সুফিদের ব্যবহৃত শরীয়ত, মারেফত, তরিকত এবং হাকিকত শব্দের প্রকৃত ব্যাখ্যা কি?

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

শরীয়তঃ

 শরীয়ত আরবী শব্দ। শরীয়ত এর আবিধানিক অর্থ দ্বীন, জীবন পদ্দতি, ধর্ম, জীবন আচার, নিয়ম-নীতি ইত্যাদি। আবার শরীয়ত শব্দটি প্রকান্ড নদী, প্রবাহিত জলস্রোত, বৃহত্তম জন-সড়ক প্রভৃতি অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তবে আরবী ভাষায় শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলঃ পানির উৎসস্থল বা যেখান থেকে পানি উৎসারিত হয়ে গড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ সেখানে এসে পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করে।

 শরীয়ত এর পারিভাষিক অর্থঃ

পবিত্র কোরআন এবং হাদীস দ্বারা ইসলামের যে বিধান আমাদের উপর বিধিবদ্ধ করা হয়েছে তাই শরীয়ত নামে অভিহিত। অর্থাৎ ‘মহান আল্লাহ বান্দার পার্থিব জীবন ও পরকালীন জীবনের কল্যাণের লক্ষ্যে, জীবন ও জগত পরিচালনার জন্য যে আক্বিদা, ইবাদত, আখলাক, লেনদেন ও জীবন ব্যবস্থা প্রদান করেছেন, তাই হল ইসলামী শরীয়ত।  আল্লাহ প্রদত্ত যেসব বিধি বিধান সমূহ আমাদের রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে মানব জাতির প্রতি নাজিল করে নির্ধারণ করে দিয়েছেন, একেই ইসলাম ধর্মে শরীয়ত বলা হয়। মহান আল্লাহ পবিত্র মহাগ্রন্থ আল কুরআনের বহু জায়গায় বিষয়টির নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,

لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا

 অর্থঃ তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি শরীয়ত ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করেছি। ([সূরা মায়িদ ৫: ৪৮)।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:

  ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِّنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاء الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ

 অর্থঃ অতঃপর আমি আপনাকে রেখেছি দীনের এক বিশেষ শরীয়তের ওপর। অতএব, আপনি এর অনুসরণ করুন এবং যারা জানে না তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না। [সুরা আল জাসিয়াহ ৮৮:১৮]

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:

شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ

 অর্থঃ তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নিধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। ( সুরা শূরা ৪২:১৩)।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:

أَمْ لَهُمْ شُرَكَاء شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ اللَّهُ
অর্থঃ এসব লোক কি আল্লাহর এমন কোন শরীকে বিশ্বাস করে যারা এদের জন্য দীনের মত এমন একটি পদ্ধতি নির্ধারিত করে দিয়েছে আল্লাহ যার অনুমোদন দেননি? (সুরা শুরা ৪২:২১)।

ইসলামী জীবন ব্যবস্থার যাবতীয় বিধান যেহেতু শরীয়ত, তাই ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক জীবন বিধানের প্রতিটি অঙ্গনে ইসলামের সুষ্পষ্ট নীতিমালা কুরআন সুন্নাহ বিস্তারিতভাবে নির্দেশিত হয়েছে তাকে শরীয়ত মনে করে মান্য করা প্রতিটি মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব। তবে যে সকল বিষযগুলো কুরআন সুন্নাহ বিস্তারিত ও সুষ্পষ্টভাবে বর্ণিত নেই, সে সকল বিষয় ইসলামি গবেষক/ আলেম/ফিকাহশাস্ত্রের ইমামগণ কুরআন, হাদীসের আলোকে যে রায় (ইজমা ও কিয়াস) প্রদান করছেন তার আলোকে মানব জাতির  জীবন ব্যবস্থা নির্ধারণ করাও শরীয়তের অন্তরভুক্ত। কাজেই এক জন মুমিন পরিপূর্ণভাবে ইসলামি শরীয়ত পালন মাধ্যমের মহান আল্লাহ সন্ত্বষ্টি অর্জন করতে পারে। পরিপূর্ণভাবে ইসলামি শরীয়ত মান্য করলে তার জান্নাত লাভের কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবেনা।

শরীয়তের উদ্দেশ্যঃ

আমাদের পার্থিব এবং পরকালীন জীবনের কল্যাণই সাধন করাই হল শরিয়তের যাবতীয় বিধি-বিধানের উদ্দেশ্য। মানবতার মুক্তিই হল শরীয়তের মুল উদ্দেশ্য। আর এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য শরীয়ত পালন করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। শরীয়ত মহান আল্লাহ থেকে বিধিবদ্ধ তাই এর কম বেশ করে পালন করা চলবে না এবং এর সমান্তরাল অন্য কোন দ্বীন পালন করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

* الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا *

অর্থঃ আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। [ সুরা মায়েদা ৫:৩ ]

যিনি (আল্লাহ) শরীয়ত প্রনয়নকারী তিনি (আল্লাহ) জানেন কিভাবে শরীয়ত প্রনয়ন করলে মানব জাতিকে তার আসল লক্ষে পৌছে যাবে। এই জন্য মহান আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়তের মূল ভিত্তি রেখেছেন ভারসাম্যপুর্ন অবস্থানের উপর। তাই এতে এমন কোন কঠোরতাও মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়নি যা পালন করা মানুষের জন্য অসম্ভব কিংবা সীমাহীন কষ্টকর হয়। আবার এতটা নমনীয় ও সহজও করে দেয়া হয়নি যা মানুষকে স্বেচ্ছাচারিতার দিকে নিয়ে যায়। তাই কোন মানুষের জন্য শরীয়ত পালনের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। ইসলামি শরীয়তের মূল ভিত্তি হল পাঁচটি, যেমন- ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত। হজ্ব এবং যাকাত ধনীলোকদের জন্য ফরয সকলের জন্য নয়। কেউ খাটি মুমিন মুসলীম হতে হলে তাকে সর্বপ্রথম শরীয়তের পূর্ণ অনুসারী হতে হয়।

 সুফিদের নিকট শরীয়তঃ

সুফিদের অধিকাংশ অনুসারি শরীয়ত পালনের কথা বলে। তারা বলে থাকে, শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণ ব্যতীত কেউ মহান আল্লাহ অলী হতে পারেনা। কিন্তু শরীয়তের বিধিবিধাণ পালনের ক্ষেত্রে তারা তাদের পীর বা শাইখ এর কথা কে শরীয়তের উপর স্থান দেয়। এমন কি পীর সাহেব শরীয়তের বিরোধী কোন কাজের হুকুম দিলে কোন প্রশ্ন না করে তা পালন করে থাকে। তাদের মধ্যে এমন অনুসারী সংখ্যাও কম নয়, যারা মনে করে শরীয়ত একটা সময় পর্যান্ত পালন করতে হয়। এই প্রকারের সুফিগন শরীয়তের সঙ্গা ঠিক মনে করলেও মারেফতের দোহাই দিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করে শরীয়তকে ছোট করে থাকে। তাদের মতে, শরীয়ত হল প্রকাশ্য বা মারেফত হল গোপন বিষয়। তাদের মতে ইসলামি জীবন বিধানের সকল ক্ষেত্রে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি বাহ্যিক এবং অন্যটি অভ্যন্তরীন বা আধ্যাত্মিক। ইহলৌকিক জীবনের অভাব অভিযোগ প্রয়োজন ও গুরুত্ব এবং ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্জ ও যাকাত এর বাহ্যিক ক্রিয়া পদ্ধতির রূপ শরীয়তের অন্তর্গত।

অপর পক্ষে অহংকার, হিংসা, নিয়ত, আল্লাহ ভীতি ইত্যাদি যে সকল আভ্যন্তরীন বিশুদ্ধতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন তাহাকে শরীয়তের পরের ধাপ মারেফত মনে করে।  আর মারেফত হাসির হলে শরীয়ত পালনের প্রয়োজন নেই। শরীয়ত পালন করতে করতে এমন একটা সময় আসে যখন আর তাদের উপর শরীয়ত পালনের বাধ্যবাদকতা থাকেনা। অর্থাৎ সুফিগন সাধনা করতে করতে যখন আল্লাহতে বিলীন হয়ে যায়, তখন আর ইবাদতের প্রয়োজন হয়না। তারা তাদের দলীল হিসাবে সুরা হিজরের ৯৯ আয়াতটি উল্লেখ করে। মহান আল্লাহ বলেন,

*وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّى يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ*

অর্থঃ এবং পালনকর্তার এবাদত করুন, যে পর্যন্ত আপনার কাছে নিশ্চিত কথা (মৃত্যু) না আসে। ( সুরা হিজর ১৫:৯৯)।

সুফিরা এ আযাতের অনুবাদ করে, “এবং পালনকর্তার ইবাদত করুন, যে পর্যন্ত ইয়াকিন (বিশ্বাস) আসে” তাদের দাবি, শরীয়ত পালনের পর মারেফত হাসিল হলে তার আর ইবাদত লাগে না। অর্থাৎ সৃষ্টি কর্তার সাথে গভির পরিচিতির পর আর ইবাদতের প্রয়োজন হয়না।

অথচ সহিহ হাদিসে এসেছেঃ  আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মৃত্যুব্যাধিতে আক্রান্ত অবস্থায় বিলাল এসে তাঁকে সালাতের কথা অবহিত করেন। তিনি বলেনঃ তোমরা আবূ বাকরকে নির্দেশ দাও তিনি যেন লোকেদের সালাত (নামায/নামাজ) পড়ান। আমরা বললাম, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আবূ বাকর (রাঃ) নরম দিকের লোক। যখনই তিনি তআপনার স্থানে দাঁড়াবেন তখনই কেঁদে ফেলবেন এবং (সালাত (নামায/নামাজ) পড়াতে) সক্ষম হবেন না। অতএব আপনি যদি উমার (রাঃ) কে নির্দেশ দিতেন তাহলে তিনি লোকেদের সালাত (নামায/নামাজ) পড়াতেন। তিনি বলেনঃ তোমরা আবূ বাকরকে নির্দেশ দাও তিনি যেন লোকেদের সালাত (নামায/নামাজ) পড়ান। তোমরা (মুমিন জননীগণ) যেন ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-এর সঙ্গিনীগণের অনুরূপ। আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আমরা আবূ বাকর (রাঃ) এর নিকট লোক পাঠালে তিনি লোকেদের নিয়ে সালাত (নামায/নামাজ) পড়া শুরু করেন। ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেকে একটু হালকা (সুস্থ) বোধ করলে দু ব্যক্তির কাঁধে ভর করে মাটিতে তাঁর পদদ্বয় হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করতে রওয়ানা হন। আবূ বাকর (রাঃ) তাঁর আগমন টের পেয়ে পেছনে সরে যেতে উদ্যোগী হন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশারা করে তাকে স্বস্থানে স্থির থাকতে বলেন। রাবী বলেন, তিনি (মসজিদে) এসে পৌঁছলে সাহায্যকারীদ্বয় তাঁকে আবূ বাকর (রাঃ) -এর পাশে বসিয়ে দেন। আবূ বাকর (রাঃ) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর ইকতিদা করলেন এবং লোকেরা আবূ বাকর (রাঃ) এর ইকতিদা করে।

(সহিহ বুখারী ১৯৮, ৬৬৪-৬৫, ৬৭৯, ৬৮২-৮৩, ৬৮৭, ৭১২-১৩, ৭১৬, ২৫৮৮, ৩০৯৯, ৩৩৮৪, ৪৪৪২, ৫৭১৪, ৭৩০৩; সহিহ মুসলিম ৪১৮, তিরমিযী ৩৬৭২, নাসায়ী ৮৩৩-৩৪, আবূ দাঊদ ২১৩৭, আহমাদ ২৩৫৪১, ২৫৩৪৮, ২৫৩৮৬, ২৫৬০৬; মুওয়াত্ত্বা মালিক ৪১৪, দারিমী ৮২, ১২৫৭; ইবনু মাজাহ ১২৩৩, ১৬১৮। তাহক্বীক্ব আলবানী: মান সহীহ)।

উক্ত হাদিস থেকে বুঝা গেল মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যান্ত শরীয়ত পারন করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের অনুকরনীর আদর্শ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  কেও কোন প্রকারের ছাড় দেয়া হয়নি। আর ভন্ড প্রতারক মুনাফিক সুফিদের ইবাদত লাগেনা। অর্থাৎ সুফিগন শরীয়ত স্বীকার করলেও যুক্তি দিয়া শরীয়ত পালন থেকে দুরে থাকে।

 

মারেফতঃ

 মারেফত শব্দটি আরবী। যার অর্থ হলঃ শিক্ষা, পরিচয়, জানা, জ্ঞান লাভ করা। কোন বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা। মারেফত শব্দের পারিভাষিক অর্থ জানা/শোনা ও নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা যে বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা হয়, তাকেই মারেফত বলা হয়। ইসলামি শরীয়তে মারেফত বলতে বুঝায় বিশ্ব সৃষ্টির একক দাবিদার পরম করুনাময় মহান আল্লাহ ও তাঁর সুবিশাল সৃষ্টি জগত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। আল্লাহ সম্পর্কে স্বচ্ছ ও ষ্পষ্ট ধারনা রাখা ইমানের দাবি। ঈমান আনার ক্ষেত্রে প্রধান দাবি হলঃ মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস। তাহলে আল্লাহ প্রশ্ন আসে মহান আল্লাহর প্রতি কি বিশ্বাস করব? প্রথমে মহান আল্লাহর মারেফত বা পরিচয় জানতে হবে। যখন মহান আল্লাহর মারেফত বা পরিচয় জানতে পাবর তখন তার ক্ষমতা সম্পর্কেও জানতে পারব। কুরআনুর কারীমে মহান আল্লাহর শত শত আয়াতে তার নিজের পরিচয় বা মারেফত তুলে ধরেছেন। যেমনঃ আল্লাহর মারোফাত বা পরিচয়ের সবচেয়ে সুপ্রসিদ্ধ আয়াতগুলো হলঃ  সূরা ইখলাসের ৪টি আয়াত:

قُلۡ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ (١) ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ (٢) لَمۡ يَلِدۡ وَلَمۡ يُولَدۡ (٣) وَلَمۡ يَكُن لَّهُ ۥ ڪُفُوًا أَحَدٌ (٤)

অর্থ:  বলুন, তিনি আল্লাহ, এক, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি এবং তার সমতুল্য কেউ নেই। (সুরা ইখলাস ১১২:১-৪)।

সূরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াত (এ আয়াতটি কে আয়াতুল কুরসী বলা হয়)।

 ٱللَّهُ لَآ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡحَىُّ ٱلۡقَيُّومُ‌ۚ لَا تَأۡخُذُهُ ۥ سِنَةٌ۬ وَلَا نَوۡمٌ۬‌ۚ لَّهُ ۥ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَٲتِ وَمَا فِى ٱلۡأَرۡضِ‌ۗ مَن ذَا ٱلَّذِى يَشۡفَعُ عِندَهُ ۥۤ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦ‌ۚ يَعۡلَمُ مَا بَيۡنَ أَيۡدِيهِمۡ وَمَا خَلۡفَهُمۡ‌ۖ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَىۡءٍ۬ مِّنۡ عِلۡمِهِۦۤ إِلَّا بِمَا شَآءَ‌ۚ وَسِعَ كُرۡسِيُّهُ ٱلسَّمَـٰوَٲتِ وَٱلۡأَرۡضَ‌ۖ وَلَا يَـُٔودُهُ ۥ حِفۡظُهُمَا‌ۚ وَهُوَ ٱلۡعَلِىُّ ٱلۡعَظِيمُ (٢٥٥)

 অর্থ:  “আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তিনি জীবিত, সবকিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়। আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁরকে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যা কিছু রয়েছে সে সবই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোন কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান।”

সূরা হাসরের  প্রসিদ্ধ শেষ তিন আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

 هُوَ ٱللَّهُ ٱلَّذِى لَآ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ‌ۖ عَـٰلِمُ ٱلۡغَيۡبِ وَٱلشَّهَـٰدَةِ‌ۖ هُوَ ٱلرَّحۡمَـٰنُ ٱلرَّحِيمُ (٢٢)

 هُوَ ٱللَّهُ ٱلَّذِى لَآ إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡمَلِكُ ٱلۡقُدُّوسُ ٱلسَّلَـٰمُ ٱلۡمُؤۡمِنُ ٱلۡمُهَيۡمِنُ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡجَبَّارُ ٱلۡمُتَڪَبِّرُ‌ۚ سُبۡحَـٰنَ ٱللَّهِ عَمَّا يُشۡرِڪُونَ (٢٣)

هُوَ ٱللَّهُ ٱلۡخَـٰلِقُ ٱلۡبَارِئُ ٱلۡمُصَوِّرُ‌ۖ لَهُ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ‌ۚ يُسَبِّحُ لَهُ ۥ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَٲتِ وَٱلۡأَرۡضِ‌ۖ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ (٢٤)

অর্থ:  তিনিই আল্লাহ্‌, তিনি ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নাইযিনি গোপন ও প্রকাশ্য সব জানেনতিনি মহান এবং পরম করুণাময়

 তিনিই আল্লাহ্‌, তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নাই তিনিই সার্বভৌম, পবিত্র, শান্তি উৎস, ঈমানের বিধায়ক, নিরাপত্তার রক্ষক, পরাক্রমশালী, অপ্রতিরোধ্য, সর্বশ্রেষ্ঠমহিমা আল্লাহ্‌রতারা আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে যে শরীক আরোপ করে তিনি তার উর্দ্ধে

তিনিই আল্লাহ্‌ সৃষ্টিকর্তা, উদ্ভাবক, আকৃতির রূপকার, সকল উত্তম নাম তারইআকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সমস্তই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করেতিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়

            এভাবে অসংখ্যা আয়াত দ্বারা মহান আল্লাহ নিজেই তার মারেফত বা পরিচয় তুলে ধরেছেন। তার পরিচয়ের প্রধান দিক হল তার তাওহীদ বা একত্ববাদ যা সকল বান্দাকে নিশ্চিত ভাবে বিশ্বাস করতে হবে। সেই মহান আল্লাহ কুরআনে তার মারেফত বর্ণনা করে বলেন, তিনি এক ও অদ্বিতীয়, এককভাবে সকল বস্তুর মালিক, প্রতিপালক, সমগ্র বিশ্বকে তিনিই এককভাবে পরিচালনা করছেন, সকল কিছুর তিনিই সৃষ্টিকর্তা, তিনিই সকল ইবাদাতের একমাত্র যোগ্য, তিনি সর্বোতভাবে যাবতীয় পরিপূর্ণ গুণাবলী ও বৈশিষ্টে বৈশিষ্টমন্ডিত। তিনি সব কিছু দেখেন, সব কিছু শুনেন, এমনটি অন্তরের খবরএ রাখেন ইত্যাদি। তার মারেফতের সার কথা হল, তার রুবুবিয়্যাতে (প্রভুত্বে) কোন শরীক নেই। তার উরুহিয়াতে (উপাস্যত্বে) কোন শরীক নেই।

মৌলিকভাবে মারেফ বা পরিচয় তাই, যা হাদীসে জিবরাঈলে “ইহসান” এর পরিচয়ে উদ্ধৃত। যখন হযরত জিবরাঈল আঃ রাসূল সাঃ কে জিজ্ঞাসা করেন, “ইহসান কি?” তখন রাসূল সাঃ জবাবে বলেন, তুমি রবের ইবাদত এভাবে কর যে, যেন তুমি আল্লাহকে দেখ, যদি তাকে দেখতে না পাও, তাহলে অন্তত তিনি তো তোমাকে দেখছেন”। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৩৬৭, সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫০, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৮}

আল্লাহ তাআলার এতটুকু নৈকট্য অর্জন করা যে, যেন আল্লাহকে দেখার মত ভয়, মোহাব্বত মনে জাগরুক হয়, কিংবা অন্তত ইবাদতের সময় আল্লাহ দেখছেন এমন ভয় ও মোহাব্বত আল্লাহর প্রতি সৃষ্টির নামই মারেফত বা আল্লাহর পরিচয় লাভ। মহান আল্লাহ মারেফত বা পরিচয় জানা বা নাজায়েয হওয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না।

সুফিদের নিকট মারেফতঃ

সুফদের নিকট মারেফত একটি গোপন বিষয়। তাদের মতে, আমরা যাহা দেখি নাই এবং চিনিও নাই তাহাই গোপন, যাহা দেখতে পাই বা চিনতে পাই বা সে সম্পর্কে জানতে পেরেছি তাহা গোপন নয়, প্রকাশ। তারা বলে থাকে, মারিফত হলো আপন মুর্শিদের উছিলার মাধ্যমে নিজেকে অর্থাৎ আপন দেহের মোকাম মঞ্জিলকে চিনা এবং জানা। যাহা আমি অতীতে দেখিও নাই চিনিও নাই। আর এই অদেখা, অচেনা, অবুঝা, বিষয়টি সুন্দর ভাবে বুঝে, চিনে, নিজেকে চিনার মাধ্যমে আল্লাহ তথা রবকে চেনার নাম, জানার নাম, বুঝার নামই মারিফত। এ্রর প্রমান  হিসাবে তারা একটি জাল হাদিস বলে থাকে। জাল হাদিসটি হলঃ “যে ব্যাক্তি নিজেকে চিনেছে, সে তার প্রভুকে চিনতে সক্ষম হয়েছে”

এই হাদীসটির কোন ভিত্তি নেই। হাফিয সাখাবী “মাকাসিদুল হাসানা” গ্রন্থের ১৯৮ পৃষ্ঠায় বলেন, আবু মুযাফফার ইবনুস সামায়ানী বলেনঃ মারফু হিসাবে এটিকে জানা যায় না। ইয়াহইয়া ইবনু মুয়ায আর-রাজির ভাষ্য হিসাবে বলা হয়ে থাকে। ইমাম নব্বী বলছেন এটা সাব্যস্ত হয়নি।

সুয়ুতী হাদিসটি যায়লুল মাওযুআহ” গ্রন্থে ২০৩ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম নাবাবীর কথাটি উল্লেখ করে তাকে সমর্থন করেছেন। তিনি তার আলল কাওলীল গ্রন্থে (২/৩৫১) বলেছেন হাদিসটি সহিহ নয়। শাইখ আল-কারী তার মাওযুয়াত গ্রন্থের ৮৩ পৃষ্ঠায় ইবনু তাইমিয়া হতে নকল করে বলেছেনঃ হাদিসটি বানোয়াট। ফিরোযাবাদী বলেনঃ যদিও অধিকাংশ লোক এটিকে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস বলে চালাচ্ছেন, তবুও এটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিসের অন্তরভূক্ত নয়। এটি ইসরাইলীদের বর্ননায় বর্ণিত একটি কথা। মুহাদ্দিসগণ এ হাদীসের উপর উল্লেখিত হুকুম লাগালেও পরবর্তী হানাফী ফকীহগণের মধ্য হতে জনৈক ফাকীহ্ এটির ব্যাখ্যায় পুস্তক রচনা করেছেন, অথচ হাদীসটির কোন অস্তিত্বই নেই। (যঈফ ও জাল হাদিস, তাওহীদ পাবলিকেশন, হাদিস নম্বর ৬৬, বাংলা হাদিস এ্যাপ-এ হাদিস সিরিয়াল-৬৬)।

সুফীদের পরিভাষায় মা’রিফত হচ্ছে, এমন এক স্তর যার মধ্যে বান্দাহ উপনীত হলে সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে অবগতি অর্জন করতে পারে। এ স্তরে পৌঁছতে পারলে তার অন্তর আলোক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তখন তিনি বস্তুর নিকট তত্ত্ব উপলব্ধি করতে শুরু করেন। মানব জীবন ও সৃষ্টি জীবনের গুপ্ত রহস্য তার নিকট স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে।’ (নাউজুবিল্লাহ, এমন গুন কোন নবীকেও দেননি)।

কোন কোন সুফিদের ভাষায় মারফত অর্থ নূরে মারফত বা নুরে এলাহী তথা মহান আল্লাহ্ পাকের জ্যোতিময় দীপ্তি, পরম জ্যোতিময় সত্তার পরিচিতি লাভ, পরম প্রেমময় মহান আল্লাহ্ পাকের পূত-পবিত্র নূরের  সাথে পরিচিত হওয়াকেই মারেফত বলে। মারেফতের অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছতে হলে চারটি স্তর অতিক্রম করা অপরিহার্য।

(১) ইমানঃ অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন।

(২) তলবঃ অদৃশ্য বিষয় বস্ত্তর অনুসন্ধান কার্যে লিপ্ত হওয়া।

(৩) ইরফানঃ অদৃশ্য বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা।

(৪) ফানাফিল্লাহঃ অদৃশ্য বস্ত্ততে উপনীত ও উন্নীত হওয়া।

অর্থাৎ পরম প্রেমাম্পদের জ্যোতিময় সত্তার আলোকে নিজের ক্ষুদ্রতম সত্তাকে আলোকিত করে তোলা। তাদের মতে, মারেফতে পরিজ্ঞাত ব্যক্তিকে বলা হয় আরেফ বা আশেক আর মাশুকের মিলন কামনাই সুফি সাধনার মর্মকথা। অদৃশ্য বস্ত্তর ধ্যান ধারণায় রত অবস্থায় সাধনা করতে করতে সুফীর হৃদয়ে এমন এক অবস্থায় সৃষ্টি হয় যা তত্বজ্ঞানের নেত্র দ্বারা সৃষ্টি জগতের পরম সত্বা মহান আল্লাহর সিফাতকে প্রত্যক্ষভাবেই অনুভব এবং উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। এইরূপ নির্ভুল উপলব্ধির নামই ইরফান, বা আত্মোপলব্ধি জ্ঞান। সুফিগণ সাধনা বলে যখন জ্ঞানের চরম পরম সীমায় উন্নীত হয়ে থাকেন তখন তারা মহাজ্ঞানী রাববুল আলামীনের প্রদত্ত জ্ঞান প্রভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেন তখন তাদের ক্ষুদ্রতম জ্ঞানসত্তা মহান জ্ঞানসত্তায় মিশে কোন প্রকার ব্যবধানে দেখতে পান না সৃষ্টি জগতের বিভেদ রেখা ভুলে গিয়ে সব একাকার দেখতে পান এরই নাম ফানাফিল্লাহ বা আল্লাহতে ফানা হয়ে যাওয়া(নাউজুবল্লাহ, এটাই সুফিদের কুফরি আকিদা)

তারা আরও বিশ্বাস করে, মারেফত হলো আল্লাহর জরাতে বিচরণ ধর্মী একটি জগত। এই জগত চেনা-অচেনা, জানা-অজানা, আলো-আঁধার মেশা একটি দ্বিধা-দ্বন্দের জগত। এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝেই পরম প্রেমময়ের দর্শন লাভের আকাঙ্খা এবং তাকে জানার ব্যাকুলতা বার বার হানা দিতে থাকেন। এমনিভাবে মুর্শিদের সাহায্যে মারেফতের গোপন রাজ্যে প্রবেশ করে আত্ম বিভোর হয়ে থাকেন। যে সত্যে তিনি উপনীত হন, সে পরম সত্যের সন্ধান তিনি লাভ করে থাকেন, আর নিজের চিন্তা ভাবনার মধ্যে সীমিত থাকেন, নিজে নিজেই বহু কিছু উপলব্ধি করতে থাকেন যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না।

সেই পরম সত্যের  ধারণা প্রকাশ করা ভাষাজ্ঞানের বর্ণনাতীত। কেননা তা অনির্বাচনীয়, অপূর্ব, অপরূপ যা অব্যক্ত, অনন্ত ও অসীম। মারেফতে  উত্তীর্ণ হতে পারলে আত্মদর্শন লাভ করা যায় পরম সত্তার পরিচিতি পাওয়া যায়। দেহের মাঝে দেহীর অবস্থান, তাই আত্মতত্ত্ব নির্ভর করছে দেহ তত্বের উপর। দেহতত্বের উপর বিজয়ী হতে পারলেই আত্মতত্বে উন্নীত হওয়া যায়। আত্মতত্বের উপনীত হতে পারলেই পরম তত্বের বা পরম সত্তায় উপনীত হওয়া যায়। এ পর্যায়ে উত্তীর্ণ ব্যক্তিকে আ‘রিফ বা সুফী বলে। যাঁরা মাটির তৈরী মানুষ হয়েও মর্যাদায় আগুণের তৈরী জ্বীন এবং নুরের তৈরী ফেরশতেদার উর্দ্ধে উঠতে সক্ষম হন।

মন্তব্যঃ ইসলাম ধর্ম কোন পাগলের কথা নয়। কোন মানুষের মনগড়া মতবাদ নয়। কবির কাব্য নয় যে যা ইচ্ছা এখানে সংযোজন বা বিয়েজন করবে। ইসলাম হল মহান আল্লাহ কর্তৃক নাজিল কৃত বিধান। মহান আল্লাহ বলেন,

 وَمَا هُوَ بِقَوۡلِ شَاعِرٍ۬‌ۚ قَلِيلاً۬ مَّا تُؤۡمِنُونَ (٤١) وَلَا بِقَوۡلِ كَاهِنٍ۬‌ۚ قَلِيلاً۬ مَّا تَذَكَّرُونَ (٤٢) تَنزِيلٌ۬ مِّن رَّبِّ ٱلۡعَـٰلَمِينَ (٤٣)

অর্থঃ এবং এটা কোন কবির কালাম নয়। তোমরা কমই বিশ্বাস কর। এবং এটা কোন গণকের কথা নয়, তোমরা কমই অনুধাবন কর। এটা বিশ্বপালনকর্তার কাছ থেকে অবতীর্ণ। [ সুরা হাক্বকাহ ৬৯:৪১-৪৩ ]

কোন প্রকার ওহী পরিবর্তণ পরিবর্ধনের ক্ষমাতা আল্লাহ আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেন নাই।

ۚ قُلۡ مَا يَكُونُ لِىٓ أَنۡ أُبَدِّلَهُ ۥ مِن تِلۡقَآىِٕ نَفۡسِىٓ‌ۖ إِنۡ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَىٰٓ إِلَىَّ‌ۖ إِنِّىٓ أَخَافُ إِنۡ عَصَيۡتُ رَبِّى عَذَابَ يَوۡمٍ عَظِيمٍ۬ (١٥)

অর্থঃ হে মুহাম্মাদ! ওদেরকে বলে দাও, “নিজের পক্ষ থেকে এর মধ্যে কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন করা আমার কাজ নয়৷ আমি তো শুধুমাত্র আমার কাছে যে অহী পাঠানো হয়, তার অনুসারী৷ যদি আমি আমার রবের নাফরমানী করি তাহলে আমার একটি ভয়াবহ দিনের আযাবের আশংকা হয়”৷ (সূরা ইউনুস ১০:১৫)।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ (٣) إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡىٌ۬ يُوحَىٰ (٤)

অর্থঃ সে (মুহাম্মাদ সাঃ) নিজের খেয়াল খুশীমত কথা বলে না৷ যা তার কাছে নাযিল করা হয়, তা অহী ছাড়া আর কিছুই নয়৷  (সূরা আন-নাজম ৫৩:৩-৪)

সুফিদের উল্লেখিত ভ্রান্তমতবাদ কুরআন সুন্নাহর কোথাও খুজে পাওয়া যাবেনা। কাজেই সুফিদের এই সকল দলীল বিহীন কুরআন সুন্নাহর বহিভুত কথার কোন মুল্য ইসলামে নেই। আর যখন এই সকল ভ্রান্তমতবাদ ইসলাম বলে প্রচার করবেন তখন তারা নিশ্চিত কুফরিতে পতিত হবেন।

তাই নির্দিধায় বলা যায় সুফিদের এই মারেফত আসলে মারেফত নয়, জাহান্নামে যাওয়ার পথ। যে ব্যক্তির নিজের মাঝেই আল্লাহ তাআলার বিধান ও রাসূল সাঃ এর সুন্নত নেই (শরীয়তের আমল নেই)। উক্ত ব্যক্তি কি করে অন্য ব্যক্তিদের আল্লাহ তাআলার সাথে মারেফত বা পরিচয় করিয়ে দিবে? সেতো নিজেই আল্লাহ তাআলাকে চিনে না। তাই শরীয়তের বিধান লঙ্ঘণকারী কথিত মারেফতীদের বিশ্বাস করা জায়েজ নেই।

 তরিকতঃ

তরিকা একটি আরবি শব্দ। যার বহু বচন হলো তারাইক। প্রখ্যাত আরবি অভিধান লিসানুল আরবে এর অর্থ লেখা হয়েছে সিরাত, মাজহাব, অবস্থা। (লিসানুল আরব দশম খন্ড-২২১ পৃষ্ঠা)। তরিকার আরও কতগুলো অর্থ করা যায় যেমনঃ পদ্ধতি, রীতি, উপায়, রাস্তা, পথ মত, মাধ্যম, স্তর।

সাধারনত তরিকা সুফিাবাদের একটি পরিভাষা। সুফিদের ভাষায়, ইসলামী জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় যেমন পদ্ধতিগত ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি ইলমুল কালামের ক্ষেত্রে আশরারি ও মাতুরিদি মতবাদ, ইলমে ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফি, মালেকি, শাফেঈ ও হাম্বলি মাজহাব, ঠিক এলমে তাসাউফের ক্ষেত্রেও এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের ভিন্ন ভিন্ন রীতি পদ্ধতি রয়েছে এটাকেই বলা হয় তরিকা। এলমে ফিকহের ক্ষেত্রে যেমন প্রসিদ্ধ চার মাজহাবের ইমামদের নামানুসারেই মাজহাবের নামকরণ করা হয়েছে, তেমনি এলমে তাসাউফের তরিকাগুলোকেও বিশেষ সুফিসাধকদের নাম দ্বারা নামকরণ করা হয়েছে।

 পূর্বেই বলেছি, সুফিবাদ উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যে। সেখানকার প্রখ্যাত সুফি দরবেশ, কবি-সাহিত্যিক এবং দার্শনিকগণ নানা শাস্ত্র, কাব্য ও ব্যাখ্যা-পুস্তক রচনা করে এই দর্শনকে সাধারণের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন। কালক্রমে বিখ্যাত সুফিদের অবলম্বন করে নানা তরিকা গড়ে ওঠে। সুফীদের রয়েছে বিভিন্ন তরীকা। স্থান ও কাল অনুযায়ী অসংখ্য সুফী তরীকা আত্ম প্রকাশ করার কারণে এর সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন। চরমোনাই পীর সৈয়দ মোঃ ফজলুল করীম সাহেব ভেদে মারেফত বা ইয়াদে খোদা কিতাবে ১২৬ তরিকা থাকার কথা বলেছেন। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে অসংখ্য সুফী তরীকা আত্মপ্রকাশ করেছে। তার মধ্যে নিম্নের কয়েকটি তরীকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রায়ই সুফী তরীকার পীর ও মুরীদদের মুখে এ সমস্ত তরীকার নাম উচ্চারণ করতে শুনা যায়। এ সমস্ত তরীকা হচ্ছেঃ

১. কাদেরিয়া তরিকা।     (প্রতিষ্ঠাতা আবদুল কাদির জিলানি (৪৭১-৫৬১ হিঃ)।

২. চিশতিয়া তরিকা।         (প্রতিষ্ঠাতা খাজা মু’ঈনুদ্দিন চিশতি (৫৩৭-৬৩৩ হিঃ)।

৩. মাইজভান্ডারিয়া তরিকা  (প্রতিষ্ঠাতা আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারি (১৮২৬-১৯০৬ ইং)।

৪. নকশবন্দিয়া তরিকা।  ‌  (প্রতিষ্ঠাতা খাজা বাহাউদ্দিন ৭১৮-৭৯১ হিঃ)।

৫. মুজাদ্দিদিয়া তরিকা।    (প্রতিষ্ঠিতা নকশবন্দী হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানি (৫৬১-১৬২৪ ইং)। এবং

৬. সুহ্‌রাওয়ার্দিয়া তরিকা। (প্রতিষ্ঠাতা শিহাব উদ্দ্বীন উমার সোহরাওয়ার্দীর  (৫৩৯-৬৩২ হিঃ)।

এই সকল তরিকা যাদের নামের তাদের সাথে সম্পৃক্ত, তারা তারা এই তরিকা প্রতিষ্ঠিত করতে কতটুকু দায়ি ছিলেন তা জানতে হলে এদের জীবনি সম্পর্কে জানতে হবে। তাই যাদের নামে প্রসিদ্ধ ছয় তরিকা প্রতিষ্ঠিত তাদের জীবনি এই বইয়ের সপ্তম অধ্যায় ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করব। অতপর সুফিবাদ বিস্তারে যাদের ভূমিকা আছে তাদের কয়েকজনের জীবন উল্লেখ করব। (ইনশা আল্লাহ)।

 যে সকল তরিকাসমূহ উল্লেখ করা হল এ ধরণের কিছু ইসলামে নেই, অথবা এর কাছাকাছিও কিছু নেই।

হাদীস যেখানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, “ইহুদীরা একাত্তর ফিরকাহ’য় বিভক্ত হয়েছে এবং খৃষ্টানেরা হয়েছে বাহাত্তর ফিরকাহ’য়। আমার উম্মাহ বিভক্ত হবে তিহাত্তর ফিরকা হবে। আর এদের প্রত্যেকটি হবে জাহান্নামী একটি ব্যতীত”। জানতে চাওয়া হল, “তারা কারা, হে আল্লাহর রাসূল?” এবং তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আমার উম্মাহর একটি দল সত্যের অনুসরণ করতে থাকবে এবং বিজয়ী হবে, এবং তাদের যারা অভিশাপ দেয় কিংবা বিরোধিতা করে তারা সেই দলটির কোন ক্ষতি করতে পারবে না, যতক্ষণ না আল্লাহর ফরমান নাযিল হয়।

মনে রাখতে হবে ‘সত্য’ আছে কুর’আন এবং সহীহ হাদীস অনুসরণের মধ্যে। এটাই আল্লাহর পথ, এবং সরল পথ। মহান আল্লাহ বলেন,

وَكَذَٲلِكَ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ رُوحً۬ا مِّنۡ أَمۡرِنَا‌ۚ مَا كُنتَ تَدۡرِى مَا ٱلۡكِتَـٰبُ وَلَا ٱلۡإِيمَـٰنُ وَلَـٰكِن جَعَلۡنَـٰهُ نُورً۬ا نَّہۡدِى بِهِۦ مَن نَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِنَا‌ۚ وَإِنَّكَ لَتَہۡدِىٓ إِلَىٰ صِرَٲطٍ۬ مُّسۡتَقِيمٍ۬ (٥٢) صِرَٲطِ ٱللَّهِ ٱلَّذِى لَهُ ۥ مَا فِى ٱلسَّمَـٰوَٲتِ وَمَا فِى ٱلۡأَرۡضِ‌ۗ أَلَآ إِلَى ٱللَّهِ تَصِيرُ ٱلۡأُمُورُ (٥٣)

অর্থঃ এভাবেই আমি আপনার প্রতি ওহী প্রেরণ করেছি, কুরআন আমার নির্দেশ। আপনিতো আদৌ জানতে না কিতাব কি এবং ঈমানই বা কি। কিন্তু সেই কুরআনকে আমি একটি আলো বানিয়ে দিয়েছি যা দিয়ে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ দেখিয়ে থাকি৷ নিশ্চয়ই আপনি এর সাহায্যে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করে থাকেন। সেই আল্লাহর পথ যিনি, যা কিছু আছে আসমানে ও যা কিছু আছে জমিনে তার মালিক। জেনে রাখ, যাবতীয় বিষয় সেই আল্লাহর সমীপে প্রত্যাবর্তন করে। (সুরা আশ-শুরা ৪২:৫১-৫৩)।

        আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগ থেকে ইসলাম যতই দুরে যাচ্ছে কুরআন ও সহিহ হাদিসের পরিবর্তে ততই সুফিবাদের ধ্যান-ধারণা এবং বিজাতীদের আমল আখলাক মুসলীমদের মাঝে প্রসার লাভ করে। বিজাতীর নোংরা রীতি-নীতির জালে আটাকা পড়ে ইসলাম তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। আর হাজার হাজার শির্কী আক্বীদা ও বিদআতী রীতি-নীতির ইসলামে ঢুকে পড়েছে। সমাজের অজ্ঞ লোকেরা এর বিষাক্ত থাবায় ঈমান হারাচ্ছে। এভাবে মানুষ সরল পথ ছেড়ে বাকা পথ ধরছে।  একক তরিকা বাদ দিয়া হাজারও তরিকা তালাশ করছে।

 সুফিদের মতে তরিকতঃ

সুফিরা অবশ্য তরিকত সম্পর্কে অন্য কথা বলে। তাদের মতে তরিকত হলঃ শরীয়ত থেকে মারেফতে উত্তীর্ণ হতে হলে যে পথ অনুসরণ করতে হয় সেই অনুসৃত পথের নামই তরীকত। তরীকতপন্থী সালেকের জন্য তরীকতের অজানা-অচেনা পথ চলার জন্য একজন দিশারী বা মুর্শিদের প্রয়োজন। মুর্শিদ তাঁকে পথ দেখিয়ে তাঁর গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেন। আবার শরীয়ত পন্থীরা যখন তরীকতের পথে চলতে শুরু করেন তখন তাকে ছালেক নামে অভিহিত করা হয়। ছালেক মুর্শিদের নিকট থেকে মারেফত জগতের বহু রহস্য জেনে নেন। তরীকতের সাধন-ভজনকালে ছালেকের নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়, নানা প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে, নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য উদ্ঘাটিত হতে থাকে। আশেক আর মাশুক মিলন স্বাদে আত্মবিভোর হয়ে যায়। মাশুকের মিলন বাসনা থেকেই হৃদয়ে সৃষ্টি হয় আল্লাহপাকের স্মরণ। তরীকত পন্থীদের কর্তব্য কামেল পীর বা মুর্শিদের নিকট বায়েত গ্রহণ করা। তার মুর্শিদের দেওয়া ছবক নিয়মিত পালন করা। পীরের দেয়া শর্ত পালনে সক্ষম মুরিদকেই তরিকতের গোপন রহস্য সম্পর্কে মুর্শিদ অবহিত করে থাকেন। তরীকত হলো রিয়াজাত-মুশাহিদার পথ, আত্মসংযম ও কঠোর সাধন ভজনের পথ। তরীকত আলমে মালাকুতের অন্তর্ভুক্ত। আলমে মালাকুতকে বলা হয় খোদায়ী জগত, ফেরেশতা জগত, আত্মজগত। এই আলমে মালাকুতে প্রবেশ করতে হলে মানব চরিত্রের কতগুলো মন্দ স্বভাব পরিহার করিতে হয়। যথা-কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মিথ্যা, হিংসা- বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, আত্মঅহংকার, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, জাগতিক ধন সম্পদ, ঐশ্বর্য, কৃপনতা, লোক দেখানো উপাসনা, অবৈধ কার্যকলাপ মিথ্যা, প্রতারণা, পণ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো, ওজনে কম দেওয়া, ওজনে বেশি নেওয়া, অধিক মুনাফার আশায় পণ্যদ্রব্য গুদাম জাত করা, রাহাজানী, নরহত্যা, অপহরণ, মদ্যপান প্রভৃতি।

সুফিদের মতে, তরিকতের প্রচলিত সাত আরকান এবং ছয় আহকাম রয়েছে

৭টি আরকান হলোঃ

(১) আল্লাহকে জানার মত সময়উপযোগী জ্ঞানার্জন।

(২) জাগতিক লোভ লালসা বিসর্জন।

(৩) দুঃখ দৈন্যে ধৈর্য ধারণ।

(৪) আল্লাহ পাকের অনুগ্রহের বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

(৫) হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি ভয়ভীতি রাখা

(৬) আল্লাহর স্মরণে সর্বক্ষণ নিমগ্ন থাকা

(৭) মুরাকাবার মাধ্যমে স্রষ্টা ও সৃষ্টির ধ্যান ধারণায় মগ্ন থাকা।

তরিকতের ছয় আহকাম হলোঃ

(১) আল্লাহর মারফত লাভ।

(২) দানশীলতা।

(৩) সত্যবাদিতা রক্ষায় অটল থাকা।

 ৪) ভাগ্যলিপির উপর দৃঢ় আত্মবিশ্বাস রাখা।

(৫) আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতা বজায় রাখা।

(৬) প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত অবস্থায় দৃঢ়পদ থাকা।

এছাড়াও কম কথা, কম ঘুম ও কম খাবারে অভ্যস্ত হওয়া, নির্জন বাস করা। নৈতিক চরিত্রের উন্নতি সাধনের মাধ্যমে আত্মিক পবিত্রতা অর্জন করাই ত্বরীকতের মুখ্য উদ্দেশ্য।

মন্তব্যঃ ইসলামের নামে হাজার হাজার তরিকা করে ইসলামকে টুকরা টুকরা করা হয়েছে। মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত করা হয়েছে। এই ধরনের ফির্কা সৃষ্টি করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন ও হাদীসে বারবার বিভক্তি, ফির্কাবাজি বা দলাদলি থেকে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا

অর্থঃ “তোমরা আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর ঐক্যবদ্ধভাবে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর: তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ্ তা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। (আল-ইমরান ৩:১০৩)।

অন্যত্র বলেনঃ

وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ ﴿31﴾ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ

অর্থঃ তোমরা ঐ মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না, যারা দ্বীনকে টুকরা টুকরা করে ফেলেছে এবং যারা দলে দলে বিভক্ত হয়েছে, প্রত্যেক দল তাদের কাছে যা ছিল তাই নিয়েই খুশি। (সূরা রূম, ৩০:৩১ ও ৩২ আয়াত)।

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ

অর্থঃ তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং মতভেদ করেছে, এদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।” (সূরা আল-ইমরান ৩:১০৫)।

অন্য আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:

وَلا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ

অর্থল এবং অন্তর্ভুক্ত হয়ো না মুশরিকদের, যারা নিজেদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উৎফুল্ল।” (সূরা রূম আয়াত ৩০:৩২-৩৩।

আল্লাহ সুবহানাহু বলেন:

إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ

অর্থঃ যারা তাদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো দায়িত্ব তোমার নয়; তাদের বিষয় আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন।” (সূরা আন‘আম আয়াত ১৫৯)।

তাহলে এ কথা ষ্পষ্ট যে, এই রকম তরিকার সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামকে টুকরা টুকরা করা হারমা। এই তরিকাগুলো সেই নব আবিষ্কৃত পথ বা বিদআত যা কুরআন সুন্নাহ এবং শ্রেষ্ঠ তিন প্রজম্মের সালফে সালেহিরদের পথের বিপরীদ। এই তরিকাগুলোর শায়েখগন তাদের নিজস্ব বাক্যে ও তরিকায় জিকির আযকার তৈরি করছে এবং তাদের অনুসারিগন তা নিয়মিত আমল করতে বলছে। কোন কোন তরিকাতো (মাইজভান্ডারিয়া) হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদি, বৌদ্ধ, সকল ধর্মমতকে সঠিক বলে প্রাচার করছে। তাদের পীর বা শায়েকদের নামে মিথ্যা তথ্য বহুল শির্কি কিরামত বর্নণা করে, কিতার রচনা করে, তা মুরিদের অজিফার নামে দৈনিক পড়তে বাধ্য করে। আজগুবি ধরনের অনুষ্ঠান (উরুস, মিলাদ, ফাতেহাখানি) এর মাধ্যমে মুসলীমদের ইসলাম থেকে দুরে সরিয়ে দিচ্ছে। আপনার যদি ইসলাম সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান থাকে আর এ সকল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন তবে এদের অসারতা প্রমানে আপনাকে মোটেই বেগ পেতে হবে না। সুফিদের মাজার কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান দেখলে তাদের মুসলীম ভাবতে আপনার কষ্ট হবে। যদি শিয়াদের আমল আকিদা সম্পর্কে আপনার পূর্বে কোন ধারনা থাকে, আর আপনি মাজার কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানে হটাৎ হাজির হন তবে মনে হবে, এটা শিয়াদের কোন অনুষ্ঠাণ। মহান আল্লাহও তার দেখান সরল পথ বাদ দিয়ে এই সকল পথে চলতে কঠোরভাবে নিষেধ করছেন। যেমন তিনি বলেন,

*وَأَنَّ هَـذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلاَ تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ*

অর্থঃ তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলো না। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা সংযত হও। (সুরা আন’য়াম ৬:১৫৩)।

তার পরও যদি কেউ এই সকল তরিকার অনুসরণ করে। তাহলে আল্লাহর ষ্পষ্ট ঘোষনা, ইসলাম ছাড়া অন্য কোন পথে চলতে চেষ্টা করবে তাকে তিনি আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তরভূক্ত করবেন।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الإِسْلاَمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

অর্থঃ যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতি গ্রস্ত। (সুরা ইমরান ৩:৮৫)।

 

স্ট্যান্ডিং কমিটির সম্মানিত আলেমগণের নিকট এই প্রশ্নটি জানতে চাওয়া হয়েছিলঃ

প্রশ্নঃ ইসলামে শাধিলইয়াহ, খালওয়াতিয়াহ ইত্যাদি অসংখ্য তরিকাসমূহের ন্যায় কিছু কি রয়েছে? যদি থেকে থাকে, তাহলে তার দলীল-প্রমাণাদি কোথায়? এই আয়াতগুলোর অর্থ কি যেখানে আল্লাহ বলছেন,

“তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলো না। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা সংযত হও”। (সূরা আনআম ৬:১৫৩)

“সরল পথ আল্লাহ পর্যন্ত পৌছে এবং পথগুলোর মধ্যে কিছু বক্র পথও রয়েছে। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সবাইকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারতেন”। (সূরা নাহল ১৬-৯)।

সেই পথগুলো কোনটি যা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, এবং আল্লাহর পথ কোনটি? আর ইবন মাসউদ রাঃ বর্ণিত এই হাদীসটির অর্থ কি, যেখানে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দাগ টেনে বলছেন, “এটিই হেদায়াতের পথ” এরপর এর ডানে বামে অনেকগুলো দাগ টেনে বলেন, “এগুলো অন্যান্য পথ এবং প্রত্যেক পথে একটি করে শয়তান উপস্থিত যে মানুষকে সেই পথের দিকে ডাকছে?”

উত্তরঃ আপনি যে সকল তরিকাসমূহ উল্লেখ করেছেন এ ধরণের কিছু ইসলামে নেই, অথবা এর কাছাকাছিও কিছু নেই। ইসলামে যা আছে তা হচ্ছে আপনি যে দুটি আয়াত এবং হাদীসটি উল্লেখ করেছেন এবং অন্য আরেকটি হাদীস যেখানে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, “ইহুদীরা একাত্তর ফিরকাহ’য় বিভক্ত হয়েছে এবং খৃষ্টানেরা হয়েছে বাহাত্তর ফিরকাহ’য়। আমার উম্মাহ বিভক্ত হবে তিহাত্তর ফিরকাহ’য়; আর এদের প্রত্যেকটি হবে জাহান্নামী একটি ব্যতীত”। জানতে চাওয়া হল, “তারা কারা, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম?” এবং তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমার উম্মাহর একটি দল সত্যের অনুসরণ করতে থাকবে এবং বিজয়ী হবে, এবং তাদের যারা অভিশাপ দেয় কিংবা বিরোধিতা করে তারা সেই দলটির কোন ক্ষতি করতে পারবে না, যতক্ষণ না আল্লাহর ফরমান নাযিল হয়…’ সত্য আছে কুর’আন এবং সহীহ হাদীস অনুসরণের মধ্যে। এটাই আল্লাহর পথ, এবং সরল পথ। এটিই ইবন মাসউদ রাঃ থেকে বর্ণিত হাদীসে বর্ণিত সরল পথ, আর এই পথ অনুসরণ করেছেন সাহাবাগণ  রাঃ এবং তাদের পরবর্তী সালফে সালেহীনগণ, এবং তাদের যারা অনুসরণ করেছেন তাঁরা। অন্য সকল তরিকা বা দল হল আয়াতে উল্লেখিত সেই দল যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “…এবং অন্যান্য পথে চলো না। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে…” (আল-আন’আম

৬-১৫৩) -ফাতাওয়া আল-লাযনাহ আল-দা’ইয়িমাহ ২/২৮৩,২৮৪। আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন।

হাকিকতঃ

হাক্কুন শব্দ থেকে হাকিকুন এবং হাকিকুন শব্দ থেকে হাকিকত শব্দটির উৎপত্তি। যার আভিধানিক অর্থ বাস্তব, ধ্রুবসত্য, পরম সত্তা, সার বিষয়বস্ত্ত ইত্যাদি। হাকিকতের পারিভাষিক অর্থ হল, যে পরম সত্য বিষয় সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হওয়া যায় তাকেই হাকীকত বলা হয়। সাধারন মুমিন মুসলিম হাকিকত বলতে কোন ব্যক্তি বা বস্তুর বাস্তব অবস্থাকে বুঝে থাকে  আর সুফিগন হাকিকত বলতে বুঝে, তাদের সাধনান শেষ পর্যায়ের অবস্থা। সুফিগন মনে করে, তরীকতের অভিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হবার নামই হাকীকত। ইহা সুফী সাধনার চতুর্থ স্তর বা ধাপ। সুফি বা আরেফ এই স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারলে পরম সত্যের সন্ধান ও স্বরূপ লাভ করিতে পারেন, তথা আত্মপলব্ধি করতে সক্ষম হন। এই পরম প্রেমাম্পদের ভালবাসায় নিজের অস্তিত্ববোধ হারিয়ে যায়। তারা সৃষ্টি কর্তার সত্তায় আত্মবিলোপিত হয়ে পড়েন। ইহা ফানাফিল্লাহের স্তর। এই স্তরে উন্নীত আশেক তার মাশুকের প্রেমে উম্মাদনায় আত্ম বিভোর হয়ে পড়েন। একটি চিরন্তন অস্তিত্বের সন্ধান লাভ করতে পারেন। (নাউজুবিল্লাহ)

 

সুফিদের মতে হাকিকতঃ

তাদের মনে সাধনার এ পর্যায় স্রষ্টার অন্বেষণকারী সুফি ও স্রষ্টার মধ্যকার পর্দা উঠে যায়, যার দরুণ মহান আল্লাহর যাত (সত্তা), মোবারক ও তাঁর সিফাত (গুণাবলী), তাঁর রাজসিকতা ও সৌন্দর্য, সুফিগনের সন্নিকটে অবস্থান করে এবং সে স্রষ্টার পরম নৈকট্য অনুভব করে। এই অনুভূতি ও কলব তথা অন্তরের জ্ঞানের ফলস্বরূপ খোদা-তালাশি ব্যক্তি (সুফি/সালেক/পীর/মুরিদ) তরীকতের গোপন রহস্য জানতে পারেন এবং তিনি হাকীকতেরও জ্যোতি ও অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করেন।

সুফিদের ভ্রান্তমতানুসারে তরিকতের আমল সমূহ যথাযথভাবে পালন করার দ্বারা অন্তরে যে নূর সৃষ্টি হয় তাকে হকিকত বলে। আন্তরিকভাবে খোদার প্রেমের স্বাদ ও পরমাত্মার সাথে তার যোগাযোগ হয়। এটা হচ্ছে সুফী সাধনার চুড়ান্ত স্তর। এ স্তরে উন্নীত হলে সুফী ধ্যানের মাধ্যমে নিজস্ব অস্তিত্ব আল্লাহর নিকট বিলীন করে দেন। অন্য কথায় তার উপর আল্লাহর গুনের বিকাশ ঘটে। আশরাফ আলী থানবীর (রহ) পীর হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মাক্কি ওয়াহদাতুল ওজুদ সম্পর্কে তার অনুভূতি ও ভাবধারা ব্যক্ত করে বলেনঃ যে দিকে যে বস্তুর প্রতিই দৃষ্টি করি, তাতে তোমাকেই দেখতে পাই, অন্য আর কিছু দেখিনা।

মিনা বুক হাউজ থেকে প্রকাশিত, (প্রকাশ কাল জুন ২০১০) মসনবী শরীফ এর ৩৫ পৃষ্টায় মাওলানা রুমীর কবিতার ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়েছেঃ সর্বত্রই মহান প্রেমাস্পদ আল্লাহ তায়ালার বিকাশ; আর সৃষ্টি সবই পর্দাস্বরূপ। সে হিসেবে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান।

নিজস্ব অস্তিত্ব আল্লাহর নিকট বিলীন হলে নিজের কোন অস্বিত্ব থাকে না। তখন সৃষ্টি আর স্রষ্টার মাঝে কোন পর্থক্যও থাকেন। (নাউজুবিল্লাহ) আর এটাই হল তাদরে কুফরি আকিদা “ওয়াহদাতুল ওজুদ” তাদের বিশ্বাস ওয়াহদাতুল ওজুদ বিশ্বাসের প্রভাবে সৃষ্টি ও স্রষ্টা এক হয়ে যায়, তার নিজের গুন-গরিমা এমনকি অস্তিত্বেও আল্লাহ তায়ালার গুনাবলীর বিকাশ এতই প্রকট হয়ে যায় যে নিজের গুন-গরিমার সাথে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে পড়ে এবং নিজের কিঞ্চিতকর অস্তিত্ব তার দৃষ্টিতে ধরাই পড়ে না। তার দৃষ্টি শুধু আল্লাহর প্রতিই নিবদ্ধ থাকে। এ ভাবাবেগের সম্মুখে দুর্বল শ্রেণীর কোন মানুষ নিজের অস্তিত্ব অস্বীকার করে আনাল হক বা আমি খোদা উক্তি করে বসে। অর্থাৎ আমি এবং আমার সব কিছু আল্লাহ তায়ালার গুনাবলীতে বিকাশ মাত্র। আমি আমার মত ধর্তব্যের কিছু নয়। যেমনঃ হুসেইন বিন মনসূর হাল্লাজের বলেছিলেন ‘আনাল হক’ আর্থাৎ আমি হক ((আল্লাহ)।

সুফি মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা জালালুদ্দীন রুমী বলেনঃ  মনসূর হাল্লাজ ‘আমি খোদা’ বলে আল্লাহর পাগল সাব্যস্ত হয়েছিল, আর ফেরাউন ‘আমি খোদা’ বলে ধ্বংশ হয়েছে। প্রথম ‘আনাল হক বা আমি খোদা’ আল্লাহর রহমত অনুগ্রহ করুনা; এর ভিত্তিছিল আল্লাহর তাবেদারীতে বিলীনতা। আর দ্বিতীয় ‘আনাল হক বা আমি খোদা’ উক্তিকারির উপর আল্লাহর লানত অভিশাপ। কারন, এর ভিত্তি আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকারের উপর। মসনবী শরীফের উর্ধ অনুবাদক (আশরাফ আলী থানবীর) সুফিবাদে বিশ্বাসি হলেও তিনি লিখেনঃ এই ধরনের কথা দ্বারা “কাজীর বিচারে সে কাফির বা মুর্তাদ বিবেচিত হয়ে যাওয়ায় কাজি তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রয়োগ করতে পারে”

অথচ এই সকল আলেমগন আবার “ওয়াহদাতুল ওজুদ” আকিদায় বিশ্বাসি ছিল।

 সুফিগন আরও বিশ্বাস করে, শরীয়তগত জ্ঞান, তরিকতগত অভিজ্ঞতা এবং মারেফতের পরিচিতি জ্ঞানের সমন্বয়ে আধ্যাত্মিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অন্তদৃষ্টি সম্পন্ন মৌলজ্ঞান লাভ করে থাকেন। এ পর্যায় সুফি/সালেক ফানাফিল্লাহ দর্জায় হয় যাকে হাকিকত বলা হয়। এ মর্জাদায় উন্নীত হলে সে তার নিজের বুদ্ধি জ্ঞান, অনুভূতি ইত্যাদি মহান সত্তার হারিফে ফেলে। হাকিকতে উত্তীর্ণ সাধককে কামেল (পরিপূর্ণ মানব) বা আরেফ বিল্লাহ বলা হয়। তাদের ধারনা এ জন্য কঠোর সাধনা মুরাকাবা মুশাহেদার মাধ্যমে আল্লাহ পাকের একাত্ববোধের সাতে মিশে যেতে হবে। তাদের বিশ্বাস এই স্থরে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কোন অস্থিত্ববোধ হৃদয়ে থাকেনা। এ প্রসঙ্গে পারস্য কবি দেওয়ান হাফেজ বলেছেন, খোদার প্রেমে যে হৃদয় অনুরঞ্জিত, অবধারিত মরণেও হয়না তাঁর মরণ, সে যে চির জীবিত চির অমর।

ইসলামের ধর্মে সুফিদের ব্যাখ্যাকৃত এমন কোন হাকিকত নেই যে, শরীয়ত, তরীকত ও মারিফত এর পথ অতিক্রম করে কোন মুমিনকে হাকীকত অর্জন করতে হবে। এটা সংসার বিরাগি কিছু সুফিদের অভিমত মাত্র।

 

ইসলামে শরীয়ত, তরীকত, মারিফত ও হাকিকতের অবস্থানঃ

 কুরআন, সুন্নাহ, সাহবিদের (রাঃ) আমল কোথান এ কোন অস্ত্বিত্ব খুজে পাওয়া যায়না। কাজেই শরীয়ত, তরীকত, মারিফত ও হাকিকতের কোন অবস্থানই ইসলামি শরিয়তে নেই। যদি কেউ আশা করে এই পন্থায় আল্লাহর স্বন্ত্বষ্টি অর্জণ করবে তাহলে সে মহা ভুলের মাঝে আছে। কারন তার রাস্তা ভুল।

“হাদিসের নামে জালিয়াতি” বই-এ ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ শরীয়ত, তরীকত, মারিফত ও হাকীকত নামে একটা অধ্যায় রচনা করছেন তিনি সেখানে লিখেন।

শরীয়ত, তরীকত, মারিফত ও হাকীকত এই শব্দ সমাজে প্রচলিত অতি পরিচিত চারটি পরিভাষা। কুরআন-হাদীসে ‘‘শরীয়ত’’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামের চারটি পর্যায় বা স্তর অর্থে তরীকত, মারেফত ও হাকীকত পরিভাষাগুলো কুরআন বা হাদীসে কোথাও ব্যবহৃত হয় নি। কখনোই কোনো সাহাবী, তাবিয়ী, প্রসিদ্ধ চার ইমাম বা অন্য কেউ ইসলামের চারটি স্তর বা পর্যায় হিসেবে  এ পরিভাষাগুলি ব্যবহার করেন নি। প্রথমে শীয়াগণ এগুলি উদ্ভাবন ও ব্যবহার করেন। পরে সুন্নী সরল সূফীগণের মধ্যে পরিভাষাগুলি  প্রসার লাভ করে। বিশেষত, ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর পর মিসর, ইয়ামান, ইরান, ইরাক, বাগদাদ ও মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র শীয়াগণের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে শীয়া আকীদার অনেক কিছুই সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ সুযোগে জালিয়াতগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে হাদীস বানিয়ে বলেছেঃ

اَلشَّرِيْعَةُ شَجَرَةٌ وَالطَّرِيْقَةُ أَغْصَانُهَا وَالْمَعْرِفَةُ أَوْرَاقُهَا وَالْحَقِيْقَةُ ثَمَرُهَا

অর্থঃ ‘‘শরীয়ত একটি বৃক্ষ, তরীকত তার শাখা-প্রশাখা, মারিফত তার পাতা এবং হাকীকত তার ফল।’’

(সিররুল আসরার, পৃ. ৩৩)। মিথ্যাচারিদের আল্লাহ লাঞ্চিত করুন।

তাদের বানানো আরেকটি কথাঃ

اَلشَّرِيْعَةُ أَقْوَالِيْ وَالطَّرِيْقَةُ أَفْعَالِيْ وَالْحَقِيْقَةُ حَالِيْ وَالْمَعْرِفَةُ رَأْسُ مَالِيْ

অর্থঃ ‘‘শরীয়ত আমার কথাবার্তা, তরীকত আমার কাজকর্ম, হাকীকত আমার অবস্থা এবং মারিফাত আমার মূলধন”। (আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৬)।

আরবী মা’রিফাত (المعرفة) শব্দটি আরাফা (عرف) ক্রিয়াপদ থেকে গৃহীত। এর অর্থ  হলঃ কোনো ইন্দ্রিয় দিয়ে কোনো কিছু অবগত হওয়া বা পরিচয় লাভ করা। এভাবে মূলত ইন্দ্রিয়-লব্ধ জ্ঞান বা পরিচয়কে ‘‘মারিফাত’’ বলা হয়। তবে সাধারণত ‘মারিফাত’ বলতে ‘‘জ্ঞান’’, ‘‘পরিচয়’’ বা শিক্ষা  (knowledge, education) বুঝানো হয়। ‘‘শরীয়ত, তরীকত, হাকীকাত ও মারিফাত’’ এ পর্যায়ক্রমিক ধারায় ‘‘মারিফাত’’-কে শরীয়তের উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে কুরআন-সুন্নাহ সুস্পষ্টভাবেই মারিফাতকে শরীয়তের নিম্নের স্থান দিয়েছে। ‘জ্ঞান’ অর্থে ‘মারিফাত’ ঈমান অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আল্লাহর মারিফাত বা আল্লাহর পরিচয় লাভ মানুষকে তাঁর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাসের দিকে ধাবিত করে। তবে কুরআন-হাদীসে মূলত ‘‘ইলম’’ এবং ‘‘ফিকহ’’-এর প্রশংসা করা হয়েছে, ‘‘মারিফাত’’-এর কোনো বিশেষ প্রশংসা করা হয় নি। ‘‘মারিফাত’’ ঈমানের পথে পরিচালিত করলে তা প্রশংসনীয়। উপরন্তু কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘‘মারিফাত’’ অর্জনের পরেও মানুষ কুফর বা অবিশ্বাসে লিপ্ত হয়। কুরআনে একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহূদী-খৃস্টানদের অনেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর দীন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ‘‘মারিফাত’’ অর্জনের পরেও কুফরী করত। মহান আল্লাহ বলেনঃ

فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ

অর্থঃ ‘‘অতঃপর যখন তাদের নিকট তা (কুরআন) আগমন করল, তারা তার মারিফাত অর্জনের (প্রকৃত পরিচয় জানার) পরেও কুফরী করল। (সূরা বাকারা ২:৮৯)।

মহান আল্লাহ আরও বলেনঃ

يَعْرِفُونَ نِعْمَةَ اللَّهِ ثُمَّ يُنْكِرُونَهَا وَأَكْثَرُهُمُ الْكَافِرُونَ

অর্থঃ ‘‘আল্লাহর নিয়ামতের মারিফাত (প্রকৃত পরিচয়) তারা লাভ করে- অতঃপর তারা তা অস্বীকার করে এবং তাদের অধিকাংশই কাফির।’’ (সূরা নাহল ১৬:৮৩)।

কুরআন-সুন্নাহ মুমিনদেরকে ‘‘মারিফাত’’ অর্জনের নির্দেশ দেয়নি, বরং ইলম অর্জনের নির্দেশ দিয়েছে; কারণ ‘‘মারিফাত’’ তো ঈমান অর্জনের পূর্বের অবস্থা। কিন্তু শীয়াগণ মারিফাতকে ঈমান, ইসলাম ও শরীয়ত থেকে পৃথক উচ্চপর্যায়ের বিষয় বলে প্রচার করেন এবং মারিফাতকে ‘‘তত্ত্বজ্ঞান’’ বা গোপন বা পৃথক কোনো জ্ঞান বলে প্রচার করেন। এ সকল বিভ্রান্তির অপনোদনে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর নিম্নের বক্তব্য প্রণিধানযোগ:

نَعْرِفُ اللهَ تَعَالَي حَقَّ مَعْرِفَتِهِ كَمَا وَصَفَ اللهُ نَفْسَهُ فِيْ كِتَابِهِ بِجَمِيْعِ صِفَاتِهِ .. وَيَسْتَوِيْ الْمُؤْمِنُوْنَ كُلُّهُمْ فِيْ الْمَعْرِفَةِ وَالْيَقِيْنِ وَالتَّوَكُّلِ وَالْمَحَبَّةِ وَالرِّضَا وَالْخَوْفِ وَالرَّجَاءِ وَالإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ، وَيَتَفَاوَتُوْنَ فِيْمَا دُوْنَ الإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ كُلِّهِ.

অর্থঃ ‘‘মহান আল্লাহর প্রকৃত মা’রিফাত আমরা লাভ করেছি, তিনি যেভাবে তাঁর কিতাবে তাঁর নিজের বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে তাঁর সকল বিশেষণ সহকারে। … মুমিনগণ সকলেই সমান মারিফাতের বিষয়ে, এবং ইয়াকীন, তাওয়াক্কুল, মাহাব্বাত, রিযা (সন্তুষ্টি), খাওফ (ভয়), রাজা (আশা) এবং এ সকল বিষয়ের ঈমান এর ক্ষেত্রে। তাদের মর্যাদার কমবেশি হয় মূল ঈমান বা বিশ্বাসের অতিরিক্ত যা কিছু আছে তার সবকিছুতে।’’ [ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আকবার; মোল্লা আলী কারীর ব্যাখ্যা-সহ পৃষ্ঠা-১৫১-১৫৭)।

ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর বক্তব্য থেকে দুটি বিষয় সুস্পষ্টঃ

(১) মারিফাত ঈমানেরই সহযাত্রী। আল্লাহর সত্যিকার মারিফাত লাভই ঈমানের পথে পরিচালিত করে; এজন্য সকল মুমিনই আল্লাহর হক্ক বা প্রকৃত মারিফাত লাভ করেছেন এবং এ বিষয়ে তাঁরা সকলেই সমমর্যাদার।

(২) আল্লাহর মারিফাত গোপন কোনো তত্ত্বজ্ঞান নয় বা তা অর্জনের জন্য গোপন কোনো পথ নেই। মহান আল্লাহ তাঁর নিজের বিষয়ে ওহীর মাধ্যমে যা জানিয়েছেন তা অবগত হওয়াই তাঁর প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মারিফাত।

 সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment