সফরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানঃ চতুর্থ কিস্তি

সফরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানঃ চতুর্থ কিস্তি

 সফরের সময় সিয়ামের বিধান

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

সফরের কষ্টের কথা বিবেচনা করে ইসলাম সফর বা ভ্রমণকারীর জন্য ইসলামী বিধানে কিছুটা রুখসত বা ছাড় দিয়েছে। সালাত মহান আল্লাহ এমন এক আদেশ যাকে কোন অবস্থায়ই পরিত্যাগ করা যাবে না, তাই সে সফরে থাকুক আর বাড়িতে থাকুন। কিন্তু মহান আল্লাহ সফরের সময় সালাতের ব্যাপারে আমাদের প্রতি কিছুটা সহনশীলতা প্রদর্শণ করেছেন। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হওয়া সত্বেও সফর বা ভ্রমণকরীর জন্য চার রাকআত বিশিষ্ট সালাতকে কসর করে বা কমিয়ে দুই রাকআত করেছেন। শুধু সালাত নয় সফরে আরও কয়েকটি হুকুমের ব্যাপারে মহান আল্লাহ কিছুটা ছাড় বা রুখসত প্রদান করেছেন। সফরে থাকা কালিন সময়ে সফরকারিকে মুসাফির বলা হয়। মুসাফির ব্যক্তি সব সময় চারটি রুখসত বা ছাড়ের অধিকারী হবে। সে চারটি রুখসত হলঃ

১। সালাতকে কসর করে আদায়

২। সালাতকে জমা করা।

৩। সফরে তিন দিন ও তিন রাত্রি পর্যন্ত মোজার উপর মাসেহ করা

৪। সফর অবস্থায় রমযানের সিয়াম ভঙ্গ করা

সফরের সময় সিয়ামের বিধান

সিয়াম পালন করতে মহান আল্লাহ নির্দেশ প্রদান করছেন এবং কোন শরীয়ত সম্মত ওজর ছাড়া পরিত্যাগ করা যাবেনা। সিয়াম ত্যাগ করা হারাম এবং অস্বীকার কারি কাফির। রমজান মাস ব্যাপিয়া সিয়াম পালন করা ফরজ। কিন্তু মহান আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম এই ফরজ হিসাব মুসাফিরের জন্য কিছুটা ছাড় দিয়েছেন। যে আয়াতে মহান আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম ফরজ করেছেন সেই আয়াতেই তিনি মুসাফিরের জন্য সিয়াম পালনে ছাড় দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম পালন ও মুসাফিরের অবকাশ প্রদান করে সুরা বাকারায় এরশাদ করেন,

*شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ

অর্থঃ রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। (সুরা বাকারা ২:১৮৫)।

সালাতের ব্যাপারে দেখেছি সফরের সময় মুসাফির সালাতের কসর করছে। সিয়ামের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম ভাঙ্গার অবকাশ প্রদাণ করছেন কিন্তু মুসাফির যখন মুকিম হবে তখন তার উপর ঐ সিয়ামের কাযা করা ওয়াজির হয়ে যায়। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

أَيَّامًا مَّعْدُودَاتٍ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ وَأَن تَصُومُواْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ

অর্থঃ গণনার কয়েকটি দিনের জন্য অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে, অসুখ থাকবে অথবা সফরে থাকবে, তার পক্ষে অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্ট দায়ক হয়, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে। যে ব্যক্তি খুশীর সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণ কর হয়। আর যদি রোজা রাখ, তবে তোমাদের জন্যে বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার। (সুরা বাকারা ২:১৮৪)।

এই আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা অসুস্থ ব্যক্তি, সফরে থাকা ব্যক্তি বা মুসাফির, হায়েজ-নেফাস আক্রান্ত নারী, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারী, এবং দুর্ঘটনায় পতিত বা বিপদগ্রস্ত লোককে উদ্ধারকাজে নিয়োজিক ব্যক্তি উপর সিয়াম পালন করা সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছেন।

এই সকল ব্যক্তির যে সকল ওজরের কারনে সিয়াম পালন সাময়িক স্থগিত ছিল, তাদের সে সকল ওজর দুরিভূত হলে ঐ ভাঙ্গা বা বাদপড়া সিয়ামগুলি গননা করে পুনরায় আদায় করতে হবে। অর্থাৎ যখন অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হবে, সফরে থাকা ব্যক্তি সফর শেষ কবরে অর্থাৎ মুসাফির ব্যক্তি মুকিম হবে, নারীগণ হায়েজ-নেফাস এর সময় অতিক্রান্ত করবে, গর্ভবতী নারী সস্তান প্রষব করবে এবং স্তন্যদানকারী নারীর সন্তান স্তন্য পানের সময় অতিক্রান্ত করবে তখন সে তার ভাঙ্গা সিয়ামগুলি আদায় করা ওয়াজিব।

মহান আল্লাহ কুরআনে স্পষ্ট ঘোষনার পর এ সম্পর্কে আর কোন সংশয় থাকার কথা নয়। তাই এ সম্পর্কিত বিধী বিধাণ জানার জন্য কিছু সহিহ হাদিস উল্লেখ করব।

সফরের সময় সিয়াম না থাকার নির্দেষঃ

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, (মক্কা বিজয়ের বছর) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদীনাহ্ হতে মক্কার দিকে রওনা হলেন। (এ সফরে) তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সওম রেখেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন (মক্কা হতে দু’ মঞ্জীল দূরে) ‘উসফান’-এ (নামক ঐতিহাসিক স্থানে) পৌঁছলেন তখন পানি চেয়ে আনালেন। এরপর তা হাতে ধরে অনেক উঁচুতে উঠালেন। যাতে লোকেরা পানি দেখতে পায়। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সিয়াম ভাঙলেন। এভাবে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মক্কায় পৌঁছলেন। এ সফর হয়েছিল রমাযান (রমজান) মাসে। ইবনু ‘আব্বাস বলতেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে সিয়াম রেখেছেন, আবার ভেঙেছেন। অতএব যার খুশী সওম রাখবে (যদি কষ্ট না হয়)। আর যার ইচ্ছা রাখবে না। (সহিহ বুখারী ১৮২০, সহিহ মুসলিম ১১১৩, মিসকাত ২০২৩, আবূ দাঊদ ২৪০৪, নাসায়ী ২৩১৪, আহমাদ ২৬৫২, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮১৬০, ইবনু হিব্বান ৩৫৬৬।

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের বছর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাযান (রমজান) মাসে (মাদীনাহ্ হতে) মক্কা অভিমুখে রওনা হলেন। তিনি (মক্কা মাদীনার মধ্যবর্তী স্থান ‘উসফানের কাছে) ‘‘কুরা-‘আল গমীম’’ পৌঁছা পর্যন্ত সওম রাখলেন। অন্যান্য লোকেরাও সওমে ছিলেন। (এখানে পৌঁছার পর) তিনি পেয়ালায় করে পানি চেয়ে আনলেন। পেয়ালাটিকে (হাতে উঠিয়ে এতো) উঁচুতে তুলে ধরলেন যে, মানুষেরা এর দিকে তাকাল। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পানি পান করলেন। এরপর কিছু লোক আরয করল যে, (এখনো) কিছু লোক সওম রেখেছে (অর্থাৎ- রসূলের অনুসরণে সওম ভাঙেনি)। (এ কথা শুনে) তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ এসব লোক পাক্কা গুনাহগার, এসব লোক পাক্কা গুনাহগার। (সহিহ মুসলিম ১১১৪, মিসকাত ২০২৭, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২০১৯, সহীহ ইবনু হিববান ৩৫৪৯, সহীহ আত্ তারগীব ১০৫৩।

আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা (একবার) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তাঁর সফরসঙ্গী ছিলাম। আমাদের কেউ সায়িম ছিলেন। আবার কেউ সওম রাখেননি। আমরা এক মঞ্জীলে পৌঁছলাম। এ সময় খুব রোদ ছিল। (রোদের প্রখরতায়) সায়িম ব্যক্তিগণ (মাটিতে) ঘুরে পড়ল। যারা  সিয়ামরত ছিল না, ঠিক রইল। তারা তাঁবু বানাল, উটকে পানি পান করাল। (এ দৃশ্য দেখে) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ সিয়াম না থাকা লোকজন আজ সাওয়াবের ময়দান জিতে নিলো। (সহিহ বুখারী ২৮৯০, সহিহ মুসলিম ১১১৯, মিসকাত ২০২২, নাসায়ী ২২৮৩, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৮৯৬১, ইবনু খুযায়মাহ্ ২০৩৩, সহীহ আত্ তারগীব ১০৬১, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮১৫৫, ইবনু হিববান ৩৫৫৯, সহীহ আল জামি‘ ৩৪৩৬।

জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার এক সফরে ছিলেন। এক স্থানে তিনি কিছু লোকের সমাগম ও এক ব্যক্তিকে দেখলেন। (রোদের তাপ থেকে রক্ষা করার জন্য) ওই লোকটির ওপর ছায়া দিয়ে রাখা হয়েছে। (এ দৃশ্য দেখে) তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, ওখানে কী হয়েছে? লোকেরা বলল, এ ব্যক্তি সায়িম (দুর্বলতার কারণে পড়ে গেছে)। এ কথা শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সফর অবস্থায় সিয়াম রাখা নেক কাজ নয়। (সহিহ বুখারী ১৯৪৬, সহিহ মুসলিম ১১১৫, মিসকাত ২০২১, দারিমী ১৭৫০, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮১৫৪)।

সফরের সময় সিয়াম রাখা ইচ্ছধীনঃ

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্ত্রী আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, হামযা ইবনু ‘আমর আসলামী (রাঃ) অধিক সিয়াম পালনে অভ্যস্থ ছিলেন। তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললেন, আমি সফরেও কি সিয়াম পালন করতে পারি? তিনি বললেনঃ ইচ্ছা করলে তুমি সিয়াম পালন করতে পার, আবার ইচ্ছা করলে নাও করতে পার। (সহিহ বুখারী ১৮১৯, সহিহ মুসলিম ১১২১, তিরমিযী ৭১১, নাসায়ী ২৩০৬, ইবনু মাজাহ ১৬৬২, মিসকাত ২০১৯, আহমাদ ২৫৬০৭, ইবনু খুযায়মাহ্ ২০২৮, মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ২৯৬৪, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮১৫৬)।

হামযাহ্ ইবনু ‘আমর আল আসলামী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রসূল! সফর অবস্থায় আমি সওম পালনে সমর্থ। (না রাখলে) আমার কী কোন গুনাহ হবে? তিনি বললেন, এ ক্ষেত্রে আল্লাহ ‘আযযা ওয়াজাল্লা তোমাকে অবকাশ দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এ অবকাশ গ্রহণ করবে, সে উত্তম কাজ করবে। আর যে ব্যক্তি সওম রাখা পছন্দ করবে (সে রাখবে), তার কোন গুনাহ হবে না। (মিসকাত ২০২৯, হাদিসের মান সহিহ; সহিহ মুসলিম ১১২১, নাসায়ী ২৩০৩, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২০২৬, দারাকুত্বনী ২৩০১, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮১৫৮, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৫৬৭, ইরওয়া ৯২৬, সহীহাহ্ ১৯২)।

আবূ সা‘ঈদ আল্ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, (একবার) আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে যুদ্ধে রওনা হলাম। সে সময় রমাযান (রমজান) মাসের ষোল তারিখ অতিবাহিত হয়েছিল। (এ সময়) আমাদের কেউ সওম রেখেছে, আবার কেউ রাখেনি। সায়িমগণ সওমে না থাকা লোকদেরকে খারাপ জানেনি আবার সওমে না থাকা লোকজনও সায়িমগণকে খারাপ মনে করেনি।  (মিসকাত ২০২০ হাদিসের মান সহিহ, সহিহ মুসলিম ১১১৬, আহমাদ ১১৭০৫, সহীহ আত্ তারগীব ১০৬২)।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “সফরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানঃ চতুর্থ কিস্তি

Leave a comment