ষে যারা মত দিয়েছেন তারাও ইহাকে রিয়া বা ছোট শির্ক বলে বিশ্বাস করে। তাছাড়া মনে মনে সবিনয় ও সশংকচিত্তে অনুচ্চস্বরে আল্লাহর জিকির করাতো মহান আল্লাহর নির্দেশ।

আল্লাহর স্মরনের পরিবর্তে গায়রুল্লাহকে স্মরন করলে শির্ক হবে। শয়তান অনেক সময় মানুষকে গায়রুল্লার জিকির করতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। তখন তারা পীর, অলী, গাউস. কুতুর, জ্বীন,ভুত ইত্যাদির জিকির করে থাকে যা মুলত শির্কে আকবর। যারা হক পন্থিপীর দাবি করে, তারাও মুরিদদের পীরের ধ্যান করার আদেশ  দেন। আর শতভাগ ভন্ডরা বলে, জিকিরের সময় মনে করতে হবে আমার পীরের ক্বলব হতে যিকিরের তাছির, ফায়েজ, তাওয়াজ্জুহ সরাসরি আমার ক্বলবে প্রবেশ করছে। জিকির করব আল্লাহর আর ধ্যান করব পীরের আর ফায়েজও আসবে পীর থেকে এ কেমন অবিচার।

অনেক শির্ক পন্থিপীর জিকিরের সুন্নাহ বিরোধী পদ্দিতি দিয়ে বলে থাকেন। এই গদ্দতিতে জিকির করতে পারলে অল্প দিনের মধ্যেই জিকিরের হালত পয়দা হবে। ক্বলবের মাকাম ও রং স্পষ্ট দেখা যাবে। শরীরকে হালকা মনে হবে। যিকিরের মাধ্যমেই আধ্যাত্মিকভাবে মক্কা-মদিনা, আরশ, কুরসী, লৌহ মাহফুজ, জান্নাত প্রভৃতি বিষয়াবলী দেখতে পারবেন। আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পেলে অদৃশ্য জগতে ভ্রমণও করতে পারবেন। অর্থাৎ এলমে গাইবের অধিকারী হবেন।

কিন্তু দুঃথের বিষয় হল এমন হালত আমাদের অনুসরনীয় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও হয়নি। কোন সাহাবি এমনটি দাবি করছেন বলে কেউ প্রমান করতে পারবে না। তাহলে নিশ্চয় ইহা আলাদা তরিকা বা পথ। শির্কি পথ। ইহা ইসলামের কোন পথ নয়।

মানিক গজ্ঞের এক পীর তার অনেকগুলি লিখিত বই আছে। তার প্রতিটি বইয়ের শেষে তৃতীয় সবকের সাছিরে লিখেছেন, এই সবকের তাসিরে ছত্রিশ কোটি পশমের গোড়া গিয়ে আল্লাহর জিকির বাহির হবে। এবং কোন কোন সময় হালত এরকম হবে, দেখবেন, নাভী হতে দেহের উপরের অংশ কোটি কোটি মাইল উর্ধ্বে উঠে গিয়েছে। নাভির নিচের অংশ টুকু জমিনে পড়ে আছে। এ আবার কেমন হালত যা কোন নবী, রাসুল, সাহাবি কারোই হয়নি। যা কুরআনে নেই, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও বলে নাই, সাহাবিগন ও জানেন না, তা কি করে ইসলাম হয়?  আর যদি কেউ,  জিকিরের মাধ্যমে নামাযে বা অন্য কোনো ইবাদতে বিঘ্ন ঘটায়, কোনো ব্যক্তির বিশ্রামে সমস্যা করে, আওয়াজ বড় করে অর্থাৎ  চিৎকার করে বা মাইক ব্যবহার করে জিকির তবে তা সুন্নাহ বিরোধী হবে। এমন কি যে সকল জিকিরে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সময় ও সংখ্যা নির্ধারন করন নাই, সে সকল জিকিরে সময় ও সংখ্যা নির্ধারন করা সুন্নাহ বিরোধী।

 

*** সুকণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত ক্ষেতে যে সব ছোট শির্কে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা:

কুরআন তেলাওয়াত করা নফল ইবাদাত হলেও আল্লাহ তা‘আলা কুরআন শিক্ষা করা ফরয করে দিয়েছেন। প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন পড়া জানতে হবে। সহিহ শুদ্ধ ভাবে কুরআন তেলাওয়াত না জানলে গুরিত্বপূর্ণ আমল সালাত পরিপূর্ন হবে না। তাই যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম হিসাবে দাবী করবে তাকে অবশ্যই কুরআন শিক্ষা করতে হবে। কুরআন শিক্ষা করা এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, আল্লাহ তা‘আলা সর্ব প্রথম কুরআনের যে আয়াতটি নাজিল করেন তাতে কুরআন পড়ার নির্দেষ দান করেন।

 আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ( ٱقۡرَأۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلَّذِي خَلَقَ ) পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আলাক ৯৬:০১) কুরআন শিক্ষায় কোন প্রকার অবহেলা করা যাবে না। উম্মাতকে কুরআন শিক্ষার নির্দেশ দিয়ে  ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,অর্থঃ‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তিলাওয়াত কর’ [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ:৮৫৭২]।

কুরআন তেলাওয়াত করাকে আল্লাহ ব্যবসায়ের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। মানুষ ব্যবসার জন্য নিজের অর্থ, শ্রম, ও মেধা নিয়োগ করে কিছু মুনাফা অর্জন করার জন্য। কিন্তু তার ব্যবসায় লাভ এবং ক্ষতি দুটিরই সম্ভাবনা থাকে। কুরআন তেলাওয়াত এমন ব্যবসা যেখানে লাভ ছাড়া কোন প্রকার ক্ষতির আশংকা নেই। কুরআন তিলাওয়াত আল্লাহর সাথে একটি লাভজনক ব্যবসা। । এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّ ٱلَّذِينَ يَتۡلُونَ كِتَـٰبَ ٱللَّهِ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنفَقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَـٰهُمۡ سِرًّ۬ا وَعَلَانِيَةً۬ يَرۡجُونَ تِجَـٰرَةً۬ لَّن تَبُورَ (٢٩) لِيُوَفِّيَهُمۡ أُجُورَهُمۡ وَيَزِيدَهُم مِّن فَضۡلِهِۚۦۤ إِنَّهُ ۥ غَفُورٌ۬ شَڪُورٌ۬ (٣٠) 

অর্থঃ যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরো অধিক দান করবেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান। (সূরা ফাতির ৩৫:২৯৩০]

যে কুরআন শিখা থেকে  থেকে বিমুখ হয়ে থাকল, সে কতইনা দুর্ভাগা! আলকুরআনে এসেছে,

 وَمَنۡ أَعۡرَضَ عَن ذِڪۡرِى فَإِنَّ لَهُ ۥ مَعِيشَةً۬ ضَنكً۬ا وَنَحۡشُرُهُ ۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَـٰمَةِ أَعۡمَىٰ (١٢٤) قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرۡتَنِىٓ أَعۡمَىٰ وَقَدۡ كُنتُ بَصِيرً۬ا (١٢٥) قَالَ كَذَٲلِكَ أَتَتۡكَ ءَايَـٰتُنَا فَنَسِيتَہَا‌ۖ وَكَذَٲلِكَ ٱلۡيَوۡمَ تُنسَىٰ (١٢٦

অর্থঃ আর যে আমার যিকর (কুরআন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে,  নিশচয় তার জীবন যাপন হবে  সংকুচিত এবং আমি কিয়ামতের দিন তাকে অন্ধ অবস্থয় উঠাবো। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন?  অথচ আমিতো ছিলাম দৃষ্টিশক্তিসম্পন্নণ?  তিনি বলবেন, অনুরুপভাবে তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, অত:পর তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল। (সূরা ত্বহা ২০:১২৪১২৬)

 যে ব্যবসায় লাভ বেশী সেই ব্যবসায় লোকশান হলে ক্ষতির পরিমান ও বেশী হয়। কুরআন তেলাওয়াত যদি আল্লাহর সন্ত্বষ্টির জন্য না হয়ে অন্য কারনে হয়ে থাকে তবেতো ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। যে ব্যক্তি শুধু দুনিয়াবাসিকে শুনানোর জন্য কুরআন তেলাওয়াত করল, সে ছোট শির্ক করল। কুরআন তেলাওয়াত  ইবাদাত আর গাইরুল্লার জন্য ইবাদাত শির্ক। অনেকের আবার কুরআন তেলাওয়াত খুবই সুমধুর। সবাই তাদের কুরআন তেলাওয়াত শুনেন আর প্রশংসা করে। প্রশংসা শুনে শ্রতাদের খুসি করার জন্য তেলাওয়াত করে। শ্রতাদের খুসি করার জন্য তেলাওয়াত নিশ্চই শির্ক হবে। ইদনিং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কুরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। কেউ যদি নিজের সুনাম সুখ্যাতি অর্জনের জন্য তেলাওয়াত করে তবে তাও শর্ক হবে।

 লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে জিহাদঃ

হযরত আবু মুসা আশ’আরী (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলোঃ এক ব্যক্তি শৌর্য-বীর্য প্রদর্শনের জন্য, এক ব্যক্তি আত্মগৌরব ও বংশীয় মর্যাদার জন্য এবং অপর এক ব্যক্তি লোক দেখানের জন্য লড়াই করে। এদের মধ্যে কে আল্লাহর পথে জিহাদ করে? রাসূলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি কেবল আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার জন্য লড়াই করে সে-ই আল্লাহর পথে রয়েছে। (বুখারী, মুসলিম ও রিয়াযুস স্ব-লিহীন)।

হযরত আবু বাকরাহ নুফাই’ ইবনে হারিস সাকাফী (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন দু’জন মুসলমান তরবারী কোষমুক্ত করে পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয়, তখন হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়েই জাহান্নামের যোগ্য হয়ে যায়। আমি নিবেদন করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল! হত্যাকারীর জাহান্নামের হকদার হওয়াটাতো বুঝলাম; কিন্তু নিহত ব্যক্তির জাহান্নামী হওয়ার কারণটা কী? রাসূলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ কারণটা হলো এই যে, সেও তো  তার প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে চেয়েছিল। (বুখারী, মুসলিম ও রিয়াযুস স্ব-লিহীন)।

এক ব্যক্তি  কাছে এসে বললেন, ঐ ব্যক্তি সম্মন্ধে কি বলেন, যে ব্যক্তি সোওয়াব ও সুনামের জন্য জিহাদ করে, তার জন্য কি রয়েছে? বললেন, তার জন্য কিছুই নেই। সে ব্যক্তি তিন বার পূণরাবৃত্তি করল। তিন বার একই উত্তর দিলেন। তারপর তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য কৃত আমল ব্যতিত, যা দ্বারা আল্লাহ সন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছুই উদ্দেশ্য না হয়, আর কিছুই কবুল করেন না।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment