মক্কায় প্রবেশের পূর্বে প্রস্ততি মূলক কাজ

মক্কায় প্রবেশের পূর্বে প্রস্ততি মূলক কাজ

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

১। মক্কায় পৌঁছে একটু বিশ্রাম করা

২। গোসল করে নেয়া

৩। মক্কায় উঁচুভূমি দিয়ে পবেশ করা

৪। বাবুস সালাম গেট দিয়ে হারামে প্রবেশ করা

৫। দোয়া পড়ে মসজিদে হারামে প্রবেশ করা

৬। তাওয়াফের নিয়ত না থাকলে দুই রাকাত সালাত আদায় করা

৭। তাওয়াফের পূর্বে সম্ভব হলে আসওয়াদ চুম্বন করা

৮। মক্কা প্রবেশ কালের ভুলত্রুটিঃ

১। মক্কায় পৌঁছে একটু বিশ্রাম করাঃ

মক্কায় পৌঁছে সুবিধাজনক কোন স্থানে একটু বিশ্রাম করা, যাতে ক্লান্তি দূর হয় এবং শক্তি অর্জিত হয়।

যুহায়র ইবনু হারব ও উবায়দুল্লাহ ইবনু সাঈদ (রহঃ) ইয়াহইয়া থেকে তিনি উবায়দুল্লাহ থেকে তিনি নাফি’ থেকে এবং তিনি ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যু-তুওয়া নামক স্থানে ভোর পর্যন্ত রাত্রি যাপন করলেন, অতঃপর মক্কায় প্রবেশ করলেন। নাফি (রহঃ) বলেন, আবদুল্লাহ (রাঃ)-ও তাই করতেন। ইবনু সাঈদের বর্ণনায় আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে ফজরের সালাত আদায় করলেন। ইয়াহইয়া (রহঃ) বলেন, অথবা তিনি (উবায়দুল্লাহ) বলেছেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে সকাল পর্যন্ত অবস্থান করলেন। (সহিহ মুসলিম ২৯১৫ ইফাঃ)

২। গোসল করে নেয়াঃ

সম্ভব হলে গোসল করে নেয়া মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতেন। সুযোগ না পেলে না-করলেও চলবে। তবে নাপাকী থেকে অবশ্যই পবিত্র হতে হবে।

নাফি (রহঃ) থেকে বর্ণিত। ইবনু উমর (রাঃ) যু-তুওয়ায় ভোর পর্যন্ত রাত যাপন না করে মক্কায় উপনীত হতেন না। তিনি (সেখানে) গোসল করতেন, তারপর দিনের বেলায় মক্কায় প্রবেশ করতেন এবং নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাই করতেন বলে তিনি বলেছেন। (সহিহ মুসলিম ২৯১৫ ইফাঃ)

৩। মক্কায় উঁচুভূমি দিয়ে পবেশ করাঃ

উচ্চ গিরিপথ দিয়ে মক্কায় প্রবেশ, নিম্নপথ দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান এবং যে পথ দিয়ে শহর থেকে বের হয়েছে তার বিপরীত পথ দিয়ে সেখানে প্রবেশ করা মুস্তাহাব।

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের বছর মক্কার উচ্চ ভূমিতে অবস্থিত ‘কাদা’-র দিক দিয়ে প্রবেশ করেন। হিশাম বলেন, আমার পিতা উভয় স্থান দিয়েই প্রবেশ করতেন, তবে অধিকাংশ সময় “কাদা” টিলা দিয়ে প্রবেশ করতেন। (সহিহ মুসলিম ২৯১৩ ইফাঃ)

ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাজারার পথ দিয়ে (মদিনা থেকে) বের হতেন এবং মুআর্‌রাশ এর পথ দিয়ে সেখানে প্রবেশ করতেন। তিনি মক্কায় প্রবেশকালে উচ্চ গিরিপথ দিয়ে প্রবেশ করতেন এবং নিম্ন পথ দিয়ে বের হতেন। (সহিহ মুসলিম ২৯১০ ইফাঃ)

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় পৌঁছলেন, তখন উচ্চ এলাকা দিয়ে প্রবেশ করলেন এবং নীচু এলাকা দিয়ে বের হলেন।(সহিহ মুসলিম ২৯১২ ইফাঃ)

ইব্‌নু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সানিয়্যাতুল ‘উলয়া (হারমের উত্তর-পূর্বদিকে কাদা নামক স্থান দিয়ে) মক্কায় প্রবেশ করতেন এবং সানিয়্যা সুফলা (হারমের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে কুদা নামক স্থান) দিয়ে বের হতেন। (সহিহ বুখারী ১৫৭৫) 

৪। বাবুস সালাম গেট দিয়ে হারামে প্রবেশ করাঃ

বহু মুসলিম ধরণা করে থাকে যে, হজ্জ বা উমরা পালনেচ্ছু ব্যক্তিকে মসজিদে হারামের নির্দিষ্ট একটি গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। এই বিষয়ে কেউ কেউ তাদের লিখনিতেও প্রকাশ করছেন। কারো মতে বাবুস সালাম গেট দিয়ে প্রবেশ করা ভাল। আবার কানে মত, উমরা গেটি দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। কারো ধারনাতো এমনই যে, যদি উমরা পালনেচ্ছুক হয় তাকে অবশ্যই ‘বাবুল উমরা’ (উমরা গেট) দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। এই গেটি দিয়ে প্রবেশ করা উমরা পালনকালীকে অবশ্যই কর্তব্য কারন এটি শরিয়তের বিধান। অপর একদল আছেন যারা মনে করেন তাকে অবশ্যই ‘বাবুস সালাম’ (সালাম গেট) দিয়ে প্রবেশ করতে হবে, অন্য গেট দিয়ে প্রবেশ করা গুনাহ কিংবা মাকরূহ।

ইসলামি শরীয়তে এমন ধারণার কোন ভিত্তি নেই। বরং হজ্জ ও উমরা পালনেচ্ছু ব্যক্তি যে কোন গেট দিয়ে প্রবেশ করতে পারেন। যখন সে মসজিদে প্রবেশ করবে তখন ডান পা এগিয়ে দিবে এবং সকল মসজিদে প্রবেশ করার সময় যে দোয়া পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে সে দোয়াটি পড়বে।

৫। দোয়া পড়ে মসজিদে হারামে প্রবেশ করাঃ

আমাদের দেশে প্রচলিত অনেক কিতাবে কাবাগৃহ দেখার সময় নির্দিষ্ট কিছু দোয়া বর্ণিত আছে। অনেকে এই সকল বইপড়ে মনে করে থাকেন, কাবাগৃহ দেখার সাথে সাথে এই দোয়া বড়তে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কাবাগৃহ দেখে দোয়া করা বা পড়ার মত কিছুই বর্ণিত হয়নি। এমনকি কোন সাহাবী (বাঃ) কাবাগৃহ দেখে আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করছেন তারও কোন প্রমান নেই। কাজেই কাজটি নিসন্দেহে একটি বিদআত। কেননা যে কথা, কাজ কিংবা বিশ্বাস এর ওপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীবর্গ ছিলেন না সেটা দিয়ে আল্লাহ্‌র ইবাদত করা বিদাত ও পথভ্রষ্টতা। এর থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করেছেন। তাই যে বা যারা এই কাজটি করে থাকেন, আশা করি জানার পর পরিহার করে চলবেন। কাবাগৃহে প্রবেশ কালে মসজিদে হারামের ভিতর দিয়া প্রবেশ করতে হয় বিধায়। মসজিদে হারামে প্রবেশকালে উত্তম হলো ডান পা আগে দিয়ে প্রবেশ করা এবং নীচের দোয়াটি পড়াঃ

**أَعُوذُ بِاللهِ الْعَظِيمِ وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيمِ مِنْ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ بِسْمِ اللهِ وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلٰى رَسُوْلِ اللهِ – اَللَّهُمَّ افْتَحْ لِيْ أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ**

এবং মসজিদে হারাম থেকে বের হওয়ার সময় পড়াঃ

**بِسْمِ اللهِ وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلٰى رَسُوْلِ اللهِ اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ**

মন্তব্যঃ এই দোয়াগুলো পৃথিবীর অন্যসব মসজিদেও পড়া সুন্নত।

তাহিয়্যা (সম্ভাষণ) হল তাওয়াফ করা।

৬। তাওয়াফের নিয়ত না থাকলে দুই রাকাত সালাত আদায় করাঃ

বহু মুসলিম দিধায় থাকে, মসজিদে হারামে প্রবেশ করে কি দুই রাকাত সালাত আদায় করব না কি বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করব। যদি কেউ হজ্জ বা উমরার তাওয়াফের নিয়তে মসজিদে হারামে প্রবেশ করে বা কোন নফল তাওয়াফের নিয়তে প্রবেশ করে তবে তার জন্য উত্তম হলো, সালাত আদায় না করে কাবার তাওয়াফ করা। সেক্ষেত্রে আপনি দুই রাকাত সালাত না পড়ে তাওয়াফ করাই যথেষ্ট। কেনানা, মসজিদে হারামের তাহিয়্যা (সম্ভাষণ) হচ্ছে, তাওয়াফ। এই তাওয়াফের মাধ্যমেই আপনার সালাতের কাজ সমাধা হয়ে যাবে। অপর পক্ষে আপনি যদি তাওয়াফের নিয়ত ব্যতীত অন্য নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করেন। যেমনঃ নামাযের জন্য অপেক্ষা, কিংবা কোন দারসে হাযির হওয়া কিংবা অনুরূপ অন্য কোন নিয়তে। সে ক্ষেত্রে মসজিদে হারাম বা অন্য যে কোন মসজিদের প্রবেশের পর পরই বসার আগে দুই রাকাত সালাত আদায় করে নিবেন। এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ থাকার কারণে। সার কথা হলো, তাওয়াফের নিয়ত না থাকলে দু’রাকআত সালাত আদায় না করে মসজিদে কখনো বসবেন না। তবে, জামাআত দাঁড়িয়ে গেলে সরাসরি জামাআতে শরীক হয়ে যাবেন।

আবদুল্লাহ ইব্‌নু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় উপনীত হয়ে হজ্জ বা ‘উমরাহ উভয় অবস্থায় সর্বপ্রথম যে তাওয়াফ করতেন, তার প্রথম তিন চক্করে রামল করতেন এবং পরবর্তী চার চক্করে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চলতেন। তাওয়াফ শেষে দু’ রাক‘আত সালাত আদায় করে সাফা ও মারওয়ায় সা‘ঈ করতেন। (সহিহ বুখারি ১৬১৬)

মন্তব্যঃ আমাদের অনেক মনে করে থাকে যে, মসজিদে হারামে প্রবেশের পর প্রথম সুন্নাহ সমম্ত আমল হলো, বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করা। তারা বিশ্বাস করেন যে, মসজিদে হারামের তাহিয়্যা (সম্ভাষণ) হচ্ছে। তাওয়াফ আদায় করা। অর্থাৎ যে ব্যক্তিই মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে তার জন্য তাওয়াফ করা সুন্নত। অথচ প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি এমন নয়। বরং এক্ষেত্রে মসজিদে হারামও অন্য সকল মসজিদের ন্যায়। তবে পার্থক্য হলো হজ্জ, উমর বা নফল তাওয়াফের নিয়তে থাকলে সালাত আদায় না করেই তাওয়াফ করা।

৭। তাওয়াফের পূর্বে সম্ভব হলে আসওয়াদ চুম্বন করাঃ

আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) বলেন, আমি দেখেছি, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় পৌঁছে যখন হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করতেন, তখন তিনি সাত চক্করের মধ্যে তিন চক্কর দ্রুত পদক্ষেপে সমাধা করতেন। (সহিহ মুসলিম ২৯২০)

৮। মক্কা প্রবেশ কালের ভুলত্রুটিঃ

অনেক হাজী সাহেব মক্কায় প্রবেশের পূর্বে তালবিয়া পাঠ করতে ভুলে যান। অথচ তখনি বেশি বেশি করে তালবিয়া পাঠ করার সময়। আবার অনেক হাজী সাহেব মক্কায় প্রবেশের জন্য নির্দিষ্ট দোয়া পড়ে থাকেন। মক্কা প্রবেশের জন্য নির্দিষ্ট দো‘আ নেই। অনেক হাজী সাহেব একসাথে সমস্বরে তালবিয়া পাঠ করতে থাকেন। এটি সুন্নত পরিপন্থী কাজ। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম ভিন্ন ভিন্নভাবে তালবিয়া পাঠ করেছেন। এ সময় অনেক হাজী সাহেব অপরের সমালোচনা ও দোষ চর্চা করেন, এমন পবিত্র স্থানে যা একেবারেই পরিত্যাজ্য।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “মক্কায় প্রবেশের পূর্বে প্রস্ততি মূলক কাজ

Leave a comment