জিকির কেন্দ্রিক বিদআত চতুর্থ কিস্তি 

জিকির কেন্দ্রিক বিদআত চতুর্থ কিস্তি 

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

৩১। শুধু “ইল্লাল্লাহ, ইল্লাল্লাহ” জিকির করা একটি বিদআতঃ

শুধু “আল্লাহ, আল্লাহ” জিকির করা যেমন সুন্নাহ সম্মত নয় ঠিক তেমনি শুধু “ইল্লাল্লাহ, ইল্লাল্লাহ” জিকির করাও সুন্নাহ সম্মত জিকির নয়। উপরে আলোচিত হয়েছে একক অর্থহীন বাক্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও জিকির নাই, তাই এমন জিকির করা ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবিগন (রাঃ), তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী কারো দ্বারা “ইল্লাল্লাহ, ইল্লাল্লাহ” জিকির করার প্রমান নাই। মহান গ্রন্থ আল কুরআনেও বহু আয়াতে এই কালিমা (লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ) বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। বহু স্থানে এই কালিমার সাক্ষ্য প্রদান করা হয়েছে। নিম্ম উদাহরণ দেয়ার জন্য কয়েকটি আয়াত তুলে ধরলাম। মহান আল্লাহ বলেন,

*وَإِلَـهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ*

অর্থঃ আর তোমাদের উপাস্য একইমাত্র উপাস্য। তিনি ছাড়া মহা করুণাময় দয়ালু কেউ নেই। (সুরা বাকারা ১৬৩)

মহান আল্লাহ বলেন,

*اللّهُ لا إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ*

অর্থঃ আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক। ( সুরা ইমরান ৩:২, সুরা বাকারা ২:২৫৫)

মহান আল্লাহ বলেন,

اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْأَسْمَاء الْحُسْنَى

অর্থঃ আল্লাহ তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য ইলাহ নেই। সব সৌন্দর্যমন্ডিত নাম তাঁরই। [ সুরা ত্বা-হা ২০:৮ ]

মহান আল্লাহ বলেন,

لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ يُحْيِي وَيُمِيتُ رَبُّكُمْ وَرَبُّ آبَائِكُمُ الْأَوَّلِينَ

অর্থঃ তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু দেন। তিনি তোমাদের পালনকর্তা এবং তোমাদের পূর্ববর্তী পিতৃ-পুরুষদেরও পালনকর্তা। (সুরা দুখান ৪৪:৮)।

 অসংখ্যা সহিহ হাদিসে পরিপূর্ণ কালিমা লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ উঠে এসেছে। ইহার ফজিলতও বর্নিত হয়েছে বিধান ভাবে। এমন কোন হাদিস প্রন্থ নেই যেখানে এই কলেমার গুরিত্ব তুলে ধরা হয় নাই। কিন্তু কোথাও আপনি শুধু ইল্লাল্লাহ ফজিলত বা গুরুত্ব পাবেন না। আমাদের প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও পরিপূর্ণ কালিমা লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ এর জিকির করছেন বলে হাদিসে প্রমানিত। যেমনঃ

১। মাহমুদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা তাঁর স্মরণ আছে। আর তিনি বলেনঃ তাদের ঘরের পানির ডোল থেকে পানি মুখে নিয়ে তিনি তার মুখে ছিটিয়ে দিয়েছিলেন সে কথাও তার স্মরণ আছে। তিনি বলেনঃ ইতবান ইবনু মালিক আনসারীকে, এরপর বনী সালিমের এক ব্যাক্তিকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকালে আমার এখানে এলেন এবং বললেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে ব্যাক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং এ বিশ্বাস নিয়ে কিয়ামতের দিন হাযির হবে, আল্লাহ তার উপর জাহান্নাম হারাম করে দিবেন। (সহিহ বুখারি ৫৯৮০ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

 ২। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করা হলঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ! কিয়ামতের দিন আপনার শাফা’আত লাভে কে সবচাইতে বেশি ভাগ্যবান হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবূ হুরায়রা! আমি ধারণা করেছিলাম, এ বিষয়ে তোমার আগে আমাকে আর কেউ প্রশ্ন করবে না। কারন আমি দেখেছি হাদীসের প্রতি তোমার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। কিয়ামতের দিন আমার শাফা’আত লাভে সবচাইতে ভাগ্যবান হবে সেই ব্যাক্তি যে খালিস দিলে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ (পূর্ণ কালেমা তাইয়্যেবা) বলে। (সহিহ বুখারি ৯৯ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

৩। সায়ীদ ইবনু মূসাইয়্যাব (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবূ তালিব এর মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে আসলেন। তিনি সেখানে আবূ জাহল ইবনু হিশাম ও আবদুল্লাহ ইবনু উমাইয়্যা ইবনু মুগীরাকে উপস্থিত দেখতে পেলেন। (রাবী বলেন) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ তালিবকে লক্ষ্য করে বললেন, চাচাজানো! ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালিমা পাঠ করুন, তা হলে এর অসীলায় আমি আল্লাহর সমীপে আপনার জন্য সাক্ষ্য দিতে পারব।

আবূ জাহল ও আবদুল্লাহ ইবনু আবূ উমায়্যা বলে উঠল, ওহে আবূ তালিব! তুমি কি আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম থেকে বিমুখ হবে? এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে কালিমা পেশ করতে থাকেন, আর তারা দু’জনও তাদের উক্তি পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। অবশেষে আবূ তালিব তাদের সামনে শেষ কথাটি যা বলল, তা এই যে, সে আবদুল মুত্তালিবের ধর্মের উপর অবিচল রয়েছে, সে আবদুল মুত্তালিবের ধর্মের উপর অবিচল রয়েছে, সে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে অস্বীকার করল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহর কসম! তবুও আমি আপনার জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকব, যতক্ষণ না আমাকে তা থেকে নিষেধ করা হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক নাযিল করেন, ‏مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ‏ ‏ الآيَةَ নাবীর জন্য সঙ্গত নয় … (সূরা তাওবাঃ ১১৩)। (সহিহ বুখারি ১২৭৭ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

৪। আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলাম। তার পরিধানে তখন সাদা পোশাক ছিল। তখন তিনি নিদ্রিত ছিলেন। কিছুক্ষণ পর আবার এলাম, তখন তিনি জেগে গেছেন। তিনি বললেনঃ যে কোন বান্দা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে এবং এ অবস্থার উপরে মারা যাবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি বললামঃ সে যদি যিনা করে, সে যদি চুরি করে? তিনি বললেনঃ যদি সে যিনা করে, যদি সে চুরি করে তবুও। আমি জিজ্ঞাসা করলামঃ সে যদি যিনা করে, সে যদি চুরি করে তবুও? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ সে যদি যিনা করে, সে যদি চুরি করে তবুও। আমি বললামঃ যদি সে যিনা করে, যদি সে চুরি করে তবুও? তিনি বললেনঃ যদি সে যিনা করে, যদি সে চুরি করে তবুও। আবূ যারের নাসিকা ধুলাচ্ছন্ন হলেও। আবূ যার (রাঃ) যখনই এ হাদীস বর্ণনা করতেন তখনি আবূ যারের নাসিকা ধূলাচ্ছন্ন হলেও বাক্যটি বলতেন।

আবূ আবদুল্লাহ ইমাম বুখারী) বলেন এ কথা প্রযোজ্য হয় মৃত্যুর সময় বা তার পূর্বে যখন সে তাওবা করে ও লজ্জিত হয় এবং বলে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তখন তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (সহিহ বুখারি ৫৪১০ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

মন্তব্যঃ এমনিভাবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ফজিলত সম্পর্কে শত শত হাদিস বিদ্যমান। এই বাক্যটি পৃথিবীর মধ্য শ্রেষ্ঠ বাক্য যা দ্বারা জাহান্নাহ হামাম হয়, জান্নাত ওয়াজিব হয়, এর সুপারিস পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। আপনি কুরআন সুন্নাহ কোথাও পাবেন না যে, শুধু “ইল্লাল্লাহ, ইল্লাল্লাহ” জিকির করলে এই ফজিলত হবে। কাজেউ সুন্নাহ সম্মত ইবাদাত বাদ দিয়ে মনগড়া পদ্ধতিতে ইবাদাত করার প্রয়োজনই কি? যে জিকিরের ব্যাপারে কোন সন্দেহ সংশয় নাই তা বাদ দিয়া একটি উদ্ভদ যুক্তি দাড় করিয়ে ইবাদাত করার লাভ কি? আমনি যদি পরিপূর্ণ কালিমা লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ জিকির করেন তবে ফজিলত নিশ্চিত কেন অনিশ্চিত পথে হাটবেন। একটু বিবেক খাটান।

 

দলীল খন্ডনঃ

যাহোক যারা “ইল্লাল্লাহ, ইল্লাল্লাহ” জিকির করেন তারা কোন দলীলের ভিত্তিতে করে না তার একটু পর্যালোচনা করব।

১। আরবী গ্রমার ইল্লাহ ঠিক আছেঃ

যারা এর পক্ষে বলেন তেমনই এক জন আলেম কে প্রশ্ন করা হলোঃ ইল্লাল্লাহ জিকির করা কি?

তিনি উত্তরে লিখলেনঃ

আমরা অনেক সময় বলে থাকি “এখানে কেউ আসবে না” তারপর বলি “আব্দুল্লাহ ছাড়া।”

প্রথম বারের কথা দ্বারা সবাইকে নিষধ করছি, তারপর আব্দুল্লাহ ছাড়া শব্দটি বলে শুধু আব্দুল্লাহের আগমণের অনুমতি দিচ্ছি। তাই না?

তেমনি আমাদের কালিমা “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর অর্থ। আমরা প্রথমে বলি লা-ইলাহা” মানে হল কোন ইলাহ/মাবুদ নেই”। তারপর বলি ইল্লাল্লাহ” তথা আল্লাহ আছে।

আমরা অনেক সময় বড় মজলিসে বলি কেউ এখানে আসবে না। তারপর বেশ কিছুক্ষণ পর বলি তবে আব্দুল্লাহ, তবে আব্দুল্লাহ।

এই যে, তবে আব্দুল্লাহ বলছি এর মানে কিন্তু এখানে কেউ আসবে না তবে আব্দুল্লাহ আসবে। তাই নয় কি? আব্দুল্লাহ নাই, আব্দুল্লাহ নাই একথা কিন্তু কোন আহমকই বুঝে না।

ঠিক তেমনি বার তাসবীহ জিকিরে দুইশত বার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ জিকির করার পর চারশত বার শুধু বলা হয় ইল্লাল্লাহ [তবে আল্লাহ], ইল্লাল্লাহ। এর মানে এর আগে উক্ত ব্যক্তির নিয়তে উহ্য রয়েছে লা-ইলাহা শব্দটি।

যে ব্যক্তিই ইল্লাল্লাহ জিকির করেন, তার মনে কিছুতেই একথা থাকে না যে, আল্লাহ নাই, আল্লাহ নাই নাউজুবিল্লাহ। বরং তার ব্রেইনে থাকে লা-ইলাহা আর মুখে উচ্চারণ করে ইল্লাল্লাহ। যার পরিপূর্ণতা মূলত লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। অন্তরে লা ইলাহা শব্দ আর মুখে ইল্লাল্লাহ। সুতরাং এতে কোন প্রকার অর্থের বিকৃতি ঘটে না। কুফরী কোন কথাই আবশ্যক হয় না।

আরবী ভাষায় এর ভুরি ভুরি নজীর রয়েছে। যেমনঃ

এক হাদীসে এসেছে রাসূল সাঃ হারামের সিমানার গাছ কাটতে নিষেধ করেছেন। তথন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ বলেন, ইল্লাল ইজখির? তথা “তথা “তবে ইজখির”। তখন রাসূল (সাঃ) জবাবে বললেন শুধু “ইল্লাল ইজখিল তথা “ইজখীর” ছাড়া। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৩৫৩}

শুধু ইল্লাল ইজখির বললেন আল্লাহর রাসূল। মুস্তাসনা মিনহু তথা কার থেকে ইজখিরকে পৃথক করলেন তা উল্লেখ করেননি। কারণ এটি জানা বিষয় এবং মনের মাঝে উহ্য আছে সকল বিষয় কাটা হারাম তবে ইজখির ছাড়া। যেহেতু মনের মাঝে সকল কিছু কাটা হারাম শব্দটি উহ্য আছে। তাই মুখের শব্দে ইজখির বলার দ্বারা অর্থের বিকৃতি ঘটেনি।

তেমনি মনের মাঝে লা-ইলাহা লুকায়িত থাকা অবস্থায় মুখে ইল্লাল্লাহ বলার দ্বারাও কোন প্রকার অর্থের বিকৃতি ঘটে না।  কোন কুফরী কথা লাজিম আসে না। বাকি কথা হল, শায়েখের নির্ধারিত অজিফা আদায় করার সময় ছাড়া অন্য সময় কুরআন ও হাদীসে সরাসরি আসেনি এমন জিকির না করা উচিত। বিশেষ করে ইল্লাল্লাহ জিকির। বরং হাদীসে বর্ণিত জিকির করাই উত্তম। কিন্তু এটিকে শিরক বলা বিদআত বলা আহমকী বৈ কিছু নয়। (মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী, পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা)।

মন্তব্যঃ হযরতের এই ব্যাখ্যা সম্পর্কে কোন কথা বলনা। কারন তার ব্যাখ্যাটি আবরী ব্যাকারণ অনুসারে সঠিক। অর্থাৎ যারা মহান আল্লাহকে খুশি করা জন্য জিকির করবেন তিনি অন্তুরে কুফরি রাখবেন তা কেউ বিশ্বাস করেনা। তার মানে ইল্লাল্লাহ শব্দটি উচ্চারন করায় আবরী ব্যাকারন অনুসারে কোন সমস্যা নাই। আমরাও বলি, ইল্লাল্লাহ শব্দটি উচ্চারন করায় আবরী ব্যাকারন অনুসারে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু সমস্যা হল যখন আপনি বলবে ইল্লাল্লাহ ইল্লাল্লাহ শব্দ দ্বারা জিকির করা যাবে। যখনই আপনি নেকীর আশায় কোন ইবাদাত করবেন কখনই আপনাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেখান পদ্ধতিতে ইবাদাত করতে হবে। এর সময় সুযোগ থাকা সত্বেও কখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইল্লাল্লাহ ইল্লাল্লাহ শব্দ দ্বারা জিকির নাই। তিনি বলেন নাই এই পদ্ধতি জিকির করলে অধিক ফল দায়ক। আপনার কাছে অহী আসেনা অথচ আপলি এর ফজিলতে আশায় দৈনিক ৩০০ বার ৬০০ বার ১২০০ বার আদায় করছেন। তা হলে ইহাকে ইসলামে নতুর সংযোজন বা বিদআত বলতে পারবনা কেন।

ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ বলতেন, যদি আরবী ব্যাকারণ দ্বারা ইবাদাত করতে হয়, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন এসেছিলেন? তিনি তো আমাদের ইবাদাতের পদ্ধতি দেখাতে এসেছিলেন। কাজেই আপনি যদি ইবাদাত করার দাবি করেন তবে আপনানে কুরআন সুন্নাহ থেকে দলীল পেশ করতে হবে। কোন যুক্তিতে কাজ হবে না।  

২। কু্রআনের ভুল ব্যাখ্যাঃ

মহান আল্লাহ বলেন,

وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُواْ فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُواْ أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُواْ اللّهَ فَاسْتَغْفَرُواْ لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ اللّهُ وَلَمْ يُصِرُّواْ عَلَى مَا فَعَلُواْ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

অর্থঃ তারা কখনও কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোন মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের উপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? তারা নিজের কৃতকর্মের জন্য হঠকারিতা প্রদর্শন করে না এবং জেনে-শুনে তাই করতে থাকে না। (সুরা ইমরান ৩:১৩৫)

এই আয়াতটির একটি অংশ হলঃ (وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ اللّهُ) আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? এখান ইল্লাল্লাহ শব্দটি আছে। তাদের দাবি কুরআন সরাসরি ইল্লল্লাহ শব্দ পাওয়া যায়। আর কুরআনের প্রতিটি শব্দের বিনিয়ম দশ নেকীর কথা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত তাহলে ইল্লাল্লাহ শব্দের জিকিরে নিশ্চয় নেকী আছে। সুতারং ইল্লল্লাহ এর জিকির করা যাবে বিদআত হবে না। এমনিভাবে কুরআনের বহু আয়াতের একটি অংশ হিসাবে ইল্লাল্লাহ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই বাক্য তিলওয়াত করে ইল্লাল্লাহ এসে জোর দিয়ে বলেন, দেখুন কুরআন ইল্লাল্লাহ আছে কি নাই। উপস্থিত দর্শক বলেন ঠিক ঠিক। বাস হয়ে গেল ইল্লাল্লাহ জিকিরদের দলীল।

মন্তব্যঃ বুঝতেই পারছেন, কুরআনে কোন শব্দ থাকলেই তার জিকির কথা সুন্নাহ সম্মত হবে এমনটি বলার অবকাশ নেই। কুরআনে ইবলিশ শয়তানের কথা আছে, আবু লাহাবের কথা আছে, ফিরাউন, হামানসহ অনেকের কথাই আছে। তাই বলে কি এদের নামের জিকির করা সুন্নাহ সম্মত হবে। আমাদের জন্য দ্বীর পরিপুর্ন হয়ে আছে, এখানে কোন যুক্তির বলে নতুন পদ্ধতির ইবাদাত দাড়ন করা যাবে না। কুনআনের এই সকল আয়াত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর নাজিল হয়েছেন। তিনিই ভাল জানের কোন আয়াতে কোন অংশটুকু কি পরিমান ফজিলত রাখে আর কোন আয়াতের কোন অংশ বার বার পড়লে আত্মশুদ্ধি হবে। তিনি কিছু বলে গেলেন না আর আপারানা নিজের একটি পদ্ধথি আবিস্কার করে বলছেন। ইল্লাল্লাহ এর জিকির আত্মশুদ্ধির জন্য খুবই জরুরী। এই জরুরী আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝলেন। নাউজুবিল্লাহ।

মন গড়া যুক্তিঃ

ইদানিং কিছু আলেম আবার বলছেন, আপনি যদি কুরআন পড়া শিখতে যান তবে একটি শব্দ আপনাকে বার বার পড়তে হবে। মুখস্ত করতে গেলেও বার বার পড়তে হয়। মুখস্থ করার জন্য যদি একটি শব্দ বার বার বললে বিদআত না হয় তবে, ইল্লাল্লাহ জিকিরে ইল্লাল্লাহ বার বার বললে বিদআত হবে কেন? তাদের বাদি ইল্লাল্লাহ জিকির হল তাদের পীরের দেয়া একটি সবক যা মুরীদের ইসলার জন্য প্রদান করা হয়।

মন্তব্যঃ এটা কোন যুক্তি নয়। মুখন্ত করার পর আর কেউ কুরআন একটি শব্দ বার বার পড়ে না।  কিন্তু পীরের মুরীদ তার পীরের দেয়া অজিফা ইল্লাল্লাহ জিকির আজীবন আদায় করে। এই যুক্তি হল মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য। মুখস্ত জন্য বার বার পড়া আর আত্মশুদ্ধির জন্য অজিফা এক জিনিস হল।

 

৩২। সম্মিলিত জিকির করাঃ

সম্মিলিত জিকির করা একটি বিদআতি কাজ। আমাদের সমাজে এই বিদআতটিও বহুল প্রচলিত। সম্মলিতভাবে জিকির করার জন্য এরা জিকির মাহফিলের আয়োজন করে। আবার কোন কোন মসজিদে মাগরিবের পর সম্মিলিত জিকিরের মজলিস আয়োজন করে। কোথাও আবার সপ্তাহে একদিন সম্মিলিত জিকিরের মজলিস আয়োজন করে থাকে। আবার এমনও অনেক সময় একই পীরের মুরিদগণ তাদের যে কোন পীর ভাইয়ের বাড়িতে সপ্তাতে একদিন সম্মিলিত জিকিরের মজলিস করে থাকে। কোন কোন পীরের মুরিদগন মাসে মাসে সম্মিলিত জিকিরের মজলিস আয়োজন করে থাকে, এই ধরনের জিকিরের মজলিস বাড়ির আঙ্গিনা বা উঠানে হয়ে থাকে। জিকির শেষে ডাল চালে খিচুড়ি খাওয়ান হয়। অনেক মুরিদ আবার বছরে একবার সম্মিলিত জিকিরের আয়োজন করে থাকে।

এইভাবে সম্মিলিতভাবে জিকির করা যে বিদআত তাতে মাজার পুজারী আর শিয়া ছাড়া সকলে একমত যে বিদআত হবে।

আমাদের সমাজে দেওবন্দী অনুসারী আলেম যারা নিজদের হক পন্থী পীর বলে দাবী করেন তারা সম্মিলতিভাবে জিকির করাকে শর্ত সাপেক্ষে জায়েয বলেছেন। তারা দলীল হিসবে এই হাদিসটি উল্লেখ করে তাকে।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমি আমার বান্দার কাছে তার ধারণা অনুযায়ী। যখন সে আমার যিকর করে তখন আমি তার সঙ্গে থাকি। বান্দা আমাকে একাকী (তার মনে মনে) স্মরণ করলে আমিও তাকে একাকী স্মরণ করি। আর যদি সে কোন মজলিসে আমার জিকির (স্মরণ) করে তাহলে আমি তাকে তাদের চাইতে উত্তম মজলিসে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে তাহলে আমি তার দিকে এক হাত নিকটবর্তী (অগ্রসর) হই। যদি সে আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে অতি দ্রুত আসি। (সহিহ মুসলিম ৬৫৬১ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

তাদের দাবিঃ  হাদিসে বলা হয়েছে, “যদি সে কোন মজলিসে আমার জিকির (স্মরণ) করে তাহলে আমি তাকে তাদের চাইতে উত্তম মজলিসে স্মরণ করি”। এখান মজলিস বলতে সম্মিলিত জিকির কে বুঝান হয়েছে। তাই সম্মিলিত জিকির জায়েয। মজলিস বলতে সম্মিলিত জিকির কে বুঝান হয়েছে কথাটি ঠিক কিন্তু জিকির বুঝাতে ইসলামি আলোচনা বুঝান হয়েছে। কারন বুখারির এক হাদিসে এসেছে ফিরিস্তাগন যখন এই জিকিরের মজলিস থেকে ফিরে যায় তখন এই মজলিস সম্পর্কে মহান আল্লাহর সাথে ফিরিস্তাদর কথা হয়। বান্দা মজলিসে কি আলোচনা করে সে সম্পর্কে আল্লাহর সাথে কথা হয়।  জান্নাত ও জাহান্নাম থেকে পানাহ চাওয়ার আলোচনা রয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় এই মজলিক কোন মৌখিক জিকিরের মজলিস নয়। তারচেয় বড় প্রমান হল কোন হাদিসে এ প্রমান নাই যে, এই রকম মৌখিক জিকিরের জন্য সাহাবীগণ একত্র হয়েছেন।

যেহেতু এই হাদিসের আলোকে তারা সম্মিলত জিকির জায়েয বলেছেন এবং সাথে সাথে শর্ত আরোপ করেছেন। তাদের মতে এই শর্ত ছাড়া সম্মিলিত জিকিরকে তারা নাজায়েয হবে। বিশেষভাবে তারা ৫ টি শর্ত পূরণ করা অত্যাবশ্যক বলেছেন। তাদের দেয়া শর্তগুলি হলোঃ

১। লোক দেখানোর উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত হওয়া।

২। কোনো ব্যক্তির নামাযে বা অন্য কোনো ইবাদতে বিঘ্ন না ঘটানো

৩। কোনো ব্যক্তির বিশ্রামে সমস্যা না হওয়া।।

৪। আওয়াজ স্বাভাবিক হওয়া, চিৎকার করে বা অতিরিক্ত উঁচু আওয়াজে না হওয়া এবং মাইক ব্যবহার না করা।

৫। সাধারণভাবে এবং সহীহ-শুদ্ধ করে যিকির করা।

তাদের দাবি যদি উল্লেখিত শর্তাবলি পাওয়া যায় তবে সম্মিলিত জিকির করতে কোনো অসুবিধা নেই। আর যদি কোনো ক্ষেত্রে উল্লেখিত শর্তসমূহ বা তা থেকে কোনো একটি শর্ত না পাওয়া যায় তাহলে সেক্ষেত্রে কাজটি শরীয়তসম্মত হবে না।

অপর পক্ষে সালাফি ও আহলে হাদিসের অনুসারী আলেমগণ যে কোন নফল আমলের জন্য একত্র হওয়া কে বিদআত মনে করে। যে সকল ইবাদতের কারনে সাহাবিগন একত্র হয়ছেন, শুধু সেই সকল ইবাদতের জন্য একত্র হওয়াকে জায়েয মনে করেন। যেমনঃ ইলম অর্জনের জন্য একত্র হওয় বা দ্বীনি আলোচনার জন্য একত্র হওয়া। কিন্তু যে সকল নফল আমল সাহাবীগন একা একা আদায় করেছেন তার জন্য একত্র হওয়াকে এরা বিদআত মনে করে। যেমনঃ ইলম অর্জন নয় শুধু মৌখিক জিকিরে জন্য একত্র হওয়া বা শুধু দুয়ার জন্য একত্র হওয়া। তাই তাদর মনে সম্মিলিত জিকির বিদাআত।

মন্তব্যঃ দেওবন্দী অনুসারী আলেম যে শর্ত সাপেক্ষে সম্মিলতিভাবে জিকির করাকে জায়েয বলেছেন। এই সকল শর্ত এখন কোন সম্মিলিত জিকিরের মজলিস মানে না। তাই সম্মিলত জিকির করা জায়েয নয়। তাছাড়া যেহেতু মৌখির জিকিরের জন্য একত্র হওয়ার কোন প্রমান সাহাবী বা তাবেয়ীদের যুগে পাওয়া যায় না। তাই এই ধরনের নব আবিস্কার বা বিদআত থেকে দুরা থাকা আবশ্যিক। 

৩৩। শুধু হু হু হু করে জিকির করাঃ

আমাদের সমাজে যারা ভন্ড পীর নামে পরিচিত তারা এই ধরনের জিকির করে থাকে। যেমনঃ আটরশী, মাইজভান্ডারী, দেওয়ানবাগী, রাজারবাগী, শুরেশ্বরী ইত্যাদি।

তবে যারা হক্কানী পীর দাবি করে যেমনঃ চরমোনাই পীর, সারসিনার পীর, ফুরফুরার পীর, দেওবন্দী ঘরানার পীর এরা এই ধরনের হু হু করে জিকির কে বিদআত বলে। শুধু বিদআত নয় জাহেলি কাজ বা হারাম কাজ মনে করে।

হু হু জিকিরের উৎসঃ

কথিত আছে, যখন কোন ব্যক্তি ঐ সকল ভন্ড পীরের মুরিদ হতে যায়, তখন তাকে অজিফা হিসাবে কালিমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ জিকিরের নির্দেশ প্রদান করা হয়। মুরিদ যখন এই জিকিরের ধাপ পার করে তখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ জিকিরের প্রথম অংশ লা ইলাহা বাদ দিয়ে শুধু ইল্লাল্লাহ, ইল্লাল্লাহ জিকিরের নির্দশ প্রদান করে। মুরিদ যখন জিকিরের ধাপ পার করে তখন, ইল্লাল্লাহ এর ইল্লা বাদ দিয়ে শুধু আল্লাহু আল্লাহু জিকিরের জিকিরের নির্দশ প্রদান করা হয়ে থাকে। মুরিদ যখন জিকিরের ধাপও পার করে তখন, আল্লাহু এর আল্লাহ বাদ দিয়ে শুধু হু হু জিকিরের অজিফা প্রদান করা হয়।

মন্তব্যঃ বুঝতেই পারছেন হু হু জিকির কে বিদআত বললে সঠিক হবে না। বরং এই ধরনের জিকির কথা পরিস্কার হারাম।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment