জিকির কেন্দ্রিক বিদআত প্রথম কিস্তি : জিকির ও জিকিরের ফজিলত

জিকির কেন্দ্রিক বিদআত প্রথম কিস্তি : জিকির ও জিকিরের ফজিলত

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

জিকির মহান আল্লাহ অন্যতম ইবাদাত। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল ইহার মাঝেই সবচেয়ে বেশী বিদআতের বিস্তৃতি ঘটেছে। এর মূল কারন জিকির সম্পর্কে সাধারণের জ্ঞানের অভাব। জিকিরের বিদআত বুঝতে হলে আগে জিকির সম্পর্কে জ্ঞান আবশ্যক। জিকিরকে সম্পর্কে না জানলে, জিকিরের বিদআত বুঝতে কষ্ট হবে। যদিও আমার বিষয় “জিকির কেন্দ্রিক বিদআত” তারপরও বিষয় বস্তুতে যাওয়ার পুর্বে জিকিরে সম্পর্কে একটু আলোচনা করব। সালাত, সিয়াম, যাকাত ইত্যাদির মত জিকিরও একটি ইবাদত। এই ইবাদাতটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রদর্শিত পথে আমল করতে হবে। তিনি কখন, কোথায়, কিভাবে এই আমল করছেন, আমাদেরও ঠিক তেমনিভাবে আমল করতে হবে। যেনতেন ভাবে মনগড়া পদ্ধতিতে এই আমল করা যাবে না। যদি যেনতেন ভাবে মনগড়া পদ্ধতিতে এই আমল করি তখন ইবাদাত না হয়ে বিদআত হবে। এই আমল করার পদ্ধতি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমানিত হবে তখন ইবাদাত হবে। আমাদের আবিস্কৃত পদ্ধতি যখনই সুন্দর হোন না কেন! আদায় করতে যত মজা পাইনা কেন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পদ্ধতি না হলে জিকিরের আমল টি নিন্দেহে বিদআত হবে। কাজেই আসুন জিকিরের মত একটি সুন্দর ইবাদাত সম্পর্কে একটু আলোচনা করি।

জিকির ( ﺫِﻛْﺮٌ) একটি আররী শব্দ যার অর্থ স্মরণ করা, মনে করা। ইসলামি পরিভাষায় যদি কেউ মৌখিরভাবে বা অন্তরের সাহায্যে অথবা কোন আমলের মাধ্যমে মহান আল্লাহকে স্মরণ করা বুঝায়। এই জিকির হতে পারে তাসবীহ তাহলীলের মাধ্যমে বা সালাত, সিয়াম, হজ্জ, ও জাকাতের ইত্যাদি ইবাদাতের মাধ্যমে।  দ্বীনী কোন মজলিসে বসার মাধ্যমেও জিকির হতে পারে। এমনটি মহান আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা গবেষণার মাধ্যমেও জিকির হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা জিকিরের সঠিক অর্থ জানি না। আমরা জিকির বলতে বুঝি কিছু তাসবীহ তাহলীল যা আমাদের দেশে প্রচলিত কিছু তথাকথিত  পীর সাহেবগণ তাদের মুরিদদের দিয়ে থাকেন। তাদের প্রদত্ত জিকিরের অধিকাংশই সুন্নাহ সম্মত আমল নয়। তারা কুরআন সুন্নাহ সম্মত জিকিরের বাইরগেয়ে বিভিন্ন স্টাইল জিকিরের শব্দ ও পদ্ধতি আবিস্কার করে নিয়েছে। কুরআন ও হাদিসের দিক নির্দেশনার বাইরে গিয়ে যে কোন জিকিরের প্রচলন করা একটি বিদআত কাজ। সমাজের অজ্ঞ শ্রেণীর সাধারণ মানুষ যাদের জিকির সম্পর্কে জ্ঞান নেই তারা এই সকল পীরদের অন্ধের মত অনুসরণ করেথাকে। তারা এই বিদআত মিশ্রিত মৌখিক জিকিরকেই একমাত্র জিকির মনে করে আমাদের দেশের অনেক মসজিদেই মাগরিবের নামজের পর ‘হালকায়ে জিকিরের’ মাহফিল করে থাকে যা সুন্নাহ সম্মত নয়। কেন সুন্নাহ সম্মত নয় পরে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি পরিস্কার হবে ইনসাআল্লাহ।

পবিত্র কোরআনুল কারীমের মধ্যে যিকির শব্দটি মোট ২৬৮ বার এসেছে। এর মধ্যে ১৫৪ বার শব্দটি ফে’ল (ক্রিয়া) হিসেবে ব্যবহার হয়েছে আর ১১৪ বার ইসম (বিশেষ্য) হিসেবে।  মজার ব্যাপার হলো এই জিকির শব্দটির এতই সুক্ষ্ম যে, শুধুমাত্র যের এর পরিবর্তে যাল অক্ষরের উপর যবর দিলেই উচ্চারণ হয় ‘যাকার’ এবং অর্থ দাঁড়ায় ‘পুরুষ’, যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

*وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالأُنثَى وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ *

অর্থঃ সেই কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম মারইয়াম। (সুরা ইমরান ৩:৩৬)

তাই জিকির শব্দটি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের আগে দেখি মহান আল্লাক পবিত্র কোরআনুল কারীমের মধ্যে জিকির শব্দ দ্বারা কি বুঝাতে চেয়েছেন। কুরআনে জিকির কি অর্থে ব্যবহার হয়েছে জানতে পারলে মনে আর জিকির সম্পর্ক কোন সংশয় থাকবে না ইনশাল্লাহ।

১। জিকির শব্দের অর্থ স্মরণঃ

জিকিরের শাব্দিক অর্থ স্মরণ, এই অর্থেই কুরআনে অনেকগুলি আয়াত আছে। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

*فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُواْ لِي وَلاَ تَكْفُرُونِ*

অর্থঃ সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। অকৃতজ্ঞ হয়ো না। (সুরা বাকারা ২:১৫২)।

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন

فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلاَةَ فَاذْكُرُواْ اللّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِكُمْ فَإِذَا اطْمَأْنَنتُمْ فَأَقِيمُواْ الصَّلاَةَ إِنَّ الصَّلاَةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَّوْقُوتًا

অর্থঃ অতঃপর যখন তোমরা সালাত সম্পন্ন কর, তখন দন্ডায়মান, উপবিষ্ট ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ কর। অতঃপর যখন বিপদমুক্ত হয়ে যাও, তখন নামায ঠিক করে পড়। নিশ্চয় সালাত মুসলমানদের উপর ফরয নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। (সুরা নিসা ৪:১০৩)।

২। জিকির শব্দের অর্থ আল কুরআনঃ

জিকির কুরআন অর্থে অনেকগুলো আয়াত আছে। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

*إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ

অর্থঃ আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক। (সুরা হিজর ১৫:৯)

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

* وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ*

অর্থঃ এবং আপনার কাছে আমি অহী (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বিবৃত করেন, যে গুলো তোদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে। যাতে তারা চিন্তা ভাবনা করে। (সুরা নাহল ১৬:৪৪)

মন্তব্যঃ এমনিভাবে কুরআনের সুরা যুকরুক ৪৩:৫, সুরা কালাম ৬৮:৫১ আয়াতে জিকির শব্দটি কুরআন অর্থে ব্যবহার হয়েছে। সুতরাং যিনি কুরআন তিলওয়াত করছেন তিনি মূলত জিকির করছেন। 

৩। জিকির শব্দের অর্থ উপদেশঃ

জিকির উপদেশ অর্থে কুরআনে কয়েকটি আয়াত আছে। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

*نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَقُولُونَ وَمَا أَنتَ عَلَيْهِم بِجَبَّارٍ فَذَكِّرْ بِالْقُرْآنِ مَن يَخَافُ وَعِيدِ

অর্থঃ তারা যা বলে, তা আমি সম্যক অবগত আছি। আপনি তাদের উপর জোরজবরকারী নন। অতএব, যে আমার শাস্তিকে ভয় করে, তাকে কোরআনের মাধ্যমে উপদেশ দান করুন।  (সুরা ক্বাফ ৫০:৪৫)

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

*وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَى تَنفَعُ الْمُؤْمِنِينَ*

অর্থঃ এবং উপদেম দিতে থাকুন। কেননা, উপদেশ মুমিনদের উপকারে আসবে। (সুরা যারিয়া’ত ৫১:৫৫)

মহান আল্লাহ বলেন,

*وَلَكِن مَّتَّعْتَهُمْ وَآبَاءهُمْ حَتَّى نَسُوا الذِّكْرَ وَكَانُوا قَوْمًا بُورًا*

অর্থঃ কিন্তু আপনিই তাদের পিতৃপুরুষদেরকে ভোগসম্ভার দিয়েছিলেন, ফলে তারা আপনার উপদেশ বিস্মৃত হয়েছিল এবং তারা ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি। (সুরা ফুরকান ২৫:১৮)।

মহান আল্লাহ বলেন,

*إِنَّمَا تُنذِرُ مَنِ اتَّبَعَ الذِّكْرَ وَخَشِيَ الرَّحْمَن بِالْغَيْبِ فَبَشِّرْهُ بِمَغْفِرَةٍ وَأَجْرٍ كَرِيمٍ*

অর্থঃ আপনি কেবল তাদেরকেই সতর্ক করতে পারেন, যারা উপদেশ অনুসরণ করে এবং দয়াময় আল্লাহকে না দেখে ভয় করে। অতএব আপনি তাদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দিন ক্ষমা ও সম্মানজনক পুরস্কারের। (সুরা ইয়াসিন ৩৬:১১)

মহান আল্লাহ বলেন,

*لَقَدْ أَنزَلْنَا إِلَيْكُمْ كِتَابًا فِيهِ ذِكْرُكُمْ أَفَلَا تَعْقِلُونَ*

অর্থঃ আমি তোমাদের প্রতি একটি কিতাব অবর্তীর্ণ করেছি; এতে তোমাদের জন্যে উপদেশ রয়েছে। তোমরা কি বোঝ না? (সুরা আম্বিয়া ২১:১০)।

মন্তব্যঃ এমনিভাবে কুরআনের উপদেশ অর্থে জিকির শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তাই মানুষকে উপদেশ প্রদানে জন্য যে সকল ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয় তাকে আমরা জিকিরের মাহফিল বলতে পারি। আমাদের অনেকের এই জ্ঞানই নেই যে, তাফসীরের মাহফিলকেও জিকিরের মাহফিল বলা যায়।

৪। জিকির শব্দের অর্থ সালাতঃ

সালাত অর্থে কুরআনে কয়কটি আয়াত আছে। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

*يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِي لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ*

অর্থঃ মুমিনগণ, জুমআর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। (সুরা জুমা ৬২:৯)

মহান আল্লাহ বলেন,

*فَقَالَ إِنِّي أَحْبَبْتُ حُبَّ الْخَيْرِ عَن ذِكْرِ رَبِّي حَتَّى تَوَارَتْ بِالْحِجَابِ*

অর্থঃ তখন সে বললঃ আমি তো আমার পরওয়ারদেগারের স্মরণে (আছরের সালাত) বিস্মৃত হয়ে সম্পদের মহব্বতে মুগ্ধ হয়ে পড়েছি-এমনকি সূর্য ডুবে গেছে। (সুরা সা’দ ৩৮:৩২)]

৫। জিকির শব্দের অর্থ বিধানঃ

বিধান অর্থেও কুরআনে জিকির শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনঃমহান আল্লাহ বলেন,

وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى

অর্থঃ এবং যে আমার বিধান (স্মরণ) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। (সুরা ত্বা-হা ২০:১২৪)

মহান আল্লাহ বলেন,

لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَمَن يُعْرِضْ عَن ذِكْرِ رَبِّهِ يَسْلُكْهُ عَذَابًا صَعَدًا

অর্থঃ যাতে এ ব্যাপারে তাদেরকে পরীক্ষা করি। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার বিধান (স্মরণ) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তিনি তাকে উদীয়মান আযাবে পরিচালিত করবেন। ( সুরা জ্বীন ৭২:১৭)

৬। জিকির শব্দের অর্থ বর্ণনকরাঃ

জিকিরের বর্ণন করা অর্থও কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

*وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ إِذِ انتَبَذَتْ مِنْ أَهْلِهَا مَكَانًا شَرْقِيًّا*

অর্থঃ এই কিতাবে মারইয়ামের কথা বর্ণনা করুন, যখন সে তার পরিবারের লোকজন থেকে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল। (সুরা মারঈয়াম ১৯:১৬) 

 

৭। জিকির শব্দের অর্থ মর্জাদাঃ

মহান আল্লাহ বলেন,

وَإِنَّهُ لَذِكْرٌ لَّكَ وَلِقَوْمِكَ وَسَوْفَ تُسْأَلُونَ

অর্থঃ এটা আপনার ও আপনার সম্প্রদায়ের জন্যে একটি মর্যাদা (জিকির) হয়ে  থাকবে এবং শীঘ্রই আপনারা জিজ্ঞাসিত হবেন। (সুরা যূখরুফ ৪৩:৪৪)

৮। জিকির শব্দের অর্থ সংবাদ বা খবরঃ

মহান আল্লাহ বলেন,

*وَيَسْأَلُونَكَ عَن ذِي الْقَرْنَيْنِ قُلْ سَأَتْلُو عَلَيْكُم مِّنْهُ ذِكْرًا*

অর্থঃ তারা আপনাকে যুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুনঃ আমি তোমাদের কাছে তাঁর কিছু অবস্থা (সংবাদ) বর্ণনা করব। (সুরা কা’হফ ১৮:৮৩ ]

৯। জিকির শব্দের অর্থ আল্লাহ ডাকাঃ

মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيراً

অর্থঃ মুমিনগণ তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে ডাক (স্মরণ) কর। [ সুরা আহযাব ৩৩:৪১ ]

১০। জিকির শব্দের অর্থ লাওহে মাহফুজ বা সংরক্ষিত ফলকঃ

মহান আল্লাহ বলেন,  

وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِن بَعْدِ الذِّكْرِ أَنَّ الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ

অর্থঃ আমি লাওহে মাহফুজের (সংরক্ষিত ফলকের) পর কিতাবে লিখে দিয়েছি। আমার যোগ্যতাসম্পন্ন (অথবা নেককার) বান্দারা পৃথিবীর অধিকারী হবে। (সুরা আম্বিয়া, ২১:১০৫)

১১। জিকির শব্দের অর্থ ইবাদাতঃ

জিকির মহান আল্লাহর একটি প্রদত্ত একটি ইবাদাত। 

মহান আল্লাহ বলেন,

* وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيراً وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا*

অর্থঃ আর আল্লাহর অধিক যিকরকারী পুরুষ ও যিকরকারী নারী। তাদের জন্য আল্লাহর প্রস্তত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। (সুরা আহযাব ৩৩:৩৫)।

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

*يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيراً*

অর্থঃ মুমিনগণ তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর। (সুরা আহযাব ৩৩:৪১)।

তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি তার রবের যিক্‌র (স্মরণ) করে, আর যে ব্যক্তি তার রবের যিক্‌র করে না তারা যেন জীবিত আর মৃত। ( সহিহ বুখারী ৬৪০৭, ভিন্ন শব্দে সহিহ মুসলিম ৭৭৯)

জিকিরের ফজিলতঃ

১২। ইহকাল ও পরকালে অন্তরে প্রশান্তি ও স্থিরতা লাভঃ

আল্লাহ তাআলা বলেন

الَّذِينَ آمَنُواْ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللّهِ أَلاَ بِذِكْرِ اللّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে। জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়। (সুরা রা’দ ১৩:২৮)।

১৩। আল্লাহর জিকির সবচেয়ে বড় ও সর্বোত্তম ইবাদতঃ

 আল্লাহ তাআলা বলেন,
اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاء وَالْمُنكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُيَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ

আপনি আপনার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব পাঠ করুন এবং নামায কায়েম করুন। নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে। আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কর।  (সুরা আনকাবুত ২৯:৪৫)।

আল্লাহ তাআলা বলেন

إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيراً وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا

নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ, মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ, ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্য্যশীল পুরুষ, ধৈর্য্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নারী, রোযা পালণকারী পুরুষ, রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ, , যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহর অধিক যিকরকারী পুরুষ ও যিকরকারী নারী-তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরষ্কার।  (সুরা আহযাব ৩৩:৩৫)।

রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, “আমি কি তোমাদেরকে তা জানাবো না আমলের মধ্যে যা সর্বোত্তম, তোমাদের মালিক (আল্লাহ্‌র) কাছে যা অত্যন্ত পবিত্র, তোমাদের জন্য যা অধিক মর্যাদা বৃদ্ধিকারী, (আল্লাহ্‌র পথে) সোনা-রূপা ব্যয় করার তুলনায় যা তোমাদের জন্য উত্তম এবং তোমরা তোমাদের শত্রুদের মুখোমুখি হয়ে তাদেরকে হত্যা এবং তারা তোমাদের হত্যা করার চাইতেও অধিকতর শ্রেষ্ঠ?” সাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই হ্যাঁ। তিনি বললেন, “আল্লাহ্ তা‘আলার যিক্‌র। (তিরমিযি ৩৩৭৭, ইবনে মাযাহ ৩৭৯০, সহিহ ইবনে মাযাহ ২/৩১৬, সহিহ তিরমিযি৩/১৩৯)।

আব্দুল্লাহ ইবন বুসর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি আরয করল, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! ইসলামের বিধিবিধান আমার জন্য বেশি হয়ে গেছে। কাজেই আপনি আমাকে এমন একটি বিষয়ের খবর দিন, যা আমি শক্ত করে আঁকড়ে ধরব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা জিহ্বা যেনো সর্বক্ষণ আল্লাহ্‌র জিকিরে সজীব থাকে। (তিরমিযী ৩৩৭৫, ইবন মাজাহ্‌ ৩৭৯৩, শাইখ আলবানী একে সহীহ বলেছেন)।

১৪। মহান আল্লাহও জিকির কারীদের স্মরন করেনঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, “আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যেরূপ ধারণা করে, আমাকে সে তদ্রূপই পাবে; আর যখন সে আমাকে স্মরণ করে, তখন আমি তার সাথে থাকি। সুতরাং যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে, আমিও আমার মনে তাকে স্মরণ করি। আর যদি সে কোনো সমাবেশে আমাকে স্মরণ করে, তাহলে আমি তাকে এর চাইতে উত্তম সমাবেশে স্মরণ করি। আর সে যদি আমার দিকে এক বিঘত পরিমাণ নিকটবর্তী হয়, তাহলে আমি তার দিকে এক হাত পরিমাণ নিকটবর্তী হই। সে এক হাত পরিমাণ নিকটবর্তী হলে আমি তার দিকে এক বাহু পরিমাণ নিকটবর্তী হই। আর সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দ্রুতবেগে যাই। (সহিহ বুখারি ৭৪০৫, সহিহ মুসলিম ২৬৭৫)

১৫। জিকিরে উদাসীন ব্যক্তি আফসোস করবেঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, “যে ব্যক্তি এমন কোনো বৈঠকে (মজলিসে) বসেছে যেখানে সে আল্লাহ্‌র যিক্‌র করে নি, তার সে বসাই আল্লাহ্‌র নিকট থেকে তার জন্য আফসোস ও নৈরাশ্যজনক হবে। আর যে ব্যক্তি এমন কোন শয়নে শুয়েছে যেখানে সে আল্লাহ্‌র যিক্‌র করে নাই, তার সে শোয়াই আল্লাহ্‌র নিকট থেকে তার জন্য আফসোস ও নৈরাশ্যজনক হবে। (আবু দাউন৪৮৫৬, সহিহুল জামে ৫/৩৪২)।

রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, “যদি কোনো দল কোনো বৈঠকে বসে আল্লাহ্‌র জিকির না করে এবং তাদের নবীর ওপর দরূদও পাঠ না করে, তাহলে তাদের সেই বৈঠক তাদের জন্য কমতি ও আফসোসের কারণ হবে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শাস্তি দেবেন, অথবা তিনি চাইলে তাদের ক্ষমা করবেন। (তিরমিযি ৩৩৮০, সহিহ তিরমিযি ৩/১৪০)

রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,“যদি কোনো একদল লোক এমন কোনো বৈঠক থেকে উঠল, যেখানে তারা আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করে নাই, তবে তারা যেন গাধার লাশের কাছ থেকে উঠে আসল। আর এরূপ মজলিস তাদের জন্য আফসোসের কারণ হবে। (আবু দাউদ ৪৮৫৫, আহম্মদ ১০৬৮০, সহিহুল জামে ৫/১৭৬)

তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি তার রবের যিক্‌র (স্মরণ) করে, আর যে ব্যক্তি তার রবের যিক্‌র করে না তারা যেন জীবিত আর মৃত। ( সহিহ বুখারী ৬৪০৭, ভিন্ন শব্দে সহিহ মুসলিম ৭৭৯)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment