তাওয়াফে জিয়ারত বা ইফাদা মাধ্যমে হজ্জের পরিসমাপ্তি করা

তাওয়াফে জিয়ারত বা ইফাদা মাধ্যমে হজ্জের পরিসমাপ্তি করা

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

তাওয়াফে জিয়ারত বা ইফাদা হলো হজ্জের মুল তাওয়াফ। সকল হজ্জকারীকেই এ তাওয়াফটি আদায় করতে হয়। এটা হল হজ্জের ফরজ তাওয়াফ যা বাদ পড়লে হজ্জ সম্পন্ন হবে না। তাওয়াফে ইফাযা  মাধ্যমেই হজ্জের পূর্ণতা লাভ করে। তওয়াফে ইফাযাকে তাওয়াফে জিয়ারতও বলা হয়। আবার অনেকে এটাকে হজের তাওয়াফও বলে থাকেন। এটি না হলে হজ শুদ্ধ হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ثُمَّ لۡيَقۡضُواْ تَفَثَهُمۡ وَلۡيُوفُواْ نُذُورَهُمۡ وَلۡيَطَّوَّفُواْ بِٱلۡبَيۡتِ ٱلۡعَتِيقِ ٢٩

অর্থঃ তারপর তারা যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়, তাদের মানতসমূহ পূরণ করে এবং প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করে। (সুরা হজ্জ ২২:২৯)

তাওয়াফে ইফাদার সময়ঃ

তাওয়াফে ইফাদার জন্য সর্বোত্তম সময় হলো কুরবানীর দিন কঙ্কর নিক্ষেপ, কুরবানী এবং মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করার পর। তাওয়াফে ইফাযার সর্বপ্রথম জায়েয সময় হচ্ছে, কুরবানীর দিন মধ্যরাত থেকে। অথবা (কঙ্কর নিক্ষেপের প্রথম ওয়াক্ত সংক্রান্ত আলিমদের ভিন্ন মতের ভিত্তিতে) ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার পর থেকে। মোট কথা, জিলহজ্জে ০৯ তারিখ আরাফার কাটানোর পর ১০ মিনায় এসে জামারায় পাথর নিক্ষেপের পরই এই তাওয়াফে ইফাদা বা জিয়ারত আদায় করা হয়। জমহুর ফুকাহার নিকট ১৩ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে সম্পন্ন করা ভাল। এর পরে করলেও কোনো সমস্যা নেই। সাহেবাইন (ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ) এর নিকট তাওয়াফে  ইফাদা আদায়ের সময়সীমা উন্মুক্ত। ইমাম আবু হানিফা (র) এর নিকট তাওয়াফে জিয়ারত আদায়ের ওয়াজিব সময় হল ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। এ সময়ের পরে তাওয়াফে যিয়ারত আদায় করলে ফরজ আদায় করলে ফরজ আদায় হয়ে যাবে তবে ওয়াজিব তরক হওয়ার কারণে দম দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে হবে। উত্তম হলো, তাওয়াফে ইফাযা বিলম্বিত না করা ১২ তারিখের মধ্যে আদায় করা। উযর ছাড়া যিলহজের পর পর্যন্ত তাওয়াফে ইফাযা বিলম্বিত করা জায়েয হবে না। হাজী সাহেবদের কেউ যদি বিদায় মুহূর্ত পর্যন্ত তাওয়াফে ইফাদা বিলম্বিত করে, তবে তাওয়াফে ইফাদার সাথে তার বিদায়ী তাওয়াফও আদায় হয়ে যাবে। তাকে আর বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে না।

তাওয়াফে ইফাদার আগে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের জন্য হালাল নয়ঃ

অনেকে মনে করে কঙ্কর নিক্ষেপ, হাদী জবেহ, মাথা মুণ্ডন অথবা চুল ছোট করার পর ইহরামের পোশাক পাল্টে হালাল হলেই স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের জন্য হালাল হয়ে যায়। তাদের ধারনা ভুল, তাওয়াফে ইফাদার বা জিয়ারত আদায়ের পূর্বে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের জন্য হালাল হয় না। ঐ তিন কাজে (কঙ্কর নিক্ষেপ, হাদী জবেহ, মাথা মুণ্ডন) পর তাওয়াফে ইফাদা করলে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের জন্য হালাল হয়ে যায়।

দলিলঃ

উম্মু সালামাহ (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আমার পালার রাতটি ছিলো কুরবানীর দিন সন্ধ্যায়। সুতরাং সেদিন তিনি আমার কাছে ছিলেন। এ সময় ওয়াহব ইবনু যাম‘আহ এবং তার সাথে আবূ উমায়্যাহ পরিবারের জনৈক ব্যক্তি উভয়েই জামা পরিহিত অবস্থায় আমার নিকট প্রবেশ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াহবকে জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আবূ ‘আব্দুল্লাহ! তুমি কি তাওয়াফে ইফাদা সম্পন্ন করেছো? সে বললো, না, আল্লাহর শপথ, হে আল্লাহর রাসূল! তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তুমি তোমার জামা খুলে ফেলো। উম্মু সালামাহ (রাযি.) বলেন, তিনি মাথার দিক থেকে তা খুললেন এবং তার সাথীও মাথার দিক থেকে তার জামা খুললো।

অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ রাসূল! এরূপ করার কারণ কি? তিনি বললেনঃ আজকের দিনে তোমাদের জন্য বিধান শিথিল হয়েছে। তোমরা যখন জামরায় কংকর মেরে, কুরবানী সম্পন্ন করে চুল মুড়াবে, তখন একমাত্র স্ত্রীসহবাস ছাড়া এ পর্যন্ত ইহরামের কারণে যা কিছু তোমাদের জন্য হারাম ছিলো তা হালাল হবে। আর যদি আজকে বায়তুল্লাহ তাওয়াফের আগে রাত হয়ে যায় তাহলে তাওয়াফ করা পর্যন্ত তোমরা অনুরূপভাবে ইহরাম অবস্থায় থেকে যাবে, যেভাবে ছিলে জামরায় কংকর মারার আগে। (সুনানে আবু দাইদ ১৯৯৯)

ঋতুবতী মহিলার তাওয়াফে ইফাদাঃ

ঋতুবতী মহিলা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাওয়াফ করবে না। তাওয়াফ ছাড়া হজ্জের অন্য সব বিধান যেমন আরাফায় অবস্থান, মুযদালিফায় রাত্রিযাপন, কঙ্কর নিক্ষেপ, কুরবানী ও দো‘আ-যিকর ইত্যাদি সবই করতে পারবে। কিন্তু স্রাব বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তাওয়াফ করতে পারবে না। স্রাব বন্ধ হলে তাওয়াফে জিয়ারত সেরে নেবেন। এ ক্ষেত্রে কোনো দম দিতে হবে না। আর যদি ঋতুবতী মহিলা পবিত্র হওয়া পর্যন্ত কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণে তাওয়াফে ইফাদার জন্য অপেক্ষা করতে না পারে এবং পরবর্তীতে তাওয়াফে যিয়ারত আদায় করে নেয়ারও কোনো সুযোগ না থাকে, তাহলে সে গোসল করে ন্যাপকিন বা এ জাতীয় কিছুর সাহায্য নিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ করে তাওয়াফ করে ফেলবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা কাউকে তার সাধ্যাতীত কাজের আদেশ করেন না। ইবন তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, এর জন্য সে মহিলার ওপর কোন দম ওয়াজিব হবে না। তবে মুজতাহীদ  আলেমগণ মনে করেন যে, শারীরিক ক্ষতি না হয় এমন ওষুধ ব্যবহারের মাসিক স্রাব বন্ধ বা বিলম্ব করে তাওয়াফে ইফাযা সম্পর্ক করা জায়েয আছে।

তাওয়াফে ইফাদাতে রমল নাইঃ

হজ্জের সফরে তাওয়াফে কুদুম বা আগমণী তাওয়াফে শুধু রমল করতে হয়। আর কোন প্রকার তাওয়াফে রমন নাই। তাই তাওয়াফে ইফাদাতে রমল নাই।

দলিলঃ

১. ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফে যিয়ারাতের সাত চক্করের একটিতেও রমল করেননি। (সুনানে আবু দাউদ ২০০১)

২. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফে যিয়ারার সাত চক্করে রমল (বাহু দুলিয়ে বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ) করেননি। আতা (রহঃ) বলেন, তাওয়াফে যিয়ারাতে রমল করতে হয় না। (ইবনে মাজাহ ৩০৬০)

তাওয়াফে বিদাঃ

বায়তুল্লাহ শরীফ হতে প্রত্যাবর্তনের সময় যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে বিদা বলে। এই তাওয়াফটি বহিরাগত হাজ্জিদের জন্য মুজতহীদ আলেমগণ ওয়াজিব বলে গন্য করেছেন। কাজেই যারা মিনায় আইয়ামে তাশরিকের দিনগুলি অবস্থান শেষ করবেন, তারা সরাসরি নিজ নিজ দেশে চলে যেতে পারবেন না। কেননা, কাবাঘরের শেষ ওয়াজিব তাওয়াফটি এখনও বাকি আছে। তবে মক্কাবাসিগন মিনা থেকে সরাসরি তাদের বাড়িতে চলে যেতে পারবেন। কেননা তাদের তাওয়ায়ে বিদা করতে হয় না। কিন্তু বহিরাগত হাজ্জিগন মক্কা হয়ে বিদায়ী তাওয়াফ শেষ করে নিজ নিজ বাস স্থানে ফিরবেন। এই তাওআফের মাঝেই বহিরাগত হাজ্জিগন তাদের হজ্জ শেষ করে মক্কা থেকে প্রস্থানের অনুমতি পায়। 

বহিরাগত হাজিদের জন্য বিদায়ি তাওয়াফ ওয়াজিবঃ

বিদায়ি তাওয়াফের পূর্বেই হজ্জের সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। তবে বহিরাগত হাজিদের জন্য বিদায়ি তাওয়াফ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বিদায়ী তাওয়াফ আদায় করা হানাফি মাজহাবে ওয়াজিব হিসাবে গন্য করা হয়। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি তাগিদ দিয়েছেন।

১. ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকেরা বিভিন্ন পথ দিয়ে প্রত্যাবর্তন করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ “কেউই যেন শেষবারের মতো বায়তুল্লাহ ত্বওয়াফ না করা পর্যন্ত প্রত্যাবর্তন না করে।” (সহিহ মুসলিম ৩১১১)

২. ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকেরা তাওয়াফে যিয়ারাত সম্পন্ন করে মক্কার চতুর্দিক দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করলেনঃ তোমাদের কেউ যেন শেষ বারের মতো বায়তুল্লাহ তাওয়াফ না করে চলে না যায়। (সুনানে আবু দাউদ ২০০২)

বিদায়ী তাওয়াফ কি হজ্জের অংশ?

আমরা জানি, বিদায়ী তাওয়াফ কেবল বহিরাগতদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মক্কায় বসবাসকারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেহেতু মক্কায় বসবাসকারী হাজিদের জন্য প্রযোজ্য নয়, তাই এ তাওয়াফ হজ্জের অংশ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেননা হজ্জের অংশ হলে মক্কাবাসী এ থেকে অব্যাহতি পেত না। আবার উম্মুল মু’মিনীন সফিয়্যাহ্ বিনতু হুয়াই (রাঃ) ত্বওয়াফে ইফাযাহ্ করার পর হায়যগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তাকে বিদায়ী তাওয়াফ না করেই মক্কা ত্যাগের অনুমিত প্রদান করেন। যদি হজ্জের অংশ হত তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে এই তাওয়াফ সম্পন্ন না করে মক্কা ত্যাগ করেত দিতেন না। তাওয়াফে ইফাদা বা হজ্জের ফরজ তাওয়াফে কোন প্রকার ছাড় দেয়ার কথা হাদিসে উল্লেখ নাই। কেননা তাওয়াফে ইফাদা হজ্জের অংশ।

দলিলঃ

১. আবূ সালামাহ্ ও ‘উরওয়াহ্ (রহঃ) থেকে বর্ণিত, ‘আয়িশা (রাঃ) বলেন, উম্মুল মু’মিনীন সফিয়্যাহ্ বিনতু হুয়াই (রাঃ) ত্বওয়াফে ইফাযাহ্ করার পর হায়যগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। ‘আয়িশা (রাঃ) আরও বলেন, আমি তার হায়িযের কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট উল্লেখ করলাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ সে কি আমাদেরকে আটকিয়ে রাখবে? ‘আয়িশা (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল সে ত্বওয়াফে ইফাযাহ্ করার পর হায়যগ্রস্ত হয়েছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে সে রওনা হতে পারে। (সহিহ মুসলিম ৩১১৩)

২. আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সহধর্মিণী সাফিয়্যা বিনত হুয়াই (রাঃ) ঋতুবর্তী হলেন এবং পরে এ কথাটি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে অবগত করানো হয়। তখন তিনি বললেনঃ সে কি আমাদের যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে? তারা বললেন, তিনি তো তাওয়াফে যিয়ারাহ্ সমাধা করে নিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তাহলে তো আর বাধা নেই। (সহিহ বুখারি ১৭৫৭, আবু দাউদ ২০০৩)

৩. ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, তাওয়াফে যিয়ারাহ্ আদায় করার পর ঋতুমতী মহিলাকে রওয়ানা হয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে। (সহিহ বুখারি ১৭৬০)

৪. ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ লোকদেরকে (প্রত্যাবর্তনকালে) শেষবারের মত বায়তুল্লাহ ত্বওয়াফের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ঋতুবতী মহিলাদেরকে তা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে। (সহিহ মুসলিম ৩১১২)

মন্তব্যঃ সারকথা হলো, ঋতুবর্তী মহিলা যারা তাওয়াফে যিয়ারত সম্পন্ন করে ফেলেছেন, তাদের জন্য সম্ভব হলে পবিত্র হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন এবং পবিত্রতা অর্জন শেষে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন। এটাই উত্তম। অন্যথায় তাদের থেকে এই তাওয়াফ রহিত হয়ে যাবে।

বিদায়ী তাওয়াফের পদ্ধতিঃ

বিদায়ী তাওয়াফ অন্য তাওয়াফের মতই। তবে এ তাওয়াফ সাধারণ পোশাক পরেই করা হয়। তাওয়াফ হাজরে আসওয়াদ থেকে শুরু করতে হয়। এর সাতটি চক্করে কোন রমল এবং ইযতিবা কিছুই নেই। তাওয়াফ শেষ করার পর দু’রাক‘আত তাওয়াফের সালাত আদায় করতে হবে। মাকামে ইবরাহীমের সামনে সম্ভব না হলে হারামের যেকোনো জায়গায় আদায় করবেন। এ তাওয়াফের পর কোন সা‘ঈ নেই। অনেক এখানে উল্টা পায়ে বা পিছের দিকে হাটি যা মুলত বিদআত। এতদিন স্বাভাবিক যেভাবে কাবাঘর থেকে ফিরেছেন আজও ঠিক সেই ভাবে ফিরবেন। তবে নিজের প্রিয় বস্তু ত্যাগ করে ফিরে আসাতে মনের মাঝে একটু কষ্ট আসতেই পারে। এতে কোন সমস্যা নাই। কেননা, কাবার মহব্বত তো মহান আল্লাহ জন্য।

মন্তব্যঃ হাজী সাহেবদের সর্বশেষ আমল হবে এই তাওয়াফ। এই তাওয়াফের পর আর দীর্ঘ সময় মক্কায় অবস্থান করা যাবে না। করলে পুনরায় বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে। তবে যদি সামান্য সময় অবস্থান করে, যেমন কোন সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা, খাদ্যসামগ্রী ক্রয়ের জন্য অপেক্ষা কিংবা উপহার সামগ্রীর জন্য অপেক্ষা।

মক্কাবাসিদের জন্য বিদায়ি তাওয়াফ নাইঃ

ক্কার বাসিন্দাদের উপর বিদায়ী তাওয়াফ নেই। কারণ বিদায়ী তাওয়াফ ওয়াজিব হয় বায়তুল্লাহকে বিদায় জানানোর কারণে। এই কারণ মক্কাবাসীদের মধ্যে পাওয়া যায় না। যেহেতু মক্কা তাদেরই দেশ। বিদায়ী তাওয়াফ যে হজ্জের রুকন নয় শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া সে কথা আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, এ কারণে মক্কাবাসীর উপর তাওয়াফে কুদুম ও তাওয়াফে বিদা’ (বিদায়ী তাওয়াফ) নেই। যেহেতু তাদের ক্ষেত্রে এ কার্যকারণ অনুপস্থিত। কারণ তারা তো মক্কার দিকে আগমন (কুদুম) করে আসেনি। কিংবা মক্কাকে বিদায় (বিদা’) দিয়েও যাবে না। যেহেতু তারা সেখানেই থাকে। (মাজমুউল ফাতাওয়া (২৬/২৬১)

শাইখ বিন বায (রহঃ) বলেন, মক্কাবাসীর উপর বিদায়ী তাওয়াফ নেই। (ফাতাওয়া ১৭/৩৯৩)

হারামের ভেতরে অবস্থানকারী সকলের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য।

ইবনে কুদামা বলেন: যার গৃহ হারাম এলাকার ভেতরে সে মক্কাবাসী; তার উপর বিদায়ী তাওয়াফ নেই। (আল-মুগনি (৩/২৩৭)

কিন্তু কোন মক্কাবাসী যদি হজ্জ আদায় করার পরপর মক্কা ছেড়ে চলে যেতে চায় তাহলে মক্কা থেকে বের হওয়ার পূর্বে তাকে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হবে।

ইমাম নববি (রহঃ) বলেন: আমাদের মাযহাবের আলেমগণ বলেন, যে ব্যক্তি হজ্জ শেষ করার পর মক্কাতে অবস্থান করার নিয়ত করেছে তার উপর বিদায়ী তাওয়াফ নেই। এ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই। হোক না এ ব্যক্তি মূলত মক্কার অধিবাসী কিংবা ভিনদেশী। আর যদি মক্কা থেকে তার নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য অথবা অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য বের হতে চায় তাহলে সে বিদায়ী তাওয়াফ করবে। (আল-মাজমু ৮/২৫৪]

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন: যদি কোন মক্কাবাসী হজ্জ আদায় করে হজ্জের পরপর সফর করতে চান তাহলে তিনি বিদায়ী তাওয়াফ করবেন। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে বাণী: “তোমাদের কেউ বের হবে না যতক্ষণ না তার সর্বশেষ আমল হয় বায়তুল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত”[সহিহ মুসলিম (১৩২৭)] এটি একটি আম বা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সাধারণ দলিল। অতএব, আমরা মক্কাবাসীকে বলব: আপনি যেহেতু হজ্জের দিনগুলোতে সফর করছেন এবং আপনি হজ্জও আদায় করেছেন সুতরাং আপনি বিদায়ী তাওয়াফ না করে সফর করবেন না। (ফাতাওয়া ২৩/৩৩৯)

আল্লাহই ভাল জানেন। (ফতোয়াটির উৎসঃ (https://islamqa.info) ইসলামি প্রশ্ন উত্তর, প্রশ্ন নম্বর ৪১৮৯৪)

হজ্জের পরিসমাপ্তিঃ

হজ্জ সম্পন্ন করার পর আপনি যতো বেশি পারেন মসজিদুল হারামে ফরয, সুন্নাত, নফল, জানাযা, চাশত, তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করুন এবং নফল তাওয়াফ করুন। নফল তাওয়াফ করার নেকী অনেক অনেক বেশি। হজ্জের পর যদি আপনার বাড়ি ফিরে যাওয়ার ফ্লাইট থাকে তবে বিদায় তাওয়াফ করে ফ্লাইট ধরুন। আর যদি ফ্লাইট একটু দেরী হয় তবে হজ্জের পরও আপনি কিছু ইসলামিক ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখে আসতে পারেন। আপনি এ সময়ে কিছু কেনাকাটাও করতে পারেন। আর যদি মদিনা আগে না গিয়ে থাকের তবে বিদায়ী তাওয়াফ করে মদিনার পথে রওয়ানা হবেন। এই তাওয়াফে ইফদার মাধ্যমে হজ্জের কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়। বিদায়ী তাওয়াফের মাধ্যমের বহিরাগত হাজ্জিদের এ হজ্জ ও মক্কার কার্যক্রমের পরিসমাপ্তি ঘটে। এবার যার যার বাড়ি ফেরার পালা। সবাই সুবিধা মত বাড়িতে ফিরবেন কিন্তু এই মুহুর্তে মহান আল্লাহ একটি হুকুম আছে। মহান আল্লাহ হজ্জের কার্যাদি সম্পন্ন করার পর অধিক পরিমাণে জিকির ও ইস্তিগফার করার নির্দেশ প্রদান করছেন। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

*فَإِذَا قَضَيْتُم مَّنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُواْ اللّهَ كَذِكْرِكُمْ آبَاءكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْرًا فَمِنَ النَّاسِ مَن يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا وَمَا لَهُ فِي الآخِرَةِ مِنْ خَلاَقٍ*

অর্থঃ আর অতঃপর যখন হজ্জ্বের যাবতীয় অনুষ্ঠান ক্রিয়াদি সমাপ্ত করে সারবে, তখন স্মরণ করবে আল্লাহকে, যেমন করে তোমরা স্মরণ করতে নিজেদের বাপ-দাদাদের কে। বরং তার চেয়েও বেশী স্মরণ করবে। তারপর অনেকে তো বলে যে পরওয়াদেগার! আমাদিগকে দুনিয়াতে দান কর। অথচ তার জন্যে পরকালে কোন অংশ নেই। (সুরা বাকারা ২:২০০)

এই আয়াতের আদেশ মত নিজ নিজ বাড়ি ফেরার শুরু থেকেই মহান আল্লাহকে সব সময় স্মরনে রাখতে হবে। এই লক্ষে সফরের শুরু থেকেই স্থান ও কালভেদে দোয়া গুলো পড়া শুরু করি। এই কাজটি সারা জীবন চালিয়ে যাওয়ার নিয়ত করি। সফরসঙ্গী ও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সদয় ও উন্নত আচরণ করবেন। যদি তাদের রীতি এমন হয়ে থাকে যে, সেখানে হাদিয়া নিয়ে যেতে হয়, তাহলে তাদের মনোতুষ্টির জন্য হাদিয়া নিয়ে যাবেন।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “তাওয়াফে জিয়ারত বা ইফাদা মাধ্যমে হজ্জের পরিসমাপ্তি করা

Leave a comment