লাইলাতুল মিরাজ এবং ইহার ভুলভ্রান্তী প্রথম কিস্তি

লাইলাতুল মিরাজ এবং ইহার ভুলভ্রান্তী প্রথম কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

১।   শবে মিরাজ বা লাইলাতুল মিরাজ

শব একটি ফারসী শব্দ যার অর্থ রাত। শব শব্দের আরবী লাইল। তাই বলা যায় শবে মিরাজ বা লাইলাতুল মিরাজ দুটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। আমারা ইসলামের অনেক পরিভাষাই আরবীর পরিবর্তে ফারসী ব্যবহার করি। যেমনঃ সালাত কে নামাজ বলি, সিয়াম কে রোজা বলি, এ সব বলাল এক মাত্র কারন উপমহাদেশে মোগলদের মাতৃভাষা ফারসীর প্রভাব। সে যা হোক আমাদের আলোচ্য বিষয় হল শবে মিরাজ বা লাইলাতুল মিরাজ। এই  লাইলাতুল মিরাজ আমাদের উপমহাদেশসহ বিভিন্ন দেশে খুব গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয়। এই রাত কে কেদ্রো করে পরের দিন সরকারি ছুটি থাকে সিয়াম পালনের জন্য। ইসলামের একটি গুরুত্ব পূর্ণ ইবাদত মনে করে কোন মুসলীম শ্বাষক হয়ত এই দিনটি ছুটির দিন ঘোষনা করেছেন। আমার এই লেখায় আমি মিজারে ঘটনা সম্পর্কে সঠিক একটা ধারনা দিব। অতপর, এই দিনে করণীয় ও বর্জণীয় আমল সম্পর্কে আলোচনা কবর। ইনশাল্লাহ।  

মি‘রাজ শব্দের অর্থ উপরে আরোহন। আল্লাহ তাঁর হাবীব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভূমি থেকে আকাশে আরোহণ করিয়ে প্রথম আকাশ থেকে শুরু করে সপ্তাকাশ ভেদ করে সিদরাতুল মুন্তাহা পেরিয়ে তাঁর নিজের কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। সেটাকেই মি‘রাজ বলা হয়। অপর পক্ষে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাতের একাংশে মক্কার হারাম থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস এর এলাকায় যে সফর করানো হয়েছে সেটাকে ইসরা বলা হয়। ইসরা শব্দের অর্থ হল রাতের সফর বা রাতের ভ্রমন।

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ইসরা ও মিরাজ একই রাতে হয়েছিল বিধায় বিষয়টি খুবই গুরুত্ব বহন করে। ইসরার দলীল পবিত্র কুরআনের সূরা আল-ইসরা বা বনী ইসরাঈল এর প্রথম আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে,

سُبۡحَـٰنَ ٱلَّذِىٓ أَسۡرَىٰ بِعَبۡدِهِۦ لَيۡلاً۬ مِّنَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ إِلَى ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡأَقۡصَا ٱلَّذِى بَـٰرَكۡنَا حَوۡلَهُ ۥ لِنُرِيَهُ ۥ مِنۡ ءَايَـٰتِنَآ‌ۚ إِنَّهُ ۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ (١) 

অর্থঃ পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যান্ত-যা র চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল। (সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:১)

আর মি‘রাজের দলীল হচ্ছে, অন্য আয়াত যেখানে বলা হয়েছে,

 وَلَقَدۡ رَءَاهُ نَزۡلَةً أُخۡرَىٰ (١٣) عِندَ سِدۡرَةِ ٱلۡمُنتَهَىٰ (١٤) عِندَهَا جَنَّةُ ٱلۡمَأۡوَىٰٓ (١٥) إِذۡ يَغۡشَى ٱلسِّدۡرَةَ مَا يَغۡشَىٰ (١٦) مَا زَاغَ ٱلۡبَصَرُ وَمَا طَغَىٰ (١٧) لَقَدۡ رَأَىٰ مِنۡ ءَايَـٰتِ رَبِّهِ ٱلۡكُبۡرَىٰٓ (١٨) 

নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল, সিদরাতুলমুন্তাহার নিকটে, যার কাছে অবস্থিত বসবাসের জান্নাত।

যখন বৃক্ষটি দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার, তদ্দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল। তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি এবং সীমালংঘনও করেনি।

নিশ্চয় সে তার পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছে। (সুরা নাজম ৫৩:১৩-১৮)।

                              

২। পটভূমিঃ

মিরাজ ছিল মহান আল্লাহ প্রদত্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ নবুয়তের নিদর্শন। এমন এক সময় মহান আল্লাহ এই নিদর্শণ প্রদান করেন যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চার দিক থেকে বিপদে ঘিরে ধরেছিল। এতিম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তারা দাদা প্রতিপালন করেন। তিনি মারা যাওয়ার পর যিনি তাকে পিতার শ্নেহে পালন পালন করেন তিনি হলেন আবু তালেব। যিনি কাফের হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সার্বক্ষনিক নিজের তত্ত্বাবধানে রাখতেন। তার জীবদ্দশায় কেউ তার কোন ক্ষতি করতে চাইলেও সক্ষম হত না। নবুওয়তের দশম বৎসরে এই মহান ব্যক্তির মারা যান। তার মৃত্যুর পর কাফেররা অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠে। এর কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহাও মারা যান। যিনি শুধু রাসূলের স্ত্রীই ছিলেন না বরং তার দাওয়াতের প্রধান সহযোগীও ছিলেন। তার সমস্ত সম্পত্তি রাসূলের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। যিনি প্রতি দিন হেরা গুহায় খাবার পৌছে দিতেন। অহীর সংবাদ পেয়ে প্রথম ঈমান এনেছিলেন। হিজরতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যত কষ্ট প্রতিটির সাথে ভাগ ছিল উম্মুল মুমিনীন খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহার। আবু তালেব ও খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহার মৃত্যুর পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসহায় বোধ করলেন। তিনি ইসলামের দাওয়াত পৌছে দেয়ার জন্য বিভিন্ন গোত্র পতিদের সহায়তা চাইলেন। কিন্তু কেউ তাকে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ায়নি। এমতাবস্থায় তিনি ইসলামে বাণী পৌছাতে মক্কা থেকে তায়েফ বাসির নিকট গেলেন। তায়েফের বাসির গোত্রপতিদের নিকট তিনি ইসলাম গ্রহনর আহবান জানান যাতে তার হাত শক্তিশালী হয় কিন্তু তাদের কেউ তার কথায় কর্ণপাতই করল না। উপরন্তু তারা দুষ্ট শিশুদের তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। এমতাবস্থায় যা ঘটার তা-ই ঘটল। তারা তাকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করে দিল। তিনি মক্কায় ফিরে আসলেন। মহান আল্লাহ্ তাকে সম্মানিত করতে চাইলেন। তিনি তাকে ইসরা ও মি‘রাজের মত বিরল সম্মানে সম্মানিত করলেন।

 

৩। সহিহ কয়েকটি হাদিসের মাধ্যমে মিরাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনা বর্ণনা করছিঃ

১। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ আমার কাছে বুরাক আনা হল। বুরাক গাধা থেকে বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট একটি সাদা রঙের জন্তু। যতদুর দৃষ্টি যায়, এক এক পদক্ষেপে সে ততাদূর চলে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি এতে আরোহন করলাম এবং বায়তুল মাকদাস পর্যন্ত এসে পৌছলাম। তারপর অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কিরাম তাদের বাহনগুলো যে রজ্জুতে বাধতেন, আমি সে রজ্জুতে আমার বাহনটিও বাধলাম। তারপর মসজিদে প্রবেশ করলাম ও দু-রাকাত সালাত আদায় করে বের হলাম। (সহিহ মুসলিম ৩০৮ নম্বর হাদিসের প্রথম অংশ কারন পরের হাদিসে বাকী অংশ আছে ইফাঃ)।

২। আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ আমি মক্কাতে ছিলাম। আমার ঘরের ছাদ ফাঁক করা হলো। তখন জিবরীল আলাইহিস সালাম অবতরণ করলেন। তিনি আমার বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। এরপর তা যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করলেন। তারপর হিকমত ও ঈমানে পরিপূর্ণ একটি পাত্র আনা হলো এবং তা আমার বুকে ঢেলে বক্ষ বন্ধ করে দিলেনা এরপর আমার হাত ধরলেন এবং ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা করলেন। আমরা যখন প্রথম আসমানে গিয়ে পৌছলাম, তখন জিবরীল আলাইহিস সালাম এ আসমানের দ্বাররক্ষীকে বললেন, দরজা খুলুন! তিনি বললেন, কে? বললেন, জিবরীল। দ্বাররক্ষী বললেন, আপনার সাথে কি অন্য কেউ আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমার সাথে মুহাম্মদ আছেন। দাররক্ষী বললেন, তাঁর কাছে আপনাকে পাঠান হয়েছিল কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এরপর দরজা খুলে দেওয়া হলো।

আমরা প্রবেশ করে দেখি, এক ব্যাক্তি, তাঁর ডানে একদল মানুষ এবং বায়ে একদল মানুষ। যখন তিনি ডান দিকে তাকান তখন হাসেন, আর যখন বাঁ দিকে তাকান তখন কাঁদেন। তিনি আমাকে বললেন মারহাবা হে সুযোগ্য সন্তান। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি জিবরীলকে বললাম, ইনি কে? তিনি বললেন, ইনি  আদম আলাইহিস সালাম আর ডানে ও বায়ের এ লোকগুলো তার বংশধর। ডান পার্শ্বস্থরা হচ্ছে জান্নাতবাসী আর বাম পার্শ্বস্থরা হচ্ছে জাহান্নামবাসী। আর এ কারণেই তিনি ডান দিকে তাকালে হাসেন এবং বাঁ দিকে তাকালে কাদেন।

তারপর জিবরীল আলাইহিস সালাম আমাকে নিয়ে ঊর্ধ্বারোহণ করলেন এবং দ্বিতীয় আসমানে পৌছলেন এবং এর দ্বাররক্ষীকে বললেন, দরজা খুলুন। তিনি প্রথম আসমানের দ্বাররক্ষীর মত প্রশ্নোত্তর করে দরজা খূলে দিলেন। আনাস (রাঃ) বলেন, এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, তিনি আসমানসমূহে . আদম, ইদূরীস, মূসা ও ইবরাহীম (আলাইহিমুস সালাম) এর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। আদম আলাইহিস সালাম প্রথম আসমানে এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ষষ্ঠ আসমানে। এছাড়া অন্যান্য নাবীর অবস্থান সম্পর্কে এ রেওয়ায়েতে কিছু উল্লেখ নেই।

আনাস (রাঃ) বলেন, যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও  জিবরীল আলাইহিস সালাম ইদরীস আলাইহিস সালাম এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, মারহাবা, হে সুযোগ্য নাবী! সুযোগ্য ভ্রাতা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? জিবরীল আলাইহিস সালাম উত্তর দিলেন; ইনি ইদরীস আলাইহিস সালাম তারপর আমরা মূসা আলাইহিস সালাম-এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনিও বললেন, মারহাবা হে সুযোগ্য নাবী, সুযোগ্য ভ্রাতা। জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তিনি জবাব দিলেন, ইনি মূসা আলাইহিস সালাম।

তারপর আমরা ঈসা আলাইহিস সালাম এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম, তিনিও বললেন, মারহাবা হে সুযোগ্য নাবী, সুযোগ্য ভ্রাতা! জিজ্ঞেস করলাম ইনি কে? তিনি বললেন, ইনি ঈসা আলাইহিস সালাম। তারপর আমরা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম, তিনিও বললেন, মারহাবা হে সুযোগ্য নাবী, সুযোগ্য সন্তান! জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তিনি বললেন, ইনি . ইবরাহিম আলাইহিস সালাম।

ইবনু শিহাব, ইবনু হাযম, ইবনু আব্বাস ও আবূ হাব্বা আনসারী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তারপর জিবরীল আলাইহিস সালাম আমাকে নিয়ে আরো ঊর্ধ্বে চললেন। আমরা এমন এক স্তরে পৌঁছলাম যে, তথায় আমি কলম-এর খশমশ (লেখার) শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ইবনু হাযম ও আনাস ইবনু মালিক বর্ণনা করেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ তখন আল্লাহ তা’আলা আমার ওপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত (নামায/নামাজ) ফরয করেন। আমি এ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করার পথে মূসা আলাইহিস সালাম এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার প্রতিপালক আপনার উম্মতের ওপর কি ফরয করেছেন? আমি উত্তরে বললাম, তাদের উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়েছে। 

মূসা আলাইহিস সালাম আমাকে বললেন, আপনি আপনার রবের কাছে ফিরে যান, কেননা আপনার উম্মাত তা আদায় করতে সক্ষম হবে না। তাই আমি আল্লাহর নিকটে ফিরে গেলাম। তখন আল্লাহ এর অর্ধেক কমিয়ে দিলেন। আমি আবার ফিরে এসে মূসা (আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে জানালে তিনি বললেন, না, আপনি পুনরায় ফিরে যান, কেননা আপনার উম্মাত এতেও সক্ষম হবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তারপর আমি আল্লাহর নিকটে ফিরে গেলে তিনি বললেন, এ নির্দেশ পাঁচ, আর পাঁচই পঞ্চাশের সমান করে দিলাম, আমার কথার কোন রদবদল নেই।

এরপর আমি মূসা আলাইহিস সালাম এর কাছে ফিরে আসি। তিনি তখনো বললেন, আপনি ফিরে যান আল্লাহর নিকটে। আমি বললাম আমার লজ্জা অনুভূত হচ্ছে। তারপর জিবরীল আলাইহিস সালাম আমাকে নিয়ে চললেন, আমরা সিদরাতুল মুনতাহায় পৌছলাম। তা এত বিচিত্র রঙে আবৃত যে, আমি বুঝতে পারছি না যে, আসলে তা কী। তারপর আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান হল। সেখানে ছিল মুক্তার গম্বুজ আর তার মাটি ছিল মিশকের। (সহিহ মুসলিম ৩১২ নম্বর হাদিস ইফাঃ)।

৩। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাবী বলেন, আনাস (রাঃ) সম্ভবত তার সম্প্রদায়ের জনৈক মালিক ইবনু সা’সাআ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ একদা আমি কাবা শরীফের কাছে নিদ্রা ও জাগরণের মাঝামাঝি অবস্থায় ছিলাম। তখন তিন ব্যাক্তির মধ্যবতী একজনকে কথা বলতে শুনতে পেলাম। যাহোক তিনি আমার কাছে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন। তারপর আমার কাছে একটি স্বর্ণের পাত্র আনা হল, তাতে যমযমের পানি ছিল। এরপর তিনি আমার বক্ষ এখান থেকে ওখান পর্যন্ত বিদীর্ন করলেন। বর্ণনাকারী কাতাদা (রাঃ) বলেন, আমি আমার পার্শ্বস্থ একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এখান থেকে ওখান পর্যন্ত- বলে কি বোঝাতে চেয়েছেন?

তিনি জবাব দিলেন, “বক্ষ থেকে পেটের নীচ পর্যন্ত”। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ এরপর আমার হৃদপিণ্ডটি বের করা হল এবং যমযমের পানি দিয়ে তা ধৌত করে পূনরায় যথাস্থানে স্থাপন করে দেয়া হল। ঈমান ও হিকমতে আমার হৃদয় পূর্ন করে দেয়া হয়েছে। এরপর আমার কাছে ‘বুরাক’- নামের একটি সাদা জন্তু উপস্থিত করা হয়। এটি গাধা থেকে কিছু বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট। যতদুর দৃষ্টি যায় একেক পদক্ষেপে সে ততদুর চলে। এর উপর আমাকে আরোহণ করান হল। আমরা চললাম এবং দুনিয়ার আসমান পর্যন্ত পৌছলাম। জিবরীল আলাইহিস সালাম দরজা খুলতে বললেন। বলা হল, কে? তিনি বললেন, জিবরীল। বলা হল, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, আমার সাথে মুহাম্মাদ আছেন। দাররক্ষী বললেন, তাঁর কাছে আপনাকে পাঠান হয়েছিল কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এরপর দরজা খুলে দিলেন এবং বললেন, মারহাবা! কত সম্মানিত আগন্তুকের আগমন হয়েছে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তারপর আমরা আদম আলাইহিস সালাম-এর কাছে আসলাম … এভাবে বর্ণনাকারী পূর্ণ হাদীসটি বর্ণনা করেন। তবে এ রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয় আসমানে ঈসা ও ইয়াহইয়া, তৃতীয় আসমানে ইউসুফ, চতূর্থ আসমানে ইদরীস, পঞ্চম আসমানে হারুন আলাইহিস সালাম এর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তারপর আমরা ষষ্ঠ আসমানে গিয়ে পৌছি এবং মূসা আলাইহিস সালাম এর কাছে গিয়ে তাঁকে সালাম দেই। তিনি বললেন, মারহাবা, হে সুযোগ্য নাবী, সুযোগ্য ভ্রাতা! এরপর আমরা ডাঁকে অতিক্রম করে চলে গেলে তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। আওয়াজ এল, আপনি কেন কাঁদছেন? তিনি জবাব দিলেন, প্রভু, এ বালককে আপনি আমার পরে পাঠিয়েছেন; অথচ আমার উম্মাত অপেক্ষা তাঁর উম্মাত অধিক সংখ্যায় জান্নাতে প্রবেশ করবে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমরা আবার চললাম এবং সপ্তম আসমানে গিয়ে পৌছলাম ও ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর কাছে আসলাম। সাহাবী তাঁর এ হাদীসে আরো উল্লেখ করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেনঃ সেখানে তিনি চারটি নহর দেখেছেন। তন্মধ্যে দুটি প্রকাশ্য ও দুটি অপ্রকাশ্য। সবগুলোই সিদূরাতূল মুনতাহার গোড়া হতে প্রবাহিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি বললাম, হে জিবরীল! এ নহর গুলো কি? তিনি বললেন, অপ্রকাশ্য নহরদ্বয় তো জান্নাতের নহর আর প্রকাশ্যগুলো নীল ও ফূরাত। অর্থাৎ এ দুটি নহরের সা’দূশ্য রয়েছে জান্নাতের ঐ দুটি নহরের সাথে।

এরপর আমাকে বায়তুল মামুরে উঠান হল। বললামঃ হে জিবরীল! একি? তিনি বললেন, এ হচ্ছে ‘বায়তুল মামুর’। প্রত্যহ এতে সত্তর হাজার ফেরেশতা (তাওয়াফের জন্য) প্রবেশ করে। তারা একবার তাওয়াফ সেরে বের হলে কখনও আর ফের তাওয়াফের সুযোগ হয় না তাদের। তারপর আমার সম্মুখে দূটি পাত্র পেশ করা হলো, একটি শরাবের, অপরটি দুধের। আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। তিনি আমাকে বললেন, আপনি ঠিক করেছেন। আল্লাহ আপনার উম্মাতকেও আপনার ওসীলায় ফিতরাত এর উপর কায়েম রাখুন। তারপর আমার উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত (নামায/নামাজ) ফরয করা হয়… এভাবে বর্ণনাকায়ী হাদীসের শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করেন।(সহিহ মুসলিম ৩১৩ নম্বর হাদিস ইফাঃ)।

৪। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ ইসরা মিরাজের রাতে ঈলিয়া নামক স্থানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে শরাব ও দুধের দু’ টি পেয়ালা পেশ করা হয়েছিল। তিনি উভয়টির দিকে নযর করলেন। এরপর দুধের পেয়ালাটি গ্রহন করেন। তখন জিবরীল আলাইহিস সালাম বললেনঃ সকল প্রসংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি আপনাকে স্বভাবজাত জিনিসের দিকে পথ দেখিয়েছেন। অথচ যদি আপনি শরাব গ্রহণ করতেন তাহলে আপনার উম্মত গুমরাহ হয়ে যেত। যুহরী (রহঃ) থেকে মা’মার, ইবনু হাদী, উসমান, ইবনু উমর যুবায়দী অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।(সহিহ বুখারী ৫১৭৬ ইফাঃ)

৫। জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, যখন কুরাইশরা মিরাজের ঘটনায় আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে লাগলো, তখন আমি হিজরে (কাবার একটা অংশের নাম) দাঁড়ালাম। আল্লাহ তা’আলা বায়তুল মুকাদ্দাস কে আমার সামনে উম্মুক্ত করে দিলেন। আমি তা দেখে দেখে তার সকল চিহ্ন তাদের বলে দিতে লাগলাম। ইয়াকুব ইবনু ইব্রাহিম ইবনু শিহাব সূত্রে অতিরিক্ত বর্ণনা করেছেন। যখন কুরাইশরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে লাগল, সেই ঘটনার ব্যাপারে যখন আমাকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফর করানো হয়েছিল। পরবর্তী অনুরূপ। এমন যা সবকিছু চুরমার করে দেয়। আমাকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফর করানোর ঘটনাটি যখন কুরাইশরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে লাগল। (সহিহ বুখারী ৪৩৫০ ইফাঃ)

৪। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি মিরাজে আল্লাহ কে দেখেছেন?

৬। মাসরুক রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে হেলান দিয়া বসেছিলাম। তখন তিনি বললেন, “হে আবু আয়েশা! তিনটি কথা এমন, যে এর কোন একটি বলল, সে মহান আল্লাহ সম্পর্কে ভীষণ অপবাদ দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেগুলো কী? তিনি বললেন, যে এ কথা বলে যে,  মুহাম্মাদ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার রবকে দেখেছেন, সে আল্লাহর উপর ভীষণ অপবাদ দেয়। আমি তো হেলান অবস্থায় ছিলাম, এবার সোজা হয়ে বসলাম। বললাম, হে উম্মুল মু’মিনীন! থামুন। আমাকে সময় দিন, ব্যস্ত হবেন না। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কি বলেন নি? তিনি তো আল্লাহকে ষ্পষ্ট দিগন্তে দেখেছেন। (তাকবির ৮১:২৩)। অন্যত্রে “নিশ্চয়ই তিনি তাকে আরেক বার দেখে ছিলেন। (নাজম ৫৩:১৩)।  আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেন, আমিই এ উম্মতের প্রথম ব্যক্তি, যে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, তিনি তো ছিলেন জিবরীল আলাইহিস সালাম। কেবল এ দু’বার-ই আমি তাকে তার আসল আকৃতিতে দেখেছি। আমি তাকে আসমান থেকে অবতরণ করতে দেখেছি। তাঁর বিরাট দেহ ঢেকে ফেলেছিল আসমান ও জমিনের মধ্যবতী সবটুকু স্থান। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা আরও বলেন, তুমি কি শোন নি?  আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “তিনি (আল্লাহ) দৃষ্টির অধিগম্য  নন, তবে দৃষ্টিশক্তি তাঁর অধিগত এবং তিনিই সূক্ষ্মদর্শী ও সম্যক পরিজ্ঞাত। (আনয়াম ৬:১০৩)। এরূপ তুমি কি শোন নি?  আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “মানুষের এমন মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যম ব্যতিরেকে অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে অথবা এমন দূত প্রেরণ ব্যতিরেকে যে তাঁর অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করেন, তিনি সর্বোচ্চ ও প্রজ্ঞাময়। (শূরা ৪২:৫)।  আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, আর ঐ ব্যক্তিও আল্লাহর উপর ভীষণ অপবাদ দেয়, যে এমন কথা বলে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কিতাবের কোনো কথা গোপন রেখেছেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “হে রাসূল!আপনার রবের কাছ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার করুন, যদি তা না করেন তবে আপনি তাঁর বার্তা প্রচারই করলেন না। (মায়েদা ৫:৬৭)। তিনি (আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) আরো বলেন, যে ব্যক্তি এ কথা বলে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর ওহী ব্যতীত কাল কী হবে তা অবহিত করতে পারেন, সেও আল্লাহর উপর ভীষন অপবাদ দেয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, বল, আসমান ও জমিনে আল্লাহ ব্যতীত গায়েব সম্পর্কে কেউ জানে না।” (সূরা আন-নামল ২৭:৬৫, সহিহ মুসলিম ৩৩৬ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

৭। মাসরুক রাহমাহুল্লাহ বলেন। আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মি‘রাজ রজনীতে যদি আল্লাহর দর্শন না পেয়ে থাকেন,তাহলে আল্লাহর এ বলার অর্থ কি দাঁড়াবে? এরপর তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর নিকটবর্তী হলেন এবং আরো নিকটবর্তী, ফলে তাদের মধ্যে ধনুকের ব্যবধান রইল বা তারও কম। তখন আল্লাহ তার বান্দার প্রতি যা ওহী করবার তা ওহী করলেন। (নাজম ৫৩:৮-১০)। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেন, তিনি তো ছিলেন জিবরীল আলাইহিস সালাম। তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে (সাধারণ) পুরুষের আকৃতিতে আসতেন। কিন্তু তিনি এবার (আয়াতে উল্লিখিত সময়) নিজস্ব আকৃতিতে এসেছিলেন। তার দেহ আকাশের সীমা ঢেকে ফেলেছিল। (সহিহ মুসলিম হাদীস নম্বর ৩৩৯ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

৫। মিরাজ কখন হয়েছিলঃ

আমাদের দেশে রজব মাসের চাঁদ উঠলেই পত্র-পত্রিকাতে নিউজ ছাপা হয়। রজব মাসের চাঁদ উঠেছে এই মাসের অমুক তারিখে শবে মিরাজ। দেশের সকল মুসলিম ধরেই নিয়েছি যে রজব মাস মানেই মিরাজের মাস। এই মাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো মিরাজ। শবে মিজার উপলক্ষে প্রতিটি দৈনিকে বিশেষ ক্রোড় পত্র বের করে। মিরাজের উপর বিস্তার লেখালেখি হয়, যার মধ্যে গুরুত্ব পায় শবে মিজারের গুরুত্ব, ঘটে যাওয়া সত্য কাহিণী, মিথ্যা ফজিলত ও বিদআতী আমল। এই সব প্রবদ্ধ লেখা হয় আমাদের সমাজে আমরা যারা আলেম মনে করি তাদের দ্বারা। তবে হ্যা, ইদানিং অনেক ভাল মানের আলেন ও এ সম্পর্কে সত্য তুলে ধরছেন। আমাদের দেশে যারা আলেম নামে পরিচিতি তারাও এ সম্পর্কে নিজেদের অজ্ঞতার কারনে এই মাসের নির্দিষ্ট দিনে মিরাজ সম্পর্কিত আলোচনা করে। সাধারন মুসলিমকে ধোকা দিয়ে এই দিনের গুরুত্ব তুলে ধরে রাতে সালাত আদায় করতে ও দিনে সিয়াম পালন করতে উৎসাহ প্রদান করেন। সাধারন মুসলিমদেরও দোষ আছে। এই রাতে এশার সালাতের পর হুজুরের ওয়াজ না শুনে এবং মিলাদ না পড়ে কেউই মসজিদ থেকে বাহির হয় না। যেহেতু দিন হল সরকারি ছুটির দিন। নিশ্চয় কিছু একটাতো আছেই, তা না হলে সরকার বাহাদুর ছুটি দিন কেন? যা হোক আবার অনেক আলেম বাধ্য হন কিছু একটা বলার বা করার জন্য।

মিজারের রাতে যখন কোন আলেম কিছু বলতে যায়, তখন মিরাজ সম্পর্কিত সত্য ঘটনা কুরআন সুন্নাহ মোতাবেগই বলেন কিন্তু এই রাতের ফজিলত এ আমল সম্পর্কিত যত কথা বলেন সবই মিথ্যা বানোয়াট। কিন্তু হুজুরদে মিথ্যা ফজিলত ও আমলের কথা বলার কারনে অনেকেই মনে করে থাকেন এই রাতের অনেক গুরুত্ব আছে।

আমাদের সমাজে মিরাজ মানেই রজব মাসের ২৭ তারিখ। এই তারিখটা এতই প্রসিদ্ধ লাভ করেছে যে, এ রিপরীত কোন তারিখ থাকতে পারে তা কেউ কল্পণাও করতে পারেনা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা রীতির প্রতি আমাদের একনিষ্ট অনুসরণই এর জন্য দায়ী। পৃথীবির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জণকারী সিরাত গ্রন্থ আর-রাহিকুল মাখতুম-এ মিরাজ সম্পর্কে একটা অধ্যায় আছে। সেখানে মিরাজের তারিখ সম্পর্ক অনেকগুলি মতামত তুলে ধরেছেন আলোচনা শুরুতে ঐ তারিখগুলো হুরহু তুলে ধরলাম।

মিরাজের এ বিশ্ববিশ্রুত অলৌকিক ঘটানাটি কোন সময় সংগটিত হয়েছিল সে ব্যাপারে জীবন চরিতগনের মধ্যে যে মতভেদ দেখআ যায় তা নিম্ম লিপিদ্ধ করা হল,

১। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে নবুয়াত প্রদান করা হয়েছিল, সে বছর মিরাজ সংগটিত হয়েছিল। (এটা তাবারীর কথা)

২। নবুয়াতের পাঁচ বছর পর মিরাজ সংগটিত হয়েছিল (ইমাম নাবাবী এবং ইমাম কুরতুবি এ মত অধিক গ্রহন যোগ্য বলে স্থির করেছেন।

৩। দশম নবুয়াত বর্ষের ২৭ শে রজব তারিখে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল। (আল্লামা মানসুরপুরী এ মত গ্রহন করেছেন।

৪। হিজরতের ১৬ মাস পূর্বে, আর্থাৎ নবুয়াতের দ্বাদশ বর্ষের রমাজান মাসে মিরাজ সংগটিত হয়েছিল।

৫। হিজরতের ১ বছর ২ মাস পূর্বে আর্থাৎ নবুয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষের মুহারম মাসে মিরাজ সংগটিত হয়েছিল।

৬। হিজরতের ১ বছর পূর্বে আর্থাৎ নবুয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষের রবিউল আউয়াল মাসে মিরাজ সংগটিত হয়েছিল।

এর মধ্য প্রথম তিনটি মত গ্রহন যোগ্য নয় কারন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার মৃত্য হয়েছিল পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হওয়ার পূর্বে। আর এ ব্যাপারে সকলে এক মত যে, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হয় মিরাজের রাত্রিতে। এ কথাটি পরিস্কার যে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার মৃত্য হয়েছিল মিরাজের পূর্বে। তাছাড়া, এ কথা সর্বজন বিদিত যে, তার মৃত্যু হয়েছিল দশম নবুওয়াত বর্ষের রমাযান মাসে। কাজেই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি দশম নবুওয়াত বর্ষের রমাযান আগে মিরাজ হতে পারে না। বাকি তিনটি মতের একটির উপর অন্যটির প্রধান্য দেয়ার প্রমান পাওয়া যায় না।

মন্তব্যঃ বিশ্ব নন্দীত সিরাত গ্রন্থ আর-রাহিকুল মাখতুম এর ভাষ্যগুলি ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যায় মিরাজ সংগটিত হওয়ার সময় হিজরতের এক বা দেড় বছর পূর্বে নবুয়াতের দ্বাদশ বর্ষের রমাজান মাসে অথবা ত্রয়োদশ বর্ষের মুহারম বা রবিউল আউয়াল মাসে। একটু খেয়াল করুন এই গ্রন্থ ২৭ শে রজব তারিখে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল বলে যে কথা বলা হয়েছে তার একেবারেই বাতিন। অথচ আমরা কি বোকা ঐ বাতিল তারিখে আসল ধরে শবে মিরাজ পালন করছি।

আরও কয়েকটি মতঃ

১। ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত প্রকাশের একাদশ বৎসরের (৬২০ খ্রিষ্টাব্দ) রজব মাসের ২৬ তারিখের দিবাগত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথমে কাবা শরিফ থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসায় গমন করেন। (তথ্যঃ উইকিপিডিয়া, রেফারেন্স নাই)

২। সুরা বনী ঈসরাইলের শানে নজুলে বলা হয়েছে, প্রথম আয়াতটিই একথা ব্যক্ত করে দেয় যে, মি’রাজের সময় এ সূরাটি নাযিল হয়। হাদীস ও সীরাতের অধিকাংশ কিতাবের বর্ণনা অনুসারে হিজরাতের এক বছর আগে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। তাই এ সূরাটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কায় অবস্থানের শেষ যুগে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তরভুক্ত।

 ৩। হাদিস সাস্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মাপের হাদিস বিশারদদের একজন হলেন হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) তার থেকে উপকৃত হননি এমন একজন আলেম খুজে পাওয়া দুষ্কর হবে। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেছেন, কোন কোন বক্তা বা গল্প বাজ বা লেখক জানাই রসূল (সঃ) এর মিরাজ নাকি রজব মাসে হয়েছে। তিনি অভিমত দিয়েছে এটা মিথ্যা । তিনি আরো বলেছেন রসূল (সঃ) এর মিরাজ রজব মাসের ২৭ তারিখে হয়েছে এমন কোন গ্রহন যোগ্য বর্ণনা পাওয়া যায় না।

৪। ইবনে হাজার ইবনে দাহিয়া থেকে বর্ণনা করে বলেন, কাহিনিকারদের কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন মিরাজ রজব মাসে। তিনি বলেন, এটা মিথ্যা। 

৫। রজব বলেন, মিরাজের সময় এমন এক বর্ণনা সূত্রে তা উল্লেখ করা হয়েছে যা অশুদ্ধ।

কাসেম ইবনে মুহাম্মদ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইসরা-মিরাজ ছিল রজবের ২৭ তারিখ এ কথা ইব্রাহীম হারবি ও অন্যান্যরা অস্বীকার করেছেন।  

৬। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ) বলেছেন, বিশুদ্ধ কোন বর্ণনা দ্বারা কোন মাসের কথা, কোন দিনের কথা, কোন তারিখের কথা জানা জায়নি। এবং এ বিষয়ে যতো গুলো বর্ণনা পাওয়া যায় তার কোনটিই গ্রহন যোগ্য নয়।

৭। কুরআনে মিরাজ সম্পর্কে বলা হলেও তারিখ বলা হয় নাই।

৮। মিরাজ সম্পর্কে অসংখ্যা হাদিস বর্ণিত হলেও মিরাজের তারিখ সম্পর্কে কোন সহিহ হাদিস নেই।

৯। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এর জীবন সম্পর্কে লেখা সিরাত গ্রন্থে অনুমান ভিত্তিক অনেক তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু কোন সহিহ সনদ পাওয়া যায় না।

  মন্তব্যঃ আলোচনার সার কথা হল, লাইলাতুল মিরাজের সঠিক তারিখ কেউ জানেন। কোন বছর তা নিয়েই বিতর্ক আছে, কোন মাস তা নিয়ে বিতর্ক আছে আর তারিখ নিয়েতো মহা বিতর্ক আছে। আলোচনার শুরুতে মিরাজ সম্পর্ক অনেকগুলী সহিহ হাদিস উল্লেখ করেছি। এ সকল হাদিস সমূহে দেখা যায় যে, তাকে আসমানের দিকে ঊর্ধ্বে মিরাজ করানো হয়েছে। তাঁর জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। এমনকি তিনি সপ্ত আকাশ পাড়ি দিয়েছেন। এরপর তার রব্ব তার সাথে যা ইচ্ছা কথা বলেছেন এবং তাঁর উপর নামায ফরয করেছেন। যে রাত্রিতে মিরাজ সংগঠিত হয়েছে সে রাত্রিকে তারিখ বা কত সালে মিরাজ হয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে কোন হাদিস বর্ণিত হয়নি। না রজব মাসের ব্যাপারে আর না অন্য কোন মাসের ব্যাপারে। কিন্তু এই রাত্রিকে নির্দিষ্ট করে যে সব আমলের বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে সে বর্ণনাগুলোর কোনটি হাদিস বিশারদদের নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত নয়। এমন কি আমল সংক্রান্ত হাদিসগুল যঈফ সনদেও নাই, সহিহ অনেক দুরের কথা। এই রাতে যদি ইবাদতের কোন কল্যান নিহীত থকেত তবে মহান আল্লাহ আমদেরকে অবশ্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে অবহিত করতেন। মিরাজ যে রজব মাসের ২৭ তারিখেই হয়েছে এর কোন গ্রহন যোগ্য ভিত্তি কোরআন ও সহিহ সুন্নাতে কোথাও পাওয়া যায় না। কারন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিদিষ্ট কোন তারিখ বলে যাননি। এই রাতটি বা এই তারিখটি যদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতো তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দিষ্ট করে রেখে যেতেন। আর সাহাবারা ঠিকই আদায় করতেন। এমন একটা বরকতময় রাত চলে যাবে আর সাহাবা আজমাইনরা আমল করবেন না তাতো হতে পারে না।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment