রমাজান মাসের চাঁদের গুরুত্ব

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

চাঁদ দেখার সাথে সাথে রমজান মাস শুরু হয়ে যায়। রমজান মাসে কে কেন্দ্র করেই সিয়াম সাধনা চলতে থাকে। এই মাসের চাঁদের উপর ভিত্তি করেই বিশ্বের ১৮০ কোটি মুসলিম সিয়াম সধনা শুরু করে। মুসলিমদের ধর্মীয় উৎসব, রীতিনীতি, অনুশাসনের জন্য অনুসরণ করেন ইসলামিক চন্দ্র বর্ষপঞ্জী। এই চন্দ্র বর্ষপঞ্জীর নয় নম্বর মাস হচ্ছে রমজান। শাওল মাস যখন শেষ হয়ে আসে, তখন সবাই পরিস্কার আকাশে এক নতুন চাঁদের অপেক্ষায় থাকেন। প্রতি বছর রমজান মাস ইংরেজী ক্যালেন্ডারের তুলনায় ১১ দিন এগিয়ে আসে। এর ফলে প্রতি বছর রমজান মাসের অভিজ্ঞতা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা ভিন্নতর। কারণ বছরের বিভিন্ন সময় দিন দীর্ঘ কিংবা ছোট হয়। রমজান মাসে মুসলিমদের সূর্যোদয়ের আগে থেকে সূর্যাস্ত পানাহার থেকে বিরত থেকে রোজা রাখতে হয়। যদি মুসলিমরা সৌর বর্ষপঞ্জী অনুসরণ করতো, তাহলে রমজানের সময় প্রতি বছর ঠিক একই মৌসুমে হতো। এর মানে বিশ্বের কোন কোন অংশের মুসলিমদের সব সময় গ্রীস্মের সময় রোজা রাখতে হতো, যখন কিনা দিন সবচেয়ে লম্বা। আর কোন দেশে হয়তো শীতের সময় রোজা রাখতে হতো, যখন দিন ফুরিয়ে যায় দ্রুত। কিন্তু চন্দ্র বর্ষপঞ্জী অনুসরণের সুবিধা হচ্ছে, এটি বিশ্বের সব মুসলিমকে বিভিন্ন মৌসুমে রোজার অভিজ্ঞতার সুযোগ করে দেয়। প্রতি তেত্রিশ বছরে রমজান মাস ঘুরে ফিরে আবার সৌর বর্ষপঞ্জীর একই সময়ে ফিরে আসে। এই রমজান মাসকে কেন্দ্র করে তাই মুসলীমদের আমল শুরু হয়। কাজেই এই মাসের চাঁদের একটা অতিরিক্ত কদর আছে। মহান আল্লাহ বলেন,

* يُرِيدُ اللّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ*

অর্থঃ আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা’আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। (সুরা বাকারা ২:১৮৫)।

এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা রমজানের সম্পূর্ণ সময়কে গণনা করে সিয়াম আদায়ের নির্দেশ প্রদার করছেন। অর্থাৎ রমজন মাসের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সিয়াম সাধনাকে সকল মুসলীমদের জন্য ফরজ করেছেন।

চাঁদ দেখে সিয়ামঃ

মহান আল্লাহ তাআলা রমজানের সম্পূর্ণ সময়কে গণনা করে সিয়াম আদায়ের নির্দেশ প্রদার করছেন। আমাদের প্রিয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আমাদের শিক্ষা প্রদান করেছেন সঠিকভাবে। তিনি আমাদের চাদের সাহায্য গণনা করতে শিখিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাআলা স্বয়ং কুরআনে চাঁদকে সময় গণনা জন্য সৃষ্টি করেছেন। তিনি এরশাদ করেন,

*يَسْأَلُونَكَ عَنِ الأهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ*

অর্থঃ তোমার নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। বলে দাও যে এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ (গণনা) এবং হজ্বের সময় ঠিক করার মাধ্যম। (সুরা বাকারা ২:১৮৯)।

চাঁদ দেখে সিয়াম শুরু কর আর চাঁদ দেখে সিয়াম শেষ কর সন্দেহ হলে সাবান মাস পূর্ণকরঃ

চাঁদ দেখার উপরই রমজানের সাওম নির্ভর করে। চাঁদ দেখেই সিয়াম শুরু করতে হবে। আবার চাঁদ দেখেই সিয়ামের পরিশমাপ্তি ঘটাতে হবে।

 আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের কথা আলোচনা করে বললেনঃ চাঁদ না দেখে তোমরা সাওম পালন করবে না এবং চাঁদ না দেখে ইফতার করবে না। যদি মেঘাছন্ন থাকে তাহলে তাঁর সময় (ত্রিশ দিন) পরিমান পূর্ন করবে। (সহীহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৭৮৫, ১৭৮৬ ও ১৭৮৮ ইঃফাঃ; রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২২৯ (শব্দাবলী বুখারীর), সহিহ মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, “তোমাদের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ত্রিশ দিন রোযা রাখ।”এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহীহ বুখারী ১৯০৯,  সহিহ মুসলিম ১০৮১, তিরমিযী ৬৮৪, নাসায়ী ২১১৭-২১১৯, ২১২৩, ইবনু মাজাহ ১৬৫৬, আহমাদ ৭৪৬৪, ৭৫২৭, ৭৭২১, ৭৮০৪, ৯১১২, ৯১৭৬, ৯২৭১, ৯৫৪৩, ৯৫৭৫, ২৭২১১, ২৭২৬৫, ২৭৩১৭, দারেমী ১৬৮৫।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা রমযানের পূর্বে রোযা রেখো না। তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ছাড়। আর যদি তার সামনে কোন মেঘ আড়াল করে, তবে (মাসের) ত্রিশ দিন পূর্ণ কর।” (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৩৩, হাদিসের মান হাসান সহিহ, এই হাদিসটি আরও আছেঃ তিরমিযী ২৮৮, নাসায়ী ২১২৪, ২১২৫, ২১২৯, ২১৩০, আবূ দাউদ ২৩২৭, আহমাদ ১৯৩২, ১৯৮৬, ২৩৩১, ২৭৮৫, ৩৪৬৪, ইবনু মাজাহ ৬৩৫, দারেমী ১৫৬৩, ১৬৮৬)।

উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা চাঁদ না দেখা পর্যন্ত সওম (রোযা) পালন করবে না এবং তা না দেখা পর্যন্ত সওম শেষ (ভঙ্গ) করবে না। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় তোমরা যদি চাঁদ না দেখতে পাও তাহলে (শা‘বান) মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ করো (অর্থাৎ- এ মাসকে ত্রিশ দিন হিসেবে গণ্য করো)। অপর বর্ণনায় আছেঃ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ মাস ঊনত্রিশ রাতেও হয়। তাই চাঁদ না দেখা পর্যন্ত সওম পালন করবে না। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ করো। (হাদিসের মান সহিহ মিশকাত-১৯৬৯, বুখারী ১৯০৬, মুসলিম ১০৮০, নাসায়ী ২১২১, মালিক ১০০২, আহমাদ ৫২৯৪, দারিমী ১৭২৬, দারাকুত্বনী ২১৬৭, সুনানুল কুবরা লিল বাযহাক্বী ৭৯২২, ইবনু হিববান ৩৪৪৫, ইরওয়া ৯০৩, সহীহ আল জামি‘ ৭৩৫২)

        আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা সওম পালন করো চাঁদ দেখে এবং ছাড়ো (ভঙ্গ করো) চাঁদ দেখে। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে শা‘বান মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ করো। করো। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-১৯৭০, বুখারী ১৯০৯, মুসলিম ১০৮১, তিরমিযী ৬৮৪, নাসায়ী ২১১৭, ২১১৮, আহমাদ ৯৫৫৬, ৯৩৭৬, ৯৮৫৩, ৯৮৮৫, ১০০৬০, দারিমী ১৭২৭, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৭৯৩৩, ৭৯৩২, ইবনু হিব্বান ৩৪৪২, ইরওয়া ৯০২, সহীহ আল জামি‘ ৩৮১০)।

আবূল বাখতারী (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা ‘উমরাহ্ করার জন্য বের হলাম। অতঃপর যখন আমরা ‘বাত্বনি নাখলাহ্’ নামক (মক্কা আর ত্বয়িফের মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম) স্থানে পৌঁছে আমরা (নতুন) চাঁদ দেখলাম। কিছু লোক বলল, এ চাঁদ তৃতীয় রাতের (তৃতীয়ার), কিছু লোক বলল, এ চাঁদ দু’ রাতের (দ্বিতীয়ার) চাঁদ। এরপর আমরা ইবনু ‘আব্বাস-এর সাক্ষাত পেলাম। তাঁকে বললাম, আমরা নতুন চাঁদ দেখেছি। আমাদের কেউ কেউ বলেন, এ চাঁদ তৃতীয়ার চাঁদ। আবার কেউ বলেন, দ্বিতীয়ার চাঁদ। ইবনু ‘আব্বাস জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কোন রাতে চাঁদ দেখেছ? আমরা বললাম, ঐ ঐ রাতে। তখন ইবনু ‘আব্বাস  বললেন, নিশ্চয়ই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাযানের সময়কে চাঁদ দেখার উপর নির্দিষ্ট করেছেন। অতএব এ চাঁদ সে রাতের যে রাতে তোমরা দেখেছ।

এ বর্ণনাকারী হতেই অন্য একটি বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমরা ‘যা-তি ‘ইরক্ব’ নামক স্থানে (বাত্বনি নাখলাহ্’র কাছাকাছি একটি স্থান) রমাযানের চাঁদ দেখলাম। অতএব আমরা ইবনু ‘আব্বাসকে জিজ্ঞেস করার জন্য লোক পাঠালাম। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বললেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা শা‘বানমাসকে রমাযানের চাঁদ দেখা পর্যন্ত দীর্ঘ করেছেন। যদি তোমাদের ওপর আকাশ মেঘলা থাকে, তাহলে গণনা পূর্ণ করো (অর্থাৎ- শা‘বান মাসের সময় ত্রিশদিন পূর্ণ করো)। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-১৯৮১, মুসলিম ১০৮৮, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৯০২৭। তবে ইরওয়া ৯০৩, সহীহ আল জামি‘ ১৭৯০-তে শেষের অংশটুকু রয়েছে)।

 

সাবান মাস ২৯ বা ৩০দিনে হতে পারেঃ

উম্মে সালমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মাসের জন্য তাঁর স্ত্রীদের সঙ্গে ঈলা করলেন। ঊনত্রিশ দিন পার হওয়ার পর সকালে বা সন্ধায় তিনি তাঁদের নিকট গেলেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হল, আপনি তো এক মাস পর্যন্ত না আসার শপথ করেছিলেন? তিনি বলেলেন, মাস ঊনত্রিশ দিনেও হয়েও থাকে।(সহীহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৭৮৯ ও ১৭৯০ ইঃফাঃ)।

ইবনু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দু’হাতের অঙ্গুলী তুলে ইশারা করে) বলেনঃ মাস এত এত দিনে হয় এবং তৃতীয় বার বৃদ্ধাঙ্গুলীটি বন্ধ করে নিলেন।(সহীহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৭৮৭ ইঃফাঃ)

ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমরা উম্মি জাতি। হিসাব-কিতাব জানি না, কোন মাস এত, এত, এত (অর্থাৎ- কোন মাস এভাবে বা এভাবে এভাবে হয়।) তিনি তৃতীয়বারে বৃদ্ধাঙ্গুলি বন্ধ করলেন। তারপর বললেন, মাস এত দিনে, এত দিনে এবং এত দিনে অর্থাৎ- পুরা ত্রিশ দিনে হয়। অর্থাৎ- কখনো মাস ঊনত্রিশ আবার কখনো ত্রিশ দিনে হয়। [হাদিসের মান সহিহঃ মিশকাত-১৯৭১, বুখারী ১৯১৩, মুসলিম ১০৮০, আবূ দাঊদ ২৩১৯, নাসায়ী ২১৪১, মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ্ ৯৬০৪, আহমাদ ৫০১৭, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮২০০।

সাবান মাসের শেষে রমজানের সাওম শুরু না করাঃ

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন রমযান মাসের এক বা দু’দিন আগে (শা’বানের শেষে) রোযা পালন শুরু না করে। অবশ্য সেই ব্যক্তি রোযা রাখতে পারে, যে ঐ দিনে রোযা রাখতে অভ্যস্ত। [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৩২। হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-১৯৭৩, এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহীহ বুখারী ১৯১৪, সহীহ মুসলিম ১০৮২, তিরমিযী ৬৮৪, ৬৮৫, নাসায়ী ২১৭২, ২১৭৩, আবূ দাউদ ২৩৩৫, ইবনু মাজাহ ১৬৫০, আহমাদ ৭১৫৯, ৭৭২২, ৮৩৭০, ৯০৩৪, ৯৮২৮, ১০২৮৪, ১০৩৭৬, ২৭২১১, ২৭৩১৭, দারেমী ১৬৮৯। মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক্ব ৭৩১৫, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৭৯৬৩।

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যখন শা’বান মাসের অর্ধেক বাকী থাকবে, তখন তোমরা রোযা রাখবে না।”

 [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৩৪, হাদিসের মান হাসান সহিহ, এই হাদিসটি আরও আছেঃ তিরমিযী ৭৩৮, ৬৮৪, ৬৮৫, সহীহুল বুখারী ১৯১৪, মুসলিম ১০৮২, নাসায়ী ২১৭২, ২১৭৩, আবূ দাউদ ২৩৩৫, ২৩৩৭, সহিহ: মিশকাত-১৯৭৪, ইবনু মাজাহ ১৬৫০, ১৬৫১, ১৬৫৫, আহমাদ ৯৪১৪, ২৭২১১, ২৭৩১৭, দারেমী ১৬৮৯, ১৭৪০]

আবূ ইয়াক্বাযান আম্মার ইবনে ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সন্দেহের দিনে রোযা রাখল, সে অবশ্যই আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাফরমানী করল।’ [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৩৫, হাদিসের মান হাসান সহিহ, এই হাদিসটি আরও আছেঃ তিরমিযী ৬৮৬, নাসায়ী ২১৮৮, আবূ দাউদ ২৩৩৪, ইবনু মাজাহ ১৬৪৫, দারেমী ১৬৮২]

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা কেউ রমজানের একদিন কিংবা দুই দিন আগে থেকে সাওম  শুরু করবে না। তবে কেউ যদি এ সময় সিয়াম পালনে অভ্যস্ত থাকে তাহলে সে সেদিন সাওম করতে পারবে। (সহিহ বুখারী হাদিস ১৮৯৩ ইঃফাঃ)।

মন্তব্যঃ সিয়ামসহ সকল প্রকারের ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব হল পরিপূর্ণ কুরআন সুন্নাহর অনুসরণ করা এবং শরীয়তের সকল বিষয় মহান  আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আগত বিষয়াদির উপর পরিপূর্ণ নির্ভর করা। তাঁদের দেওয়া নীতি-বিধান মেনে চলা। উপরোক্ত হাদিসের আলোকে আমরা স্পষ্টরূপে দেখতে পাই মহান আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসের আগমন নিশ্চিত করতে কয়েকটি নিদর্শন নির্দিষ্টি করে দিয়েছেন। যেমনঃ

(১) চাঁদ দেখে সিয়াম শুরু করতে হবে।

(২) চাঁদ দেখে সিয়াম শেষ করতে হবে।

(৩) চাঁদ দেখা না গেলে সাবান মাসকে ত্রিশ দিন ধরে নিতে হবে।

(৪) সাবান মাসের শেষে দিকে সিয়াম শুরু করে রমজান মাসকে এগিয় না আনা।

(৫) সিয়াম পালনে অভ্যস্ত থাকলে, সে সাবান মাসের শেষে দিকে সিয়াম পালন করতে পারবে।

জ্যোতিষগণনার উপর নির্ভর করা যাবে নাঃ

জ্যোতিষ গণনা বা পঞ্জিকা মতে রমাযান মাস ধরে নিয়ে সিয়াম শুরু করা যাবেনা। যদি জ্যোতিষীদের হিসাব মতে আজকের রাত রমাযানের প্রথম তারীখ হয়, কিন্তু সন্ধ্যায় কেউই চাঁদ না দেখে থাকে, তাহলে সিয়ম শুরু করা যাবে না। যদি চাঁদ না দেখে জ্যোতিষ-গণনা বা পঞ্জিকা মতে সিয়াম রাখি তবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অবমাননা করা হবে। সহিহ হাদিসে এসেছে,

আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা‘বান মাসে যেরূপ সতর্ক থাকতেন অন্য মাসে এতটা সতর্ক থাকতেন না। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাযানের চাঁদ দেখে সিয়াম পালন করতেন। আকাশ মেঘলা থাকলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (শা‘বান মাস) ত্রিশদিন পুরা করার পর সওম শুরু করতেন। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-১৯৮০, আবূ দাঊদ ২৩২৫, আহমাদ ২৫১৬১, সহীহ ইবনু হিববান ১৯১০, দারাকুত্বনী ২১৪৯, মুসতাদারাক লিল হাকিম ১৫৪০, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৪৪৪, ইরওয়া ৯০৩, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৭৯৩৯)।

জ্যোতিষ-গণনা বা পঞ্জিকা মতে আপনি সিয়াম শুরু করছেন অথচ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আকাশ মেঘলা থাকলে শা‘বান মাস ত্রিশদিন ধরে সিয়াম শুরু করতেন। কাজেই জ্যোতিষ-গণনা বা পঞ্জিকা মতে সিয়াম শুরু করা যাবেনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ, “তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ছাড়” পালনের সমস্যা হবে পারে।  তা ছাড়া পঞ্জিকার হিসাব নির্ভুল নয়। এক এলাকায় সচল হলেও অন্য এলাকায় অচল। অতএব তার উপর ভরসা করে চোখ বুজে রোযা রাখা বৈধ নয়। পঞ্জিকার হিসাবের উপর নির্ভর করার কথা শরীয়ত ও বিবেকে স্বীকৃত নয়। কেননা, মুসলিম উম্মাহ   মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এর নবুয়াত কাল থেকে নিয়ে আজও পর্যন্ত চাঁদ দেখার উপরই নির্ভর করেছে। তারা কখন জ্যোতিষ-গণনা বা পঞ্জিকার হিসাবের উপর ভরসা করেনি।

মন্তব্যঃ জ্যোতিষী হিসাব’কে বুঝাতে হলে প্রখর জ্ঞান থাকতে হয়। তাই এ হিসাব খুবই কম সংখ্যক লোকই রাখতে পারে। ইসলাম সার্বজনিন বিধায় ব্যাপরাটি জটিল না করে চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল করে দেওয়া হয়েছে। যাতে এ বিষয়ে লোকেরা অসুবিধা তথা জ্যেতিষী গণনার কষ্ট থেকে রেহাই পায়। তার প্রমান নিম্মের হাদিসখানা।

ইবন ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমরা উম্মী জাতি। আমরা লিখি না এবং হিসাবও করিনা। মাস এরুপ অর্থাৎ কখনও উনত্রিশ দিনের আবার কখনও ত্রিশ দিনের হয়ে থাকে। (সহীহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৯৩ ইঃফাঃ)।

 চাঁদ দেখার জন্য দুরবীন ব্যবহারঃ

চাঁদ দেখার জন্য দূরের জিনিস কাছের করে দেখার যন্ত্র দূরবীন ব্যবহার করা যাবে। এই প্রযুক্তির ব্যবহার দোষা নয়। অবশ্য দূরবীন ব্যবহার করা বা চাঁদ দেখার জন্য তা ক্রয় করা ওয়াজেব নয়। কারণ, বাহ্যিকভাবে সুন্নাহ এ কথাই নির্দেশ করে যে, এর জন্য স্বাভাবিক দর্শনের উপর নির্ভর হবে, অস্বাভাবিক কোন দর্শনের উপর নয়। তবুও যদি কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তি ঐ যন্ত্রের মাধ্যমে চাঁদ দেখে থাকে, তাহলে তার ঐ দেখার উপর আমল করা যাবে। বহু পূর্ব যুগেও লোকেরা ২৯শে শা’বান বা ২৯ শে রমাযান উঁচু উঁচু মিনারে চড়ে ঐ শ্রেণীর যন্ত্রের মাধ্যমে চাঁদ দেখত। যাই বা হোক, যে কোন মাধ্যম ও উপায়ে, যে কোন প্রকারে চাঁদ দেখা গেলে সেই দেখার উপর আমল করা জরুরী হবে। কেননা, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এর বাণী এ ব্যাপারে সাধারণ। তিনি বলেন, ‘‘তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে ঈদ কর।’’ (সুআলান ফিস-সিয়ামঃ ৩১পৃঃ;  রমাযানের ফাযায়েল ও রোযার মাসায়েল, আবদুল হামীদ ফাইযী)।

উদয়স্থলের বিভিন্নতাঃ

আধুনিক যুগের আমরা সকলে জানি এবং ঐক্যমত প্রষণ করি যে, চাঁদের উদয়স্থল ভিন্ন ভিন্ন এবং উদয়কালও ভিন্ন ভিন্ন। যার ফলে একই সময় পৃথিবীর কোথাও চাঁদ দেখা যায়, কোথাও যায় না। একটু লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, সাধারণত মধ্য প্রাচ্যে আমাদের দেশে তুলনায় এক দিন আগে চাঁদ দেখা যায়। তাই বর্তমানে বিভিন্ন দেখে চাঁদ দেখান উপর নির্ভর করে সিয়াম শুরু করে থাকে এবং ঈদ উৎজাপন করে থাকে। কিন্ত ইদানিং কিছু মুসলিম ভাই দাবি করে থাকে পৃথিবীর কোন স্থানে বা দেশে যদি রমজান মাসের চাঁদ দেখা যায় এবং সেই সংবাদ যদি বিভিন্ন দেশে পৌঁছে যায় তবে সেই সংবাদের ভিত্তিতে বিশ্বের সকল মুসলিম কলে সিয়াম শুরু করবে এবং ঠিক তেমনি ভাবে যদি শাওয়ালের চাঁদ দেখা যায় তবে সিয়াম ছেড়ে দিবে। তাদের মতামত অনেকে প্রত্যাখান করেছে। কিন্তু তার পরও সাম্প্রতি কালে বিষয়টির চর্চা একটু বেশীই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেক স্থানে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। পক্ষে বিপক্ষে দলীল-প্রমাণ ও যুক্তি দিতেও দেখা যায়। আবার অনেকে এসবের তোয়াক্কা না করে অন্য দেশে চাঁদ দেখা দিলে বিশেষ করে সৌদি আবরে (চাঁদ) দেখা দিলে তারা সউদীর সাথে সিয়াম পালন শুরু করে দেয় কিংবা ঈদ করে। এর ফলে একই দেশে ও সমাজে বসবাস করার পরেও কেউ এক-দুই দিন আগেই সিয়াম শুরু করে বা ঈদ উত্জাপন করে। যারা এটি করে  থাকে তারা কিছু যুক্তি ও প্রদান করে থাকে। প্রথমে তাদের কিছু যুক্তি তুলে ধরব। তার পর দেখব যে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সিয়াম শুরু করে তাদের যুক্তি।

যারা মনে করে বিশ্বের সকল দেশে একই সাথে  সিয়াম শুরু ও ঈদ পালন করবে তাদের যুক্তি হলঃ

প্রথম যুক্তিঃ

চাঁদ দেখার উপরই রমজানের সাওম নির্ভর করে। চাঁদ দেখেই সিয়াম শুরু করতে হবে। আবার চাঁদ দেখেই সিয়ামের পরিশমাপ্তি ঘটাতে হবে। কাজেই পৃথিবির কোথাও চাঁদ দেখা গেলে সিয়াম শুরু করতে হবে।

 আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের কথা আলোচনা করে বললেনঃ চাঁদ না দেখে তোমরা সিয়াম পালন করবে না এবং চাঁদ না দেখে ইফতার করবে না। যদি মেঘাছন্ন থাকে তাহলে তাঁর সময় (ত্রিশ দিন) পরিমান পূর্ন করবে। (সহীহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৭৮৫, ১৭৮৬ ও ১৭৮৮ ইসলামি ফাইন্ডেশন, সহিহ মুসলিম ২৩৭৫, ২৩৭৬, ২৩৭৭; রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন হাদিস নম্বর ১২২৯)।

যেহেতু চাঁদ দেখা গেছে কাজেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের কথা  চাঁদ দেখে সিয়াম পালন করতে বলেছেন। তিনি কোন সিমা উল্লেখ করেনি। তাই আমরা চাঁদ দেখার প্রমান পেলেই সিয়াম শুরি করব।

তাদের দ্বিতীয় যুক্তিঃ

যদি কোন সৎ মুসলিম চাঁদ দেখতে পায় তবে তার সাক্ষের ভিত্তিতে সিয়াম শুরু করা যাবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সৎ মুসলিম ব্যক্তির চাঁদ দেখার সংবাদের কারণে নিজে রোযা রেখেছেন এবং সাহাবীদেরও রোযা পালনের আদেশ দিয়েছেন।

 যেমন হাদিসে এসেছঃ  ইবনে উমার (রাযিঃ) বলেনঃ “ লোকেরা হিলাল দেখা-দেখি করে, তারপর আমি রাসূল (সাঃ) কে সংবাদ দিলাম যে, আমি হিলাল দেখেছি। তাই তিনি (সাঃ) রোযা রাখেন এবং লোকদের রোযা রাখার আদেশ দেন”। [আবু দাঊদ, ২৩৪০/ইবনু হিব্বান ৩৪৪৭]

অন্য এক হাদিসে এসেছেঃ একদা এক আ’রাবী (বেদুইন) নবী (সাঃ) কে সংবাদ দেয় যে, সে হিলাল দেখেছে, তখন রাসূল (সাঃ) তাকে বলেনঃ “তুমি কি সাক্ষী দিচ্ছ যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো উপাস্য নেই এবং অবশ্যই মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল”? সে বললঃ হাঁ। তারপর নবীজী বিলালকে বললেনঃ “বিলাল উঠ এবং লোকদের সংবাদ দিয়ে দাও যেন তারা আগামী কাল রোযা রাখে”। [আবু দাঊদ, সিয়াম অধ্যায়, নং (২২৪০) তিরমিযী, সিয়াম অধ্যায়ঃ নং (৬৯১) নাসাঈ, ইবনু মাজাহ]

তাই তাদের দাবি, যদি কোনো এক দেশবাসী চাঁদ দেখে এবং তাদের সত্য সংবাদের ভিত্তিতে পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম দেশবাসীর প্রতি সিয়াম শুরু করা এবং ঈদ পালন করা জরূরী।  আধুনিক যুগ এতটাই প্রযুক্তি সম্পন্ন যে পৃথীবির কোথাও চাঁদ উঠলে সাথে সাথে নিশ্চত সংবাদের মাধ্যমে জানা যাবে। ভুল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

তাদের তৃতীয় যুক্তি হলঃ এক সাথে রোযা শুরু করা ও ঈদ করাতে মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।

যারা মনে করে চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সিয়াম শুরু ও ঈদ পালন করবে তাদের যুক্তি হলঃ

 প্রথম যুক্তিঃ

চাদ না দেখে সিয়াম পালন করতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করছেন, তাই চাঁদ না দেখে সিয়াম শুরু করা যাবে না।

আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের কথা আলোচনা করে বললেনঃ চাঁদ না দেখে তোমরা সিয়াম পালন করবে না এবং চাঁদ না দেখে ইফতার করবে না। যদি মেঘাছন্ন থাকে তাহলে তাঁর সময় (ত্রিশ দিন) পরিমান পূর্ন করবে। (সহীহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৭৮৫, ১৭৮৬ ও ১৭৮৮ ইসলামি ফাইন্ডেশন, সহিহ মুসলিম ২৩৭৫, ২৩৭৬, ২৩৭৭; রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন হাদিস নম্বর ১২২৯)।

চাঁদ দেখেই সিয়াম শুরু করতে হবে। আবার চাঁদ দেখেই সিয়ামের পরিশমাপ্তি ঘটাতে হবে। কিন্তু এখানে সিমার বাধ্য বাধকতা আছে। যেমনঃ

ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া, ইয়াহইয়া ইবনু আয়্যুব, কুতায়বা ও ইবনু হুজর (রহঃ) … কুরায়ব (রহঃ) থেকে বর্ণিত যে, উম্মুল ফযল বিনত হারিস তাকে সিরিয়ায় মু’আবিয়া (রাঃ) এর নিকট পাঠালেন। (কুরায়ব বলেন) আমি সিরিয়ায় পৌছলাম এবং তার প্রয়োজনীয় কাজটি সমাধা করে নিলাম। আমি সিরিয়া থাকা অবস্থায়ই রমযানের চাঁদ দেখা গেল। জুমু’আর দিন সন্ধ্যায় আমি চাঁদ দেখলাম। এরপর রমযানের শেষভাগে আমি মদিনায় ফিরলাম। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) আমার নিকট জিজ্ঞাসা করলেন এবং চাঁদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। এরপর জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কোন দিন চাঁদ দেখেছ? আমি বললাম, আমরা তো জুমু’আর দিন সন্ধায় চাঁদ দেখেছি।

তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি নিজে দেখেছ কি? আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি দেখেছি এবং লোকেরাও দেখেছে। তারা সিয়াম পালন করেছে এবং মুআবিয়া (রাঃ) ও সিয়াম পালন করেছেন। তিনি বললেন, আমরা কিন্তু শনিবার সন্ধ্যায় চাঁদ দেখেছি। আমরা সিয়াম পালন করতে থাকব, শেষ পর্যন্ত ত্রিশ দিন পূর্ণ করব অথবা চাঁদ দেখব। আমি বললাম, মু-আবিয়া (রাঃ) এর চাঁদ দেখা এবং তাঁর সিয়াম পালন করা আপনার জন্য যথেষ্ট নয় কি? তিনি বললেন, না, যথেষ্ট নয়। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এরূপ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। (সহিহ মুসলিম ইসলামি ফাউন্ডশন  হাদিস নম্বর ২৩৯৯)।

মন্তব্যঃ সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে তাই নিজ এলাকার চাঁদ দর্শনের উপরই আমাদের সালাফদের আমল।

০২।  এলাকা ভিত্তক সিয়াম পালন শুরু করাঃ

 ইবনে উমার (রাযিঃ) বলেনঃ “ লোকেরা হিলাল দেখা-দেখি করে, তারপর আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সংবাদ দিলাম যে, আমি হিলাল দেখেছি। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রোযা রাখেন এবং লোকদের রোযা রাখার আদেশ দেন”। [আবু দাঊদ, ২৩৪০/ইবনু হিব্বান ৩৪৪৭]

মন্তব্যঃ এই হাদিস দ্বারা সাহাবী ইবনে উমার (রাযিঃ) মদিনার বসে চাঁদ দেখেছিল এবং মদিনায় অবস্থিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সংবাদ দিয়েছিল। মদীনার চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের রাজিঃ সিয়াম পালনের হুকুম দিয়েছিলেন। তিনি যে শহরের অধিবাসী ছিলেন এবং সেই শহরে নবী (সাঃ) কে সংবাদ দিয়েছিলেন। এমন সংবাদ গ্রহণে আপত্তি নেই কারণ এটা এক দেশ বরং একই শহরের সংবাদ, যাতে চন্দ্রের উদয়স্থল এক।

৩। চাঁদ না দেখা গেলে রমজান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ করবেঃ

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকালে যদি চাঁদ না দেখা যায় তবে সিয়াম পালন শুরু করা যাবে না। কারন শাবান মাস ত্রিশ দিনেও হতে পারে। কাজেই যে দেশে চাঁদ দেখবে শুধু তারাই সিয়াম পালন করবে।  

উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা চাঁদ না দেখা পর্যন্ত সওম (রোযা) পালন করবে না এবং তা না দেখা পর্যন্ত সওম শেষ (ভঙ্গ) করবে না। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় তোমরা যদি চাঁদ না দেখতে পাও তাহলে (শা‘বান) মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ করো (অর্থাৎ- এ মাসকে ত্রিশ দিন হিসেবে গণ্য করো)। অপর বর্ণনায় আছেঃ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ মাস ঊনত্রিশ রাতেও হয়। তাই চাঁদ না দেখা পর্যন্ত সিয়াম পালন করবে না। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ করো। (হাদিসের মান সহিহ মিশকাত-১৯৬৯, বুখারী ১৯০৬, মুসলিম ১০৮০, নাসায়ী ২১২১, মালিক ১০০২, আহমাদ ৫২৯৪, দারিমী ১৭২৬, দারাকুত্বনী ২১৬৭, সুনানুল কুবরা লিল বাযহাক্বী ৭৯২২, ইবনু হিববান ৩৪৪৫, ইরওয়া ৯০৩, সহীহ আল জামি‘ ৭৩৫২)

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা সওম পালন করো চাঁদ দেখে এবং ছাড়ো (ভঙ্গ করো) চাঁদ দেখে। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তাহলে শা‘বান মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ করো। করো। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-১৯৭০, বুখারী ১৯০৯, মুসলিম ১০৮১, তিরমিযী ৬৮৪, নাসায়ী ২১১৭, ২১১৮, আহমাদ ৯৫৫৬, ৯৩৭৬, ৯৮৫৩, ৯৮৮৫, ১০০৬০, দারিমী ১৭২৭, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৭৯৩৩, ৭৯৩২, ইবনু হিব্বান ৩৪৪২, ইরওয়া ৯০২, সহীহ আল জামি‘ ৩৮১০)।

মন্তব্যঃ শাবান মাসের ২৯ তারিখে কোনো স্থানে চাঁদ দেখা না দিলে, তাদের জন্য ৩০ শাবান পূরণ করতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেনে। সেখানকার লোকদের জন্য ৩০ শাবান হচ্ছে (ইয়ামুশ্ শাক্ক) সন্দেহের দিন। এরা যদি সে দিন অন্য দেশের সংবাদের ভিত্তিতে রোযা রাখে তাহলে, তারা সন্দেহের দিনে রোযাপালনকারী হবে না কি? অথচ নবী (সাঃ) সন্দেহের দিনে সিয়াম পালন করতে নিষেধ করেছেন। বলতে পারেন এক পর্যায়ে পৃথিবীতে আর সন্দেহের দিনই থাকবে না।

৪। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত চাঁদ দেখান দোয়া পড়া থেকে বঞ্চিতঃ

চাঁদ দেখা একটি আমলঃ নতুন চাঁদ দেখলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করতে বলেছেন। ত্বালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নতুন চাঁদ দেখতেন তখন এই দো‘আ পড়তেন,

“আল্লা-হুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি অলঈমা-নি অসসালা-মাতি অলইসলা-ম, রাববী অরাববুকাল্লাহ, (হিলালু রুশদিন অখায়র)।”

 অর্থঃ হে আল্লাহ! তুমি ঐ চাঁদকে আমাদের উপর উদিত কর নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সাথে। (হে চাঁদ) আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ। (হেদায়েত ও কল্যাণময় চাঁদ!)। [হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৩৬, হাদিসের মান হাসান কিন্তু বন্ধনী-ঘেরা শব্দগুলি তিরমিযীতে নেই। এই হাদিসটি আরও আছেঃ তিরমিযী ৩৪৫১, আহমাদ ১৪০০, দারেমী ১৬৮৮)।

একটি দেশে চাঁদের দর্শন স্বীকৃত হলে উপরের হাদীসের প্রতি বিশ্বের বহু দেশের মুসলিম আর আমল করতে পারবে না। হিলাল দেখা এবং তা দেখে নবী (সাঃ) যেই দুআ পড়তে বলেছেন, তা আমল করাও আর তাদের ভাগ্যে জুটবে না। কারণ অনেক দেশের লোককে আর চাঁদ দেখার প্রয়োজন হবে না। স্বীকৃত দেশটি দেখবে আর বাকীগুলো কেবল তাদের সংবাদের ভিত্তিতে রোযা রাখবে এবং ঈদ করবে। কিছু মুসলীম ব্যাতিত সকলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত চাঁদ দেখান দোয়া পড়া থেকে বঞ্চিত থাকবে।

৫। দিনের সাথে সূর্যের এবং মাসের সাথে চাঁদের সম্পর্কঃ

ইসলাম ধর্মে  দুটি ষ্পষ্ঠ বিষয় হল, দিনের সময় কাল সূর্যের সাথে সম্পর্কিত। আর মাসের সময় কাল চাঁদের সাথে সম্পর্কিত। সালাতের সময় দিনের সাথে সম্পর্কিত, কাজেই সূর্যের উপর ভিত্তি করে দিনে  পাঁচ ওয়াক্ত সালাত  আদায় করে হবে। প্রত্যেক দেশ প্রাত্যহিক সেহরীর ও ইফতারের ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন সময় ব্যবহার করে থাকে, ঠিক তেমনিই মাসিক রোযা শুরু ও শেষ হওয়ার সময় ভিন্ন ভিন্ন হওয়া জরুরী। আর এ কথা বিদিত যে, মুসলিমদের ঐক্যমতে দৈনিক সময়ের স্বতন্ত্র প্রভাব আছে। তাই যারা প্রাচ্যে বাস করে তারা তাদের আগে সেহরী খাওয়া বন্ধ করবে। যারা প্রতীচ্যে বাস করে। অনুরূপ প্রাচ্যের লোক প্রতীচ্যের লোকদের পূর্বে ইফতার করবে। সুতরাং যখন দৈনিক সময়ে সূর্যের উদয়াস্ত কালের ভিন্নতা মেনে নিতে বাধ্য, তখন তারই সম্পূর্ণ অনুরূপ মাসের ব্যাপারেও চন্দ্রের উদয়কালের ভিন্নতাকে মেনে নিতে আমরা বাধ্য। তাই এমন কথা বলা কারো জন্য যুক্তি সঙ্গত হবে না যে সকলে একই সাথে সিয়াম শুরু এ শেষ করবে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ

অর্থঃ আর পানাহার করতে থাকো।যতক্ষণ না রাত্রির কালো রেখার বুক চিরে প্রভাতের সাদা রেখা সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। (সুরা বাকার ২:১৮৭)

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘রাত যখন এদিক (পূর্ব গগণ) থেকে আগত হবে,  দিন যখন এদিক (পশ্চিম গগণ) থেকে বিদায় নেবে এবং সূর্য যখন অস্ত যাবে, তখন রোযাদার ইফতার করবে। (বুখারী ১৯৪১, মুসলিম ১১০০, ১১০১, আবূ দাঊদ ২৩৫১, ২৩৫২, তিরমিযী, দারেমী, সুনান)

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) এই কথাকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন যে, যে দেশের লোক চাঁদ দেখেছে তাদের এবং তাদের সামনের (পশ্চিম) দেশের লোকেদের জন্য রোযা রাখা ওয়াজেব। আর এ কথা গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে, যখনই কোন দেশে চাঁদ দেখা যাবে, তখনই তার পরবর্তী (পশ্চিমী) দেশে চাঁদ অবশ্য অবশ্যই দেখা যাবে। কেননা, সে দেশের সূর্য দেরীতে অস্ত যায়। এইভাবে যত দেরীতে সূর্য ডুববে, চাঁদ সূর্য থেকে তত দূর হবে এবং তত উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হবে। উদাহরণস্বরূপ যদি বাহরাইনে চাঁদ দেখা যায়, তাহলে তার পশ্চাতের দেশ নজ্দ (রিয়ায), হিজায (মক্কা-মদ্বীনা), মিসর ও মরক্কোতেও রোযা ওয়াজেব হবে। পক্ষান্তরে তার পূর্ব দিকের দেশ হিন্দ্, সিন্দ্ ও মা অরাআন নাহার (ইরান, পাকিস্তান ও ভারতের) লোকদের জন্য রোযা রাখা ওয়াজেব হবে না। (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৩২১-৩২২, ইবনে উসাইমীন,  রমাযানের ফাযায়েল ও রোযার মাসায়েল , আবদুল হামীদ ফাইযী)

৬। যুগ যুগ ধরে চলে আসা মুসলিমদের আমলঃ

আধুনিক যুগে আমরা বিজ্ঞানের কল্যানে জানতে পেরেছি যে পৃথিবীর সকল স্থানে একই সাথে চাঁদের উদয় ঘটেনা। পৃথিবী গোলাকার বিধায় এক এক স্থান থেকে এক এক সময় চাঁদ দেখা যায়। তাই আমাদের পূর্বসুরি সালাফগণ সারা বিশ্বে হিলাল (নতুন চাঁদ) দেখে ভিন্ন ভিন্ন সময় সিয়াম শুরু ও শেষ করেছেন।  তাই সারা বিশ্বে হিলাল উদয়স্থলে পার্থক্য থাকার কারণে বিভিন্ন দেশ ও প্রান্তে সেখানকার দর্শন অনুযায়ী সিয়াম পালন ও ঈদ উদযাপন স্বীকৃত হবে। এই নিয়ম যেমন আধুনিক বিজ্ঞান ও দলীল সম্মত ঠিক তেমন বিগত মুসলিমতের থেকে চলে আসা রিতী। ইসলাম শুরু থেকে অনেক যুগ অতিক্রম করেছে যেমনঃ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এর যুগ, খুলাফায়ে রাসেদীনদের যুগ, উমাইয়া বংশের যুগ, আব্বাসীয় খলীফাদের যুগ, এবং এর পরবর্তী যুগেও এই একই ধারায় সিয়াম শুরু ও শেষ করা হয়েছে। এটাই হল যুগে যুগে ধারাবাহিক ভাবে চলে আসা মুসলিম সমাজের আমল। ইতিপূর্বে তাঁরা কোনো মুসলিম দেশে চাঁদ দেখা দিলে সেই দর্শনের ফলে পৃথিবীর সকল মুসলিম সিয়াম পালন শুরু করে নাই বা ঈদ উৎযাপন করে নাই।  

৭। বাস্তবে একসাথে রমজান শুরুর কিছূ প্রাকটিকাল সমস্যা হবেঃ

লন্ডনের গ্রিনিচ শহরের মানমন্দিরের মূল মধ্যরেখা হতে পূর্ব বা পশ্চিমে ১৮০ করে মোট ৩৬০ ভাবে ভাগ করা হয়েছে। প্রতি ভাগকে বলা হয় ১ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ। পৃথিবীর চারপাশ বা এই ৩৬০ ভাগ ঘুরে আসতে সূর্যের সময় লাগে ২৪ ঘন্টা বা ১৪৪০ মিনিট। অর্থাৎ ১ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ জন্য সময়ের পার্থক্য হবে (১৪৪০ মিঃ ÷৩৬০= ৪ মিনিট) ৪ মিনিট।

সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের দ্রাঘিমার পার্থক্য হল ৪৫ ডিগ্রি, সে হিসাবে সময়ে পার্কত্য হবে ৪৫X৪= ১৮০ মিনিট বা ৩ ঘন্টা। আবার সৌদি আরবের সাথে জাপানের সময়ের পার্থক্য ৬ ঘন্টা, অস্ট্রেলিয়া সময়ে পার্কত্য হবে ৭ ঘন্টা এবং ফিজি, মার্শাল আইল্যান্ড এর সময়ে পার্কত্য হবে ৯ ঘন্টা।

মনে করুন সিয়াম শুরু করার জন্য সৌদি আরব কেই আদর্শ হিসাবে ধরে নিলাম। এখন সৌদি আরবে মাগরিব তথা সূর্যাস্তের সময় সন্ধ্যা ৭টায়। উক্ত সময়ে বাংলাদেশে বাজে রাত ১০টা। ঐ একই সময়ে জাপানের সময় রাত ১ টা, অস্ট্রেলিয়াতে বাজে রাত ২ টা। উক্ত সময়ে ফিজি, মার্শাল আইল্যান্ড এ বাজে ভোর ৪টা। সৌদি সরকার সূর্যাস্তের সাথে সাথে সদ্ধ্যা ৭ টায় চাঁদ দেখার খবর ঘোষণা করে দিল। সকল বিশ্ববাসিকে সিয়াম পালনের আহবান জানাল। এই খবর বাংলাদেশে যদি সাথে সাথেও পৌঁছায় তাহলেও তখন বাংলাদেশের সময় হবে রাত ১০। অস্ট্রেলিয়া সময় হবে রাত ২ টা এবং ফিজি, মার্শাল আইল্যান্ড সময় হবে ভোর ৪ টা।

ফিজি ও মার্শাল আইল্যান্ড যখন চাঁদ দেখার খবর পাবে তখন তাদের ফযর শুরু তথা সেহেরীর শেষ। ঐসব দেশে বসবাসকারী মুসলিমদের প্রতিবছরই সেহেরী না খেয়ে, তারাবীহ না পড়েই রমাযান মাসের প্রথম দিন শুরু করতে হবে।

আর মক্কার ঠিক উল্টো পাশের স্থানটিতে মক্কায় সন্ধ্যা শুরুর সাথে সাথে দিন শুরু হয়। তারা চাঁদ দেখার খবরের ভিত্তিতে রমাযান মাস শুরু করে তবে, প্রতি বছর একই রমাযান মাস কোন কোন দেশের মুসলিমরা আরামের সাথে চাঁদ দেখে ধীরেসুস্থে তারাবীহ পড়ে, স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়ে উঠে সেহেরী খেয়ে রোযা শুরু করবে।

একই বিশ্বে একই আমল করতে যেয়ে মুসলিমদের একাংশকে এধরনের অমানবিক, বৈষম্যমূলক ও কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়ার দায়ভার কে বহন করবে। প্রতিবছর একদল মুসলিম তাদের রমাযান মাস এবং প্রথম রোযা শুরু করবে তারাবীহ না পড়ে, সেহেরী না খেয়ে অভুক্ত থেকে এবং রমাযানের প্রথম রাত্রির বরকত থেকে বঞ্চিত অবস্থায়। এটা কি স্বাভাবিকভাবে গ্রহনযোগ্যতা পাবে? এর মানবিক ও বাস্তব সমাধান না করা হলে সারা বিশ্বে একই দিনে ও একই চাঁদের ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করার ধারণা কতটুকু গ্রহনযোগ্যতা পাবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

সৌদি আরব ও এর প্রতিবেশী দেশগুলো এবং সৌদি থেকে পশ্চিমে অবস্থিত দেশগুলোর জন্য সৌদির চাঁদ দেখার সাক্ষ্য সহজে গ্রহণযোগ্য। পশ্চিমের দেশগুলতে সূর্যাস্ত হয় সৌদি আরব থেকে পরে। যেমনঃ সৌদির যখনস সন্ধ্যা ৭ টা, ইংল্যান্ডে তখন বিকাল ৪ টা। কাজেই সৌদি আরব থেকে পশ্চিমে অবস্থিত দেশগুলো সৌদির চাঁদ দেখার খবর বা সাক্ষ্য সহজেই গ্রহন করতে পারবে। কিন্তু সৌদি থেকে পূর্ব দিকে অবস্থিত দেশগুলোর জন্য আমল করা ততই কঠিন, অমানবিক এবং অবাস্তব হয়ে উঠবে। এটা কখনও যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।  

৮। সিয়াম শুরু এবং শেষ একসাথে করতে পারলেই মুসলিম  উম্মার ঐক্য প্রতিষ্ঠা হবে নাঃ

এক সাথে সিয়াম শুরু করা ও ঈদ করাতে মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। তাদের এ যুক্তি অনুমান মাত্র, তা হতেও পারে আর নাও পারে। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম ঐক্য হচ্ছে তাওহীদের ঐক্য, কিতাবুল্লাহ ও সহীহ সুন্নাতে রাসূলিল্লাহর প্রতি আমলের ঐক্য। আর তা হিলাল ঐক্যে অর্জন হতে পারে না। বিভিন্ন স্থানে হিলাল উদয়ের পার্থক্যের কারণে মুসলিমগণ যেই ভাবে হিলাল দেখে রোযা রাখে বা ছাড়ে সেই নিয়ম অপসারণের চেষ্টা করলে অনেকেই মেন নিবে না। কারন চলমান কোন আমল অপসারণ করলে সঠিক কুরআন হাদিসের রেফারেন্স দরকার। শুধু যুক্তি ভিত্তিক কথা কেউ মানবে আবার কেউ মানবে না যার ফলে ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্য হওয়া স্বাভাবিক। তাই এই নিয়ম অপসারণের চেষ্টা করা হলে ঐক্য তো হবেনা বরং দেশ, সমাজ, এমনকি পরিবারে অনৈক্য সৃষ্টি হতে পাবে। যে যেই যুক্তিকে সঠিক মনে করবে সে তারই অনুসরণ করবে।

পৃথিবীর যে কোন স্থানে চাঁদ দেখা গেলেই সমস্ত পৃথিবী বাসি এক সাথে সিয়াম পালন করতে পারব কি? এ প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে উভয় দলের মতামত পেলাম। এ সম্পর্কিত দুটি বিখ্যাত ফতোয়া যা শাইখ আব্দুল আজীজ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ এবং সৌদি আরবের সর্বচ্চো উলামা পরিষদ প্রদান করেছেন, তা উল্লেক করছি।

চাঁদ সংক্রান্ত দুটি আধুনিক ফতওয়াঃ

চাঁদের উপর ভিত্তি করে সিয়াম শুরু ও ঈদ উদযাপন করা সমর্পরকে দুটি আধুনসিক ফতওয়া উল্লেখ করলাম আশা করি ইহার ফলে এ সমস্যার অনকেটা সমাধান হবে।

 প্রথম ফতওয়াঃ

সৌদি আরবের বিশিষ্ট আলেম শাইখ আব্দুল আযীয ইবন আবদুল্লাহ ইবন বায রাহিমাহুল্লাহ এর ফতওয়াঃ

শাইখ আব্দুল আজীজ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ কে প্রশ্ন করা হয়ঃ যদি কোনো ইসলামি রাষ্ট্রে চাঁদ দেখা যায়, আর  আমি যে দেশে বসবাস করি, সেখানে শাবান ও রমজান মাস ত্রিশ দিনে পুরো করা হয়, তাহলে আমি কী করব? রমজান প্রসঙ্গে মানুষের মতপার্থক্যের কারণ কী?

তিনি জবাব দেনঃ  আলহামদুলিল্লাহ, আপনার জন্য রোযা আপনার দেশের লোকদের সাথে থাকাই আবশ্যক। তারা যদি রোযা রাখে তাদের সাথে রোযা রাখবেন; আর তারা যদি রোযা না রাখে তবে আপনিও তাদের সাথে রোযা রাখবেন না। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«الصَّوْمُ يَوْمَ تَصُومُونَ، وَالفِطْرُ يَوْمَ تُفْطِرُونَ، وَالأَضْحَى يَوْمَ تُضَحُّونَ»

অর্থঃ ‘তোমরা যেদিন রোযা রাখবে সেদিনই রোযা, যেদিন ইফতার করবে সেদিনই ইফতার, আর তোমরা যেদিন কোরবানি করবে সেদিনই কোরবানি।’’ (তিরমিযী : ৬৯৭)

দ্বিতীয়তঃ  ইখতিলাফ ভাল জিনিস নয়, তাই আপনার দেশের সাথে থাকাই আপনার জন্য জরুরি ও সঙ্গত। আপনার দেশের মুসলিমগণ যখন রোযা করবেন না, আপনি তাদের সাথে রোযা না করবেন। আর যখন তারা রোযা রাখবে আপনি তাদের সাথে রোযা রাখবেন।

আর মত পার্থক্যের কারণ হচ্ছে, কেউ চাঁদ দেখে, কেউ চাঁদ দেখে না। অতপর যারা চাঁদ দেখে, অন্যরা তাদের উপর ভরসা করে, তাদেরকে বিশ্বাস এবং তাদের দেখা অনুযায়ী আমল করে। আবার কখনো তাদের বিশ্বাস কিংবা তাদের দেখা অনুযায়ী আমল করা হয় না, ফলে ইখতিলাফ সংঘটিত হয়। কোনো দেশ চাঁদ দেখে এবং চাঁদ দেখার ফয়সালা দেয়, ফলে দেশবাসী রোযা রাখে অথবা ইফতার করে। আর অন্য দেশ এ দেখার উপর ভরসা কিংবা বিশ্বাস করে না- ভৌগলিক কিংবা রাজনৈতিক ইত্যাদি কারণে।

সকল মুসলিমের জন্য আবশ্যিক হল চাঁদ দেখেই রোযা রাখবে আবার চাঁদ দেখে রোযা ভাঙ্গবে করবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস ব্যাপকঃ

«إِذَا رَأَيْتُمُ الْهِلَالَ فَصُومُوا، وَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَأَفْطِرُوا، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَصُومُوا ثَلَاثِينَ يَوْمًا»

অর্থঃ ‘যখন তোমরা চাঁদ দেখবে রোযা রাখবে, আবার যখন চাঁদ দেখবে ইফতার করবে। আর আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন হয়, তবে সংখ্যা ত্রিশ দিন পূরণ করবে।’’ (মুসলিম : ১০৮১)

যদি সকলে চাঁদ দেখা বিশ্বাস করে এবং মনে করে যে, বাস্তবিকই তা দেখা গেছে, তবে সে হিসেবে রোযা রাখা ও ইফতার করা ওয়াজিব। হ্যাঁ, যদি বাস্তবতার ব্যাপারে মত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়, আর কেউ কাউকে বিশ্বাস না করে, তখন আপনার জন্য সঙ্গত হবে আপনার দেশের মুসলমানদের সাথে রোযা রাখা এবং তাদের সাথে ইফতার করা। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

«الصَّوْمُ يَوْمَ تَصُومُونَ، وَالفِطْرُ يَوْمَ تُفْطِرُونَ، وَالأَضْحَى يَوْمَ تُضَحُّونَ»

অর্থঃ ‘তোমরা যেদিন রোযা রাখবে সেদিনই রোযা, যেদিন ইফতার করবে সেদিনই ইফতার, আর তোমরা যেদিন কোরবানি করবে সেদিনই কোরবানি।’’ (তিরমিযী : ৬৯৭)।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে প্রমাণিত, কুরাইব তাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, শাম দেশের লোকেরা জুমুআর দিন রোযা রেখেছে। ইবনে আব্বাস বললেন, আমরা চাঁদ দেখেছি শনিবার, আমরা যতক্ষণ না চাঁদ দেখব রোযা রাখব না, অন্যথায় ত্রিশ দিন পূর্ণ করব।

তিনি শামবাসীদের চাঁদ দেখার উপর আমল করেন নি, যেহেতু উভয় দেশের মাঝে দূরত্ব অনেক বেশী এবং উভয়ের উদয়স্থলও ভিন্ন। তাঁর দৃষ্টিতে এটা ইজতেহাদের বিষয়। ইবনে আব্বাস এবং তার অনুসরণ করে যারা বলেছেন, নিজ দেশের সাথে রোযা এবং নিজ দেশের সাথে ইফতার করার জন্য, তাদের মতই আমাদের জন্য অনুসরণীয়। শায়খ আব্দুল আজীজ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ, মজমু ফাতওয়া ওয়ামাকালাত মুতানাওয়েয়াহ, অনুবাদক: সানাউল্লাহ নজির আহমদ, সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব)।

শায়খ আব্দুল আজীজ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ, যে হাদিটির কথা উল্লেখ করেছেন সেই হাদিসটি হলঃ

কুরাইব বলেন, একদা উম্মুল ফাযল বিনতে হারেষ আমাকে শাম দেশে মুআবিয়ার নিকট পাঠালেন। আমি শাম (সিরিয়া) পৌঁছে তাঁর প্রয়োজন পূর্ণ করলাম। অতঃপর আমার শামে থাকা কালেই রমাযান শুরু হল। (বৃহস্পতিবার দিবাগত) জুমআর রাত্রে চাঁদ দেখলাম। অতঃপর মাসের শেষ দিকে মদ্বীনায় এলাম। আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) আমাকে চাঁদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কবে চাঁদ দেখেছ?’ আমি বললাম, ‘আমরা জুমআর রাত্রে দেখেছি।’ তিনি বললেন, ‘তুমি নিজে দেখেছ?’ আমি বললাম, ‘জী হ্যাঁ। আর লোকেরাও দেখে রোযা রেখেছে এবং মুআবিয়াও রোযা রেখেছেন।’ ইবনে আববাস (রাঃ) বললেন, ‘কিন্তু আমরা তো (শুক্রবার দিবাগত) শনিবার রাত্রে চাঁদ দেখেছি। অতএব আমরা ৩০ পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অথবা নতুন চাঁদ না দেখা পর্যন্ত রোযা রাখতে থাকব।’ আমি বললাম, ‘মুআবিয়ার দর্শন ও তাঁর রোযার খবর কি আপনার জন্য যথেষ্ট নয়?’ তিনি বললেন, ‘না। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে এ রকমই আদেশ দিয়েছেন।’ (মুসলিম ১০৭৮ নং)

 

দ্বিতীয় ফতওয়াঃ

চাঁদ উঠার বিভিন্ন উদয়স্থল সংক্রান্ত মতভেদ কি বিবেচনাযোগ্য? এ ব্যাপারে অমুসলিম দেশে মুসলিম কমিউনিটির অবস্থান সম্পর্ক সৌদি আরবের সর্বচ্চো উলামা পরিষদের ফতওয়া বোর্ড “ফাতাওয়া আল-লাজ্‌নাহ আদ-দা’ইমাহ” এর সিদ্ধান্ত।

প্রশ্ন: আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার কিছু মুসলিম ছাত্র। প্রতি বছর রমযান মাসের শুরুতে আমাদের একটি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যা মুসলিমদের তিনটি দলে ভাগ করে দেয়ঃ

 এক দল, তারা যে দেশে বাস করে সে দেশের চাঁদ দেখে সাওম রাখে।

 এক দল, যারা সউদি আরবে সিয়াম শুরু হলে সাওম পালন করে।

 এক দল, যারা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মুসলিম ছাত্র ইউনিয়নের খবর (নতুন চাঁদ দেখার) পৌঁছলে সাওম রাখে যারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে চাঁদ দেখার দায়িত্ব পালন করে। তারা (সেই মুসলিম ছাত্র ইউনিয়ন) দেশের কোন স্থানে চাঁদ দেখলে বিভিন্ন সেন্টারসমূহে তা দেখার খবর পৌঁছে দেয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত মুসলিমরা একই দিনে সাওম পালন করে যদিও এই শহরগুলো অনেক দূরে দূরে অবস্থিত।

এক্ষেত্রে সিয়াম পালন, চাঁদ দেখা ও এ সংক্রান্ত খবরের ব্যাপারে কারা বেশি অনুসরণ যোগ্য?

আমাদের এ ব্যাপারে দয়া করে ফাতওয়া দিন, আল্লাহ আপনাদেরকে পুরস্কৃত করুন, সাওয়াব দিন।


উত্তরঃ: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।


প্রথমতঃ:

নতুন চাঁদের ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল থাকার ব্যাপারটি ইন্দ্রিয় ও ‘আক্বল (বুদ্ধি) দ্বারা অবধারিতভাবে জানা বিষয়গুলোর একটি। যে ব্যাপারে ‘আলিমগণের কেউ দ্বিমত পোষণ করেন নি। তবে মুসলিমদের ‘আলিমগণের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনাযোগ্য কিনা তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ

ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল এবং তা বিবেচনাযোগ্য না হওয়ার মাসআলাটি তাত্ত্বিক মাসআলাগুলোর একটি, যাতে ইজতিহাদের সুযোগ রয়েছে। জ্ঞান ও দ্বীনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞজনদের মাঝে এ ব্যাপারে ইখতিলাফ (দ্বিমত) আছে। আর এটি এমন একটি গ্রহণযোগ্য মতভেদ যে ব্যাপারে সঠিক মত প্রদানকারী (মুজতাহিদ) দুইবার সাওয়াব পাবেন-ইজতিহাদ করার সাওয়াব ও সঠিক মত প্রদান করার সাওয়াব এবং ভুল মত প্রদানকারী (মুজতাহিদ) শুধু ইজতিহাদ করার সাওয়াব পাবেন।

এই মাসআলাটিতে ‘আলিমগণ দুটি মত প্রদান করেছেন :

ক. তাঁদের কেউ কেউ ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করেছেন।

খ. আবার তাঁদের কেউ কেউ ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করেননি।

তবে উভয়পক্ষই কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দলীল দিয়েছেন, এমনকি একই পাঠ থেকে দলীল দিয়েছেন। কারণ তা দুটি মতের সপক্ষেই দলীল হিসেবে পেশ করা যায়। আর তা আল্লাহ্‌র-তা‘আলার বাণীঃ

*يَسْأَلُونَكَ عَنِ الأهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ*

অর্থঃ তোমার নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। বলে দাও যে এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ (গণনা) এবং হজ্বের সময় ঠিক করার মাধ্যম। (সুরা বাকারা ২:১৮৯)।

এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীঃ তিনি বলেন, “তোমরা নতুন চাঁদ দেখে সাওম শুরু কর এবং নতুন চাঁদ দেখে সাওম শেষ কর।” (সহিহ বুখারী ১৯০৯, সহিহ মুসলিম ১০৮১)।

আর এ ভিন্ন মতভেদের কারণ হল পাঠ বোঝার ক্ষেত্রে ভিন্নতা হওয়া এবং এ ব্যাপারে দলীল দেয়ার ক্ষেত্রে উভয়েরই ভিন্ন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা।

তৃতীয়তঃ

চাঁদ দেখা সংক্রান্ত কমিটি নতুন চাঁদ হিসাবের সাহায্যে নিশ্চিত হবার ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত দলীলসমূহ গবেষণা করে দেখেছেন এবং তাঁরা এ ব্যাপারে ‘আলিমগণের বক্তব্য যাচাই করেছেন। এরপর তাঁরা ইজমা‘ (ঐকমত্য) ক্রমে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব দ্বারা শারী‘আত সংক্রান্ত মাসআলাসমূহের ক্ষেত্রে নতুন চাঁদ দেখা নিশ্চিত করার ব্যাপারটি বিবেচনা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর দলীল হিসেবে তাঁরা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীঃ তিনি বলেন, “তোমরা নতুন চাঁদ দেখে সাওম শুরু কর এবং নতুন চাঁদ দেখে সাওম শেষ কর।” (সহিহ বুখারী ১৯০৯, সহিহ মুসলিম ১০৮১)।

এবং তাঁর (রাসূলুল্লাহ)  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী, তিনি বলেন, “তোমরা তা (নতুন চাঁদ) না দেখা পর্যন্ত সাওম রেখো না ও তা (নতুন চাঁদ) না দেখা পর্যন্ত সাওম শেষ করো না।” (মালিক ৬৩৫, ও এর অর্থে অন্যান্য দলীল সমূহও রয়েছে)।

গবেষণা ও ফাত্‌ওয়া ইস্যুকারী স্থায়ী কমিটি এ মত পোষণ করে যে, মুসলিম ছাত্র ইউনিয়ন (অথবা এ ধরণের অন্য কোনো সংস্থা যারা ইসলামী কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব করে) অমুসলিম সরকার শাসিত দেশসমূহে সেখানে বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য নতুন চাঁদ দেখা নিশ্চিত করার ব্যাপারে মুসলিম সরকারের স্থলাভিষিক্ত হবে।

আর পূর্বে উল্লেখিত তথ্যের ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে, এই ইউনিয়নের দুটো মতের যে কোনো একটি মত- ভিন্ন ভিন্ন উদয়স্থল বিবেচনা করা বা না করা- এর যে কোনো একটি বেছে নেয়ার ইখতিয়ার আছে। এরপর তারা সেই মতকে সে দেশের সমস্ত মুসলিমদের উপর প্রয়োগ করবে। আর সে মুসলিমদের সেই মতকে যা তাদের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে তা মেনে নেয়া বাধ্যতামূলক; ঐক্যের স্বার্থে, সিয়াম শুরুর জন্য এবং মতভেদ ও বিভ্রান্তি এড়িয়ে চলার জন্য।

এ সমস্ত দেশে যারা বাস করে তাদের উচিত নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে তৎপর হওয়া, তাদের মাঝে এক বা একাধিক বিশ্বস্ত ব্যক্তি যদি তা (নতুন চাঁদ) দেখে তবে তারা সাওম পালন করবে এবং সেই ইউনিয়নকে খবর দিবে যাতে তারা সবার উপর এটি প্রয়োগ করতে পারে। এটি হল মাস শুরু হওয়ার ক্ষেত্রে।

আর তা (মাস) শেষ হওয়ার ক্ষেত্রে শাউওয়ালের নতুন চাঁদ দেখা বা রমযানের ত্রিশ দিন পূর্ণ করার ব্যাপারে দুইজন ‘আদল ব্যক্তির শাহাদাহ (সাক্ষ্য) অবশ্য প্রয়োজন। এর দলীল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা নতুন চাঁদ দেখে সাওম পালন কর এবং নতুন চাঁদ দেখে সাওম শেষ করো বা ঈদুল ফিতর আদায় কর। আর যদি নতুন চাঁদ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ার কারণে দেখা না যায় তবে (মাসকে) ত্রিশ দিন পূর্ণ কর।” আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন। (ফাতাওয়া আল-লাজ্‌নাহ আদ-দা’ইমাহ (১০/১০৯); অনুবাদক : ইবতিসাম আযাদ আব্দুর রাহমান, মাক্তাবা আস-সাবাত)।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment