সিয়ামরত অবস্থায় আমলসমূহ (দ্বিতীয় পর্ব)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

যে আমলগুলি রমাজান মাসের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়

১। নফল সালাতের পাবন্দি করা

রমজান মাসে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের পাশাপাশি তারাবী ও তাহাজ্জুদ আদায় করলে সালাতের হক আদায় হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ। তার পর সময় ও স্থানের সাথে কিছু সালাত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  দ্বারা প্রমানিত। সেই সালাতসমূহ ও আদায় করা। যেমনঃ ইশরাক, আওয়াবীন, সালাতুত দ্বোহা, সাশত, তাহিয়াতুল মাসজিদ, তাহিয়াতুল অজু ইত্যাদি।

২। তওবা, দুয়া ও কান্নাকাটি করাঃ

দুয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এ জন্য এই বরকত পূর্ণ মাসে বেশি বেশি দুয়া করা ও আল্লাহর নিকট বেশি বেশি কান্নাকাটি করা। এ মাসে মহান আল্লাহ বহু জাহান্নামী মানুষকে ক্ষমা করে দেন। কাজেই আমারা তার নিকটি বার বার জাহান্নাম থেকে পানহ চেয়ে দুয়া করব। যেমন সহিহ হাদিসে এসেছে, আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন রমাযান (রমজান) মাসের প্রথম রাত হয়, শয়তান ও অবাধ্য জীনদেরকে বন্দী করা হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহকে বন্ধ করে দেয়া হয়। এর একটিও খোলা রাখা হয় না। এদিকে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। একটিও বন্ধ রাখা হয় না। আহবানকারী (ফেরেশতা) ঘোষণা দেন, হে কল্যাণ অনুসন্ধানকারী! আল্লাহর কাজে এগিয়ে যাও। হে অকল্যাণ ও মন্দ অনুসন্ধানী! (অকল্যাণ কাজ হতে) থেমে যাও। এ মাসে আল্লাহ তা‘আলাই মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করেন এবং এটা (রমজান মাসের) প্রত্যেক রাতেই হয়ে থাকে। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত -১৯৬০, তিরমিযী ৬৮২, ইবনু মাজাহ ১৬৪২, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ১৮৮৩, মুসতাদারাক লিল হাকিম ১৫৩২, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৫০১, সহীহ ইবনু হিববান ৩৪৩৫, সহীহ আল জামি‘ ৭৫৯)।

মন্তব্যঃ রমজান মাসে মহান আল্লাহর নিকট বার বার দুয়া করে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।

৩। নেক আমল, কল্যাণকর কাজ ও সৎকর্ম বেশি বেশি করাঃ

নেক আমল, কল্যাণকর কাজ ও সৎকর্মে অগ্রগামী হওয়া, প্রতিযোগিতা করা মহান আল্লাহর একটি নির্দেশ। ইসলামী জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আর রমজান মাসে নেক আমল, কল্যাণকর কজের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

*فَاسْتَبِقُواْ الْخَيْرَاتِ أَيْنَ مَا تَكُونُواْ يَأْتِ بِكُمُ اللّهُ جَمِيعًا*

অর্থঃ কাজেই সৎকাজে প্রতিযোগিতামূলকভাবে এগিয়ে যাও। যেখানেই তোমরা থাকবে, আল্লাহ অবশ্যই তোমাদেরকে সমবেত করবেন। ( সুরা বাকারা ২:১৪৮)

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা সৎকাজে দ্রুত অগ্রসর হও। শীঘ্রই অন্ধকার রাতের মত ফেতনা দেখা দিবে। তখন অবস্থা এমন হবে যে, সকাল বেলা একজন মানুষ মুমিন থাকবে আর সন্ধ্যায় কাফের হয়ে যাবে। আবার সন্ধ্যায় মুমিন থাকবে সকালে কাফের হয়ে যাবে। তারা পার্থিব সামান্য স্বার্থে নিজের ধর্ম বিক্রি করে দিবে।’ (বর্ণনায়, সহিহ মুসলিম)

মন্তব্যঃ রমজানে মাসই হল ইবাদতের মৌসুম, কেননা এ মাসের আমল মহান আল্লাহ নিকট খুই প্রিয় এবং এ মাসে আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব বৃদ্ধি করা হবে। এ মাসের একটি ভাল আমল অন্য যে কোন মাসের চেয়ে অনেক বেশি উত্তম। সেজন্য যথাসম্ভব বেশি বেশি ভাল কাজ করতে হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘এ মাসের প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে আহবান করতে থাকে যে, হে কল্যাণের অনুসন্ধানকারী তুমি আরো অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের পথিক, তোমরা অন্যায় পথে চলা বন্ধ কর। (তুমি কি জান?) এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তায়ালা কত লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন’’। (সুনান আত-তিরমিযী : ৬৮৪)।

৪। বেশি বেশি দান-সদাকাহ করাঃ মহান আল্লাহ বলেনঃ

وَأَنفِقُوا مِن مَّا رَزَقْنَاكُم مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَى أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُن مِّنَ الصَّالِحِينَ

অর্থঃ আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় কর। অন্যথায় সে বলবেঃ হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। (সুরা মুনাফিক্বুন ৬৩:১০)।

আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমাদানে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত। (সহিহ বুখারি তাওহীদ প্রকাশলী হাদদদদিস নম্বর ১৯০২)।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, কোন ধরনের দান-সদকায় বেশী সওয়াব লাভ করা যায় ? তিনি বললেন, তোমার এমন অবস্থায় সদকা করা যে তুমি সুস্থ, সম্পদের প্রতি চাহিদা আছে, দরিদ্রতার ভয় করছ ও সচ্ছলতার আশা করছ। আর এমনভাবে বিলম্ব করবে না যে, যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যাবে তখন বলবে এটা অমুকের জন্য, ওটা অমুকের জন্য। অথচ তা অমুকের জন্য নির্ধারিত হয়েই আছে। (সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম)

মন্তব্যঃ এ মাসে বেশি বেশি দান-সাদাকাহ করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। কেননা আমাদের প্রিয় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে বেশী বেশী দান করতেন। আমাদের সমাজে যারা ইয়াতীম, বিধবা ও গরীব মিসকীন আছে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করা। হিসাব করে এ মাসে যাকাত দেয়া উত্তম কিন্তু এ মাসেই দিতে হবে এমনটি নয়।

৫। আল্লাহর যিকর করাঃ

 আল্লাহর জিকির সবচেয়ে বড় ও সর্বোত্তম ইবাদত। কেননা আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করা হচ্ছে ইবাদতের আসল লক্ষ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ

অর্থঃ আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কর। (সুরা আনকাবুত ২৯:৪৫)।

 আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيراً وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا

অর্থঃ এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী, এদের জন্য আল্লাহ রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান। (সূরা আহযাব ৩৩:৩৫)।

আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন এক আমল সম্পর্কে অবহিত করব না, যা তোমাদের অধিপতির নিকট সবচেয়ে উত্তম ও পবিত্র, এবং তোমাদের মর্যাদা অধিক বৃদ্ধিকারী, এবং তোমাদের জন্য স্বর্ণ-রূপা দান করা ও দুশমনের মুখোমুখি হয়ে তোমরা তাদের গর্দানে বা তারা তোমাদের গর্দানে আঘাত করার চেয়ে উত্তম? তারা বলল, হ্যাঁ ইয়া রাসূলুল্লাহ! তিনি বললেনঃ জিকরুল্লাহ (আল্লাহর জিকির বা স্মরন)।  (তিরমিজি -৩২৯৯)।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ইয়াহইয়া বিন জাকারিয়া আলাইহিস সালাম ইসরাঈলদেরকে বলেছেনঃ আমি তোমাদেরকে আল্লাহর জিকিরের আদেশ দিচ্ছি, কারণ এর তুলনা এমন এক ব্যক্তির ন্যায় যার পিছনে দুশমন দৌড়ে তাড়া করে ফিরছে, সে সুরক্ষিত দুর্গে প্রবেশ করে নিজকে রক্ষা করেছে। অনুরূপ, বান্দা আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে শয়তান থেকে সুরক্ষা পায়। (আহমদ:২৭৯০)

রমজানে আমরা যে সকল ইবাদাত করি ইহাও জিকিরের মধ্যে অন্তরভূক্ত। যেমনঃ সালাত কায়েম, জাকাত প্রদান, পিতা-মাতার সাথে অমায়িক আচরণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা, জ্ঞানার্জন ও অপরকে শিক্ষাদান-ইত্যাদি। কেননা, সৎকর্মের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহকে স্মরণ করা। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

 إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي

অর্থঃ আমিই আল্লাহ আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম কর। (সুরা ত্বা-হা ২০:১৪)।

মন্তব্যঃ জিকির অন্তর দ্বারা হতে পারে, জিহ্বা দ্বারা হতে পারে বা এক সঙ্গে উভয়টা দ্বারাও হতে পারে। নিজেস্ব কাজের ও ইবাদতের ফাঁকে ফাঁকে জিকির করে রমজানের পুরসময়টা কাজে লাগাতে পারি।  

মৌখিক জিকির হলোঃ যেমন তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ ও তাকবীর ইত্যাদি পড়া, যা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। আবার দুয়া করাও মৌখিক জিকির, কেননা এ-দ্বারা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ হয়, ইহকাল ও পরকালের প্রয়োজন পূরণ হয়। আমারা  স্থান কাল ভেদে যে দুয়া করে কাজ সম্পাদন করি এই সকল মাসনুন দুয়া ও জিকিরের অন্তরভূ্ক্ত।

অন্তরের জিকিরঃ অন্তর দিয়ে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করা। এটা অন্যতম বড় জিকির। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ  

الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىَ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

অর্থঃ যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষযে, (তারা বলে) পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও। (সুরা ইমরান ৩:১৯১)।

মন্তব্যঃ রমজান মাসে মহান আল্লাহর খুসির জন্য যা আমল করছি সবই জিকিরের অন্তরভূক্ত। কিন্তু তার পরও দুনিয়া নির্বাহের কোন কাজ ব্যস্ত থাকা কালিন যেমনঃ রিক্সা চালনা কালিন, ব্যবসা করার সময়, রান্না করার সময় মহান আল্লাহর স্মরণ করতে পারি। আবার কাজ শুরু ও শেষ করা দুয়া পড়ে পড়ে মহান আল্লাহর স্মরণ করতে পারি। একা একা কাজ করছি বা হাঁটছি তখনও দুয়া বা জিকির করতে পারি। এভাবে রমজানের প্রতিটি মুহুর্ত কাজে লাগাতে পারি।

৬। অপরকে খাদ্য খাওয়ানোঃ

বর্তমানে এমনও অসহায় মানুষ আছে যারা ঠিকমত খেতে পায় না। আমি পেশাদার ভিকারীদের কথা বলছিনা। আপনার চার পাশে এমন অনেক বিধবা, এতিম, অসহায়, দুস্থ নারী, বয়স্কা অসুস্থ নর নারীর অভাব নেই। প্রয়োজন শুধু একটু চোখ তুলে তাকান। রমজান মাসে এই সকল লোকদের খাওয়ানো, বিশেষ করে সিয়াম পালনকারী গরীব, অসহায়কে খাদ্য খাওয়ানো বিরাট সাওয়াবের কাজ। মহান আল্লাহ বলেনঃ

أَرَءَيۡتَ ٱلَّذِى يُكَذِّبُ بِٱلدِّينِ (١) فَذَٲلِكَ ٱلَّذِى يَدُعُّ ٱلۡيَتِيمَ (٢) وَلَا يَحُضُّ عَلَىٰ طَعَامِ ٱلۡمِسۡكِينِ (٣)

অর্থঃ সে সেই ব্যক্তি, যে এতীমকে গলা ধাক্কা দেয়। আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচারদিবসকে মিথ্যা বলে? এবং মিসকীনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না। (সুরা মাউন ১০৭:১-৩)।

মহান আল্লাহ বলেনঃ

وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا

অর্থঃ (তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও) তারা আল্লাহর ভালবাসায় অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীকে খাবার দান করে। (সূরা আদ-দাহর ৭৬:৮)।

এ বিষয়ে হাদীসে বলা হয়েছে: ‘‘আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, একজন লোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইসলামে উত্তম কাজ কোনটি? তিনি বললেন, অন্যদেরকে খাবার খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া। (সহীহ আল-বুখারী হাদিস নম্বর ২৭ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

মন্তব্যঃ রমজান মাসে আমরা সকলেই খাবারের প্রতি একটু ঝুকে পড়ি। এই জন্য এ মাসে আরব দেশের ব্যবসাই সম্প্রদায় জিনিস পত্রের দাম কমিয়ে দেয় আর আমাদর ব্যবসাই সম্প্রদায় জিনিস পত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে একে বারে নিম্ম শ্রেণীর লোক জন্য খাবার ক্রয় করে ঠিক মত পরিবেশন করা কষ্ট সাধ্য হয়ে যায়। তাই যারা সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করে তাদের উচিৎ এই অসহায় বিধবা, এতিম, দুস্থ নারী, বয়স্কা ও অসুস্থ নর নারীর খাবারে ব্যবস্থা করা। এতে রমজানের মহিমা আরও বৃদ্ধি পাবে আর দাতাগণ আদায় করে নিতে পারে মহান আল্লাহ সন্ত্বষ্টি। 

৭। আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নীত করাঃ

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,

*وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُونَ سُوءَ الْحِسَابِ*

অর্থঃ এবং যারা বজায় রাখে ঐ সম্পর্ক, যা বজায় রাখতে আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন এবং স্বীয় পালনকর্তাকে ভয় করে এবং কঠোর হিসাবের আশঙ্কা রাখে।(সূরা রাদ ১৩:২১]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا﴾

অর্থঃ ‘আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক।’[সূরা আন-নিসা : ০১]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ ﴾

অর্থঃ এবং যারা আল্লাহর অঙ্গীকারকে দৃঢ় ও পাকা-পোক্ত করার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ যে, সম্পর্ক বজায় রাখতে আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে, ওরা ঐ সমস্ত লোক যাদের জন্যে রয়েছে অভিসম্পাত এবং ওদের জন্যে রয়েছে কঠিন আযাব। ( সুরা রা’দ ১৩:২৫)।

এসব আয়াত থেকে আমরা সুস্পষ্ট বুঝতে পারি আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আত্মীয়তা-সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এ সম্পর্ক ক্ষুণ্ন করতে নিষেধ করেছেন। হাদিস মাধ্যমে জানা যায় এ সম্পর্ক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুবই গুরুত্ব প্রদান করেছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কামনা করে তার রিজিক প্রশস্ত হোক এবং তার আয়ু দীর্ঘ হোক সে যেন আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখে। (সহিহ বুখারী ৫৯৮৫ তাওহীদ প্রকাশনী; সহিহ মুসলিম – ৪৬৩৯)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহিহ বুখারী ৬৬৮৫ তাওহীদ প্রকাশনী; সহিহ মুসলিম -: ৪৬৩৭)।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি জীবের সৃজন কাজ শুরু করেন। যখন তিনি এ কাজ সমাপ্ত করেন, আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলে উঠল, ‘এটি আপনার কাছে আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্নকারীর আশ্রয়স্থান’। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, ‘হ্যা, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও, যে তোমাকে জুড়ে রাখবে আমিও তার সঙ্গে জুড়ে থাকবো আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে আমিও তাকে ছিন্ন করবো?’ আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলল, ‘জি হ্যা, হে আমার রব’। তিনি বললেন, ‘এটা শুধু তোমার জন্য’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা চাইলে এ আয়াত পড়ে দেখ,

﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ﴾

অর্থঃ ‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে?’ (সূরা মুহাম্মদ ৪৭:২২; হাদিসটি সহিহ বুখারী তাওহীদ প্রকাশনী থেকে নেয়া হয়েছে হাদিস নম্বর- ৫৯৮৭)।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় আমার আম্মা মুশরিক থাকতে একবার আমার কাছে আগমন করলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী, আমি কি আমার আম্মার সাথে সম্পর্ক রাখবো? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যা, তুমি স্বীয় মাতার সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখো। (সহিহ বুখারী ২৬২০ তাওহীদ প্রকাশনী; সহিহ মুসলিম -২৩৭২)।

মন্তব্যঃ আমাদের অনেকের সাথেই  আত্মীয়তা-স্বজনদের সম্পর্ক ভাল না। রমজান মাসে দুষ্ট ইবলীশ শয়তান আটকা থাকে এবং আমাদের সকলের মন নরম থাকে বিধায় এই মাসে তওবা করে আত্মীয়তা-স্বজনদের সম্পর্ক উন্নতি করা উচিৎ। আমরা অনেক হয়তো জানীনা যে, আত্মীয়তা-সম্পর্ক এমন এক বিষয় যার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা মানুষের রিজিক বাড়িয়ে দেন, হায়াত দীর্ঘ করেন, এবং মানুষের ধন-সম্পদে বরকত দেন। আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলতে বুঝানো হয়, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে এবং এসবের উর্ধ্বতন ও নিম্নতন আত্মীয়। সমাজ এখন এত কঠিন হয়েছে যে, কেউ আর আত্মীয় স্বজনদের খবর নেয় না। আমরা কি আত্মীয়তা-সম্পর্কই ঠিক রাখি? প্রায় অধিকাংশের উত্তর হবে? না, খবব নেই না। কারন সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝিনা। তাই আপনি যদি ঈমানদার মুসলিম হন এবং মহান আল্লাহর ক্ষমা পেয়ে জান্নাতে যেতে চান। আজই আত্মীয়তা-স্বজনদের সাথে আমরা সম্পর্ক ঠিক করে নেই। হে আল্লাহ! আমাদের আত্মীয়তা-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক ভাল রাখার তৌফিক দাও। আমিন।।

৮। ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করাঃ

ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করা। এটি একটি বিরাট সাওয়াবের কাজ। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম পক্ষ থেকে হাদিস এসেছে। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ফজরের ছালাত জামাতে পড়ে, অতঃপর সূর্য ওঠা পর্যন্ত আল্লাহর যিকরে বসে থাকে, অতঃপর দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে, তার জন্য পূর্ণ একটি হজ্জ ও উমরাহর নেকী হয়। (তিরমিযী-৫৮৬, মিশকাত -৯৭১)।

হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করে স্বীয় স্থানে বসে থাকে, তার জন্য ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। তারা এভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, হে আল্লাহ, তাকে ক্ষমা করুন; হে আল্লাহ, তার প্রতি দয়া করুন। (মুসনাদে আহমদ)।

মন্তব্যঃ যারা চাকুরিজীবি তাদের পক্ষে অফিস বন্ধ ছাড়া রমজান মাসে এই আমল করা খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু যাদের কাজ কর্ম একটু কম থাকে বা যারা নিজেস্ব ব্যাবসা চালান বা নিজেস্ব ফার্মে কাজ কলেন তারা একটু ইচ্ছা করলেই রমজান মাসে এই আমলটি করতে পারে।

৯। সামর্থ্য থাকলে উমরা পালন করাঃ

রমজান মাসে উমরা পালনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জের সমান সওয়াব বলে উল্লেখ করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জ থেকে ফিরে এলেন, উম্মে সিনান নামের আনসারি মহিলা সাহাবিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীসে তোমাকে হজ্জ পালনে বাধা প্রদান করেছিল?’ তিনি জবাবে বললেন, ‘অমুকের বাবা (নিজ স্বামী)। তার পানি টানার দুটি উট আছে, একটিতে সওয়ার হয়ে তিনি হজ আদায় করতে গেছেন, আর অপরটি আমাদের জমিতে পানি সিঞ্চনের কাজে আটক আছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তবে মনে রেখো! রমজান মাসে উমরা আদায় করলে আমার সঙ্গে হজ আদায় করার সমান মর্যাদা পেতে পার।’ শব্দের কিছুটা ভিন্নতায় অপর বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই মহিলা সাহাবিকে বলেছিলেন, ‘রমজান মাস এলে তুমি ওমরা করে নিও। কেননা রমজান মাসে ওমরা করা হজের সমান মর্যাদা রাখে।’ (সহিহ বুখারী ১৮৬৩; সহিহ মুসলিম ২৯২৮)। 

উমরা পালনের ফজিলত সম্পর্কিত আরও কয়েকটি নিম্মে উল্লেখ কর হলোঃ

১. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা হজ ও উমরা আদায় কর। কেননা হজ ও ওমরা দারিদ্র্য এবং গোনাহ দূর করে দেয় ঠিক সেভাবে, যেভাবে হাপরের আগুন লোহা, স্বর্ণ ও রুপা থেকে ময়লা দূর করে দেয়।’ (তিরমিজি, হজ অধ্যায় : ৮১০)।

২. আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘একটি ওমরা পরবর্তী ওমরা পর্যন্ত মাঝখানের গোনাহগুলোর জন্য কাফফারাস্বরূপ।’ (সহিহ বুখারী ১৭৭৩; সহিহ মুসলিম ৩১৮০)। 

৩। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীয়ে আকরাম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদকারী, হজ পালনকারী এবং ওমরা পালনকারী তারা সবাই আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহ তাদের ডাক দিয়েছেন, তারা সেই ডাকে সাড়া দিয়েছে। সুতরাং তারা আল্লাহর কাছে যা কিছু প্রার্থনা করবে, আল্লাহ অবশ্যই তাদের তা প্রদান করবেন।’ (ইবনে মাজাহ : ২৮৯৩)।

মন্তব্যঃ উমরা পালন সব সময়ই সওয়াবের কাজ। আর হাদিসগুলোর মাধ্যমে আমরা তা জানতে পারলাম যে, রমজান মাসে উমরা পালন করা খুবই তাৎপর্যপূর্ন ইবাদত। অপর পক্ষে এই আমল রমজান মাসে পালন করার ফলে ইহার সওয়াব নিঃসন্দেহে সত্তর থেকে সাতশ গুণ বা বহুগুণ বৃদ্ধি হয়ে অফুরন্ত সওয়াব হয়ে যাবে। উপরন্তু একাধিক হাদিসে রমজান মাসে ওমরা পালন করার জন্য আলাদা ফজিলতের বর্ণনাও এসেছে।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment