মৃত্যু কেন্দ্রিক বিদআত তৃতীয় কিন্তি

মৃত্যু কেন্দ্রিক বিদআত তৃতীয় কিন্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

২৫। গোরস্থানে জুতা বা সেন্ডেল পায়ে হাঁটাঃ

কবরস্থানে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া জুতা-সেন্ডেল পায়ে হাঁটা উচিৎ নয়।

বাশীর ইবনে খাসাসিয়া রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে হাঁটছিলাম। তিনি মুসলিমদের কবরস্থানে আসলেন। চলতে চলতে হঠাৎ দেখতে পেলেন এক ব্যক্তি জুতা পায়ে কবর গুলোর মাঝ দিয়ে হাঁটছে। তখন তিনি তাকে ডেকে বললেন, হে জুতাধারী, তুমি জুতা খুলে ফেল। সেই ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চিনতে পেরে জুতা খুলে ফেলে দিল। (আবুদাউদ ৩২৩০; ইবনু মাজাহ ১৫৬৮, তিরমিজি। হাকেম বলেন, হাদীসটির সনদ সহিহ, ইমাম নব্বী বলেন, হাদীসটির সনদ হাসান। এই হাদিসটি নাসাঈ শরীফে এমনিভাবে উল্লেখ আছে।

বশীর ইব্‌ন খাছাছিয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি একবার রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে চলতে ছিলাম। তিনি মুসলমানদের একটি কবরস্থানে গিয়ে বললেন যে, এরা বহু মন্দ কাজ পরিত্যাগে অগ্রগামী হয়েছে। অত:পর তিনি মুশরিকদের একটি কবরস্থানে গিয়ে বললেন যে, এরা বহু মঙ্গলময় কাজ পরিত্যাগে অগ্রগামী হয়েছে। অত:পর তিনি অন্যদিকে লক্ষ্য করে দেখলেন যে, এক ব্যক্তি জুতা পায়ে কবরস্থানে মাঝখান দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। তখন তিনি বললেন, “হে পাকা জুতা পরিধানকারী, জুতা ফেলে দাও (খুলে নাও)। (নাসাঈ হাদিস নম্বর ২০৪৮)

কবর স্থানের একটু দুর দিয়ে জুতা পায়ে হাটা যাবে। যেমন একটি সহিহ হাদিসে আছে।

রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “বান্দাকে যখন কবরে রাখা হয় এবং লোকজন প্রত্যাবর্তন করে ও চলে যায়। তখন সে অবশ্যই লোকদের জুতার পদধ্বনি শুনতে পায়। (সহিহ বুখারী ১৩৩৮, সহিহ মুসলিম ২৮৭০)।

মন্তব্যঃ কাজেই কবর স্থানের উপর জুতা বা সেন্ডেল পায়ে হাঁটা যাবে না। ওজর বসত কবর স্হানে কষ্টদায়ক কিছু থাকলে জুতা-স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে যাওয়া যাবে। তবে না যাওয়াই উত্তম।

২৬। মৃতকে কবরে রাখার সময় বা পরে আযান দেওয়াঃ

অনেক জাহেল মানুষ মৃতকে কবরে রাখার সময় বা পরে আযান দেয়। ইসলাম সম্পর্কে সামন্য ধারনা থাকলে এ কাজ করতে পারে না। কোন কাজে করলে মহান আল্লাহ খুশি হবেন এতটুকু জানা ঈমানের দাবী। মৃতকে কবরে রাখার সময় বা পরে আযান দেওয়া বিষয়ে কোনো সহিহ, যঈফ বা জাল হাদিস বর্ণিত হয় নাই। এরূপ কোনো আমল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা কোনো সাহাবীগন করেন নাই। এমনকি নামাযের ওয়াক্ত ছাড়া অন্য কোনো কারণে আযান দেয়ার কোনো প্রকারের ফযীলতও কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি। (হাদিসের নামে জালিয়াত, ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীল)

২৭। চার কুল পড়তে পড়তে খেজুরের তাজা ডাল পুতে দেয়াঃ

 অনেক এলাকায় প্রচলন আছে, মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর, চার ব্যক্তি কবরের চার কোণে দাঁড়িয়ে চার কুল (অর্থাৎ সূরা কাফিরুন, ইখলাস, ফালাক, নাস) পড়ে। তারপর তারা কবরের চার কোণে চারটি তাজা ডাল পুঁতে দেয়। কোথাও কবরের চার কোণায় চারটি খুঁটি গেড়ে দিতে দিতে চার কুল পড়ে এবং চার খুঁটিতে সুতা পেঁচায়। তবে সবচেয়ে বেশী প্রচলিত কুল পড়ে খেজুরের চারটি কাচা ডাল পুতে দেয়ার। আবার কেউ বলল, তাদের এলাকায় চারটি কঞ্চি হাতে চার কুল পড়ে কঞ্চি চারটি কবরের উপর রাখে।

এই সকল বিদআত যারা করে তাদের ধারনা, ইহার ফলে কবর আজাব লাঘব হবে। ইহা একটি মনগড়া রসম যার কোনো ভিত্তি ইসলামি শরীয়তে নাই। কোনো হাদিসে বা সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে এ আমলের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং তা বর্জনীয়। এজাতীয় মনগড়া কোনো রসমের পিছে না পড়ে প্রমাণিত কোনো আমল করা উচিৎ। যেমন দাফন শেষে মায়্যেতের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা এবং কবরের সুওয়াল জওয়াব সহজ হওয়ার জন্য দুআ করা। যারা এই বিদআত কর্মটি করেন তারা অনেক সময় সহিহ বুখারির একটি হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে থাকেন। পাঠকদের সুবিধার জন্য হাদিসটি উল্লেখ করছি।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যে কবর দু’টির বাসিন্দাদের আযাব দেওয়া হচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, এদের দু’জনকে আযাব দেওয়া হচ্ছে অথচ তাদের এমন গুনাহর জন্য আযাব দেওয়া হচ্ছে না (যা থেকে বিরত থাকা) দুঃরূহ ছিল। তাদের একজন পেশাবের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করত না আর অপরজন চোগলখুরী করে বেড়াত। এরপর তিনি খেজুরের একটি তাজা ডাল নিয়ে তা দু’ভাগে বিভক্ত করলেন, তারপর প্রতিটি কবরে একটি করে পুঁতে দিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কেন এরূপ করলেন? তিনি বললেনঃ ডাল দু’টি না শুকান পর্যন্ত আশা করি তাদের আযাব হালকা করা হবে। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১২৭৮ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ আমাদের নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট অহী আসত। তাকে মহান আল্লাহ অহীর মাধ্যমে জানালেন যে, কবরে আজাব হচ্ছে। মহান আল্লাহ কবরের আজাব হালকা হওয়ার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খেজুরের ডাল পুতে রাখতে বললে। এই ঘটনা ছিল আমাদের নবী এর জন্য খাসছিল। যদি এই উম্মতের জন্য আমভাবে আমল করার মত হত তবে এই উম্মতের সবচেয়ে বেশী আমলকারি সাহাবিগন নিশ্চই ছেড়ে দিতেন না। কিন্তু অনেক অনুসন্ধানের পরও দেখা যায় তাদের এই ধরনের আমলের কোন সহিহ, যঈফ বা জাল বর্ণনা নাই। এ সবই হল আমাদের সমাজের কিছু অজ্ঞ লোকের আবিস্কার করা বিদআতি কাজ। 

২৮। মৃত্যুর পরপরই মাগফিরাতের বাড়ীতে বা কবরস্থানে সাদাকা প্রদান করঃ

মৃত্যুর পরপরই মাইয়াতের মাগফিরাতের জন্য ঐ দিন তার বাড়ীতে বা কবরস্থানে সাদাকা প্রদান করে। হাদীস শরীফে সন্তানকে তার মৃত পিতামাতার জন্য দান-সাদকা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই দান করার কোন নির্দিষ্ট সময় বা স্থান হাদিস বর্ণিত হয় নাই। তাই যদি কেউ মনে করে মাইয়াদের মৃত্যু দিনে বা তার কবরের নিকট দান করলে অতিরিক্ত সাওয়াব বা সুবিধা আছে তবে বিদআত হবে। কোন সাহাবী মৃত্যুর দিন বা করবের নিকট দান করছেন বলে প্রামা পাওয়া যায় না। বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকে মাইয়াতের জন্য দান করলে সমান নেকী বা সওয়াব হবে।  দানকে বিনা দলীলে সময়ের সাথে বা স্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট করা বিদআতী কাজ।  মৃত্যুর পরপরই ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে চাউল ও টাকা-পয়সা বিতরণ করা

২৯। মৃতের কাজা সালাতের জন্য কাফ্ফারা আদায় করাঃ

হানাফি মাজহাবের একটি ফতওয়ার কিতাবের রেফারেন্সে বলা হলঃ

যদি মৃত ব্যক্তি তার সম্পদ থেকে তার নামাযের কাফফারা আদায়ের জন্য অসিয়ত করে যায়, আর তার নিজের মালও ছিল তাহলে তার এক তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে কাফফারা আদায় করতে হবে আর যদি তার কোন সম্পদ না থাকে, বা সে মাল রেখে গেছে কিন্তু কোন কাফফারা আদায়ের অসিয়ত করে যায়নি তাহলে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কাফফারা আদায় করা আত্মীয়দের উপর জরুরী নয় তবে স্বজনদের কাফফারা আদায় করে দেয়াই উত্তম এর দ্বারা মৃত ব্যক্তি শান্তি পায়

কাফফারার পরিমাণ হল, প্রতিদিন বিতরসহ ছয় ওয়াক্ত নামায হিসেব করে প্রত্যেক ওয়াক্তের জন্য পৌনে দুই সের গম বা আটা অথবা এর বাজার মূল্য গরীব মিসকিনকে মালিক বানিয়ে দিতে হবে অথবা প্রতি ওয়াক্তের বদলে একজন গরীবকে দুই বেলা তৃপ্তি সহকারে খানা খাওয়াতে হবে (ফতাওয়া শামী/৭২, লিখেছেনঃ লুৎফুর রহমান ফরায়েজী, পরিচালক, তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা)

মুসলিম ইচ্ছা করে সালাত কাযা করবে ভাবা যায় না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে সালাত কাযাতো দুরের কথা প্রকাশ্য মুনাফিকও সালাতের জামাত ত্যাগ করার সাহস পেত না। কিন্তু ওজরের কারনে সাহাবীদেরও সালাত কাযা হয়েছে। যেমনঃ

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খন্দকের যুদ্ধকালে এক সময় উমর (রাঃ) কুরাইশ কাফিরদের ভর্ৎসনা করতে লাগলেন এবং বললেন, সূর্যাস্তের পূর্বে আমি আসরের সালাত আদায় করতে পরি নাই। তারপর আমার বুতহান উপত্যকায় উপস্থিত হলাম। সেখানে তিনি সূর্যাস্তের পর সে সালাত আদায় করলেন, তারপরে মাগরিবের সালাত আদায় করলেন। (সহিহ বুখারী ৫৭১ ইফাঃ)।

যদি কারও সালাত কাযা হয তা সাথে সাতে আদায় করাই সুন্নাহ সম্মত। সহিহ হাদিসে এসেছে সালাতের কাফফারার প্রয়োজন নাই। যেমনঃ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যাক্তি সালাতের কথা ভুলে যায়, স্মরণ হওয়া মাত্র সে তা আদায় করে নেবে। এর কোন কাফফারার প্রয়োজন নেই। বরং আদায় করাই কাফফারা। কাতাদা (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, أَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي “আমার স্মরণে সালাত কায়েম কর। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ১৪৩৯ইফাঃ)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন কাফফারা নাই আর আমরা বুঝলাম আছে। কাজেই যারা সালাতের কাফফারার কথা বলেন তাদের কথায় কর্নপাত করার দরকার নাই।

এ কথা সুস্পষ্ট হয় যে, মরণের সময় অথবা পরে বেনামাযী অথবা কিছু নামায ত্যাগকারীর তরফ থেকে নামায-খন্ডনের উদ্দেশ্যে রাকআত হিসাব করে কাফফারা স্বরূপ কিছু দান-খয়রাত ইত্যাদি করা নিরর্থক ও নিষ্ফল। বরং এই উদ্দেশ্যে পাপ-খন্ডনের ঐ অনুষ্ঠান ও প্রথা এক বিদআত। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক -২৯৬ পৃষ্ঠা, আহ্‌কামুল জানাইয, আলবানী ১৭৪, ২৭৫ পৃষ্ঠা, মুজামুল বিদা’ ১৬৪ পৃষ্ঠা)।

অনেক আলেম মনে করেন বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃত নামায ছেড়ে দিলে তার কাযা হয় না। কাযা হবে ওজরের কারনে সালাত ত্যাগ করলে। তাদের দাবি হল, বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃত সালাত ছেড়ে দিলে বা সুযোগ ও সময় থাকা সত্ত্বেও না পড়ে অন্য ওয়াক্ত এসে গেলে পাপ তো হবেই। পরন্তু সে সালাতের আর কাযা নেই। পড়লেও তা গ্রহণযোগ্য নয়। (কারণ এমন দৃষ্টান্ত, সাহাবায়ে কেরামগণ হতে প্রমাণিত নেই) বিনা ওজরে যথাসময়ে সালাত পড়ে অন্য সময়ে কাযা পড়ায় কোন লাভ নেই। বরং যে ব্যক্তি এমন করে ফেলেছে তার উচিৎ, বিশুদ্ধচিত্তে তওবা করা এবং তারপর যথাসময়ে নামায পড়ায় যত্নবান হওয়ার সাথে সাথে নফল নামায বেশী বেশী করে পড়া। (মুহাল্লা, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/২৪১-২৪৩, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ৭৮পৃ:, ১নং টীকা, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৫/৩০৬, ১৫/৭৭, ১৬/১০৫, ২০/১৭৪, মিশকাত ৬০৩ নংহাদীসের আলবানীর টীকা দ্র:)

প্রশ্ন হলঃ কেউ সালাত কাযা করে মারা গেলে তার বিধান কি? 

যদি কেউ মারা যায়, আর জিম্মায় কোন ফরয নামায কিংবা একাধিক ফরয নামায বাকি থাকে, সেই ক্ষেত্রে তার এই নামাযের কাযা বা কাফফারার বিধান ইসলামে নেই। কেননা ইবাদাতের বেলায় নিয়ম হলো, কোন প্রতিনিধির দ্বার কোন ইবাদত আদায় করা জায়েয নেই। তবে হ্যাঁ শরীয়ত যেখানে প্রতিনিধির দ্বারা ইবাদত শুদ্ধ হওয়ার কথা প্রমাণিত আছে, একমাত্র সেই ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হবে। যেমন হজ্জ বা মান্নাত রোযা। কিন্তু ফরজ সালাতের  বিষয়ে প্রতিনিধি বা কাফফারা দিয়ে আদায় হওয়ার বিষয়ে কোন প্রমাণ কুরআন বা হাদীসে বর্ণিত হয়নি। সালাত কখনই মাফ হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত তার হুঁশ জ্ঞান ঠিক থাকে। এমন অসুস্থ যে তার হুঁশ-জ্ঞান নাই, তখন তার সালাত এমনিতেই মাফ। কারন কাযা আদায় করার সময় ও সুযোগ না পেলে কোন পাপ হবে না। ধরূন কোন ব্যক্তির কাযা সালাত আদায় করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু পার নাই। কাযা আদায়ের পূর্বে হঠাৎ তিনি মারা গেলেন। তার কি হবে? মহান আল্লহ বলেন,

لاَ يُكَلِّفُ اللّهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا

অর্থঃ আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না। (সুরা বাকার ২:২৮৬)।

তাই যে ব্যক্তি বীনা ওজরে সালাত আদায় না করে মারা গেল, তার জন্য দোয়া, ইস্তেগফার করবে, তার কোন অসিয়ত থাকলে তা আদায় করবে, তার বন্ধু-বান্ধবের এবং আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়ন করবে। পিতা-মাতার জন্য সন্তানের প্রধান দায়িত্ব হলো, দোয়া করা, এবং সদকায়ে জারিয়া, বা ওয়াকফ জাতীয় দান করা। কারণ,  আবু হুরায়রা (রাঃ),রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মানুষ যখন মারা যায়, তখন সমস্ত আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের দরজা বন্ধ হয়না। সাদকায়ে জারিয়া, যদি এমন সন্তান রেখে যায়, যে পিতার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবে, যদি এমন দ্বীনি শিক্ষা রেখে যায়, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। [সহিহ মুসলিম ৪৩১০]

এত গেলে মৃত ব্যক্তির বিধান। জীবিত কোন ব্যক্তি যদি অজ্ঞতার কারনে বা অলসতার করানে সালাত আদায় না করে থাকে, তবে তার কি করতে হবে?

আমাদের সমাজে অনেক আলেম বলে থাকেন যে, বহু দিনের কাযা সালাত তাকে আদায করতে হবে। প্রতি ওয়াক্তে এক এক ওয়াক্তের সালাত কাযা করতে হবে। তারা এর নাম দিয়েছেন উমরী কাযা। কারণ হাদিসে উমরী কাযা বলে কোন সালাতের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কাজেই সালাত ত্যাগ কারির একমাত্র বিধান খাটি মনে তওবা করা। উমরী বলে শরীয়তে কোন নামায নেই। এই বিধায় পালন করা বিদআত। অবশ্য এই তওবাকারী ব্যক্তির উচিৎ, বেশী বেশী করে নফল সালাত আদায় করতে হবে। কারন তার ফরজের ঘারতি নফল দ্বারা আদায় করা হবে।

একটি সহিহ হাদিসে উল্লখ আছে, আনাস ইবনু হাকীম আদ-দাব্বী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, তিনি যিয়াদ অথবা ইবনু যিয়াদের ভয়ে মদ্বীনায় চলে আসেন এবং আবূ হুরায়রা (রাঃ) এর সাথে সাক্ষাত করেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) আমাকে তাঁর বংশ-পরিচয় প্রদান করেন এবং আমি আমার পরিচয় প্রদান করি তিনি আমাকে বলেনঃ হে যুবক! আমি কি তোমার নিকট হাদীছ বর্ণনা করব না? জবাবে আমি বললাম, হ্যা। আল্লাহ্ আপনার উপর রহম করুন। রাবী ইউনুস বলেনঃ আমি মনে করি তিনি এই হাদীছটি সরাসরি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন লোকদের আমলসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম তাদের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে তিনি বলেনঃ আমাদের মহান রব ফিরেস্তাদের বান্দার নামায সম্পর্কে স্বয়ং জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও জিজ্ঞাসা করা হবে। করবেন, দেখতো সে তা পূর্ণ রূপে আদায় করেছে না তাতে কোন ক্রটি আছে? অতঃপর বান্দার নামায পরিপূর্ণ হলে তা তদ্রুপই লিখিত হবে। অপর পক্ষে যদি তাতে কোন ক্রটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয় তবে তিনি (রব) ফেরেস্তাদের বলবেনঃ দেখতো আমার বান্দার কোন নফল নামায আছে কি? যদি থাকে তবে তিনি বলবেনঃ তোমরা তার নফল নামায দ্বারা তার ফরয নামাযের ক্রটি দূর কর। অতঃপর এইরূপে সমস্ত ফরয আমলের ক্রটি নফল দ্বারা দূরীভূত করা হবে। হাদিসের মানঃ সহিহ সূনান আবু দাউদ ইফাঃ, অধ্যায়ঃ সালাত হাদিস নম্বরঃ ৮৬৪, তিরমিযী-৩৩৭, ইবনে মাজাহ-১১৭, সহিহ তারগিব ১/১৮৫)

মন্তব্যঃ এক কথায় বলা যায় মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার কাযা করা সালাতের কোন কাফফারা দিতে হবে না। মৃত ব্যক্তির কাযা সালাতের কাফফারা বলে সমাজে যা প্রচলিত আছে তার পুরোটাই আন্দাসের উপর চালিয়ে দেয়া। কাজেই ধরনের সালাতের কাফফারা আদায় করা একটি বিদআতী কাজ।

 

৩০। কবর জিয়াতের জন্য দিন ক্ষন নির্দিষ্ট করাঃ

আমাদের উপমহাদেশ একটি যঈফ হাদিসের উপর ভিত্তি করে লাইলাতুল মিরাজে দল বেধে কবর জিয়ারতে জন্য যায়। অনেক দেখা যায় প্রতি জুমার দিন, জুমার সালাতের পরই কবর জিয়ারত করে থাকে। প্রতি জুমার দিন জিয়ারত করা রেওয়াজে পরিনত করে নিয়েছে। এমনিভাবে কেউ কেউ আবার আমল পেশ করার দিন সোম ও বৃহস্পতিবারে পিতা-মাতার কবর জিয়ারত করার জন্য নির্দিষ্ট করেছে। অনেককে দেখা যায় আশূরা, লাইলাতুল কদর, রামাযান ও দুই ঈদে বিশেষভাবে কবর যেয়ারত করা। কবর জিয়ারত করা একটি সুন্নাহ সম্মত নফল আমল। কোন নফল আমল করার ক্ষেত্র যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন সময়ের সাথ সম্পর্কিত না করে তবে সেই আমলটি সময়ের সাথে সম্পর্কিত করলে বিদআত হবে। তবে কেউ যদি সময়ের সাথে নির্দষ্ট না করে তবে লাইলাতুল মিরাজে, জুমার দিন, আশূরায়, লাইলাতুল কদরে, রামাযানে ও দুই ঈদের দিন কবর জিয়াত করতে পারে।

৩১। মৃত্যু-দিবস পালনঃ

আমাদের সমাজে ইদানিং মৃত্যু দিবস পালন একটি রেওয়াজে পরিনত হয়েছে। বিশেষ করে বড় বড় দলের নেতাদের মৃত্যু দিবস এমন ঘটা করে পালন করা হয় বা কাঙ্গালীভোজের আয়োজন করা হয়, তাতে মনে হয় ইহাই হল প্রকৃত নিয়ম। আসলে এটা সমাজেরই নিয়ম, ইসলামের কিছুই না। কাজেই মৃত্যু দিবস পালন একটি সামাজিক প্রথা এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এ প্রথাটি সম্পূর্ণ বিধর্মীদের। ইসলাম বা মুসলমানদের আচার নয়। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হল, মুসলিমগণ কাফেরদের অনুসরণ করে তাদের এ প্রথা মত আমল করে যাচ্ছে। ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম দিবস,মৃত্যু দিবস পালন করা এবং এ উপলক্ষে যে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয় তা হারাম এবং বিদআত। মৃত্যু দিবস পালনের কোন প্রমাণ কিংবা চর্চা রাসুল সা. কিংবা তাঁর সাহাবী (রাঃ) দের মাধ্যমে হয়েছিল বলে কোন প্রমাণ নাই।

 এমনকি নবী প্রেমের নজীরবিহীর দৃষ্টান স্থাপনকারি সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমদের কেহ এ ধরনের কাজ করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই। অসংখ্যা নবী রাসূলদের কথা আমরা জানি কই কারোতো মৃত্যু দিবস পালন করিনা। যদি ইহা ইসালামের কোন বিধান হত তবে সকল নবী রাসুল না হলেও অন্তত কুরআনে ২৫ জন নবীর মৃত্যু দিবস আল্লাহ জানিয়ে দিয়ে তা পালন করার নির্দশ দিতেন। তারপরে আসুন, খুলাফায়ে রাশেদীন ও অসংখ্য সাহাবা, মনীষি আওলিয়ায়ে কেরাম ইন্তেকাল করেছেন। যদি তাদের মৃত্যু দিবস পালন ইসলাম সমর্থিত হত বা সওয়াবের কাজ হত তাহলে বছরব্যাপী জন্ম-মৃত্যু দিবস পালনে ঘূর্ণাবর্তে আবদ্ধ হয়ে যেতে হত আমাদের সকল মুলমানদের। রাসূলুল্লাহ সা. এর সাহাবাগন ছিলেন সত্যিকারার্থে নবীপ্রেমিক ও সর্বোত্তম অনুসারী। নবী প্রেমের নজীর ও দৃষ্টান্ত তারাই স্থাপন করেছেন। তারা কখনো নবী কারীম সা. এর মৃত্যু দিবস পালন করেননি। যদি এটা করা ভাল হত ও মহব্বতের পরিচায়ক হত তবে তারা তা অবশ্যই করতেন। আর জন্মোৎসব পালন করার কালচার সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা ছিল না তা বলা যায় না। কেননা তাদের সামনেই তো খৃষ্টানরা ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জন্মদিন (বড়দিন) উদযাপন করত। তাই যদি কেউ এটাকে ধর্মীয় আচার মনে করে করে, তবে তা বিদআত হিসেবে একটা গুনাহের কাজ বলে পরিগণিত হবে। আর যদি সমাজে প্রচলিত প্রথা হিসেবে করা হয় তবে তা অমুসলিমদের অনুসরণ-অনুকরণের দোষে দুষিত হবে, যা নিঃসন্দেহে একটি মারাত্মক অপরাধ ও  বিদআত বলে পরিগনিত হবে।

৩২। মৃতের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী মাইক বাজানঃ

অনেক জাহেল শ্রেণীর মুসলিককে দেখা যায় মৃতের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বা অন্য কোন উপলক্ষে দিনভর উচ্চৈঃস্বরে তার বক্তৃতা বা কুরআনের ক্যাসেট বাজানো যা নিঃকৃষ্ট ধরনের বিদআত। ইসলাম যেখানে   মৃতের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করার অনুমতি প্রদান করে না, সেখান আর একটি অপসংস্কৃতি কিভাবে অনেমোধণ করে। নিজেদের মন মত বিদআতি আমল চালু না করে যদি কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করি তা হলে মৃত ব্যক্তির পাশাপাশি যারা তাদের জন্য আমল করবে তাদেরও উপকার হবে। যেমনঃ ধরুন মৃত ব্যক্তির নামে দান করলেন। এতে জীবিত ব্যক্তি যিনি দান করলেন তার তো নেকী হবেই, এর পর যার নামে তিনি দান করলে তাকেও নেকী পৌছান হবে। কিন্তু আমরা যারা অজ্ঞ তারা এসকল আমন না করে, ঢাকঢোল পিটিয়ে মৃতের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে দিনভর উচ্চৈঃস্বরে ইসলামি গান বা কুনআন তিলওয়াতের ক্যাসেট বাযাচ্ছি। অথচ মাইকে উচ্চৈঃস্বরে কুনআন তিলওয়াত করাও জায়েয নয়। আপনার মাইকের শব্দে হয়তে কোন অসু্স্থ রোগীর কষ্ট হচ্ছে বা অন্য কারো ইবাদাতে মনসংযোগের ব্যাঘাট ঘটছে। কাউকে কষ্ট দিয়া নফল আমলও জায়েয নয়। সে খানের আমাদের করা বিদআত দ্বারা মৃত ব্যক্তির কত টুকু উপকার হবে! আসল কথা হল কুরআন সুন্নাহর বাহিরে কোন আমলই নেকি পৌছাতে পারে না। কাজেই মৃতের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উচ্চঃস্বরে মাইকে যা করব সবই বিদআত হিসাবে পরিগনিত হবে।

৩৩। সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট মৃত কেন্দ্রিক কিছু বিদআতঃ

ক। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের সময় বদনায় পানি দিয়ে যাওয়া এই নিয়তে যে, মৃতের রূহ এসে ওযূ করে ছালাত আদায় করে যাবে।

খ। মৃতের ঘরে চল্লিশ দিন যাবৎ বিশেষ লৌহজাত দ্রব্য রাখা।
গ। মৃতের বিছানা ও খাট ইত্যাদি ৭দিন পর্যন্ত একইভাবে রাখা।

ঘ। লাইলাতুল বরাতে বুযর্গ ব্যক্তিকে ডেকে মৃতের কবর যিয়ারত করিয়ে নেওয়া।

ঙ। মৃত ব্যক্তির কক্ষে তিন রাত, সাত রাত বা চল্লিশ রাত ব্যাপী আলো জ্বেলে রাখা হয়।

চ। তিন দিন, সাত দিন, চল্লিশ দিনে, প্রতি বছরে মিলাদ ও খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা।

ছ। চল্লিত দিন পর্যান্ত বাড়ির স্ত্রী নয় এমন মহিলাদের আত্মীয়দের বাড়িতে যেতে নিষেধ করা।

৩৪। কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকদের জন্য দো‘আ করা বিদআতঃ

অজ্ঞতার কারনে অনেক মুসলিম কাফির, মুশরিক, মুনাফিকদের জন্য দো‘আ করে যা ইসলমি শরীয়ত সম্মত কাজ নয়। কারন মহান আল্লাহ এরশাদ করেনঃ

*مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُواْ أَن يَسْتَغْفِرُواْ لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُواْ أُوْلِي قُرْبَى مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ*

অর্থঃ নবী ও মুমিনের উচিত নয় মুশরেকদের মাগফেরাত কামনা করে, যদিও তারা আত্নীয় হোক একথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা দোযখী, সুরা তাওবা ৯:১১৩।

৩৫। মাটিয়াল খাওয়ানঃ

যারা কবর খনন করে ও দাফনের কাজে সাহায্য করে, তাদেরকে মৃতের বাড়ী দাওয়াত দিয়ে বিশেষ খানার ব্যবস্থা করা। যাকে কোন কোন স্থানে ‘মাটিয়াল খায়ান’ বলে আবার কোন কোন এলাকায় ‘ধোয়া খানা’ বলা হয়। আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি রুসমের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। সমাজে যে কোন ধরনের খানার বা যিয়াফতের আয়োজনের কথা তো আছে আনন্দের মুহূর্তে। কিন্তু এই খানার আয়োজন হয় মুসিবতের মুহূর্তে। অথচ একজন মুমিন মুসলীম হিসাবে এই বিপদের সময় সকলের উচিত ছিল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। যদি কেউ এমন স্থানে থাকে কেউ পারিশ্রমিক ছাড়া কাজ করে না তবে তার কথা ভিন্ন। কিন্তু আমরা যা করছি তাতো সমাজের রুসম হিসাবে। হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ আলবাজালী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা (সাহাবাগণ) দাফনের পর মৃতকে কেন্দ্র করে সমবেত হওয়া ও খাবারের আয়োজন করাকে জাহিলিয়াত যুগের ‘নিয়াহা’ বলে গণ্য করতাম। (মুসনাদে আহমদ ২/২০৪; ইবনে মাজাহ ১৬১২)।

মাইয়াতের জন্য খানার ব্যবস্থা না করে এতিমখানায় বা গরিব দুঃখিদের দান করা যেতে পারে। তাদের এই দান মৃত ব্যক্তির উপকার হবে বলে দলীল আছে। যেমনঃ

সা‘দ ইবন ‘উবাদাহ (রাঃ) এর মা তার অনুপস্থিতিতে মারা যান। পরে তিনি বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমার অনুপস্থিতিতে আম্মা মারা গেছেন। আমি যদি তাঁর জন্য কিছু সাদাকাহ করি তবে কি তা তাঁর উপকারে আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আপনি সাক্ষী, আমার মিখরাফ নামক বাগানটি তাঁর জন্য সাদাকাহ করলাম। (বুখারী, কিতাবুর ওয়াসায়া ২৫৫১)

মন্তব্যঃ সাহাবীদের সুন্নাহ সম্মত আমল বাদ দিয়া জাহেলী যুগের আমল করা কতটুকু শরীয়ত সম্মত। সমাজের চাপে বা লোক চক্ষুর ভয়ে এই ধরনের কাজ করা নিঃসন্দেহে বিদআত।

৩৬। মসজিদের পাশে কবর দেয়ায় অতিরিক্ত সুবিধা পাবেঃ 

অনেকের মাঝে ধারনা মসজিদের পাশে কবর দেয়ায় ফলে তিনি প্রতি দিন আযান শুনতে পাবেন। ইসলামি আকিদা হল মানুষ মারা যাওয়ার পর পৃথিবীর থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। জীবিত লোক যেমন তার কোন সংবাদ নিতে পারবে না, আমার তিনি জীবিত লোকদের কোন সংবাদ নিতে পাবনেনা। আযান শুনতে পাওয়াতো প্রশ্নই আসে না। অনেকর এও ধারনা করে আযান শুনে নেকী পাবে বা গোর আযাব মাফ হবে। এই ভাবে দলীল প্রমানহীণ অমুলক ধারনা থেকেই মসজিদের পাশে কবর দেওয়া জন্য অনেক তাদের স্বজনদের অছিয়ত করে যায়। অথচ মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا يَسْتَوِي الْأَحْيَاء وَلَا الْأَمْوَاتُ إِنَّ اللَّهَ يُسْمِعُ مَن يَشَاء وَمَا أَنتَ بِمُسْمِعٍ مَّن فِي الْقُبُورِ

অর্থঃ আরও সমান নয় জীবিত ও মৃত। আল্লাহ শ্রবণ করান যাকে ইচ্ছা। আপনি কবরে শায়িতদেরকে শুনাতে সক্ষম নন। (সুরা ফাতির ৩৫:২২)।

মন্তব্যঃ কাজেই মসজিদের পাশে কবর দেওয়ায় অতিরিক্ত ফায়দা আশা করি একটি ভুল বিশ্বাস। এই ধরনের কাজ করা একটি পরিস্কার বিদআত।

৩৭। জানাযার সময় স্ত্রীর নিকট দেনমোহর মাপ চাওয়াঃ

কুরআনের সুন্নাহ দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায়, দেনমোহর পুরুষের ওপর স্ত্রীর ঋন এবং এটা আদায় করা ওয়াজিব। কাজেই এই ঋন পরিশোধ করতেই হবে। স্বামীর জিম্মায় দেনমোহর আদায় না করলে তা ঋণ হিসেবে বাকি থেকে যাবে। স্ত্রী যদি উক্ত মোহরানা মাফ না করে, আর স্বামীও তা পরিশোধ না করে, তাহলে কিয়ামতের ময়দানে স্বামীর অপরাধী সাব্যস্ত হবে। তাই দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করে দেয়া জরুরী। অতএব তা আদায় না করলে স্বামী গোনাহগার হবেন এবং স্ত্রীর নিকট এই ঋণ অবশিষ্ট থেকে যাবে। তবে হ্যাঁ, যদি স্ত্রী স্বেচ্ছায় মোহরের দাবী ছেড়ে দেয়, তবে স্বামীর ওপর এর বাধ্যকতা অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু স্ত্রীকে মোহর ক্ষমা করে দেওয়ার ব্যাপারে বাধ্য করা কিংবা মোহর আদায় করতে অস্বীকৃতি জানানো- অমার্জনীয় অপরাধ। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,

*وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً ۚ فَإِن طِبْنَ لَكُمْ عَن شَيْءٍ مِّنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَّرِيئًا *

অর্থঃ আর তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশীমনে। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর। (সূরা নিসা ৪:৪)

মন্তব্যঃ আমাদের দেশে দেনমোহর সম্পর্কে প্রায় সকলেই অজ্ঞ। তাই বিবাহ সময় মোহর পরিশোধ না করার নিয়তে যে স্বামী অধিক পরিমাণ মোহর নির্ধারণপূর্বক স্ত্রীকে বিয়ে করে তার সঙ্গে দাম্পত্য জীবন শুরু করে। এই দেনমোহর যে একটা ঋন পরিশোধ করতে হবে তা আমরা কেউই ভাবি না। অনেক স্বামী আবার মনে করেন, স্ত্রীর ভরণ-পোষণসহ যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করছি তাহলে কেন আবার দেনমোহর কেন দিতে হবে। আসলে দেনমোহরের সঙ্গে ভরণ পোষণের কোনো সম্পর্ক নেই। দু’টি সম্পূর্ণ আলাদা অধিকার, দু’টোই স্বামীকে বহন করতে হবে। এই অবস্থায় স্বামী যখন মারা যায় তখন সমাজের সকলের মিলে স্ত্রীকে দেনমোহর মাপ করে দেয়ার জন্য চাপ দেন। স্ত্রী তখন মাপ করতে বাধ্য হয় অথবা লোক লজ্জার ভয়ে বলে থাকে মাপ করে দিয়েছি। এমনিভাবে জানাযার সময় স্ত্রীর নিকট থেকে দেনমোহর মাফ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা একটি কঠিন বিদআত। সকলের উচিত দেনমোহর সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করে সথাযথভাবে আদায় করা।

৩৮। লাশ দেখান সময় পর্দা না করাঃ

পর্দা একটি ফরজ বিধান। সালাত, সিয়াম, হজ্জের মত পর্দা একটি ফরজ বিধান যাহা কেন অবস্থায়ই পরিত্যাগ করা যাবে না। সালাত পড়ি দৈনিক পাঁচবার, সিয়াম আদায় করি বছরে একমাস, হজ্জ করি জীবনে একবার কিন্তু পর্দা করতে হবে চব্বিশ ঘন্টা। এক মুহুর্তের জন্য পর্দা পাদ দেয়া যাবে না। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,

قُل لِّلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ

মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। ( সুরা নুর ২৪:৩০)]

وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاء بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاء بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ التَّابِعِينَ غَيْرِ أُوْلِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَاتِ النِّسَاء وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সুরা নুর ২৪:৩১)

মন্তব্যঃ পর্দা জীবিত এ মৃত ব্যক্তি দুজনেরই করতে হবে। কেউ মারা গেল বিশেষ করে মহিলা মারা গেলে তাকে অবশ্য পর্দার বিধান মত রাখতে হবে যাতে মাহরাম ছাড়া কেউ দেখতে না পারে। কিন্তু খুবই দুঃখের বিষয় আমাদের সমাজে মহিলা পুরুষ কার জন্য এই বিধানটি মানা হয় না। সমাজের অবস্থা এখন এতটি খাবাপ যে জীবিত কেউ পর্দা করলে তাকে মৌলবাদী হিসাবে, আনসোস্যাল হিসাবে, গন্য করা হয়। আর মরার পর পর্দা বিষয় মাইয়াতের প্রতি হালকা সহানুভূতি জাগলেও কাজ হয় না। অর্থাৎ মরার পরও বেপর্দা হিসাবে থেকে যায়। আমরা যারা দ্বীন মানার চেষ্টা করি তারা কিন্তু মাইয়াতের পর্দার বিষয় কঠর হতে পারি আমাদের দেখাদেখি হয়ত সমাজে পরির্তন আসবে। কিন্তু বিষয়টি খাট করে দেখার কোন অবকাশ নেই।     

৩৯। মৃত্যু জন্য ইছালে সাওয়াব এর নামে বিভিন্ন বিদআতী আমল করে থাকে।

আপন জন বিশেষ করে পিতা মাতার প্রতি সবার ভালবাসা থাকে অসীম। তাদের জন্য ভাল কিছু একটা করা সকলের কাম্য বিশেষ করে তাদের মৃত্যুর পর, সংসারে ভাল কোন কাজ হলে বা সংসারে উন্নতী হলে তাদের কথা আরও বেশী মনে পরে। তখন তাদের জন্য কিছু একটা করার অপরিসীম ইচ্ছা জাগে কিন্তু তারা যে আর পৃথিবীতে নেই। তাই তাদের জান্য কিছু একটা করার ইচ্ছা থেকেই তাদের নিকট সওয়ার পৌছানোর বিভিন্ন প্রথা সৃষ্টি হয়েছে। এ মাঝে কোনটি ইসলামী শরীয়ত সম্মাত আবার কোনটি শরীয়ত বহির্ভূত বিদআত। এখানে মৃত্যুর জন্য বর্জণীয় কয়েকটি আমল উল্লেখ করব। ইনশা আল্লাহ।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment