বিদআত চিনার উপায় দ্বিতীয় কিস্তি : কিভাবে বুঝবেন আপনার আমলটি বিদআত

বিদআত চিনার উপায় : দ্বিতীয় কিস্তি

কিভাবে বুঝবেন আপনার আমলটি বিদআত

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

*** কিয়াসঃ

কিয়াসঃ কিয়াস (قياس) আরবি শব্দ যার অর্থ হল অনুমান করা, পরিমান করা, তুলনা করা, ওজন করা, নমুনা, সাদৃশ্য করা ইত্যাদি।

মালিকিগণ বলেন, “মূল আইন হতে ইল্লাতের যুক্তিভত্তিক সিদ্বান্ত হল কিয়াস।”

শাফিঈগণ বলেন, “একটি পরিচিতি জিনিসের সাহতে অন্য একটি পরিচিতি জিনিসের ইল্লাতের মাধ্যমে সম্বনয় সাধন হল কিয়াস।”

ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) এর মতে, “কিয়াস হল আইনের বিস্তৃতি। মূল আইন যখন সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বলতে পারে না, তখন মূল আইন হতে ইল্লাতের মাধ্যমে নতুন বিধি আহরন করতে হয়, এখানে আইনের যে বিস্তৃতি হয় তা হল কিয়াস।”

সুতারং আমরা বলতে পারি যে, কিয়াস শরীয়াতের এমন উৎস যার সাহায্যে কুরআন হাদিসের আলোকে নতুন কোন বিষয়ের সমাধান দেওয়া হয়। তবে কিয়াস প্রয়োগ করার সময় বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে, “কিয়াস যেন কখনও কুরআন, হাদীস ও ইজমার পরিপন্থী না হয়”। যার সমাধান কুরআন, হাদীস ও ইজমা’– এ তিনটির যে কোন একটির দ্বারা করা সম্ভব, তার সমাধান“কিয়াস” দ্বারা করা নাজায়েজ। ইসলামি শরীয়তের মুল তিন উত্সত কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার দলিল উপর ভিত্তি করে কোন বিষয়ের উপর মাসয়ালা নির্ণয় করাই হল কিয়াস। কিয়াস ইসলামী শরীয়াতের চতুর্থ উৎস হিসাবে ধরা হয়।

এছাড়াও কিয়াসের ভিত্তি হাদীস দ্বারা প্রমাণিতঃ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, মুআয ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহ আনহু কে ইয়েমেনের গভর্ণর করে পাঠানোর সময় তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে মুআয! তুমি কীসের ভিত্তিতে ফায়সালা করবে? তিনি বললেন, “আল্লাহ’র কিতাব দিয়ে, তিনি বললেন, “যদি আল্লাহ’র কিতাবে তা না থাকে?” তিনি বললেন, “তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নত দিয়ে”, তিনি বললেন, “যদি রাসূলের সুন্নতে তা না থাকে?” তিনি বললেন, “তখন আমি ইজতিহাদ করে ‘রায়’ দিবো।” তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর রাসূলের প্রতিনিধিকে এমন পথের সন্ধান দিয়েছেন যাতে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল ‘সন্তুষ্ট’। (আহমদ শরীফ)।

কিয়াসকে বিরোধিতা করার কোন সুযোগ নেই। তবে কেউ কেউ কিয়াসের ঘোর বিরোধিতা করে থাকে। তারা কিয়াসের বিরোধিতা করার জন্যে নিম্নোক্ত আয়াত আর হাদীসসমূহ তুলে ধরে। যেমনঃ মহান আল্লাহ কুরআনে এরশাদ করেন,

أَفَغَيۡرَ ٱللَّهِ أَبۡتَغِى حَكَمً۬ا وَهُوَ ٱلَّذِىٓ أَنزَلَ إِلَيۡڪُمُ ٱلۡكِتَـٰبَ مُفَصَّلاً۬‌ۚ

অর্থঃ এমতাবস্থায় আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মীমাংসাকারীর সন্ধান করবো? অথচ তিনি পূর্ণ বিস্তারিত বিবরণসহ তোমাদের কিতাব নাযিল করেছেন। (সুরা আনআম ৬:১১৪)।

এভাবে তারা এর সমর্থনে সূরা আনআমের-৫৫, ৯৭, ৯৮, সুরা বাকারার-১৫৯, সূরা আরাফের-৩২,৫২,১৪৫ সূরা বণী ঈসরাইলের-১২ এবং সূরা রুমের ২৮ নম্বর আয়াত তুলে ধরে। উক্ত আয়াতগুলিতে বলা হয়েছে কুরআন কে সকল কিছুর বিস্তারিত বিবরণসহ নাজিল করা হয়েছে। এর পরই বলবেন কুরআন যেহেতু সকল কিছুর বিস্তারিত বিবরণসহ নাজিল করা হয়েছে এবং দ্বীন ইসলামকে মহান আল্লাহ পরিপুর্ণ বলে ঘোষনা করে বলেনঃ

 ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِى وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَـٰمَ دِينً۬ا‌

অর্থঃ ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম। আমার নেয়ামতকে তোমাদের উপর পূর্ণতা দিলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সুরা মায়েদা ৫:৩)।

সহিহ হাদিসে বাসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, ‘‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহ্‌র কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত হল ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৫৩৫ ও সুনান আন-নাসায়ী, হাদীস নং ১৫৬০, হাদীসের শব্দ চয়ন নাসায়ী থেকে)।

উক্ত আয়াত ও  হাদিস দ্বারা কিয়াস বিরোধীরা প্রশ্ন করেন,  কুরআনে সকল বিষয় বিস্তারিত বর্ণিত তার পরও কি কিয়াস দরকার? দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ। এখন ইজমা কিয়াসের নামে দ্বীন ইসলামে নতুন নতুন সংযোজন কি আদৌ সম্ভব?

ইসলামি শরীয়তের কোন বিধানের জন্য একটি সহিহ হাদিসই যথেষ্ট, যদিও বিষয়টি সম্পর্কে কুরআনে কোন বক্তব্য পাওয়া না যায়। যেমন, ধরুন কবরের আজাব সম্পর্কে আল্লাহর কালাম কুরআনে কোন কিছু নেই কিন্তু সহিহ হাদিস দ্বারা কবরের আজাব প্রমানিত। কেউ কবরের আয়াত অস্বীকার করলে কি মুসলিম থাকবে? কবরের আজাব অস্বীকারকারি যে কাফির এতে মনে হয় কেউ দ্বিমত করবেন না।

আল্লাহর কালাম কুরআন ও তার ব্যাখ্যা হাদিসের সমন্নয়ে ইসলামের বিধান নির্ধারিত। আল্লাহ বলেন, ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম’ এর অর্থ ইসলামে কোন বিধি বিধানে কোর সংযোজন বা বিয়োজন হবে না। আমলের ক্ষেত্র নতুর কোন পদ্দতি (বিদআত) এর প্রচল করা যাবে না। নতুর কোন পদ্দতিতে ইবাদাতের অর্থ হল আল্লাহ রসুল এই পদ্দতিটি বুঝতে পারেন নি। তিনি যানতেন না কিভাবে ইবাদতের সাহায্যে আল্লাহর সন্ত্বষ্টি অর্জণ করতে হয়। এমন বিশ্বাস তাকে ইসলাম থেকে বের করে দিবে। ইবাদতের নতুন কোন পদ্দতি নয় কিন্তু সমসাময়িক বিষয় যা পরিহার করে চলা সম্ভব নয়, এমন বিষয় যা সরাসরি কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়নি, শুধু সেই বিষয়টি কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে শরীয়ত সম্মত সমাধান প্রদান করা নিশ্চয় বিদআত হবে না। কিয়াসের সঙ্গায় দেখবেন বলা হয়েছে,

 “কিয়াস শরীয়াতের এমন উৎস যার সাহায্যে কুরআন-হাদীসের আলোকের কোন নতুন কোন বিষয় সমাধান দেওয়া হয়। তবে “কিয়াস” প্রয়োগ করার সময় বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে, “কিয়াস যেন কখনও কুরআন, হাদীস ও ইজমার পরিপন্থী না হয়”।

কুরআন সুন্নায় আছে এমন বিধানে কিয়াস করা হারাম। আবার কিয়াস করে ইবাদতের নতুন পদ্দতি (বিদআত) আবিস্কার করাও হারাম কাজ। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ছিলনা, এমন অনেক কাজ আমাদের সামনে চলমান, যা কোন অবস্থায়ই এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। নতুন চলমান কাজের সাথে ইসলামি শরীয়তের বিধানের সমন্নয় সাধন কার খুবই জরুরি ছিল বা এখনও জরুরী। তাই মুজতাহিদ আলেমগন কিয়াসের মাধ্যমে এই নতুন চলমান কাজের সমন্নয় সাধন করেন বা করছেন। এমনই কিছু নতুন কাজের উদাহরন দিচ্ছি যা এড়িয়ে চলা সম্মব নয়।

যেমনঃ

১. টিবিতে ইসলামি অনুষ্টান দেখা, সংবাদ দেখা, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা, বিজ্ঞানের আবিস্কার দেখা, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখ ইত্যাদি।

২. ইন্টারনেট ব্যবহার করা এবং এর মাধ্যমে ই-মেইল পাঠিয়ে সংবাদ বা গুরুত্ব পূর্ণ তথ্য আদান প্রদাণ করা, ইসলিক স্কলারদের বিভিন্ন বক্তব্য ফতোয়া আটলোড করে প্রচার করা, এবং ডাউনলোড করে শুনা।

৩. ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের (ফেসবুক, টুইটার, গুগল) মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করা, বিভিন্ন মুসলিম ভাইদের সাথে যোগাযোগ রাখা, বিভিন্ন দেশ ও জাতী সম্পর্কে জানা।

৪. মোবাইল ফোর ব্যবহার করা। মোবইল ফোনে কুরআন রাখা, বিনা অজুতে পরিরহণ করা, ভিতরে কুরাআনের সফট কপি আছে এমন মোবাইল নিয়ে টয়লেটে গমন করা, মোবাইলে কুরআন শুনে তেলওয়াতের সিজনা দিতে হবে কিনা?

৪. ব্যাংকে টাকা জনা রাখা, কোন ধরনের ব্যাংকিং জায়েয আর কোন ধরনের ব্যাংকিং নাজায়েয। ইসলামি শরীয়ত মত ব্যাংকিং করতে চাইলে তার পদ্দতি কি হবে।

৫. বর্তমানে বিভিন্ন ধরণেনের জীবনবিমা আমাদের মাঝে প্রচলিত ইসলামে এ সকল জীবনবিমা ব্যবহার করা কতটুকু শরীয়ত সম্মত। ইসলামে শরীয়তে জীবনবিমার অবস্থান কোথায়।

৬. পৃথিবীর এমন কোন দেশ নেই যেখানে শেয়ার বাজার নেই, তা সে দেশে মুসলীম হোক আর অমুসলীম হোক।  ইসলামি শরীয়ত শেয়ার বাজার পরিচালিত করতে চাইলে এ নীতিমালা কেমন হবে। বর্তমানে যে শেয়ার বাজার চালু আছে তা কি ইসলামি শরীয়ত সম্মত?

৭. কুরাআন, হাদিস, ইসলামি বিভিন্ন গ্রন্থ সফট কপি করে কম্পিউটারের মাধ্যমে পড়া জায়েয হবে কি? এই সকল গ্রন্থ ইন্টারনেটের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া কতটুকু শরীয়ত সম্মত?

এভাবে হাজার হাজার সমস্যার সমাধান সরাসরি কুরআন হাদিসে নেই। তাই মুজতাহিদ আলেমগন এই সকল সমসাময়িক বিষয়ের সমাধান কুরাআন সুন্নার মাধ্যমে সমাধান দিবেন। কারণ কুরাআন সুন্নার এর মুলনীতি নিহীত আছে। যেমনঃ টিবি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ইত্যাদি ইসলামি শরিয়তের পর্দার বিধান মাথায় রেখে কিয়াস করবেন। ব্যাংকিং, জীবনবিমা, শেয়ার বাজার ইত্যাদি ইসলামি শরিয়তের সুদ ও ব্যবসার বিধান মাথায় রেখে কিয়াস করবেন। এমনিভাবে চলমান কাজ কর্মকে কুরাআন সুন্নায় বর্ণিত বিধানের আলোকে সমাধান করে নেয়াই কিয়াস করার মুল উদ্দেশ্য। কিয়াস মানে ইসলামের সমান্তার নতুন কোন দ্বীন দাড় করা নয়।

যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের প্রয়োজনের পরিবর্তন ঘটে। দেখা যায় নতুন সমস্যা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম এর ওফাত থেকে আজ অবধী এমন অনেক সমস্যা ছিল যা কুরআন হাদিসে সরাসরি উল্লেখ নেই কিন্তু কুরআন হাদিসের মুল বিষয়টি উল্লেখ আছে। তখন মুজতাহিদ আলেমগন কুরআন সুন্নাহর দলিলের উপর ভিত্তি করে কিয়াস করেছেন যা ইসলামি শরীয়তের প্রধান চারটি উৎসের একটি। যেমনঃ বর্তমান যুগে হিরোইন, গাজা, কোকেন, ইয়াবা, ফেন্সিডিল ও আফিমসহ অনেক মাদকদ্রব্য আবিষ্কারিত হয়েছে। সরাসরি এ সকল মাদক দ্রব্য হারামের কথা কুরআন সুন্নাহে নেই কিন্তু এর ব্যাপারে মুলনীতি বর্ণিত আছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

 يَـٰٓأَيُّہَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡخَمۡرُ وَٱلۡمَيۡسِرُ وَٱلۡأَنصَابُ وَٱلۡأَزۡلَـٰمُ رِجۡسٌ۬ مِّنۡ عَمَلِ ٱلشَّيۡطَـٰنِ فَٱجۡتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ (٩٠) 

অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরসমূহ এ সমস্তই হচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানী কার্যকালাপ৷ এগুলো থেকে দূরে থাকো, আশা করা যায় তোমরা সফলতা লাভ করবে (সুরা মায়েদা ৫:৯০)

কিন্তু পরবর্তীতে মুজতাহিদ্গণ চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে এটি আবিষ্কার করলেন যে, হিরোইন, গাজা, আফিম ইত্যাদি মদের ন্যায় একটি খারাপ ও জঘন্য কাজ, যা মানুষের ভিতর নেশার উদ্রেক সৃষ্টি করে তাই তা মদের ন্যায় হারাম হিসেবে বিবেচিত হবে।

অনুরূপভাবে সমকামিতার ব্যাপারে কুরআন-হাদীসে তেমনকিছু উল্লেখ করা হয় নাই। তাই এই ব্যাপারে কুরআন-হাদীসের ভিতর কোন সঠিক দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায় না। মহান আল্লাহ বলেন,

 وَلَا تَقۡرَبُواْ ٱلزِّنَىٰٓ‌ۖ إِنَّهُ ۥ كَانَ فَـٰحِشَةً۬ وَسَآءَ سَبِيلاً۬ (٣٢) 

অর্থঃ তোমরা যিনার কাছেও যেয়ো না, ওটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য পথ (সূরা বনী-ঈসরাইল ১৭:৩২

পরবর্তীতে মুজতাহিদ্গণ চিন্তা-গবেষণা আবিষ্কার করলেন যে, সমকামিতা ব্যভিচারের মত একটি অশ্লীল ও পাপপূর্ণ একটি কাজ। তাই এটিও ব্যভিচারের মত হারাম।

***  ইজমা ও কিয়াস শুধু সমস্যার সমাধান দেন, কোন আমল সৃষ্ট করে নাঃ

ইজমা ও কিয়াসের আলোচনার আলোক জানতে পারলাম, ইজমা ও কিয়াস নতুন কোন আমল সৃষ্টি করে না। ইহা নতুন কোন আমলের পদ্ধতিও আবিস্কার করে না। এমনিভাবে কুরআন হাদিসের প্রমানিত কোন আমলকে হ্রাস বা বৃদ্ধিও করেনা।

***  ইজমা ও কিয়াসের মুল উদ্যেশ্য হলোঃ

১। বিজ্ঞানের আবিস্কারের ফলে প্রতি নিয়তো নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কুরআন হাদিসের আলোকে এর সমাধান প্রদান করা। যেমনঃ মোবাইল ফোনে কুরআন পড়া, ইন্টার নেট বা টিভিতে দ্বীন প্রচার করা, বিমানে বা ট্রেনে সালাত আদায় করার বিধান ইত্যাদি।

২। জীবন জিবীকার কারনে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কুরআন হাদিসের আলোকে এর সমাধান প্রদান করা। যেমনঃ ইসলমি ব্যাংকি, ইসলামি বীমা, শেয়ার বাজার ইত্যাদি।

ইসলামি শরীয়তে সালাতে নির্দষ্ট পদ্ধতি আছে, নিয়ম কানুন আছে। যাকাত, হজ্জ, সিয়াম প্রতিটি ইবাদতের নির্দষ্ট নিয়ম কানুন বা পদ্ধতির বিন্দু মাত্র বাহিরে গেলে আমলটি গ্রহনীয় হবেনা। ইজমা কিয়াস দ্বারা এমনভাবে নতুন পদ্ধতির কোন আমল আবিস্কার করা যাবে না। ইজমা কিয়াস দ্বারা শুধু জায়েজ, নাজায়েজ, হালাল, হারাম নির্ধারন করা যাবে। যেমন, মোবাইল ফোনে কুরআন পড়া যাবে, ইন্টার নেট বা টিভিতে দ্বীন প্রচার করা যাবে, ইসলমি ব্যাংকি জায়েজ, সুদ ভিত্তিক ব্যাংকি নাজায়েজ ইত্যাদি। ইহার দ্বারা শুধু হারাম হামার নির্ধারন করা হল, নতুন কোন ইবাদত আবিস্কার করা হল না। ইজমা ও কিয়াসের সম্পর্ক হালাল হারামের সাথে ইবাদতে সাথে নয়। কাজেই ইমজা কিয়াস করা বিদআত নয়।

*** আমলের ক্ষেত্রে কোন যুক্তি গ্রহণ যোগ্য নয়ঃ

পূর্বের আলোচনায় দেখতে পেলাম কিয়াস করে আমলের সদ্ধতি আবিস্কার করা বিদআত। ঠিক তেমনিভাবে দলীলবিহীন কোন যুক্তি দ্বারাও আমলের পদ্ধতি আবিস্কার করা যাবে না।

***  সালাফদের যুগের আমল কি দলীল হিসাবে গন্য করা যাবে? 

এই প্রশ্নের উত্তরের আগে আমাদের জানা প্রয়োজন সালাফদের যুগ বলতে আমরা কি বুঝি এবং সালাফ করা। সালাফ একটি আবরি শব্দ (سلف‎‎)। যার আবিধানিক অর্থ পূর্বসূরী। সালাফ ( سلف‎‎) বলতে ইসলাম ধর্মানুসারে সাধারণত নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার পরবর্তী তিন প্রজন্মকে বুঝানো হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরের তিন প্রজন্ম হলো, সাহাবী, তাবেয়ী এবং তাবে-তাবেয়ীদের যুগ। বুঝার সুবিধার্থে খুবই সংক্ষেপে সালাফদের সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা হলঃ

***  সাহাবীঃ

‘সাহাবী’ শব্দটি আরবী ভাষার ‘সুহবত’ শব্দের একটি রূপ। একবচনে ‘সাহেব’ ও ‘সাহাবী’ এবং বহুবচনে ‘সাহাব’ ব্যবহৃত হয়। আভিধানিক অর্থ সংগী, সাথী, সহচর, এক সাথে জীবন যাপনকারী অথবা সাহচর্যে অবস্থানকারী। ইসলামী পরিভাষায় ‘সাহাবা’ শব্দটি দ্বারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহান সংগী-সাথীদের বুঝান হয়ে থাকে। সাধরণত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংগী সাথীদের বুঝানোর জন্য ‘সাহেব’-এর বহুবচনে ‘সাহাবা’ ছাড়া ‘আসহাব’ ও ‘সাহব’ ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সাহাবীর উল্লেখিত সংজ্ঞাটি ইমাম বুখারী, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলসহ অধিকাংশ পণ্ডিতের নিকট সর্বাধিক সঠিক বলে বিবেচিত।

অবশ্য সাহাবীর সংজ্ঞার ক্ষেত্রে আরো কয়েকটি অপ্রসিদ্ধ মতামতও আছে। যেমন, কেউ কেউ সাক্ষাতের  স্থলে চোখে দেখার শর্ত আরোপ করেছেন। কিন্তু তাতে এমন সব ব্যক্তি বাদ পড়ে যাবেন যাঁরা মুমিন হওয়া সত্ত্বেও অন্ধত্বের কারণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চোখে দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যেমনঃ আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম (রাঃ), অথচ তিনি অতি মর্যাদাবান সাহাবী ছিলেন।

যারা ঈমান অবস্থায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং মুমিন অবস্থাতেই ইন্তেকাল করেছেন তাদেরকেই ‘সাহাবী’ বলা হয়। (কাওয়াইদুল ফিকহ, সাইয়েদ মুফতি মুহাম্মাদ আমীমুল এহসান, পৃষ্ঠা-৩৪৬)

আল্লামা ইবনে হাজার রাহ. ‘আলইসাবা ফী তাময়ীযিস সাহাবা’ গ্রন্থে সাহাবীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন: “সাহাবী সেই ব্যক্তি যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ঈমান সহকারে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং ইসলামের ওপরই মৃত্যুবরণ করেছেন।

হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেনঃ সাহাবী হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, এক বা দু’বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহচর্য অথবা তাঁর সাথে দু’একটি গাযওয়া বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ। কিছু সংখ্যক উলামায়ে উসূল ও উলামায়ে ইলমুল কালাম-এর মতে, সাহাবী হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দীর্ঘ সাহচর্য ও সুন্নাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁর পরিচিতি ও খ্যাতি। কেউ কেউ আবার বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার শর্ত আরোপ করেছেন। একদল আলিমের মতে যে ব্যক্তি বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর এক নজর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখেছেন, তিনি সাহাবী।

সাহাবীগণের সংখ্যা লক্ষাধিক। নবী-রাসূরগণের পরই তাদের মর্যাদা। কুরআন ও হাদিসে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে। তারা আল্লাহ তাআলার মনোনীত জামাআত বা কাফেলা। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِينَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ وَمِنْهُم مُّقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللَّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَضْلُ الْكَبِيرُ

অর্থঃ অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করেছি তাদেরকে যাদেরকে আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি। তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর নির্দেশক্রমে কল্যাণের পথে এগিয়ে গেছে। এটাই মহা অনুগ্রহ। (সূরা ফাতিরা ৩৫:৩২)

মহান আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা, সাহাবীগণের ঈমানকে মাপকাঠি বা কষ্টিপাথর বলে, অন্যদের সেরকম ঈমান আনার তাগিদ দিয়েছেন, যেমন মহান আল্লাহ বলেছেনঃ

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ آمِنُواْ كَمَا آمَنَ النَّاسُ قَالُواْ أَنُؤْمِنُ كَمَا آمَنَ السُّفَهَاء أَلا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاء وَلَـكِن لاَّ يَعْلَمُونَ

অর্থঃ আর যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা ঈমান আন যেমন লোকেরা ঈমান এনেছে’, তারা বলে, ‘আমরা কি ঈমান আনবযেমন নির্বোধরা ঈমান এনেছে’? জেনে রাখ, নিশ্চয় তারাই নির্বোধ। কিন্তু তারা জানে না। (সুরা বাকারা ২:১৩)

আর সাহাবাগণের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে তাদের ঈমানকে আল্লাহ অন্যদের জন্য মানদন্ড বানিয়েছেন। তাদের কিছু প্রশংসনীয় গুণাগুণ মহান আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করে বলেনঃ

مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاء عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاء بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِم مِّنْ أَثَرِ السُّجُودِ

অর্থঃ মুহাম্মদ আল্লাহর রসূল এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সেজদারত দেখবেন। তাদের মুখমন্ডলে রয়েছে সেজদার চিহ্ন। (সুরা ফাতহ ৪৮:২৯)

তাদের এসবগুণাগুণ শুধু কুরআনে না বরং তাওরাত, ইনজীলেও এসকল বৈশিষ্ট্য বর্ণিত ছিল। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, আল্লাহর বাণীঃ

وَالسَّابِقُونَ الأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللّهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

অর্থঃ আর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তারা সেখানে চিরস্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য। (সূরা তাওবা ৯:১০০)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মাতের সর্বোত্তম মানুষ আমার যুগের মানুষ (সাহাবীগণ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগ। (সহিহ বুখারী ৩৬৫১)।

এরূপ আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালমন্দ কর না। তোমাদের কেউ যদি উহুদ পর্বত পরিমাণ সোনা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর, তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ-এর সমপরিমাণ সওয়াব হবে না। (সহিহ বুখারী ৩৬৭৩, সহিহ মুসলিম ২২২, ৬৫৪১)

আবূ নাজীহ্ আল-‘ইরবাদ ইবন সারিয়াহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক বক্তৃতায় আমাদের উপদেশ দান করেন যাতে আমাদের অন্তর ভীত হয়ে পড়ে ও আমাদের চোখে পানি এসে যায়। আমরা নিবেদন করিঃ হে আল্লাহর রাসূল! মনে হচ্ছে বিদায়কালীন উপদেশ; আপনি আমাদেরকে অসীয়াত করুন। তিনি বললেনঃ “আমি তোমাদের মহান আল্লাহকে ভয় করতে অসীয়াত করছি, আর আনুগত্য দেখাতে অসীয়াত করছি; যদি কোন গোলামও তোমাদের শাসক হয় তবুও। তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা অনেক মতবিরোধ দেখবে; সুতরাং তোমরা আমার সুন্নাত ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদ্বীনের পদ্ধতি মেনে চল, তা দাঁত দিয়ে (অর্থাৎ খুব শক্তভাবে) ধরে রাখ; আর অভিনব বিষয় সম্পর্কে সাবধান থাক, কারণ প্রত্যেক অভিনব বিষয় হচ্ছে বিদ’আত, প্রত্যেক বিদ’আত হচ্ছে গোমরাহী এবং প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণাম হচ্ছে জাহান্নামের আগুন। (আবূ দাউদ ৪৬০৭, ও তিরমিযী ২৬৬) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, হাদিসটি হাসান সহিহ)।

সাহাবীদের পরস্পরের মধ্যে মর্যাদা হিসেবে স্তরভেদ থাকতে পারে, কিন্তু পরবর্তী যুগের কোন মুসলমানই, তা তিনি যত বড় জ্ঞানী, গুণী ও সাধক হোন না কেন কেউই একজন সাধারণ সাহাবীর মর্যাদাও লাভ করতে পারেন না। এ ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ্‌ এবং ইজমা একমত। কুরআন ও হাদীসে সাহাবাগণের মর্যাদা ও বিশেষত্ব অনেক বেশী পাওয়া যায়। তা থেকে অনেক সংক্ষেপে তা থেকে বর্ণনা করা হল। তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরণ ও অনুকরনে প্রথম সারীর মানুষ ছিলেন। তাদের অনুসরনেই হক তাদের কথা কাজ সব কিছুই ইশলামী শরীয়তের দলীল হিসাবে গন্য করা হয়ে থাকে।

***  তাবেয়ীঃ

যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগের পরে এসেছেন এবং তাকে দেখেননি। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গ পেয়েছেন তারা হলের তাবেয়ী। উলুমুল হাদিস এর পরিভাষায় তাবেয়ী হচ্ছেন, যিনি সাহাবীর সাক্ষাত পেয়েছেন তিনি তাবেয়ী। বিশুদ্ধ মতানুযায়ী, এর জন্য দীর্ঘদিনের সঙ্গ শর্ত নয়। অতএব, যিনি সাহাবীর সাক্ষাত পেয়েছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন তিনিই তাবেয়ী। তাবেয়ীর মধ্যে উত্তমতার স্তরভেদ রয়েছে।

 হাফেয ইবনে হাজার (রহঃ) ‘নুখবাতুল ফিকার’ (৪/৭২৪) গ্রন্থে বলেনঃ  তাবেয়ী হচ্ছেন- যিনি সাহাবীর সাক্ষাত পেয়েছেন। ইবনে কাছির (রহঃ)  বলেন, খতিব আল-বাগদাদী বলেন, তাবেয়ী হচ্ছেন যিনি সাহাবীর শিষ্য ছিলেন। হাকেমের বক্তব্যের দাবী হচ্ছেঃ যিনি সাহাবীর সাক্ষাত পেয়েছেন তাকে তাবেয়ী বলা যাবে। তাঁর থেকে এ কথাও বর্ণিত আছে যে, যদিও সাহাবীর শিষ্যত্ব না পেয়ে থাকুক না কেন?

তাবেয়ীগণের উদাহরণ হচ্ছেঃ সাঈদ ইবনে আল-মুসায়্যিব, উরওয়া ইবনে যুবাইর, হাসান বসরী, মুজাহিদ ইবনে জাবর, সাঈদ ইবনে যুবায়ের, ইবনে আব্বাসের ক্রীতদাস ইকরিমা, ইবনে উমরের ক্রীতদাস নাফে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পর ১০ হিজরী থেকে রাদিয়াল্লাহ আনহদের  যুগ শুরু হয়। তাবেঈগন যেহেতু সাহাবীর নিকট হাদীস শিক্ষা গ্রহন করেন তাই তাদের আর সাহাবি যুগ একসাথে যুগপথ চলতে থাকে। ঐতিহাসিকদের মতে সর্বশেষ তাবেঈ ১৬৪ থেকে ১৭৪ হিজরি সালের মধ্যে মারা যান। কাজেই তাবেঈদের যুগ ১৭৪ হিজরী পর্যান্ত ধরে নিতে পারি। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই জম্ম গ্রহন করলেই তাবেঈ হবেনা। কারন তাবেঈ হলেন তিনি, যিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোন সাহাবীর নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন অথবা অন্ততপক্ষে তাঁকে দেখেছেন এবং মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে তাবেঈ বলা হয়।

***  তাবে-তাবেয়ীঃ

তাবে-তাবেঈ বলতে বুঝি, যিনি কোন তাবেঈ এর নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন অথবা অন্ততপক্ষে তাঁকে দেখেছেন এবং মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে তাবে-তাবেঈ বলা হয়। তারা  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণের সাক্ষাত লাভ করেনি। বরং তাদের ছাত্র তাবেয়ীগণের সাক্ষাত লাভ করেছেন এবং তাঁদের সঙ্গ পেয়েছেন। সকল সাহাবি রাদিয়াল্লাহ আনহু’গন ১১০ হিজরীর মধ্যেই মারা যান। অপরপক্ষে তাবে-তাবেঈগন যেহেতু তাবেঈগনদের নিকট হাদীস শিক্ষা গ্রহন করেন, তাই তাদের আর তাবেঈদের যুগ একসাথে যুগপথ চলতে থাকে। ঐতিহাসিকদের মতে সর্বশেষ তাবেঈ ১৬৪ থেকে ১৭৪ হিজরি সালের মধ্যে মারা যান। কাজেই তাবে-তাবেঈদের যুগ ১৭৪ হিজরী থেকে শুরু হয় বলে ধরে নিতে পারি। কারো কারো মতে, প্রথম হিজরী শতকের সমাপ্তিতে তাবেঈ যুগেরও সমাপ্তি হইয়া যায়। কিন্তু তাবে-তাবেয়ীনের যুগ ঠিক কখন শুরু হইল এবং কখন শেষ হইয়া গেল, সন তারিখের ভিত্তিতে তাহা বলা কঠিন। এতদসত্ত্বেও প্রকৃত কথা এই যে, তাবে-তাবেঈনের আসল যুগ দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথম চতুর্থাংশে সূচিত হইয়া তৃতীয় শতকের প্রথম চতুর্থাংশ পর্যন্ত শেষ হইয়া যায়। অর্থাৎ ১১০ হিজরীতে যখনই সর্বশেষ সাহাবী মারা গেলেন তখনি তাবেয়ীদের ছাত্র তাবে-তাবেঈদের যুগ শুরু হল। তাবে-তাবেয়ী হওয়ার যোগ্যতা ১৭৪ হিজরিতে শেষ হয়ে যার। তার পর তাবে-তাবেয়ীগন যত দিন বেচে ছিলেন ঠিক তত দিনই তাদের যুগ ছিল এ হিসাবে তাদের যুগ কম বেশী ২২০ হিজরী পর্যান্ত স্থায়ী ছিল তাবে-তাবেঈদের যুগে হাদীসের চর্চা, প্রচার ও সংগ্রহ পূর্বাপেক্ষাও অধিক ব্যাপক ও গভীরভাবে চলে।

তাবে-তাবেয়ীদের যুগে অনেকে ইলমে হাদীসে অনেক বুৎপত্তি  এবং খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাদের মাঝে ফিকহি মতভেদ থাকা সত্বেও তারা কেন মতবিরোধ করেনি? তাবে-তাবেয়ীগন যত দিন বেচে ছিলেন ঠিক তত দিনই তাদের যুগ ছিল এ হিসাবে তাদের যুগ কম বেশী ২২০ হিজরী পর্যান্ত স্থায়ী ছিল যে সকল তাবে তাবেয়ী আলেমে দ্বীন যারা ২২০ হিজরী পর্যান্ত বেচে ছিলেন তাদের কিছু নাম উল্লেখ করছি

এই তিন যুগের মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও কর্ম পদ্ধতি সঠিক ছিল। এ বিষয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছেঃ

ইমরান ইবনে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম যুগ হল আমার সাহাবিদের যুগ। অতঃপর তৎপরবর্তী (তাবেয়িদের) যুগ। ইমরান বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর যুগের পর উত্তম যুগ হিসাবে দুই যুগ উল্লেখ করেছেন, না তিন যুগ তা আমার জানা (স্মরণ) নেই।’ অতঃপর তোমাদের পর এমন এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা সাক্ষ্য দেবে অথচ তাদেরকে সাক্ষী মানা হবে না। তারা খেয়ানত করবে এবং তাদের নিকট আমানত রাখা যাবে না। তারা আল্লাহর নামে মানত করবে কিন্তু তা পুরা করবে না। আর তাদের দেহে স্থূলত্ব প্রকাশ পাবে। (সহিহ বুখারি ২৬৫১, ৩৬৫০, ৬৪২৮, ৬৬৯৫, মুসলিম ২৫৩৫, তিরমিযি ২২২১, ২২২২, নাসায়ি৩৮০৯, আবু দাউদ ৪৬৫৭, আহমদ ১৯৩১৯, ১৯৩৩৪, ১৯৪০৫, ১৯৪৫১)।

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃনাবী (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “আমার যুগ হচ্ছে সর্বোত্তম যুগ, তারপর তাদের পরবর্তী যুগ, তারপর তাদের পরবর্তী যুগ। তারপর এরূপভাবে মিথ্যার প্রসার ঘটবে যে, কারো নিকট সাক্ষ্য তলব না করা হলেও সে সাক্ষ্য দিবে, শপথ করতে বলা না হলেও শপথ করবে”। (তিরমিজী ২৩০৩, সহীহ, মাজমাউয যাওয়াইদ (১০/১৯)। মমন

মন্তব্যঃ উপরের আলোচনা দ্বারা বুঝা যায় সালাফ ( سلف‎‎) তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরবর্তী তিন প্রজন্মদের আমল আখলাকে দলীল হিসাবে গ্রহন করা যেতে পারে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরের তিন প্রজন্ম সাহাবী, তাবেয়ী এবং তাবে-তাবেয়ী এদের অধিকাংশই হকের উপর ছিল। তারা দলীল প্রমানের উপরই আমল করার চেষ্টা করছেন। তারপরও যদি তাদের কোন আমল সরাসরি কুরআন সুন্নাহর বিপরীত যায় তবে তার পরিত্যাজ্য। কারন তাদের সকলের নিকট দ্বীন সমানভাবে পৌছায় নি, তারা না জেনে অথবা মর্ম না বুঝে আমলে করছেন। সহিহ সুন্নাহ জানার পর তারা পরিত্যাগ করেছেন একথা ভাবাও যায় না। এই তিন যুগের সালাফদের নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে বর্তমান যুগের অধিকাংশ আলেমদের মতামত হলো তরা হকের উপর ছিলেন এবং তাদের আমল দলীল হিসাবে গন্য। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, নবী রাসূল ব্যতিত কেউ মহান আল্লাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, কাজেই তাদের দ্বারা ভুল করা বা ভুল হওয়াও একটি সাভাবিক ঘটনা। এই কথা মাথায় রেখেই সালাফদের অনুসরণ করতে হবে। তাদের আমলের বীপরিত আমল যে বিদআত তাতে কোন সন্দেহ নেই। কাজেই এই তিন যুগে যে আমল ছিলনা তা সন্দেহাতীতভাবে বিদআত।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment