লাইলাতুল মিরাজ এবং ইহার ভুলভ্রান্তী দ্বিতীয় কিস্তি

লাইলাতুল মিরাজ এবং ইহার ভুলভ্রান্তী দ্বিতীয় কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

৬। লাইলাতুল মিরাজ উদযাপন বা আমল করা ইসলামী কাজ নয়ঃ

সহজেই বুঝতে পারছি মিরাজের ঘটনা প্রবাহ শতভাগ সঠিক হলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকে এ রাতটি কোন অবস্থায়ই প্রমানিত হয় নাই। যদি এই রাত্রিটি সুনির্দিষ্টভাবে প্রমানিত হত, তহলেও এই রাত্রিতে বিশেষ কোন ইবাদত পালন করা বা বিশষভাবে পালন করা কোন ঈমানদারের জন্য জায়েয হবে না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীবর্গ এ দিবসটি বিশেষভাবে পালণ করেননি এবং এ দিবসে বিশেষ কোন ইবাদত আদায় করেননি। যদি সে দিবসটি পালন করা শরিয়তের বিধান হত তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের জন্য সেটা বর্ণনা করতেন। হয়তো কথার মাধ্যমে কিংবা তাঁর আমলের মাধ্যমে। আর সে রকম কিছু ঘটলে সে কথা সবাই জানতে পারত এবং সাহাবায়ে কেরাম আমাদের কাছে সেটা বর্ণনা করতেন। কেননা, উম্মতের যা কিছু প্রয়োজন এর সবকিছু তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। দ্বীনি কোন বিষয় বর্ণনা করার ক্ষেত্রে তাঁরা অবহেলা করেননি। বরং তাঁরা যে কোন ভাল কাজে অগ্রণী ছিলেন। যদি এ দিবসটি উদযাপন করা শরিয়তসম্মত হত তাহলে তাঁরা সবার আগে সেটা উদযাপনে এগিয়ে যেতেন। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন মানুষের জন্য সর্বাধিক কল্যাণকামী। তিনি রাসূলের দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করেছেন, আমানত যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। সুতরাং এ রাতকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া ও পালন করা যদি দ্বীনি বিষয় হত তাহলে এক্ষেত্রে তিনি গাফেল থাকতেন না এবং এটি গোপন করতেন না। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এমন কিছু আসেনি অতএব বুঝতে হবে এ রাতকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া ও এ রাতটি উদযাপন করা ইসলামী কাজ নয়। আল্লাহ্‌ তাআলা এ উম্মতের জন্য দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র অনুমোদন ছাড়া এ দ্বীনের মধ্যে নব কিছু চালু করবে তার নিন্দা করেছেন।

আল্লাহ্‌ তাআলা সূরা মায়িদাতে বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন (ধর্ম) হিসেবে পছন্দ করলাম।” (সূরা মায়িদা ৫:৩)।

সহিহ হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম কর্তৃক বিদআত যে কঠিন হুশিয়ার দিয়েছেন তাতো আমরা জানিই। কাজেই সতর্ক হই সময় আছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিরাজ হয়েছে এটা ঠিক এবং তা কোরআন ও হাদিস দ্বারা প্রমানিত। এবং এই বিষয় অস্বিকার করলে তার ঈমানই থাকবেনা। শবে মিরাজের আমলের গুরুত্ব যদি থাকতো তাহলে সহিহ বর্ণনায় অবশ্যই পাওয়া যেত। আমার মুসলিম ভাই ও বোনেরা আমরা সেই আমলটিই করবো যেই আমল কুরআন ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এর বাইরে যদি আমরা কোন কিছু করি তাহলে বিদআত হবে। বিধায় রজব মাসকে কেন্দ্র করে মিরাজ উৎযাপন করা বা পালন করা এটা বিদয়াত হবে। আমাদের আমল পরিত্যায্য হতে পাবে। এই বিষয় গুলো আল্লাহ আমাদের বোঝার তাওফিক তান করুন।

। লাইলাতুল মিরাজের আমলঃ

লাইলাতুল মিরাজে কোন প্রকার আমল সহিহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত নয়।  যারা আমল করে তারাও জানেন যে, লাইলাতুল মিরাজ উপলক্ষে বিশেষ কোনো আমলের কথা শরীয়তে উল্লেখ করা হয়নি। তারপরও এ রাতে আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশেষ ইবাদত বন্দেগিতে লিপ্ত থাকতে পছন্দ করে থাকেন। এই  রাতকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মসজিদ কমিটি কিংবা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে ওয়াজ ও দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রথা বহুদিন যাবত চলে আসছে। সারা রাত জিকির, কুরআন তিলওয়াত, নফল সালাত, দুরুত, দুয়া, ইস্তেগফার ইত্যাদিরম মাধ্যে কাটিয়ে দেয়। অনেকে রাতে কবর স্থানে যায় এবং মৃত ব্যক্তিদের জন্যে দোয়া করা ও দরুদ-ইস্তেগফার পাঠ করে। লাইলাতুল মিরাজের পরদিন অর্থাৎ ২৭ রজব নফল রোজা রাখে।  

৮। লাইলাতুল মিরাজের ফজিলত সম্পর্কে শতভাগ জাল হাদিসসমূহঃ

এমন হেড লাইন কেন দিলাম? যেহেতু বহু গবেষনা করেও লাইলাতুল মিরাজের কোন নির্দিষ্ট রাত নির্ধারণ করতে পারি নাই। যেখানে রাতটি খুজে পেলাম না তো আমল খুজে পাব কিভাবে। আমল পেলাম তো ফজিলত পাব কোথায়? তাই লাইলাতুল মিরাজের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস পাওয়া খুবই হাস্যকর ব্যাপার। কিন্তু বিদআতিদের লেখায় এবং ওয়েব সাইডে ঠিকই বহু জাল হাদিস আছে। তাই শতর্ক করার জন্য কিছু জাল কথা তুলে ধরছি। একটা কথা প্রতিধান যোগ্য, যদি লাইলাতুল মিরাজের কোন ফজিলতের কথা বলে হয় তবে তা অবশ্য রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস হবে। কারন আমলে পদ্ধতি ও  ফজিলত হলো অহী, যা মহান আল্লাহর তরফ থেকে আসে। শবে বরতাতের কোন ফজিলাত যেহেতু সহিহ বা যঈফ হাদিস নেই। তাই এই জালগুলি রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম উল্লেখ না করে বলা দেয়া হলোঃ

১। শবে মেরাজ উপলক্ষে নফল নামাযের নিয়তে দুই রাকআত করে মোট ১২ রাকআত নামায পড়তে হবে। প্রতি রাকআতে সূরা ফাতিহার সাথে অন্য যে কোন সূরা পড়া যাবে। নামায শেষে ১০০ বার পড়ুনঃ সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়ালা ইলাহা ইল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর। ১০০ বার যে কোন ইস্তেগফার (আস্তাগফিরুল্লাহা রাব্বি মিন কুল্লি জাম্বিওঁ ওয়া আতুবু ইলাইহি, লা হাওলা ওয়া লা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম।’ ১০০ বার যেকোন দরুদ শরীফ (আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদিম মাদানিল জুদি ওয়াল কারামি মাম্বাইল ইলমি ওয়াল হিলমি ওয়াল হিকামি ওয়া আলা আলিহী ওয়া আসহাবিহী ওয়া বারিক ওয়া সাল্লিম)। এরপর পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল আল্লাহ পাকের নিকট দুনিয়া ও আখিরাতের যেকোন কল্যাণকর দো’আ করুন এবং দিনে রোযা রাখুন। ইনশা’আল্লাহ দো’আ কবূল হবে। ১০০ শত বছরের ইবাদতের সওয়াব!  (কানযুল উম্মাল, খন্ড-১২, পৃষ্ঠাঃ ৩১২-৩১৩, হাদিস নম্বরঃ ৩৫১৭০, এহইয়া উলুমুদ্দীন, বায়হাকী শরীফ, খন্ড-৩, পৃষ্ঠাঃ ৩৭৪, মাসাবাতা বিসুন্নাহ, পৃষ্ঠাঃ ৭০)  শবে মেরাজের রোযাঃ

২। রজব মাসের মধ্যে এমন এক দিন এবং রাত আছে, যা বড় মর্যদাবান। যেই ব্যক্তি ঐ দিনে রোজা এবং রাতে ইবাদত করবে, আল্লাহ পাক তার আমল নামাই ১০০ শত বছর লাগাতার রোজা রাখা এবং নামায পড়ার সওয়াব দান করবেন। আর সেই সময়টি হল, রজব মাসের ২৭ তারিখের (শবে মেরাজের) দিন এবং রাত। (দুররুল মনসুর, আল জামেয়ুল কবীর, জামেয়ুল আহাদীস ওয়াল ওরাসিল, শুআবুল ইমান।

৩। বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মেরাজ ভ্রমণে যান তখন তিনি রোজা অবস্থায় ছিলেন। তাই তাঁর স্মরণে রোজা পালন করা অবশ্যই ফজিলত হিসেবে গণ্য হবে। সহিহ হাদিসে আশুরার সিয়াম পালনে  ইহুদিদের বিরোধীতা করার কথা বলা হয়েছে কিন্তু অনেক ভন্ড আলেম এই রাতের পর দিনের সিয়াম সম্পর্ক বলেন, তোমরা ইহুদিদের বিরোধিতা ও আল্লাহর অধিক সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্ত অন্তত দুটি রোজা রাখো। তাই রজবের ২৬-২৭ বা ২৭-২৮ তারিখে এই রোজা রাখা উত্তম।

লাইলাতুল মিরাজ সম্পর্কে প্রচলিত মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কাহিনীঃ

৯। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আরশে আরোহণঃ

সমাজে প্রচলিত আছে মিরাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুতা পায়ে আরশে আরোহণ করেছিলেন।

 মন্তব্যঃ ডঃ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ, হাদিসের নামে জালিয়াত কিতাবে লিখেন, কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট একটি কথা। মি’রাজের ঘটনা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসিদ্ধ ৬টি হাদীস গ্রন্থ সহ সকল হাদীস গ্রন্থে প্রায় অর্ধ শত সাহাবী থেকে বিভিন্নভাবে মি’রাজের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সিহাহ সিত্তার এ বিষয়ক হাদীসগুলো আমি ভালভাবে পড়ার চেষ্টা করেছি। এছাড়া মুসনাদ আহমাদসহ প্রচলিত আরো ১৫/১৬টি হাদীস গ্রন্থে এ বিষয়ক হাদীসগুলো পাঠ করার চেষ্টা করেছি। কুরআনে এবং এ সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গমনের কথা বারংবার বলা হয়েছে। তিনি সিদরাতুল মুনতাহার ঊর্ধ্বে বা আরশে গমন করেছেন বলে কোথাও উল্লেখ করা হয় নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাগ্রত অবস্থায় স্বশরীরে মি’রাজে গমন করেন এবং সিদরাতুল মুনতাহার সর্বোচ্চ মাকামে আল্লাহর সান্নিধ্য বা ‘দীদার’  লাভ করেন বলে এ সকল হাদীস প্রমাণ করে। রাফরাফে চড়া, আরশে গমন করা ইত্যাদি কথা সিহাহ সিত্তা, মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস-গ্রন্থে সংকলিত কোনো হাদীসে নেই।  ৫/৬ শতাব্দী পর্যন্ত সংকলিত ইতিহাস ও সীরাত বিষয়ক গ্রন্থগুলোতেও এ বিয়য়ে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। দশম হিজরী শতাব্দী ও পরবর্তী যুগে সংকলিত সীরাতুন্নবী বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থে মি’রাজের বিষয়ে রাফরাফ-এ আরোহণ, আরশে গমন ইত্যাদি ঘটনা বলা হয়েছে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবীর আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি, যে সকল হাদীস কোনো প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে পাওয়া যায় না, বরং ৫ম হিজরী শতকে বা তার পরে কোনো কোনো মুহাদ্দিস বা বিষয়ভিত্তিক লেখক তা সংকলন করেছেন, সেগুলো সাধারণত বাতিল বা অত্যন্ত দুর্বল সনদের হাদীস। বিশেষত ১১শ-১২শ শতাব্দীর গ্রন্থাদিতে সহীহ, যয়ীফ ও মাউযূ সবকিছু একত্রে মিশ্রিত করে সংকলন করা হয়েছে।

আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী যারকানী (১১২২ হি) ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা ‘শারহুল মাওয়াহিব’ গ্রন্থে আল্লামা রাযী কাযবীনীর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘কোনো একটি সহীহ, হাসান অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন। বরং বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তথায় এমন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন যে, কলমের খসখস শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। যিনি দাবি করবেন যে, রাসূলুল্লাহ সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন তাকে তার দাবীর পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে। আর কিভাবে তিনি তা করবেন! একটি সহীহ অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি আরশে আরোহণ করেছিলেন। কারো কারো মিথ্যাচারের প্রতি দৃকপাত নিষ্প্রয়োজন। (যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ৮/২২৩)।

১০। জুতা পায়ে আরশে উঠা সম্পর্কে সমাজে বহুল প্রচলিত একটি জাল হাদীসঃ

মি’রাজের রাত্রিতে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে উচ্চতম আকাশমন্ডলিতে নিয়ে যাওয়া হলো এবং আরশে মু‘আল্লায় পৌঁছালেন, তখন তিনি তাঁর পায়ের জুতা খুলার ইচ্ছা করেন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা মূসাকে (আ) বলেছিলেন,‘‘তুমি তোমার জুতা খোল। তুমি পবিত্র ‘তুয়া’ প্রান্তরে রয়েছ।’’ ত্বহা ২০:১২)।  তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আহবান করে বলা হয়, হে মুহাম্মাদ, আপনি আপনার পায়ের জুতা খুলবেন না। কারণ আপনার জুতাসহ আগমনে আরশ সৌভাগ্যমন্ডিত হবে এবং অন্যদের উপরে বরকতের অহংকার করবে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুতা পায়ে রেখেই আরশে আরোহণ করেন।’’

মন্তব্যঃ ডঃ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ, হাদিসের নামে জালিয়াত কিতাবে লিখেন, এ কাহিনীর আগাগোড়া সবটুকুই বানোয়াট। এ কাহিনীর উৎপত্তি ও প্রচারের পর থেকে মুহাদ্দিসগণ বলছেন যে, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসও এ সকল মিথ্যা কথা নির্বিচারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে বলেন। এ সকল কথা তাঁরা কোন্ হাদীস গ্রন্থে পেয়েছেন তাও বলেন না, খুঁজেও দেখেন না, আবার যারা খুঁজে দেখে এগুলোর জালিয়াতির কথা বলেছেন তাঁদের কথাও পড়েন না বা শুনতে চান না। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করুন। (যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ৮/২২৩; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৩৭; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ৫৩০)।

আল্লামা রাযিউদ্দীন কাযবীনী, আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-মাক্কারী, যারকানী, আব্দুল হাই লাখনবী, দরবেশ হূত প্রমুখ মুহাদ্দিস এ কাহিনীর জালিয়াতি ও মিথ্যাচার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী এ প্রসঙ্গে বলেন: ‘‘এ ঘটনা যে জালিয়াত বানিয়েছে আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মি’রাজের ঘটনায় বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশি। এত হাদীসের একটি হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজের সময় পাদুকা পরে ছিলেন। এমনকি একথাও প্রমাণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরশে আরোহণ করেছিলেন। (আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার  পৃষ্ঠা-৩৭, হাদীসের নামে জালিয়াতি, ডঃ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ)

 

১১। মিরাজের রাত্রিতে আত্তাহিয়াতু লাভঃ

আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত কথা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজের রাত্রিতে ‘আত্তাহিয়াতু’ লাভ করেন।

বিষয়ে প্রচলিত একটি গল্পঃ  গল্পটির সার-সংক্ষেপ হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মিরাজের রাত্রিতে যখন সর্বচ্চ নৈকট্যে পৌঁছান তখন মহান আল্লাহকে সম্ভাষণ করে বলেনঃ ‘আত্তাহিয়াতু লিল্লাহি ওয়াস সালাওয়াতু ওয়াত্ তাইয়েবাতু অর্থাৎ সমস্ত শ্রদ্ধা, ভক্তি, সম্মান, সমস্ত ইবাদত ও পবিত্রতা আল্লাহর জন্য। আল্লাহ্ তায়ালা এর জবাবে ইরশাদ করেন, আস-সালামু আলায়কা আইয়্যুহান নাবীও ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু  অর্থাৎ হে নবী সালাম, আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত আপনার প্রতি। সময় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের উম্মতের কথা মনে পড়ে গেল। তখন তিনি বলে উঠলেন, আস-সালামু আলায়না ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস্ সালিহীন অর্থাৎ সালাম (শান্তি) বর্ষিত হোক আমাদের ওপর এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপর। তখন জিবরীল আলাইহিস সালাম ও অন্য সকল আকাশবাসী বলেন, আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই। আল্লাহ পক্ষ থেকে জবাব এলো, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রসূলুহু অর্থাৎ আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহম্মদ তাঁর বান্দা ও রসূল।

ইমাম কুরতুবী বলেনঃ এ গল্পটির কোন ভিত্তি আছে বলে জানা যায় না। কোথাও কোনো গ্রন্থে সনদসহ বর্ণিত হয়েছে বলেও জানা যায় না। মি’রাজের ঘটনা বিভিন্ন হাদীস ও সিরাত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও কোনো সনদসহ বর্ণনায় মি’রাজের ঘটনায় এ কাহিনীটি বলা হয়েছে বলে আমি দেখতে পাইনি। সনদবিহীন ভাবে কেউ কেউ তা উল্লেখ করেছেন। (কুরতুবী, তাফসীর ৩/৪২৫

শাকীক ইবন সালামাহ (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদ (রা) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিছনে সলাত আদায়কালে বলতাম, ‘আসসালামু আলা জিবরীল, ওয়া মিকাঈল এবং আসসালামু আলা ফুলান ওয়া ফুলান’। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আল্লাহ নিজেই তো সালাম, তাই তোমাদের কেউ সলাত আদায়কালে যেন বলে, (আত্তাহিয়াতু লিল্লাহি ওয়াসসলাওয়াতু ওয়াতত্বাইয়েবাতু, আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস স্বলেহিন) আমাদের সব সালাম ও অভিবাদন, সলাত ও দু’আ এবং পবিত্রতা মহান আল্লাহর জন্য। হে নাবী! আপনার উপর সালাম, আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ বর্ষিত হোক। আমাদের ও আল্লাহর সকল নেক বান্দাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। কেননা তোমরা যখন এটা পাঠ করবে তখন তা আসমান ও যমিনের মাঝে যত নেক বান্দা আছে সবার নিকটেই পৌঁছে যাবে। আর সাথে এটাও পড়বে (আশহাদু আল-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ)। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। আমি সাক্ষ্য আরও দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। (সহিহ বুখারী ৮৩১, ৬২৩০, ৬৩২৮, ৭৩৮১; সহিহ মুসলিম ৪০২; আবু দাউদ ৯৬৮; ইবন মাযাহ ৮৯৯; নাসাঈ ১১৬৮, ১১৬৯; বুলুগুল মারাম ৩১৪; তিরমিযি ২৮৯; আহমাদ ৭০৮, ৭১৩; মিশকাতুল মাসাবীহ ৯০৯; দারিমী ১৩৪০,১৩৪১, ১৩৪৬; ইবন খুজায়মাহ ৭০৪; ইরওয়া ৩৩৬)

 

১২। মিরাজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাতাশ বছর সময় লেগেছিলঃ

আমাদর সমাজের এক শ্রেণীল বক্তা প্রায়ই ওয়াজের মাহফিলে বলে থাকেন, মিরাজের রাত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাতাশ বছর সময় ব্যয় হয়েছিল। আবার কেউ কেউ আরো চটকদার করে বলেন থাকেন, ইন্তেকালের সময় যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিবরীল ও মালাকুল মাওত হাজির হল, তখন তিনি মালাকুল মাওতকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এত তাড়াতাড়ি কেন এলে? আল্লাহ তো আমাকে নববই বছর হায়াত দিয়েছিলেন। তখন জিবরীল বললেন, আপনার জীবনের সাতাশ বছর তো মিরাজের রাতেই অতিবাহিত হয়ে গেছে!

মন্তব্যঃ উপরোক্ত বর্ণনার কোনো ভিত্তি আমরা পাইনি। মেরাজের সহীহ ও নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েতগুলোর কোথাও বলা হয়নি যে, মেরাজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কত সময় অতিবাহিত হয়েছিল। কুরআন মজীদ এবং সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসে বলা হয়েছে যে, এই ঘটনাটি একটি রাতে সংঘটিত হয়েছিল। তাতে পুরো রাত লেগেছিল নাকি রাতের কিছু অংশ, না চোখের পলকেই ঘটে গিয়েছিল তা সহীহ হাদীসে নেই। হাদীসে এই কথাও নেই যে, আল্লাহ তাআলা তখন সময় ও সৃষ্টিজগতকে স্থির রেখেছিলেন কি না। 

অতএব মিরাজের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তার রহস্য ও তাৎপর্য আলোচনার সময় এই সব অমূলক কথাবার্তার আশ্রয় নেওয়া খুবই নিন্দনীয় ও সর্বোতভাবে পরিত্যাজ্য।  কোনো দায়িত্বশীল ও আমানতদার ব্যক্তি এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। আল্লাহ তাআলার পরিষ্কার আদেশ- 

ولا تقف ما ليس لك به علم

 ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই এর পিছনে পড়ো না।’ এরপরও শুধু অনুমান ও ধারণার উপর ভিত্তি করে বলা, বিশেষত মানুষের সামনে বর্ণনা করা বড়ই অন্যায়। উপরন্তু তা যখন হয় আল্লাহ ও রাসূলের সাথে সম্পর্কিত তখন তো এর ভয়াবহতা বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন। আমীন। (প্রচলিত ভুল, পৃষ্ঠা ২০৫, মাওলানা আবদুল মালেক, মাসিক আল কাউসার ২০১১ জুন)

 

১৩। মিরাজ অস্বীকারকারীর মহিলায় রূপান্তরিত হওয়া

সমাজে প্রচলিত একটি গল্প হল, এক ব্যক্তি মিরাজের ঘটনা অস্বীকার করল। একদিন সে স্ত্রীকে মাছ কাটতে দিয়ে নদীতে গোসল করতে যায়। ডুব দিয়ে উঠে দেখে সে মহিলা হয়ে গেছে। সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল এক সওদাগর। সে তাকে দেখে বিবাহ করে। তাদের সন্তান-সন্ততি হয় এবং তারা বড় হয়ে যায়। পরবর্তীতে একদিন সে নদীতে গোসল করতে যায়। ডুব দেওয়ার পর দেখে আবার সে আগের পুরুষ ব্যক্তি হয়ে গেছে। তখন সে বাড়িতে ফিরে দেখে তার স্ত্রী এখনো মাছ কাটছে। স্ত্রীকে সব ঘটনা খুলে বলে এবং তার ভুল বুঝতে পারে। এভাবে তার মেরাজের ঘটনা বুঝে আসে।

মন্তব্যঃ এটি একটি অলীক কাহিনী, যা অসার কথার উপর ভিত্তি করে আবিষ্কার করা হয়েছে। তা হল, কিছু মানুষ মনে করে, মিরাজে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাতাশ বছর অতিবাহিত হয়েছে। অর্থাৎ মিরাজে তো নবীজী গিয়েছেন এক রাতে, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তখন সময় ও সৃষ্টিজগৎকে স্থির করে রেখেছেন। মাঝখান দিয়ে মেরাজে নবীজীর সাতাশ বছর সময় কেটে গেছে।

সাতাশ বছর কেন্দ্রিক আরো পূর্বের বর্ণনাটিও প্রমান করে সবই মিথ্যা। এসকল বর্ণনার কোনো ভিত্তি নাই। মিরাজের সহিহ ও নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েতগুলোর কোথাও বলা হয়নি যে, মিরাজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কত সময় অতিবাহিত হয়েছিল। কুরআন মজীদ এবং সহিহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসে বলা হয়েছে যে, এই ঘটনাটি রাতের কোনো একটি অংশে সংঘটিত হয়েছিল। তাতে পুরো রাত লেগেছিল নাকি রাতের কিছু অংশ, না চোখের পলকেই ঘটে গিয়েছিল তা সহীহ হাদীসে নেই। হাদীসে এই কথাও নেই যে, আল্লাহ তাআলা তখন সময় ও সৃষ্টিজগতকে স্থির রেখেছিলেন কি না।

অতএব মিরাজের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তার রহস্য ও তাৎপর্য আলোচনার সময় এইসব অমূলক কথাবার্তার আশ্রয় নেওয়া খুবই নিন্দনীয় ও সর্বোতভাবে পরিত্যাজ্য। (প্রচলিত ভুল পৃষ্ঠা ২০৫,  মাওলানা আবদুল মালেক, মাসিক আল কাউসার ২০১৭ জানুয়ারী)।

১৪। মুহূর্তের মধ্যে মি’রাজের সকল ঘটনা সংঘটিত হওয়াঃ

প্রচলিত একটি কথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মিরাজের সকল ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে সংঘটিত হয়ে যায়। তিনি সকল ঘটনার পর ফিরে এসে দেখেন, অজুর পানি গড়িয়ে পড়ছে, দরজার শিকল নড়ছে, বিছানা তখনো গরম রয়েছে ইত্যাদি।

মন্তব্যঃ ডঃ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ, হাদিসের নামে জালিয়াত কিতাবে লিখেন, এ সকল কথা ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মান। আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, সিহাহ সিত্তাহ-সহ প্রায় ২০ খানা হাদীস গ্রন্থের মি’রাজ বিষয়ক হাদীসগুলো আমি অধ্যয়ন করার চেষ্টা করেছি। অধিকাংশ হাদীসে মি’রাজে ভ্রমণ, দর্শন ইত্যাদি সবকিছু সমাপ্ত হতে কত সময় লেগেছিল সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ করা হয় নি। তাবারানী সংকলিত একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘অতঃপর প্রভাতের পূর্বে আমি মক্কায় আমার সাহাবীদের কাছে ফিরে আসলাম। তখন আবূ বক্কর (রাদিঃ) আমার কাছে এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি গত রাতে কোথায় ছিলেন? আমি আপনার স্থানে আপনাকে খুঁজেছিলাম, কিন্তু আপনাকে পাই নি। তখন তিনি মি’রাজের ঘটনা বলেন। (হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৭৩-৭৪। হাদীসটির সনদের একজন রাবীকে কেউ কেউ নির্ভরযোগ্য বলেছেন এবং কেউ কেউ দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন)।

এ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম রাতে মি’রাজে গমন করনে এবং শেষ রাতে ফিরে আসেন। সারা রাত তিনি মক্কায় অনুপস্থিত ছিলেন। এরূপ আরো দু একটি হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, মি’রাজের ঘটনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েছিলেন। (হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৭৫-৭৬; ইবনু হাজার, আল-মাতালিব ৪/৩৮৯-৩৮১)।

মি’রাজের ঘটনায় কত সময় লেগেছিল তা কোনো গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় নয়। এ মহান অলৌকিক ঘটনা আল্লাহ সময় ছাড়া বা অল্প সময়ে যে কোনো ভাবে তাঁর মহান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য সম্পাদন করতে পারেন। কিন্তু আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, হাদীসে যা বর্ণিত হয় নি তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে না বলা। তিনি ফিরে এসে দেখেন পানি গড়াচ্ছে, শিকল নড়ছে, বিছানা তখনো গরম রয়েছে ইত্যাদি কথা কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় না। মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়িদ দরবেশ হূত (১২৭৬ হি) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজের রাত্রিতে গমন করেন এবং ফিরে আসেন কিন্তু তখনো তার বিছান ঠান্ডা হয় নি, এ কথাটি প্রমাণিত নয়। (দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ১১২)।

১৫। সিদরাতুল মুনতাহার পাতা ও মানুষের জন্ম-মৃত্যু

সমজে প্রচলিত আছে, আল্লাহর আরশের কাছে একটি গাছ আছে, যার নাম সিদরাতুল মুনতাহা। মানুষ জন্ম নিলে নাকি সিদরাতুল মুনতাহা গাছটিতে একটি পাতা গজায়। আবার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে ঐ পাতাটি ঝরে পড়ে। তা দেখে ফিরিশতা বুঝতে পারেন যে এই ব্যক্তির মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। (হাদীসের নির্ভরযোগ্য কোনো গ্রন্থে এ বর্ণনা পাওয়া যায়নি)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সিদরাতুল মুনতাহা পর্যান্ত পৌছান তখন জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম তাকে নাকি বলেছেন আমার এর বেশি যাওয়ার অনুমতি তার নেই। আমি যদি আর এক কদম বা চুল পরিমান অগ্রসর হই আমার ডানা সমূহ জ্বলে যাবে। (এটি একটি নিকৃষ্টতম মিথ্যা কথা, আলবুসীরি মাদিহুর রাসীলিল আযাম ৭২, এসব হাদিস নয়, মাওলানা আবদুল মালেক ১/১৫৫)

এ রকমই দুটি ভিত্তিহীন রেওয়াত হলঃ

প্রথম টিঃ  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন আমার নিকট জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এসে ছিল সে আমার সফর সফর সঙ্গী ছিল। তিনি এমন একজায় এসে থেমে যান। আমি বললাম হে জিব্রাঈল! এমন জায়গা এসে বন্ধু কি বন্ধুকে পরিত্যাগ করে? জিব্রাঈল আলাইহিস উত্তর দিলেন, আমি যদি আর এক কদম বা চুল পরিমান অগ্রসর হই আমার পাখাগুল জ্বলে ছাই হয়ে যাবে। এরপর আমাকে নুরের সাথে জুড়ে দেওয়া হল এবং সত্তর হাজার পর্দা পার করান হল। যার একটি পর্দার সাথে অন্য পর্দার মিল ছিল না। আমার সাথে মানব ও ফিরিস্তাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ঐ সময় আমার মনে ভিতির সঞ্চয় হল এবং একজান ঘোষনাকারী আবু বক্করের কন্ঠৈ ঘোষনা দিলেন, থামুন! আপনার প্রভূ সালাতে নিয়োজিত রয়েছেন। আমি আবেদন করলাম দুটি বিষয় আমরা আশ্চর্য মনে হল। একটি হল আবু বক্কর কি আমার চেয়েও অগ্রগামী বয়েছেন। দ্বিতীয়টি হল, আমার প্রভূ তো সালাতে মুখাপেক্ষী নন। তখন এরশাদ হল মুহাম্মাদ, (এই আয়াত পাঠ করুন এখান একটি আয়াত আজে) আমার সালাতের অর্থ হল আপনার ও আপনার উম্মতের প্রতি রহমত। আর আবু বক্করের কন্ঠের ঘটনা হল, আমি একজন ফিরিস্তা আবু বক্করে আকৃতিতে বানিয়েছি, যে আপনাকে আবু বক্করের কন্ঠে আপনাকে ডাকবে। তা হলে আপনার অস্বস্তি দুর হবে এবং আপনি এতটা ভীত হবেনা।  যা আসল  উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেয়।

দ্বিতীয় টিঃ সত্তরটি পর্দা যার প্রতিটির ব্যস ছিল পাঁচ শত বছরের রাস্তা। পর্যাক্রমে অতিক্রমের পর একটি রফরফ তথা সবিজ রংঙের একট মসনদ আমার জন্য আনা হল। এরপর আমাকে উপরে উঠান হল। শেষ পর্যান্ত আমি আরশ পর্যান্ত পৌছালাম। শেষ পর্যান্ত আমি এমন মহান জিনিস দেখেছি, যার বিবরণ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।বর্ণানা দুটি সংক্ষেপিত। (শামী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এগুল নিঃসন্দেহে মিথ্যা। শরহুল মাওয়াহিব, যুরকাণী৮/২০০)

মন্তব্যঃ নুরের পর্দা সম্পর্কে ডঃ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ, হাদিসের নামে জালিয়াত কিতাবে লিখেন, সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, মহান আল্লাহর নূরের পর্দা রয়েছে। (সহিহ মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৬১)। কিন্তু পর্দার সংখ্যা, প্রকৃতি ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় না। কিছু হাদীসে আল্লাহর পর্দার সংখ্যার কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ‘‘৭০ হাজার নূরের পর্দা’’ ‘‘৭০ টি পর্দা’’, ‘‘৭টি পর্দা’’ ইত্যাদির কথা বলা হয়। মুহাদ্দিসগণ বিস্তারিত নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন যে, এ অর্থের হাদীসগুলো কিছু সন্দেহাতীতভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট কথা আর কিছু যয়ীফ, দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য কথা। (তাবারী, আত-তাফসীর ১৬/৯৫; কুরতুবী, আত-তাফসীর ১৫/২৯৫; ইবনু কাসীর, আত-তাফসীর ১/২৫০, ৩/৩১৭; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/১৩৭, ১৪২; আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ আসফাহানী, আল-আযামাহ ২/৬৬৭-৭২৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৭৯-৮০; আবূ ইয়ালা, আল-মুসনাদ ১৩/৫২০; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/২২৯; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/৭৩-৭৪, সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/১৪-১৯)।

১৬। শবে মিরাজ বিদআত কেন?

১। এই রাতের আমল সম্পর্কে কুরআন, সহিহ হাদিস বা যঈফ হাদিসে কোন প্রকার দলীল প্রমান পাওয়া যায় না।

২। লাইলাতুল মিরাজের ঘটনা বহু সহিহ হাদিস দ্বার প্রমানিত হলেও ২৭ তারিখ সম্পর্কে কোন সহিহ হাদিস তো দুরের কথা কোন যঈফ হাদিন ও নেই।

৩। নবী জীবন দসায় বা তার ওফাতের পর কোন সাহাবী, তাবেয়ী বা তাবে-তাবেয়ী কেউই লাইলাতুল মিরাজে কোন প্রকার আমল করেছেন বলে প্রমান পাওয়া যায় না।

৪। সাহাবা ও তাবিইনগণ মিরাজের রাতকে অন্য রাতগুলো থেকে আলাদাভাবে দেখেছেন বলে কোনো দলিল আমাদের হাতে নেই।

৫। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন আমলকে সময় সাথে না করে থাকলে অন্য কেউ তা সময়ের সাথে খাচ করে নিলে বিদআত হবে। লাইলাতুল মিরাজ এমন এমন একটি ইবাদাত যাএ ২৭ শে রজব তারিখের সাথে খাচ করা হয়েছে। 

৬। ইসলামি শরীয়তে অনেক নফল  ইবাদাত আছে যেমনঃ জিকির, দান সদকা, দুয়া করা, ইস্তেগফার পড়া, কুরআন তিলওয়াত করা ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সফল ইবাদাত বান্দার সীমার মধ্যে থেকে পালন করতে বলেছেন। যদি কেউ এই সকল নফল আমল নিজের জন্য খাচ করে নেয় এবং ছুটে গেলে আফসোস করে তবে তার জন্য ঐ আমলটি বিদআত হয়ে যাবে।

৭। কোন আমল নিজে আবিস্কার করে বা আমলের কোন পদ্ধতি আবিস্কার করে দ্বীনি কাজ মনে করে নেকীর আশায় করলে বিদআত হবে।

১৭। আমাদের করণীয়

১। এই সম্পর্ক আমাদের আকিদা সঠিক করা। মিরাজের যে সকল ঘটনা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত তার বিশ্বস করা। মিরাজের প্রমাণিত কোন কিছুকে অস্বীকার না করা। কারন মিরাজ অস্বীকার করলে কুফরী হবে।
২। এই রাতে যেহেতু পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হয়েছে তাই তার উপর গুরুত্ব দেয়া। কারণ সালাত আকাশে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডেকে সম্মানের সাথে প্রদান করা হয়েছে। দুনিয়ার কোন স্থানে বা অন্য কোন মাধ্যমে সেটা ফরয করা হয়নি।

৩। মিরাজ সম্পর্কে সঠিক ধারনা রাখা। এই সম্পর্কে সমাজে যে সকর মিথ্যা কল্প কাহিণী প্রচলিত আছে তার জেনে নিজে শতর্ক হয় এবং অপরকে শতর্ক করি।

৪। লাইলাতুল মিরাজের কোন দিন, মাস বা সন সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত নয় তাই এই রাত্রি নির্ধারণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

৫। এই রাতই যেহেতু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দিষ্ট করে যায় নাই এবং কোন প্রকার আমলও করে নাই। তাই আমরাও এই রাতের সকল প্রকার আমল থেকে বিরত থাকব। তবে এই রাতে গতানুগনিত যে আমল করা হয় তা করলে কোন অসুবিধা নেই।

৬। এই রাতে আমল নাই। তাহলে আমলের ফজিলত থাকে কি করে। কাজেই এই রাতের আমলেন যত ফজিলত বলা হবে, তা সবই মিথ্যার উপর ভিত্তি করে বলা হচ্ছে।

৭। এই রাতের ইবাদত করার পাশাপাশি পরের দিনে সিয়াম পালন করা থেকে বিরত থাকা। যদি কারন সোমবার, বৃহস্পতিবার বা প্রতি আরবী মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে সিয়াম পালনের অভ্যাস থাকে তার জন্য এই দিনের সাথে মিলে গেলে সিয়াম পালনের জন্য কোন অসুবিধা নেই।

সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত সূরা আল-বাকারার শেষ দু’টি আয়াত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রদান করা হয়েছে। তাই এই দুটি আয়াত পাঠ করা এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার পাশাপাশি প্রচার ও প্রসারের চেষ্টা করা।।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment