সফরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানঃ দ্বিতীয় কিস্তি

সফরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানঃ দ্বিতীয় কিস্তি

সালাত জমা করার বিধান

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

সফরের কষ্টের কথা বিবেচনা করে ইসলাম সফর বা ভ্রমণকারীর জন্য ইসলামী বিধানে কিছুটা রুখসত বা ছাড় দিয়েছে। সালাত মহান আল্লাহ এমন এক আদেশ যাকে কোন অবস্থায়ই পরিত্যাগ করা যাবে না, তাই সে সফরে থাকুক আর বাড়িতে থাকুন। কিন্তু মহান আল্লাহ সফরের সময় সালাতের ব্যাপারে আমাদের প্রতি কিছুটা সহনশীলতা প্রদর্শণ করেছেন। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হওয়া সত্বেও সফর বা ভ্রমণকরীর জন্য চার রাকআত বিশিষ্ট সালাতকে কসর করে বা কমিয়ে দুই রাকআত করেছেন। শুধু সালাত নয় সফরে আরও কয়েকটি হুকুমের ব্যাপারে মহান আল্লাহ কিছুটা ছাড় বা রুখসত প্রদান করেছেন। সফরে থাকা কালিন সময়ে সফরকারিকে মুসাফির বলা হয়। মুসাফির ব্যক্তি সব সময় চারটি রুখসত বা ছাড়ের অধিকারী হবে। সে চারটি রুখসত হলঃ

১। সালাতকে কসর করে আদায়

২। সালাতকে জমা করা।

৩। সফরে তিন দিন ও তিন রাত্রি পর্যন্ত মোজার উপর মাসেহ করা

৪। সফর অবস্থায় রমযানের সিয়াম ভঙ্গ করা

২.৯.১। সালাত জমা করাঃ

সালাত জমা করার অর্থ হল দুই ওয়াক্তের সালাত কে একত্রে আদায় করা। অর্থাৎ যুহর ও আসরের এবং মাগরিব ও ইশার সালাত একত্রে আদায় করা। মুসল্লী আসরের সালাত এগিয়ে এনে যোহরের সময়ে প্রথম যোহর তারপর আসর আদায় করবে। অথবা যোহরকে এমনভাবে দেরী করা যে যোহরের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাবে, তারপর আসরের ওয়াক্ত আসলে প্রথমে যোহর আদায় করে তারপর আসরের সালাত আদায় করা। অনুরূপভাবে মাগরিব ও ইশার ক্ষেত্রেও যোহর ও আসরের মত আদায় করা। অর্থাৎ মাগরিবের সময়ে ইশাকে এগিয়ে এনে প্রথমে মাগরিব তারপর ইশার সালাত আদায় করবে। অথবা মাগরিবকে এমনভাবে পিছিয়ে দিবে যে মাগরিবের সময় শেষ হয়ে যাবে, তারপর ইশার ওয়াক্ত হলে সেখানে প্রথমে মাগরিব আদায় করে তারপর ইশার সালাত আদায় করে নিবে।

আরাফা ও মুজদালিফায় সালাত জমা করাঃ

হাজিরা আরাফাতের ময়দানের জোহর ও আসরের একত্রে আদায় করে। আবার মুজদালীফায় মাগরিব ও ইশার সালাত একত্রে আদায় করে। তবে ফজরের সাথে কোন সালাত একত্র জমা করা যাবে না, ঠিক তেমনি মাগরিবের সাথে আসরের সালাত ও জমা করা যাবে না।

ইব্‌নু উমর (রাঃ) ইমামের সাথে সালাত আদায় করতে না পারলে উভয় সালাত একত্রে আদায় করতেন।

যে বছর হাজ্জাজ ইব্‌নু ইউসুফ ইব্‌নু যুবাইরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, সে বছর তিনি ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরাফার দিনে উকূফের সময় আমরা কিরূপে কাজ করব? সালিম (রহঃ) বললেন, আপনি যদি সুন্নাতের অনুসরণ করতে চান তাহলে ‘আরাফার দিনে দুপুরে সালাত আদায় করবেন। ‘আবদুল্লাহ ইব্‌নু ‘উমর (রাঃ) বলেন, সালিম ঠিক বলেছে। সুন্নাত মুতাবিক সাহাবীগণ যুহর ও ‘আসর এক সাথেই আদায় করতেন। (বর্ণনাকারী বলেন) আমি সালিমকে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কি এরূপ করেছেন? তিনি বললেন, এ ব্যাপারে তোমরা কি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত ব্যতীত অন্য কারো অনুসরণ করবে? (সহিহ বুখারি ১৬৬২

ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দ্রুত সফর করতেন, তখন মাগরিব ও ইশা একত্রে আদায় করতেন। ইবরাহীম ইবনু তাহমান (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সফরে দ্রুত চলার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুহর ও আসরের সালাত একত্রে আদায় করতেন আর মাগরিব ইশা একত্রে আদায় করতেন। আর হুসাইন (রহঃ)

আনাস ইবনু মলিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরকালে মাগরিব ও ইশার সালাত একত্রে আদায় করতেন এবং আলী ইবনু মুবারকও হারব (রহঃ) আনাস (রাঃ) থেকে হাদীস বর্ণনায় হুসাইন (রহঃ) এর অনুসরণ করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একত্রে আদায় করেছেন। (সহীহ বুখারী ১০৪২ ইফাঃ)।

আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখেছি যখন সফরে তাঁকে দ্রুত পথ অতিক্রম করতে হত, তখন মাগরিবের সালাত এত বিলম্বিত করতেন যে মাগরিব ও ইশা একত্রে আদায় করতেন। সালিম (রহঃ) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) ও দ্রুত সফরকালে অনুরূপ করতেন। তখন ইকামতের পর মাগরিব তিন রাকা’আত আদায় করতেন এবং সালাম ফিরাতেন। তারপর অল্প সময় অপেক্ষা করেই ইশা-এর ইকামাত দিয়ে তা দু’রাকা’আত আদায় করে সালাম ফিরাতেন। এ দু’য়ের মাঝে কোন নফল সালাত আদায় করতেন না এবং ইশার পরেও না। অবশেষে মধ্যরাতে (তাহাজ্জুদের জন্য) উঠতেন। (সহীহ বুখারী ১০৪৩ ইফাঃ)

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে এ দু’সালাত একত্রে আদায় করতেন অর্থাৎ মাগরিব ও ইশা। (সহিহ বুখারী  ১০৪৪ ইফাঃ)।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য ঢলে পড়ার আগে সফর শুরু করলে আসরের ওয়াক্ত পর্যন্ত, যুহর বিলম্বিত করতেন এবং উভয় সালাত একত্রে আদায় করতেন। আর (সফর শুরু করার আগেই) সূর্য ঢলে গেলে যুহর আদায় করে নিতেন। এরপর (সফরের উদ্দেশ্যে) আরোহণ করতেন। (সহীহ বুখারী  ১০৪৫ ও ১০৪৬ ইফাঃ)।

যুদ্ধের সময় দুই সালাত একত্রে আদায়ঃ

সাঈদ ইবনু যুবায়র (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনু আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুকের যুদ্ধে সফরকালে যুহর ও আসর এবং মাগরিব ইশা একত্রে আদায় করেন। সাঈদ বলেন, আমি ইবনু আব্বাস (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁকে তা করতে কিসে উদ্বুদ্ধ করেছিল? তিনি বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য তার উম্মাতকে কষ্টে না ফেলা। (সহিহ মুসলিম ১৫০৩ ইফাঃ)

মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুকের যুদ্ধের সময় যোহর ও আসর এবং মাগরিব ও ইশার সালাত একত্রে আদায় করেন। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তার এইরূপ করার কারণ কি? তিনি বলেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর উম্মাতকে কষ্ট না দেওয়া। (সহিহ মুসলিম ১৫০৫ ইফাঃ)

উপরের হাদিস দ্বারা বুঝা যায় বিভিন্ন কারনে সালাত জমা করা যায়। তবে সালাত জমা করা অন্যতম কারন হিসাবে সফরকে ধরা হলেও একমাত্র কারন নয়। মুসফির যে কারনে সালাত কসর করে ঠিক সেই কারনে সালাত জমা করা বৈধ। হাদিসের আলোকে দেখতে পাই যে কোন সংকটের কারনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত জমা করেছেন। যেমনঃ তিনি যুদ্ধের সময় দুই সালাত একত্রে আদায় করছেন। বৃষ্টির কারণে যদি মসজিদে যেতে কষ্ট হয়, তবে দু’নামাযকে একত্রিত করা যাবে। ঠিক তেমনি ভাবে, শীতকালে যদি কঠিন ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হয় এবং সে কারণে মসজিদে যাওয়া কষ্টকর হয় তবে দু’নামাযকে একত্রিত করবে। নিজের মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে তবে দু’নামাযকে একত্রিত করবে। এছাড়া এ ধরণের আরো কোন কঠিন সমস্যার সম্মুখিন হলে দু’নামাযকে একত্রিত করবে।

এমন কি মুকিম অবস্থায়ও যে কেউ চাইলে সালাত জমা করতে পারে। যেমনঃ

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফর অথবা ভয়-ভীতি ছাড়াই মদিনায় যুহর ও আসরের সালাত একত্রে আদায় করেছেন। আবূ যুবায়র (রহঃ) বলেন, আমি সাঈদকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন এইরুপ করলেন? তিনি বললেন, তুমি যেমন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছ, আমিও তেমনি ইবনু আব্বাসকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তখন তিনি বললেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদ্দেশ্য ছিল, তার উম্মাতেরকাউকে কষ্ট না দেওয়া। (সহিহ মুসলিম ১৫০২ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ মুকিম অবস্থায় সংকট ছাড়া কেউ সালাত জমা করার ব্যাপারে মতামত দেননি। শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মানুষ যখনই দু’নামাযকে একত্রিত না করলে সমস্যা বা সংকটের সম্মুখিন হবে তখনই একত্রিত করণ তার জন্য বৈধ হয়ে যাবে। আর সমস্যা না হলে একত্রিত করবে না। কিন্তু যেহেতু সফর মানেই সমস্যা ও সংকট তাই মুসাফিরের জন্য দু’নামাযকে একত্রিত করা জায়েয। চাই তার সফর চলমান হোক বা কোন স্থানে অবস্থান করুক। তবে সফর চলমান থাকলে একত্রিত করা উত্তম। আর সফরে গিয়ে কোন গৃহে বা হোটেলে অবস্থান করলে একত্রিত না করাই উত্তম। কিন্তু মুসাফির যদি এমন শহরে অবস্থান করে যেখানে নামায জামাআতের সাথে অনুষ্ঠিত হয়, তখন জামাআতের সাথে নামায আদায় করা ওয়াজিব। ঐ সময় নামায কসরও করবে না একত্রিতও করবে না। কিন্তু জামাআত ছুটে গেলে কসর করবে একত্রিত করবে না। অবশ্য একত্রিত করা জরূরী হয়ে পড়লে করতে পারে। (ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম)

আলেমগণ দু’সালাত একত্রে আদায় বা জমা করার ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। এমই কিছু ইজতিহাদ ধর্মী কথা উল্লেখ করছিঃ

১. অধিকাংশ আলেম যেমন মালেকী, শাফেয়ী, হাম্বলীগণ এ মত পোষণ করেছেন যে, সফরের কারণে যোহর এবং আসর অনুরূপভাবে মাগরিব ও ইশার সালাতকে একত্রে আদায় করা জায়েয। (আশ-শারহুল কাবীর, ১/৩৬৮; মুগনিল মুহতাজ, ১/৫২৯, কাশশাফুল কিনা‘, ২/৫)

২. হানাফী আলেমগণ বলেন, আরাফা ও মুযদালিফা ব্যতীত দু’ ফরয সালাতকে একত্র করে আদায় করা যাবে না। তবে আকৃতিগতভাবে একত্রিত করা যাবে, আর তা হচ্ছে যোহরকে তার শেষ সময় পর্যন্ত দেরী করে আদায় করা তারপর আসরকে তার প্রথম ওয়াক্তে আদায় করা। (আদ-দুররুল মুখতার ওয়া হাশিয়া ইবন আবেদীন, ১/৩৮১]

৩. শাফে‘ঈ ও হাম্বলীদের নিকট যদি দ্বিতীয় সালাতকে এগিয়ে নিয়ে এসে প্রথম ওয়াক্তে দু’সালাতকে একত্রে পড়ে তবে সেখানে দ্বিতীয় সালাতকে আদায় করার নিয়্যত প্রথম সালাত আদায়ের সময়েই থাকতে হবে। অবশ্য যদি প্রথম সালাতকে দেরী করে দ্বিতীয় সালাতের সময়ে নিয়ে যায় তখন প্রথম সালাত আদায়ের সময় দ্বিতীয় সালাতকে একত্রিত করার নিয়্যত লাগবে না। সে হিসেবে যদি প্রথম সালাত আদায় করার সময় দ্বিতীয় সালাতকে এগিয়ে নিয়ে আদায় করার নিয়্যত না করে তবে তার জমা বা একত্রিত করে আদায় করা শুদ্ধ হবে না। [রাওদাতুত তালেবীন, ১/৩৯৬; কাশশাফুল কিনা‘ ২/৮]

৪. মালেকী মাযহাবের আলেমগণের মতে, প্রথম সালাত আদায় করার সময়ে দ্বিতীয় সালাতকে তার সাথে জমা করার নিয়্যত করা ওয়াজিব কিন্তু শর্ত নয়। (আর তা দ্বিতীয় সালাতকে এগিয়ে নিয়ে আসা বা প্রথম সালাতকে দেরীতে আদায় করা উভয় ক্ষেত্রেই সমান) সুতরাং যদি কেউ প্রথম সালাত আদায়ের সময় দ্বিতীয় সালাতকে জমা নিয়্যত করা ছেড়ে দিল, তবে তাতে সালাত বাতিল হবে না। [হাশিয়াতুল আদাওয়ী (১/৩৩৫)]

৫. আর এক বর্ণনায় ইমাম আহমাদ, ইমাম মুযানী এবং ইবন তাইমিয়্যাহ বলেন, প্রথম সালাত আদায়ের সময় দ্বিতীয় সালাত তার সাথে একত্রিত করার নিয়্যতের বাধ্য-বাধকতা নেই। [আল-মুহাযযাব, (১/১৯৭); আল-ইনসাফ:২/৩৪১]

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “সফরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানঃ দ্বিতীয় কিস্তি

Leave a comment