বিদআত চিনার উপায় প্রথম কিস্তি : কিভাবে বুঝবেন আপনার আমলটি বিদআত

বিদআত চিনার উপায় প্রথম কিস্তি 

কিভাবে বুঝবেন আপনার আমলটি বিদআত

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

মুসলীম সমাজ সবচেয়ে বেশী বিভ্রান্তিতে আছে বিদআদ চিহিৃত করণ নিয়ে। যারা বিদআত করে তারা কখন স্বীকার করে না যে তার আমলটি বিদআত। সে নানা অনুহাতে বিদআতটিক ভাল কাজ বলে চালিয়ে যেতে চায়। যখন কাউকে বললেন ভাই আপনার এ আমলটি বিদআত। সে সাথে সাথে উত্তর দেন, দেখুন বুঝালাম আমলটি কি বিদআত, কিন্তু আমিতো কোন খারাপ কাজ করছিনা। আমলটি ভাল, মহান আল্লাহর খুশির জন্যই করছি। তাছাড়া কারও ক্ষতিতো আর হচ্ছে না। কিন্তু যে কিছুতেই বুঝতে চাবে না যে, আমলটি মহান আল্লাহর খুশির জন্যই করা হয় অথচ তার কোন নিয়ম পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর সুন্নাহে নেই বা সময় সুযোগ থাকতেও সাহাবিগনও (রাঃ) করেন নাই। কাজেই বিদআতি আমল পরিত্যাগের আগে বিদআত চিনা খুবই দরাকার। যেমন ধরুন মিলাদুন্নবী একটি বিদআতি আমল। যখন আপনি কোন বিদআতি বলেবেন আমলটি বিদআত। সে শত শত ভাল ভাল যুক্তি দিয়ে মিলাদুন্নবী পালনের কথা বলবে। তাদের যুক্তি থেকে কোন খারাপ আপনি পাবেন না। কারন পৃথিবীর শ্রষ্ঠ মানুষের পক্ষে তা যা বলবে তা নিতান্তই কম হবে। তাই তাদের যুক্তি মিলাদুন্নবী পালন আপনি রাজি হয়ে যাবেন। কিন্তু আপনার যদি বিদআত চিনার জ্ঞান থাকে, তা হলে তাদের কোন যুক্তি আপানার কাছে যৌক্তিক মনে হবেন। কারন আপনি জেনে গেছেন যে, কোন ভাল কাজ ইসলাম মনে করে করা হয় অথচ সময় সুযোগ থাকতেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এই পদ্ধতিতে এমন আমল করে নাই তাই বিদআত। যখন দেখবেন মিলাদুন্নবী সম্পর্কে কুনআন হাদিসে কোন আমল বর্ণনা নাই। তখন আপনি এই আমলকে বিদআত বলে ঘোষনা দিবেন। কাজেই বুঝা গেলে বিদআত থেকে মুক্ত থাকতে গেলে আগে বিদআতকে সঠিকভাবে চিনতে হবে। শত্রুকে চিনতে পারলে যেমন তার থেকে শর্তক থাকা যায়। বিদআতকে চিনতে পারলেও তার থেকে শর্তক থাকা যাবে। তাই আসুন দেখি, কিভাবে বুঝবেন আপনার আমলটি বিদআত। নিম্ম এমনই কথগুলি মানদন্ড বর্ণনা করা হলোঃ

১। কুনআন ও সহিহ হাদিসে আমলটির কোন দলীল নেই

২। ইসলামী শরীয়ত সম্মত আমল নিয়ে বাড়াবাড়ি

৩। ইসলামি শরিয়ত সম্মত কোন বিষয়ে বৃদ্ধি

ক। ইবাদতে বৃদ্ধি করা

খ। আকিদায় বৃদ্ধি করা

গ। রাসূল সম্পর্কে বৃদ্ধিকরা

ঘ। অলী আওলীয়া সম্পর্কে বৃদ্ধিকরা

৪। ইসলামি শরিয়ত সম্মত কোন ইবাদতে হ্রাস করা

৫। ইবাদতকে স্থানের সাথে নির্দিষ্ট করা

৬। ইবাদতকে সময়ের সাথে নির্দিষ্ট করা

৭। ইবাদতকে সংখ্যার সাথে নির্দষ্ট করা

৮। অত্যধিক দুর্বল, মিথ্যা ও জাল হাদীসের উপর আমল করা

৯। যে আমলটির করার প্রমান খাইরুন রুকনেও পাওয়া যায় না

১০। শরীয়তের বাহিরে সম্পূর্ণ নতুন কোন পদ্ধতি আবিস্কার করে ইবাদত করা

১১। ইসলাম বিরোধী হারাম কাজকে ইবাদত মনে করে বিদআত করা

১২। বিদআতের সম্পর্ক দ্বীনের সাথে দুনিয়ার সাথে নয়

১৩। ইবাদতের উপকরন বিদআত নয়

১৪। বিদআতে আরও কিছু নীতিমালা

১। কুরআন ও সহিহ হাদিসে আমলটির কোন দলীল নেইঃ

ইসলামি শরীয়তে ইমান-আমল, আকিদা-বিশ্বাসের কোন ব্যাপারে এখানে কোন অপূর্ণতা নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিটি আমলকে বিস্তারিতভাবে বলে দিয়েছেন নিজেও আমল করে দেখিয়েছে, যাতে পরবর্তী কেউ বলতে না পারে যে, কুরআন মোতাবেক আমল করা কঠিন। অতএব আমরা তা করতে পারব না। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমল করে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাই তো হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘তোমরা কি কুরআন পড়নি?’ সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হ্যাঁ। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের জীবন্ত নমুনা ছিলেন।’ যখনই কোনো আহকাম নাজিল হত তিনি সবার আগে এর ওপর আমল করতেন। এজন্যই কুরআন ঘোষণা দিয়েছে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম নমুনা।’ (সূরা আহযাব)  কোন আমল আদায়ের জন্য এখন আর কোন অবস্থায়ই কুরআন হাদিসের বাইরে যাবার প্রয়োজন নেই৷ কুরআন হাদিসে ইসলামি শরীয়তের প্রতিটি বিধানের সমস্ত প্রশ্নের নীতিগত বা বিস্তারিত জবাব পাওয়া যায়৷

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অসংখ্যা হাদিসে ‘কুরআন ও হাদিস’ কে আকড়ে ধরে আমর করার নির্দেশ প্রদান করছেন। তিনি বার বার গুরুত্বসহকারে বলেছেন যতদিন আমরা কুরআন হাদিস মোতাবেগ চলব ততদিন হিদায়াতে উপর থাকব।

আবূ হুরাইরা কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা অবলম্বন করলে তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ। ‘হওয’ (কাওসারে) আমার নিকট অবতরণ না করা পর্যন্ত তা বিচ্ছিন্ন হবে না। (হাকেম ৩১৯)

ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত, বিদায়ী হজ্জে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকেদের মাঝে খোতবা (ভাষণ) দিলেন। তাতে তিনি বললেন, ‘‘শয়তান এ বিষয়ে নিরাশ হয়ে গেছে যে, তোমাদের এই মাটিতে তার উপাসনা হবে। কিন্তু এতদ্ব্যতীত তোমরা যে সমস্ত কর্মসমূহকে অবজ্ঞা কর, তাতে তার আনুগত্য করা হবে, এ নিয়ে সে সন্তুষ্ট। সুতরাং তোমরা সতর্ক থেকো! অবশ্যই আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস ছেড়ে যাচ্ছি। যদি তা দৃঢ়তার সাথে  ধারণ করে থাকো তবে কখনই তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হল আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবীর সুন্নাহ। (হাকেম ৩১৮, সহীহ তারগীব ৩৬)

ইসলামি শরীয়তের প্রতিটি আমলের সুনির্দিষ্ট দলিল আছে। ইসলামি শরীয়তের মুল আমলগুলির মধ্য সালাত, সাওম, হজ্জ, যাকাত, তাবলীগ, জিহাদ, আত্মশুদ্ধি ইত্যাদি আমলের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। এই সকল আমল কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমনিত। এই আমলগুলি গুরুত্বসহকারে আদায় করলে যেমন ফজিলত বর্ণিত হয়েছে, তেমনি অবজ্ঞা বা অপহেলা করে আদায় না করলেও শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যখন দেখা যাবে আমলের পক্ষে কুরআন ও সহিহ হাদিসের কোন দলীল পাওয়া যায় না তখন মনে করতে হবে আমলটি বিদআত।

সারকথা হলো, কুরআন ও সহিহ হাদিসের বাহিরে কোন আমলই গ্রহন যোগ্য নয়। আমল থাকবে তো দলীল থাকবে, দলীল নেইতো আমলটি নির্দিধায় বিদআত।

ধরুন একজন আল্লাহ পাগল অজ্ঞ ঈমানদার ভাবল, মহান আল্লাহর ইবাদত সালাতে যে পদ্ধতিতে কপাল ও নাক মাটিতে ঠেকিয়ে সিজদাহ করা হয় তার চেয়ে যদি সম্পূর্ন মাথা ঠেকিয়ে পা সম্পূর্ণ উপরে দিয়ে সিজদা করা হয় তবে কষ্টও বেশী হবে, নেকীর পরিমানও বেশী হবে অথবা অধিক সোয়াবের আশায় প্রতি রাকআত সালাতে দুটি রুকু ও তিন চারটি সিহদাহ শুরু করল। আপনি বলুন, তার সালাত কি আদায় হবে? পৃথিবীর কোন মানুষের পক্ষে সালাতের পদ্ধতিতে সংযোজন বা বিয়োজন করার ক্ষমতা নাই। অর্থাৎ কুরআন হাদিসের বাহিরে কোন আমল করা যাবে না।

যদি কেউ কোন কাজ বা আমলকে ইসলামি শরীয়তের ইবাদত বলে প্রচার করে বা আদায় করার আহবান জানায় তবে তাকে অবশ্যই কুরআন হাদিস থেকে দলীল পেশ করতে হবে। দলীলের ভীত্তিতে আমলটি ইবাদত হবে আর দলীলের বাহিরের ইবাদতটি বিদআত হবে।

যেমনঃ একটি জমি নিয়ে দুই জনের মধ্যে বিরোধ চলতে। দুইজনেই জমিটি নিজের বলে দাবি করছে। সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমে বলা হবে, যে ব্যক্তি জমিটির সঠিক দলীল উপস্থাপণ করতে পারবে সেই জমিটির মালিক হবে। দুই জনের এক জন দলীল দেখানে পারল, অন্য জন পারলনা। যে জমির দলীল দেখা পারল, সেই জমির সঠিক মালিক আর যে জমির দলীল দেখাতে পারলনা সে কিছুতেই জমির মালিক নয়।

 

*** বিআদতী আমলের কোন দলীল নেইঃ

অনেক প্রশ্ন করে, আমলটি যে বিদআত তার দলীল দেন?

‌‌আগেই বলেছে বিদআতি আমলের কোন দলীল নেই। যারা বিদআত করে তাদের কাছে যেমন দলীল নেই। যারা বিদআত বলে, তারাও কোন দলীল দিতে পারবে না। যেমনঃ একটি সুন্দর গাড়ি বাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। অনেক খোজ খবর নিয়ে গাড়ির মালিক পাওয়া গেল না। গাড়িটি মালিকবিহীন বিধায় থানায় রাখা হল। একজন লোক এসে দাবি করল গাড়িটি আমার। থানা কর্তৃপক্ষ কি দাবি করার সাথে সাথেই গাড়িটি দিয়ে দিবে। না, দিবে না। গাড়ি প্রদানের আগে তাকে যাচাই বাচাই করা হবে যে, সত্যিই তিনি গাড়ির মালিক। থানায় গাড়ির মালিক কে গাড়ি দলীল উপস্থান করতে হবে। অর্থাৎ যেই গাড়ির মালিক দাবি করবে, তাকেই এর স্বপক্ষে দলীল প্রমান উপস্থাপণ করতে হবে। কিন্তু এক ভদ্রলোক বললেন গাড়ির মালিক আমি নই। এই গাড়ি আমার নয়। আমি জানিনা গাড়িটি কার। তা হলে থানা কর্তৃপক্ষ কি, এই ব্যাক্তির নিকট দলীল চাইবেন যে, গাড়িটি যে আপনার নয় তার দলীল দেন। যে দাবিই করেনি গাড়ি আমার, তার নিকট দলীল চাওয়া যেমন বোকামি, ঠিক তেমনিভাবে যে বলছে আমলটি বিদআত তার নিকট দলীল চাওয়াও ঠিক তেমনি বোকামি। দলীল তো চাইবে তার নিকটি যে দাবি করবে গাড়িটি আমার।

ঠিক তেমনি দলীলতো চাইতে হবে তার নিকট যে বললে আমলটি সঠিক বা শরীয়ত সম্মত। যে বলবে আমলটি বিদআত তার নিকট কোন দলীল থাকবেনা। সে এটুকু বলবে এই আমলটি ইসলামি শরীয়তের নাই। সুতারং যে আমলটি বিদআত তার কোন দলীল নেই। দলীল নাই এটাই বিদআতের দলীল।

*** ইজমা ও কিয়াস বিদআত নয় কেন?

অনেকে প্রশ্ন করে থাকে, ইসলামি শরীয়তের প্রধান চারটি উৎস হলো কুরআন, হাদিস ইজমা ও কিয়াস। শরীয়তের অনেক কাজ আছে যা কুরআন হাদিস দ্বারা প্রমানিত নয় কিন্তু ইজমা কিয়াস দ্বারা নির্ধারণ করা হয়। তাহলে ইমাজ কিয়াস করা কি বিদআত?

আসলে ইমজা ও কিয়াস করা বিদআত নয়। কারন ইজমা ও কিয়াস ইবাদতের পদ্ধতি আবিস্কার করে না। ইহা শুধু নতুন কোন বিষয়ের হালাল হারাম নির্ধারণ করে থাকে। কুরআন সুন্নাহর বাহিরে ইজমা ও কিয়াস দ্বারা ইবাদতের পদ্ধতি আবিস্কার করলে তা অবশ্যই বিদআত হবে। কোন নতুন বিষয় যুগের প্রয়োজনে আবিস্কার হয়েছে তার ব্যবহার ও প্রয়োগ কখনও হালাল আবার কখনও হারাম। যেমন, ইন্টার নেটে দ্বীন প্রচার করা। ইহাকে অনেক হারাম হলেছেন আবার অনেকে শর্ত সাপেক্ষে জায়েয বলেছেন। দুজনই কুরআন সুন্নাহর আলোক হালাল বা হারাম নির্ধারণ করেছেন। ইহাই কিয়াস, এর দ্বারা কোর কোন নতুত আমল আবিস্কার হয়নি শুধু হারাম হালাল নির্ধারণ হয়েছে মাত্র। কুনআন ও হাদিসের দলীলের ভিত্তিতেই  ইজমা কিয়াস করা হয়। এই বিষয়টি সম্পর্কে বুঝতে হলে ইজমা ও কিয়াস সম্পর্ক একটু ধারন থাকতে হবে। তাই পরবর্তী আলোচনায় বিষয় বস্তু হলো ইজমা ও কিয়াস।

***  ইজমাঃ

ইজমার শব্দটি জামউন শব্দ হতে এসেছে যার অর্থ হল সংগ্রহ, একত্রীকরণ ইত্যাদি। ইজমার শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল সন্নিবেশন করা, একত্রীত করা, জমা করা, মতৈক্যে পৌছা, একমত পোষণ করা ইত্যাদি। 

সাধারণত ইসলামি শরীয়তের কোন বিষয় মুসলিমদের মাঝো সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত বা মতৈক্য কে ইজমা বলা হয়। শরীয়াতের কোন বিষয়ে ইজমা (সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত) হতে হলে অবশ্যই একই যুগের সকল মুজতাহিদের আলেমদের কোন বিষয়ে একমত হতে হবে। এছাড়াও পরামর্শের মাধ্যমে কোন বিষয় মতৈক্য সৃষ্টি করতে ইসলাম বিশেষভাবে উৎসাহ দিয়ে থাকে। যেমন, মহান আল্লাহ বলেন,

وَشَاوِرۡهُمۡ فِى ٱلۡأَمۡرِ‌ۖ فَإِذَا عَزَمۡتَ فَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ‌ۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُتَوَكِّلِينَ (١٥٩)

অর্থঃ এবং দীনের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শে তাদেরকে (ইমানদারদের) অন্তরভুক্ত করো৷ তারপর যখন কোন মতের ভিত্তিতে তোমরা স্থির সংকল্প হবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করো৷ আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা তাঁর ওপর ভরসা করে কাজ করে৷  (ইমরান ৩:১৫৯)

 মহান আল্লাহ বলেন,

 وَٱلَّذِينَ ٱسۡتَجَابُواْ لِرَبِّہِمۡ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَمۡرُهُمۡ شُورَىٰ بَيۡنَہُمۡ وَمِمَّا رَزَقۡنَـٰهُمۡ يُنفِقُونَ (٣٨)

অর্থঃ যারা তাদের রবের নির্দেশ মেনে চলে, নামায কায়েম করে এবং নিজেদের সব কাজ পরস্পর পরামর্শের ভিত্তিতে চালায়, আমি তাদের যা রিযিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে (সুরা শুরা ৩৮)

উম্মতী মুহাম্মদ যখন পরামর্শ করে কোন বিষয় মতৈক্য স্থাপন করবে তখন তার বিরোধিতা কোন অবস্থায় করা যাবে না। আর মুসলমানদের ইজমা যে আল্লাহ পাকের কাছেও গ্রহণযোগ্যা হবে তা স্বয়ং রাসূল (সাঃ) এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহিহ হাদিসঃ ‘‘আমার উম্মত কখনও ভ্রষ্ট পথে একমত হবে না’। (মুস্তাদরাকে হাকিম (১/২০০-২০১) হাদীস নং- ৩৯৪, ৩৯৬, ৩৯৭, ৩৯৯, ৪০০। আরো দেখুন: আবুদাউদ (৪/৯৮) হাদীস নং- ৪২৫৩; তিরমিজি (৪/৪৬৬) হাদীস নং- ২১৬৭; ইবনে মাজা (২/১৩০৩) হাদীস নং- ৩৯৫০)।

শরীয়াতের দৃষ্টিতে ইজমার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কারণ যুগের পর যুগ পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিভিন্ন ধরনের সমস্যার উদ্ভব ঘটছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তার সমাধান সরাসরি কুরআন-হাদীসের সাহায্যে দেওয়া যায় না। সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুদের যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান কাল অবধী এই ধারা প্রবাহমান আছে। এমন অনেক বিষয় ছিল যা শুধু সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুদের ঐক্যমতৈর ভিত্তিতে হয়েছে। তাদের পরবর্তীতে মুজতাহিদ আলেম সমাজ বিভিন্ন ইজমা করেছেন। এর ফলে মুসলীম সমাজের নতুন নতুন সমস্যার সমাধান দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সমাধান দিতে পারে। ইজমাকে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই।

কেউ যদি সাহাবাদের ইজমাকে অস্বীকার করে তবে সে কাফির হবে আর যদি মুজতাহিদদের ইজমা অস্বীকার করে তাহলে সে কাফির না হলেও গুনাহগার হবে। ইসলামি শরীয়তে ইজমা দুই প্রকার। যথাঃ

০১। শরীয়তে বর্ণিত বিষয়ে ইজমা

০২। ইজতিহাদি বিষয়ে ইজমাঃ

**  শরীয়তে বর্ণিত বিষয়ে ইজমাঃ

ইসলামি শরীয়তের প্রধান উত্স কুরাআন ও হাদিস। এই উত্স থেকে উম্মত যা পেয়েছে এবং সকলে যার উপর আমল করছে তাতে কাহারও কোন দ্বিমত নেই তাকেই শরীয়তে বর্ণিত বিষয়ে ইজমা বলে। এই আমল ও বিশ্বাস এমন যে কোন দল বা ফির্কা এর বিরোধীতা করেনা।

যেমনঃ  সালাত পাঁচ ওয়াক্ত, হজ্জ করা ফরজ, যাকাত আদায় ফরজ, জান্নাতের জন্য ইমান আনা শর্ত, রমজানের সাওম ফরজ ইত্যাদি ইত্যাদি।  এ সকল ইমান ও আমলের ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই।

** ইজতিহাদি বিষয়ে ইজমাঃ

কুরআন-সুন্নাহ’র পরোক্ষ, অস্পষ্ট ও পরস্পর বিরোধপূর্ন জটিল কিছু বিষয়ে মুজতাহিদ আলেমগন নিজেস্ব ইজতিহাদ মোতাবেগ কিছু বায় প্রদান করছেন। এ রকম ক্ষেত্রে তাদের ইজতিহাদের মাঝে কখন মিল ছিল আবার কখন অমিল ছিল। যখন সকল মুজতাহিদের ইজতিহাদ এক ও অভিন্ন হয় তখন তাকে ইজতিহাদি বিষয়ে ইজমা বলে। কিছু ইজমা সাহাবাদের ভিতর হয়ে ছিল আর দ্বিতীয় ধরনের ইজমা সাহাবাদের পরবর্তী সময় সকল মুসলিম মুজতাহিদের ভিতর সংঘটিত হয় ছিল এবং বর্তমানে এ ধারা চলমান আছে।

যেমনঃ

ইজতিহাদি বিষয়ে ইজমা আবার দুই প্রকার যথাঃ

১। ইজমাউস সাহাবা 

২। ইজমাউস উম্মত

** ইজমাউস সাহাবাঃ

সাহাবীদের দ্বারা প্রমানি ইজমা কর ইজমাউস সাহাবা বলে। এই ইজমা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর যুগেও হতে পারে, তার পরের যুগেও হতে পারে। তবে ইজমাউস সাহাবরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর  ওফাতের পরে হয়েছে। সকল সাহাবীদের ঐক্যমত পোষণ করাকে ইজমাউস সাহাবা বলা হয়।

যেমনঃ হযরত আবূ বকর (রাঃ)কে খলীফা হিসেবে নির্বাচিত করা, তার সময় কুরআন সংকলিত হওয়া, তার সময় ভণ্ড নবীদের বিরুদ্বে যুদ্ব করা, উমর (রাঃ) এর খিলাফতকালে তারাবীর নামায জামায়াতের সাথে আদায় করা,  উসমান (রাঃ) এর খিলাফত আমলে কুরআনকে নতুনভাবে সাজানো।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রাঃ) এর খিলাফতকালে যখন বিভিন্ন রাজ্য মুসলিমদের হাতে জয়ী হতে থাকে এবং বিজিত দেশে বিভিন্ন ধরনের আইন চালু ছিল। ইসমালি আইনের সাথে এই নতুন নতুন আইনের সংমিশ্রন ঘটতে থাকে, যার ভিতর কোনটা গ্রহণ করা হবে আর কোনটা হবে না তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়।

এসময় মুসলিম আইনবিদগণ ইজামার মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলামী আইন বাস্তবায়নে এক বিশেষভূমিকা পালন করে। তিনি তার শাসনাধীন অঞ্চলগুল ভাগ করে একটি কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন যা বিশালাকার ইসলামী সাম্রাজ্যকে পরিচালনায় সহায়ক হন। তিনি সাহাবিদের দিয়ে মজলীসে শুরা গঠন করে যাদের ইজতিহাদের দ্বারা ইসলামী সাম্রাজ্যকে পরিচালনা করতেন। প্রশাষণকে ভাগ করেন, পুলীশ বাহিলী, গোযেন্দা বাহিনি, জনপ্রশাষণ গঠন করেন।

হযরত উসমান ইবনু আফ্ফান রাদিয়াল্লাহ আনহু খলীফা নিযুক্ত হওয়ার পর কতগুলি ইজতিহাদ করেন তা পালনের হুকুম দেন। যেমনঃ কুরআন সংকলন করেন, জুমআর দ্বিতীয় আজান বৃদ্ধি করেন, হজ্জের সময় মিনায় সালাত সংক্ষিপ্ত না করা।

এভাবেই সাহাবি রাদিয়াল্লাহ আনহুদের জ্ঞান ও গবেষনার কারণে কুরআন ও হাদিসের আহকাম সম্পর্কিত বিধানগুলর পাশাপাশি সাহাবিদের মতামত থেকেও মুসলিম সমাজ উপকৃত হল। ইমলামি শরীয়তের হুকুম আহকার আহরণের পদ্ধতি সম্পর্কিত আলোচনা ব্যাপকতর হলো। সেগুলো পরবর্তী যুগের আলেমদের নিকট পৌঁছে গেলো এবং পরবর্তী কালের আলেম সমাজ কুরআন হাদিসের পাশাপাশি সাহাবি  ইজতিহাদ ও ইজতিহাদ করার পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে কোন কোন সমস্যা খলীফা ও সাহাবা রাদিয়াল্লাহ আনহদের পরামর্শ ক্রমে সমাধান হত আর এটাই ছিল সাহাবিদের সম্মিলিত মত যাকে আমরা শরীয়তের তৃতীয় উৎস হিসেবে ‘ইজমাউস সাহাবা’ বল থাকি।

*** ইজমাউস উম্মতঃ

উম্মতের মুজতাহিদ আলেমদের বিভিন্ন ইজতিহাদের মাঝে যখন ইজমার সৃষ্টি হয় তখন তাকে ইজমাউস উম্মত হিসাবে ধরা হয়।

যেমনঃ এক সময় সুদ সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা আইন বিভিন্ন ধরনের পণ্যের অসামাঞ্জস্যকর বিনিময় বাণ্যিজ্যের উপর জারী হত। যেমনঃ স্বর্ণ, রৌপ্য, গম, বার্লি, খেজুর ও কিসমিস। শাফী ও হাম্বলী মাযহাবের মতে তা সকল অসামঞ্জস্যকর বদল বাণিজ্যের উপর আরোপ করা যায়, মালিকীগণ মনে করতেন তা কেবলমাত্র গুদামজাত পণ্যের উপর আরোপ করা যায় আর হানাফীগণ মনে করতেন যে, যেসকল পণ্য কেবল ওজন করা যায় তার উপর সে ধরনের আইন প্রয়োগ করা যায়। এমতাবস্থায় সকলের ভিতর বিভ্রান্ত সৃষ্টি হলে তারা একটি বিষয় ঐক্যমতে পৌছে যে, সুদের আইন কেবলমাত্র গুদামজাত খাদ্যদ্রব্যের অসামঞ্জস্য বিনিময় বাণিজ্যে প্রযোজ্য হবে। এট হল ইজমাউস মুজতাহিদ এর উদাহরণ।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment