প্রথম কিস্তি : শবে বরাতের সুচনা

প্রথম কিস্তি : শবে বরাতের সুচনা

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

১। শবে বরাত কি?

শবে বরাত নামটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। এই দিন সরকরি ছুটির দিন বলে সকল নাগরিকই জানে এটি একটি ইসলমি দিবস। আমরাও দেখে থাকি এই রাতে প্রতিটি মসজিদে বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে রাতটি অতিবাহিত করে। আবার কিছু লোককে দেখা যায় তারা এ রাতের বিশেষ ইবাদতকে বিদআত হবে। আলোচনা সমালোচায় এক পর্যায় শবে বরাত বা মধ্য শাবানের রজনীর এই আমলকে মুরুব্বিদের দোহাই ও সমাজে প্রচলিত বলে দাবি করে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হলোঃ শবে বরাত বা মধ্য শাবানের রজনীর আমল, বিশেষ নামায পড়া, রোযা রাখা, মিলাদ পড়া, মিষ্টি মিঠায় বিলি করা, আলোক সজ্জা করা ইত্যাদি ইসলামি শরীআতে একটা নব আবিস্কার বিষয়। এই ধরনের কোন আমল বা অনুষ্ঠান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে কিংবা সাহাবাগণের যুগে ছিল না। পরবর্তীতে আব্বাসীয় খেলাফতের একজন শিয়া মতাদর্শী মন্ত্রী মুহাম্মাদ বিন আলী বিন খলফ এ দিনকে বিশেষ ঈদ বা অনুষ্ঠান হিসেবে পালন করা, মিষ্টি মিঠায় বিলি করা শুরু করেন এবং ৪৪৮ হিজরীতে এক ব্যক্তি বায়তুল মুকাদ্দস মসজিদে বিশেষ নামাযের আয়োজন করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

হাফেয ইবনে রজব (রহঃ) তার কিতাব লাতায়িফুল মায়ারিফে লিখেছেনঃ “তাবেয়ীদের যুগে সিরিয়ায় খালিদ ইবনে মা’দান, মকহুল, লুকমান ইবনে আমের প্রমুখ আলিম এ রাতকে মর্যাদা দিতে শুরু করেন এবং এ রাতে বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। তখন লোকেরা তাদের থেকে এটা অনুসরণ করতে আরম্ভ করল। এরপর লোকদের মধ্যে মতানৈক্য শুরু হল। বসরা অঞ্চলের অনেক আবেদগণ এ রাতকে গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু মক্কা ও মদীনার আলিমগণ এটাকে বিদ‘আত বলে প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর সিরিয়াবাসী আলিমগণ দুই ভাগ হয়ে গেলেন। একদল এ রাতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। এদের মধ্যে ছিলেন খালেদ ইবনে মা’দান, লোকমান ইবনে আমের। ইসহাক ইবনে রাহভিয়াহও তাদের অনুরূপ মত পোষণ করতেন।

            শবে বরাত দুটি ফারসী শব্দের সমন্নয় গঠিত হয়ছে। একটি হল শব অপরটি বরাত। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত এবং ‘বরাত’ শব্দের অর্থ সৌভাগ্য বা ভাগ্য। এই অর্থ অনুসারে শবে বরাত শব্দটির অর্থ হল, সৌভাগ্য রজনী বা ভাগ্য রজনী। অনেক বলে থাকে শব ফারসী শব্দ হলেও বরাত শব্দটি আবরি যার অর্থ হল, সম্পর্কচ্ছেদ, পরোক্ষ অর্থে মুক্তি। সে অর্থে শবে বলাতের অর্থ হয় মুক্তির রজনী। কেউ কেউ আবার শবে বরাত কে লাইলাতুল বরাত বলে থাকে। এই ক্ষেত্রে দুটি শব্দই আবরি যার অর্থ হল, মুক্তির রজনী। যেমন কুরআন মাজীদে সূরা বারাত রয়েছে যা সূরা তাওবা নামেও পরিচিত। ইরশাদ হয়েছেঃ

بَرَآءَةٌ۬ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۤ إِلَى ٱلَّذِينَ عَـٰهَدتُّم مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ (١) 

অর্থঃ সম্পর্কচ্ছেদ করা হল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে সেই মুশরিকদের সাথে, যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে। (সূরা তাওবা ৯:১)
এখানে বারাতের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা। ‘

আরার বারাত’ মুক্তি অর্থেও আল-কুরআনে এসেছে। যেমনঃ সুরা কামারে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন।

 أَكُفَّارُكُمۡ خَيۡرٌ۬ مِّنۡ أُوْلَـٰٓٮِٕكُمۡ أَمۡ لَكُم بَرَآءَةٌ۬ فِى ٱلزُّبُرِ (٤٣)

অর্থঃ তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? না কি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাব সমূহে? (সূরা কামার ৫৪:৪৩)

অতএব শবে বরাত শব্দটার অর্থ দাড়ায় মুক্তির রজনী, সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী। অথবা সৌভাগ্যের রাত, যদি ‘বরাত’ শব্দটিকে ফার্সী শব্দ ধরা হয়। শবে বরাত শব্দটাকে যদি আরবীতে তর্জমা করতে চান তাহলে বলতে হবে ‘লাইলাতুল বারায়াত’। বরায়াত শব্দটি এর রূপ বা উচ্চারণ আরবী ও ফারসী ভাষায় একই রকম কিন্তু এর অর্থ ভিন্ন। সার কথা হল ‘বারায়াত’ শব্দটিকে আরবী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফারসী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য। যেহেতু কুরআন সুন্নাহতে এই শব্দের বা এই রাতের কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। আর অনাবর ভাষাভাষীদের এই রাতের আমলে প্রতি ঝোক বেশি, তাই শবে বারাত দুটি ফারসী শব্দ ধরে নেয়াই যুক্তি যুক্ত। তা হলে একে ‘সৌভাগ্য রজনী’ বলাই অধিক শ্রেয়।

 

২। কখন এই রাত আসেঃ

প্রতি বছর হিজরি সালের শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রে মুসলিম উম্মাহ কিছু বিদআতী এই রাতকে সৌভাগ্যের রজনী হিসেবে পালন করে বহু মনগড়া আমল করে থাকে। তারা এর সমর্থনে একটি হাদিস পেশ করে থাকে। হাদিসটি হলঃ

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে না পেয়ে ঘর থেকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম। হঠাৎ তাকে বাকী গোরস্তানে যেয়ে পেলাম। তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি আশংকা করো আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর কোন অন্যায় করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রী কাছে চলে গিয়েছেন বলে আমার ধারণা হয়েছিল। তিনি বলেন, শোন, আল্লাহ তা‘আলার মধ্য শাবানের রাত্রিতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে নেমে আসেন অনন্তর বানূ কালব গোত্রের বকরী পালের লোমের সংখ্যার চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে তিনি ক্ষমা করে দেন। (সুনানে তিরমীজি হাদিস নম্বর ৭৩৭ ইসলামি ফাউন্ডেশন এবং ৭৩৯ মাদানী প্রকাশনী; ইবনু মাজাহ ১৩৮৯)

তিরমীজির টিকাঃ ইমাম ঈসা (রহঃ) বলেন, হাজ্জাতের বরাতে এই সূত্রটি ছাড়া আয়িশা (রাঃ) এর হাদীসটি সম্পর্কে কোন কিছু আমাদের জানা নাই। এই হাদীসটিকে দুর্বল বলতে আমি মুহাম্মদ আল-বুখারীকে শুনেছি। তিনি বলেন, রাবী ইয়াহইয়া ইবনু আবূ কাসীর উরওয়া (রহঃ) থেকে কোন রিওয়ায়াত শোনেননি। মুহাম্মদ আল-বুখারী বলেন, এমনিভাবে হাজ্জাজ ইয়াহইয়া ইবনু আবূ কাসীরের নিকট থেকে কিছুই শোনেননি। এই হাদিসটি মানঃ যঈফ।

৩। শবে বরাত অনুসারীদের দলীল ও পর্যালোচনাঃ

কোন সত্য পন্থী আলেম পবিত্র কুরআনের কোন আয়াত শবে বরাত সম্পর্কে দলীল হিসাবে পেশ করেন না কারন শবে বরাত কিংবা লাইলাতুল বারায়াতের নামে কোন শব্দ কুরআন মাজীদে খুজে পাবেন না, আয়াততো অনেক দুরের কথা। সত্য কথাটাকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় পবিত্র কুরআন মাজীদে শবে বরাতের কোন আলোচনা নেই। সরাসরি তো দূরের কথা আকার ইংগিতেও নেই। শবে বরাত নামটি হাদীসের কোথাও উল্লেখ হয়নি। তবে হাদিসের গ্রন্থ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রাত সম্পর্কে বেশ কয়েকটি যঈফ হাদিস উল্লেখ আছে। এই সকল যঈফ হাদিসগুলিতে কোন প্রকার আমল করার কথা বলা হয়নি। ফিকহের কিতাবেও এ রাত সম্পর্কে কিছু বলা হয় নাই। কিন্তু কিছু কিছু অখ্যাত বইয়ে এ সম্পর্কি আলোচনা পাওয়া যায়। শবে বরাতের পক্ষে যারা কথা বলেন যারা কুরআন সুন্নাহ থেকে দলীল পেশ করা চেষ্টা করেন। তাদের দেয়া কিছু দলীল পর্যালোচনা করব, ইনশাল্লাহ।

৪। কুরআন থেকে তাদের দলীল ও পর্যালোচনাঃ

যারা শবে বরাতে পক্ষে কথা বলেন তাদের দেখা যায় শবে বরাতের গুরুত্ব আলোচনা করতে যেয়ে সূরা দুখানের প্রথম চারটি আয়াত পাঠ করেন। আয়াতসমূহ হলঃ 

حمٓ (١) وَٱلۡڪِتَـٰبِ ٱلۡمُبِينِ (٢) إِنَّآ أَنزَلۡنَـٰهُ فِى لَيۡلَةٍ۬ مُّبَـٰرَكَةٍ‌ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ (٣) فِيہَا يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ (٤)

অর্থঃ হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিতো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা দুখান ৪৪:১-৪)।

শবে বরাতের পক্ষের ব্যাখ্যাঃ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় শবে বরতা পন্থী আলেমগন অনেক মিথ্যা, ভুয়া ও মনগড়া তথ্য দিয়ে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে থাকে। তাদের প্রথম দাবি সুরা দখানে উল্লেখিত এই বরকতময় রজনী হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত বা শবে বরাতের রাত। তাদের দাবী, মধ্য শাবানের রাত্রিতে বছরের সকল ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়, জীবিত ও মৃতদের তালিকা লেখা হয় এবং হাজিদের তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকা থেকে পরবর্তীতে একজনও কমবেশি হয় না মহান আল্লাহ শবে বরাতের রাতে সকল বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববান ফেরেশতাদের কাছে ন্যস্ত করে থাকেন। তাদের এই কথা স্পষ্টভাবেই কুরআনের অপব্যাখ্যা তাদের এ ব্যাখ্যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয় বরং এখানে বরকতপূর্ণ রাত বলতে লাইলাতুল ক্বদর উদ্দেশ্য। 

তাদের ব্যাখ্যার জবাবঃ আল্লামা ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, অত্র বরকতপূর্ণ রাতই হল লাইলাতুল ক্বদর বা ক্বদরের রাত। যেমন অন্যত্র সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। কুরআনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য কথা হল, কুরআনের কোন অস্পষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা যদি অন্য কোন আয়াতে সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়, তাহলে কুরআনের ব্যাখ্যাই গ্রহণ করতে হবে। আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ সূরা কদরের শুরুতে বলেন, মহান আল্লাহ এই আয়াত দ্বারা বরকতময় রাতের অর্থ পনের শাবানের রাতকে বুঝান নাই তিনি এই আয়াত দ্বারা যে বরকতময় রাতের কথা বলছেন তা হল, লাইলাতুল কদর যদি কেউ এই আয়াত দ্বারা শাবানের পনের তারিখ বুঝিয়ে থাকেন তবে তা হবে মারাত্বক অন্যায় এবং মহান আল্লাহর কালাম বিকৃত করার মত অপরাধ  কুরআনের এই আয়াতগুল লক্ষ করুন। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّآ أَنزَلۡنَـٰهُ فِى لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ (١) وَمَآ أَدۡرَٮٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ (٢) لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٌ۬ مِّنۡ أَلۡفِ شَہۡرٍ۬ (٣) تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَـٰٓٮِٕكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيہَا بِإِذۡنِ رَبِّہِم مِّن كُلِّ أَمۡرٍ۬ (٤) سَلَـٰمٌ هِىَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ (٥)

অর্থঃ আমি এই কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য মালাইকা ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশে। এই শান্তি ও নিরাপত্তা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সূরা কাদর ৯৭:১-৫)।

পূর্বে উল্লেখিত সুরা দুখানের আয়াত থেকে স্পষ্ট দুটি ধারনা পাওয়া যায়

প্রথমটি হলোঃ মহান আল্লাহ বরকতময় একটি রজনীতে কুরআন নাজিল করেছেন।

দ্বিতীয়টি হলোঃ এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত করা হয়।

বিদআতীগন বলে থাকেন, এই বরকতময় রজণী হল শবে বরাত বা লাইলাতুর বরাত। আর আমরা বলছি এই বরকতময় রজণী হল লাইলাতুল করদ বা করদের রাত্রী। তাহলে কে সঠিক? একটু লক্ষ করুন, সুরা দুখানের ঐ আয়াতে বলা হয়ে, এই বরকতময় রজনীতে কুরআন নাজিল হয়েছে। তাহলে একটা বিষয় শতভাগ নিশ্চত যে, কুরআন যে রাত্রে নাজিল হয়েছে সেই রাতই হল এই বরকতময় রজণী। এবার দেখুন, সুরা কাদরে মহান আল্লাহ বলেন, আমি এই কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। দুটি আয়াতের সমন্নয় করলে দাড়ায়, কুরআন নাজিল হয়েছে এক বরকতময় রাতে আর সে রাতের নাম হল লাইলাতুল কদর। কাজেই মহান আল্লাহর কুরআনের বাণীর পর আর কারও ব্যাখ্যা বিশ্লষন গ্রহন করা হারাম। একটি স্পষ্ট দলীলের বিপরীত কোন প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লষন করা যাবে না। তবে বলতে পারেন লাইতাতুল কদর কখন হয়। এ প্রশ্নের জবাব ও মহান  আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরঅনে দিয়ে এরশাদ করছেন,

*شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ*

অর্থঃ রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন। (সুরা বাকারা ২:১৮৫)।

এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলে দিলেন, কুরআন নাজিল হয়েছে রমজান মাসে। কাজেই এই বরকতময় রজণী হল লাইলাতুল কদর অবশ্যই রমজান মাসে। কুনআনে এই স্পষ্ট দলীল বলে দিচ্ছে লাইলাতুল কদর হল রমজান মাসে। তাই যারা সুরা দুখানের ঐ আয়াত দ্বারা শবে বরাতের দলীল দেন তারা কুনআনেরই অবমাননা করছেন।

এক কথায় বলা যায় সূরা দুখানের প্রথম চার আয়াতের ব্যাখ্যা হল সূরা কদর। আল কুরআনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করা হল সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। কিন্তু সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকার অর্থ যদি শবে বরাত হয় তাহলে এ আয়াতের অর্থ দাড়ায় আল কুরআন শাবান মাসের শবে বরাতে নাযিল হয়েছে। অথচ উপরের আলোচনায় থেকে কুরআনের দলীল দ্বারা সহজে অনুমেয় কুরআন নাযিল হয়েছে রামাযান মাসের লাইলাতুল কদরে। 

আপনি যদি তাফসীর থেকে এর ব্যাখ্যার আলোচনা দেখেন তবে দেখবেন, অধিকাংশ মুফাচ্ছিরে কিরামের মত হল উক্ত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। শুধু মাত্র তাবেয়ী ইকরামা (রহঃ) এর একটা মত উল্লেখ করে বলা হয় যে, তিনি বলেছেন বরকতময় রাত বলতে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতকেও বুঝানো যেতে পারে।  তিনি বরকতময় রজনীর যে ব্যাখ্যা শাবানের ১৫ তারিখ দ্বারা করেছেন, তা ভুল হওয়া সত্ত্বেও প্রচার করতে হবে এমন কোন নিয়ম-কানুন নেই। বরং তা প্রত্যাখ্যান করাই হল হকের দাবী। তিনি যেমন ভুলের উর্ধ্বে নন, তেমনি যারা তার থেকে বর্ণনা করেছেন তারা ভুল শুনে থাকতে পারেন অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বানোয়াট বর্ণনা দেয়াও অসম্ভব নয়। এমন কথা বলার অধিকার কুরআন দিয়েছেন তার স্পষ্ট বর্ণনা দ্বারা। তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। যা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য। এ বরকতময় রাতের দ্বারা উদ্দেশ্য যদি শবে বরাত হয় তাহলে শবে কদর অর্থ নেয়া চলবেনা।

       আর একটু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, সুরা দুখানে চার নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয় (৪৪:৪)। কাজেই ভাগ্য রজনী বলতে যা বুঝায় তাও হবে লাইলাতুল কদরে, শবে কদরে নয়। কিন্তু বিআদতীদের বাদী হল, শবে বরাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মাউত, রিয্‌ক-দৌলত সম্পর্কে সিদ্ধান- নেয়া হয় ও লিপিবদ্ধ করা হয়। তাদের এই বাদী সরাসরি কুরআন বিরোধী। তাদের প্রচারনার ফলে অনেক অজ্ঞ মুসলিম শবে বরাতের গুরুত্ব বর্ণনায় সূরা দুখানের উক্ত আয়াত উল্লেখ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এ আকীদাহ বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, শবে বরাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মাউত, রিয্‌ক-দৌলত সম্পর্কে সিদ্ধান নেয়া হয় ও লিপিবদ্ধ করা হয়। আর শবে বরাত উদযাপনকারীদের শতকরা নিরানব্বই জনের বেশী এ ধারণাই পোষণ করেন। তারা এর উপর ভিত্তি করে লাইলাতুল কদরের চেয়ে ১৫ শাবানের রাতকে বেশী গুরুত্ব দেয়। অথচ কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ বিষয়গুলি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত। তাই যারা শবে বরাতের গুরুত্ব বুঝাতে উক্ত আয়াত যারা উল্লেখ করেন তারা মানুষকে সঠিক ইসলামী আকীদাহ থেকে দূরে সরানোর কাজে লিপ্ত, যদিও মনে-প্রাণে তারা তা ইচ্ছা করেন না।

ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর তাফসীরে বলেছেনঃ কোন কোন আলেমের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত)। কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা।”

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment