বিভিন্ন প্রকারের খতম কেন্দ্রিক বিদাআত  : প্রথম কিস্তি

বিভিন্ন প্রকারের খতম কেন্দ্রিক বিদাআত  : প্রথম কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

১। বিভিন্ন প্রকারের খতমঃ

বর্তমানে বিভিন্ন প্রকারের খতমের প্রচলন ব্যাপক আকার আকার ধারন করছে। বিশেষত মৃত্যু ব্যক্তির রুহের মাগফিরাত কামনা করে বা বিপদ আপদ দুর করার নাম করে বিভিন্ন প্রকারের খতম করা হয়।  ‘খতম’ শব্দটি মূলত আরবী ‘ ختم ’  শব্দের বাংলা ব্যবহার। যার মূল অর্থ হচ্ছে, কোনো বস্তুতে মোহর লাগানো বা তাকে সিলযুক্ত করে বন্ধ করা। আমরা খতম শব্দটির কোন কাজ শেষ করার অর্থে ব্যবহার করি। সমাজে প্রচলিত খতমের অর্থ হলো, সম্পূর্ণটুকু পড়ে শেষ করা। যেমন কুরআন খতম অর্থ হলো, কুরআনকে শব্দযোগে পড়ে শেষ করা। পবিত্র কুরআনে শব্দটি হৃদয়ে মোহর এঁটে দেওয়ার অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ

خَتَمَ اللّهُ عَلَى قُلُوبِهمْ وَعَلَى سَمْعِهِمْ وَعَلَى أَبْصَارِهِمْ غِشَاوَةٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ عظِيمٌ

আল্লাহ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানসমূহ বন্ধ করে দিয়েছেন, আর তাদের চোখসমূহ পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। [ সুরা বাকারা ২:৭ ]

      তবে বিভিন্ন হাদীসে ‘ختم’ শেষ করা অর্থে ব্যবহার হয়েছে। যেমন আয়াতটি শেষ পর্যন্ত পড়া, সুরাটি শেষ পর্যন্ত পড়া ইত্যাদি শব্দ হাদীসে ব্যবহার হয়েছে।  কুরআন সম্পূর্ণটা পড়ার ক্ষেত্রে খতম শব্দের ব্যবহার সাহাবিদের মধ্যে ছিল। তবে ‘হাদীস খতম’ বা ‘হাদীসটি খতম’ এমন কোনো ব্যবহার বা প্রয়োগ তাদের মাঝে ছিল বলে জানা যায় না। খতম শব্দটি শেষ পর্যন্ত পৌঁছা বা পুরোটা পড়ার অর্থে ব্যবহার হলেও ‘খতম করানো’ বা ‘খতম পড়ানো’, এমন কোনো ব্যবহার বা প্রয়োগ না সাহাবিদের যুগে ছিল, না খাইরুল ক্বুরুনে ছিল। কেননা কুরআন, হাদীস, দো‘আ, দুরূদ, যিকর ইত্যাদির খতমের যে আমল আজ সমাজে প্রচলিত এই সিস্টেম বা পদ্ধতিটি একেবারেই নতুন। তাই ‘খতম’ শব্দের শাব্দিক অর্থ অভিধানে পেলেও আমাদের সিস্টেমের তার পারিভাষিক কোনো অর্থ আহলে ইলমদের কোনো কিতাবে পাবেন না। কাজেই আমাদের সমাজের প্রচলিত প্রতিটি খতমের পদ্ধতিই বিদআত। প্রচলিত খতমের পদ্ধতি আলাদা আলাদাভাবে বর্ণনা করলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। ইনসায়াল্লাহ।

২। খতমে কুরআনঃ

কুরআন প্রতিটি মুসলিমের জীবন বিধান। এই কুরআন তাকে নিয়মি তিলওয়াত করতে হবে এবং এর মর্ম বুঝে তদনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে। কুরআন শিক্ষা ও তেলাওয়াতের ফযিলত কুরআন ও সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত। যেমনঃ আল্লাহ তাআলা বলেন,

 إِنَّ ٱلَّذِينَ يَتۡلُونَ كِتَـٰبَ ٱللَّهِ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنفَقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَـٰهُمۡ سِرًّ۬ا وَعَلَانِيَةً۬ يَرۡجُونَ تِجَـٰرَةً۬ لَّن تَبُورَ * لِيُوَفِّيَهُمۡ أُجُورَهُمۡ وَيَزِيدَهُم مِّن فَضۡلِهِۚۦۤ إِنَّهُ ۥ غَفُورٌ۬ شَڪُورٌ۬ *

অর্থঃ যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরো অধিক দান করবেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান। সুরা ফাতির ৩৫:২৯-৩০)।

কুরআন তিলাওয়াত ঈমান বৃদ্ধি করেঃ  কুরআন তিলাওয়াত করা বান্দার জন্য এমন উপকারী। এবং কুরআন তিলাওয়াত করলে ঈমান বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ ٱللَّهُ وَجِلَتۡ قُلُوبُهُمۡ وَإِذَا تُلِيَتۡ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتُهُۥ زَادَتۡهُمۡ إِيمَٰنٗا وَعَلَىٰ رَبِّهِمۡ يَتَوَكَّلُونَ ٢ 

অর্থ: ‘মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের উপরই ভরসা করে’। (সুরা  আনফাল ০৮:২)।

সহিহ হাদিসের কুরআন তিলাওয়াত অনেক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। তাদের মধ্য অন্যতম কয়েকটি হাদিস হলঃ

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) কর্তক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুজনের ক্ষেত্রে ঈর্ষা করা জায়েয। ক. যাকে আল্লাহ কুরআন (মুখস্ত করার শক্তি) দান করেছেন, সুতরাং সে তার (আলোকে) দিবা-রাত্রি পড়ে ও আমল করে। খ. যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ দান করেছেন এবং সে (আল্লাহর পথে ) দিন-রাত ব্যয় করে’’। (সহিহ বুখারী ৫০২৫)

আবূ উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, ‘তোমরা কুরআন মাজীদ পাঠ করো। কেননা, কিয়ামতের দিন কুরআন, তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে। (সহিহ মুসলিম ৮০৪)।

উকবা বিন আমের রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে হতে যে ব্যক্তি সকালে মসজিদে দু’টি আয়াত পাঠ করে বা শিখে, তাকে দু’টি উট সদকা করার সওয়াব দেয়া হবে। এভাবে যত বেশি আয়াত তিলাওয়াত করবে, ততবেশি উট সদকা করার সওয়াব প্রদান করা হবে। (সহিহ মুসলিম)।

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) কর্তক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেন, পবিত্র কুরআন পাঠক, হাফেয ও তার উপর আমলকারীকে (কিয়ামতের দিন) বলা হবে, ‘তুমি কুরআন কারীম পড়তে থাকো ও চড়তে থাকো। আর ঠিক সেইভাবে স্পষ্ট ও ধীরে ধীরে পড়তে থাকো, যেভাবে দুনিয়াতে পড়তে। কেননা, (জান্নাতের ভিতর) তোমার স্থান ঠিক সেখানে হবে, যেখানে তোমার শেষ আয়াতটি খতম হবে।” ( আবূ দাউদ ১৮৬৮, তিরমীযি ২৯১৪ হাসান)

এই ফজিলতের কারনে প্রতিটি মুসলিম কুরআত তিলওয়াত করতে চায়। তারা নিজে না পড়েও অন্যের দ্বারা কুরআন পড়িয়ে হক আদায় করতে চায়। কিন্তু তারা এক বারের জন্যও ভাবেনা তাদের আমলটি কতটুকু সুন্নাহ সম্মত। কুরআন না বুঝে তিলওয়াত করলেও ফজিলত আছে। যেমনঃ আব্দল্লাহ ইবনে মাসাউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) এর একটি বর্ণ পাঠ করবে, তার একটি নেকী হবে। আর একটি নেকি দশটি নেকীর সমান হয়। আমি বলছি না যে, ‘আলিফ-লাম-মীম’ একটি বর্ন; বরং আলিফ একটি বর্ন, লাম একটি বর্ন, মীম একটি বর্ন। (অর্থাৎ, তিনটি বর্ন দ্বারা গঠিত ‘আলিফ-লাম-মীম’, যার নেকীর সংখ্যা হবে তিরিশ)। (তিরমিযী-২৯১০, হাদিসের মান হাসান)

মনে রাখতে হবে কুনআন এসেছে আমাদের সঠিক পথ দেখাতে কিন্তু কুরআন না বুঝে তিলওয়াত করলে কুরআনের আদেশ নিষেধ বুঝতে পারব না। কুরআন নির্দেশিত সহজ সরল পথ খুজে পাবনা। অথচ মহান আল্লাহ বলেনঃ

 إِنَّ هَـذَا الْقُرْآنَ يِهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا كَبِيرًا

অর্থঃ এই কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল এবং সৎকর্ম পরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্যে মহা পুরস্কার রয়েছে। (সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:৯)।

কুরআন তিলওয়াতের এত ফজিলত থাকা সত্বেও কুরআন খতম কেন বিদআত হবে?

১। আমাদের সকল আমলের প্রথম মাপকাঠি হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি কুরআন খতম করছেন। রমজানে দুই খতম দিয়েছেন বলে সহিহ হাদিসে প্রমানিত। কিন্তু মাইয়াতে জন্য তিনি কুরআন খতম করছেন বলে সহিহ, যঈফ বা জাল হাদিসেও তার কোন উল্লেখ নাই।

২। আমাদের দ্বিতীয় অনুকরনীয় মাপকাঠি হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এস সহচর সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)। তারা কুরআন নিজে শিখতেন, নিজে পড়তেন। যিনি জানেন না তিনি শিখতেন। এই শিক্ষাই তাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছেন। অনেক সময় কেউ কুরআন অপরের কাছে শুনতে চাইতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও কোনো কোনো সাহাবী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে শুনার আগ্রহ প্রকাশ করতেন, শুনতেন। তবে অন্যকে এনে বাড়ীতে খতম করানোর কোনো রেওয়াজ তাদের মাঝে ছিল না। কেউ মারা গেলে তাদের যা করণীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছেন তারা শুধু তাই করতেন। কেউ অসুস্থ হলে, বিপদে পড়লে কী করণীয় তাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে দিয়েছেন। কেউ মারা গেলে বা অন্য কোনো সমস্যায় পড়লে কুরআন খতম করা বা খতম করানোর কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে একটিবার কাউকে বলেন নি নিজেও করেন নি। তাই আমলটি বিদআত হওয়ার কোন বাধা থাকে না।

৩। নফল যে সকল ইবাদাত একাকী আদায় করতে হয়, সে সকল ইবাদাত একাকীই আদায় করতে হবে। সম্মিতভাবে পড়া যাবে না। সাধারণত কুরআন খতমের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। খতম করার পর দুয়া করার জন্য লোকদের ডাকা হয়। তাদের জন্য তোবারকের ব্যবস্থা করা হয়। এই কাজে ডাকাডাকি করে লোক জড় করা হয়। যাকে শরীয়তের পরিভাষায় ‘‘তাদাঈ’’ (ডাকাডাকি) বলা হয়, যা নফল ইবাদতে নিষিদ্ধ।

যেমনঃ আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সামনে কিছু মানুষ সালাতুদ্দ্বোহা জামাতের আকারে পড়ছিল, যখন তার কাছে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো তিনি তাদের আমলকে বিদ‘আত আখ্যা দিলেন। অথচ সালাতুদ্দ্বোহা একাকি পড়া প্রমাণিত।

আবার, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এক গোত্রের ব্যাপারে শুনলেন, তারা উচ্চস্বরে তাহলিল এবং দুরূদ পড়ছে, তখন তিনি তাদেরকে বিদ‘আতি বলে মসজিদ থেকে বের করে দিলেন। অথচ একাকি তাসবীহ, তাহলীল এবং দুরূদ পড়া পূণ্য ও ছওয়াবের কাজ।

এমনিভাবে, যদি কেউ অধিক ফজিলতের আশায় তাহাজ্জুতের সর্বচ্চো সালাতে সময় ডাকাডাকি করে বেশী লোকের সমাগম ঘটিয়ে সালত আদায় করে, তবে তার আমলটি বিদআত হবে। অথচ তাহাজ্জুতের সালাত অন্যতম নফল ইবাদাত।

৪। যদি কুরআন খতম জায়েয হত, তা হলে এর সর্বচ্চো হুকুম প্রতি হবে নফল।  কিন্তু এই নফল আমলে কাউকে আহবান করলে না আসলে তাকে তাকে বিভিন্নভাবে তিরস্কার  করা হয়। তার প্রতি  , বিদ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ বদ্ধমূল হয়। অথচ নফল আমলের বান্দার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে তার প্রতি জোর করা বা তিরস্কার করা অন্যায়।

৫। নফল কোন আমলকে ফরজের মত জরুরি মনে করাও বিদআত। কিন্ত আমাদের সমাজে কেউ মারা গেলে কুরআন কুরআন খতমের উপর এমন জোর দেয়া হয় যে মনে হয় ইহা একটি ফরজ ইবাদাত। জরুরী মনে করার কারনে দেখা যায়, মাইয়াতকে দাফন ও জানাযার সালাতের আগেই তার লাশের চার পাশে বসে কুরআন খতম করার জন্য লেগে যায়।

৬। কুরআন খতমের জন্য ২০/৩০ জন মিলে এক একজন, এক একজায়গা থেকে পড়ে সকলের পড়ার অংশ একত্র করে খতম হয়েছে বল বাদি করে। এভাবে অনেকে মিলে খতম করার প্রচলন সাহাবি, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের যুগে ছিল না। কোন মহামতি মাযহাবের চার ইমাম থেকেও প্রমানিত নয়। তাই এই পদ্ধতিতে কুরআন পড়ে খতম করা বিদআত।

৭। নফল আমলের জন্য পরিমান নির্দিষ্ট করা বিদআত। জিকির আযকার, তাসবী তহলীল, নফল সালাত, সাদাকা এর কোন নির্দিষ্ট পরিমান নাই। বান্দা তার সাধ্য অনুসারে করবে। কিন্তু আমারা যদি একটি পরিমান নির্ধারণ করে ফরজ করি তবে তা শরীয়ত সম্মত হবে না। এর আলোকে বলা যায়, কুরআন তিলওয়াত একটি নফল ইবাদাত সাধ্যমত যা সহজ হবে তাই তিলওয়াত করা ইসলামি শরীয়তে বাদি। এক সাথে সম্পুর্ন কুরআন শব্দ যোগে পড়া নিজের উপর বাধ্য করে নেয় কত টুকু শরীয়ত সম্মত। অথচ কুরআন খতমকারী একদিন, তিন দিনে, সাতদিন বা মাসে তার উপর কুরআন খতম করা বাধ্য করে নেয়।

একটি সহিহ হাদিসে এসেছে, ঐ সময় পর্যন্ত কুরআন পড় যতক্ষন মনে বিরক্তিবোধ না হয় এবং যখন ক্লান্ত হয়ে পড় তখন ছেড়ে দাও।(সহিহ বুখারী ৪৭৭৩)

৮। অনেকে একদিনে কুরআন খতম কারর জন্য হাফিজ ভাড়া করে আনে। এভাবে টাকার বিনিময়ে শুধু কুরআন তিলওয়াত করা বিদআত নয়, হারাম।

৯। একদিনে  কুরআন খতম কারর সময় কুরআন তিলওয়াতে হক আদায় হয় না। যেমনঃ তাড়াতাড়ি তিলওয়াতের কারনে আবরী হুরূফের সিফাত বিশুদ্ধভাবে আদায় হয় না। অনেক ক্ষেত্র গুন্নাহ, ইজহার, ইখফা ও মদসমুহের প্রতিও কোন খেয়াল করা হয় না।

১০। অনেকে অঞ্চলে চার পাঁচ জন হাফিজ মিলে একদিনে কুরআন খতম করা হয়। তারা এই কাজে মাইক ব্যবহার করে যা ইসলামি শরীতের দৃষ্টতে হারাম কাজ। কারন মাইকের কারনে অনেক অসুস্থ ব্যক্তির অসুবিধা হয়, কেউ টয়লেট বা বাথরুমে বসে কুরআন শুনতে বাধ্য হয়। সাধারন মানুষের ঘুমের বেঘাত ঘটে। সমাজের শত করা নিরানব্বই পার্সেন্ট মানুষই তিলওয়াতের সিজদা আদায় করতে পারেন না। কারণ তারা জানেনা কোন আয়াতটি পাঠ করার পড় সিজদা দিতে হয়।

৩। খতমে বুখারিঃ

খতমে বুখারি বলতে এক কথায় বুঝা যায়, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সহিহ হাদিস গ্রন্থ বুখারির আগাগোড়া পড়ে শেষ করা। তাই শুরুতে সহিহ বুখারির লেখক ও সহিহ বুখারি সম্পর্ক একটি আলোক পাত করছি। তার পর আলোচনা করব কেন বুখারী খতম বিদআতঃ

সহিহ বুখারির লেখকঃ আরব রীতি অনুযায়ী ইমাম বুখারি রাহিমাহুল্লাহর বংশধারা সহ তার পুরো নাম হলো, মুহাম্মদ ইবন ইসমাইল ইবন ইবরাহীম ইবন মুগীরাহ ইবন বারদিযবাহ। তার মূল নাম মুহাম্মদ। তিনি ১৯৪ হিজরীর শাওয়াল মাসের ১৩ তারিখ রোজ শুক্রবার (৮১০ খ্রিস্টাব্দ) খোরাসানের বুখারা এলাকায় (বর্তমানে উজবেকিস্তানের অংশ) জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৯ বৎসর বয়সে কুরআন মুখস্থ শেষ করেই ১০ বৎসর বয়স থেকে হাদীস মুখস্থ, হাদীসের চর্চা, হাদীস সংরক্ষণ করতে বিভিন্ন মুহাদ্দিসের কাছে যাতায়াত শুরু করেন। তার মেধা ছিল বর্ণনাতীত। তার মেধা, হাদীস গ্রহণে সতর্কতার বিভিন্ন ঘটনা কিতাবাদিতে উল্লেখ রয়েছে। ২৫৬ হিজরীর ১লা শাওয়াল, মোতাবেক ৩১ আগষ্ট ৮৭০ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবার দিবাগত রাত্রে ৬২ বৎসর বয়সে এই মহান ব্যক্তিত্ব মারা যান।

সহিহ বুখারীঃ ইমাম বুখারির জীবনের শ্রেষ্ঠতম কর্ম ‘সহিহ বুখারী’ নামে প্রসিদ্ধ হাদিসের এই গ্রন্থটি। এই গ্রন্থটি সংকলনের জন্য ইমাম বুখারী (রঃ)-এর উদ্বুদ্ধ হওয়ার কারণসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে, তাঁর বিখ্যাত ওস্তাদ ইসহাক ইবন রাহওয়ায়হ (রঃ) পরোক্ষভাবে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ তোমারদের মধ্যে কেউ কি এমন নেই, যে ‘গায়ের সহিহ হাদিস’ থেকে ‘সহিহ হাদিস’ বাছাই করে একখানি গ্রন্থ রচনা করবে। ইমাম বুখারীর মনে এরূপ একটি গ্রন্থ সংকলনের ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠে এবং তিনি দীর্ঘ ষোল বছরের অক্লান্ত সাধনার পর তা সমাপ্ত করতে সক্ষম এবং তিনি তার কাজে নিঃসন্দেহে সফল হয়েছে।

ইমাম বুখারির মত আরও কয়েকজন মুহাদ্দিস শুধু সহহি হাদিস সংকলনের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে তৃতীয় শতকের ইমাম বুখারী (২৫৬ হি) ছাড়াও ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশাইরী (২৬১ হি) অন্যতম। তাঁদের পরে আব্দুল্লাহ ইবনু আলী ইবনুল জারূদ (৩০৭ হি), মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক ইবনু খুযাইমা (৩১১ হি), আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ, ইবনুশ শারকী (৩২৫ হি), কাসিম ইবনু ইউসূফ আল-বাইয়ানী (৩৪০ হি), সাঈদ ইবনু উসমান, ইবনুস সাকান (৩৫৩ হি), আবু হাতিম মুহাম্মাদ ইবনু হিববান আল-বুসতি (৩৫৪ হি), আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ হাকিম নাইসাপূরী (৪০৫ হি), যিয়াউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহিদ আল-মাকদিসী (৬৪৩ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস শুধু সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেন। কিন্তু পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসদের চুলচেরা নিরীক্ষার মাধ্যমে শুধুমাত্র বুখারী ও মুসলিমের গ্রন্থদ্বয়ের সকল হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে। বাকী কোনো গ্রন্থেরই সকল হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হয় নি। বরং কোনো কোনো গ্রন্থে যয়ীফ, বাতিল ও মিথ্যা হাদীস সংকলিত হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। দ্বাদশ হিজরী শতকের অন্যতম আলিম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (১১৭৬হি/ ১৭৬২খৃ) হাদীসের গ্রন্থগুলোকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে তিনটি গ্রন্থ: সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক। এ গ্রন্থগুলোর সকল সনদসহ বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত। (হাদিসের নামে জালিয়াতি ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীল)

ইমাম বুখারি তার জীবনের বিশাল একটা সময় অতিবাহিত করে হাদিসের উপর পূর্ণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। অতপর, ২১৭ হিজরী সনে তার বয়স যখন ২৩, তখন তিনি এই গ্রন্থটির রচনা শুরু করেন। গ্রন্থটিতে শুধুমাত্র সহিহ হাদিস সংকলন করেন এবং দীর্ঘ সাধনার পর ২৩৩ হিজরী সনে এই মহান কাজটি সমাপ্ত করতে সক্ষম হন। রচনাকালে তিনি সর্বদা সিয়াম পালন করতেন এবং প্রতিটি হাদীস লিখতে গোসল করে দু রাক‘আত সালাত আদায় করতেন বলে জানা যায়। বিশুদ্ধতার উপর নিশ্চিত হওয়ার আগে কোনো হাদিস লিখতেন না। বর্ণনায় আরো জানা যায় যে, তিনি বিশুদ্ধ থেকে বিশুদ্ধতম হাদীসের সংকলনের ইচ্ছায় তার মুখস্থ অনুমানিক ছয় লক্ষ হাদীস থেকে বাছাই করে একেবারে সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীসটিকেই এই গ্রন্থে স্থান দেন। এত সংখ্যক হাদীস থেকে বিভিন্ন হাদীস বারবার বর্ণনা সহকারে মাত্র ৭২৭৫ বা তার সামান্য কমবেশ হাদিস তার কিতাবে স্থান পেয়েছে।

ইমাম বুখারী তাঁর এই রচনায় সহীহ গ্রহণের প্রচেষ্টায় পূর্ণ সফল হয়েছেন বলে সমস্ত উলামায়ে মুহাদ্দিসীন যাচাই ও পরীক্ষা নিরীক্ষার পর স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি তার চেষ্টায় সফল হওয়ায় সারা বিশ্বের আনাচে কানাচে তাঁর কিতাবের সুনাম, সুখ্যাতি ও মূল্যায়ন ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর কিতাব দল মত নির্বিশেষে সর্বজনের কাছে, কুরআনের পর সর্বোচ্চ বিশুদ্ধ কিতাব হিসেবে ভূষিত হয়। এই বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ থেকে আমরা যেভাবে উপকৃত হতে পারিঃ

* এই সহিহ গ্রন্থ থেকে ইলম অর্জণ করতে পারি।

* ইলম অর্জণ করে তার আলোকে আমল করতে পারি।

* এই গ্রন্থে হাদিস নিজে বুঝতে চেষ্টা করা এবং অপরকে বুঝানোর চেষ্টা করা।

* সম্ভর হলে হাদিসগুলি মুখস্ত করা।

* এই সহিহ হাদিস গ্রন্থটি প্রচার প্রসারে নিজে ভুমিকা রাখি।

* মাদ্রাসা বা স্কুলের সিলেভাসে এই গ্রস্থ অন্তরভুক্তি করি।

* আলেমদের উচিত এই গ্রস্থের আলোকে ফিকাহ রচানা করা।

আমরা কি করছি?

সহিহ হাদিস স্বীকার করার পরও এই বলে হাদিসের উপর আমল করাকে আস্বীকার করছি। আমাদের সমাজে অনেক লোক আছে যারা এই সহিহ গ্রন্থের বিপরীত আমল করে থাকেন এবং তাদের দলীলও দুর্বল কিন্তু যখন তাদের বলা হয় ঐ দুর্বল হাদিস ছেড়ে সহিহ হাদিসের আমল কর তবে তারা বলে থাকে আমাদের মাযহাবে নেই, বড় হুজুর এভাবে আমল করতে বলেছেন, যুগ যুগ ধরে এই আমল আমাদের মাঝে চলে আসছে, সমাজের অধিকাংশ মানুষতো এমনিভাবেই আমল করছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

৪। সহিহ বুখারি খতম বিদআত কেন?

১। সহিহ বুখারি খতম করা বিদআত নয় কিন্তু যখন মনে করবে বুখারি খতম করা একটি ইবাদাত তখন বিদআত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস পড়লে বা শুনলে নেকীর কাজ হবে এতে কার দ্বিমত নাই। এ হিসাবে বুখারির প্রতিটি হাদিস পাঠের বিনিময় নেকী হবে কিন্তু সমগ্র বুখারী পড়া মাধ্যমে খতম করলে আলাদা কোন নেকী পাওয়া যাবে মনে করলেই বিদআত হবে। কারন ইবাদতের কোন পদ্ধতির কথা বললে দলীল লাগবে।

২। সহিহ বুখারি সংকলন হয়েছে ২৩৩ হিজরী সনে। অর্থাৎ সাহবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের স্বর্ণালী যুগের পরে। এই তিন যুগের পর আর কোন আমলের পদ্ধতি আবিস্কার করার অধিকার কার নেই। তাই এই তিন যুগের পর লিখতি কিতাবের খতম করে নেকীর আশা করা যায় না। তবে আলাদা আলাদা হাদিস সধ্যমত পড়লে বা পড়ে আমল করলে বিদআত হবে না।

৩। সহিহ বুখারি খতমের নামে একটি আলাদা অনুষ্ঠান করা হয়। ইসলামে ইলম অর্জনের জন্য সমাবেশ করা যায়। কোন ঘোষনা ছাড়া এই মহান গ্রন্থ পড়ে শেষ করার পর বা খতম করার পর মহান আল্লাহ শুকরীয়া আদায় করা যায় কিন্তু খতমের নামে দিন ধার্য করে সমাবেশ করে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা বিদআত হবে।

৪। আমলের জন্য দলীল প্রয়োজন কিন্তু বুখারী খতমের কোন দলীল নেই। যেহেতু বুখারি সাহবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ী যুগের পর লেখা তাই হয়ত কোন বিদআতী বলেবে কুরআন সুন্নাহ এর দলীল থাকার কথা নয় ইহা বিদআতে হাসানা। কিন্তু অনেক গবেষণা করে দেখা গেছে সাহবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ী যুগের পরও কোন সলফে সালেহীন বুখারী খতমের আমল করে নাই। ইহার আবিস্কারক হল উপমহাদেশের বিদআত আতুর ঘর ব্রেলভী আকিদার মাদ্রাসা ও বর্তমানে কিছু কিছু দেওবন্দী ঘরানার কওমী মাদ্রাসা।

৫। খতমে ইউনুসঃ  

ইউনুস আলাইহিস সালাম আল্লাহর প্রেরিত একজন নবী। আমরা জানি তিনি কোন এক কারনে মাছের পেটি ছিলেন। তিনি মাছের পেটে থাকা অবস্থায় মহান আল্লাহর নিকট বিদপ দুর করার ফরিয়াদ করেছিলেন, মহান আল্লাহ তার ফরিয়াদ কবুল করেছিন। এই সম্পর্কে মহান আল্লাহই আমাদের জানিয়ে দেন। সুরা আম্বিয়তে এই সম্পর্কে মহান  আল্লাহ তার রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি সাল্লামকে লক্ষ্য করে কয়েকজন নবীর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে এই বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন,

*وَذَا النُّونِ إِذ ذَّهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ أَن لَّن نَّقْدِرَ عَلَيْهِ فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ*

অর্থঃ এবং মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, অতঃপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাঁকে ধৃত করতে পারব না। অতঃপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহবান করলেনঃ তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই; তুমি নির্দোষ আমি গুনাহগার। (সুরা আম্বিয়া ২১:৮৭)।

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

*فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنجِي الْمُؤْمِنِينَ*

অর্থঃ অতঃপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। আমি এমনি ভাবে বিশ্ববাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি। (সুরা আম্বিয়া ২১:৮৮)। বিপদে পড়ে

আয়াত দুটির দিকে একটু লক্ষ করলেই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারব যে বিপদের সময় আমাদের করণীয় কি? এই আয়াতের শিক্ষা হল, যে কোনো বিপদে মুমিন নিজেকে মহান আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনই করবে। যেমনটি আল্লাহ নবী ইউনুস আলাইহিস সালাম বিপদে পড়ে মাছের পেটে থাকাবস্থায় মহান আল্লাহ নিকটি সকাতরে প্রার্থনা করে বলে ছিলেন। (কুরআনের ভাষায়) 

*لا إِلَهَ إِلا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ*

অর্থঃ তুমি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তুমি দোষমুক্ত, নিশ্চয় আমি গোনাহগার। অতএব যখনই কোনো মুসলিম ব্যক্তি কোনো বিষয়ে এর মাধ্যমে দো‘আ করেছে আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। (সুনানে তিরমিযী – ৩৫০৫,  মুসনাদে-১৪৬২)।

তাই বিদআতি মুসলিম আবিস্কার করেছে যদি কোন ব্যক্তি বিপদ-আপদ, মামলা-মোকাদ্দমা ও সঙ্কটের সময় এই দো‘আ সোয়া লক্ষ বার পড়ে। এবং প্রত্যেক একশতবার পড়া হইলে শরীর বা মুখে পানি দিবে। পাক অবস্থায় পাক বিছানায় বসিয়া কেবলামুখী হইয়া পড়িবে। ৩, ৭ কিংবা ৪০ দিনে শেষ করিবে। মাছের পেটের ভিতর অন্ধকারের এই দোয়া জন্মলাভ করিয়াছে বলিয়া অন্ধকারে বসিয়া পড়িলে আরও সত্বর ফল লাভ হয়। খতম শেষ হইলে একবার এই আয়াত পড়িবেঃ

*فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنْجِي الْمُؤْمِنِينَ *

অর্থঃ তৎপর আমি তাঁহার (হযরত ইউনুস নবীর) দোয়া কবুল করিয়াছিলাম এবং তাঁহাকে কঠিন বিপদ হইতে উদ্ধার করিয়াছিলাম এবং এইরূপে আমি বিশ্বাসীগণকে উদ্ধার করিয়া থাকি।’’ 

এই তাদবীরকে খতমে ইউনুস বলা হয়। ইহা প্রত্যেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী ও অব্যর্থ ফলপদ বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। (নেয়ামুল কুরআন, মৌলবী শামছুল হুদা, রহমানিয়া লাইব্রেরী, একাদশ সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ১২০।

মন্তব্যঃ কুরআন হাদীসের আলোক আমরা দেখতে পাই বিপদ আপদের সময় এই দোয়াটি পড়তে পারে। এবং আশা করা যায়, এই দোআ পড়লে আল্লাহ তাকে বিপদ মুক্ত করবেন। কিন্তু দোয়াটি সোয়া লক্ষ বার পড়লে বিপদ দুর হবে এ কথা সে কিভাবে জানল। যারা এই সোয়া লক্ষ বার পড়ার আমল কে তাদের  প্রশ্ন করলে বলে, এই আমল পরীক্ষিত। এই যে পরীক্ষা করে নিজে নিজে সংখ্যা দিয়া আমল আবিস্কার করল, তার মানে দ্বীনে বিদআত সৃষ্টি করল। সংখ্যা না দিয়ে বিপদ মুক্তির জন্য দোয়াটি পড়লে বিদপ দুর হবে যা হাদিস দ্বারা প্রমানিত।

৬। খতমে নারীঃ

বিদআতি আবিস্কারকগন নারী নামের একটি দুরুদ আবিস্কার করে। এই নারী দুরুদটি ৪৪৪৪ বার পড়ার মাধ্যমে একটি খতম দিয়ে থাকে। নারী নামের দুরূদটি আসলে দুরূদ নয়, এটা একটি শির্কি কবিতা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য দুরুদ পড়া নেকীর কাজ। তাই হাদিসে বর্ণিত দুরুদগুলি পড়াই উত্তম কারন অনেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য দুরুদ লিখতে গিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। অনেক সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসা করতে করতে মহান আল্লাহ অংশীদার করছে যা স্পষ্ট শির্ক কাজ। এমনই একটি কবিতার নাম হচ্ছে নারী। এই নারী নামের দুরুদ ৪৪৪৪ বার পড়ে যে খতম আবিস্কার করা হয়েছে তাকে ‘খতমে নারী’ বা ‘দুরুদে নারীয়াহ’ বলা হয়।

মানুষের তৈরি এই কাল্পনিক নারী নামের দুরুদ খতমের জন্য আবার ফজিলতের কথাও বলা হয়। বিদআতিদের মনগড়া ফজিলত হলো, এই দুরুদের খতম পড়লে নাকি আগুন যেমন কোনো বস্তুকে ভস্মীভূত করে দেয় ঠিক তদ্রূপ এই খতমও বিপদ আপদকে ভস্মীভূত করে দূরে সরিয়ে দেয়। তাই এই খতমের নাম আরবী শব্দ ‘‘نار’’ যার অর্থ আগুন, এই অর্থের দিকে সম্পৃক্ত করে। তাই আসুন দেখি খতমে নারী কী? এবং তা পড়া বা পড়ানো কতটুকু সমীচীন? দুরুদের নামে বিদআতিদের আবিস্কৃত কবিতাটি হলঃ

“اللهم صَلِّ صَلاةً كامِلَةً وسَلِّمْ سَلامًا تامًّا على سَيِّدنا محمدٍ الذي تَنْحَلُّ به العُقَدُ، وتَنْفَرِجُ به الكُرَبُ وتُقضى به الحوائجُ وتُنالُ به الرغائبُ وحُسْنُ الخواتِمِ ويُسْتسقى الغمامُ بوجهه الكريم، وعلى آله وصحبه في كل لمحة ونفس بعددِ كل معلوم لك”.

অর্থঃ ‘হে আল্লাহ পরিপূর্ণ রহমত ও পূর্ণ শান্তি বর্ষিত কর আমাদের সরদার মুহাম্মদের উপর। যার মাধ্যমে সমস্যাসমূহ সমাধান হয়, দুঃখ দুর্দশা তিরোহিত হয়, প্রয়োজনাদি মিটিয়ে দেওয়া হয়, পূণ্যাবলী ও সুন্দর শেষ পরিণাম অর্জিত হয়, তার পবিত্র চেহারা/সত্তার মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করা হয়। আর রহমত বর্ষণ কর তার পরিবার ও তার সাহাবায়ে কেরামের উপর তোমার জানা সংখ্যানূযায়ী, প্রতিটি মুহুর্তে ও নিঃশ্বাসে।

মন্তব্যঃ সত্যসন্ধানী মুসলীম ব্যক্তি অর্থের দিকে একটু মনোনিবেশ করলেই দো‘আটির তাৎপর্য এবং এমন দো‘আ পড়া কতটুকু সিদ্ধ তা বুঝে নিতে পারবেন। খতমটিতে যেহেতু অনেক আপত্তিকর শব্দ বা বাক্য রয়েছে তাই এর আপত্তিগুলো কোনো পর্যায়ের নিজ বিবেক দিয়ে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝা যাবে। এই বাক্যগুলি মাধ্যমে নবী সাঃ কে অসিলা (মাধ্যম) ধরে বিভিন্ন সাহায্য চাওয়া হয়েছে। এই ধরনের চাওয়াকে মহান আল্লাহ শির্ক কাজ উল্লেক করছেন। আরবের মুশরিকগন ঠিক এইভাবে তাদের দেবতার মাধ্যামে মহান আল্লাহ সাহায্য চাইত। কুরআনের অসংখ্য আয়াতে তাদের এসব বিশ্বাস বর্ণনা করা হয়েছে, যেগুলো থেকে তাদের এমন বিশ্বাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। মক্কার সমস্ত কাফের এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করত। মূল পরিচালনায় তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করত বলে কুরআনের একাধিক আয়াতে এর প্রমাণ মিলে। মূর্তির পূজা করলেও মূর্তিকে তারা মূল পরিচালনাকারী বলে বিশ্বাস করত না। তাদের নিজের মুখের কথা ছিল,

*مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى *

অর্থঃ ‘আমরা তাদের ইবাদত কেবল এ জন্য করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। (সূরা আয-যুমার ৩৯:৩)।

সবকিছুর ক্ষমতা, রক্ষা, সৃষ্টি, রিযিক, পরিচালনা ইত্যাদির মূল কর্তৃত্ব আল্লাহর হাতে বলে তাদের বিশ্বাস ছিল। কিন্তু  আল্লাহকে পাওয়ার জন্য মাধ্যম ধরত। এটাই ছিল আরবের মুসরিকদের শির্ক। আমার জানি কোন আমলের জন্য সময় বা সংখ্যা নির্ধারনের জন্য মহান আল্লাহ প্রতিনীধি ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাই তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যদি নির্দষ্ট সংখ্যা বলে না থাকেন, তা হলে কোন মানুষই নির্দিষ্ট সংখ্যার সাথে ইবাদত সম্পৃক্ত করতে পারবে না। অথচ দুরুদে নারী খতম ৪৪৪৪ বার পড়ার সাথে সংশ্লীষ্ট।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment