আমাদের সালাফগণ ও চার ইমাম কিভাবে সবর করেছেন

আমাদের সালাফগণ ও চার ইমাম কিভাবে সবর করেছেন

সালাফ একটি আবরি শব্দ যার অর্থ অতীত, বিগত, পূর্ববর্তী। সালেহীন এ একটি আরবি শব্দ যার অর্থ সৎলোক, ভাল মানুষ, যোগ্য লোক, নেকলোক।আর মানহাজ ও আরবি শব্দ যার অর্থ পথ, পন্থা, পদ্ধতি, প্রণালী, রাস্তা, প্রোগ্রাম, কার্যক্রম, পাঠক্রম, সিলেবাস, কারিকুলাম। সুতরাং সলফে সালেহীন অর্থ হল অতীতের বা পূর্ববর্তী নেকলোকগণ বা সৎবান্দাগণ। সুতরাং সলফে সোলেহীনের মানহাজ মানে হল, পূর্ববর্তী সৎলোকগণ যে পথ, পন্থা, পদ্ধতি, নীতি অনুসরণ করেছিল তাই হল সালাফে সালেহীনের মানহাজ। যাকে সংক্ষেপে সালাফ মানহাজ বলা হয়। আর যারা এই সব পূর্ববর্তী নেকলোক বা সৎলোকদের অনুসরণ করে থাকে তাদেরকে সালাফী বলা হয়।

কুরআনের আয়াতে سَلَف (সালাফ) অর্থ অতীত, বিগতঃ যেমন, মহান আল্লাহ বলেন,

*فَجَعَلْنَاهُمْ سَلَفًا وَمَثَلا لِلآخِرِينَ*

অর্থঃ অতঃপর পরবর্তীদের জন্য আমি তাদেরকে করে রাখলাম অতীত ইতিহাস ও দৃষ্টান্ত। [যুখরুফ, ৪৩:৫৬]

সালাফে সালেহীন কারা?

সালাফে সালেহীন বলতে বুঝায় প্রথম তিন স্বর্ণযুগের লোকদেরকে, তথা; সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীন এবং আমাদের সম্মানিত হেদায়াতপ্রাপ্ত ইমামগণ। সুতরাং পরবর্তীতে তাদের অনুসরণকারী এবং তাঁদের পথ অবলম্বনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে তাঁদের প্রতি সম্বোধন করতঃ সালাফী বলা হয়। (তথ্যসূত্রঃ বই: ওয়াহীর জ্ঞান,তাওহীদ পাবলিকেশন্স)

সুতারং আমি সাহাবি, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী ও হেদায়াতপ্রাপ্ত ইমামদের  কয়েকটি ঘটনা শুধু তুলে ধরব যাতে সবর অর্জন সহজ হয়। তাদের সকলের সবরের ঘটানা লিখনে শতাধীর খন্ডের কিতাব হবে। শুধু বুঝার জন্য সহিহ সনদের হাদিস ও সালাফদের জীবনি থেকে কয়েকটি উদাহরণ।

ইসলামের প্রথমিক যুগে সাহাবিগনের সবরঃ

ইসলামের প্রথমিক যুগে সাহাবিগন শুধু মুসলিম হবার কারণে যারা অমানসিক নির্যাতন ও নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে।

১। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অবশ্যই আল্লাহ্‌র পথে আমাকে যতটা নির্যাতন করা হয়েছে, অপর কাউকে সেরূপ নির্যাতন করা হয়নি এবং আমাকে আল্লাহ্‌র পথে যতটা ভীত-সন্ত্রস্ত করা হয়েছে, অপর কাউকে সেরূপ ভীত-সন্ত্রস্ত করা হয়নি। আমার ও বিলালের উপর দিয়ে তিন তিনটি রাত এমনভাবে অতিবাহিত হয়েছে যে, বিলালের বগলের নিচে দাবিয়ে রাখা সামান্য খাদ্য ছাড়া এমন কোন খাদ্য ছিল না যা কোন প্রাণী খেতে পারে। ( হাদিসের মান সহিহ তিরমিযী ২৪৭২ তাহক্বীক্ব আলবানী: সহীহ। তাখরীজ আলবানী: মিশকাত ৫২৫৩, সহীহাহ ২২২২)। 

২। আল-হুমায়দী (রহঃ) … খাব্বাব (রাঃ) বলেন, আমি (একবার) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে হাযির হলাম। তখন তিনি তাঁর নিজের চাদরকে বালিশ বানিয়ে কাবা গৃহের ছায়ায় বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন। (যেহেতু) আমরা মুশরিকদের পক্ষ থেকে কঠিন নির্যাতন ভোগ করছিলাম। তাই আমি বললাম, আপনি কি (আমাদের শান্তি ও নিরাপত্তার) জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন না? তখন তিনি উঠে বসলেন এবং তাঁর চেহারা রক্তিম বর্ণ হয়ে গেল। তখন তিনি বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী ঈমানদারদের মধ্যে কারো কারো শরীরের হাড় পর্যন্ত সমস্ত গোশত ও শিরা উপশিরাগুলি লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়ে বের করে ফেলা হত। কিন্তু এসব নির্যাতনও তাদেরকে দ্বীন থেকে বিমুখ করতে পারত না। তাঁদের মধ্যে কারো মাথার মধ্যবর্তী স্থানে করাত স্থাপন করে তাকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলা হত। কিন্তু এ নির্যাতনও তাঁদেরকে তাঁদের দ্বীন থেকে ফিরাতে পারতনা। আল্লাহর কসম, আল্লাহ্ তা’আলা অবশ্যই দ্বীনকে পরিপূর্ণ করবেন, ফলে একজন উষ্ট্রারোহী সান’আ (শহর) থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে সে ভয় করবে না। রাবী (রহঃ) আরো অতিরিক্ত বর্ণনা করেন এবং তার মেষ পালেন উপর নেকড়ে বাঘের আক্রমণে সে ভয় করবে না। (সহিহ বুখারি ইঃফাঃ ৩৫৭৩)।

৩। বিলাল (রাঃ) উমাইয়াহ বিন খালাফের ক্রীতদাস ছিলেন। বিলাল (রাঃ) ইসলাম কবূল করলে এই ইসলামের ঘোর শত্রু তা মেনে নিতে পারলো না। ফলে তাকে অসহনীয় নির্যাতন স্বীকার করতে হয় এমনকি দুপুর রোদের উত্তপ্ত বালুর উপর শুইয়ে বুকের উপর বিশাল আকৃতির পাথর চাপা দিয়ে তাকে ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করতে চেয়েছিল কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাকে ধৈর্য প্রদান করেছিলেন এবং তিনি ইসলাম ত্যাগ করেননি। অতঃপর আবূ বাক্র (রাঃ) তাকে ক্রয় করে আযাদ করে দিয়েছিলেন। বাদর যুদ্ধে উমাইয়াহ ও তার পুত্র নিহত হওয়ার কথা শুনে বিলাল (রাঃ)তার অভিব্যক্তি বর্ণনা যে বর্ণনা দিয়েছেন তা ছিল নিম্মরূপঃ

 ‘আবদুর রাহমান ইবনু ‘আওফ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উমাইয়াহ ইবনু খালফে্র সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলাম। বাদর যুদ্ধের দিন তিনি ‘উমাইয়াহ ইবনু খালাফ ও তার পুত্রের নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করলে বিলাল (রাঃ) বললেন, যদি ‘উমাইয়াহ ইবনু খালাফ প্রাণে বেঁচে যেত তাহলে আমি সফল হতাম না। সহিহ বুখারি হাদিস নং আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৬৭৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৬৮২)।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুতে ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা শোক প্রকাশঃ

আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশী অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং তাকে কষ্ট ঘিরে ফেলল, তখন (তাঁর কন্যা) ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেন, ‘হায়!! আব্বাজানের কষ্ট! তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা শুনে বললেন, ‘‘আজকের দিনের পর তোমার পিতার কোনো কষ্ট হবে না।’’ অতঃপর যখন তিনি মারা গেলেন, তখন ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেন, ‘হায় আব্বাজান! প্রভু যখন তাঁকে আহ্বান করলেন, তখন তিনি তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন। হায় আব্বাজান! জান্নাতুল ফিরদাউস তাঁর বাসস্থান। হায় আব্বাজান! আমরা জিবরীলকে আপনার মৃত্যু-সংবাদ দেব।’ অতঃপর যখন তাঁকে সমাধিস্থ করা হল, তখন ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা (সাহাবাদেরকে) বললেন, ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর মাটি ফেলতে কি তোমাদেরকে ভাল লাগল? (সহীহ বুখারী ৪৪৬২, নাসায়ী ১৮৪৪, ইবনু মাজাহ ১৬২৯, ১৬৩০, আহমাদ ১২০২৬, ১২৬১৯, ১২৭০৪, দারেমী ৮৭; রিয়াযুস স্বালেহীন ২/২৯)।

মৃত্যুর জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শোক প্রকাশঃ

আবূ যায়েদ উসামাহ ইবনু যাইদ ইবনু হারেসাহ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্বাধীনকৃত দাস এবং তাঁর প্রিয়পাত্র তথা প্রিয় পাত্রের পুত্র থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কন্যা তাঁর নিকট সংবাদ পাঠালেন যে, ‘আমার ছেলের মর মর অবস্থা, তাই আপনি আমাদের এখানে আসুন।’ ‘তিনি সালাম দিয়ে সংবাদ পাঠালেন যে, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা যা নিয়েছেন, তা তাঁরই এবং যা দিয়েছেন তাও তাঁরই। আর তাঁর কাছে প্রতিটি জিনিসের এক নির্দিষ্ট সময় আছে।” অতএব সে যেন ধৈর্য ধারণ করে এবং সওয়াবের আশা রাখে।’ রাসূল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কন্যা পুনরায় কসম দিয়ে বলে পাঠালেন যে, তিনি যেন অবশ্যই আসেন। ফলে তিনি সা‘দ ইবনু ‘উবাদাহ, মু‘আয ইবনু জাবাল, উবাই ইবনু কা‘ব, যাইদ ইবনু সাবেত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এবং আরো কিছু লোকের সঙ্গে সেখানে গেলেন। শিশুটিকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তুলে দেওয়া হল। তিনি তাকে নিজ কোলে বসালেন। সে সময় তার প্রাণ ধুকধুক্ করছিল। (তার এই অবস্থা দেখে) তাঁর চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। সা‘দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! একি?’ তিনি বললেন, ‘‘এ হচ্ছে দয়া, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের অন্তরে রেখে দিয়েছেন।’’

অন্য একটি বর্ণনায় আছে, ‘‘যে সব বান্দার অন্তরে তিনি চান তাদের অন্তরে রেখে দিয়েছেন। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে কেবল মাত্র দয়ালুদের প্রতই দয়া করেন।’’ (সহীহুল বুখারী ১২৮৪, ৫৬৫৫, ৬৬০২, ৬৬৫৫, ৭৩৭৭, ৭৪৪৮, মুসলিম ৯২৩, নাসায়ী ১৮৬৮, আবূ দাউদ ৩১২৫, আহমাদ ২১২৬৯, ২১২৮২, ২১২৯২; রিয়াযুস স্বালেহীন ২/২৯)।

উম্মে সুলাইম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার সবর ধারনের দৃষ্টান্তঃ

আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবূ ত্বালহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর এক ছেলে অসুস্থ ছিল। আবূ ত্বালহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন কোন কাজে বাইরে চলে গেলেন তখন ছেলেটি মারা গেল। যখন তিনি বাড়ি ফিরে এলেন তখন জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‘আমার ছেলে কেমন আছে?’ ছেলেটির মা উম্মে সুলাইম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহ বললেন, ‘সে পূর্বের চেয়ে আরামে আছে।’ অতঃপর তিনি তাঁর সামনে রাতের খাবার হাজির করলেন। তিনি তা খেলেন। অতঃপর তার সঙ্গে যৌন-মিলন করলেন। আবূ ত্বালহা যখন এসব থেকে অবকাশপ্রাপ্ত হলেন, তখন স্ত্রী বললেন যে, ‘(আপনার বাইরে চলে যাওয়ার পর শিশুটি মারা গেছে।) সুতরাং শিশুটিকে এখন দাফন করুন।’ সকাল হলে আবূ ত্বালহা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমতে হাজির হয়ে সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন যে, ‘‘তোমরা কি আজ রাতে মিলন করেছ?’’ তিনি বললেন, ‘জী হ্যাঁ।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘হে আল্লাহ! তুমি এ দুজনের জন্য বরকত দাও?’’ অতএব (তাঁর দো‘আর ফলে নির্দিষ্ট সময়ে উম্মে সুলাইম) একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। (আনাস বলেন,) আমাকে আবূ ত্বালহা বললেন, ‘তুমি একে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে নিয়ে যাও।’ আর তার সঙ্গে কিছু খেজুরও পাঠালেন। তিনি বললেন, ‘তার সঙ্গে কি কিছু আছে?’ আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, ‘জী হ্যাঁ! কিছু খেজুর আছে।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলো নিলেন এবং তা চিবালেন। অতঃপর তাঁর মুখ থেকে বের করে শিশুটির মুখে রেখে দিলেন। আর তার নাম ‘আব্দুল্লাহ’ রাখলেন। (বুখারী-মুসলিম)

বুখারীর আর এক বর্ণনায় আছে, ইবনু উয়াইনাহ বলেন যে, জনৈক আনসারী বলেছেন, ‘আমি এই আব্দুল্লাহর নয়টি ছেলে দেখেছি, তারা সকলেই কুরআনের হাফেয ছিলেন।’

মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে যে, আবূ ত্বালহার একটি ছেলে, যে উম্মে সুলাইমের গর্ভ থেকে হয়েছিল, সে মারা গেল। সুতরাং তিনি (উম্মে সুলাইম) তাঁর বাড়ির লোককে বললেন, ‘তোমরা আবূ ত্বালহাকে তাঁর পুত্রের ব্যাপারে কিছু বলো না। আমি স্বয়ং তাঁকে এ কথা বলব।’ সুতরাং তিনি এলেন এবং (স্ত্রী তাঁর সামনে রাতের খাবার রাখলেন। তিনি পানাহার করলেন। এ দিকে স্ত্রী আগের তুলনায় বেশী সাজসজ্জা করে তাঁর কাছে এলেন এবং তিনি তাঁর সঙ্গে মিলন করলেন। অতঃপর তিনি যখন দেখলেন যে, তিনি (স্বামী) খুবই পরিতৃপ্ত হয়ে গেছেন এবং যৌন-সম্ভোগ করে নিয়েছেন, তখন বললেন, ‘হে আবূ ত্বালহা! আচ্ছা আপনি বলুন! যদি কোন সম্প্রদায় কোন পরিবারকে কোন জিনিস (সাময়িকভাবে) ধার দেয়, অতঃপর তারা তাদের ধার দেওয়া জিনিস ফিরিয়ে নিতে চায়, তাহলে কি তাদের জন্য তা না দেওয়ার অধিকার আছে?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘না।’ অতঃপর স্ত্রী বললেন, ‘আপনি নিজ পুত্রের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে প্রতিদান পাওয়ার আশা রাখুন। (অর্থাৎ আপনার পুত্রও আল্লাহর দেওয়া আমানত ছিল, তিনি তাঁর আমানত ফিরিয়ে নিয়েছেন।)’

আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, (এ কথা শুনে) তিনি রাগান্বিত হলেন। অতঃপর তিনি বললেন, ‘তুমি আমাকে কিছু না বলে এমনি ছেড়ে রাখলে, অবশেষে আমি সহবাস করে যখন অপবিত্র হয়ে গেলাম, তখন তুমি আমার ছেলের মৃত্যুর সংবাদ দিলে!’ এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমতে হাজির হয়ে যা কিছু ঘটেছে তা বর্ণনা করলেন। তা শুনে তিনি দো‘আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! তাদের দু’জনের জন্য এই রাতে বরকত দাও।’ সুতরাং (এই দো‘আর ফলে) তিনি গর্ভবতী হলেন।

আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফরে ছিলেন। উম্মে সুলাইম ও (তাঁর স্বামী আবূ ত্বালহা) তাঁর সঙ্গে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অভ্যাস ছিল যে, যখন তিনি সফর থেকে মদ্বীনায় আসতেন তখন তিনি রাতে আসতেন না। যখন এই কাফেলা মদ্বীনার নিকটবর্তী হল, তখন উম্মে সুলাইমের প্রসব-বেদনা উঠল। সুতরাং আবূ ত্বালহা তাঁর খিদমতের জন্য থেমে গেলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মদ্বীনায়) চলে গেলেন।’ আনাস বলেন, ‘আবূ ত্বালহা বললেন, ‘‘হে প্রভু! তুমি জান যে, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদ্বীনা থেকে বাইরে যান, তখন আমি তাঁর সঙ্গে যেতে ভালবাসি এবং তিনি মদ্বীনায় প্রবেশ করেন, তখন আমি তাঁর সঙ্গে প্রবেশ করতে ভালবাসি এবং তুমি দেখছ যে, (আমার স্ত্রীর) জন্য আমি থেমে গেলাম।’’

উম্মে সুলাইম বললেন, ‘হে আবূ ত্বালহা! আমি পূর্বে যে বেদনা অনুভব করছিলাম এখন তা অনুভব করছি না, তাই চলুন।’ সুতরাং আমরা সেখান থেকে চলতে আরম্ভ করলাম। যখন তাঁরা দু’জনে মদ্বীনা পৌঁছলেন, তখন আবার প্রসব বেদনা শুরু হল। অবশেষে তিনি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। আমার মা আমাকে বললেন, ‘যে পর্যন্ত তুমি একে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমতে না নিয়ে যাবে, সে পর্যন্ত কেউ যেন একে দুধ পান না করায়।’ ফলে আমি সকাল হতেই তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমত নিয়ে গেলাম। অতঃপর আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বাকী হাদীস বর্ণনা করলেন। সহীহুল বুখারী ১৩০১, ১৫০২, ৫৪৭০, ৫৫৪২, ৫৮২৪, মুসলিম ২১১৯, ২১৪৪, আবূ দাউদ ২৫৬৩, ৪৯৫১, আহমাদ ১১৬১৭, ১২৩৩৯, ১২৩৮৪, ১২৪৫৪, ১২৫৪৬;রিয়াযুস স্বালেহীন২০/৪৫।

উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর সবর করার ঘটনাঃ

ইবনু আব্বাস বর্ণনা করেন যে, উয়াইনাহ ইবনু হিসন এলেন এবং তাঁর ভাতিজা হুর্র ইবনু কাইসের কাছে অবস্থান করলেন। এই (হুর্র) উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর খেলাফত কালে ঐ লোকগুলির মধ্যে একজন ছিলেন যাদেরকে তিনি তাঁর নিকটে রাখতেন।

আর কুরআন বিশারদগণ বয়স্ক হন অথবা যুবক দল তাঁরা উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর সভাষদ ও পরামর্শদাতা ছিলেন। উয়াইনাহ তাঁর ভাতিজাকে বললেন, ‘হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র! এই খলীফার কাছে তোমার বিশেষ সম্মান রয়েছে। তাই তুমি আমার জন্যে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি চাও।’ ফলে তিনি অনুমতি চাইলেন। সুতরাং উমার তাকে অনুমতি দিলেন। অতঃপর যখন উয়াইনাহ ভিতরে প্রবেশ করলেন, তখন উমার (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)কে বললেন, ‘হে ইবনু খাত্ত্বাব! আল্লাহর কসম! আপনি আমাদেরকে পর্যাপ্ত দান দেন না এবং আমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করেন না!’

(এ কথা শুনে) উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাগান্বিত হলেন। এমনকি তাকে মারতে উদ্যত হলেন। তখন হুর্র তাঁকে বললেন, ‘হে আমীরুল মু’মেনীন! আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীকে বলেন, ‘‘তুমি ক্ষমাশীলতার পথ অবলম্বন কর। ভাল কাজের আদেশ প্রদান কর এবং মূর্খদিগকে পরিহার করে চল।’’ সূরা আল আরাফ ১৯৮ আয়াত) আর এ এক মূর্খ।’ আল্লাহর কসম! যখন তিনি (হুর্র) এই আয়াত পাঠ করলেন, তখন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একটুকুও আগে বাড়লেন না। আর তিনি আল্লাহর কিতাবের কাছে (অর্থাৎ তাঁর নির্দেশ শুনে) সত্বর থেমে যেতেন। (সহীহুল বুখারী ৪৬৪২, ৭২৮৬)।

 

আঘাতের শুরুতে সবর করাটাই হল প্রকৃত সবরঃ

আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি মহিলার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। সে একটি কবরের পাশে বসে কাঁদছিল। তিনি বললেন, ‘‘তুমি আল্লাহকে ভয় কর এবং ধৈর্য ধারণ কর।’’ সে বলল, ‘আপনি আমার নিকট হতে দূরে সরে যান। কারণ, আমি যে বিপদে পড়েছি আপনি তাতে পড়েননি।’ সে তাঁকে চিনতে পারেনি (তাই সে চরম শোকে তাঁকে অসঙ্গত কথা বলে ফেলল)। অতঃপর তাকে বলা হল যে, ‘তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন।’ সুতরাং (এ কথা শুনে) সে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুয়ারের কাছে এল। সেখানে সে দারোয়ানদেরকে পেল না। অতঃপর সে (সরাসরি প্রবেশ করে) বলল, ‘আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।’ তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘আঘাতের শুরুতে সবর করাটাই হল প্রকৃত সবর।’’ (সহীঃ বুখারী ১২৫২, ১২৮৩, ১৩০২, ৭১৫৪, সহিহ মুসলিম ৯২৬, তিরমিযী ৯৮৮, নাসায়ী ১৮৬৯, আবূ দাউদ ৩১২৪, ইবনু মাজাহ ১৫৯৬, আহমাদ ১১৯০৮, ১২০৪৯, ১২৮৬০; রিয়াযুস স্বালেহীন)। মুসলিমের একটি বর্ণনায় আছে, সে (মহিলাটি) তার মৃত শিশুর জন্য কাঁদছিল।

আনাস ইবন মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’প্রকৃত সবর হচ্ছে বিপদের প্রথম অবস্থাতেই সবর করা’। (সহিহ বুখারী ১২৮৩, ১৩০২, ৭১৫৪; সহিহ মুসলিম ১৫৩৪, ১৫৩৫; তিরমিযি ৯৮৮; নাসায়ী ১৮৬৯; আবু দাউদ ৩১২৪; ইবন মাযাহ ১৫৯৬; রিয়াদুস সালিহীন ৩২)।

ইয়াসির পরিবার উপর অকথ্য নির্জাতন ও তাদের সবরঃ

ইয়ামন থেকে মক্কায় হিজরতকারী এই পরিবার মক্কার বনু মাখযূমের সাথে চুক্তিবদ্ধ মিত্র (حَلِيفٌ) ছিল। পরিবার প্রধান ইয়াসির বিন মালিক এবং তার স্ত্রী সুমাইয়া ও পুত্র ‘আম্মার সকলে মুসলমান হন। ফলে তাদের উপরে যে ধরনের অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। বনু মাখযূম নেতা আবু জাহ্লের নির্দেশে তাদেরকে খোলা ময়দানে নিয়ে উত্তপ্ত বালুকার উপরে শুইয়ে রেখে প্রতিদিন নানাভাবে নির্যাতন করা হ’ত। একদিন চলার পথে তাদের শাস্তির দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, صَبْرًا آلَ يَاسِر فَإِنَّ مَوْعِدَكُمُ الْجَنَّةُ ‘ধৈর্য ধর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা হ’ল জান্নাত’। অবশেষে ইয়াসিরকে কঠিন নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।(ইবনু হিশাম ১/৩১৯-২০; হাকেম হা/৫৬৪৬; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ ১০৩ পৃঃ, সনদ ছহীহ; ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৩৮৪৬; আল-ইছাবাহ, ইয়াসির ‘আনাসী ক্রমিক ৯২১৪; আল-ইস্তী‘আব ক্রমিক ২৮২২)।

অতঃপর পাষাণহৃদয় আবু জাহ্ল নিজ হাতে ইয়াসিরের বৃদ্ধা স্ত্রী সুমাইয়ার গুপ্তাঙ্গে বর্শা বিদ্ধ করে তাকে হত্যা করে। তিনিই ছিলেন ইসলামে প্রথম মহিলা শহীদ। (আল-ইছাবাহ, সুমাইয়া, ক্রমিক ১১৩৩৬)।

অতঃপর তাদের পুত্র ‘আম্মারের উপরে শুরু হয় নির্যাতনের পালা। তাকেও বেলালের ন্যায় কঠিন নির্যাতন করা হয় যতক্ষণ না সে রাসূল (ছাঃ)-কে গালি দিতে রাযী হয়। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি তাদের কথা মেনে নেন। পরে মুক্তি পেয়েই তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন كََيْفَ تَجِدُ قَلْبَكَ؟ ‘ঐ সময় তোমার অন্তর কিরূপ ছিল’? তিনি বললেন, مُطْمَئِنًّا بِالْإِيْمَانِ ‘ঈমানের উপর অবিচল’। রাসূল (ছাঃ) বললেন إِنْ عَادُوا فَعُدْ ‘যদি ওরা আবার বলতে বলে, তাহ’লে তুমি আবার বল’। তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়,

مَنْ كَفَرَ بِاللهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلاَّ مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ

‘ঈমান আনার পরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কুফরী করে, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ক্রোধ এবং কঠিন শাস্তি। কিন্তু যাকে বাধ্য করা হয়, অথচ তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে (তার কোন চিন্তা নেই)’ (নাহল ১৬/১০৬)। ইবনু কাছীর বলেন, সকল বিদ্বান এ বিষয়ে একমত যে, কুফরীতে বাধ্য করা হ’লে বাধ্যকারীর কথামত কাজ করা জায়েয (ইবনু কাছীর)। একমাত্র বেলাল ছিলেন, যিনি তাদের কথা মত কাজ করতেন না, বরং কেবলি বলতেন আহাদ, আহাদ। (হাকেম হা/৩৩৬২, ২/৩৫৭ পৃঃ সনদ ছহীহ; কুরতুবী হা/৩৯৫৫; বায়হাক্বী হা/১৭৩৫০, ৮/২০৮-০৯ পৃঃ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নাহল ১০৬ আয়াত)।

পরে হযরত আবুবকর (রাঃ) ‘আম্মার বিন ইয়াসিরকে তার মনিবের কাছ থেকে খরীদ করে মুক্ত করে দেন। ‘আম্মার ঐ সময় আবুবকর (রাঃ)-এর প্রশংসায় যে কবিতা বলেন, তার শুরু ছিল নিম্নরূপঃ

جَزَى اللهُ خَيْرًا عَنْ بَلاَلٍ وَصَحْبِهِ + عَتِيْقًا وَأَخْزَى فَاكِهًا وَأَبَا جَهْلِ

‘আল্লাহ উত্তম পুরস্কার দান করুন আবুবকর (রাঃ)-কে বেলাল ও তার সাথীদের পক্ষ হ’তে এবং লাঞ্ছিত করুন আবু ফাকীহাহ (উমাইয়া বিন খালাফ) ও আবু জাহ্লকে’। (আবু নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া ১/১৪৮; তানতাভী, তাফসীর সূরা লায়েল ১৯-২০ আয়াত, ১৩/২০৪ পৃঃ)।

‘আম্মার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন, যে ব্যক্তি ‘আম্মারের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে আল্লাহ তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন’। খালিদ বিন অলীদ (রাঃ) বলেন, এই হাদীছ শোনার পর থেকে আমি সর্বদা তাকে ভালোবাসতাম’। (হাকেম হা/৫৬৭৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৩৮৬)।

আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ভন্ডনবীদের বিরুদ্ধে ইয়ামামাহ্র যুদ্ধে তার কান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওমর (রাঃ) তাকে কূফার গবর্ণর নিযুক্ত করেন। রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, تَقْتُلُهُ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ ‘তাকে বিদ্রোহী দল হত্যা করবে’ (বুখারী হা/৪৪৭)। ৩৭ হিজরীতে ছিফফীনের যুদ্ধে তিনি আলী (রাঃ)-এর পক্ষে যোগদান করেন এবং শহীদ হন। এসময় তাঁর বয়স ছিল ৯৩ বছর। আলী (রাঃ) তাঁকে গোসল ও কাফন না দিয়েই দাফন করেন।(আল-ইছাবাহ, ‘আম্মার ক্রমিক ৫৭০৮; আল-ইস্তী‘আব ক্রমিক ১৮৬৩)।

পূর্বের যুগের এক বিশ্বয়কর বালক ও তার জাতীর লোকদের সবরের কাহিনীঃ

সুহাইব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমাদের পূর্ব যুগে একজন বাদশাহ ছিল এবং তাঁর (উপদেষ্টা) এক জাদুকর ছিল। জাদুকর বার্ধক্যে উপনীত হলে বাদশাহকে বলল যে, ‘আমি বৃদ্ধ হয়ে গেলাম তাই আপনি আমার নিকট একটি বালক পাঠিয়ে দিন, যাতে আমি তাকে জাদু-বিদ্যা শিক্ষা দিতে পারি।’ ফলে বাদশাহ তার কাছে একটি বালক পাঠাতে আরম্ভ করল, যাকে সে জাদু শিক্ষা দিত। তার যাতায়াত পথে এক পাদ্রী বাস করত। যখনই বালকটি জাদুকরের কাছে যেত, তখনই পাদ্রীর নিকটে কিছুক্ষণের জন্য বসত, তাঁর কথা তাকে ভাল লাগত। ফলে সে যখনই জাদুকরের নিকট যেত, তখনই যাওয়ার সময় সে পাদ্রীর কাছে বসত। যখন সে পাদ্রীর কাছে আসত জাদুকর তাকে (তার বিলম্বের কারণে) মারত। ফলে সে পাদ্রীর নিকটে এর অভিযোগ করল। পাদ্রী বলল, ‘যখন তোমার ভয় হবে যে, জাদুকর তোমাকে মারধর করবে, তখন তুমি বলবে, আমার বাড়ির লোক আমাকে (কোন কাজে) আটকে দিয়েছিল। আর যখন বাড়ির লোকে মারবে বলে আশঙ্কা হবে, তখন তুমি বলবে যে, জাদুকর আমাকে (কোন কাজে) আটকে দিয়েছিল।’

সুতরাং সে এভাবেই দিনপাত করতে থাকল। একদিন বালকটি তার চলার পথে একটি বিরাট (হিংস্র) জন্তু দেখতে পেল। ঐ (জন্তু)টি লোকের পথ অবরোধ করে রেখেছিল। বালকটি (মনে মনে) বলল, ‘আজ আমি জানতে পারব যে, জাদুকর শ্রেষ্ঠ না পাদ্রী?’ অতঃপর সে একটি পাথর নিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ! যদি পাদ্রীর বিষয়টি তোমার নিকটে জাদুকরের বিষয় থেকে পছন্দনীয় হয়, তাহলে তুমি এই পাথর দ্বারা এই জন্তুটিকে মেরে ফেল। যাতে (রাস্তা নিরাপদ হয়) এবং লোকেরা চলাফিরা করতে পারে।’ (এই দো‘আ করে) সে জন্তুটাকে পাথর ছুঁড়ল এবং তাকে হত্যা করে দিল। এর পর লোকেরা চলাফিরা করতে লাগল। বালকটি পাদ্রীর নিকটে এসে ঘটনাটি বর্ণনা করল। পাদ্রী তাকে বলল, ‘বৎস! তুমি আজ আমার চেয়ে উত্তম। তোমার (ঈমান ও একীনের) ব্যাপার দেখে আমি অনুভব করছি যে, শীঘ্রই তোমাকে পরীক্ষায় ফেলা হবে। সুতরাং যখন তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হবে, তখন তুমি আমার রহস্য প্রকাশ করে দিও না।’

আর বালকটি (আল্লাহর ইচ্ছায়) জন্মান্ধত্ব ও কুষ্ঠরোগ ভাল করত এবং অন্যান্য সমস্ত রোগের চিকিৎসা করত। (এমতাবস্থায়) বাদশাহর জনৈক নিকটী অন্ধ হয়ে গেল। যখন সে বালকটির কথা শুনল, তখন প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে তার কাছে এল এবং তাকে বলল যে, ‘তুমি যদি আমাকে ভাল করতে পার, তাহলে এ সমস্ত উপঢৌকন তোমার।’ সে বলল, ‘আমি তো কাউকে আরোগ্য দিতে পারি না, আল্লাহ তা‘আলাই আরোগ্য দান করে থাকেন। যদি তুমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন কর, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে দো‘আ করব, ফলে তিনি তোমাকে অন্ধত্বমুক্ত করবেন।’ সুতরাং সে তার প্রতি ঈমান আনল। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে আরোগ্য দান করলেন। তারপর সে পূর্বেকার অভ্যাস অনুযায়ী বাদশাহর কাছে গিয়ে বসল। বাদশাহ তাকে বলল, ‘কে তোমাকে চোখ ফিরিয়ে দিল?’ সে বলল, ‘আমার প্রভু!’ সে বলল, ‘আমি ব্যতীত তোমার অন্য কেউ প্রভু আছে?’ সে বলল, ‘আমার প্রভু ও আপনার প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ।’ বাদশাহ তাকে গ্রেপ্তার করল এবং তাকে ততক্ষণ পর্যন্ত শাস্তি দিতে থাকল, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ঐ (চিকিৎসক) বালকের কথা বলে দিল। অতএব তাকে (বাদশার নিকটে) নিয়ে আসা হল। বাদশাহ তাকে বলল, ‘বৎস! তোমার কৃতিত্ব ঐ সীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে যে, তুমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য দান করছ এবং আরো অনেক কিছু করছ।’ বালকটি বলল, ‘আমি কাউকে আরোগ্য দান করি না, আরোগ্য দানকারী হচ্ছেন একমাত্র মহান আল্লাহ।’ বাদশাহ তাকেও গ্রেপ্তার করে ততক্ষণ পর্যন্ত শাস্তি দিতে থাকল, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ঐ পাদ্রীর কথা বলে দিল। অতঃপর পাদ্রীকেও (তার কাছে) নিয়ে আসা হল। পাদ্রীকে বলা হল যে, ‘তুমি নিজের ধর্ম থেকে ফিরে যাও।’ কিন্তু সে অস্বীকার করল। ফলে তার মাথার সিঁথিতে করাত রাখা হল। করাতটি তাকে (চিরে) দ্বিখন্ডিত করে দিল; এমনকি তার দুই ধার (মাটিতে) পড়ে গেল।

তারপর বাদশাহর নিকটীকে নিয়ে আসা হল এবং তাকে বলা হল যে, ‘তোমার ধর্ম পরিত্যাগ কর।’ কিন্তু সেও (বাদশার কথা) প্রত্যাখান করল। ফলে তার মাথার সিঁথিতে করাত রাখা হল। তা দিয়ে তাকে (চিরে) দ্বিখন্ডিত করে দিল; এমনকি তার দুই ধার (মাটিতে) পড়ে গেল। তারপর বালকটিকে নিয়ে আসা হল। অতঃপর তাকে বলা হল যে, ‘তুমি ধর্ম থেকে ফিরে এস।’ কিন্তু সেও অসম্মতি জানাল। সুতরাং বাদশাহ তাকে তার কিছু বিশেষ লোকের হাতে সঁপে দিয়ে বলল যে, ‘একে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও, তার উপরে তাকে আরোহণ করাও। অতঃপর যখন তোমরা তার চূড়ায় পৌঁছবে (তখন তাকে ধর্ম-ত্যাগের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা কর) যদি সে নিজের ধর্ম থেকে ফিরে যায়, তাহলে ভাল। নচেৎ তাকে ওখান থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দাও।’ সুতরাং তারা তাকে নিয়ে গিয়ে পাহাড়ের উপর আরোহণ করল। বালকটি আল্লাহর কাছে দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার জন্য তাদের মুকাবেলায় যে ভাবেই চাও যথেষ্ট হয়ে যাও।’ সুতরাং পাহাড় কেঁপে উঠল এবং তারা সকলেই নীচে পড়ে গেল।

বালকটি হেঁটে বাদশার কাছে উপস্থিত হল। বাদশাহ তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার সঙ্গীদের কি হল?’ বালকটি বলল, ‘আল্লাহ তা‘আলা তাদের মোকাবেলায় আমার জন্য যথেষ্ট হয়েছেন।’

বাদশাহ আবার তাকে তার কিছু বিশেষ লোকের হাতে সঁপে দিয়ে বলল যে, ‘একে নিয়ে তোমরা নৌকায় চড় এবং সমুদ্রের মধ্যস্থলে গিয়ে তাকে ধর্মের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা কর! যদি সে স্বধর্ম থেকে ফিরে আসে, তাহলে ঠিক আছে। নচেৎ তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ কর।’ সুতরাং তারা তাকে নিয়ে গেল। অতঃপর বালকটি (নৌকায় চড়ে) দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ! তুমি এদের মোকাবেলায় যেভাবে চাও আমার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাও।’ সুতরাং নৌকা উল্টে গেল এবং তারা সকলেই পানিতে ডুবে গেল।

তারপর বালকটি হেঁটে বাদশাহর কাছে এল। বাদশাহ বলল, ‘তোমার সঙ্গীদের কী হল?’ বালকটি বলল, ‘আল্লাহ তা‘আলা তাদের মোকাবেলায় আমার জন্য যথেষ্ট হয়ে গেছেন।’ পুনরায় বালকটি বাদশাহকে বলল যে, ‘আপনি আমাকে সে পর্যন্ত হত্যা করতে পারবেন না, যে পর্যন্ত না আপনি আমার নির্দেশিত পদ্ধতি অবলম্বন করবেন।’ বাদশাহ বলল, ‘তা কী?’  সে বলল, ‘আপনি একটি মাঠে লোকজন একত্রিত করুন এবং গাছের গুড়িতে আমাকে ঝুলিয়ে দিন। অতঃপর আমার তূণ থেকে একটি তীর নিয়ে তা ধনুকের মাঝে রাখুন, তারপর বলুন, ‘‘বিসমিল্লাহি রাব্বিল গুলাম!’’ (অর্থাৎ এই বালকের প্রতিপালক আল্লাহর নামে মারছি।) অতঃপর আমাকে তীর মারুন। এভাবে করলে আপনি আমাকে হত্যা করতে সফল হবেন।’

সুতরাং (বালকটির নির্দেশানুযায়ী) বাদশাহ একটি মাঠে লোকজন একত্রিত করল এবং গাছের গুঁড়িতে তাকে ঝুলিয়ে দিল। অতঃপর তার তূণ থেকে একটি তীর নিয়ে তা ধনুকের মাঝে রেখে বলল, ‘বিসমিল্লাহি রাব্বিল গুলাম!’ (অর্থাৎ এই বালকের প্রতিপালক আল্লাহর নামে মারছি।) অতঃপর তাকে তীর মারল। তীরটি তার কান ও মাথার মধ্যবর্তী স্থানে (কানমুতোয়) লাগল। বালকটি তার কানমুতোয় হাত রেখে মারা গেল। অতঃপর লোকেরা (বালকটির অলোকিকতা দেখে) বলল যে, ‘আমরা এ বালকটির প্রভুর উপর ঈমান আনলাম।’ বাদশার কাছে এসে বলা হল যে, ‘আপনি যার ভয় করছিলেন তাই ঘটে গেছে, লোকেরা (আল্লাহর প্রতি) ঈমান এনেছে।’ সুতরাং সে পথের দুয়ারে গর্ত খুঁড়ার আদেশ দিল। ফলে তা খুঁড়া হল এবং তাতে আগুন জ্বালানো হল। বাদশাহ আদেশ করল যে, ‘যে দ্বীন থেকে না ফিরবে তাকে এই আগুনে নিক্ষেপ কর’ অথবা তাকে বলা হল যে, ‘তুমি আগুনে প্রবেশ কর।’ তারা তাই করল। শেষ পর্যন্ত একটি স্ত্রীলোক এল। তার সঙ্গে তার একটি শিশু ছিল। সে তাতে পতিত হতে কুণ্ঠিত হলে তার বালকটি বলল, ‘আম্মা! তুমি সবর কর। কেননা, তুমি সত্যের উপরে আছ।’’(মুসলিম ৩০০৫, তিরমিযী ৩৩৪০, আহমাদ ২৩৪১৩; রিয়াযুস স্বালেহীন ৬/৩১)।

ইমাম আবু হানিফা কর্তৃক কাজীর পদ প্রত্যাখান ও নির্জাতন ভোগঃ

১৩০ হিজরী সালে তখন আববাসী খিলাফত প্রতিষ্ঠার  হয়, যখন তাঁর বয়স প্রায় ৫০ বৎসর। আববাসী খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর দ্বিতীয় আববাসী খলীফা মানসূর ক্ষমতা লাভ করে এবং ১৪৬ হিজরীতে (৭৬৩ সালে) সালে আব্বাসীয় বংশের আল-মনসুর আবু হানিফাকে রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেন কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকার জন্য তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তার পরীবর্তে তার ছাত্র আবু ইউসুফকে প্রধান বিচারপতির দ্বায়িত দেওয়া হয়। প্রস্তাব প্রত্যাখানের ব্যাপারে আবু ইউসুফ আল মনসুরকে ব্যাখা দেন তিনি নিজেকে এই পদের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন না।

আল-মনসুরের এই পদ প্রস্তাব দেওয়ার পেছেনে তার নিজস্ব কারণ ছিল, আবু হানিফা প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পর মনসুর তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এই অভিযোগের ব্যাখ্যায় আবু হানিফা বলেন, “আমি যদি মিথ্যাবাদী হই তাহলে প্রস্তাব প্রত্যাখান করার ব্যাপারে আমার মতামত সঠিক, কারণ কিভাবে আপনি প্রধান বিচারপতির পদে একজন মিথ্যাবাদিকে বসাবেন।” এই ব্যাখার উত্তরে আল-মনসুর আবু হানিফাকে গ্রেফতার করেন ও তাকে নির্যাতন করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। এমনকি বিচারকরা সিদ্ধান্ত নিতেন কে তার সাথে দেখা করতে পারবে। দীর্ঘ চার বছর পর ১৫০ হিজরী (৭৬৭ সালে) সালে আবু হানিফা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর কারণ পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ বলেন আবু হানিফা আল মনসুরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের চেষ্ঠা করেন এ জন্য তাকে জেলখানর ভেতর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।

মন্তব্যঃ সত্যের অবিচল থাকার জন্য মৃত্যুকে সহজে মেনে নেয়া কত বড় সবর, একটু ভাবনার বিষয়।

ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ -এর উপর নির্যাতনের একটি ঘটনাঃ

একবার মদিনার গভর্নর জাফর ইবনে সুলাইমানের কাছে কেউ বিষোদগার করল যে, ইমাম মালিক (রহিঃ) তাঁর বাইয়াতকে সহিহ মনে করেন না। এতে জাফর ইমামের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া ইমাম মালিক  (রহঃ) ও আব্বাসীয় যালিম শাসকদের যূলমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর ছিলেন। তৎকালীন খলীফা মনসুরের চাচাতো ভাই মদীনার গভর্ণর জাফরের নির্দেশে ইমাম মালিকের উপর অবর্ণণীয় নির্যাতন করা হয়। ইমামের দেহের কাপড় খুলে নির্মমতার সাথে চাবুকাঘাত করা হয়। যার ফলে সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়। কিন্তু এইভাবে নির্যাতন করেও তৃপ্ত হতে পারেননি মদীনার যালিম গভর্নর। ইমাম মালিক (রহিঃ)-কে ক্ষত-বিক্ষত দেহ নিয়ে উটের পিঠে বসিয়ে শহরের অলি-গলিতে প্রদক্ষিন করা হয়। তারপর ইমাম রক্তাক্ত অবস্থায় মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে রক্ত পরিস্কার করে দুই রাকাত নামায আদায় করেন। ইমাম গভর্ণরের কথামত ফাতওয়া দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণেই তাঁর উপর এই ধরনের নির্যাতন করা হয়েছিল। ইমাম মালিক (রহিঃ) আজও মুসলিমদের হৃদয় জূড়ে আছে ভালবাসা নিয়ে। গভর্নর কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে জনসাধারণ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা বহুগুণ বেড়ে যায়। আর তৎকালীন আব্বাসীয় যালিমদেরকে মুসলিমরা ঘৃনা ভরে স্মরণ করে।

 

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর সবর ও সাধনাঃ

ইমাম শাফেয়ী (রহ.) ছোট কালেই পিতাকে হারিয়ে ইয়াতীম হয়ে যান, পিতার মৃত্যুর পর অভিভাবকহীনতা ও দারিদ্রতা ইত্যাদি নানা সমস্যার সম্মুখীন হন, পিতা মারা গেলে বিচক্ষণ মা তাকে দু’বছর বয়সে মক্কার পার্শ্ববর্তী নিয়ে আসলে তিনি কুরআন মুখস্ত করায় মনোনিবেশ হন এবং সাত বছর বয়সেই সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্ত করেন। (মানহাজ ইমাম শাফেয়ী ফি ইছবাতিল আকীদাহ, ১/২৩ পৃঃ)।

তার আর্থিক অবস্থ বেশী ভাল ছিল না। তাই তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষকতার কাজ করতেন। তিনি নিজেই বলেন, আমি যখন মায়ের কাছে ইয়াতীম অসহায়, শিক্ষক দেয়ার মত মায়ের কাছে কিছু নেই এমতাবস্থায় শিক্ষক এর স্থলাভিষিক্তে দায়িত্ব পালন শর্তে পড়াতে রাযি হলে আমি তার কাছে কুরআন মুখস্ত খতম করলাম। অতঃপর মাসজিদে বিভিন্ন আলিমদের কাছে বসে হাদীস ও মাসআলা মুখস্ত করতে লাগলাম এবং কিছু বিষয় হাড়ের টুকরায় লিখে রাখতাম। (তাওয়াল্লী তাসীস, ৫৪ পৃঃ)।

তিনি আরো বলেন, আমার বয়স যখন প্রায় দশ বছর তখন মক্কায় জ্ঞান চর্চায় ব্যস্ত থাকা দেখে আমার এক আত্মীয় আমাকে বললেনঃ “তুমি একাজ কর না বরং অর্থ উপার্জনের পথধর”। তিনি বলেন আমি তার কথায় কান দিলাম না বরং শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চায় আমি আরো মগ্ন হলাম ফলে আল্লাহ আমাকে এসব জ্ঞান দান করেছেন। (তাওয়াল্লী তাসীস, ৫৩ পৃঃ)।

তিনি ছোট কাল হতে শিক্ষানুরাগী এবং কঠোর জ্ঞান সাধনার ফলে সাত বছরে কুরআনের হাফেয এবং দশ বছরে মুয়াত্তা হাদীস গ্রন্থ হিফয করে পনের বা আটার বছর বয়সে ফাতাওয়া প্রদান শুরু করেন। সাথে সাথে মক্কায় আরবী পন্ডিতদের কাছে আরবী কবিতা ও ভাষা জ্ঞানে পূর্ণ পান্ডিত্ব লাভ করেন। (আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ১০/২৬৩ পৃঃ)।

মন্তব্যঃ সবর ছাড়া এভাবে একজন এতিম অসহান বালকের জগৎ বিখ্যাত আলিম হওয়া অসম্ভব ছিল। আল্লাহ রহমতের সাথে তার সাধনা, অধ্যবশায়, চেষ্ট, সবর তাকে খ্যাতির শিখরে পৌছে দিয়েছন।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ এর উপর অপরিসীম নির্যাতনঃ

আব্বাসী খলীফা মামুনুর রশিদের যুগে মুতাযেলা আলেমদের খুব প্রভাবছিল। তাদের প্রভাবে স্বয়ং খলীফা মামুনও প্রভাবিত হয়ে গিয়েছিলেন। মুতাযেলাদের মতে কুরআন আল্লাহর “মাখলুক”। তারা খলীফাকে এই কথা বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল। মামুন খিলাফতে আসিন হওয়ার পর মুতাজেলা আলেমগন তার চার পাশে ভীর জমায় এবং তাকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। তিনি মানুষ কে খালকে কুরআনের দিকে আহবান করেন। যারা তার আহবান অমান্য করল খলিফার আদেশে তাদের প্রহার করে এবং ভাতা প্রদান বদ্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়। ফলে তাদের অধিকাংশ এই মতের সমর্থ জানায় কিন্তু ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল এবং মুহাম্মাদ বিন নূহ (রঃ) কুরআনকে মাখলুক বলতে অস্বীকার করলেন। তারা উভয়েই বললেনঃ কুরআন আল্লাহর কালাম। ফলে খলিফার নির্দেশে তাদের দুজন এক উটে চড়িয়ে খলিফার নিকট পাঠিয়ে দেয়। তখন তারা দুজনে ছিলেন শৃংখলাবদ্ধ এবং এক সঙ্গে একই উটের আরহী করে খলিফার নিকট নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা দেন।কিন্তু তার খলিফার নিকট পৌঁছার আগেই বিনা অসুখে মামুন মৃত্যুমুখে পতিত হয়।  মামুনের মৃত্যু সংবাদ আসার পর রক্ষীরা ইমামকে মুহাম্মাদ নুহ এর সাথে বাগাদের জেলে ফেরত নিয়ে আসল। মামুনের পরে মুতাসেম খলীফা নিযুক্ত হলেন। মুতাসেম যদিও মুতাযেলা মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু মামুনের গৃহীত নীতি থেকে ফিরে আসাও তার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। কারণ খলীফা মামুন মুতাসেমকে মুতাযেলা মতাদর্শের উপর অটল থাকার অসীয়তও করেছিলেন। তাই মামুনের প্রতি মুতাসেমের অগাধ ভালবাসার কারণেই মুতাসেম খলীফা হয়ে সর্বপ্রথম যে সিদ্বান্তটি গ্রহণ করেন তা হলো তিনি ইমাম আহমাদকে হাত পা বেঁধে বাগদাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি জেলেফেলে রাখলেন। তাতে তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে বাগদাদের বড় জেলে সাধারণ কয়েদীদের সাথে স্থানান্তর করলেন। এখানে তিনি ত্রিশ মাস অবস্থান করেন। কারো কারো মতে আঠার মাস কারা ভোগ করেন। এরই মধ্যে দীর্ঘকারা ভোগ এবং নির্যাতনের কারণে জেলের মধ্যেই মুহাম্মাদ বিন নূহ মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ইমাম আহমাদ একাই ময়দানে বাতিলের মোকাবেলা করতে থাকলেন।

মুতাসিম এর সম্মুখে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে প্রহার করার আলোচনা।

ইমাম আহমদকে জেলখানা থেকে বের করে খলীফা মুতাসিম এর সম্মুখে হাজির করা হলে মুতাসিম তার শৃংখল আরো বাড়িয়ে দেন। ইমাম আহমদ বলেন, আমি শিকলগুলোর জনই হাটতে পারি না। ফলে সেগুলো পায়জামার ফিতায় বেধে হাতে করে চলতে লাগলাম। তারপর তারা আমার নিকট কি একটি পশু এনে চড়িয়ে দিল। আমি শিকলের ভারে উপুর হয়ে পড়ে যেতে উদ্যত হই। তখন আমাকে ধরে রাখার মত কেউ আমার সাথে ছিল না। কিন্তু মহান আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছেন। আমি মুতাসিমের ভবনে নিকট এলে আমাকে একটি গৃহে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। সেখানে কোন বাতি ছিল না। আমি অজু করার ইচ্ছা করলাম। হাত বাড়িয়ে পানি ভর্তি একটি বরতন পেয়ে গেলাম। আমি অজু করলাম সালাতে দাড়ালাম কিন্তু কিবলা ঠাহর করতে পারলামনা। ভোরে বুঝতে পারলাম আমি কিবলা মুখি হয়েই সালাত পড়েছি। সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য।

তারপর আমাকে তলর করা হল। আমাকে মুতাসিম এর নিকট নিয়ে যাওয়া হল। খলিফা আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন, তোমরা কি মনে করেছিল ইনি নওজোয়ান? ইনি তো বয়োবৃদ্ধ লোক। ইমাম আবু দাউদ তখন আমার নিকট উপবিষ্ট। আমি নিকটি গিয়ে তাকে সালাম দিলাম। তিনি বললেন ওকে আমাম আরো নিকটে নিয়ে আস। তারপর তিনি বললেন বস। আমি বসে পড়লাম। লোহাগুলো আমাকে ভারি করে রেখেছে। কিছু সময় নিরব বসে থেকে বললামঃ হে আমিরুল মুমিনীন! আপনার ভাতিজা রাসূল (সাঃ) কিসের প্রতি আহবান করে ছিলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ ব্যতিত কোন ইলাহ নেই এর সাক্ষের প্রতি। আমি বললামঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ব্যতিত কোন ইলাহ নেই। তারপর তাকে আবদুল কায়স প্রতিনিধি দল সম্পর্কে ইবনে আব্বাসের হাদিসখানি শুনিয়ে বললামঃ আল্লাহ রাসূল (সাঃ) প্রতি আহবান করেছিলেন।

আহমদ ইবনে হাম্বল বলেনঃ তারপর ইবনে আবু দাউদ কিছু কথা বলল, আমি তার মর্ম কিছুই বুঝিনি কারন আমি তার বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না। তারপর মুতাসিম বললেন আপনি যদি আমার পূর্ববর্তী খলফার কবজায় না থাকতের তাহলে আমি আপনার পিছে লাগতাম না। তারপর তিনি বললেন হে আবদুর রহমান আমি তোমাকে অত্যাচার নির্যাতন বদ্ধ করতে বলিনী। ইমাম আহমদ বললেনঃ আল্লাহ আকবর। এতো মুসলমানদের জন্য সুখের কথা। তার পর তিনি বললেনঃ আবদুর রহমান তুমি তার সাথে বিতর্ক কর এবং কথা বল। শুনে আবদুর রহমান বলল, কুরআনের ব্যাপারে আপনার মতামত কি? আমি জবাব দিলাম না। খলীফা মুতাসিম বললেন আপনি জবাব দিন। আমি বললাম ইলম সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি নিশ্চুপ বইলেন। আমি বললাম পবিত্র কালাম আল্লাহর ইলম বিষেশ। আর যে ব্যাক্তি বিশ্বাস করল আল্লাহর মাখলুক, সে আল্লাহকে অস্বীকার করল। খলিফা কোন কথা বললেন না, লোকেরা বলল, উনি আপনাকে ও আমাদেরকে কাফির বলছে। কিন্তু খলিফা তাদের কথায় কর্ণপাত করলেন না। আবদুর রহমান বলল, আল্লাহ ছিলেন কিন্তু কুরআন ছিল না। আমি বললাম, আল্লাহ ছিলেন কিন্তু ইলম ছিল না। এবার তিনি চুপশে গেলেন। তারা পরস্পর কানাঘুসা করতে লাগল। আমি বললাম হে আমিরুল মুমিনীর তারা আমাকে কুরআন হাদিম থেকে কিঞ্চিত প্রমান দিক। তাহলে আমি খালকুন কুরআনেন প্রতি সমর্থন দিব। শুনে ইবনে আবু দাউদ বললেন, আপনি কুরআন ও হাদিস ছাড়া আর কিছুই বলছেন না। আমি বললাম, এ দুটি ছাড়া কি ইসলাম দাড়াতে পারে? তারা তাদের মতের পক্ষে নিম্ম লিখেত আয়াত দ্বারা দলীল পেশ করল।

মহান আল্লাহ বলেন,

 مَا يَأۡتِيهِم مِّن ذِڪۡرٍ۬ مِّن رَّبِّهِم مُّحۡدَثٍ

অর্থঃ তাদের কাছে তাদের রবের পক্ষ থেকে যে উপদেশ আসে (সুরা আম্বিয়া ২১:২)

মহান আল্লাহ বলেন,

ٱللَّهُ خَـٰلِقُ كُلِّ شَىۡءٍ۬

অর্থঃ প্রত্যেকটি জিনিসের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ৷ (সুরা রাদ ১৩:১৬)

মহান আল্লাহ বলেন,

تُدَمِّرُ كُلَّ شَىۡءِۭ بِأَمۡرِ رَبِّہَا

অর্থঃ তার রবের নির্দেশে প্রতিটি বস্তুকে ধ্বংস করে ফেলবে৷ (সুরা আহকাফ ৪৬:২৫)।

জবাবে ইবনে আবু দাউদ বললেন, তিনি আল্লাহর শপথ, হে আমিরুল মুমিনীন! ভ্রান্ত, বিভ্রান্তকারী ও বিদআতী। আপনার এখানে অনেক বিচরক ও ফকিহ আছে। আপনি তাদের জিজ্ঞাসা করুন। খলীফা জিজ্ঞাসা করেন আপনাদের অভিমত কি? তারা ও সেই উত্তর প্রদান করে যা ইবনে আবু দাউদ বলেছিলেন। 

তারা দ্বিতীয় দিন ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল উপস্থিত করে এবং তৃতীয় দিন ও তারা তার সাথে বিতর্ক করে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর কন্ঠ তাদের কন্ঠ থেকে উচ্চ ছিল। এবং তার দলীর তাদের দলীলকে পরাজিত করেন। সবাই চুপ করলে ইবনে আবু দাউদ সকলের উদ্দেশ্য কথা বলা শুরু করেন। ইলমে কালামে লোকটা ছিল সকলের চেয়ে অজ্ঞ। বিতর্কে নানা বিষয় আলোচনায় উঠে কিন্তু কুরআন সুন্নাহ উদ্ধৃতি দেওয়ার মত যোগ্যাতা তাদের কারো ছিল না। তারা কুরআন সুন্নাহ দলীলাদি অস্বীকার করে যুক্তির অবতারনা করতে থাকে। আমি তাদের বক্তব্য শুনলাম, যা কেউ বলতে পারে, আমার এ ধারণা ছিল না। ইবনে গাউস আমার সাথে দীর্ঘ আলাপ করে, যাতে সি দেহ ইত্যাদি নিয়ে অহেতুক বিষয়ে অবতাবণা করে। আমি বললাম আমি আপনার বক্তব্য বুঝতে পারছিনা। আমি শুধু এতটুকু জানি মহান আল্লাহ এক ও অমুখাপেক্ষী এবং তার মত কিছুই নেই। এবার তিনি চুপশে যান। আমি পর জগতে আল্লাহ দিদার সংক্রান্ত হাদিস তাদের সামনে উপস্থাপন করি। তারা হাদিসের সনদ দুর্বল আখ্যায়িত করা এবং কতিপয় মাহাদ্দিস এর প্রতি কটাক্ষপূর্ণ উক্তি করতে শুরা করে। কিন্তু অসম্ভর এত দুরবর্তী স্থান থেকে তারা তাদের নাগাল পাবে কি করে। এহেন বাগ বিতন্ডার মাঝে খলিফা তার প্রতি কোমল আচরণ দেখাতে থাকে। এবং বলিছিলেন আহমদ আপনি প্রশ্নগুলির জবাব দিন। আমি আপনাকে আমার একনিষ্ট ব্যক্তিদের এবং যারা আমাম ফরাস মাড়ায় তাদের মধ্যে অন্তরভূক্ত করে নিব। আমি বললাম, হে আমিরুল মুমুনীন! তারা আমার সম্মুখে আল্লাহর কিতাবের একটি আয়াত কিংরা রাসূল (সাঃ) একটি হাদিস উপস্থাপন করুক। তখন আমি তাদের জবাব দিব। তারা তখন কুরআন হাদিসের দলীল প্রমান কে অস্বীকার করল, তখন ইমাম আহমদ নিম্মের আয়াতগুলি দ্বারা মুকাবিলা করেন।

মহান আল্লাহ বলেন,

إِذۡ قَالَ لِأَبِيهِ يَـٰٓأَبَتِ لِمَ تَعۡبُدُ مَا لَا يَسۡمَعُ وَلَا يُبۡصِرُ وَلَا يُغۡنِى عَنكَ شَيۡـًٔ۬ا (٤٢)

অর্থঃ যখন সে নিজের বাপকে বললো, “আব্বাজান! আপনি কেন এমন জিনিসের ইবাদত করেন, যা শোনেও না দেখেও না এবং আপনার কোন কাজও করতে পারে না?  (সুরা মরিয়াম ১৯:৪২)।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَكَلَّمَ ٱللَّهُ مُوسَىٰ تَڪۡلِيمً۬ا (١٦٤)

অর্থঃ আমি মূসার সাথে কথা বলেছি ঠিক যেমনভাবে কথা বলা হয়৷ (সুরা নিসা ৪:১৬৪)।

মহান আল্লাহ বলেন,

 إِنَّنِىٓ أَنَا ٱللَّهُ لَآ إِلَـٰهَ إِلَّآ أَنَا۟ فَٱعۡبُدۡنِى

অর্থঃ আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, কাজেই তুমি আমার ইবাদত করো (সুরা ত্বহা ২০:১৪।

মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّمَا قَوۡلُنَا لِشَىۡءٍ إِذَآ أَرَدۡنَـٰهُ أَن نَّقُولَ لَهُ ۥ كُن فَيَكُونُ (٤٠)

অর্থঃ কোনো জিনিসকে অস্তিত্বশীল করার জন্য এর চেয়ে বেশী কিছু করতে হয় না যে, তাকে হুকুম দিই “হয়ে যাও” এবং তা হয়ে যায়৷ (সুরা নাহল ১৬:৪০)। 

ইমাম আহমদ এইভাবে আরো অনক আয়াত দ্বারা দলীল পেশ করেন। ঐদিকে পুলিশ প্রধান আব্দুর রাহমান বিন ইসহাক বিনইবরাহীম বলতেন। হে আমীরুল মুমিনীন! আমি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বালকে ত্রিশ বছর যাবৎ চিনি। তিনি আপনার আনুগত্য করাকে ওয়াজিব মনে করেন, আপনার শাসনকে সমর্থন করেন এবং আপনার সাথে জিহাদ করাকে ফরয মনে করেন। সেই সাথে তিনি একজন বিজ্ঞ আলেম এবং ফকীহ।

 অপর দিকে ইবনে দাউদ এবং অন্যান্য বিদআতীরা তার দলীল প্রমানের সঙ্গে না পেরে, অবশেষে খলিফার ব্যক্তিত্বকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করে। এবং খলীফাকে ইমামের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলত এবং বুঝাতো যে, ইমাম আহমাদ একজন গোমরাহ, কাফের এবং বিদআতী। তৎক্ষণাৎ ইবনে দাউদ বলতে লাগলঃ হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি যদি তাঁকে ছেড়েদেন, তাহলে লোকেরা বলাবলি করবে যে, ইমাম আহমাদের সামনে দুইজন আব্বাসী খলীফা পরাজয় বরণ করেছে। এবার খলিফার আত্ম মর্জাদা জেগে উঠে এবং ক্রোধ তীব্র আকার ধারন করে। অথচ তিনি ছিলেন স্বভাবে তাদের চেয়ে কোমল ব্যক্তি। তার মনে প্রীতি জম্মে যে, তার লোকেরা সত্যের উপর।

ইমাম আহমদ বলেন, তখন খলীফা আমাকে বলেন, আল্লাহ তোমাকে অভীসপ্ত করুক। আমি আশা করে ছিলাম, তুমি আমাকে জবাব দিবে। কিন্তু তুমি আমাকে জবাব দিলে না। তার পর বললেন, একে উদোম করে ফেল এবং হেচড়াও।

ইমাম আহমদ বলেন, আমাকে উদোম করে ফেলা হল এবং হেচড়ানো হল। শাস্তিদানকারি ও বেত্রাঘাতকারিদের আনা হল। আমি চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম আমার কাপড়ে বাধা রাসূল (সবঃ) এর কয়েকটি চুল ছিল তা তারা ছিনিয়ে নিল। আমি চরম শাস্তির শিকার হলাম। আমি বললাম, হে আমিরুল মুমিনীন! মহান আল্লাহকে ভয় করুন।মহান আল্লাহকে ভয় করুন।

 রাসুল (সাঃ) বলেছে, যে মুসলমান সাক্ষ্যদেয় ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইহাহ নেই’, তিন কারনের একটিও না পাওয়া গেলে তার রক্ত হালাল নয়।

রাসুল (সাঃ) আরো বলেছে, আমি মানুষের সাথে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হই নাই। যতক্ষন না তারা বলে,’আল্লাহ ছাড়া কোন ইহাহ নেই’। তখনই তারা বলল, তো তারা আমার থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করে নিল।

এমতবস্থায় কিসের ভিত্তিতে আমার রক্তকে হালল ভাবছেন। অথচ আমিতো সেরূপ কোন অপরাধ করেনি। হে আমিরুল মুমিনীন! স্মরণ করুন, আজ আমাকে যেমন আপনার সামনে দাড়াতে হয়েছে ঠিক তেমনি আপনাকে ও মহান আল্লাহর সামনে দাড়াতে হবে। মনে হল এ কথা শুনে তিনি থমকে গেলেন। কিন্তু তারা অনবরত বলতে লাগল, হে আমিরুল মুমিনীন! সে একজন গোমরাহ, কাফির এবং বিদআতী। ফলে খলিফা আবার শাস্তির নির্দেশ দিলেন আর আমি নানান রকম শাস্তির মাঝে দাড়িয়ে রইলাম। একখানা চেয়ার আনা হল আমাকে তার উপর দাড় করান হল। এক ব্যক্তি আমাকে একটি কাঠ ধরান নির্দেশ দিল। আমি বিষয়টি বুঝতে পারলাম না। আমার হাত দুটি দুদিকে ছড়িয়ে গেল। প্রহার কারিদের আনা হল তাদের হতে ছিল কোড়া। তারা এক একজন আমাকে দু দুটি তাবুক মারতে শুরু করল। একজন দুটি চাবুক মারছে এবং সরে যাচ্ছে অপর জন এসে আবার অনুরুপ দুটি চাবুক মারছে। তারা আমাকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ফেলে। কিন্তু আমি তাদের আহবানে সাড়া দিচ্ছিলাম না। তারা বলতে ছিলেন, তুমি ধ্বংশ হও। খলিফা তোমার মাথার উপরে। কিন্তু আমি তাদের বক্তব্য গ্রহণ করলামনা। তারা পুনরায় আমাকে প্রহার শুরু করে। খলিফা আবার ও আমার নিকট এলেন।  আমি তার আহবানে সাড়া দিলাম না। তারা পুনরায় আমাকে প্রহার শুরু করে। খলিফা তৃতীয়বারের মত ও আমার নিকট এসে আহবান জানালেন। কিন্তু বেদম মারের চোটে আমি তার বক্তব্য বুঝতে পারিনি। তারা পুনরায় আমাকে বেদমভাবে মারতে শুরু করে। এবং আমার চেতনা হারিয়ে যায়। আমি প্রহার অনুভব করতে পারছিলাম না। তাতে খলিফা ভয় পেয়ে যায়। এবং আমাকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। আমাকে ছেড়ে দেয়া হল। তখন আমি এতটুকু টের পেয়েছি যে, আমি একটি ঘরের একটি কক্ষে অবস্থান করছি। আমার কোন অনুভুতি ছিল না। আমার পায়ের বেড়িগুলি খুলে ফেলেছে। এই ঘটনা ঘটেছিল ২২১ হিজরী সালের রমজান মাসের ২৫ তারিখ। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১০ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং-৫৬০-৫৬৬, প্রকাশনি ইসলামি ফাউন্ডেশন, প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর-২০১০)।

২২১ হিজরী সালের রমজান মাসের ২৫ তারিখের এই নিদারুন ঘটনার পর, খলিফা ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল মুক্তি  করে  পরিবারের নিকট পৌছে দেয়ার নির্দেশ দেন। সে দিন তাকে ত্রিশের অধিক চাবুক মারা হয়। কেউ বলে আশিটি। কিন্তু আঘাত ছিল অত্যন্ত বেদম ও তীব্র। ইমামকে যখন দারুল খিলাফত থেকে ইসহাক ইবন ইব্রাহীমের গৃহে নেয়া হয় তখন তিনি রোজাদার ছিলেন। রোজা ভেঙ্গে দুর্বলাতা দুর করার জন্য তাকে সাতু এনে দেয়া হয় কিন্তু তিনি রোজা ভাংতে অস্বীকার করলেন। এবং রোজা পূর্ণ করলেন। যোহরের ওয়াক্ত হলে তিনি লোকদের সাথে সালাত আদায় করলেন। তখন কাজি ইবনে সামাআ বললেন, আপনি রক্তমাখা গায়ে সালাত আদায় করলেন। উত্তরে ইমাম আহমদ বললেন, উমর (রাঃ) এমন অবস্থায় সালাত আদায় করেছেন যে, তখন তান জখম রক্ত প্ররাহিত করছিল। একথা শুনে ইবনে সামাআ নিশ্চুপ হয়ে গেল।

বর্ণিত আছে ইমাম আহমদকে প্রহার করার জন্য দাড় করান হয়, তখন তার পায়জামার ফিতা ছিড়ে যায়। তিনি শংকিত হয়ে যান তার তার পায়জামা খসে পড়ে যায় কিনা। তাই তিনি সতর ঢেকে নিয়ে ঠোট নেড়ে মহান আল্লাহ নিকট দোয়া করলেন। ফলে আল্লাহ তার পায়জামার ফিতা পূর্বের ন্যায় করে দেন। বর্ণিত আছে তিনি বলেছিলেন, হে সাহায্য প্রার্থীদের সাহায্যকারি, হে বিশ্বজাহানের মাবুদ, তুমি যদি জেনে থাক আমি তোমারই সন্তুষ্টি লাভে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আছি, তাহলে তুমি আমার ইজ্জত ক্ষুন্ন হতে দিয় না।

নিজ গৃহে ফিরে আসার পর জারায়িহী এসে তার দেহ থেকে নিস্প্রাণ গোশত কেটে ফেলেন এবং তার চিকিত্সা করতে থাকেন। খলিফার নায়িব সর্বক্ষন তার খোজ খবর রাখতে শুরু করে। কারন খলিফার পক্ষ থেকে ইমামের সাথে যা করা হয়েছিল তাতে তিনি ভীষণ অনুতপ্ত হন। পরে যখন ইমাম আহমদ সুস্থ হন তখন মুতাসিম ও মুসলিমগন তাতে আনন্দিত হন। আল্লাহ তাকে সুস্থতা দান করার পর কিছু দিন বেচে ছিলেন। কিন্তু ঠান্ডা লাগলে বৃদ্ধা আঙ্গুলি তাকে কষ্ট দিত। যারা তাকে কষ্ট দিয়েছিল বিদআতী বাদে সকলকে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি কুরআনের নিম্মের আয়াত তেলওয়াত করতেন।

وَلۡيَعۡفُواْ وَلۡيَصۡفَحُوٓاْ‌ۗ أَلَا تُحِبُّونَ أَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَكُمۡ‌ۗ وَٱللَّهُ غَفُورٌ۬ رَّحِيمٌ (٢٢)

অর্থঃ তাদেরকে ক্ষমা করা ও তাদের দোষ-ক্রটি উপেক্ষা করা উচিত ৷ তোমরা কি চাও না আল্লাহ তোমাদের মাফ করেন? আর আল্লাহ ক্ষমাশীলতা ও দয়া গুণে গুণান্বিত (সুরা নুর ২৪:২২)।

সহিহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে,  রাসুল (সাঃ) বলেছেন,

আমি তিনটি জিনিসের উপর কসম খেতে পারি। দানে ধন কমে না। দানে ধন করে না। ক্ষমা দ্বারা আল্লাহ বান্দার কেবল মর্জাদা ই বৃদ্ধি করেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সমীপে বিনয়ী হয়, আল্লাহ তার মর্জাদা বৃদ্ধি করে দেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১০ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং-৫৬৬-৫৬৭, প্রকাশনি ইসলামি ফাউন্ডেশন, প্রকাশকাল সেপ্টেম্বর-২০১০)।

মন্তব্যঃ আমাদের সলফে সালেহীনদে সবরের দৃষ্টান্ত দিলে চোখে পানি ধরে রাখা কষ্টকর। এগুল পড়ে পড়ে তাদরে জীবন থেকে সবরের সবক নিলে সবর অর্জন করা সহজ হবে।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment