আশুরা এবং ইহার ভুলভ্রান্তি

আশুরা এবং ইহার ভুলভ্রান্তি প্রথম কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

১। আশুরাঃ

ইসলামি শরীয়তের কিছু পর্ব বা দিবস আছে, যা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কতৃর্ক নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এই সকল দিনে সুন্নাহ মোতাবেগ আমল করলে বহু নেকি পাওয়া যায়। এমনি একটা দিবসের নাম আশুরা। হিজরী সনের প্রথম মাস মহররমের দশ তারিখ আশুরা নামে পরিচিত। মুসলিম উম্মাহর দ্বারে কড়া নাড়ে প্রতি বছর। এ মাস আমাদের স্বরণ করিয়ে দেয় আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হিজরত ও তার দাওয়াতী জিন্দেগী শুরু ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কথা। এ মাসে রয়েছে এমন একটি দিন, দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে যে দিনে নবী মুসা আলাইহিস সালাম এর বিজয় হয়েছিল। পতন হয়েছিল তখনকার সবচেয়ে শক্তিশালী জালেম সম্রাট ফেরাউন ও তার সম্রাজ্যের। সে দিনটিই হল আশুরা বা মুহাররম মাসের দশ তারিখ।

আশুরা একটি আরবী শব্দ। আবরী যে কোন মাসের দশ তারিখের বিশেষণকে আরবিতে বলা হয় আশুরা। আরবীতে আশারা মানে হল দশ। এই আশারা থেকে আশুরা বুঝায়। কিন্তু অনারবদের অধিকাংশের নিকট আশুরা মানে মহররমের দশ তারিখ। মহররম মাসের দশ তারিখকে নির্দিষ্ট করে বলা হয় ‘আশুরায়ে মহররম’। কিছু বিশেষ কারণে এ দিনটি আল্লাহর কাছে খুব প্রিয়, তাই তিনি এ দিনে রোজা পালন ও নফল ইবাদত করায় সওয়াব প্রদান করে থাকেন বহুগুণে। কুরআন মাজিদ ও হাদিস শরিফে মহররম মাস সম্পর্কে যা এসেছে তা হলো এটি অনেক ফজিলতপূর্ণ মাস। কুরানের ভাষায় এটিকে বলা হয় ‘আরবাআতুন হুরুম’ অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম। এ সম্মানিত মাস ৪ টি হল জিলকদ, জিলহজ্জ, মহররম ও রজব। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الشَّهْرِ الْحَرَامِ قِتَالٍ فِيهِ قُلْ قِتَالٌ فِيهِ كَبِيرٌ وَصَدٌّ عَن سَبِيلِ اللّهِ وَكُفْرٌ بِهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِخْرَاجُ أَهْلِهِ مِنْهُ أَكْبَرُ عِندَ اللّهِ وَالْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ الْقَتْلِ وَلاَ يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّىَ يَرُدُّوكُمْ عَن دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُواْ وَمَن يَرْتَدِدْ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُوْلَـئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَأُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

অর্থঃ সম্মানিত মাস (রজব, জিলক্বদ, জিলহাজ্জ ও রজব) সম্পর্কে তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে যে, তাতে যুদ্ধ করা কেমন? বলে দাও এতে যুদ্ধ করা ভীষণ বড় পাপ। আর আল্লাহর পথে প্রতিবন্দ্বকতা সৃষ্টি করা এবং কুফরী করা, মসজিদে-হারা মের পথে বাধা দেয়া এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বহিস্কার করা, আল্লাহর নিকট তার চেয়েও বড় পাপ। আর ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহা পাপ। বস্তুতঃ তারা তো সর্বদাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাতে করে তোমাদিগকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে যদি সম্ভব হয়। তোমাদের মধ্যে যারা নিজের দ্বীন থেকে ফিরে দাঁড়াবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর তারাই হলো দোযখবাসী। তাতে তারা চিরকাল বাস করবে। (সুরা বাকারা ২:২১৭)।

মন্তব্যঃ সম্মানিত মাস হলো চারটি। যথাঃ মহররম, রজব, জিলক্বদ ও জিলহজ। জাহেলী যুগের লোকদের নিকট এই চারটি মাস অত্যন্ত সম্মানিত ছিল। এমনকি এ মাসগুলোতে তারা যুদ্ধবিগ্রহকে হারাম মনে করতো। তাই এগুলোকে সম্মানিত মাস নামে নামকরণ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে নিম্মের হাদিসটি প্রতিধাণ যোগ্য।

আবূ বাকরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন, সে দিন থেকে সময় যেরূপে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেরূপে আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। জিলক্বদ ও জিলহজ ও মুহাররম তিনটি মাস পরপর রয়েছে। আর এক মাস হল রজব যা জুমাদা ও শাবান মাসের মধ্যে অবস্থিত। (হাদিসের মানঃ সহিহ সহিহ বুখারী ২৯৭০ ইফাঃ)

২। আশুরার বৈশিষ্ট ও তার সিয়ামের ফজিলতঃ

আশুরার বৈশিষ্ট ও তার সিয়ামের ফজিলাত সম্পর্কে বিশেষ কিছু লিখব প্রয়োজন নাই সহিহ হাদিসগুলি অধ্যায় করলেই মোটামুটি একটা ধারনা হবে। তাই এ সম্পর্কিত কিছু হাদিস তুলে ধরব শিরোনামসহ উল্লেখ করছি।

৩। আশুরার সিয়ামের পটভূমিঃ

ইসলামে শুরুতে যখন রমজানের সিয়াম ছিলনা। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আশুরার সিয়াম পালন করতেন ও অন্যদের সিয়াম পালনের হুকুম দিতেন। 

হাদিসঃ ইবনু ‘আব্বাস  হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদীনায় গমন করার পর দেখলেন ইয়াহূদীরা ‘আশূরার দিন সিয়াম রাখে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এ দিনটার বৈশিষ্ট্য কি যে, তোমরা সিয়াম রাখো? তারা বলল, এটা একটি গুরুত্ববহ দিন। এ দিনে আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর জাতিকে মুক্তি দিয়েছেন। আর ফিরাউন ও তার জাতিকে (সমুদ্রে) ডুবিয়েছেন। মূসা  আলাইহিস সালাম শুকরিয়া হিসেবে এ দিন সিয়াম রেখেছেন। অতএব তাঁর অনুসরণে আমরাও রাখি। এ কথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ দীনের দিক দিয়ে আমরা মূসার বেশী নিকটে আর তার তরফ থেকে শুকরিয়া আদায়ের ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমরা বেশী হকদার। বস্তুত ‘আশূরার দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও সিয়াম রেখেছেন অন্যদেরকেও রাখার হুকুম দিয়েছেন। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-২০৬৭, বুখারী ১৮৭৮ ইফাঃ, মুসলিম ১১৩০, ইবনু মাজাহ ১৭৩৪, আহমাদ ৩১১২)।

৪। আশুরার সিয়ামের গুরুত্বঃ

রমাজানের সিয়াম ফরজ হওয়ার পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার আশুরার সিয়াম রাখতে আদেশ করেছেন। কিন্তু রমাজানের সিয়াম ফরজ হওয়ার যার যার ইচ্ছা এই সিয়াম পালন করেছেন।

হাদিসঃ আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে ‘আশূরার পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, পরে যখন রমযানের সাওম সিয়াম ফরয করা হল তখন যার ইচ্ছা আশূরার  সিয়াম পালন করত আর যার ইচ্ছা করত না। (সহিহ বুখারি-১৮৭৫, ১৮৭৬ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

হাদিসঃ  ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার (মুহাররম মাসের দশম) দিনে স্বয়ং রোযা রেখেছেন এবং ঐ দিনে সিয়াম রাখতে আদেশ করেছেন। [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৫৯। এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ বুখারী ২০০৪, ৩৩৯৭, ৩৯৪৩, ৪৬৮০, ৪৭৩৭, সহিহ মুসলিম ১১৩০, আবূ দাউদ ২৪৪৪, ইবনু মাজাহ ১৭৩৪, আহমাদ ১৯৭২, ২১০৭, ২১৫৫, ২৬৩৯, ২৮২৭, ৩১০২, ৩১৫৪, ৩২০৩, দারেমী ১৭৫৯

হাদিসঃ জাবির ইবনু সামুরাহ্  হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম প্রথম আমাদেরকে ‘আশূরার দিন সিয়াম রাখার হুকুম দিয়েছেন। এর প্রতি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। এ দিন আসার সময় আমাদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। কিন্তু রমাযানের সিয়াম ফরয হবার পর তিনি আর আমাদেরকে এ দিনের সিয়াম রাখতে না হুকুম দিয়েছেন, না নিষেধ করেছেন। আর এ দিন এলে আমাদের না কোন খোঁজ-খবর নিয়েছেন। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-২০৬৯, মুসলিম ১১২৮, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৯৩৫৮, আহমাদ ২০৯০৮, মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ১৮৬৯, সুনানুল কাবীর লিল বায়হাক্বী ৮৪১৩।

হাদিসঃ রুবায়্যি‘ বিনত মু’আব্বিয (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আশুরার সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের সকল পল্লীতে এ নির্দেশ দিলেনঃ যে ব্যাক্তি সিয়াম পালন করেনি সে যেন দিনের বাকি অংশ না খেয়ে থাকে, আর যার সাওম অবস্থায় সকাল হয়েছে, সে যেন সাওম পূর্ণ করে। তিনি (রুবায়্যি) (রাঃ) বলেন, পরবর্তীতে আমরা ঐ দিন রোযা রাখতাম এবং আমাদের শিশুদের রোযা রাখাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা তৈরী করে দিতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁধলে তাকে ঐ খেলনা দিয়ে ইফতার পর্যন্ত ভুলিয়ে রাখতাম। (সহিহ বুখারি হাদিস নম্বর ১৮৩৬ ইফাঃ)

হাদিসঃ সালামা ইবনু আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলাম গোত্রের এক ব্যাক্তিকে লোকজনের মধ্যে এ মর্মে ঘোষণা দিতে আদেশ করলেন যে, যে ব্যাক্তি খেয়েছে, সে যেন দিনের বাকি অংশে সিয়াম পালন করে আর যে খায় নাই, সে যেন সাওম সিয়াম পালন করে। কেননা আজকের দিন ‘আশূরার দিন। (সহিহ বুখারি-১৮৮১ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

হাদিসঃ আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আশূরার দিনকে ইয়াহুদীগণ ঈদ মনে করত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরাও এ দিনে সিয়াম পালন কর। (সহিহ বুখারি-১৮৭৯ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

হাদিসঃ আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘আশূরার  দিনে কেউ চাইলে সিয়াম পালন করতে পারে। ( সহিহ বুখারি-১৮৭৪ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

৫। আশুরার সিয়ামের ফজিলতঃ

হাদিসঃ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রমাযান (রমজান) মাসের সিয়ামের পরে উত্তম সিয়াম হলো আল্লাহর মাস, মুহাররম মাসের ‘আশূরার সিয়াম। আর ফরয সলাতের পরে সর্বোত্তম সলাত হলো রাতের সলাত (তাহাজ্জুদ)।  (হাদিসের (মান সহিহ মিশকাত-২০৩৯, মুসলিম ১১৬৩, আবূ দাঊদ ২৪২৯, তিরমিযী ৪৩৮, নাসায়ী ১৬১৩)

হাদিসঃ আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি কখনো নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে ‘আশূরার দিনের সিয়াম ছাড়া অন্য কোন দিনের সিয়ামকে এবং এ মাস অর্থাৎ রমাযান ছাড়া অন্য কোন মাসের সিয়ামকে অধিক মর্যাদা দিতে দেখিনি। (হাদিসের মান সহিহ, মিশকাত-২০৪০, বুখারী ২০০৬, মুসলিম ১১৩২, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক্ব ৭৮৩৭, আহমাদ ৩৪৭৫, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৩৯৮।

হাদিসঃ আবূ কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আশুরার দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বললেন, “তা বিগত এক বছরের গুনাহ মোচন করে দেয়।” (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬০। এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ মুসলিম ১১৬২, আহমাদ ২২০২৪, ২২১১৫।

৬। ইহুদীদের সাদৃশ্য না করা ও সিয়াম পালনের দিনঃ

হাদিসঃ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, যখন থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার সিয়াম পালন শুরু করলেন এবং অন্যদেরকেও এ সিয়াম পালনের নির্দেশ দিলেন তখন সাহাবারা রাদিআল্লাহু আনহু বলে উঠলেন, এটা তো ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের সম্মান করার দিন। (একই দিনে সিয়াম পালন করলে আমরা কি তাদের সাদৃশ্য বনে যাবো না?) উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (বেঁচে থাকলে) ইনশাআল্লাহ আগামী বছর (১০ তারিখের সাথে) ৯ তারিখেও সিয়াম পালন করব। (ফলে আমাদের ইবাদত অমুসলিমদের সাথে আর সামঞ্জসপূর্ণ হবে না)। কিন্তু পরবর্তী বছর আসার আগেই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করেছিলেন। (সহিহ মুসলীম ইসলামি ফাউন্ডেশন হাদিস নম্বর ২৫৩৭)

হাদিসঃ আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আগামী বছর যদি আমি বেঁচে থাকি, তাহলে মুহাররম মাসের নবম তারিখে অবশ্যই রোযা রাখব।” (অর্থাৎ নবম ও দশম দু’দিন ব্যাপী রোযা রাখব)।  (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬১। এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ মুসলিম ১১৩৪, আবূ দাউদ ২৪৪৫, আহমাদ ২১০৭, ২৬৩৯, ২৮২৭, ২১০২, ৩১৫৪, দারেমী ১৭৫৯

হাদিসঃ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আগামী বছর যদি আমি বেঁচে থাকি, তাহলে মুহাররম মাসের নবম তারিখে অবশ্যই রোযা রাখব।” (অর্থাৎ নবম ও দশম দু’দিন ব্যাপী রোযা রাখব)। (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৬১। এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ মুসলিম ১১৩৪, আবূ দাউদ ২৪৪৫, আহমাদ ২১০৭, ২৬৩৯, ২৮২৭, ২১০২, ৩১৫৪, দারেমী ১৭৫৯

 মন্তব্যঃ এভাবে বহু হদিস দ্বারা আশুরার সিয়ামের হুকুম ও ফজিলত প্রমানিত। চান্দ্রমাস মুহাররমের দশ তারিখ কে আশুরার দিন বলা হয়। তবে হাদিসের আলোকে বলা যায এই মাসের ৯ ও ১০ তারিখ এ দু’দিন রাখা উত্তম। অথবা ১০ ও ১১ তারিখেও রাখা যায়। শুধুমাত্র ১০ তারিখে রোযা রাখাকে উলামায়ে কিরাম মাকরূহ বলেছেন। এই দিনের সিয়াম পালনের সাথে ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু আনহু’র শহীদ হওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। এই সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পরে আসবে। আশুরার এ দিনটি পূর্ববর্তী যামানার নাবীদের সময় থেকেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও ফযীলতপূণ দিন হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। এ দিনে মূসা আলাইহিস সালাম কে ফিরআউনের হাত থেকে আল্লাহ রক্ষা করেছিলেন। তবে এ দিনের অনেক কাহিনী শোনা যায় যার কিছু হল দুর্বল, আর বেশীর ভাগই তথ্য নির্ভর নয়। এরপরও এ দিনটি আল্লাহর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদা সম্পন্ন।

৭। আশুরা সম্পর্কি জাল বর্ণনাসমূহঃ

কিন্তু খুবই দুঃখের বিষয় জালিয়াতগন এ সম্পর্কেও বহু জাল হাদিস রচনা করেছে। ডক্টর খন্দকর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ এর রচিত “হাদীসের নামে জালিয়াতি” গ্রন্থে থেকে আশুরা সম্পর্কে দুটি জাল হাদিস তুলে ধরছিঃ

জাল হাদিস নম্বরঃ-১

 যে ব্যক্তি মহররমের মাসে রোযা রাখিবে, আল্লাহ তা‘আলা তাহাকে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে ৩০ দিন রোযা রাখার সমান ছওয়াব দিবেন। আরও হাদীছে আছে- যে ব্যক্তি আশুরার দিন একটি রোযা রাখিবে সে দশ হাজার ফেরেশতার, দশ হাজার শহীদের ও দশ হাজার হাজীর ছওয়াব পাইবে। আরও হাদীছে আছে- যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে স্নেহ-পরবশ হইয়া কোন এতীমের মাথায় হাত ঘুরাইবে, আল্লাহতাআলা ঐ এতীমের মাথার প্রত্যেক চুলের পরিবর্তে তাহাকে বেহেশতের এক একটি ‘দরজা’ প্রদান করিবেন। আর যে ব্যক্তি উক্ত তারিখের সন্ধ্যায় রোযাদারকে খানা খাওয়াইবে বা ইফতার করাইবে, সে ব্যক্তি সমস্ত উম্মতে মোহাম্মদীকে খানা খাওয়াইবার ও ইফতার করাইবার ন্যায় ছওয়াব পাইবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলিলেন, যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে রোযা রাখিবে, সে ৬০ বৎসর রোযা নামায করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে। যে ব্যক্তি ঐ তারিখে বিমার পোরছী করিবে, সে সমস্ত আওলাদে আদমের বিমার-পোরছী করার সমতুল্য ছওয়াব পাইবে।… তাহার পরিবারের ফারাগতি অবস্থা হইবে। ৪০ বৎসরের গুনাহর কাফ্ফারা হইয়া যাইবে। (মাও. গোলাম রহমান, মকছুদোল মো’মেনীন, পৃ. ৪৩০-৪৩১। পুনশ্চ: মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৩; অধ্যাপিকা কামরুন নেসা দুলাল, পৃ. ২৯৮-৩০০)।

জাল হাদিস নম্বরঃ-২

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, যে ব্যক্তি মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা রাখিবে, সে ব্যক্তি যেন ১০ হাজার বৎসর যাবত দিনের বেলা রোজা রাখিল এবং রাত্রিবেলা ইবাদতে জাগরিত থাকিল। … মহররম মাসে ইবাদতকারী ব্যক্তি যেন ক্বদরের রাত্রির ইবাদতের ফযীলত লাভ করিল।… তোমরা আল্লাহ তা‘আলার পছন্দনীয় মাস মহররমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিও। যেই ব্যক্তি মহররম মাসের সম্মান করিবে, আল্লাহ তাআলা তাহাকে জান্নাতের মধ্যে সম্মানিত করিবেন এবং জাহান্নামের আযাব হইতে বাঁচাইয়া রাখিবেন… মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখা আদম (আ) ও অন্যান্য নবীদের উপর ফরজ ছিল। এই দিবসে ২০০০ নবী জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং ২০০০ নবীর দোয়া কবুল করা হইয়াছে …। (মুফতী হাবীব ছামদানী, বার চান্দের ফযীলত, পৃ. ১৩)।

মন্তাব্যঃ মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এগুলো সবই বানোয়াট কথা ও জাল হাদিস। (ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/১১২-১১৭; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০৮-১০৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৯-১৫১; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৯৪; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১২৯-১৩০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯৪-৯৫)।

জাল হাদিস নম্বরঃ-৩

একটি হাদিসে বলা হয়েছে: ‘‘যে ব্যক্তি আশূরার দিনে চোখে ‘ইসমিদ’ সুরমা ব্যবহার করবে কখনোই তার চোখ উঠবে না।’’

মন্তব্যঃ এ হাদীসটি একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেক সনদেই অত্যন্ত দুর্বল বা মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস একাধিক সনদের কারণে হাদীসটিকে ‘দুর্বল’ হিসাবে গণ্য করলেও অধিকাংশ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে জাল ও বানোয়াট হিসাবে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন, ইমাম হুসাইনের হত্যাকারীগণ আশুরার দিনে সুরমা মাখার বিদ‘আতটি চালু করেন। এ কথাটি তাদেরই বানানো। কোনো দুর্বল রাবী বেখেয়ালে তা বর্ণনা করেছেন। (ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/১১৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/২১১; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪০১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৫৭; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/৭৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২২২; মাসনূ, পৃ. ১৪১; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৩১-১৩২; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১০০-১০২)।

কয়েকটি জাল বর্ণনাঃ

  • অত্যন্ত দুর্বল সূত্রে কোনো কোনো সাহাবী বা তাবিয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এ দিনে আল্লাহ তা’আলা আদম আলাইহিস সালাম এর তাওবা কবুল করেন।
  • অনির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, এ দিনে নূহ আলাইহিস সালাম এর নৌকা জূদী পর্বতের উপর থামে।
  • অনির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, এ দিনে ঈসা আলাইহিস সালাম জন্মগ্রহণ করেন।
  • মুহার্রাম মাসে বা আশূরার দিনে দান-সাদকার বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ বিষয়ে কিছুই বর্ণিত হয় নি। তবে অত্যন্ত দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য সূত্রে একজন সাহাবী (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আশুরার দিনে সিয়াম পালন করলে যেহেতু এক বছরের সাওয়াব পাওয়া যায়, সেহেতু এ দিনে দান করলেও এক বছরের দানের সাওয়াব পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া এ দিনে দানের বিষয়ে যা কিছু বলা হয় সবই বাতিল ও ভিত্তিহীন কথা।

 

৮। আমরা আশুরা উপলক্ষে কি করিঃ

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বাবস্থা। শরীয়তের ঈমান, আকিদা ও ইবাদাতে কোন প্রকার কমতি রাখা হয় নাই। ইবাদতের বিষয়টিকে আরও বেশী কড়াকড়ি করা হয়েছে। কাজ কিভাবে করলে ইবাদাত হবে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া কেউ বলতে পারবেনা। এখন তিনি নাই, তাই কুরআন সুন্নাহর বাইরে গিয়ে কোন আমল করা যাবে না। কারন সেই আমলের পদ্ধতি কি হবে? কখন করতে হবে? মহান আল্লাহ কতটুকু খুসি হবেন, এ সব বিষয় অহীর উপর নির্ভর করা ছাড়া কোন উপায় নাই। অথচ অহীর দর্জা বন্ধ তাই কুরআন ও সহিহ হাদিসই একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু আশুরার আমলে আমরা মুসলিম জাতীকে পরিস্কার তিনটি দলে ভাগ হয়ে ইবাদত করতে দেখি। সকলে দাবি করছে আমরাই সঠিক পদ্ধতিতে আমল করছি। তিনটি দল হলঃ

১। সালাফি, দেওবন্দী ও আহলে হাদিস (সুন্নী সুমলিম)

২। ব্রেলভী বা পীর, মুরিদী ও মাজার কেন্দ্রিক আমলে বিশ্বাসি (সুন্নী সুমলিম)

৩। শীয়া সম্প্রদায়ের মুসলিম

৯। সালাফি, দেওবন্দী ও আহলে হাদিসগণের আশুরার আমলঃ

উপরের আশুরা কেন্দ্রিক সহিহ হাদিসের যে বর্ণনাগুলি তুলে ধরছি আমার যানা মনে সালাফি, দেওবন্দী ও আহলে হাদিস অনুসারীগণ ঠিক ঐভাবেই আমর করে থাকে। তারা এই দিনকে হাদিসের আলোকে বিচার বিবেচনা করে মহররম মাসের দশ তারিখের সাথে মিলিয়ে দুটি সিয়াম পালন করে।  তাদের কেউ কেউ নয় ও দশ তারিখ সিয়াম পালন করে আবার কেউ কেউ দশ ও এগার তারিখ সিয়াম পান করে। তবে তারা নয় ও দশ তারিখ সিয়াম পালন মুস্তাহাব মনে করে। এদের সমজিদগুলিতে মহররমের প্রথম জুমার খুতবায় এই সম্পর্ক বিস্তারিত আলোচনা করে। এই আলোচনায় সিয়াম পালন সম্পর্কে গুরুত্ব প্রদান করা হয় এবং আশুরায় শীয়া ও ব্রেলভী বা পীর, মুরিদী ও মাজার কেন্দ্রিক আমলে বিশ্বাসিদের সম্পর্কে কঠিক শতর্ক বাণী উচ্চরণ করা হয়।

তারপরও কোন কোন অতি উৎসাহি আলেমকে আশুরার দিনে সমজিদে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করতে দেখা যায়। কেউ কেউ মাহফিরের পর মিলাদ পড়ে ও মিষ্টি বিতরণ করে যদিও এদের মাঝে এই সংখ্যা কম। ইলম চর্চার ফলে সালাফি ও আহলে হাদিসদের মাঝে এই কাজ প্রায় শুন্যের কোটায়। দেওবন্দী ঘরানার আলেমগণও আস্তে আস্তে মিলাদ মাহফিল থেকে বের হয়ে আসছে। কিন্ত দেওবন্দী ঘরানার অনেক আলেমকে আশুরা সম্পর্কে একটি যঈফ হাদিসে উপর আমল করার জন্য উৎসাহ প্রদান করতে দেখা যায়।

হাদিসটি হলঃ হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিন তার পরিবারের উপর সচ্ছলতা দেখাবে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য উক্ত বছরকে সচ্ছল করে দিবেন। (মুজামে ইবনুল আরাবী – ২২৫, আলমুজামুল আওসাত – ৯৩০২, আল- মুজামুল কাবীর – ১০০০৭, শুয়াবুল ঈমান – ৩৫১৩, ৩৫১৫, ৩৫১৬)।

মন্তব্যঃ দেওবন্দী আলেমগনও জানের হাদিসটি যঈফ কিন্তু তারা বলেন ফাজায়েলের ক্ষেত্রে যঈফ হাদিসও গ্রহণ যোগ্য। তাই এই হাদিসের উপর আমল করলে কোন অসুবিধা নাই। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় হল, পরিবারের উপর সাধ্যানুপাতে খরচ করা জায়েজ আছে। বা খরচ করা উচিত। কিন্তু এদিন সম্মিলিতভাবে খিচুরী পাকানো, বিশাল খাবারের আয়োজন করে বিলানো, এসবই খারেজীদের সাথে মিলে যায়। যা সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য ও নাজায়েজ। (মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী, পরিচালকঃ তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা।

সালাফী আলেমদের মতে এ হাদিস মুতাবিক আমল করা যাবে নাঃ

১। ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীল বলেন, হাদীসটি কয়েকটি সনদে বর্ণিত হয়েছে। প্রত্যেকটি সনদই অত্যন্ত দুর্বল। বিভিন্ন সনদের কারণে বাইহাকী, ইরাকী, সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘জাল’ হিসেবে গণ্য না করে ‘দুর্বল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইবনু হাজার হাদীসটিকে ‘অত্যন্ত আপত্তিকর ও খুবই দুর্বল’ বলেছেন। অপরদিকে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল, ইবনু তাইমিয়া প্রমুখ মুহাদ্দিস একে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন যে, প্রত্যেক সনদই অত্যন্ত দুর্বল হওয়ার ফলে একাধিক সনদে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় না। (ইবনু তাইমিয়া, আহাদীসুল কুস্সাস, পৃ. ৭৯, ইবনুল জাওযী, আল-মাওদূ‘আত ২/১১৩-১১৭; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০৯-২১৩; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪২৭; আল-যারকশী, আত-তাযকিরা ৩৪, ১১৮; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৫০-১৫৭; ইবনু রাজাব, লাতাইফ ১/৭৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ২৪৪-২৪৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৩২-১৩৩; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ১০০-১০২।

২। হাদিসটির সকল সূত্র দুর্বল যেমন, প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ইবনে কায়্যিম জাওযী (রহঃ) এ হাদিস সম্পর্কে বলেছেন, তাবারানী হাদিসটি আনাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ সূত্রে হাইছাম ইবনে শাদ্দাখ নামের ব্যক্তি অপরিচিত। এবং উকায়লী বর্ণনা করেছেন আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে। এবং তিনি বলেছেনঃ এ সূত্রে সুলাইমান বিন আবি আব্দুল্লাহ নামের ব্যক্তি অপরিচিত। হাদিসটি সংরক্ষিত নয় আর এ হাদীসের প্রত্যেকটি সূত্র একেবারে বাজে ও খুবই দূর্বল। (আল-মানারুল মুনীফ ফিসসহিহ ওয়াজ যয়ীফ, ইবনে কায়্যিম জাওযী -রহঃ)

মন্তব্যঃ বর্ণিত হাদীসটি রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত সহিহ হাদিসের বিরোধী। সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহূদীরা আশুররা দিনে উৎসব আনন্দ করে। তোমরা তাদের বিরোধিতা করবে, এ দিনে সিয়াম পালন করবে এবং উৎসব বা আনন্দ করবে না। সিয়াম পালন করলে সে দিন কিভাবে ভাল খাবার আয়োজনের প্রশ্ন আসতে পারে? এ বিষয়টির বিবেচনায় হাদিসটি মুনকার। বলা যেতে পারে যে, দিনের বেলা সিয়াম পালন করে তারপর রাতে ভাল খাবারের ব্যবস্থা করলে উভয় হাদিস মোতাবেক আমল করা যায়। না, তা হতে পারেনা। কারণ ইতিপূর্বে আলোচিত সাহাবী আবু মূসা রা. বর্ণিত বুখারী মুসলিমের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, খায়বরের ইহুদীরা এ দিনে আনন্দ-উৎসব ও সচ্ছলতা প্রদর্শন করত রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরোধীতা করে সিয়াম পালন করতে বলেছেন। অর্থাৎ সচ্ছলতা প্রদর্শন (ভাল খাবার ও পোষাক ব্যবহার) করা যাবে না। বরং এর বিরোধীতা করে সিয়াম পালন করতে বলা হয়েছে। যদি এ দিনে ভাল খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয় তবে তা ইহুদীদের সাথে সাদৃশ্য আচরণ বলে গণ্য হবে।

আমলের ফজিলত সম্পর্কিত হাদিস দুর্বল হলেও সর্বক্ষেত্রে তা আমল করা যায় বা হাদিসটি গ্রহণ করা যায় এমন ধারণা ঠিক নয়। তবে হ্যাঁ তার অনুরূপ সহিহ হাদিস পাওয়া গেলে তখন দুর্বল হাদিস তার সনদের দুর্বলতা কাটিয়ে ‘হাসান’ এর স্তরে পৌছে যেতে পারে। তখনই সে হাদিস মুতাবিক আমল করা বা হাদিসটি গ্রহণ করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। কোন প্রমাণিত আমলের ফযীলতের ক্ষেত্রে দূর্বল সূত্রের হাদিস গ্রহণ করা যায়। এর অর্থ এ নয় যে কোন আমল প্রমাণ করার ক্ষেত্রে দূর্বল হাদিস গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু আলোচ্য হাদিসটির বিষয় বস্তুর সমর্থনে কোন সহিহ হাদিস পাওয়া যায় না। আমলের ফজীলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিস গ্রহণযোগ্য’ এ নীতি সম্পর্কে কথা হল যে সকল আমল ও তার ফজীলত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেছে সে সকল আমলের ফজীলতের ক্ষেত্রে যয়ীফ (দুর্বল) হাদিস গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু যে আমলটি কুরআন বা সহিহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিতই হয়নি তার ফজীলত কি ভাবে দুর্বল হাদিস দ্বারা প্রমাণ করা যায়? এটা করলে তো দুর্বল হাদিস দ্বারা শরয়ী ভাবে অপ্রমাণিত একটি আমল প্রমান করা লাযেম (অপরিহার্য) হয়ে যায়। কিন্তু আশুরাতে ভাল খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা সম্পর্কিত আমলটি সহিহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হয়নি। ফলে এ হাদিসটি আমল করতে গেলে দুর্বল হাদিস দ্বারা আমল প্রমাণিত হয়ে যায়, শুধু ফজীলত নয়। অপরদিকে এ হাদিসটি বুখারী মুসলিম বর্ণিত সহিহ হাদীসের খেলাফ। সে হিসেবে হাদিসটি মুনকার বা অগ্রহণযোগ্য।

আর একটি বিষয় প্রতিধান যোগ্য যে, আলোচ্য হাদিসটি যে শুধু মাত্র আমলের ফজিলতের কথা বলে তা নয়। এ হাদিসটি আকিদাহর সাথেও সম্পর্কিত। আর তা হল আশুরাতে আনন্দ-উৎসব করার আকীদাহ ও এর ফলে সাড়া বছর ভাল অবস্থায় থাকার ধারণা। অতএব আকীদাহর ক্ষেত্রে কোন দুর্বল সূত্রের হাদিস গ্রহণ করার কোন অবকাশ নেই।

১০। ব্রেলভী বা পীর, মুরিদী ও মাজার কেন্দ্রিক আমলে বিশ্বাসিদের আশুরার আমলঃ

মুলত ব্রেলভী বা পীর, মুরিদী ও মাজার কেন্দ্রিক আমলে বিশ্বাসিগণই হল উপমহাদেশে বিদআতি আমলের পাওয়ার হাউজ। এই সকল মুসলিম জনসাধারণের দিকে তাকালে আপনি দেখবেন যে, তারা এ আশুরাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের কাজ-কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এবং এ কাজগুলো তারা আশুরার আমল মনে করেই করে থাকে। যেমনঃ

১। আশুরার রাত্রি জাগরণ করে ইবাদাত করে

২। বিভিন্ন প্রকার উন্নত খাবারের ব্যবস্থা করে

৩। ওয়াজ মাহফিল ও আলোচনা সভা করে

৪। মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে

৫। কেউ কেউ পশু জবেহ

৬। কেউ কেউ শীয়দের অনুকরণে ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের স্মরনে প্রতিকৃতি বানায়

৭। অনেকে শোক প্রকাশের জন্য শীয়াদের মত তাযিয়া মিছিল বের করে

কষ্টের ব্যাপার হল, এগুলো বিভ্রান্ত শিয়া ও রাফেজীদের কাজ হলেও দুঃখজনক ভাবে এই বিদআতগুলি আজ সুন্নী নামের কিছু মুসলিম ভাইদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই আমাদের জেনে নিতে হবে কোনটা আশুরা সম্পর্কিত আমল আর কোনটা ভেজাল বা বিদআত। যদি আমাদের আমলগুলো শরীয়ত সম্মত হয় তা হলে তা দ্বারা আমরা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য ও সওয়াব লাভ করতে পারব। আর যদি আমলগুলো শরীয়ত সমর্থিত না হয়, বিদ’আত হয়, তাহলে তা পালন করার কারণে আমরা গুনাহগার হবো। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পরিবর্তে তার থেকে দূরে সরে পড়ব। বর্তমানে এই তরিকার মুসলিমদের মাঝে অনেক আলেম দাবী করে। তারা মাজার কেন্দ্রিক বড় বড় মাদ্রাসও প্রতিষ্ঠা করছে। আমরা আশা করি এরা কুরআন হাদিস নিয়ে প্রতিটি আমলের চুরচেরা বিশ্লষণ করবে এবং কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক আমল করবে। তারা নিজেরাও বিদআতি কাজ থেকে বিরত থাকবে এবং তাদের অনুসারী মুসলিমদেরও বিরত রাখবে।  

১১। শীয়া সম্প্রদায়ের মুসলিমঃ

শীয়া সম্প্রদায়ের লোকদের এই দিনটি খুবই পবিত্র মনে করে। তাদের বিশ্বাস আশুরার দিনে তাদের প্রান প্রিয় ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহ আনহু (শীয়াগন তাদের ইমাম আলাইহিস সালাম কে বলে) এই দিনে কারবালাতে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তারা এ সম্পর্কে এমন সব উদ্ভট আকিদা রাখেন যার সমর্থনে কুরআন বা সহিহ হাদিসের কোন প্রমাণ নেই। তাদের বক্তব্য শুনে মনে হবে বিশ্বের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ আশুরাতে ঘটিয়েছেন ও আগত ভবিষ্যতের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এ আশুরাতে ঘটাবেন। পৃথিবীর সৃষ্টি ও ধংশ সবই নাকি এ দিনে হয়েছে ও হবে। এমন সব উদ্ভট আকিদা তারা রাখে যার প্রমান কোন সহিহ হাদিসে পাওয়া যায় না। তাদের প্রচার প্রসারের ফলে সুন্নী অজ্ঞ মুসলিমও আজ মনে প্রানে এই সকল ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাস করতে শুরু করছে। যদি কোন আলেম এ সম্পর্কে সঠিক ধারনা প্রদান করে তবে তাকে বিভিন্ন ভাবে ভৎষোনা করা হয়। পাঠকদের শতর্ক করার জন্য প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, বহু গ্রন্থের প্রনেতা ডঃ খন্দকর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহর হাদিসের নামে জালিয়াতি কিতাব থেকে নিম্মের জাল বা বানোয়াটি কথাগুলি উল্লেখ করছি।

আশুরায় অতীত ও ভবিষ্যত ঘটনাবলির বানোয়াট ফিরিস্তিঃ মিথ্যাবাদীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে জালিয়াতি করে বলেছেঃ

  • আশুরার দিনে আল্লাহ আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছেন।
  • এ দিনে তিনি পাহাড়, পর্বত, নদনদী…. সৃষ্টি করেছেন।
  • এ দিনে তিনি কলম সৃষ্টি করেছেন।
  • এ দিনে তিনি লাওহে মাহফূয সৃষ্টি করেছেন।
  • এ দিনে তিনি আরশ সৃষ্টি করেছেন।
  • এ দিনে তিনি আরশের উপরে সমাসীন হয়েছেন।
  • এ দিনে তিনি কুরসী সৃষ্টি করেছেন।
  • এ দিনে তিনি জান্নাত সৃষ্টি করেছেন।
  • এ দিনে তিনি জিবরাঈলকে আলাইহিস সালাম সৃষ্টি করেছেন।
  • এ দিনে তিনি ফিরিশতাগণকে সৃষ্টি করেছেন।
  • এ দিনে তিনি আদমকে আলাইহিস সালাম সৃষ্টি করেছেন।
  • এ দিনে তিনি আদমকে আলাইহিস সালাম জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন।
  • এ দিনে তিনি ইদরীসকে আলাইহিস সালাম আসমানে উঠিয়ে নেন।
  • এ দিনে তিনি নূহ আলাইহিস সালাম কে নৌকা থেকে বের করেন।
  • এ দিনে তিনি দায়ূদের আলাইহিস সালাম তাওবা কবুল করেছেন।
  • এ দিনে তিনি সুলাইমান আলাইহিস সালাম কে রাজত্ব প্রদান করেছেন।
  • এ দিনে তিনি আইঊব আলাইহিস সালাম এর বিপদ-মসিবত দূর করেন।
  • এ দিনে তিনি তাওরাত নাযিল করেন।
  • এ দিনে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম জন্মগ্রহণ করেন… খলীল উপাধি লাভ করেন।
  • এ দিনে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নমরূদের অগ্নিকুন্ডু থেকে রক্ষা পান।
  • এ দিনে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কে কুরবানী করা হয়েছিল।
  • এ দিনে ইউনূস আলাইহিস সালাম মাছের পেট থেকে বাহির হন।
  • এ দিনে আল্লাহ ইউসূফকে আলাইহিস সালাম জেলখানা থেকে বের করেন।
  • এ দিনে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান।
  • এ দিনে ইয়াকূব আলাইহিস সালাম ও ইউসূফের আলাইহিস সালাম সাথে সম্মিলিত হন।
  • এ দিনে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছেন।
  • এ দিনে কেয়ামত সংঘঠিত হবে।

কেউ কেউ বানিয়েছে, মুহার্রামের ২ তারিখে নূহ (আ) প্লাবন হতে মুক্তি পেয়েছেন, ৩ তারিখে ইদরীসকে (আ) আসমানে উঠানো হয়েছে, ৪ তারিখে ইবরাহীমকে (আ) অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। (হাদিসের নামে জালিয়াত, ডঃ খন্দকর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর)

এই সলক মিথ্যা অমুলক কথা মালার সাথে তারা ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এর শাহাদাতের কথা যোগ করে থাকে। তারা দাবি করে এই সকল ঘটনার সাথে আশুরার দিনের যেমন সম্পর্ক আছে। ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু শাহাদাতেরও তেমনি সম্পর্ক আছে। তাই শীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা আশুরা মানে শুধু শুধুমাত্র কারবালাল হৃদয় বিদারক ঘটনাকেই বুঝে তাকে। তাদের সাথে মিডিয়ার প্রচারের ফলে বর্তমানে আমরা দেখছি প্রায় সর্ব মহল থেকে আশুরার মূল বিষয় বলে কারবালার ঘটনাকেই বুঝানো হচ্ছে। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সঠিক নয়। ইসলামের আগমনের পূর্বে আশুরা ছিল। যেমন আমরা হাদিস দ্বারা জানতে পেরেছি। তখন মক্কার মুশরিকরা যেমন আশুরার সিয়াম পালন করত তেমনি ইহুদীরা মুছা আলাইহিস সালাম এর বিজয়ের স্মরণে আশুরার সিয়াম পালন করত। আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার সিয়াম পালন করেছেন জীবনের প্রতিটি বছর। তার ইন্তেকালের পর তার সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) আশুরা পালন করেছেন।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment