তাওয়াফের ১৭ টি সুন্নত কার্যাবলী

তাওয়াফের ১৭ টি সুন্নত কার্যাবলী

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

আমারা আগেই জেনেছি হজ্জের তিনটি ফরজ আছে তার মধ্যে তাওয়াফ অন্যতম। তাওয়াফকে সহিহ শুদ্ধভাবে আদায় করতে হলে এই বিষয়টি সম্পর্কে ভাল করে জ্ঞান অর্জণ করতে হবে। তাওয়াফে এমন কাজ আছে যা আদায় না করলে তাওয়াফ শুদ্ধ হবে না। যার ফলে হজ্জের ক্ষতি হয়ে যাবে। এই কাজগুলোই তাওয়াফের জন্য ওয়াজিব। আবার এমন অনেক কাজ আছে যা আদায় না করলেও তাওয়াফ আদায় হয়ে যাবে কিন্তু সহিহ সুন্নাহ তোমাবেক আদায় হবে না। এমন কাজগুলো হলো, তাওয়াফের সুন্নত বা মুস্তাহাব। আবার অনেকে তাওয়াফ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকের কারনে অনেক ভুল করে থাকেন। যার ফলে কখনো ওয়াজিব ভঙ্গ হয় আবার কখনও সুন্নাহ ভঙ্গ হয়, এই কার্যাবলীতে তাওয়কফের ভুলত্রুটি বলে উল্লেখ করে আলোচনা করা হলো। এ পর্যায়ে তাওয়াফের সুন্নাহসমূহ আলোচনা করা হলোঃ তাওয়াফের সুন্নাহ সম্মত আমল হলোঃ

তাওয়াফের সুন্নত কার্যাবলী হলোঃ

১। অজুসহকারে তাওয়াফ করাঃ

২। তাওয়াফের শুরু তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ করাঃ

৩। কাবায় ঢুকেই হাজারে আসওয়াদের নিকট আসা

৪। সম্ভব হলে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করাঃ

৫। চুম্বন সম্বব না হলে ইশারায় চুম্বর করাঃ

৬। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে তাওয়াফ শুরু করাঃ

৭। তাওয়াফের সময় দোয়া করাঃ

৮। ইযতিবা করাঃ

৯। প্রথম তিন চক্করে রমল করাঃ

১০। বাকী চার চক্কর সাধারণ গতিতে আদায় করা

১১। প্রতি চক্করেই রোকনে ইয়ামীনি স্পর্ম করাঃ

১২। প্রতি চক্করে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন বা ইশারা দ্বারা চুম্বন করাঃ

১৩। প্রতি চক্করে তাকদির দেয়া

১৪। পায়ে হেঁটে বা বাহনে চড়ে তাওয়াফ করাঃ

১৫। তাওয়াফের মাঝে দোয়া ও জিকির করাঃ

১৬। তাওয়াফের মাঝে জরুরী কথা বলা ও কাজ করা যায়ঃ

১৭। তাওয়াফ শেষ করে জমজমের পানি পান করা

তাওয়াফের সুন্নত কার্যাবলী হলোঃ

১। অজুসহকারে তাওয়াফ করাঃ

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় উপনীত হয়ে সর্বপ্রথম অযূ করে তাওয়াফ সম্পন্ন করেন। (রাবী) ‘উরওয়াহ (রহঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই তাওয়াফটি ‘উমরাহ’র তাওয়াফ ছিল না। (তিনি আরো বলেন) অতঃপর আবূ বকর ও ‘উমর (রাঃ) অনুরূপভাবে হজ্জ করেছেন। এরপর আমার পিতা যুবাইর (রাঃ)-এর সাথে আমি হজ্জ করেছি তাতেও দেখেছি যে, সর্বপ্রথম তিনি তাওয়াফ করেছেন। এরপর মুহাজির, আনসার সকল সাহাবা (রাঃ)-কে এরূপ করতে দেখেছি। আমার মা আমাকে জানিয়েছেন যে, তিনি, তাঁর বোন এবং যুবাইর ও অমুক অমুক ব্যক্তি ‘উমরাহ’র ইহ্‌রাম বেঁধেছেন, যখন তাঁরা তাওয়াফ সমাধা করেছেন, হালাল হয়ে গেছেন। (সহিহ বুখারি ১৬১৪)


সুন্নহ হলো অজু করা

অনেক মুজতাহীদ আলেম মনে করেন, তাওয়াফে নামাযের মত শুদ্ধতার জন্য পবিত্রতা শর্ত। অজু না করা পর্যন্ত অপবিত্র ব্যক্তির নামায যেমন শুদ্ধ হয় না তেমনি তাওয়াফও। তাই তওয়াফের আগে সুন্দর করে অজু করে নিতে হবে। এর বীপরিতে অনেক মুজতাহীদ আলেম মনে করেন, তাওয়াফের জন্য অজু শর্ত নয়। তাওয়াফের পূর্বে অজু করে নেয়া উত্তম তবে অপরিহার্য় বা ফরজ নয়। বড় অপবিত্রতা (মাসিক) থাকলে তাকে পবিত্র হয়েই তাওয়াফ করেত হবে।

যে সকল মুজতাহীদ আলেম বলেন তাওয়াফের জন্য অজু অপরিহার্য় বা ফরজ তাদের দলিল।

১. ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বায়তুল্লাহর চারদিকে তাওয়াফ করা সালাত আদায় করার মতই। তবে সালাতে তোমরা কথা বলতে পার না কিন্তু এতে কথা বলতে পার। সুতরাং এ সময় ভাল কথা ছাড়া কিছূ বলবে না। (সুনানে তিরমিযি ৯৬০, আলবানী ‘ইরওয়াউল গালিল’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন)

২. সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওয়াফ করতে চাইতেন তখন তিনি ওযু করে নিতেন।” আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম তো বলেছেন: “তোমরা আমার কাছ থেকে তোমাদের হজ্জের কার্যাবলি শিখে নাও। (সহিহ মুসলিম ১২৯৭)

শাইখ বিন বায রাহিমাহুল্লার মতে, অজু ছাড়া তাওয়াফ শুদ্ধ হবে না। তাঁকে আরও জিজাসা করা হয় যে, “এক ব্যক্তি তাওয়াফ শুরু করার পর তার বায়ু বেরিয়েছে। তার উপর তাওয়াফ কর্তন করা কী আবশ্যক? নাকি সে তাওয়াফ চালিয়ে যাবে?”

জবাবে তিনি বলেনঃ যদি কেউ তাওয়াফের মধ্যে বায়ু, পেশাব, বীর্য, লজ্জাস্থান স্পর্শ করা কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন কারণে অপবিত্র হয় তাহলে সে নামাযের ন্যায় তার তাওয়াফ স্থগিত করে পবিত্রতা অর্জন করতে যাবে; এরপর নতুনভাবে তাওয়াফ শুরু করবে। এটাই সঠিক অভিমত; যদিও এ মাসয়ালাতে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু, তাওয়াফ ও নামাযের ক্ষেত্রে এটাই সঠিক অভিমত। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি তোমাদের কেউ নামাযের মধ্যে নিঃশব্দে বায়ু ত্যাগ করে তাহলে সে যেন বেরিয়ে গিয়ে ওযু করে আসে এবং পুনরায় নামায আদায় করে।” (সুনানে আবু দাউদ)। তাই সামগ্রিক দৃষ্টিতে তাওয়াফ নামায শ্রেণীয়।  [(মাজমুউ ফাতাওয়াস শাইখ বিন বায (১৭/২১৬-২১৭)]

কোন কোন আলেমের মতে, তাওয়াফের জন্য পবিত্রতা শর্ত নয়। এটি ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর অভিমত। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এ অভিমতটিকে পছন্দ করেছেন। তারা প্রথম অভিমতের দলিলঃগুলোর নিম্নোক্ত জবাব দেনঃ

** যে হাদিসে বলা হয়েছে যে, “বায়তুল্লাহকে তাওয়াফ নামাযতুল্য” এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী হিসেবে ‘সহিহ’ নয়; তবে এটি ইবনে আব্বাসের উক্তি। ইমাম নববী তার ‘আল-মাজমু’ কিতাবে বলেন: বিশুদ্ধ অভিমত হচ্ছে- এটি ইবনে আব্বাসের উক্তি (মাওকুফ হাদিস)। বাইহাকী ও অন্যান্য হাফেযে-হাদিস মুহাদ্দিস এমনটি বলেছেন।

** তারা আরও বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র অবস্থায় তাওয়াফ করা: এর দ্বারা এটা প্রমাণ হয় না যে, পবিত্র হয়ে তাওয়াফ করা ওয়াজিব; বরং এর দ্বারা মুস্তাহাব সাব্যস্ত হয়। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এ আমল করেছেন। কিন্তু, সাহাবীদেরকে নির্দেশ দেননি।

*** আর আয়েশা (রাঃ) কে যে তিনি বলেছেন, “একজন হাজী যা যা করে তুমিও তা তা কর; কিন্তু তুমি পবিত্র হওয়া অবধি তাওয়াফ করবে না” : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা (রাঃ) তাওয়াফ করতে বাধা দেয়ার কারণ হল, আয়েশা (রাঃ) হায়েযগ্রস্ত থাকা। কেননা হায়েযগ্রস্ত নারী মসজিদে প্রবেশ করা নিষেধ।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন:

যারা তাওয়াফের জন্য পবিত্রতা শর্ত বলেন: মূলতঃ দলিলঃ তাদের পক্ষে নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে তাওয়াফের জন্য ওযু করার নির্দেশ বর্ণিত হয়নি; না সহিহ সনদে; আর না যয়ীফ (দুর্বল) সনদে। অথচ তাঁর সাথে বিশাল সংখ্যক মানুষ হজ্জ আদায় করেছেন। এবং তিনি কয়েকটি উমরাও করেছেন। তার সাথে অনেক মানুষ উমরা করেছে। তাই তাওয়াফের জন্য ওযু থাকা যদি ফরয হত তাহলে তিনি সাধারণভাবে সেটা বর্ণনা করতেন। আর তিনি যদি বর্ণনা করতেন তাহলে মুসলমানেরা তার থেকে সেটা বর্ণনা করতেন; অবহেলা করতেন না। কিন্তু, সহিহ হাদিসে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি যখন তাওয়াফ করেছেন তখন তিনি ওযু করেছেন। শুধু এ দলিলঃ ওয়াজিব হওয়ার নির্দেশনা দেয় না। কারণ তিনি প্রত্যেক নামাযের জন্য তাওয়াফ করতেন। তিনি আরও বলেছেন: “আমি পবিত্র না হয়ে আল্লাহ্‌র যিকির করা অপছন্দ করেছি…”[মাজমুউল ফাতাওয়া (২১/২৭৩)]

এই অভিমতটি অর্থাৎ ‘তাওয়াফের জন্য পবিত্রতার শর্ত না করা’ মজবুত হওয়া সত্ত্বেও এবং দলিলঃ-প্রমাণে সে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কোন মানুষের পবিত্রতা ছাড়া তাওয়াফ করা উচিত নয়। কেননা পবিত্র হয়ে তাওয়াফ করা উত্তম, অধিক সতর্কতাপূর্ণ ও দায়মুক্তির অধিক উপযুক্ত এতে কোন সন্দেহ নেই। এর উপর আমল করার মাধ্যমে ব্যক্তি জমহুর আলেমের অভিমতের বিপরীত আমল করা থেকে নিরাপদে থাকবে।

তবে, ওযু রক্ষা করতে গিয়ে তীব্র কষ্ট-ক্লেশের মুখোমুখি হলে মানুষ এ অভিমতের উপর আমল করতে পারে; যে পরিস্থিতি মওসুমগুলোতে তৈরী হয়ে থাকে। কিংবা ব্যক্তি যদি অসুস্থ হয় নতুবা বয়োবৃদ্ধ হয় যাতে করে প্রচণ্ড ভীড়, তীব্র ঢেলাঠেলি ইত্যাদি কারণে ওযু রাখা তার জন্য কঠিন হয়ে যায়।

শাইখ বিন উছাইমীন (রহঃ) জমহুর আলেমের দলিলঃগুলোর জবাব দেয়ার পর বলেন, পূর্ব আলোচনার ভিত্তিতে বলতে পারি, যে অভিমতের প্রতি হৃদয় প্রশান্ত হচ্ছে সে অভিমতটি হচ্ছে: তাওয়াফের জন্য লঘু অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়া শর্ত নয়। তবে, কোন সন্দেহ নাই যে, পবিত্র হয়ে তাওয়াফ করা উত্তম এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণের দিক থেকে অধিক পরিপূর্ণ। এক্ষেত্রে জমহুর আলেমের বিরুদ্ধে গিয়ে এটি লঙ্ঘন করা উচিত নয়। কিন্তু, কখনও কখনও ব্যক্তি শাইখুল ইসলামের মনোনীত অভিমতটি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। যেমন- তীব্র ভীড়ের মধ্যে কেউ যদি অপবিত্র হয়, সেক্ষেত্রে যদি বলা হয় যে, বের হয়ে ওযু করে আসা তার উপর আবশ্যক এবং বিশেষতঃ তার যদি কয়েকটি চক্কর বাকী থাকে- এতে তীব্র কষ্ট রয়েছে। আর যাতে তীব্র কষ্ট রয়েছে এবং দলিলঃ যদি সুস্পষ্ট না হয় সেক্ষেত্রে মানুষকে এমন অভিমতের উপর আমলে বাধ্য করা উচিত নয়। বরং আমরা সহজ্জটির উপর আমল করব। কেননা দলিলঃ ছাড়া কষ্টকর অভিমতের উপর মানুষকে আমল করতে বাধ্য করা আল্লাহ্‌র বাণী “আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য সহজ্জ করতে চান; কঠিন করতে চান না” এর খিলাফ।[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৮৫; আল-শারহুল মুমতি (৭/৩০০)]

২। তাওয়াফের শুরু তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ করাঃ

নাফি’ (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইব্‌নু ‘উমর (রাঃ) হারামের নিকটবর্তী স্থানে পৌছলে তালবিয়া পাঠ বন্ধকরে দিতেন। অত:পর যী-তুয়া নামক স্থানে রাত যাপন করতেন। এরপর সেখানে ফজরের সালাত আদায় করতেন ও গোসল করতেন। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ করতেন। (সহিহ বুখারি ১৫৭৩) 

তাওয়াফের বিস্তারিত বিবরণে দেখেসি, ‘হাজারে আসওয়াদ (কাল পাথরের) কাছে গিয়ে, বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার বলে পাথরকে চুমু দিয়ে তাওয়াফ কার্য শুরু করতে হবে। কাবাঘরকে বামপাশে রেখে তাওয়াফ করতে হয়।

মন্তব্যঃ সহিহ হাদিসের আলোকে জানা যায়, হারামের নিকটবর্তী স্থানে পৌছলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালবিয়া পাঠ বন্ধকরে দিতেন। তাওয়াফের সময় তিনি দোয়া ও জিকিরে ব্যস্ত থাকতেন।  তাই সুন্নাহের দাবি হলে, তাওয়াফের শুরু তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ করে দিতে হবে।

৩। কাবায় ঢুকেই হাজারে আসওয়াদের নিকট আসাঃ

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদীনাহ্ হতে (হজ্জ্জ ও ‘উমরা পালনের জন্য) মাক্কায় প্রবেশ করে হাজারে আসওয়াদের দিকে অগ্রসর হলেন, একে চুমু খেলেন। তারপর বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করলেন, এরপর সাফা পাহাড়ের দিকে এলেন এবং এর উপর উঠলেন যাতে বায়তুল্লাহ দেখতে পান। তারপর দু’ হাত উঠালেন এবং উদারমনে আল্লাহর যিকির ও দু‘আ করতে লাগলেন। (আবু দাউদ ১৮৭২, মিসকাত ২৫৭৫)

৪। সম্ভব হলে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করাঃ

১. আবদুল্লাহ ইব্‌নু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে মক্কায় উপনীত হয়ে তাওয়াফের শুরুতে হাজ্‌রে আসওয়াদ ইসতিলাম (চুম্বন, স্পর্শ) করতে এবং সাত চক্করের মধ্যে প্রথম তিন চক্করে রামল করতে দেখেছি। (সহিহ বুখারি ১৬০৩)

২. আসলাম (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ‘উমর ইব্‌নু খাত্তাব (রাঃ) কে হাজ্‌রে আসওয়াদ চুম্বন করতে দেখেছি। আর তিনি বললেন, যদি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখতাম তাহলে আমিও তোমায় চুম্বন করতাম না। (সহিহ বুখারি ১৬১০)

৩. সালিম (রহঃ) থেকে। তার পিতা তাকে বর্ণনা করতে যেয়ে বলেছেন যে, উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হাজারে আসওয়াদে চুম্বন করে বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি নিশ্চিত জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র। আমি যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখতাম তবে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। অনুরূপ একটি হাদীস যায়দ ইবনু আসলাম থেকে তার পিতার সুত্রে বর্ণিত হয়েছে। (সহিহ মুসলিম ২৯৩৭ ইফাঃ)

৪. আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (মাদীনাহ থেকে) আগমন করে মক্কায় প্রবেশ করলেন, এরপর ‘হাজরে আসওয়াদের’ নিকটবর্তী হয়ে তাতে চুমু খেলেন এবং বায়তুল্লাহ তওয়াফ করলেন। অতঃপর সাফা পাহাড়ের চুড়ায় উঠলেন এবং সেখান থেকে বায়তুল্লাহ দৃষ্টিগোচর হলেই তিনি দুই হাত উত্তলোন করে যতক্ষন ইচ্ছে মহান আল্লাহর যিকির করলেন এবং দু’আ করলেন। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, এ সময় সিঁড়ির পাথর তার নীচে ছিলো। হাশিম (রহঃ) বলেন, সেখানে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ইচ্ছেমত দু’আ করেন। (আবু দাউদ ১৮৭২)

৫। চুম্বন সম্বব না হলে ইশারায় চুম্বর করাঃ

ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটের পিঠে (আরোহণ করে) বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করেন, যখনই তিনি হাজ্‌রে আসওয়াদের কাছে আসতেন তখনই কোন কিছু দিয়ে তার প্রতি ইঙ্গিত করতেন। (সহিহ বুখারি ১৬১২)

ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটের পিঠে সওয়ার হয়ে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করেন, যখনই তিনি হাজরে আসওয়াদের কাছে আসতেন তখন তাঁর হাতের বস্তু (লাঠি) দিয়ে তার দিকে ইঙ্গিত করতেন ও তাকবীর বলতেন। (সহিহ বুখারি ১৬৩২)

৬। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে তাওয়াফ শুরু করাঃ

হাজারে আসওয়াদের দিকে অগ্রসর হয়ে ডান হাত দিয়ে আপনি তা স্পর্শ করে এতে চুম্বন করবেন। যদি হাত দিয়ে পাথরটিকে স্পর্শ করা সম্ভব না হয়, তাহলে সেদিকে ফিরে ডান হাত দিয়ে ইশারা করবেন। তবে হাতে চুম্বন করবেন না। ইশারা করার সময় বলবেন ‘‘আল্লাহু আকবার। (সহিহ বুখারি)

বায়হাকীর এক বর্ণায় সহিহ সনদে ইবনে উমার থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তাওয়াফের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার’ বলা উত্তম। (বায়হাকী ৫/৭৯ এবং আত-তালখীসুল হাবীর ২/২৪৭ হাফেজ ইবনে হাজার, সনদ সহিহ)

৭। তাওয়াফের সময় দোয়া করাঃ

১. আবদুল্লাহ্ ইবনুস সায়েব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দু’ রুকনের মাঝখানে বলতে শুনেছিঃ

**رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَّقِنَا عَذَابَ النَّارِ**

অর্থঃ হে আমাদের রব! আমাদেরকে তুমি দুনিয়ায় সুখ দাও, আখেরাতেও আমাদেরকে সুখী কর এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদেরকে বাঁচাও। (সুরা বাকারা ২:২০১)। (সুনানে আবু দাউদ ১৮৯০ ইফাঃ)

৮। ইযতিবা করাঃ

ইফরাদ হজ্জকারী বাইতুল্লাহ এসে প্রথম একটি তাওয়াফ করে এবং কেরান হজ্জকারী ও তামাত্তু হজ্জকারী উমরার উদ্দেশ্যে যে তাওয়াফ করে থাকেন তাকে তাওয়াফে কুদুম বা আগমনি তাওয়াফ বলে। এই তাওয়াফের সময় রমল করা হয়। এই রমল করা সময়  পুরুষেরা ইহরামের গায়ের কাপড়টির একমাথা ডান বগলের নীচ দিয়ে এমনভাবে পেঁচিয়ে দেয়, যাতে ডান কাঁধ, বাহু ও হাত খোলা থাকে। কাপড়ের বাকী অংশ ও উভয় মাথা দিয়ে বাম কাঁধ ও বাহু ঢেকে তাওয়াফ করবে। এই নিয়মটাকে আরবীতেও ইযতিবা বলা হয়। এটা করা সুন্নাত।

সুনানে তিরমিজিতে হাসান সদনে একটি হাদিসে এসেছেঃ

১. ইয়ালা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, একটি চাদরের মধ্যভাগ ডান বগলের নীচে দিয়ে এবং তার দুই প্রান্ত বাম কাঁধের উপর দিয়ে জড়ানো (ইযতিবা) অবস্থায় (বাহু খোলা রেখে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল্লাহ্ তাওয়াফ করেছেন। (সুনানে তিরমিজি ৮৫৯, আবু দাউদ ১৮৮৩ ইফাঃ)

২. ইয়ালা ইবনে উমাইয়্যা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ডান কাঁধ খোলা রেখে এবং বাম কাঁধের উপর চাদরের উভয় কোণ একত্রে লটকিয়ে তাওয়াফ করেন। কাবীসা (রাঃ) তার বর্ণনায় বলেন, তাঁর পরিধানে ছিল একটি চাদর। (সুনানে ইবনে মাজা ২৯৫৪)

৯। প্রথম তিন চক্করে রমল করাঃ

রামল শুরু হয় সপ্তম হিজরীতে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ষষ্ঠ ‘হিজরীতে হুদায়বিয়া থেকে ফিরে যান উমরা আদায় না করেই। হুদায়বিয়ার চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তী বছর তিনি ফিরে আসেন উমরা পালনের উদ্দেশ্যে। সময়টি ছিল যিলকদ মাস। সাহাবাদের কেউ কেউ জ্বরাক্রান্ত হয়েছিলেন। তাই মক্কার মুশরিকরা মুসলমানদেরকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে পরস্পরে বলাবলি করতে লাগল, ‘এমন এক সম্প্রদায় তোমাদের কাছে আসছে ইয়াছরিবের (মদিনার) জ্বর যাদেরকে দুর্বল করে দিয়েছে। শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবাদেরকে (রাঃ) রামল অর্থাৎ আমাদের যুগের সামরিক বাহিনীর কায়দায় ছোট ছোট কদমে গা হেলিয়ে বুক টান করে দৌড়াতে বললেন। উদ্দেশ্য, মুমিন কখনো দুর্বল হয় না এ কথা মুশরিকদেরকে বুঝিয়ে দেয়া। একই উদ্দেশ্যে রামলের সাথে সাথে ইযতিবা অর্থাৎ চাদর ডান বগলের নীচে রেখে ডান কাঁধ উন্মুক্ত রাখারও নির্দেশ করলেন তিনি। সেই থেকে রমল ও ইযতিবার বিধান চালু হয়েছে।

এই কথার দলিলঃ

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে নিয়ে মক্কা্ আগমন করলে মুশরিকরা মন্তব্য করল, এমন একদল লোক আসছে যাদেরকে ইয়াসরিব-এর (মাদ্বীনার) জ্বর দুর্বল করে দিয়েছে (এ কথা শুনে) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে ‘রামল’ করতে (উভয় কাঁধ হেলে দুলে জোর কদমে চলতে) এবং উভয় রুকনের মধ্যবর্তী স্থানটুকু স্বাভাবিক গতিতে চলতে নির্দেশ দিলেন, সাহাবীদের প্রতি দয়াবশত সব ক’টি চক্করে রামল করতে আদেশ করেননি। (সহিহ বুখারি ১৬০২)

বনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়তুল্লাহ শরীফ প্রথমবারের তাওয়াফে তিন চক্কর দ্রুত পদক্ষেপে এবং চার চক্কর স্বাভাবিক পদক্ষেপে তাওয়াফ করতেন। তিনি সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈর সময় (বাতনুল মাসীল) মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়াতেন। ইবনু উমর (রাঃ)-ও তাই করতেন। (সহিহ মুসলিম ২৯১৮)

‘আবদুল্লাহ ইব্‌নু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বায়তুল্লাহ পৌঁছে প্রথম তাওয়াফ করার সময় তিন চক্করে রামল করেতেন এবং পরবর্তী চার চক্করে স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে চলতেন। সাফা ও মারওয়ায় সা’ঈ করার সময় উভয় টিলার মধ্যবর্তী নিচু স্থানটুকু দ্রুতগতিতে চলতেন। (সহিহ বুখারি ১৬১৭

সেই সপ্তম হিজরী থেকে রমল করা শুরু হয়ে আজও এইকাজ সুন্নাহ হিসাবে পরিগনিত হয়ে আসছে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রিয় সাহাবী রাদুয়াল্লাহু আনহুগন ও এই আমল ছাড়েন নাই।

দলিলঃ আবদুল্লাহ ইব্‌নু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ ‘উমর ইব্‌নু খাত্তাব (রাঃ) হাজ্‌রে আসওয়াদকে লক্ষ্য করে বললেন, ওহে! আল্লাহর কসম, আমি নিশ্চিতরূপে জানি তুমি একটি পাথর, তুমি কারও কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পার না। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। এরপর তিনি চুম্বন করলেন। পরে বললেন, আমাদের রামল করার উদ্দেশ্য কী ছিল? আমরা তো রামল করে মুশরিকদেরকে আমাদের শক্তি প্রদর্শন করেছিলাম। আল্লাহ এখন তাদের ধ্বংস করে দিয়েছেন। এরপর বললেন, যেহেতু এই (রামল) কাজটি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) করেছেন, তাই তা পরিত্যাগ করা পছন্দ করি না। (সহিহ বুখারি ১৬০৫)

১০। বাকী চার চক্কর সাধারণ গতিতে আদায় করা

১. ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে মক্কায় পৌছে হাজ্জ (হজ্জ) ও উমরার জন্য বায়তুল্লাহর যে তাওয়াফ করতেন, তাতে তিন চক্কর দ্রুত পদক্ষেপে এবং চার চক্কর স্বাভাবিক পদক্ষেপে সম্পন্ন করতেন। তাপর দু’রাকাআত সালাত আদায় করতেন। অতঃপর সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করতেন। (সহিহ মুসলিম ২৯১৯)

২. জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, হাজরে আসওয়াদ হতে শুরু করে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন বার দ্রুত পদক্ষেপে তাওয়াফ করেন এবং ধীর পদক্ষেপে চারবার তাওয়াফ করেন। (তিরমিজি ৮৫৭)

১১। প্রতি চক্করেই রোকনে ইয়ামীনি স্পর্ম করাঃ

রুকনে ইয়ামানী এটি কাবাঘরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে অবস্থিত। এটি ইয়ামান দেশের দিকে হওয়াতে একে রুকনে ইয়ামানী বলা হয়েছে থাকে। কাবা ঘরের এই অংশে কখনো  চুম্বন  করবেন না, তবে স্পর্শ করা মুস্তাহাব। মনে রাখতে হবে শুধু হাজরে আসওয়াদ পাথটি চুম্বন করব আর রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করব।  যা সহহি হাদিস দ্বারা প্রমানিত। ইহা ছাড়া অন্য কোন স্থান ষ্পর্শ বা চুম্বন কোন সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত হয়। যা হয় শুধুই আবেগের ফল। বিষয়টি বুঝার জন্য একটি উদাহরণ দেই।

১. একবার হযরত মু‘আবিয়া ও ইবনু আববাস (রাঃ) একত্রে ত্বাওয়াফরত অবস্থায় মু‘আবিয়া (রাঃ) কাবাগৃহের সবগুলি রুকন (চারটি কোণ) স্পর্শ করলে ইবনু আববাস (রাঃ) তার প্রতিবাদ করে বলেন, কেন আপনি এ দু’টি রুকন স্পর্শ করছেন? অথচ রাসূল (ছাঃ) এ দু’টি স্পর্শ করেননি। জবাবে মু‘আবিয়া (রাঃ) বলেন, কা‘বাগৃহের কোন অংশই পরিত্যাগ করার নয়। তখন ইবনু আববাস আয়াত পাঠ করে শোনালেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে’ (আহযাব ২১) জবাবে মু‘আবিয়া (রাঃ) বললেন, আপনি সত্য বলেছেন’। (ত্বাবারাণী আওসাত্ব ২৩২৩, আহমাদ ৩৫৩২ হাদিসে সনদ সহহি)

২. আবদুল্লাহ্ ইবন উবায়দ ইবন উমায়ার (রহঃ) থেকে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি বললো: হে আবু আবদুর রহমান! আমি আপনাকে এই দু স্তম্ভ (দু’রুকনে ইয়ামানী) ব্যতীত অন্য কোন স্তম্ভ চুম্বন করতে দেখি না। তিনি বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ এদের স্পর্শ করা গুনাহ দূর করে দেয় এবং তাঁকে এও বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি সাতবার তাওয়াফ করে, সে একটি গোলাম আযাদ করার সাওয়াব পাবে। (সুনানে নাসাঈ ২৯২২ হাদিসের মান সহিহ)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর সুন্নত হচ্ছে, এটিকে চুমু না দিয়ে শুধু স্পর্শ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে এ রুকনটিতে স্পর্শ করতেন।

১. আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল ইয়ামানী রুকন দু’টিই স্পর্শ করতে দেখেছি। (সহিহ মুসলিম ২৯১৩)

২. আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দুই ইয়ামানী রুকন ব্যতীত বায়তুল্লাহর অন্য কিছু স্পর্শ করতে দেখিনি।  (সহিহ মুসলিম ২৯৫১)

৩. উবায়দ ইবনু জুরায়জ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমর (রাঃ)-কে বললেন, হে আবূ ‘আবদুর রহমান! আমি আপনাকে এমন চারটি কাজ করতে দেখি, যা আপনার অন্য কোন সঙ্গীকে করতে দেখিনা। তিনি বললেন, ‘ইবনু জুরায়জ, সেগুলো কি?’ তিনি বললেন, আমি দেখি, (১) আপনি তাওয়াফ করার সময় রুকনে ইয়ামানী দু’টি ব্যতীত অন্য রুকন স্পর্শ করেন না। (২) আপনি ‘সিবতী’ (পশমবিহীন) চপ্পল পরিধান করেন; (৩) আপনি (কাপড়ে) হলুদ রং ব্যবহার করেন এবং (৪) আপনি যখন মক্কায় থাকেন লোকে চাঁদ দেখে ইহরাম বাঁধে; কিন্তু আপনি তারবিয়ার দিন (৮ ই যিলহাজ্জ) না এলে ইহরাম বাঁধেন না।

৩. আবদুল্লাহ (রাঃ) বললেনঃ রুকনের কথা যা বলেছ, তা এজন্য করি যে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ইয়ামানী রুকনদ্বয় ছাড়া আর কোনটি স্পর্শ করতে দেখিনি। আর ‘সিবতী’ চপ্পল, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পশমবিহীন চপ্পল পরতে এবং তা পরিহিত অবস্থায় অজু করতে দেখেছি, তাই আমি তা করতে ভালবাসি। আর হলুদ রং, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তা দিয়ে কাপড় রঙিন করতে দেখেছি, তাই আমিও তা দিয়ে রঙিন করতে ভালবাসি। আর ইহরাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নিয়ে তাঁর সওয়ারি রওনা না হওয়া পর্যন্ত আমি তাঁকে ইহরাম বাঁধতে দেখিনি। (সহিহ বুখারি ১৬৭ ইফাঃ)

১২। প্রতি চক্করে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন বা ইশারা দ্বারা চুম্বন করাঃ

১. ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটের পিঠে আরোহণ করে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করেন, যখনই তিনি হাজ্‌রে আসওয়াদের কাছে আসতেন তখনই কোন কিছুর দ্বারা তার ইঙ্গিত করতেন এবং তাকবীর বলতেন। (সহিহ বুখারি  ১৬১৩)

২. ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উটের পিঠে (আরোহণ করে) বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করেন, যখনই তিনি হাজ্‌রে আসওয়াদের কাছে আসতেন তখনই কোন কিছু দিয়ে তার প্রতি ইঙ্গিত করতেন। (সহিহ বুখারি  ১৬১২)

মন্তব্যঃ বর্তমান ভীড়ের কারনে প্রতি চক্করতো দুরের কথা, পুরা সফরেই একবার চুম্বন করা সম্বব নয়। আর মহিলাদেরতো হজ্জের মৌসুমে চুম্বন করার প্রশ্নই আসে না। যা হোক সরাসরি চুম্বন করা আর ইশারায় চুম্বর করার মাঝে তেমন পার্থক্য নাই কেননা, আমলটি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সরাসরি প্রমানিত যে, তিনি প্রতি চক্করে হাজরে আসওয়াদ ইশারা দ্বারা চুম্বন করেছেন।

১৩। প্রতি চক্করে তাকদির দেয়াঃ

ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উটের পিঠে সওয়ার হয়ে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করেন, যখনই তিনি হাজরে আসওয়াদের কাছে আসতেন তখন তাঁর হাতের বস্তু (লাঠি) দিয়ে তার দিকে ইঙ্গিত করতেন ও তাকবীর বলতেন। (সহিহ বুখারি ১৬৩২)

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটের উপর সওয়ার অবস্থায় বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করেছেন। হাজারে আসওয়াদের কাছে পৌঁছেই নিজের হাতের কোন জিনিস (লাঠি) দিয়ে ইশারা করতেন এবং (আল্লা-হু আকবার) তাকবীর দিয়েছেন। (মিসকাত ২৫৭০)

ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটের পিঠে সওয়ার হয়ে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করেন, যখনই তিনি হাজরে আসওয়াদের কাছে আসতেন তখন তাঁর হাতের বস্তু (লাঠি) দিয়ে তার দিকে ইঙ্গিত করতেন ও তাকবীর বলতেন। (সহিহ বুখাই ১৬০৭)

১৪। পায়ে হেঁটে বা বাহনে চড়ে তাওয়াফ করাঃ

১. সাফিয়্যাহ বিনতু শাইবাহ (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিরাপদ হওয়ার পর তাঁর উটে সওয়ার হয়ে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করেন এবং তাঁর হাতের লাঠির সাহায্যে (ইশারায়) হাজরে আসওয়াদে চুমু দিলেন। সাফিয়্যাহ বলেন, আমি এ দৃশ্য তাকিয়ে দেখেছিলাম। (সুনানে আবু দাউদ ১৮৭৮)

২. আবুত তুফাইল (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাঁর সাওয়ারীতে চড়ে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে দেখেছি। তিনি তাঁর লাঠির সাহায্যে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করার পর তাতে চুমু দিয়েছেন। মুহাম্মাদ ইবনু রাফি‘র বর্ণনায় রয়েছেঃ অতঃপর তিনি সাফা ও মারওয়ায় যান এবং স্বীয় বাহনে আরোহিত অবস্থায়ই সাত বার তাওয়াফ (সাঈ) করেন। (সুনানে আবু দাউদ ১৮৭৯)

মন্তব্যঃ এখন ভীরের কারনে বাহনে চড়ে তাওয়াফ করার আর প্রশ্ন উঠে না। তবে যারা অসুস্থ, বৃদ্ধ, মাজুর, মহিলা, শিশু ইত্যাদি লোক জন তাদের উপরের কারনে হুইল চেয়ারে করে কাবা তাওয়াফ করতে পারেন।

১৫। তাওয়াফের মাঝে দোয়া ও জিকির করাঃ

তাওয়াফরত অবস্থায় খুব বেশী বেশী জিকির, দোয়া ও তাওবা করতে থাকবেন। কুরআন তিলাওয়াতও করা যায়। কিছু কিছু বইতে আছে প্রথম চক্রের দোয়া, ২য় চক্রের দোয়া ইত্যাদি। কুরআন হাদীসে এ ধরনের চক্রভিত্তিক দোয়ার কোন ভিত্তি নাই।

১. তাওয়াফের করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  নীচের দোয়াটি পড়তেন। দোয়াটি হলঃ

**اَللَّهُمَّ إِيْمَانًا بِكَ وَتَصْدِيْقًا بِكِتَابِكَ وَوَفَاءً بِعَهْدِكَ وَاتِّبَاعًا لِسُنَّةِ نَبِيِّكَ مَحَمَّدٍ -صلى الله عليه وسلم**-

অর্থঃ হে আল্লাহ! তোমার প্রতি ঈমান এনে, তোমার কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তোমার সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণের জন্য তোমার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের অনুসরণ করে এ তাওয়াফ কার্যটি করছি।

২. এর পর মাকামে ইব্রাহীমের নিকট পড়েছেন,

*وَاتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى*

অর্থঃ আর তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের জায়গা বানাও। ( সুরা বাকারা ২:১২৫)

৩. ইয়ামানীর পাশে এসে পৌঁছলে ভীড় না হলে এ কোণকে ডান হাত দিয়ে ষ্পর্শ করার চেষ্টা করা। কিন্তু সাবধান, এ রুকনে ইয়ামেনীকে চুমু দেবেন না, এর পাশে এসে হাত উঠিয়ে ইশারাও করবেন না এবং সেখানে ‘আল্লাহু আকবার’ও বলবেন না। ‘আল্লাহু আকবার’ বলবেন হাজরে আসওয়াদে পৌঁছে। রুকনে ইয়ামেনী ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে নিম্নের এ দোয়াটি পড়া মুস্তাহাবঃ

**رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَّقِنَا عَذَابَ النَّارِ**

অর্থঃ হে আমাদের রব! আমাদেরকে তুমি দুনিয়ায় সুখ দাও, আখেরাতেও আমাদেরকে সুখী কর এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদেরকে বাঁচাও। (সুরা বাকারা ২:২০১)

৪. উপরের দোয়াটি পড়তে পড়তেই আপনি রুকনে ইয়ামেনী থেকে হাজরে আসওয়াদে চলে এসেছেন। আপন এবার নতুন তাওয়াফ চক্কর শুরু করছেন। তাওয়াফের প্রত্যেক চক্রেই হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা বা ষ্পর্শ করা উত্তম। কিন্তু হজ্জের মৌসুমে প্রচন্ড ভীড়ের কারণে এটি খুবই দূরূহ কাজ। সেক্ষেত্রে প্রতি চক্রেই হাজরে আসওয়াদের পাশে এসে এর দিকে মুখ করে ডান হাত উঠিয়ে ইশারা করবেন। ইশারাকৃত এ হাত চুম্বন করবেন না। ইশারা করার সময় একবার বলবেন (بسم الله الله أكبر ) ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’।

১৬। তাওয়াফের মাঝে জরুরী কথা বলা ও কাজ করা যায়ঃ

তাওয়াফ মহান আল্লাহর জন্য খাসভাবে নিবেদীত একটি ইবাদাত। ইবাদতের সময় আজে বাদে কথা ও কাজ থেকে দুরে থাকা ইমানের দাবি। কাজেই তাওয়াফ করার সময় কোন প্রকার ফাহেসা করা ও কাজ না করা ভাল। তবে প্রয়োজন সাথীদের সাথে কথা বলেলে তাওয়াফ ভঙ্গ হয় না। আবার এমন জরুরী কাজ যা না করলে তাওয়াফ ব্যাহত হয়। সে সকল কাজ তাওয়াফের মাঝে করা যায়। এমনকি সালাতের ইকামত হলে তাওয়াফ স্থগিত রেখে জামাতে অংশগ্রহন করতে হয়। সালাত শেষে বাকি তাওয়াফ করতে হয়।

দলিলঃ

১. ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বায়তুল্লাহর চারদিকে তাওয়াফ করা সালাত আদায় করার মতই। তবে সালাতে তোমরা কথা বলতে পার না কিন্তু এতে কথা বলতে পার। সুতরাং এ সময় ভাল কথা ছাড়া কিছূ বলবে না। (সুনানে তিরমিজি ৯৬৩ ইফাঃ)

২. তাওয়াফ করার সময় কথাবার্তা বলাঃ ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বায়তুল্লাহর তাওয়াফের সময় এক ব্যক্তির নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, সে চামড়ার ফিতা বা সূতা অথবা অন্য কিছু দ্বারা আপন হাত অপর এক ব্যক্তির সাথে বেঁধে দিয়েছিল। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে তাঁর বাঁধন ছিন্ন করে দিয়ে বললেন, হাত ধরে টেনে নাও। (সহিহ বুখারি ১৬২০)

৩. ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: বায়তুল্লাহর তাওয়াফও সালাতই, তবে তাওয়াফের মধ্যে কথা বলা আল্লাহ হালাল করেছেন (যা সালাতে হারাম)। ফলে যে ব্যক্তি এতে (তাওয়াফের মধ্যে) কথা বলবে, সে যেন কল্যাণকর কথা ব্যতীত অন্য কোনো কথা না বলে। (সুনানে আদ দামেরী ১৮৮৪)

১৭। তাওয়াফ শেষ করে জমজমের পানি পান করা

 যমযমের পানি পান করতে যাওয়া মুস্তাহাব। পান শেষে যমযমের কিছু পানি মাথার উপর ঢেলে দেয়া সুন্নাত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি করতেন।

১. ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে যমযমের পানি পান করেন। (সুনানে নাসাঈ ২৯৬৪)

২. ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে যমযমের পানি পান করিয়েছি। তিনি দাঁড়ানো অবস্থায় তা পান করেন। (সুনানে নাসাঈ ২৯৬৪)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “তাওয়াফের ১৭ টি সুন্নত কার্যাবলী

Leave a comment