সবর অর্জনের তেইশটি পদ্ধতিঃ তৃতীয় পর্ব

সবর অর্জনের তেইশটি পদ্ধতিঃ তৃতীয় পর্ব

৮। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুসরনের মাধ্যমে সবর অর্জন করাঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হল সবরের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। তার জীবনের প্রতিটি বাকে সবরের দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। জম্মের পূর্বে পিতার বিদায়, জম্মের ছয়মাসের মাথায় মাতার মৃত্যু। যে দাদার কাছে লালিত পালিত হচ্ছিল ছয় বছরের মাথায় তার মৃত্যু। ইসলাম প্রচারে প্রাথমিক পর্যায় কাফিরদের অত্যচার। তায়েব-এ দাওয়াত দান কালে রক্তাক্ত হওয়া। নও মুসলিদের প্রতি কাফিদের অমানুষিক অত্যাচার। কাফিদের অত্যাচারে মুসলীমদের শহীদ হওয়া বা দেশ ত্যাগে বাধ্য হ্ওয়া। তিন তিনটি বছর না খেয়ে পাহাড়ারের পাদদেশে অবরোধ হয়ে থারা। নবুয়াতের বিভিন্ন কাজে সমর্থন দান কারি চাচা আবু তালিব এ প্রান প্রিয় স্ত্রী খাদিজা রাদিয়াল্লাহ তায়াল আনহুমার মৃত্যু। কয়েকজন ঔরসজাত মেয়ে এবং ছেলে ইব্রাহিম ইন্তেকাল করেন। চক্ষুযুগল অশ্রসিক্ত, হৃদয় ভারাক্রান্ত, স্মায়ুতন্ত্র ও অস্থিমজ্জা নিশ্চল নির্বাক। তারপরও মহান আল্লাহ শুকরিয়া আদায়ে মস্তক অবনত। মক্কাবাসি কর্তৃক হত্যার ষড়যন্ত্র হয়ে মাতৃভূমি ছেড়ে মনীনায় হিজরত করতে বাধ্য করা। এখান তার বিপদের কয়েকটি শিরনাম দিলাম। এ সকল বিপদে তার সবরের তুলনা তিনি নিজে। তার চরিত্রের প্রশংসায় মহান আল্লাহ বলেন,

وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ

আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। [ সুরা কালাম ৬৮:৪ ]

সা‘দ ইবনু হিশাম (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-এর কাছে গেলাম। তাঁর কাছে বললাম, হে উম্মুল মু’মিনীন! আমাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘খুলুক’ (স্বভাব-চরিত্র) ব্যাপারে কিছু বলুন। ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বললেন, তুমি কি কুরআন পড়ো না? আমি বললাম, হ্যাঁ পড়ি। এবার তিনি বললেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নৈতিকতা ছিল আল-কুরআন। (বড় হাদিসের কিছু আংশ, মিসকাত -১২৫৭, মুসলিম-৭৪৬)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্র ছিল আল কুরআন’’ এর অর্থ হলো আল কুরআনের আদেশ, নিষেধ, ভদ্রতা, সবর ইত্যাদি ধারণ করা। আরো স্পষ্ট করে আমার বিষয় বস্তু সাথে মিল রেখে বলা যেতে পারে যে, কুরআনুল কারীমে প্রায় ১০০ এর মত আয়াতে সবরের কথা বলা হয়েছে তার সম্পুর্ণটাই তার চরিত্র বিদ্যমান ছিল। তাই পরকালে বিশ্বাসী আল্লাহ ভীরু গোটা মুসলিম জাতি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সবর করার পদ্দতি, কারন, ধরণ, বিষয় বস্তু জেনে তাদরে নিজেদের চরিত্রে ধারন করবে তাহলে এই উম্মতের সকলে সবর অর্জন করা সহজ হবে।

তার সবর সম্পর্ক অনেক শিক্ষনীয় ঘটনা হাদিসের সহিহ সনদে বর্ণিত আছে। এ সকল হাদিসগুল বার বার পড়ে নিজেদের মাঝে সবর এর মত মহৎ গুন হাচিলের চেষ্টা করতে হবে। এমনই কিছু হাদিস উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরলাম।

আবদান (রহঃ) ও খালিদ ইবনু মাখলাদ (রহঃ)……… আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একবার এক বেদুঈন এসে মসজিদের এক কোণে পেশাব করে দিল। তা দেখে লোকজন তাকে ধমকাতে লাগল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিষেধ করলেন। তার পেশাব শেষ হলে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘র আদেশে এর উপর এক বালতি পানি ঢেলে দেওয়া হল। (সহিহ বুখারি হাদিস-২২১ ইঃ ফাঃ)।

একবারের ঘটনা রাসূলুল্লাহ (সা.) বর্ণনা করেন, আমি আর বেলাল সফরে বের হয়েছি। একাধারে তিন দিন চলে গেল। আমাদের সাথে প্রাণ বাঁচানোর মতো খাবার নেই, ওই যৎসামান্য খাবার ছাড়া; যা বেলাল বোগলের নিচে লুকিয়ে রেখেছিল [তিরমিজি শরিফ]। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.)এর কাছে প্রস্তাব করা হয়েছিল, তুমি যদি চাও উহুদ পাহাড়কে স্বর্ণে পরিণত করে দেয়া হবে। রাসূল (সা.) বললেন, হে আল্লাহ! আমি এটা চাই না। আমি চাই একদিন আহার করব আর তোমার শোকর আদায় করব। আরেক দিন অভুক্ত থাকব আর সবর করব।’ রাসূলের দোয়া ছিল এ রকম, হে আল্লাহ! আমাকে গরিব অবস্থায় রাখো, গরিব অবস্থায়ই আমার মৃত্যু দান করো, গরিবদের সঙ্গেই আমার হাশর করো [ইবনে মাজাহ, তিরমিজি শরিফ]

ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, হুনাইন যুদ্ধের গনিমতের মাল বণ্টনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু লোককে (তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য) প্রাধান্য দিলেন (অর্থাৎ অন্য লোকের তুলনায় তাদেরকে বেশী মাল দিলেন)। সুতরাং তিনি আক্বরা‘ ইবনু হাবেসকে একশত উঁট দিলেন এবং ‘উয়াইনা ইবনু হিসনকেও তারই মত দিলেন। অনুরূপ আরবের আরো কিছু সম্ভ্রান্ত মানুষকেও সেদিন (মাল) বণ্টনে প্রাধান্য দিলেন। (এ দেখে) একটি লোক বলল, ‘আল্লাহর কসম! এই বণ্টনে ইনসাফ করা হয়নি এবং এতে আল্লাহর সন্তোষ লাভের ইচ্ছা রাখা হয়নি!’ আমি (ইবনু মাসউদ) বললাম, ‘আল্লাহর কসম! নিশ্চয় আমি এই সংবাদ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দেব।’ অতএব আমি তাঁর কাছে এসে সেই সংবাদ দিলাম যা সে বলল। ফলে তাঁর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে এমনকি লালবর্ণ হয়ে গেল। অতঃপর তিনি বললেন, ‘‘যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ইনসাফ না করেন, তাহলে আর কে ইনসাফ করবে?’’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহ মূসাকে রহম করুন, তাঁকে এর চেয়ে বেশী কষ্ট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি ধৈর্য ধারণ করেছিলেন।’’ অবশেষে আমি (মনে মনে) বললাম যে, ‘আমি এর পরে কোন কথা তাঁর কাছে পৌঁছাব না।’ (সহীহুল বুখারী ৩১৫০, ৩৪০৫, ৪৩৩৫, ৪৩৩৬, ৬০৫৯, ৬১০০, ৬২৯১, ৬৩৩৬, মুসলিম ১০৬২, আহমাদ ৩৫৯৭, ৩৭৫০, ৩৮৯২, ৪১৩৭;রিয়াযুস স্বালেহীন ১৮/৪৩)।

‘আইয়্যাশ ইবনুল ওয়ালিদ (রহঃ) … ‘উরাওয়া ইবনু যুবায়র (রহঃ) বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) এর নিকট বললাম, মক্কার মুশ্রিক কর্তৃক নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে সর্বাপেক্ষা কঠের আচরণের বর্ণনা দিন। তিনি বললেন, একদিন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা’বা শরীফের (পশ্চিম পার্শ্বস্থ) হিজর নামক স্থানে সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করছিলেন। তখন ‘উকবা ইবনু আবূ মু’য়াইত এল এবং তার চাঁদর দিয়ে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কন্ঠনালী পেচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলল। তখন আবূ বকর (রাঃ) এগিয়ে এসে ‘উকবাকে কাঁধে ধরে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট থেকে সরিয়ে দিলেন এবং বললেন, তোমরা এমন ব্যাক্তিকে হত্যা করতে চাও যিনি বলেন, একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাই আমাদের প্রতিপালক। (সহিহ বুখারি ইঃফাঃ ৩৫৭৭)

মন্তব্যঃ  এ সকল হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারব নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি পরিমান সবর করছেন।

৯। মনে করতে হবে দুঃখের পর আছে সুখ তাহলে সবর অর্জন করা সহজ হবে।

যেহেতু পৃথিবীতে আল্লাহ আমাদের খুদা, ভয়, জান মালের ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করবেন তাই বিপদ আসবেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে পৃথিবীর কিছুই স্থায়ী নয়। এখানে বিপদও  স্থায়ী নয়। সবর করে আল্লাহর স্বন্ত্বষ্টি অর্জন করতে পারলে এই সাময়িক দুঃখের পরই সুখ আছে। কুনআনুল কারীমের বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ এ সকল কথা অনেক বার বলে আমাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। তিনি বলেন,

**إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا *

অর্থঃ নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। (সুরা আনশিরাহ, আয়াত ৬)

মহান আল্লাহ বলেন,

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ

অর্থঃ যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমাণদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেব যা তারা করত। (সুরা আন নাহল ১৬:৯৭)

মহান আল্লাহ প্রতিশ্রুতি সত্য তাই উত্তম কাজের (সবর) এর বিনিসয়ে উত্তম প্রাপ্য পুরষ্কার দিবেন। মানুষ যত বড় পাপীই হোক, আল্লাহকে ডাকলে আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দেন। আপনি যত পাপীই হোন, আর যত দুঃখ কষ্টের মধ্যেই থাকুন না কেন, আল্লাহকে ডাকুর আপনার কষ্টে পরে সুখ আসবেই। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, তিনি নিশ্চয়ই আপনার ডাকে সাড়া দেবেন।  আপনার দুঃখ কষ্ট দুর করবেন। যেমনঃ আল্লাহপাক বলেন,

**وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ *

অর্থঃ তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। যারা আমার এবাদতে অহংকার করে তারা সত্বরই জাহান্নামে দাখিল হবে লাঞ্ছিত হয়ে। (সুরা আল মুমিন, আয়াত ৬০)

মন্তব্যঃ ঈমাদারদের জন্য দুনিয়া একটি জেলখানা। জেল খানায় কারা ভোগের পর মু্ক্তি পেল যেমন স্বাধীনতার স্বাধ পাওয়া যায়। ঠিক তেমনি বিপদকে সামান্য মনে করে সবর করলে পরক্ষনেই শান্তির সুবাতাশ বইতে থাকবে। এমন আশা করলে বিপদে সবর করা সহজ হবে।

১০। বিপদের সময় মনে করতে হবে মুমিনের জন্য আল্লাহই যথেষ্টঃ

যারা মুমিন তারা একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করবে। বিপদের সময় যদি কেউ মনে করে যে আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট তবে তার সবর করা খুবই সহজ হবে। পার্থিব জীবনে দেখি একজন ক্ষমতাসীল লোকের উপর ভরসা করা অনেক অসাধ্য কাজে হাত দেন। সবচেয়ে ক্ষমাতাশীর স্বত্বার প্রতি ভরসা তাকে সবর অর্জনের সাহায্য করবে। আল্লাহই তার জন্যে যথেষ্ট। যে আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখে আল্লাহই তার জন্যে যথেষ্ট। মহান আল্লাহপাক বলেন,

**إِذْ هَمَّت طَّآئِفَتَانِ مِنكُمْ أَن تَفْشَلاَ وَاللّهُ وَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ *

অর্থঃ যখন তোমাদের দুটি দল সাহস হারাবার উপক্রম হলো, অথচ আল্লাহ তাদের সাহায্যকারী ছিলেন, আর আল্লাহর উপরই ভরসা করা মুমিনদের উচিত। (সুরা আল ইমরান ৩:১২২)

মহান আল্লাহপাক বলেন,

**وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ *

অর্থঃ এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন। (সুরা আত তালাক্ব ৬৫:৩)

মহান আল্লাহপাক বলেন,

**الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُواْ لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَاناً وَقَالُواْ حَسْبُنَا اللّهُ وَنِعْمَ *

অর্থঃ যাদেরকে লোকেরা বলেছে যে, তোমাদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য লোকেরা সমাবেশ করেছে বহু সাজ-সরঞ্জাম; তাদের ভয় কর। তখন তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হয়ে যায় এবং তারা বলে, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট; কতই না চমৎকার কামিয়াবীদানকারী। (সুরা আল ইমরান ৩:১৭৩)

মহান আল্লাহপাক বলেন,

**فَانقَلَبُواْ بِنِعْمَةٍ مِّنَ اللّهِ وَفَضْلٍ لَّمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُواْ رِضْوَانَ اللّهِ وَاللّهُ ذُو فَضْلٍ عَ *

অর্থঃ অতঃপর ফিরে এল অর্থঃ মুসলমানরা আল্লাহর অনুগ্রহ নিয়ে, তদের কিছুই অনিষ্ট হলো না। তারপর তারা আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত হল। বস্তুতঃ আল্লাহর অনুগ্রহ অতি বিরাট। (সুরা আল ইমরান ৩:১৭৪)

১১। আল্লাহর স্মরণ করা বা জিকির করার মাধ্যমে সবর অর্জন করতে হবেঃ

জীবনের প্রতি মুহুর্তে বিপদ, দুঃখ, কষ্ট, হতাশা ইত্যাদি আসবেই কারন এসব জীবনেই একটি অংশ। এসব এলেই হতাশ হয়ে পড়া কোন মুমীনের লক্ষণ নয়। এগুলো এলে কি করতে হবে তাও আল্লাহপাক বাতলে দিয়েছেন। আল-কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন,

فَإِذَا مَسَّ الْإِنسَانَ ضُرٌّ دَعَانَا ثُمَّ إِذَا خَوَّلْنَاهُ نِعْمَةً مِّنَّا قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ بَلْ هِيَ فِتْنَةٌ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

অর্থঃ মানুষকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে আমাকে ডাকতে শুরু করে, এরপর আমি যখন তাকে আমার পক্ষ থেকে নেয়ামত দান করি, তখন সে বলে, এটা তো আমি পূর্বের জানা মতেই প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না। (সুরা আল জুমার ৩৯:৪৯)

মহান আল্লাহ বলেন,

وَإِذَا مَسَّ الإِنسَانَ الضُّرُّ دَعَانَا لِجَنبِهِ أَوْ قَاعِدًا أَوْ قَآئِمًا فَلَمَّا كَشَفْنَا عَنْهُ ضُرَّهُ مَرَّ كَأَن لَّمْ يَدْعُنَا إِلَى ضُرٍّ مَّسَّهُ كَذَلِكَ زُيِّنَ لِلْمُسْرِفِينَ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ

অর্থঃ মানুষের অবস্থা হচ্ছে, যখন সে কোন কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়, তখন সে দাঁড়িয়ে ,বসে ও শায়িত অবস্থায় আমাকে ডাকে৷ কিন্তু যখন আমি তার বিপদ হটিয়ে দেই তখন সে এমনভাবে চলতে থাকে যেন সে কখনো নিজের কোন খারাপ সময়ে আমাকে ডাকেইনি৷ ঠিক তেমনিভাবে সীমা অতিক্রমকারীদের জন্য তাদের কার্যক্রমকে সুশোভন করে দেয়া হয়েছে৷  (সুরা ইউনুছ ১০:১২)

মন্তব্যঃ বিপদে আল্লাহ সাহায্য করে, তার উদাহরন স্বয়ং আল্লাহই দিলেন। তাই বিপদে আল্লা্হর স্বরণ মানে হল বিপদে আল্লাহ সাহায্য কামনা করা। এই জন্য বিপদে  আল্লাহর সাহায্য না আসা পর্যান্ত সবর করা।

১২। আল্লাহ যেমনি ভাবে আমাকে বিপদ দিয়েছেন ঠিক তেমনিভাবে দুর করবেনঃ

মহান আল্লাহ বলেন,

 قُلۡ مَن يُنَجِّيكُم مِّن ظُلُمَـٰتِ ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِ تَدۡعُونَهُ ۥ تَضَرُّعً۬ا وَخُفۡيَةً۬ لَّٮِٕنۡ أَنجَٮٰنَا مِنۡ هَـٰذِهِۦ لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلشَّـٰكِرِينَ (٦٣) قُلِ ٱللَّهُ يُنَجِّيكُم مِّنۡہَا وَمِن كُلِّ كَرۡبٍ۬ ثُمَّ أَنتُمۡ تُشۡرِكُونَ (٦٤)

অর্থঃ আপনি বলুনঃ কে তোমাদেরকে স্থল ও জলের অন্ধকার থেকে উদ্ধার করেন, যখন তোমরা তাঁকে বিনীতভাবে ও গোপনে আহবান কর যে, যদি আপনি আমাদের কে এ থেকে উদ্ধার করে নেন, তবে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। আপনি বলে দিনঃ আল্লাহ তোমাদেরকে তা থেকে মুক্তি দেন এব সব দুঃখ-বিপদ থেকে। তথাপি তোমরা শির্ক কর। [ সুরা আন’য়াম ৬:৬৩-৬৪ ]

কঠিন সময়ে আল্লাহর সাহায্য আসবেই। আল-কোরআনে আল্লাহপাক তেমন ঘটনার উল্লেখ করেছেন। কাজেই মুমিন হয়ে থাকলে দুশ্চিন্তা পরিহার করুন।

 মহান আল্লাহ বলেন,

*إِلاَّ تَنصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُواْ ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللّهَ مَعَنَا فَأَنزَلَ اللّهُ سَكِينَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُودٍ لَّمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُواْ السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللّهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ *

অর্থঃ যদি তোমরা তাকে (রসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো, আল্লাহ তার সাহায্য করেছিলেন, যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন বিষন্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় সান্তনা নাযিল করলেন এবং তাঁর সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখনি। বস্তুতঃ আল্লাহ কাফেরদের মাথা নীচু করে দিলেন আর আল্লাহর কথাই সদা সমুন্নত এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সুরা তাওবা ৯: ৪০)

বিপদে ধৈর্য্য ধারন করার কথা বারংবার বলা হয়েছে। অন্যের দেয়া কষ্ট থেকে আল্লাহ তার মুমিন বান্দাকে অবশ্যই রক্ষা করেন। মুমিনের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র তিনি নস্যাত করে দেন। মহান আল্লাহ বলেন,

*وَاصْبِرْ وَمَا صَبْرُكَ إِلاَّ بِاللّهِ وَلاَ تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَلاَ تَكُ فِي ضَيْقٍ مِّمَّا يَمْكُرُونَ *

অর্থঃ আপনি সবর করবেন। আপনার সবর আল্লাহর জন্য ব্যতীত নয়, তাদের জন্যে দুঃখ করবেন না এবং তাদের চক্রান্তের কারণে মন ছোট করবেন না। (সুরা আন নাহল, আয়াত ১২৭)

১৩।  বিপদে আল্লাহ নিয়ামতের কথা স্মরণ করাঃ

শত চেষ্টা করেও যখন বিপদ থেকে বেচে থাকা সম্ভব হবে না তখন মনে করতে হবে বিপদ আল্লাহ পক্ষে থেকে পরীক্ষার জন্য এসেছে। এ পরীক্ষায় আমাকে পাশ করতেই হবে। তার মহান আল্লাহ দেয়া অসংখ্যা নিয়ামতের কথা স্মরণ করে, সবর করতে হবে। আর নেয়ামতের শুকরিয়া করাতো আল্লাহর আদেশ। যেমন তিনি বলেন,

وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِن شَكَرْتُمْ لأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ

যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর। (সুরা ইবরাহীম ১৪:৭)

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُواْ لِي وَلاَ تَكْفُرُونِ

সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না। (সুরা বাকারা ২:১৫২)।

দুনিয়ার ব্যাপারটা একটু ভাবি কেউ কোন উপকার করলে, তার দ্বারা কোন কষ্ট পেলে আমরা কষ্টকে কষ্টই মনে করিনা। কথায় বলে, যে গরু দুধ দেয় তার লাথিও খাওয়া যায়। অথচ যেই আল্লাহর দানের উপর কার দান নেই। তিনি কখনও তার বান্দার অমঙ্গল চান না। তিনি আমারই ভালর জন্য, আমারই মর্জাদা বাড়ানোন জন্য, আমারই গুনাহ মাপের জন্য বিপদ দিলেন আর আমি ভুল বুঝে ভুল করে তারই উপর দোষ চাপাচ্ছি। ইহা বহুত বড় জুলুম। কাজেই যার উপর কারো দান নেই, যিনি শুধুই দেন। তাই মহান আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করে  বিপদের মুহূর্তে তার সন্ত্বষ্টির জন্য সবর করা। এতে তার বালা-মুসিবত, বিপদ-আপদ সহনীয় হয়। যিনি আমাকে বিপদ দ্বারা পরীক্ষা করছেন তিনি আমাকে উদ্ধার করবেন। এ বিশ্বাস নিয়ে সবর করলে কষ্টের পরিমাণ অনুযায়ী সওয়াব অর্জিত হবে। সবাই জানি পরবর্তী কোন ভাল ফলের জন্য নগদ শ্রম দিতে হয়। ইহকালের কষ্টের সিঁড়ি পার হয়ে পরকালের স্বাদ আস্বাদান করতে হয়। কাজেই কষ্টের সময় আল্লাহ নেয়ামতের কথা স্মরণ করলে সবর করা সহজ হবে।

১৪। দুয়ার দ্বারা সবর অর্জন করা সহজ হবেঃ

বিপদে আল্লাহর নিকট দুয়া করা। দুয়ার দ্বারা সবর অর্জন করা সহজ হবে। বান্দা বিপদে পড়ে যখন দোয়া করবে তখন মনে হবে আল্লাহ আমার কথা শুনছেন। এ বিপদ থেকে তিনি আমাদে উদ্ধার করবেন তখন বান্দার পক্ষে সবর করা অনেক সহজ হবে। মহান আল্লাহ বলেনঃ

*فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنجِي الْمُؤْمِنِينَ*

অর্থঃ তখন আমি তার (ইউনুস আঃ) দোয়া কবুল করেছিলাম এবং দুঃখ থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছিলাম, আর এভাবেই আমি মুমিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি৷

আল্লাহ্‌ পাক আরো এরশাদ করেনঃ

وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

অর্থঃ হে মুমিন সমপ্রদায় তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তওবা কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার। (সূরা নূরঃ ৩১)

পরিস্কার কথা, দোয়া করলে আল্লাহ বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। এ বিশ্বাস রেখে বিপদে আল্লাহর সাহায্য কামনা করলে সবর করা সহজ হবে। দুনিয়াতে কোন সাময়িক বিপদে পড়ল যদি তার নিকট এমন খবর থাকে যে কেউ একজন তাকে সাহায্যের জন্য চেষ্টা করছে যখন তার মন বল বেড়ে যাবে এবং এই বিপদে তার সবর করা সহজ হবে। আল্লাহপাক বলেনঃ

وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ
অর্থঃ তোমাদের পালনকর্তা বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাক আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। নিশ্চয় যারা আমার কাছে দুআ করে না, দুআ করতে অহংকার করে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (সূরা মু’মেনঃ ৬০)।

তিনি আরো বলেনঃ

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ

অর্থঃ “এবং যখন আমার বান্দাগণ আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, তখন তাদেরকে বলে দিনঃ নিশ্চয় আমি তাদের সন্নিকটেই। কোন ব্যক্তি যখনই আমাকে আহ্বান করে, তখনই আমি তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে থাকি; সুতরাং তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমাকে বিশ্বাস করে, তাহলেই তারা সঠিক পথে চলতে পারবে।” (সূরা বাকারা ২:১৮৬)।

আল্লাহ্‌ আরো বলেনঃ

وَهُوَ الَّذِي يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَعْفُو عَنِ السَّيِّئَاتِ وَيَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ

অর্থঃ তিনিই তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং পাপরাশী ক্ষমা করেন, আর তোমরা যা কর তিনি তা জানেন।” (সূরা শূরাঃ ২৫)।

হাদিসে এসেছেঃ আবু তামীমাহ আল- হুজাইমী বালাহাজীমের জনৈক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, আমি একদা বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাঃ)! আপনি কিসের প্রতি আহবান করেন? তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে এ কথার প্রতি আহবান করি যে, আল্লাহ এক, যাকে কোন মুসিবতে পরে তুমি তাকে ডাকলে তিনি তোমার মুসিবত দূর করেন। তৃণ-পানিহীন বিজন প্রান্তরে হারিয়ে গিয়ে তাঁকে ডাকলে তিনি তোমাকে তোমার (ঠিকানায়) ফিরিয়ে দেন। তিনি ঐ সত্ত্বা যাকে দুর্ভিক্ষে পরে তুমি ডাকলে তোমাকে সচ্ছলতা দান করেন’’ সাহীহাহ ৪২০ আতিফা পাবলিকেশন্স ৯৩১ (আলবানি সহীহ বলেছেন)

মন্তব্যঃ কাজেই বিপদে দোয়া করে করে আল্লাহ্‌ পাক এর সাহায্য কামন করতে হবে। মনে করবে নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাকে শুনছেন। এবং তিনিই আমাকে শর্তহীনভাবে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। তাহলে সবর করা সহজ হবে।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment