ছোট শির্কের ফলাফল ও মুক্তির উপায়

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

*** শির্কে আসগার বা ছোট  শির্ক ফলাফলঃ

  • শির্কে আসগার বান্দাকে মুসলিম মিল্লাতের গন্ডী থেকে বের করে দেয় না।
  • শির্কে আসগার (ছোট শির্ক) সম্পাদনকারি ব্যক্তি বড় ঝুঁকির মধ্যে থাকে, কারণ ছোট শির্ক কবিরা গুনাহ।
  • এই শির্ক একত্ববাদের আক্বীদায় ত্রুটি ও কমতির সৃষ্টি করে যা বান্দার শুধু তৎসংশ্লিষ্ট আমলকেই নষ্ট করে, অন্য সব আমল নষ্ট করেনা।
  • শির্কে আসগারে লিপ্ত ব্যক্তি জাহান্নামে গেলে ও চিরকাল সেখানে অবস্থান করবে না।
  • বান্দা শির্কে আসগার (ছোট শির্ক) থেকেই শির্কে আকবারের (বড় শিরক) দিকে ধাবিত হয়।
  • কিয়মতের কঠিন দিনে রিয়াকারীদেরকে আল্লাহ বলবেন: যাও দুনিয়াতে যাদেরকে জন্য আমল করতে, তাদের কাছ থেকে কোনো পুরস্কার নিয়ে আস।

০১।    মুসনাদে আহমদে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ . قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ : وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ؟ قَالَ :الرِّيَاء . إِنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَقُولُ يَوْمَ تُجَازَى الْعِبَادُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ بِأَعْمَالِكُمْ فِي الدُّنْيَا فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً»

আমি তোমাদের ব্যাপারে ছোট শিরক থেকে খুব ভয় করছি। সাহাবীরা বললেন – ইয়া রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম! ছোট শিরক কি? রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তা হলো “রিয়া” বা লোক দেখানো ইবাদত। যেদিন আল্লাহ তাআ’লা বান্দাদের আমলের পুরস্কার প্রদান করবেন, সেদিন রিয়াকারীদেরকে বলবেন: যাও, দুনিয়াতে যাদেরকে দেখানোর জন্য আমল করতে, তাদের কাছে যাও। দেখো তাদের কাছ থেকে কোনো পুরস্কার পাও কিনা?

(মুসনাদে আহমাদ, সহীহ ইবনে খুজায়মা, আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন তার সহিহ হাদিস সমগ্রে-৯৫১)।

২. মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। রিয়াকারী বা লোক দেখানো আমলকারীর ও তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে।

আলকামা ইব্ন ওয়াক্কাস আল-লায়সী (র) থেকে বর্ণিত, আমি উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)-কে মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিঃ আমি রাসূলুল্লাহ্  (সা) কে বলতে শুনেছিঃ প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সেই উদ্দেশ্যেই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য।

তাহক্বীক: মারফু হাদিস। (বুখারীঃ তাওহীদ.পাবলিকেশান্স ১, আধুনিক প্রকাশনী. ১ , ইসলামিক ফাউন্ডেশন. ১, ৫৪, মুসলিমঃ ৫০৩৬; আবূ দাউদঃ ২২০৩; তিরমিযীঃ ১৭৪৮; দারাকুতনীঃ ১৩৪; নাসাঈঃ ৭৫, ৩৪৫০, ৩৮১০; আহমাদঃ ১৭০, ৩০৭। মুসলিম ২৩/৪৫ হা: ১৯০৭)।

৩. কিয়ামতের দিন ‘রিয়াকারী’ বা লোক দেখানো আমলকারীর বিচার সবার প্রথম হবে,

কিয়ামতের দিন প্রথমে যেসব লোকের বিচার করা হবে তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে ‘শহীদ’ ব্যক্তি। তাকে উপস্থিত করে আল্লাহ তাঁর নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিবেন। সে তা স্বীকার করবে। অতঃপর, আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন আমার দেয়া নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে সে বলবেঃ আমি আপনার দেওয়া নেয়ামতের বিনিময়ে আপনার রাস্তায় জিহাদ করে শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছে; বরং তুমি এই উদ্দেশ্যে জিহাদ করে শহীদ হয়েছিলে যাতে করে লোকেরা তোমাকে শহীদ বলে আখ্যায়িত করে। পৃথিবীতে তা বলা হয়ে গেছে। অতঃপর তাকে মুখের উপর উপুড় করে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

অতঃপর, এমন একজন ‘আলেমকে’ উপস্থিত করা হবে যে দ্বীনি ইলম অর্জন করেছে এবং মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন পাঠ করেছে। অতঃপর তাকে আল্লাহর নেয়ামতসমূহ স্মরণ করানো হবে। সেও তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেনঃ আমার দেয়া নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ? সে বলবেঃ আমি আপনার দেওয়া নেয়ামতের বিনিময়ে দ্বীনি ইল্ম অর্জন করেছি, অন্যকে তা শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার জন্যে কুরআন পাঠ করেছি। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো; বরং তুমি এই জন্যে বিদ্যা শিক্ষা করেছিলে যাতে করে মানুষ তোমাকে আলেম বলে। আর এই জন্যে কুরআন পাঠ করেছিলে যাতে লোকেরা তোমাকে কারী বলা হয়। পৃথিবীতে তোমাকে এই সব বলা হয়ে গেছে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের আদেশ দেয়া হবে। অতঃপর নাক ও মুখের উপর উপুড় করে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এরপর ঐ ব্যক্তিকে আনা হবে যাকে আল্লাহ নানারকম ধন-সম্পদ দান করেছিলেন। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমার দেয়া নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ? সে বলবেঃ আপনি যেসমস্ত পথে খরচ করা পছন্দ করেন তার কোন পথই আমি বাদ দেইনি, সকল পথেই খরচ করেছি। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো; বরং তুমি এই জন্য খরচ করেছো যাতে করে মানুষ তোমাকে ‘দানশীল’ বলে। পৃথিবীতে তোমাকে তা বলা হয়ে গেছে। অতঃপর তাকে মুখ ও নাকের উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপের আদেশ দেয়া হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহ মুসলিম : কিতাবুল ইমারাহ)।

৪। মাহমুদ ইব্ন লাবিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আমি তোমাদের ওপর যা ভয় করি তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে শির্কে আসগর (ছোট শির্ক)। তারা বলল: হে আল্লাহর রাসূল শির্কে আসগর কি? তিনি বললেন: “রিয়া (লোক দেখানো আমল), আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তাদেরকে (রিয়াকারীদের) বলবেন, যখন মানুষকে তাদের আমলের বিনিময় দেয়া হবে: তোমরা তাদের কাছে যাও যাদেরকে তোমরা দুনিয়াতে দেখাতে, দেখ তাদের কাছে কোন প্রতিদান পাও কিনা”। (আহমদ, হাদিসটি সহিহ)।

 

রিয়া থেকে মুক্তির উপায়

১।  সম্মান, সুনাম, সুখ্যাতি লাভের ইচ্ছা্ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, ইহা অন্তর থেকে বের করতে হবে।

২। কোন আমল শুরু করার আগেই বার বার অন্তরের নিয়ত পরিশোধিত করা। রিয়ার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা।

৩।  আমল করার সময় রিয়া আসাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। খুব কম লোকই আছে যাদের রিয়া আসেনা।  কাজেই রিয়া আসার সাথে সাথে নিয়ত সহিহ করতে হবে। যত বারই অন্তরে রিয়া আসবে ততবারই নিয়ত সহিহ করতে হবে। আমর না ছেড়ে  সহীহ নিয়ত অন্তরে উপস্থিত করে আমল করে যেতে হবে।

৪। যে ইবাদত প্রকাশ্যে করার বিধান (নামাজ, সালাত, সাওম, হজ্জ্ব, জাকাত, দ্বীন প্রচার, জিহাদ ইত্যাদি) তাতো প্রকাশ্যে করতে হবে। এ ছাড়া অন্যান্য ইবাদত যেমন: নফল সালাত, দান সদকা, তাহাজ্জুদ, নফল সাওম, মানুষের উপকার ইত্যাদি গোপনে করার চেষ্টা করতে হবে।

৫।     শির্ক থেকে  বাচার জন্য রাসুলুল্লাহ (সাঃ) শেখানো একটা দুয়া আছে, কেউ যদি প্রতিদিন সকাল বিকাল একবার করে পড়েন, তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তাকে শিরক থেকে হেফাজত করবেন।

দুয়াটি হচ্ছে:

اللَّهُمَّ  إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ وَأَنَا أَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَلِمَا لاَ أَعْلَمُ

উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ’উযুবিকা আন উশরিকা বিকা ওয়া আনা আ’লাম, ওয়া আস-তাগফিরুকা লিমা লা আ’লাম।

অনুবাদঃ হে আল্লাহ! আমার জানা অবস্থায় তোমার সাথে শিরক করা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আর আমার অজানা অবস্থায় কোনো শিরক হয়ে গেলে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

(আহমাদ ৪/৪০৩, হাদীসটি সহীহ, সহীহ আল-জামে ৩/২৩৩; হিসনুল মুসলিমঃ পৃষ্ঠা ২৪৬)।

উপরের আমলগুলি অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে আশা করা যায় মহান আল্লাহ ধীরে ধীরে আমাদের ইবাদত রিয়া মুক্ত করে দিবেন। ইনশাআল্লাহ। আমিন। সুম্মা আমিন।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment