সালাত কেন্দ্রিক বিদআত ও মতবিরোধ : তৃতীয় কিস্তি

সালাত কেন্দ্রিক বিদআত ও মতবিরোধ : তৃতীয় কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

 ১৬। স্বরব সালাতে ফাতিহা শুনবে আর নীরব সালাতে ফাতিহা পড়বেঃ

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন,

*وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُواْ لَهُ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ*

অর্থঃ আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখ এবং নিশ্চুপ থাক যাতে তোমাদের উপর রহমত হয়। ( সুরা আরাফ ৭:২০৪)

তাফসিরে ইবনে কাসিরে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কুরআন তিলওয়াতের সময় মক্কার কুরাইশ কাফিরগন বলত, “তোমরা শুনো না, শুনতে দিয়ো না, বরং কুরআন পাঠের সময় গণ্ডগোল ও হৈ চৈ করতে থাকো।” কিন্তু এই নীরবতা অবলম্বনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে ফরয নামাযের ব্যাপারে বা ঐ সময়, যখন ইমাম উচ্চৈঃস্বরে কিরআত পাঠ করেন।

যেমনঃ হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “অনুসরণের জন্যেই ইমাম নিযুক্ত করা হয়। সুতরাং যখন সে তাকবীর পাঠ করে, আর সে যখন কিরআত পাঠ করে তখন তোমরা নীরব হয়ে যাও।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) তার সহীহ গ্রন্থে তাখরীজ করেছেন এবং আহলে সুনান এটা বর্ণনা করেছেন)

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন যে, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে লোকেরা নামাযের সময় কথা বলতো। অতঃপর যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়“তোমরা নীরব থাকো ও কিরআত শ্রবণ কর তখন নামাযে নীরব থাকার নির্দেশ দেয়া হয়।

ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “আমরা নামাযের মধ্যে একে (আরবী) অপরকে বলতাম। এ জন্যে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়।” হযরত বাশীর ইবনে জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “একদা ইবনে মাসউদ (রাঃ) নামায পড়াচ্ছিলেন। লোকদেরকে তিনি দেখলেন যে, তারা ইমামের সাথে নিজেরাও কিরআত পাঠ করছে। তিনি নামায শেষে বললেনঃ “তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা কুরআন শুনছে না এবং বুঝছো না? অথচ আল্লাহ তা’আলা নীরব থেকে শুনতে বলেছেন?”

যুহরী (রঃ) বলেন যে, এই আয়াতটি আনসারের একটি লোকের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয় (এই আয়াতটি মাক্কী এবং আনসারদের ইসলাম ককূলের পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছিল)। রাসূলুল্লাহ (সঃ) পড়তেন তখন তিনিও তার পিছনে পিছনে পড়ে যেতেন। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সশব্দ নামায শেষ করে বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ নিজেও কি আমার সাথে সাথে পড়ছিল?” তখন একটি লোক উত্তরে বললোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)। হ্যা (আমি পড়ছিলাম বটে)।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমার কি হয়েছে যে, আমি মানুষকে আমার সাথে সাথে কুরআন পড়তে দেখছি?” তখন থেকে মানুষ সশব্দ নামাযে ইমামের পিছনে কিরআত পড়া হতে বিরত থাকেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও আহলুস সুনান বর্ণনা করেছেন)

যুহরী (রঃ) বলেন যে, উচ্চ শব্দ বিশিষ্ট নামাযে ইমামের পিছনে কিরআত না পড়া উচিত। ইমামের কিরআতই মুকতাদীর জন্যে যথেষ্ট, যদিও তার শব্দ শোনা না যায়। কিন্তু যদি উচ্চ শব্দ বিশিষ্ট নামায না হয় তবে পড়ে নেয়া যায়। কিন্তু এটা ঠিক নয় যে, কেউ সশব্দ নামাযে ইমামের পিছনে কিরআত পড়ে। না প্রকাশ্যে পড়ে, না গোপনে পড়ে। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “কুরআন পাঠের সময় তোমরা নীরবতা অবলম্বন কর।” আমি বলি- আলেমদের একটি দলের নীতি হচ্ছে, উচ্চ শব্দ বিশিষ্ট নামাযে মুকতাদীর উপর এটা ওয়াজিব নয় যে, নিজেও সে কিরআত পাঠ করবে। না ইমামের সূরায়ে ফাতেহা পাঠের সময়, না অন্য সরা পাঠের সময়।

ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর দু’টি উক্তি রয়েছে। এ দুটি উক্তির মধ্যে একটি উক্তি এটাও রয়েছে। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) বলেন যে, মুকতাদী যেন কোন সময়েই কিরআত পাঠ না করে, আস্তের নামাযেও নয় এবং জোরের নামাযেও নয়। কেননা হাদীসে এসেছে- “যার জন্যে ইমাম রয়েছে, ইমামের কিরআতই তার কিরআত।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) হযরত জাবির (রাঃ) হতে মার’ রূপে বর্ণনা করেছেন।

এটা মুআত্তায় হযরত জাবির (রাঃ) হতে মাওকুফরূপে বর্ণিত আছে। ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন যে, এটাই বিশুদ্ধমত তবে এটা অত্যন্ত জটিল ও মতভেদী মাসআলা।

ইমাম বুখারী (রঃ) বলেন যে, ইমামের পিছনে কিরআত ওয়াজিব। নামায সিররী হাক অথবা জিহরী হোক। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সমধিক জ্ঞাত। ‘যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন নীরবে শ্রবণ কর’ অর্থাৎ ফরয নামাযে যখন কিরআত পাঠ করা হয় তখন চুপচাপ হয়ে শ্রবণ কর।

ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ ইবনে কারীয (রাঃ) বলেনঃ “আমি একদা উবাইদুল্লাহ ইবনে উমাইর (রাঃ) এবং আতা’ ইবনে রাবাহ (রাঃ)-কে পরস্পর কথাবার্তা বলতে শুনি। অথচ সেই সময় অন্য দিকে ওয়ায হচ্ছিল। তখন আমি তাদেরকে বললামঃ আল্লাহর যিকির হচ্ছে অথচ আপনারা শুনছেন না কেন? আপনারা তো শাস্তির যোগ্য হয়ে গেছেন! তখন তারা আমার দিকে ঘুরে তাকালেন এবং পুনরায় কথা বলতে শুরু করলেন। আমি আবার তাদেরকে সতর্ক করলাম। তারা এবারও আমার দিকে তাকালেন এবং পরস্পর কথা বলতেই থাকলেন। আমি তৃতীয়বার আমার কথার পুনরাবৃত্তি করলাম। তখন তারা বললেনঃ “এটা হচ্ছে নামায সম্পৰ্কীয় নির্দেশ যে, নামাযে ইমাম যখন কুরআন পাঠ করেন তখন মুকতাদীকে নীরব হয়ে শুনতে হবে। তাদেরকে পড়তে হবে না।”

মুজাহিদ (রঃ) এবং আরও কয়েকজন বর্ণনাকারীও কুরআনের এই হুকুমের ব্যাপারে এ কথাই বলেন। তারা বলেন যে, কেউ যদি নামাযের মধ্যে না থাকে এবং কুরআন পাঠ হয় তবে তার কথা বলায় কোন দোষ নেই। যায়েদ ইবনে আসলামও (রঃ) এই ভাবই নিয়েছেন। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এই হুকুম নামায এবং জুমআর দিনের খাবার সাথে সম্পর্কযুক্ত। ইবনে জুবাইর (রঃ) বলেন যে, এটা ঈদুল আযহা, ঈদুল ফিত্র, জুমআর দিনের খুৎবা এবং জিহরী নামাযের সাথে সম্পর্কযুক্ত। জিহরী ছাড়া অন্য নামাযের সাথে এটা সম্পর্কযুক্ত নয়। ইবনে জারীরও (রঃ) এটাই অবলম্বন করেছেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে নামাযে ও খুৎবায় চুপ থাকা। আর এ হুকুমই হচ্ছে- তোমরা খুৎবায় ও ইমামের পিছনে নীরব থকি। হাদীসে হুবহু এই হুকুমই এসেছে। মুজাহিদ (রঃ) এটা খুবই খারাপ মনে করতেন যে, ইমাম যখন কোন ভয়ের বা রহমতের আয়াত পাঠ করেন তখন মুকতাদীরা কিছু বলতে শুরু করে দেয়। এটা ঠিক নয়, বরং মুকতাদীর উচিত হবে নীরব থাকা। ভয় এবং আশার আবেগে মুখে কোন কথা উচ্চারণ করা উচিত নয়। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কুরআনের কোন আয়াত নীরব হয়ে শ্রবণ করে তার জন্যে দ্বিগুণ সওয়াব লিখা হয়। আর যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে, কিয়ামতের দিন এই কুরআন তার জন্যে নূর বা আলো হবে।

কাতাদা (রহঃ) আরো একটু অতিরিক্ত বর্ণনা করেছেন যে, “ইমাম যখন কিরা’আত পড়বে তখন তোমরা চুপ থাকবে।” আবূ কামিল (রহঃ) আবূ আওয়ানা (রহঃ) থেকে যে রিওয়াত করেছেন সেটিতে ছাড়া আর কারো বর্ণনায় এ বাক্যটি নেই যে, কারণ আল্লাহ তাআলা তার নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যবানীতে বলেছেন, যে তার প্রশংসা করে তিনি তা শোনেন। (উপরের সবটুকু আলোচনা ইবনে তাফসিরে ইবনে কাসির থেকে নেয়া হয়েছে)।

এই সম্পর্কে কয়েকটি হাদিসের দিকে একটু খেয়াল করুনঃ

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অনুসরণ করার জন্যই তো ইমাম নিযুক্ত করা হয়। সুতরাং ইমাম যখন তাকবীর বলেন, তোমরাও তাকবীর বলো। যখন তিনি কিরাআত পড়েন তখন তোমরা নীরব থাকো। যখন তিনি গাইরিল মাগযূবি আলাইহিম ওয়ালায-যুআলীন বলেন, তখন তোমরা আমীন বলো। যখন তিনি রুকূ করেন, তখন তোমরাও রুকূ করো। আর যখন তিনি সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ বলেন, তখন তোমরা আল্লাহুম্মা রাববানা ওয়ালাকাল হামদ বলো। যখন তিনি সাজদাহ করেন, তখন তোমরাও সাজদাহ করো। তিনি বসা অবস্থায় সালাত পড়লে তোমরাও সকলে বসা অবস্থায় সালাত পড়ো। (হাদিসটি নেয়া হয়েছে ইবনে মাজাহ থেকে হাদিস নম্বর ৮৪৬, নাসায়ী ৯২১-২২, আবূ দাঊদ ৬০৩, আহমাদ ৭১০৪, দারিমী ১৩১১, তাহক্বীক্ব আলবানী: হাসান সহীহ। তাখরীজ আলবানী: মিশকাত ৮৫৭)।

আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ইমামের কিরাআাত পাঠের সময় তোমরা নীরব থাকবে। তিনি তাশাহ্হুদ পাঠের জন্য বসলে তোমাদের যে কোন মুসল্লীর প্রথম যিকির যেন হয় তাশাহ্হুদ। (হাদিসটি নেয়া হয়েছে ইবনে মাজাহ থেকে হাদিস নম্বর ৮৪৭, আবূ দাঊদ ৯৭২, আহমাদ ১৯০১০, দারিমী ১৩১২, তাহক্বীক্ব আলবানী: সহীহ। তাখরীজ আলবানী মিশকাত ২৬৩।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে সালাত পড়লেন উপরোক্ত হাদীসের অনুরূপ। এই বর্ণনায় আরো আছেঃ যে সালাতে ইমাম সশব্দে কিরাআত পড়েন, তখন থেকে সেই সালাতে তারা কিরাআত পাঠ ত্যাগ করেন। (হাদিসটি নেয়া হয়েছে ইবনে মাজাহ থেকে হাদিস নম্বর ৮৪৭, তিরমিযী ৩১২, নাসায়ী ৯১৯, আবূ দাঊদ ৮২৬, আহমাদ ৭২২৮, মুওয়াত্ত্বা মালিক ১৯৪, তাহক্বীক্ব আলবানী সহিহ)।

ইসহাক (ইমাম মূসলিমের ছাত্র) বলেন, আবূ নযর-এর ভাগিনা আবূ বাকর (রহঃ) এ রিওয়াত সম্পর্কে আলোচনা করলেন। ইমাম মুসলিম (রহঃ) বললেন, তুমি কি কাউকে সুলায়মান থেকে বেশী স্মরণ শক্তি সম্পন্ন বলে মনে কর? আবূ বাকর (রহঃ) বললেন, তাহলে আবূ হুরায়রা (রাঃ) এর হাদীস? অর্থাৎ ইমাম যখন কিরা’আত পড়ে তখন তোমরা চুপ থাক” (এটার কি হবে?) তিনি বললেন, এটা আমার কাছে সহীহ। আবূ বাকর বললেন, তাহলে সেটা আপনি এখানে কেন আনলেন না? তিনি জবাব দিলেন, আমি সব সহীহ হাদীসই এখানে আনছি না বরং এখানে কেবল সেগুলোই আনছি যার উপর মুহাদ্দিসগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ৭৯০ ইফাঃ)

এর পক্ষে দুটি যুক্তিঃ

১। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইমাম যখন ‘আমীন’ বলেন, তখন তোমারও ‘আমীন’ বলো। কেননা, যারা ‘আমীন’ (বলা) ও ফিরিশতাদের ‘আমীন’ (বলা) এক হয়, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ‘আমীন’ বলতেন। (সহিহ বুখারী ৭৪৪ ইফাঃ, সুনানে আবু দাউদ ৯৩৬)।

মন্তব্যঃ হাদীসটিতে বলা হয়েছে, সালাতে কুরআন পাঠকারী (ইমাম) যখন আমীন বলবে, তোমরাও তখন আমীন বলবে। কেননা ফেরেশতাগণও আমীন বলে থাকে। সালাতে কুরআন পাঠ করা ইমামেরই কর্তব্য। যদি ইমাম ও মুকতাদী সবার জন্য কুরআন পাঠের বিধান থাকতো তবে শুধু ইমামকে এ বিশেষণে উল্লেখ করা হতো না।

২। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইমাম গয়রিল মাগদুবি আলাইহিম ওলাদ-দোয়াল-লীন (غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ) পড়লে তোমরা ‘আমীন’ বলো। কেননা, যার এ (আমীন) বলা ফিরিশতাদের (আমীন) বলার সাথে একই সময় হয়, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।(সহিহ বুখারী ৭৪৬ ইফাঃ)।

ওয়াইল ইবনে হুজর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “ওয়ালাদ্দল্লীন” পাঠ করার পর জোরে “আমীন” বলতেন। (সুনানে আবু দাউদ ৯৩২, সুনানে তিরমিযী, সুনানে ইবনে মাজাহ)।

মন্তব্যঃ মুকতাদী সূরা ফাতেহা পাঠে ব্যস্ত থাকলে ইমাম ফাতিহা শেষ করার সাথে সাথে আমিন বলাটা কঠিন হয়ে যাবে।  ফলে যথাসময়ে আমীন বলাও হয়ে উঠবে না। সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিকে মুকতাদীকে ইমামের “গয়রিল মাগদুবি আলাইহিম ওলাদ-দোয়াল-লীন” বলার প্রতি খেয়াল রাখতে বলবেন, অপরদিকে সূরা ফাতেহা পাঠের আদেশ দিয়ে তাকে ব্যস্ত করে রাখবেন, এমনটা হতে পারে না।

হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী রহ. তার ফাতহুল বারী গ্রন্থে লিখেছেনঃ মুকতাদিকে যখন ইমামের কেরাত মনোযোগ দিয়ে শুনতে বলা হলো এবং ইমামের ফাতেহা পাঠ শেষে তার দোয়ার উপর আমীন বলতে নির্দেশ দেওয়া হলো, এতে প্রমাণিত হলো যে, মুকতাদির উপর কেরাত পড়ার দায়িত্ব নেই।

কেননা সে যখন মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করলো এবং তার দোয়ার উপর আমীন বললো, তখন ধরে নিতে হবে যে, সে নিজেও দোয়া করলো। যেমন পূর্বসূরিগণের অনেকেই বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যে মূসা ও হারূন আলাইহিমাস সালামকে বলেছেন: তোমাদের দু’জনের দোয়াই কবুল করা হলো, তাঁরা বলেছেন, আসলে মূসা আ.ই দোয়া করেছিলেন, আর হারূন আ. আমীন আমীন বলেছিলেন। এতদসত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা দুজনকেই দোয়াকারী আখ্যা দিয়েছেন। (ফাতহুল বারী ৪/২২৭)

মন্তব্যঃ যারা দাবি করে, স্বরব সালাতে ফাতিহা শুনবে আর নীরব সালাতে ফাতিহা পড়বে। তাদের দাবি ও দলীল দুটিই মজবুদ কাজেই এইভাবে আমলকারী মুসল্লীদের সালাত হবে না, এমনটি বলার কোন অবকাশ নাই। যারা এই নিয়মে সালাত আদায় কবরে তারা সঠিক দলীলের উপর আছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে।

 

১৭। স্বরব এবং নীরব সকল সালাতে ফাতিহা পড়া ওয়াজিবঃ

স্বরব, নীরব সকল নামাযে ইমাম, মুক্তাদী, একাকী সবার জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য।

উবাদা ইবনু সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি সালাতে সূরা ফাতিহা পড়ল না তার সালাত হল না। (সহিহ বুখারী ৭২০ ইফাঃ)

উবাদা ইবনু সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি ফতিহাতুল কিতাব (সূরা ফাতিহা)পাঠ করবে না তাঁর সালাত হবে না। (সুনানে তিরমিজি ২৪৭ ইফাঃ)। 

উবাদাহ ইবনু সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যাক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করেনি, তার সালাত হয়নি। (ইবনে মাযাহ ৮৩৭)

উবাদা ইবনু সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, যে ফাতিহাতুল কিতাব পাঠ করবে না তার (পরিপূর্ণ) সালাত হবে না। (সহিহ মুসলিম ৭৬০ ইফাঃ)

নোটঃ সহিহ মুসলিম ইফাঃ এর পরের ৭৬১, ৭৬২, ৭৬৩, ৭৬৫, ৭৬৬, ৭৬৭, ৭৬৮ এবং ৭৬৯ নম্বর হাদিসে এই একই বিষয়ে হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যাক্তি সালাত আদায় করল, তাতে উম্মুল কুরআন পাঠ করল না সে সালাত হবে অসম্পূর্ণ। তিনি তিনবার এটা বললেন। অতঃপর আবূ হুরায়রা (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হল, আমরা তো ইমামের পেছনে থাকি (তখনো কি ফাতিহা পড়ব?) তিনি বললেন, তখন মনে মনে তা পড়। কারণ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমি সালাতকে আমার ও আমার বান্দার মধ্যে অর্ধেক করে ভাগ করেছি। আর বান্দা যা চাইবে তা সে পাবে।

অতঃপর বান্দা যখন বলে,  الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই প্রাপ্য); আল্লাহ তা’আলা এর জবাবে বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে।

সে যখন বলে, الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ (তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু); আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার বান্দা আমার গুনাবলী বর্ণনা করেছে, গুণগান করেছে।

অতঃপর সে যখন বলে, مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ‏ (কর্মফল দিবসের মালিক), তিনি বলেন, আমার বান্দা আমার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছে। আর কখনো বলেছেন, আমার বান্দা  (তার সব কাজ) আমার উপর সোপর্দ করেছে।

সে যখন বলে, إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ (আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি); তিনি বলেন- এটা আমার এবং আমার বান্দার মধ্যকার ব্যাপার। আমার বান্দা যা চাইবে তা সে পাবে।

যখন সে বলে, اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ * صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ‏ (আমাদের সরল পথ প্রদর্শন কর, তাদের পথে যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছ, যারা ক্রোধ নিপতিত নয়, পথভ্রষ্টও নয়); তখন তিনি বলেন, এটা কেবল আমার বান্দার জন্য। আমার বান্দা যা চায় তা সে পাবে।

সুফিয়ান বলেন, আলা ইবনু আবদুর রহমান ইবনু ইয়া‘কুব (রহঃ) আমার কাছে তখন বর্ণনা করেন যখন তিনি বাড়ীতে অসুস্থ ছিলেন। আমি (শুশ্রূষার জন্য) তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। অতঃপর এ সম্পর্কে তার কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম। (সহিহ মুসলিম ৭৬৪ ইফাঃ থেকে নেয়া হাদিসটি আরও আছে আবু দাউদ ৮২১ ইফাঃ, তিরমিজি ২৯৫৩ ইফাঃ, সুনানে নাসাঈ-৯১২)।

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যাক্তি কোন সালাত পড়লো এবং তাতে উম্মুল কুরআন (সূরাহ ফাতিহা) পড়েনি তার সালাত অসম্পূর্ণ। আবূস সাইব (রহঃ) বলেন, আমি বললাম, হে আবূ হুরাইরাহ! আমি কখনো কখনো ইমামের সাথে সালাত পড়ি। তিনি আমার বাহুতে খোঁচা দিয়ে বলেন, হে ফারিসী! তুমি তা মনে মনে পড়ো। (ইবনে মাযাহ ৮৩৮, এমনিভাবে ইবনে মাযাহ এর ৮৩৯, ৮৪০ এবং  ৮৪১ নম্বর হাদিসও সুরা ফাতিহা পড়ার কথা উল্লেখ আছে)

উবাদা ইবনুস সামেত (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামায পড়লেন। কিন্তু কুরআন পাঠ তাঁর নিকট কঠিন অনুভূত হলো। নামাযশেষে তিনি বলেনঃ নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে তোমাদের ইমামের পিছনে কুরআন পাঠ করতে দেখেছি। রাবী বলেন, আমরা বললাম, হাঁ, আল্লাহর শপথ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বলেন, তা করো না, অবশ্যই উম্মুল কুরআন (সূরা আল-ফাতিহা) পড়ো। কেননা যে ব্যক্তি সূরা আল-ফাতিহা পড়ে না, তার নামায হয় না। এই সনদসূত্র হাসান (উত্তম)। (সুনান আদ দারাকুতনী ১১৮৬ এর পর এই একই বিষয় ১১৮৭ থেকে ১১৯৯ হাদিস বর্ণিত হয়েছে)

স্বরব, নীরব সকল নামাযে ইমাম, মুক্তাদী, একাকী সবার জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব। এমই মতই বেশী শক্তিশালী ও সমধীক গ্রহন যোগ্য। তবে মাসবূক যদি ইমামের রুকূর সময় নামাযে শামিল হয়, তবে সূরা ফাতিহা পাঠ করা রহিত হয়ে যাবে। একথার দলীল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস।

হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ যে ব্যক্তি নামাযের রুকু পেয়ে যায় ইমাম তার পিঠ সোজা করার পূর্বে, সে ব্যক্তি উক্ত রাকাত পেয়ে গেল। (সুনানে বায়হাকী কুবরা ২৪০৮, সুনানে দারা কুতনী ১৩২৯, সহীহ ইবনে খুজাইমা)

হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ইমামকে রুকু অবস্থায় পাবে, তারপর সে ইমাম মাথা উঠানোর আগে তার সাথে রুকু করে, তাহলে উক্ত রাকাত পেয়ে গেছে। (সুনানে বায়হাকী কুবরা ২৪১৩)

হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি ইমামের সাথে রুকু পায়নি, সে উক্ত রাকাত পায়নি (সুনানে বায়হাকী কুবরা ২৪১১)

হযরত জায়েব বিন ওহাব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি একদা আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ এর সাথে তাঁর ঘরে থেকে মসজিদের দিকে বের হলাম। তারপর যখন আমরা মসজিদের মাঝে পৌঁছলাম তখন ইমাম রুকু করে ফেলে। তখন আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ তাকবীর বলে রুকু করলেন। আর আমিও তার সাথে রুকু করলাম। তারপর আমরা রুকু অবস্থায় চলতে লাগলাম। অবশেষে আমরা মুসুল্লিদের মাথা উঠানোর সময় কাতারের সাথে মিলিত হলাম। তারপর যখন ইমাম সাহেব নামায শেষ করল। আমি দাঁড়ালাম। কারণ আমার ধারণা ছিল আমি [এক] রাকাত পায়নি। তখন আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। তারপর বললেনঃ তুমিতো রাকাত পেয়েছো। (সুনানে বায়হাকী কুবরা ২৬৯০,২৪১৮, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২৬৩৭)

আবূ কাতাদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমরা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করছিলাম। হঠাৎ তিনি লোকদের (আগমনের) আওয়াজ শুনতে পেলেন। সালাত শেষে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তোমাদের কি হয়েছিল? তারা বললেন, আমরা সালাতের জন্য তাড়াহুড়া করে আসছিলাম।নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এরূপ করবে না। যখন সালাতে আসবে ধীরস্থিরভাবে আসবে (ইমামের সাথে) যতটুকু পাও আদায় করবে, আর যতটুকু ফাওত হয়ে যায় তা (ইমামের সালাম ফেরানোর পর) পূরা করে নিবে। (সহিহ বুখারি ৬০৭ ইফাঃ)

উপরের হাদিসের আলোকে বলা যায় মাসবূকের জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা রহিত হয়ে যায়।  মাসবূকের সূরা ফাতিহা পাঠ রহিত হওয়ার যুক্তিগত কারন হলো, মাসবূক তো কিরআত পাঠ করার জন্য দাঁড়ানোর সুযোগই পায়নি। অতএব সুযোগ না পেলে তার আবশ্যকতাও রহিত হয়ে যাবে। যেমন হাত কাটা ব্যক্তি ওযু করার সময় তার হাতের কাটা অংশের পরিবর্তে বাহু ধৌত করবে না। বরং ধৌত করার স্থান উপস্থিত না থাকার কারণে এ ফরয রহিত হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ইমামকে রুকূ অবস্থায় পেল তার জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা রহিত হয়ে যাবে। কেননা ক্বিরআত পাঠ করার জন্য দন্ডায়মান হওয়ার সুযোগই সে পায়নি। আর ইমামের অনুসরণ করতে গিয়ে এখানে দন্ডায়মান হওয়াও রহিত হয়ে যাবে।

মন্তব্যঃ উপরের চারটি মতামত নিয়ে গবেষনা করতে গিয়ে অনেক হাদিস পড়াশুনা করতে হয়েছে। অনেক মুজতাহীদ আলেমের গবেষনাও পড়েছি। আমার কাছে শেষের মতটিই বেশী কুরআন সুন্নাহর নিকটবর্তী মনে হয়েছে। যে মতটি আমদের বর্তমান যুগের সালাফি আলেমগন বলে থাকে। আর আমদের উপমহাদেশের অধিকাংশ আলেম মনে করে থাকেন, একাকী সালাতে ফাতিহা পাঠ ওয়াজিব হলেও ইমামের পিছনে পাঠ করা ওয়াজিব নয়। তাদের এই মতটিও সঠিক। কাজেই নিজের মতটি অধিক সঠিক বলে, এই মতভেদ পূর্ণ মাসায়েল নিয়ে মতবিরোধ করা ঠিক হবে না। যুগ যুগ ধরে আমাদের সালাফদের মাঝে এই বিষয় নিয়ে মতভেদ ছিল। তারা একটির উপর অন্যটিকে প্রধান্য দিয়েছেন কিন্তু অন্যদের মতামত বাতিল বলেন নাই। আমরাও তাদের অনুসরণ করব। সীমা লঙ্ঘন করব না।

১৮ফাতিহার পর আমির বলাঃ

সালাতে ফাতিহার পর আমির বলা নিয়ে কোন প্রকার মতভেদ আছে বলে জানা যায় না। তবে আমিন জোরে হবে, না আস্ত হবে এই নিয়ে মতবিরোধ চরমে। প্রায় প্রতিটি হাদিস গ্রন্থে আমিন বলা সংক্রান্ত হাদিস এসেছে। কোথাও স্বশব্দে আবার কোথাও শুধু আমিন বলা সম্পর্কে। কিন্তু আমিল আস্তে বা মনে মনে বলতে হবে এমন কোন হাদিস নেই। যেমন জগত শ্রেষ্ট দুটি সহিহ হাদিসের গ্রন্থ সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমের হাদিসটি একটু লক্ষ করুন। 

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইমাম যখন ‘আমীন’ বলেন, তখন তোমারও ‘আমীন’ বলো। কেননা, যারা ‘আমীন’ (বলা) ও ফিরিশতাদের ‘আমীন’ (বলা) এক হয়, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। ইবনু শিহাব (রহঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ‘আমীন’ বলতেন। (হাদিসটি সহিহ বুখারী ৭৪৪ ইফাঃ থেকে নেয়া আরও আছে সহিহ মুসলিম ৮০০ ও ৮০২ ইফাঃ, সুনানে আবু দাউদ ৯৩৬, সুনানে তিরমিজী ২৪৮, নাসাঈ ৯২৮ ইফাঃ)।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইমাম গয়রিল মাগদুবি আলাইহিম ওলাদ-দোয়াল-লীন (غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ) পড়লে তোমরা ‘আমীন’ বলো। কেননা, যার এ (আমীন) বলা ফিরিশতাদের (আমীন) বলার সাথে একই সময় হয়, তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।(সহিহ বুখারী ৭৪৬ ইফাঃ, সহিহ মুসলিম ৭৯৮ ইফাঃ)।

এই হাদিস দুটিই সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম থেকে সংকলিত। দেখুন এখানে কেউ হাদিস দুটি পড়লে বুঝতে পারবে না যে, আমিন কি সশব্দে না নিঃশব্দে বলতে হবে। এর উপর কিয়াস করে অনেক আলেম বলেন থাকেন আমিন বলেত হবে একথা ঠিক কিন্তু সশব্দের কথা নাই তাই সালাতে আমিন আস্তে বললেও চলবে। কিন্তু সহিহ বুখারির শিরোনাম নাম ও এর পরের টিকা দেখুন যা স্বয়ং ইমাম বুখারী লিখেছেন। পরিচ্ছেদঃ ৫০২. ইমামের সশব্দেআমীনবলা এর পর তিনি লিখেনঃ

আতা (রহঃ) বলেন, ‘আমীন’ হল দু’আ। তিনি আরও বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবন যুবাইর (রাঃ) ও তাঁর পিছনের মুসুল্লীগণ এমনভাবে ‘আমীন’ বলতেন যে, মসজিদ গুমগুম আওয়ায হতো। আবূ হুরায়রা (রাঃ) ইমামকে ডেকে বলতেন, আমাকে ‘আমীন’ বলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন না। নাফি’ (রহঃ) বলেন, ইবন উমর (রাঃ) কখনই ‘আমীন’ বলা ছাড়তেন না এবং তিনি তাদের (আমীন বলার জন্য) উৎসাহিত করতেন। আমি তাঁর কাছ থেকে এ সম্পর্কে হাদীস শুনেছি।

যা হোক অন্তত সহিহ বুখারির হাদিস নিয়ে কিয়াস করার সুযোগ নেই যে, আমিন সশব্দে না নিঃশব্দে বলতে হবে। যেখানে ইমাম বুখারী উল্লেখ করেছেন আমিন সশব্দে বলার অধ্যায় সেখানে আমরা তার উল্লেখিত হাদিস দ্বারা ভিন্ন কিছু কিয়াস করা ঠিক হবে না। অর্থাৎ সহিহ বুখারীর মতে আমিন হবে সশব্দে। এই একই হাদিস সহিহ মুসলিমে এসেছে কাজেই আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।

১৯। সশব্দে আমিন বলাঃ

১। ওয়াইল ইবনে হুজর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “ওয়ালাদ-দল্লীন” পাঠ করার পর জোরে “আমীন” বলতেন। (সুনানে আবু দাউদ ৯৩২)

২। ওয়াইল ইবনে হুজর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিছনে নামায আদায় করা কালে তিনি উচ্চ স্বরে আমীন বলেন এবং (নামায শেষে) ডান ও বাম দিকে সালাম ফিরান এভাবে যে, আমি তাঁর গণ্ডদেশের সাদা অংশ পরিষ্কারভাবে দেখি। (সুনানে আবু দাউদ ৯৩)।

৩। ওয়াইল ইবনু হুজর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা কেনন যে, তিনি বলেন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ( غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ ) পাঠের পর আমীন বলতে শুনেছি। আর তিনি দীর্ঘস্বরে তা পাঠ করেছেন। (সুনানে তিরমিজী ২৪৮)

৪। ওয়ায়িল (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পেছনে সালাত আদায় করেছি। যখন তিনি সালাত আরম্ভ করতেন তখন তাকবীর বলতেন এবং তাঁর উভয় হাত দু’কান পর্যন্ত তুলতেন। এরপর সূরা ফাতিহা পাঠ করা আরম্ভ করতেন।আর তা শেষ করে “আমীন” বলতেন এবং তা বলার সময় তার স্বর উচু করতেন। (সুনানে নাসাঈ ৮৮২ ইফাঃ)

৫। আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ইয়াহূদীরা তোমাদের কোন ব্যাপারে এত বেশি ঈর্ষান্বিত নয় যতটা তারা তোমাদের সালাম ও আমীনের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত। (ইবনে মাজাহ ৮৫৬)

৬। ওয়ায়িল ইবনু হূজর (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি সলাতে ‘‘গয়রিল মাগযূবিআলায়হিম ওয়ালায্ যোয়াল্লীন’’ পড়ার পর সশব্দে ‘আমীন’ বলেছেন। (মিশকাতুল মাসাবিহ ৮৪৫)।

৭। ওয়ায়িল ইবনু হুজর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠ করলেন, [“ওয়ালাদ্দ্ব-ল্লীন।” (ফাতিহা: ৭)] তখন বললেন, “আমীন”। আর এতে তিনি তাঁর কন্ঠস্বর উচ্চ করলেন। (সুনান আদ দামেরী ১৩৭৯)

মন্তব্যঃ প্রায় সকল হাদিসের গ্রন্থে আমিন সশব্দে বলা সম্পর্কিত হাদিস বিদ্যমান। তাই আমিন যে সশব্দে বলতে হবে এতে কোন প্রকার দিধা থাকার কথা নয়। কিছু হাদিস এমন আছে যার দ্বারা সশব্দে বা নিঃশব্দ কোনটাই নির্দেশ করে না, তার উপর ভিত্তি করে অনেক মুজতাহীদ আলেম আমিন আস্তে বলার পক্ষে মত প্রদান করেছেন। সালাতে আমিন বলা মুলত একটি সুন্নাহ ইবাদাত। ইহার পড়লে সওয়াব আছে কিন্তু না পড়লে তার সালাত হবে না, এমন কথা কোন আলেম বলেন নাই। অনেকে আমিন বলা কে মুস্তাহাব আমলও বলেছেন। কাজেই আমিন বলা সুন্নাহ কিন্তু জোরে বলা এবং আস্তে বলা নিয়ে মতবিরোধ করে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা হারাম। 

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment