সেহরির বিধান

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

সেহরি খাওয়া মাধ্যমে সিয়াম শুরু করা ইসলামি শরীয়তের একটি অন্যতম রৗতি। মহান আল্লাহ সেহরি খাওয়ার সময় বলেছেন কিন্তু ফরজ করেনি। অপর পক্ষ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেহরি খেতে বলেছেন এবং সেহরি খাওয়ার লাভ বর্ণনা করেছেন। এই জন্য সেহরে খাওয়া নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম নির্দেষিত সুন্নাত। যদি কেউ অনিচ্ছা কৃতভাবে সেহরি খেতে না পার তবে তার কোন গুনাহ হবে না। অপর পক্ষে কেই ইচ্ছা কৃতভাবে সেহরি না খেলে সুন্নাহ মোতাবেগ আমল থেকে বঞ্চিত হবে। সেহরি খাওয়া সু্ন্নাহ হলেও ইহার অনেক গুরুত্ব ও ফজিলত আছে। নিম্মে সেহরির ফজিলত বর্নণা করা হল। আয়াত। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,

وَكُلُواْ وَاشْرَبُواْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّواْ الصِّيَامَ إِلَى الَّليْلِ وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

অর্থঃ আর পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ নিজের আয়াত সমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে। (সুরা বাকারা ২:১৮৭)।

সেহেরীর ফজিলতঃ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) খেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা সাহরী খাও, কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে।

(সহিহ বুখারি প্রকাশনায় ইসলামি ফাউন্ডেশন হাদিস নম্বর ১৮০১, মিশকাত-১৯৮২, মুসলিম ১০৯৫, তিরমিযী ৭০৮, নাসায়ী ২১৪৬, ইবনু মাজাহ ১৬৯২, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ৭৫৯৮, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৮৯১৩, ইবনু খুযায়মাহ্ ১৯৩৭, আহমাদ ১১৯৫০, দারিমী ১৭৩৮, সহীহ আত্ তারগীব ১০৬৩; হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৩৭)

আমর ইবন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমাদের রোযা ও কিতাব-ধারীদের (ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের) রোযার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, সেহরি খাওয়া।” (হাদিসের মান সহিহঃ মিশকাত-১৯৮৩, হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন, তাওহীদ পাবলিকেশন থেকে হাদিস নম্বর ১২৪০ এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ মুসলিম ১০৯৬, তিরমিযী ৭০৯, নাসায়ী ২১৬৬, আবূ দাউদ ২৩৪৩, আহমাদ ১৭৩০৮, ১৭৩৪৫, দারেমী ১৬৯৭, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক ৭৬০২, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৮৯১৫, আহমাদ ১৭৭৬২, ১৭৭৭১, ১৭৮০১, ইবনু খুযায়মাহ্ ১৯৪০, ইবনু হিববান ৩৪৭৭, আল আওসার লিত্ব ত্ববারানী ৩২০৮, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮১১৫, সহীহ আত্ তারগীব ১০৬৪, সহীহ আল জামি‘ ৪২০৭, নাসায়ী ২১৬)।

রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সাহরী হল একটি বরকতময় খাদ্য, তাই তা তোমরা ছেড়ে দিয়ো না। এক ঢোক পানি দ্বারা হলেও সাহরী করে নাও। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও ফেরেশ্‌তাগণ সাহরীতে অংশ গ্রহণকারীদের জন্য দোয়া করে থাকেন। (আহমদ : ১১৩৮৪)।

উপরের বর্ণিত হাদিসের আলোকে বলা যায়ঃ

ক।  সাহরী খাওয়া সুন্নত।

খ। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহরী খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন।

গ। ইহুদী ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধাচরণ করা।

ঘ। সেহরি খাওয়া বারতদময়

 

তাছাড়া সেহরি খেলে নিম্মের উপকার হয়ঃ

ক।  দিনের বেলা ক্ষুধা-পিপাসা মোকাবিলা করা সহজ হয় এবং কষ্ট কম হয়।

খ। সাহরীর মাধ্যমে শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও কিয়ামুল লাইল করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

গ। ফজরের সালাত জামাতের সাথে আদায় করা নিশ্চিত হয়।

সেহরির সময়ঃ

সেহরির সময় মহান আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি  এরশাদ করেন,

*وَكُلُواْ وَاشْرَبُواْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّواْ الصِّيَامَ إِلَى الَّليْلِ*

অর্থঃ আর পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। (সুরা বাকারা ২:১৮৭)।

‘আদী ইবনু হাতিম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন এই আয়াত নাযিল হলঃ ‏حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ‏ ‘’তোমরা পানাহার কর রাত্রির কাল রেখা হতে সাদা রেখা যতক্ষন স্পষ্টরুপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়। তখন আমি একটি কাল এবং একটি সাদা রশি নিলাম এবং উভয়টিকে আমার বালিশের নিচে রেখে দিলাম। রাতে আমি এগুলোর দিকে বারবার তাকাতে থাকি। কিন্তু নিকট পার্থক্য প্রকাশিত হল না। তাই সকালেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট গিয়ে এ বিষয় বললাম। তিনি বললেনঃ এতো রাতের আধার এবং দিনের আলো। (সহিহ বুখারি প্রকাশনায় ইসলামি ফাউন্ডেশন হাদিস নম্বর ১৭৯৫)

সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন এই আয়াত নাযিল হলঃ ‏وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ‏ ‘’তোমরা পানাহার কর, যতক্ষন না কাল রেখা সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়। কিন্তু তখনো مِنَ الْفَجْرِ কথাটি নাযিল হয়নি। তখন সিয়াম পালন করতে ইচ্ছুক লোকেরা নিজেদের দুই পায়ে একটি কাল এবং একটি সাদা সুতলি বেধে নিতেন এবং সাদা কাল এই দুইটির পার্থক্য না দেখা পর্যন্ত তাঁরা পানাহার করতে থাকতেন। এরপর আল্লাহ তা’আলা শব্দটি নাযিল করলে সকলেই বুঝতে পারলেন যে, এ দ্বারা উদ্দেশ্য হল রাত (এর আধার) এবং দিন (এর আলো)।  (সহিহ বুখারি প্রকাশনায় ইসলামি ফাউন্ডেশন হাদিস নম্বর ১৭৯৬)

দেরি করে সাহরী খাওয়াঃ

সাহরীর অর্থ হল যা কিছু রাতের শেষ ভাগে খাওয়া হয়। সুন্নত হল দেরি করে সাহরী খাওয়া। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা শেষ সময়ে সাহরী খেতেন।

সাহল ইবনু সা’দ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার পরিবার-পরিজনের মধ্যে সাহরী খেতাম। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে সালাতে শরীক হওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি করতাম। (সহিহ বুখারি প্রকাশনায় ইসলামি ফাউন্ডেশন হাদিস নম্বর ১৭৯৮)।

যায়েদ ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে সেহরি খেয়েছি, অতঃপর নামাযে দাঁড়িয়েছি।’ তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘ওই দুয়ের (নামায ও সেহরির) মাঝখানে ব্যবধান কতক্ষণ ছিল?’ তিনি বললেন, ‘(প্রায়) পঞ্চাশ আয়াত পড়ার মত সময়।’ (হাদিসটি নেয়া হয়েছে সহিহ বুখারি প্রকাশনায় ইসলামি ফাউন্ডেশন হাদিস নম্বর ১৭৯৯,  এই হাদিসটি আরও আছেঃ সহীহ বুখারী ৫৭৫, ১৯২১, সহিহ মুসলিম ১০৯৭, তিরমিযী ৭০৩, নাসায়ী ২১৫৫, ২১৫৬, ইবনু মাজাহ ১৬৯৪, আহমাদ ২১০৭৫, ২১১০৬, ২১১২৮, ২১১৬৩, দারেমী ১৬৯৫, রিয়াযুস স্বা-লিহীন ১২৩৮)।

ইবনু ‘উমর (রাঃ) থেকে এবং কাসিম ইবন মুহাম্মদ (রহঃ) ‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বিলাল (রাঃ) রাতে আযান দিতেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ ইবনু উম্মে মাকতূম (রাঃ) আযান দেওয়া পর্যন্ত তোমরা পানাহার কর। কেননা ফজর না হওয়া পর্যন্ত সে আযান দেয় না। কাসিম (রহঃ) বলেন, এদের উভয়ের মাঝে শুধু এতটুকু ব্যবধান ছিল যে, একজন নামতেন এবং অন্যজন উঠতেন। (সহিহ বুখারি প্রকাশনায় ইসলামি ফাউন্ডেশন হাদিস নম্বর ১৭৯৭, হাদিসটি আরও আছেঃ সহিহ মুসলিম ১০৯২, তিরমিযী ২০৩, নাসায়ী ৬৩৭, ৬৩৮, আহমাদ ৪৫৩৭, ৫১৭৩, ৫২৬৩, ৬২৯৪, ৫৪০১, ৫৪৭৪, ৫৬৫৩, ৫৮১৮, ৬০১৪, ইবনু মাজাহ ১৬৩, ১৬৪, দারেমী ১১৯০, রিয়াযুস স্বা-লিহীন ১২৩৯)।

সেহরীর কিছু বিধানঃ

সেহরীর খাবার হালকা হওয়া ভালঃ

তাই সাহরী খাওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। তবে সাহরীর খাবার হালকা হওয়া ভাল। এমন বেশি খাওয়া উচিত নয়, যাতে দিনের বেলা কাজ-কর্মে অলসতা দেখা দেয়। যে কোন হালাল খাবার সাহরীতে গ্রহণ করা যায়। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মুমিনের উত্তম সাহরী হল খেজুর। (আবু দাউদ : ২৩৪৭)

ফজরের আযান শুনতে পেলেও সেহরি খাওয়া বন্ধ না করাঃ

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ (সাহরী খাবার সময়) তোমাদের কেউ ফজরের আযান শুনতে পেলে সে যেন হাতের বাসন রেখে না দেয়। বরং নিজের প্রয়োজন সেরে নেবে। (হাদিসের মান সহিহ: মিশকাত-১৯৮৮, আবূ দাঊদ ২৩৫০, আহমাদ ৯৪৭৪, ১০৬২৯, ১০৬৩০, মুসতাদারাক লিল হাকিম ৭২৯, সহীহাহ্ ১৩৯৪, সহীহ আল জামি‘ ৬০৭।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

Leave a comment