মৃত্যু ব্যাক্তির কবর কেন্দ্রীক আমলগত বিদআত দ্বিতীয় কিস্তি

মৃত্যু ব্যাক্তির কবর কেন্দ্রীক আমলগত বিদআত দ্বিতীয় কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

** কবরের উপর ঘর তৈরি করে বসবাস করাঃ

কবর একটি পরিত্র স্থান। কবরের উপর ঘর তৈরি করে বসবাস করা নেহায়েত গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ। এ কাজের দ্বারা কবরবাসীকে অপমান করা হয়। তাই যারা এ কাজ করবে তাদেরকে বারণ করা এবং শরীয়তের বিধান সম্পর্কে অবহিত করা জরুরী। তারা কবরের উপর যেসব সালাত আদায় করেছে, তা সব বাতিল ও বৃথা। কবরের উপর বসাও অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ সম্পর্কিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লাম এর কিছু হাদিস তুলে ধরছিঃ

হাদিসঃ-১ জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের উপর চুনা লাগানো, তার উপর বসা, কবরের উপর গৃহনির্মাণ বা পাকা করতে নিষেধ করেছেন। (সহিহ মুসলিম ২১১৭, তিরমিযী ১০৫২, নাসায়ী ২০২৭, আবূ দাঊদ ৩২২৫, ইবনু মাজাহ ২৫৬২, আহমাদ ১৩৭২৫)

হাদিসঃ-২ মালিক (রাহিঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমরা যা জানি তা হল, মলমূত্র ত্যাগের জন্য কবরের উপর  বসতে নিষেধ করা হয়েছে। (মুয়াত্তা মালিক ৫৩৮)

হাদিসঃ-৩ আবূ মারসাদ আল-গানাবী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমরা বসবে না এবং কবরকে সামনে রেখে নামায আদায় করবে না। (তিরমিজ ১০৫০, সহিহ মুসলিম)।

হাদিসঃ-৪ আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কারো অঙ্গারের উপর বসা, যা তার কাপড় জ্বালিয়ে তার চামড়া পর্যন্ত পৌঁছে যায় কবরের উপর বসা অপেক্ষা তার জন্য উত্তম।” (সহিহ মুসলিম ২২৯২, আবূ দাউদ ৩২২৮, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, আহমাদ, ইবনে হিব্বান)

হাদিসঃ-৫ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লম বলেছেন, তোমরা কবরের দিকে মুখ করে নামায পড়বে না এবং কবরের উপর বসবে না। (সহিহ মুসলিম ২১২২)

হাদিসঃ-৬ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লম আরও বলেছেন, আল্লাহ ইহুদী ও নাসারাদের উপর লানত করেছেন,কারণ তারা তাদের নবীদের কবর সমূহকে মসজিদে পরিণত করেছে।(সহিহ মুসলিম ১০৭৯)।

মন্তব্যঃ এখান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লম থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করলাম যেখানে তিনি কবরের উপর বসতে ও সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন। কাজেই কবরের উপর ঘর নির্মানের মত গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকি। এই কাজটু শুধু বিদআত হবে হবে না। চব্বিশ ঘন্টা পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার মত গুনাহ হবে।

** কবর কেন্দ্রিক মসজিদ নির্মান করাঃ

কবর কেন্দ্রিক মসজিদ নির্মান করা একটি নিকৃষ্ট বিদআত। কারন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লম থেকে সহিহ সনদে অনেকগুলি হাদিস কবর কেন্দ্রিক মসজিদ নির্মান করতে নিষধ করা করা হয়েছে। হাদিসে নিষেধ নেই ভাল কাজ মনে করে করাই বিদআত। কিন্তু এই কাজ বিদআতের পাশাপাশি হারামও কেননা, এই কাজটি করতে তিনি বারণ করেছেন।

‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ উম্মু হাবীবা ও উম্মু সালামা (রাঃ) হাবশায় তাঁদের দেখা একটা গির্জার কথা বলেছিলেন, যাতে বেশ কিছু মূর্তি ছিল। তাঁরা উভয়ে বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট বর্ণনা করলেন। তিনি ইরশাদ করলেনঃ তাদের অবস্থা ছিল এমন যে, কোন সৎ লোক মারা গেলে তারা তার কবরের উপর মসজিদ বানাতো। আর তার ভিতর ঐ লোকের মূর্তি তৈরি করে রাখতো। কিয়ামত দিবসে তারাই আল্লাহ্‌র নিকট সবচাইতে নিকৃষ্ট সৃষ্টজীব বলে পরিগণিত হবে। (সহিহ বুখারী  আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪০৯, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ৪১৫)

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তাদের মধ্যে কোন সৎ লোক মারা গেলে তাঁরা তাঁর কবরের উপর মাসজিদ বানাতো। এতে আরো আছে “এরা সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্টতম”। (সহিহ বুখারী ৪২৭, সহিহ মুসলিম ৫২৮, নাসায়ী ৭০৪, আহমাদ ২৩৭৩১)

’আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ উম্মু হাবীবাহ ও উম্মু সালামাহ (রাঃ) হাবশায় তাঁদের দেখা একটা গির্জার কথা বলেছিলেন, যাতে বেশ কিছু মূর্তি ছিল। তাঁরা উভয়ে বিষয়টি নাবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট বর্ণনা করলেন। তিনি ইরশাদ করলেনঃ তাদের অবস্থা ছিল এমন যে, কোন সৎ লোক মারা গেলে তারা তার  মাসজিদ বানাতো। আর তার ভিতরে ঐ লোকের মূর্তি তৈরি করে রাখতো। কিয়ামাত দিবসে তারাই আল্লাহ্‌র নিকট সবচাইতে নিকৃষ্ট সৃষ্টজীব বলে পরিগণিত হবে। (সহিহ বুখারী ৪২৭, সহিহ মুসলিম ৫২৮)

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসুস্থতাকালে তাঁর এক সহধর্মিনী হাবশা দেশে তাঁর দেখা ‘মারিয়া’ নামক একটি গীর্জার কথা আলোচনা করলেন। (উম্মাহাতুল মু’মিনীনের মধ্যে) উম্মে সালামা এবং উম্মে হাবিবা (রাঃ) হাবাশায় গিয়েছিলেন। তারা ঐ গীর্জাটির সৌন্দর্য এবং তাতে রক্ষিত চিত্রসমূহের বিবরণ দিলেন। তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাথা তুলে বললেনঃ সে সব দেশের লোকেরা তাদের কোন পূণ্যবান ব্যাক্তি মারা গেলে তাঁর সমাধিতে মসজিদ নির্মাণ করত এবং তাতে সে সব চিত্র অংকন করত। তারা হল, আল্লাহর নিকটে নিকৃষ্ট মাখলূক। (সহিহ বুখারী ১২৬০ এবং ৪২২ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

মন্তব্যঃ কবর কেন্দ্রিক মসজিদ নির্মান করা সম্পর্কে উপলের সহিহ হাদিসগুলিই যথেষ্ট ব্যাখ্যা বিশ্লষনের আর প্রয়োজন নেই। কেননা আহলে সুন্নাহ ওয়ার জামাতের কোন আলেম এই সকল হাদিসের বিপরীত কোন হাদিস উল্লেখ করে নাই। এর বিপরীত কোন আমলও পাওয়া যায় না।

** একটি সংশয়ের নিরষনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর মসজিদে নব্বীর মধ্যে কেন?

১। মসজিদ নির্মিত হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবদ্দশায়। মসজিদটি সম্প্রসারনের কারনে মনে হয় মসজিদটি কবরের উপর নির্মিত। আসলে কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা হয়নি।

২। এ কথাটি সবাই জানে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার স্ত্রী আশেয়া (রাঃ) এর ঘরে মারা যান এবং তাকে মসজিদে নব্বীর সাথে আশেয়া (রাঃ) এর হুজরায় দাফন করা হয়েছে। কাজেই বলা যায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মসজিদেই দাফন করা হয় নি। আশেয়া (রাঃ) এর হুজরা বা ঘরটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মসজিদের মিম্বর থেকে মাত্র ৫০/৬০ মিটার দুরে। কাজেই যখন মসজিদটি সম্প্রসারনের সিদ্ধান্ত হয় তখন দেখা যায় আশেয়া (রাঃ) এর ঘরটি মসজিদের ভিতরে পড়ে যায়। যেহেতু আশেয়া (রাঃ) এর ঘরের মধ্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর তাই অনেক সাহাবী মসজিদটি সম্প্রসারনে আশেয়া (রাঃ) এর ঘরটি মসজিদের ভিতরে দিতে আপত্তি জানায়। তাই বলা যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরটি মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করানো সাহাবীদের যৌথ সিদ্ধান্তে হয়নি বরং তাদের অধিকাংশের মৃত্যুর পর হয়েছে। তখন তাঁদের অল্প কয়েকজন মাত্র বেঁচে ছিলেন। উহা ঘটেছিল ৯৪ হিজরী সনে মসজিদ সম্প্রসারণ কালে। বস্তুত: এই কাজটি সাহাবীদের অনুমতি বা তাদের যৌথ সিদ্ধান্তে হয়নি। তাদের কেউ কেউ উহাতে দ্বিমতও পোষণ করেছিলেন এবং বাধা দিয়েছিলেন। তাবেঈনদের মধ্যে সাঈদ বিন মুসাইয়েব তাদের অন্যতম।

৩। যারা হজ্জে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর জিয়ারত করেছেন তারা দেখেছেন যে, কবরটি মুল মসজিদের এক পাশে পড়েছে তাই কবরটি মসজিদের ভিতরে নেই। কারণ উহা মসজিদ হতে সম্পূর্ণ পৃথক রুমে রয়েছে। আর মসজিদকে ওর উপর বানানো হয়নি। এজন্যই এই স্থানটিকে তিনটি প্রাচীর দ্বারা সংরক্ষিত ও বেষ্টিত করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রাচীরকে এমন একটি দিকে রাখা হয়েছে যা কিবলা হতে বিপরীত পার্শে রয়েছে এবং উহার এক সাইড উল্টা দিকে রয়েছে,যাতে করে কোন সানুষ নামায পড়া কালীন উহাকে সম্মুখীন না করতে পারে কারণ উহা কিবলা হতে এক পার্শে রয়েছে। এছাড়া কবরটি বাহির থেকে সরাসরি দেখা যায় না। মনে হবে চার দেয়ালের মাঝে একটি রুম। যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর মসজিদের ভিতরে বলে দলীল প্রদান করেন তাদের জন্য উপরের বক্তব্য টুকু যথেষ্ঠ। মহান আল্লাহ বলেনঃ

 *إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللهِ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ *

অর্থঃ একমাত্র তারাই আল্লাহর মাসজিদসমূহ আবাদ করবে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে। (সূরা তাওবা ৯:১৮)।

** মসজিদের মধ্যে কবর থাকলে তাতে সালাত আদায় করার বিধান?

একদা শায়খুল ইসলাম ইমাম তায়মিয়্যাহ (রহ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ কবর রয়েছে এমন মাসজিদে সলাত পড়া সঠিক হবে কি? লোকেরা তাতে জামাআতে পাঁচ ওয়াক্ত এবং জুমু‘আতে একত্রিত হবে কি হবে না, কবরটি কি সমান করে দেওয়া হবে নাকি তাতে প্রাচীর দেয়া হবে?  

অতঃপর তিনি উত্তর দিলেনঃ আল-হামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য), ইমামগণ এ ব্যাপারে একমত যে, কবরের উপর মাসজিদ নির্মিত হবে না। কেননা নাবী (সা) বলেছেন, নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তীরা কবরসমূহকে মাসজিদে পরিণত করেছিল সাবধান! তোমরা কবরকে মাসজিদে পরিণত করবে না আমি তোমাদেরকে এরূপ কাজ করতে নিষেধ করে যাচ্ছি’’ ইমামগণ এতেও একমত যে মসজিদের ভিতর মৃত ব্যক্তিকে দাফন করাও জায়েয নয়। যদি  মাসজিদটি কবরের পূর্বে নির্মাণ হয়ে থাকে তাহলে কবরের অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। কবর নতুন হলে লাশকে কবরস্থানে দাফন করতে হবে। আর যদি (পূর্বে) কবর ছিল এমন স্থানে মাসজিদটি তৈরী হয় তাহলে মাসজিদটিকে স্থানান্তারিত করতে হবে নতুবা কবরের অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। অতএব যে মসজিদের কোন একটি অংশে কবর রয়েছে সেখানে ফরয, নফল কোন সলাতই পড়া যাবে না। কেননা শরীয়তে তা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। [মাজমূউ ফাতাওয়া ১/১০৭, ২/১৯২] 

ইমাম আবূ হানিফা (রহ) এর ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ (রহ) বলেন, কবরের কাছে মাসজিদ নির্মাণ আমাদের নিকট মাকরূহ (তাহরীমী) তথা হারাম কাজ। [কিতাবুল আসার পৃষ্ঠা-৪৫; পাকা মাযার ও ওয়াসীলার তত্ত্বসার পৃষ্ঠা-৬১)।

আলেমদের এই ফতওয়ার সমর্থনে কয়েকটি সহিহ হাদিস উল্লেখঃ

হাদিসঃ-১ আবূ হুরায়রাহ (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘আল্লাহ ইয়াহুদীদের ধবংস করুন, তারা তাদের নবীগণের কবরকে সিজদার স্থান (মাসজিদ) বানিয়ে নিয়েছে।’’ (সহীহ বুখারী ৪২৬, সহীহ মুসলিম ১২১৩, আবু দাউদ ৩২২৯ আহমাদ ৯১৪৪)

হাদিসঃ-২ সাহাবী জুনদুব (রা) বলেন, আমি নাবী (সা) কে বলতে শুনেছি “খবরদার! তোমাদের আগে যারা ছিল তারা নিশ্চয়ই তাদের নাবীদের এবং তাদের সৎলোকদের কবরগুলোকে মাসজিদ বানিয়ে নিত। খবরদার! তোমরা কবরগুলোকে মাসজিদ বানিও না। আমি অবশ্যই তোমাদেরকে তা থেকে নিষেধ করছি।’’ (সহীহ মুসলিম ১২১৬)

হাদিসঃ-৩ মারসাদ (রা), রাসূল (সা) হতে বর্ণনা করেন, “তোমরা কবরের উপর বস না, আর কবরকে সামনে রেখে সলাত আদায় করো না।’’ (সহীহ মুসলিম ২২৯৪)।

হাদিসঃ-৪ আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি,  “নিশ্চয় মানবকুলের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো ঐ ব্যক্তি যে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময় জীবিত থাকবে এবং ঐ ব্যক্তি যে কবরকে সিজদার স্থানে পরিণত করবে।’’ (ইবনু খুযায়মা ৭৮৯, আহমাদ ৩৮৪৪ হদিসের মান সহিহ)।

হাদিসঃ-৫ আনাস (রা) বলেন,  রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় যে স্থান মাসজিদ নির্মাণের জন্য নির্ধারণ করেন সেখানে মুশরিকদের কবর ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) এর নির্দেশক্রমে মুশরিকদের কবরগুলো খুঁড়ে হাড়গোড় ইত্যাদি বেছে অন্যত্র ফেলে দেয়া হলো। (সুনান আবূ দাউদ ৪৫৩ হাদিসের মান সহিহ)।

হাদিসঃ-৬ নাবী (সা) বলেন, “মৃত (মু’মিন) ব্যক্তির হাড় ভাঙ্গা, তা তার জীবিত অবস্থায় ভাঙ্গার সমতুল্য।’’ [আবূ দাউদ ৩২০৭, ইবনে মাজাহ ১৬১৬ হাদিসের মান সহিহ)।

মন্তব্যঃ সুতরাং কুরাআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মাসজিদকে কবরমুক্ত করতে হলে কবর শুধু সমতল করলেই হবে না। বরং মাসজিদের ভিতরে পুরাতন কবর থেকে হাড়-গোড় তালাশ করে যত্নসহকারে তা অন্যত্র দাফন করতে হবে। অন্যথায় মাসজিদটি কবরমুক্ত হবে না। হাড়-গোড় না পাওয়া গেলে সেই স্থানে থেকে পরিমাণ মত মাটি নিয়ে অন্যত্র দাফন করতে হবে।

** কবর যিয়ারতের বিদআতঃ

কবর যিয়ারত একটি সুন্নাহ সম্মত নফল ইবাদাত। এই নফল ইবাদাত করতে গিয়ে আমাদের দেশের হাজার হাজাল লোক বিদআত লিপ্ত। তাই প্রথমে কবর যিয়ারত সম্পর্কি কিছু হাদিস তুলে ধরব যাতে সহজেই এর বৈধনা প্রমান পাওয়া যাবে। তারপর এ সম্পর্কিত কিছু বিদআত তুলে ধরব।

ইবন বুরায়দা (রহঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইতিপূর্বে আমি তোমাদের কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা কবর যিয়ারত করবে। কেননা, কবর যিয়ারতের ফলে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়।(আবু দাউদ ৩২২১ ইফাঃ)

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আম্মার কবর যিয়ারত করলেন এবং কাঁদলেন, উপস্থিত সবাইও কাঁদলেন। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমি আল্লাহর নিকট তাঁর জন্য ইস্তিগফার করার অনুমতি চেয়েছিলাম, আমাকে অনুমতি দেয়া হয়নি, অতঃপর তাঁর কবর যিয়ারত করার অনুমতি চেয়েছিলাম, তখন অনুমতি দেয়া হল। তোমরা কবর যিয়ারত করতে থাক, কবর মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (সহিহ মুসলিম ২১৩১ ইফাঃ, আবু দাউদ ৩২২০ ইফাঃ, তিরমিজি ১০৫৪ ইফাঃ)

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরস্থানে গমন করেন। তখন তিনি বলেনঃ

السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لاَحِقُونَ

অর্থঃ তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক, হে মু’মিনদের গৃহে বসবাসকারী। আর অবশ্যই আমরা ইনশাআল্লাহ্‌ তোমাদের সাথে মিলিত হব। (আবু দাউদ ৩২২৩ ইফাঃ)

যিয়াদের আযাদকৃত গোলাম কাযা’আ (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবূ সা’ইদ (রাঃ)-কে যিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে বারটি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন, বলতে শুনেছি, চারটি বিষয় যা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি (অথবা) তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ননা করতেন। আবূ সা’ইদ (রাঃ) বলেন, এ বিষয়গুলো আমাকে আশ্চর্যানিত করে দিয়েছে এবং চমৎকৃত করে ফেলেছে। (তা হল এই) স্বামী কিংবা মাহরাম ব্যতীত কোন মহিলা দুই দিনের পথ সফর করবে না। ‘ঈদুল ফিতর এবং ‘ঈদুল আযহা এ দুই দিন কেউ সিয়াম পালন করবে না। ‘আসরের পর সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত এবং ফজরের পর সূর্য উদয় হওয়া পর্যন্ত কেউ সালাত  আদায় করবে না। মসজিদে হারাম, আমার মসজিদ এবং মসজিদে আকসা, এ তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের জন্য সফরের প্রস্তুতি গ্রহন করবে না (সহিহ বুখারী ১৭৪২ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ এই হাদিসগুলি প্রমান করা যিয়ারত একটি সুন্নত সম্মত নফল কাজ। এই যিয়ারতের মাধ্যমে মুমিনের উপকার হল মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। মাইয়াত বা মৃত ব্যক্তির উপকার হল তার জন্য দুয়া করা দোয়া কবুল হলে মহান আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন। মাইয়াত যদি আযাব প্রাপ্ত হয় তাহলে আল্লাহ্‌ তায়ালা তার আযাব কমিয়ে দিবেন, আর যদি নেক্কার হয় তাহলে আল্লাহ্‌ তায়ালা তার মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দিবেন।

এই নফল ইবাদতটি করতে গিয়ে যে বিদআতি কাজ হয় তা নিম্মে উল্লেখ করা হলঃ

**  দোয়া জন্য জাল হাদিসঃ

আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত ‘আচ্ছালামুয়ালাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর’ দুয়াটি বানোয়াট এবং জাল। এরকম ভিত্তিহীন দোয়া না পড়ে উপরে বর্ণিত দুয়াটির উপরই আমল করতে হবে। ইহা ছাড়াও সহিহ হাদিসে কয়েকটি দোয়া উল্লেখ আছে।

** কবরে উপর বসা যাবে নাঃ

** আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ যদি জ্বলন্ত কয়লার উপর বসে পড়ে এবং তার কারণে তার কাপড় পুড়ে শরীর পর্যন্ত পৌছে যায়, তা তার জন্য কারো কবরের উপর বসা অপেক্ষা উত্তম হবে। (সহিহ মুসলিম ২১২০)

** আবূ মারছাদ আল-গানাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কবরের উপর বসবে না এবং সেই দিকে ফিরে সালাত (নামায/নামাজ) ও আদায় করবে না। (সহিহ মুসলিম, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ১০৫০, আল আহকাম ২০৯,২১০, তাহযীরুস সাজিদ ৩৩)

** জুতা পায় কবরের উপর হাটা যাবেন নাঃ

কবরস্থানে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া জুতা-সেন্ডেল পায়ে হাঁটা উচিৎ নয়।

বাশীর ইবনে খাসাসিয়া রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে হাঁটছিলাম। তিনি মুসলিমদের কবরস্থানে আসলেন। চলতে চলতে হঠাৎ দেখতে পেলেন এক ব্যক্তি জুতা পায়ে কবর গুলোর মাঝ দিয়ে হাঁটছে। তখন তিনি তাকে ডেকে বললেন, হে জুতাধারী, তুমি জুতা খুলে ফেল। সেই ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চিনতে পেরে জুতা খুলে ফেলে দিল। (আবুদাউদ ৩২৩০; ইবনু মাজাহ ১৫৬৮, তিরমিজি। হাকেম বলেন, হাদীসটির সনদ সহিহ, ইমাম নব্বী বলেন, হাদীসটির সনদ হাসান। এই হাদিসটি নাসাঈ শরীফে এমনিভাবে উল্লেখ আছে।

বশীর ইব্‌ন খাছাছিয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি একবার রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে চলতে ছিলাম। তিনি মুসলমানদের একটি কবরস্থানে গিয়ে বললেন যে, এরা বহু মন্দ কাজ পরিত্যাগে অগ্রগামী হয়েছে। অত:পর তিনি মুশরিকদের একটি কবরস্থানে গিয়ে বললেন যে, এরা বহু মঙ্গলময় কাজ পরিত্যাগে অগ্রগামী হয়েছে। অত:পর তিনি অন্যদিকে লক্ষ্য করে দেখলেন যে, এক ব্যক্তি জুতা পায়ে কবরস্থানে মাঝখান দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। তখন তিনি বললেন, “হে পাকা জুতা পরিধানকারী, জুতা ফেলে দাও (খুলে নাও)। (নাসাঈ হাদিস নম্বর ২০৪৮)

***  মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারত করার বিধানঃ

মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারত করা জায়েয কি না এ ব্যাপারে আলেমদের মাঝে দ্বিমত পরিলক্ষীত হয়। তবে অগ্রাধিকারযোগ্য মত হল, মহিলাদের জন্য কবর যিয়ারত করা জায়েজ নয়।

আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতকারী মহিলাদের লা’নত করেছেন। (তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ১০৫৬ ইফাঃ, ইবনু মাজাহ ১৫৭৬)

কতক আলিম মনে করেন, হাদীসটি হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক কবর যিয়ারতের অনুমতি প্রদানেরও পূর্বের। সুতরাং কবর যিয়ারতের অনুমতি প্রদানের পর এখন পুরুষ-মহিলা সকলেই এই অনুমতির অন্তর্ভুক্ত।  তবে অধিকাংশ ফকিহর মতে নারীদের কবর জিয়ারতের অনুমতি নেই। কেননা

নারীদের ইলম ও সবরের ক্ষমতা কম। তারা করবেন নিকট বিলাপ করে ও কান্নাকাটি যা বিদআত। অনেক সময় ফরজ পর্দার লঙ্ঘন হয়।

***  অমুসলিমের কবর যিয়ারত করাঃ

শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে হলে অমুসলিমের কবর যিয়ারত করা জায়েয। অনেক ভাবেন মুসলিমদের কবর জিয়ারতই শরীয়ত সম্মত হয় কিনা। আর অমুসলীমদের কবর জিয়ারততো না জায়েযই হবে।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আম্মার কবর যিয়ারত করলেন এবং কাঁদলেন, উপস্থিত সবাইও কাঁদলেন। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমি আল্লাহর নিকট তাঁর জন্য ইস্তিগফার করার অনুমতি চেয়েছিলাম, আমাকে অনুমতি দেয়া হয়নি, অতঃপর তাঁর কবর যিয়ারত করার অনুমতি চেয়েছিলাম, তখন অনুমতি দেয়া হল। তোমরা কবর যিয়ারত করতে থাক, কবর মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (সহিহ মুসলিম ২১৩১ ইফাঃ, আবু দাউদ ৩২২০ ইফাঃ, তিরমিজি ১০৫৪ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ উক্ত হাদীসে প্রমাণিত হয়, শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে মুশরিকদের কবর যিয়ারত করা জায়েজ।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

 

Leave a comment