আশুরা এবং ইহার ভুলভ্রান্তি

আশুরা এবং ইহার ভুলভ্রান্তি দ্বিতীয় কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

১২। কারবালার প্রান্তের প্রকৃত ঘটনাঃ

৬০ হিজরিতে ইরাকবাসীদের নিকট সংবাদ পৌঁছল যে, হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু ইয়াযীদ ইবন মুয়াবিয়ার হাতে বাইআত করেন নি। তারা তাঁর নিকট চিঠি-পত্র পাঠিয়ে জানিয়ে দিল যে ইরাকবাসীরা তাঁর হাতে খেলাফতের বাইআত করতে আগ্রহী। ইয়াযীদকে তারা সমর্থন করেন না বলেও সাফ জানিয়ে দিল। তারা আরও বলল যে, ইরাকবাসীরা ইয়াযীদের পিতা মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতিও মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। চিঠির পর চিঠি আসতে লাগল। এভাবে পাঁচ শতাধিক চিঠি হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এসে জমা হল। প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার জন্য হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম ইবন আকীলকে পাঠালেন। মুসলিম কুফায় গিয়ে পৌঁছলেন। গিয়ে দেখলেন, আসলেই লোকেরা হুসাইনকে চাচ্ছে। লোকেরা মুসলিমের হাতেই হুসাইনের পক্ষে বাই‘আত নেওয়া শুরু করল। হানী ইবন ‘উরওয়ার ঘরে বাই‘আত সম্পন্ন হল।

সিরিয়াতে ইয়াযীদের নিকট এই খবর পৌঁছা মাত্র বসরার গভর্নর উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য পাঠালেন। ইয়াযীদ উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদকে আদেশ দিলেন যে, তিনি যেন কুফাবাসীকে তার বিরুদ্ধে হুসাইনের সাথে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেন। সে হুসাইনকে হত্যা করার আদেশ দেন নি।

উবাইদুল্লাহ কুফায় গিয়ে পৌঁছলেন। তিনি বিষয়টি তদন্ত করতে লাগলেন এবং মানুষকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। পরিশেষে তিনি নিশ্চিত হলেন যে, হানী ইবন ‘উরওয়ার ঘরে হুসাইনের পক্ষে বাই‘আত নেওয়া হচ্ছে।

অতঃপর মুসলিম ইবন আকীল চার হাজার সমর্থক নিয়ে অগ্রসর হয়ে দ্বিপ্রহরের সময় উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করলেন। এ সময় উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদ দাঁড়িয়ে এক ভাষণ দিলেন। তাতে তিনি ইয়াযীদের সেনাবাহিনীর ভয় দেখালেন। তিনি এমন ভীতি প্রদর্শন করলেন যে, লোকেরা ইয়াযীদের ধরপাকড় এবং শাস্তির ভয়ে আস্তে আস্তে পলায়ন করতে শুরু করল। ইয়াযীদের ভয়ে কুফাবাসীদের পলায়ন ও বিশ্বাস ঘাতকতার লোমহর্ষক ঘটনা জানতে চাইলে পাঠকদের প্রতি ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ কর্তৃক রচিত ‘মিনহাজুস সুন্নাহ’ বইটি পড়ার অনুরোধ রইল। যাই হোক, কুফাবাসীদের চার হাজার লোক পালাতে পালাতে এক পর্যায়ে মুসলিম ইবন আকীলের সাথে মাত্র তিন জন লোক অবশিষ্ট রইল। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মুসলিম ইবন আকীল দেখলেন, হুসাইন প্রেমিক আল্লাহর একজন বান্দাও তার সাথে অবশিষ্ট নেই। এবার তাকে গ্রেপ্তার করা হল। উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদ তাকে হত্যার আদেশ দিলেন। মুসলিম ইবন আকীল উবাইদুল্লাহর নিকট আবেদন করলেন, তাকে যেন হুসাইনের নিকট একটি চিঠি পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়। এতে উবাইদুল্লাহ রাজী হলেন। চিঠির সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ছিল এ রকম:

“হুসাইন! পরিবার-পরিজন নিয়ে ফেরত যাও। কুফাবাসীদের ধোঁকায় পড়ো না। কেননা তারা তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে। আমার সাথেও তারা সত্য বলে নি। আমার দেওয়া এই তথ্য মিথ্যা নয়।”

অতঃপর যুলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ আরাফা দিবসে উবাইদুল্লাহ মুসলিমকে হত্যার আদেশ প্রদান করেন। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, মুসলিম ইবন ‘আকীল ইতোপূর্বে কুফাবাসীদের ওয়াদার উপর ভিত্তি করে হুসাইনকে আগমনের জন্য চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠির উপর ভিত্তি করে যুলহাজ্জ মাসের ৮ তারিখে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। অনেক সাহাবী তাঁকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন। তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আব্দুল্লাহ ইবন আমর এবং তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফীয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ইবনে উমর হুসাইনকে লক্ষ্য করে বলেন: হুসাইন! আমি তোমাকে একটি হাদীছ শুনাব। জিবরীল আলাইহিস সালাম আগমন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়া এবং আখিরাত- এ দুটি থেকে যে কোনো একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি দুনিয়া বাদ দিয়ে আখিরাতকে বেছে নিয়েছেন। আর তুমি তাঁর অংশ। আল্লাহর শপথ! তোমাদের কেউ কখনই দুনিয়ার সম্পদ লাভে সক্ষম হবেন না। তোমাদের ভালোর জন্যই আল্লাহ তোমাদেরকে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন।

হুসাইন তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং যাত্রা বাদ দিতে অস্বীকার করলেন। অতঃপর ইবনে উমর হুসাইনের সাথে আলিঙ্গন করে বিদায় দিলেন এবং ক্রন্দন করলেন। সুফিয়ান ছাওরী ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হুসাইনকে বলেছেন: মানুষের দোষারোপের ভয় না থাকলে আমি তোমার ঘাড়ে ধরে বিরত রাখতাম।

ইরাকের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু হুসাইনকে বলেছেন: হোসাইন! কোথায় যাও? এমন লোকদের কাছে, যারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছে এবং তোমার ভাইকে আঘাত করেছে?

আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, হুসাইন তাঁর জন্য নির্ধারিত ফয়সালার দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছেন। আল্লাহর শপথ! তাঁর বের হওয়ার সময় আমি যদি উপস্থিত থাকতাম, তাহলে কখনই তাকে যেতে দিতাম না। তবে বল প্রয়োগ করে আমাকে পরাজিত করলে সে কথা ভিন্ন। (ইয়াহ্-ইয়া ইবনে মাঈন সহীস সূত্রে বর্ণনা করেছেন)

যাত্রা পথে হুসাইনের কাছে মুসলিমের সেই চিঠি এসে পৌঁছল। চিঠির বিষয় অবগত হয়ে তিনি কুফার পথ পরিহার করে ইয়াযীদের কাছে যাওয়ার জন্য সিরিয়ার পথে অগ্রসর হতে থাকলেন। পথিমধ্যে ইয়াযীদের সৈন্যরা ‘আমর ইবন সা‘দ, শামির ইবন যুল জাওশান এবং হুসাইন ইবন তামীমের নেতৃত্বে কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের গতিরোধ করল। হুসাইন সেখানে অবতরণ করে আল্লাহর দোহাই দিয়ে এবং ইসলামের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনটি প্রস্তাবের যে কোনো একটি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহবান জানালেন।

হুসাইন ইবন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং রাসূলের দৌহিত্রকে ইয়াযীদের দরবারে যেতে দেওয়া হোক। তিনি সেখানে গিয়ে ইয়াযীদের হাতে বাই‘আত গ্রহণ করবেন। কেননা তিনি জানতেন যে, ইয়াযীদ তাঁকে হত্যা করতে চান না। অথবা তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেওয়া হোক।  অথবা তাঁকে কোনো ইসলামী অঞ্চলের সীমান্তের দিকে চলে যেতে দেওয়া হোক। সেখানে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত বসবাস করবেন এবং রাজ্যের সীমানা পাহারা দেওয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। (ইবনে জারীর হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন)

ইয়াযীদের সৈন্যরা কোনো প্রস্তাবই মানতে রাজী হল না। তারা বলল: উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদ যেই ফয়সালা দিবেন আমরা তা ব্যতীত অন্য কোনো প্রস্তাব মানতে রাজী নই। এই কথা শুনে উবাইদুল্লাহর এক সেনাপতি (হুর ইবন ইয়াযীদ) বললেন: এরা তোমাদের কাছে যেই প্রস্তাব পেশ করছে তা কি তোমরা মানবে না? আল্লাহর কসম! তুর্কী এবং দায়লামের লোকেরাও যদি তোমাদের কাছে এই প্রার্থনাটি করত, তাহলে তা ফেরত দেওয়া তোমাদের জন্য বৈধ হত না। এরপরও তারা উবাইদুল্লাহর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেই দৃঢ়তা প্রদর্শন করল। সেই সেনাপতি ঘোড়া নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলেন এবং হুসাইন ও তাঁর সাথীদের দিকে গমন করলেন। হুসাইনের সাথীগণ ভাবলেন: তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে আসছেন। তিনি কাছে গিয়ে সালাম দিলেন। অতঃপর সেখান থেকে ফিরে এসে উবাইদুল্লাহর সৈনিকদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাদের দুইজনকে হত্যা করলেন। অতঃপর তিনিও নিহত হলেন। (ইবনে জারীর হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন)

সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে হুসাইনের সাথী ও ইয়াযীদের সৈনিকদের মধ্যে বিরাট ব্যবধান ছিল। হুসাইনের সামনেই তাঁর সকল সাথী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হলেন। অবশেষে তিনি ছাড়া আর কেউ জীবিত রইলেন না। তিনি ছিলেন সিংহের মত সাহসী বীর। কিন্তু সংখ্যাধিক্যের মুকাবিলায় তার পক্ষে ময়দানে টিকে থাকা সম্ভব হল না। কুফাবাসী প্রতিটি সৈনিকের কামনা ছিল সে ছাড়া অন্য কেউ হুসাইনকে হত্যা করে ফেলুক। যাতে তার হাত রাসূলের দৌহিত্রের রক্তে রঙ্গিন না হয়। পরিশেষে নিকৃষ্ট এক ব্যক্তি হুসাইনকে হত্যার জন্য উদ্যত হয়। তার নাম ছিল শামির ইবন যুল জাওশান। সে বর্শা দিয়ে হুসাইনের শরীরে আঘাত করে ধরাশায়ী করে ফেলল। অতঃপর ইয়াযীদ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে তিনি শাহাদাত অর্জনের সৌভাগ্য লাভ করেন। বলা হয় এই শামিরই হুসাইনের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কেউ কেই বলেন, সিনান ইবন আনাস আন্ নাখঈ নামক এক ব্যক্তি তাঁর মাথা দেহ থেকে আলাদা করে। আল্লাহই ভাল জানেন।

কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের সাথে আরও যারা নিহত হয়েছেনঃ

  • আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সন্তানদের মধ্যে থেকে আবু বকর,মুহাম্মাদ, উসমান, জাফর এবং আব্বাস।
  • হুসাইনের সন্তানদের মধ্যে হতে আবু বকর,উমর, উসমান, আলী আকবার এবং আব্দুল্লাহ।
  • হাসানের সন্তানদের মধ্যে হতে আবু বকর,উমর, আব্দুল্লাহ এবং কাসেম।
  • আকীলের সন্তানদের মধ্যে হতে জাফর,আব্দুর রাহমান এবং আব্দুল্লাহ ইবন মুসলিম ইবন আকীল।
  • আব্দুল্লাহ ইবন জা‘ফরের সন্তানদের মধ্যে হতে‘আউন এবং আব্দুল্লাহ। ইতোপূর্বে উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদের নির্দেশে মুসলিম ইবন আকীলকে হত্যা করা হয়। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হোন। আমীন

ফুরাত নদীর পানি পান করা থেকে বিরত রাখার কিচ্ছাঃ

বেশ কিছু গ্রন্থ হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর কে ফুরাত নদীর পানি পান করা থেকে বিরত রাখার ঘটনা বর্ণনা করে থাকে। আর বলা হয় যে, তিনি পানির পিপাসায় মারা যান। এ ছাড়াও আরও অনেক কথা বলে মানুষকে আবেগময় করে যুগে যুগে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে এবং মূল সত্যটি উপলব্ধি করতে তাদেরকে বিরত রাখার হীন ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এ সব কাল্পনিক গল্পের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। ঘটনার যতটুকু সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে আমাদের জন্য ততটুকুই যথেষ্ট। কোনো সন্দেহ নেই যে, কারবালার প্রান্তরে হুসাইন নিহত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

১৩। কারবালার ঘটনার সাথে আশুরার সম্পর্ক কি?

কারবালায় ইমাম হুসাইন (রাঃ) শাহাদাত বরনের সাথে আশুরার কোন সম্পর্ক নেই। আমরা হাদিসের আলোকে যে আশুরার করা বলেছি উহা রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওফাতের আগের ঘটনা। তিনি নিজে আশুরার ফজিলত ও গুরুত্ব সাহাবিদের সামনে তুলে ধরেছেন। মুছা আলাইহিস সালামে বিজয়ের শুকরিয়া স্বরুপ সিয়াম পালন করেছে। যেমন হাদিসে এসেছে,

ইবনু ‘আব্বাস  হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদীনায় গমন করার পর দেখলেন ইয়াহূদীরা ‘আশূরার দিন সিয়াম রাখে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এ দিনটার বৈশিষ্ট্য কি যে, তোমরা সিয়াম রাখো? তারা বলল, এটা একটি গুরুত্ববহ দিন। এ দিনে আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর জাতিকে মুক্তি দিয়েছেন। আর ফিরাউন ও তার জাতিকে (সমুদ্রে) ডুবিয়েছেন। মূসা  আলাইহিস সালাম শুকরিয়া হিসেবে এ দিন সিয়াম রেখেছেন। অতএব তাঁর অনুসরণে আমরাও রাখি। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ দীনের দিক দিয়ে আমরা মূসার বেশী নিকটে আর তার তরফ থেকে শুকরিয়া আদায়ের ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমরা বেশী হকদার। বস্তুত ‘আশূরার দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও সিয়াম রেখেছেন অন্যদেরকেও রাখার হুকুম দিয়েছেন। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-২০৬৭, বুখারী ১৮৭৮ ইফাঃ, মুসলিম ১১৩০, ইবনু মাজাহ ১৭৩৪, আহমাদ ৩১১২)।

অপর পক্ষ, শিয়ারা যে আশুরা কথা গুরুত্ব দিয়ে বলে থাকে তা এক নয়। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তেকালের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর হিজরী ৬১ সালে কারবালার ময়দানে জান্নাতী যুবকদের নেতা, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রিয় নাতী সাইয়েদুনা হুসাইন (রাঃ) শাহাদাত বরণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম উম্মাহর জন্য এটা একটা হৃদয় বিদারক ঘটনা। ঘটনাক্রমে এ মর্মান্তিক ইতিহাস এ আশুরার দিনে সংঘঠিত হয়েছিল। এটি ছিল উম্মতের ওপর নেমে আসা সবচে বড় বিপদগুলোর একটি।

আল্লামা ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ হুসাইনের রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু শাহাদতের ঘটনাটি মহা বিপদগুলোর একটি। কারণ, হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু এবং তাঁর আগে উসমান রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু-এর শহীদ হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়েই পরবর্তীতে উম্মতের ওপর নেমে এসেছে অনেক মহা দুর্যোগ। আর তাঁদের শহীদ করেছে আল্লাহর নিকৃষ্ট বান্দারা। (মাজমু ফাতাওয়া ৩/৪১১)।

মুসলিদের প্রতিটি আমল হতে হবে কুরআন সুন্নাহ মোতাবেগ। আশুরাকে কেন্দ্র করে যদি কোন আমল করতে হয়। তা হলে কুনআন সুন্নাহ থেকে দলীল নিতে হবে। কাজেই আমরা যে আশুরার কথা বললাম তার দলীল এ দিলাম। সহিহ হাদিসের এমন কোন গ্রন্থ নেই যেখানে আশুরার সিয়ামের কথা নেই। যদিও এই সিয়াম উম্মতের জন্য সুন্নাহ বা নফল কিন্তু কোন মুহাক্কিক আলেমই তার হাদিসের গ্রন্থে আশুরার বিষয়টি এড়িয়ে যান নাই। কিন্তু শীয়া সম্প্রদায় যে আশুরার কথা বলে তা সংঘটিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ইন্তেকালের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর হিজরী ৬১ সালে। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই এই পৃথিবীতে নাই। তাহলে আমলের হাদিসতো থাকার কথা নয়। যার কথায় বিনা বাক্যে ইবাদত করা যায় তিনি তো নেই। কারবালার এ দুঃখজনক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহবাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ), আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ), আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ), আনাস বিন মালেক (রাঃ), আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ), জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ), সাহল বিন সায়াদ (রাঃ), যায়েদ বিন আরকাম (রাঃ), সালামাতা ইবনুল আওকা (রাঃ), সহ বহু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। তারা তাদের পরবর্তী লোকদের চেয়ে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার পরিবারবর্গকে অনেক বেশী ভালবাসতেন। তারা আশুরার দিনে কারবালার ঘটনার স্নরণে কোন কিছুর প্রচলন করেননি। আমারা যে আশুরাকে সম্মান করি, যে আশুরায় সিয়াম পালন করি তারা কথা আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গিয়েছেন। এবং তার সাহাবায়ে কেরাম যে আশুরার সিয়াম পালনের মাধ্যমে উৎজাপন করেছেন। আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে আশুরার আমল উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য রেখে গেছেন তার সাথে কারবালার ঘটনার কোন ভূমিকা ছিলনা।

আশুরা উপলক্ষে মাতম করা, তাযিয়া বা শোক মিছিল বাহির করা, আলোচনা সভা কোন কিছুরই প্রমাণ পাওয়া যায় না। আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে আশুরা পালন করেছেন তারা সেভাবেই তা অনুসরণ করেছেন। অতএব আমরা কারবালা কেন্দ্রিক যে আশুরা পালন করে থাকি, এ ধরণের আশুরা রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমল বা হাদিস দ্বারা প্রমানিত নয়। সাহাবায়ে কেরাম ও এমন আশুরা পালন করে নাই। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিংবা সাহাবীগন কিভাবে পালন করবের? শীয়াদের এই আশুরাতো চালু হয়েছিল রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওফাতের পঞ্চাশ বছর পরে।  যদি এ পদ্ধতিতে আশুরা পালন আল্লাহর রসূলের মুহব্বাতের পরিচয় হয়ে থাকত, তাহলে এ সকল বিজ্ঞ সাহাবাগণ তা পালন থেকে বিরত থাকতেন না, তারা সাহসী ছিলেন। তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতেন না। কিন্তু তারা তা করেননি। তাই যে সত্য কথাটি আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, তা হলো আশুরার দিনে কারবালার ঘটনার স্মরণে যা কিছু করা হয় তাতে আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবাদের রেখে যাওয়া আশুরাকে ভুলিয়ে দিয়ে এক বিকৃত নতুন আশুরা প্রচলনের প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

কিন্তু এই উম্মদের দাবীদার এই বিষয়টি নিয়ে দুটি দলে বিভক্ত হয় বাড়াবাড়ি করছে। তাদের বাড়াবাড়ির ফলে অশুরার মূল চেতনা থেকে আমরা বহু চলে গেছি। যেমন শিয়াদের কয়েকটি দল এ দিনকে শোক দিবস হিসেবে পালন করে। হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতিকৃতি নিয়া তাযিয়া বা শোক মিসিল করে। মিছিল শেষে শোক প্রকাশের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে নিজেদর পিঠে চাকু মারে, নিজদের বিভিন্নভাবে জখম, নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করে, কষ্ট দেয়, বুক চাপড়ায়, কাপড় ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহিলী সব কথাবার্তা বলে। কেউ কেউ তরবারী দিয়ে মাথায় আঘাত করে রক্ত বয়ে দেয়। ইউটিউবে আশুরা বা কারবালা লিখে সার্স দিলে এমন হাজার হাজার নিজেক কষ্ট দেয়া জাহিলী কাজ পাওয়া যাবে। তাদের দাবী, এভাবে তারা হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহুকে হারানোর বেদনা প্রকাশ করে। এরা নিজেদের তাঁর একান্ত ভক্ত ও অনুসারী বলেও দাবী করে। মিডিয়াগুলোও এমনভাবে প্রচার করে যেন তারাই একমাত্র আহলে বাইত বা রাসূল-পরিবারের ভক্ত। যারা তাদের মতো কাজ করে না তারা আহলে বাইত-এর ভক্ত নয়। এটা একদম নির্জলা মিথ্যাচার। 

অপর পক্ষে কিছু লোক এমন আছে তারা আশুরা দিবসে আনন্দ-উৎসব করে। তারা এ দিনে গোসল করা, মেহেদি ও সুরমা লাগানো ইত্যাদি আনন্দ প্রকাশ কাজ করে। এমন করার উদ্দেশ্য, যারা এ দিনটিকে শোক দিবস হিসেবে পালন করে তাদের বিরুদ্ধাচারণ করা। কিন্তু এটাতো ভ্রান্তির বদলে ভ্রান্তির চর্চা এবং বিদআতকে প্রতিরোধ করা বিদআতের মাধ্যমে। এরাও সঠিক পথের উপর নাই। শুধু শীয়া নয় আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের কিছু লোকও আছে, যারা শীয়াদের মত শোক প্রকাশ করে আবার কিছু লোক এমন আছে যারা শীয়াদের বিরুদ্ধাচারণ করতে গিয়ে সিমা লঙ্গন করে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহুর শাহাদতের ঘটনায় খুবই মর্মাহত কিন্তু শোক প্রকাশেএ ইসলামি শরীয়তের সিমা লঙ্ঘন করে না। হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহুর অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে শহীদ হয়েছেন তাকেও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত অস্বীকার করে না। কিন্তু অজ্ঞ শীয়াদের মত গালে ছুরি চালানো, বুকে চাপড়ানো এবং নিজেকে ক্ষত-আহত করার মত গর্হিত কাজ করে না। ইদানীং আশুরাকে কেন্দ্র করে সমাজে যে সকল জাহেলী কাজ শুরু হয়ে তা সকলের জানা। মিডিয়ার কল্যানে আজ সবাই এ সকল ভ্রান্তি দেখে দেখে মূল শিক্ষা আমল থেকে দুরে সরে যাচ্ছে। শীয়াদের এই সকল গর্হিত কাজ সম্পর্ণ হারাম। ইসলামি শরীয়তে মৃত্যুর জন্য শোক পালন যা করনীয় সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। কাজেই ভুল করার সুযোগ নাই।

ইমাম বুখারী এবং ইমাম মুসলিম (রহঃ) আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সে আমাদের উম্মতভুক্ত নয় যে গালে আঘাত করে, বুকের কাপড় ছেঁড়ে এবং জাহেলী কথাবার্তা বলে। (সহিহ বুখারী -১২৯৪, সহিহ মুসলিম-১০৩]

ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রহ. আবূ মূসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আমি তাদের থেকে মুক্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের থেকে মুক্ত। আর সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (শোকে) মাথা মুণ্ডনকারিণী, বিলাপকারিণী এবং বুক বিদীর্ণকারিণী থেকে মুক্ত। (সহিহ বুখারী – ১২৩৪, সহিহ মুসলিম – ১০৪)।

তেমনি আবূ মালেক আশআরী রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার উম্মত জাহেলী যুগের চারটি স্বভাব সহজে ছাড়তে পারবে না। বংশ নিয়ে গর্ব, বংশ তুলে গালি দেয়া, তারকা দেখে বৃষ্টি চাওয়া এবং মৃত ব্যক্তির ওপর বিলাপ করা। তিনি বলেন, বিলাপকারিণী যদি মৃত্যুর আগে তওবা না করে তাহলে কেয়ামতের দিন তাকে এমনভাবে উঠানো হবে যে, তার সর্বাঙ্গ খোস-পাঁচড়া ও আলকাতরায় ভরা থাকবে। (সহিহ মুসলিম – ৯৩৪)।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment