সিয়ামরত অবস্থায় আমলসমূহ (চতুর্থ পর্ব)

গ. যে আমলগুলি দ্বারা রমজানে কুরআনের হক আদায় হবে।

রমজান মাস কুরআন নাজিলের মাস। এই মাসের অন্যান্য সকল মাসের উপর মর্জাদাসম্পন্ন হওয়ার এক মাত্র কারন হলো, এ মাসেই কুরআন নাজিল হয়। মহান এ মাসের সঙ্গে কুরআনুল কারিমের গভীর সর্ম্পক রয়েছে। এই মাসেই পবিত্র কুরআন লওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়। এই জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই্হি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে কুরআনকে আলাদাভাবে মর্জাদা প্রদাণ করেছেন। তিনি এই মাসে জিব্রাঈল আলাহিস সালামকে তিনি কুরআন শুনাতেন আবার জিব্রাঈল আলাহিস সালামও তাকে কুরআন শুনাতেন। বছরে তারা দুজনে এক অপরকে সম্পূর্ণ শুনাতেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, জিব্রাইল (আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাই্হি ওয়া সাল্লামের নিকট প্রতিবছর একবার কুরআন পাঠ পেশ করতেন। আর যে বছর তিনি মারা যান সে বছর দুইবার পেশ করেন। (সহিহ বুখারি ৪৬১৪)।

এমনকি রমজান মাসের প্রত্যেক রাতেই নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিব্রাইল আলাইহিস সালামকে কুরআন মাজিদ শুনাতেন এবং তিনিও নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শুনাতেন। হাদিস শরিফে আছে, জিবরাইল আমিন রমজানের শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক রাতে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করতেন এবং  তাকে কুরআন শরিফ পড়ে শুনাতেন। ( সহিহ বুখারি ১৯০২)।

ইবনে কাছির (রহঃ) বলেনঃ জিব্রাইল (আঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাই্হি ওয়া সাল্লামকে যতটুকু কুরআন নাযিল হয়েছে ততটুকু পাঠ করে শুনাতেন। (আল-জামে ফি গারিবিল হাদিস’ গ্রন্থে (৪/৬৪)

যে কারণে রমজান মাস অন্যান্য মাসের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,

*شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ

অর্থঃ রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। (সুরা বাকারা ২:১৮৫)।

উপরের আয়াতে মহান আল্লাহ ষ্পষ্ট করে রমজান মাসের তিনটি মহান বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন।

* কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের হেদায়েত জন্য

* কুরআন ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য

* সম্পূর্ণ রমজান ব্যাপিয়া সিয়াম পালন করা।

ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি হল আল কুরআন। আল আল কুরআনের মূল বিষয় বস্তু হল, আদম সন্তারকে এমন জ্ঞান দান করা যা সে জানত না। তাইতো অহীর সুচনায় মহান আল্লাহ তাআলা নাজিল করলেন,

ٱقۡرَأۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلَّذِى خَلَقَ (١) خَلَقَ ٱلۡإِنسَـٰنَ مِنۡ عَلَقٍ (٢) ٱقۡرَأۡ وَرَبُّكَ ٱلۡأَكۡرَمُ (٣) ٱلَّذِى عَلَّمَ بِٱلۡقَلَمِ (٤) عَلَّمَ ٱلۡإِنسَـٰنَ مَا لَمۡ يَعۡلَمۡ (٥)

অর্থ: পড়ো (হে নবী), তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন৷ জমাট বাঁধা রক্তের দলা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন৷ পড়ো, এবং তোমার রব বড় মেহেরবান, যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন৷ মানুষকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন, যা সে জানতো না৷ 

আল্লাহ তা‘আলার নিজ করুনায় মানুষ জাতীর হেদায়েতের জন্য মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার বড়ই মেহেরবানী যে, তিনি আমাদের এমন একটি কিতাব দিলেন, যার মধ্যে আছে ইহাকাল ও পরকালের মুক্তির পাথেয়। তাই রমজানে কুরআন কেন্দ্রিক আমল করে এর যথাযথ হক আদায় করতে হবে। বিদ্বানগন মনে করেন আল কুরআনের মাধ্যমে সঠিকভাবে দিক নির্দেশনা পেতে হলে, আল্লাহর বান্দাকে কুরআন মাফিক আমলকে বিভিন্ন পর্যায় ভাগ করে শিক্ষা গ্রহন করতে হবে। কুরআনের যথাযথ হক আদায় করতে হলে আমাদের নিম্মের আমলগুলি করতে হবে।

১। কুরআনের উপর ঈমান আনাঃ

২। বিশুদ্ধভাবে কুরআনের শিক্ষা করাঃ

৩। অপরকে কুরআন পড়া শিক্ষা দেয়াঃ

৪। কুরআন শিক্ষার পর নিয়মিত তিলাওয়াত করাঃ

৫। সহিহ হাদিসে বর্ণিত সুরা বা আয়াত মুখস্থ করে নিয়মিত তেলওয়াত করা

৬। কুরআন তেলওয়াত শ্রবন করা

৭। কুরআন মুখস্থ বা হিফয করা

৮। অর্থ বুঝে বুঝে কুরআন পড়া,সম্ভব হলে বিশুদ্ধ তাফসিরের আলোকে পড়া

৯। কুরআন অনুসারে জীবন যাপর করা

১০। কুরআন অন্যেনর নিকট পৌছান

৪। কুরআন শিক্ষার পর নিয়মিত তিলাওয়াত করাঃ

কুরআন তিলাওয়াত করা কুরআনের অন্যতম হক। কুরআন মাজীদে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এভাবে,

اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ

অর্থঃ তোমার প্রতি যে কিতাব ওহী করা হয়েছে, তা থেকে তিলাওয়াত কর। (সূরা আনকাবুত ২৯:৪৫)।

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশিগ্রন্থ আল কুরআন। কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ বুঝে কিংবা না বুঝে যেভাবেই পড়ুক না কেন পাঠকের জন্য নেকি আছে। এমন কি এই  ঐশি গ্রন্থের সাথে ভালবাসা রাখাও নেকির কাজ। কুরআন যথাযথ তেলওয়ার শিক্ষা গ্রহন করার পর নিয়মিত কুরআন তেলওয়ার করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلاَوَتِهِ أُوْلَـئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ وَمن يَكْفُرْ بِهِ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ

অর্থঃ আমি যাদেরকে গ্রন্থ দান করেছি, তারা তা যথাযথভাবে পাঠ করে। তারাই তৎপ্রতি বিশ্বাস করে। আর যারা তা অবিশ্বাস করে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত। (সুরা বাকারা ২:১২১)।

মহান আল্লাহ বলেন,

لَيْسُواْ سَوَاء مِّنْ أَهْلِ الْكِتَابِ أُمَّةٌ قَآئِمَةٌ يَتْلُونَ آيَاتِ اللّهِ آنَاء اللَّيْلِ وَهُمْ يَسْجُدُونَ

অর্থঃ তারা সবাই সমান নয়। আহলে কিতাবদের মধ্যে কিছু লোক এমনও আছে যারা অবিচলভাবে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং রাতের গভীরে তারা সেজদা করে। [ সুরা ইমরান ৩:১১৩ ]

আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً يَرْجُونَ تِجَارَةً لَنْ تَبُورَ ﴿29﴾ لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُمْ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّهُ غَفُورٌ شَكُورٌ 

অর্থঃ যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং আমি যা দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসা আশা করে, যাতে কখনও লোকসান হবে না। পরিণামে তাদেরকে আল্লাহ তাদের সওয়াব পুরোপুরি দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও বেশি দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল মূল্যায়নকারী। (সুরা ফাতির ৩৫:২৯-৩০)

মহান আল্লাহ বলেন,

وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُنَا بَيِّنَاتٍ تَعْرِفُ فِي وُجُوهِ الَّذِينَ كَفَرُوا الْمُنكَرَ يَكَادُونَ يَسْطُونَ بِالَّذِينَ يَتْلُونَ عَلَيْهِمْ آيَاتِنَا قُلْ أَفَأُنَبِّئُكُم بِشَرٍّ مِّن ذَلِكُمُ النَّارُ وَعَدَهَا اللَّهُ الَّذِينَ كَفَرُوا وَبِئْسَ الْمَصِيرُ

অর্থঃ যখন তাদের কাছে আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ আবৃত্তি করা হয়, তখন তুমি কাফেরদের চোখে মুখে অসন্তোষের লক্ষণ প্রত্যক্ষ করতে পারবে। যারা তাদের কাছে আমার আয়াত সমূহ পাঠ করে, তারা তাদের প্রতি মার মুখো হয়ে উঠে। বলুন, আমি কি তোমাদেরকে তদপেক্ষা মন্দ কিছুর সংবাদ দেব? তা আগুন আল্লাহ কাফেরদেরকে এর ওয়াদা দিয়েছেন। এটা কতই না নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল। (সুরা হাজ্জ্ব ২২:৭২)।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। (সুনান আত-তিরমিযি : ২৯১০)।

মন্তব্যঃ কুরআন তেলাওয়াত করা মহান আল্লাহর হুকুম, তা সত্বেও নিয়মিত কুরআন তেলওয়াত করা মুস্তাহাব পর্যায়ের আমল। এটি জরুরী বা ফরজ পর্যায়ের আমল নয়। এই আমল না করলে কোন মুসলমান গুনাহগার হবেন না। কিন্ত মনে রাখতে হবে কুরআন তেলওয়াত একটি গুরুত্বপূর্ন ইবাদাত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-তোমরা কোরআন তিলাওয়াত কর, কেননা, কোরআন কিয়ামতের দিবসে তিলাওয়াত ও আমলকারীর জন্য সুপারিশকারী হিসেবে আবির্ভূত হবে। (সহিহ মুসলিম)

এমন কি রমজান মাসে রোজাদারের কুরআন তিলওয়াত করা খুবই নেকির কাজ হলেও ফরজ করেন নাই। তবে ব্যক্তির উচিত রমজানে বেশি বেশি কুরআন পড়া। এটাই ছিল রাসূলের আদর্শ। গোটা রমজান মাসে জিব্রাইল আলাইহিস সালাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কুরআন পাঠ করতেন।

বিশুদ্ধ

কুরআন তিলাওয়াতের আদবঃ

বিশুদ্ধ  উচ্চারনে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। তিলাওয়াতের আদবগুলো রক্ষাকরতে হবে। বাংলাভাষায় উচ্চারণ করে পড়লে হবে না। আবূ হুরায়রা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে কুরআন সুন্দর উচ্চারণে পড়ে না, সে আমার উম্মতের মধ্যে শামিল নয়। (সহিহ বুখারী- ৭৫২৭)।

কুরআন তেলওয়ার সময় কিছু আদব বা নিয়ম কানুনের প্রতি লক্ষ রাখাতে হবে। তা না হলে কুরআন আমাদের জন্য নেকীর পরিবর্তে পাপই বয়ে আনবে। তাই কুরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে কুরআন তেলওয়াতের কিছু আদব আলোচনা করব।

কুরআন তেলাওয়াত করা নফল ইবাদাত হলেও আল্লাহ তা‘আলা কুরআন শিক্ষা করা ফরয করে দিয়েছেন। প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন পড়া জানতে হবে। সহিহ শুদ্ধ ভাবে কুরআন তেলাওয়াত না জানলে গুরুত্বপূর্ণ আমল সালাত পরিপূর্ন হবে না। তাই যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম হিসাবে দাবী করবে তাকে অবশ্যই কুরআন শিক্ষা করতে হবে। কুরআন শিক্ষা করা এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, আল্লাহ তা‘আলা সর্ব প্রথম কুরআনের যে আয়াতটি নাজিল করেন তাতে কুরআন পড়ার নির্দেষ দান করেন। নিম্ম কুরআন তিলওয়াতের আদব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ

আদব – ০১::   বিশুদ্ধ নিয়ত শুদ্ধ করা

কুরআন তেলাওয়াত যদি আল্লাহর সন্ত্বষ্টির জন্য না হয়ে অন্য কারনে হয়ে থাকে তবেতো ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। যে ব্যক্তি শুধু দুনিয়াবাসিকে শুনানোর বা নাম করার জন্য কুরআন তেলাওয়াত করল, সে ছোট শির্ক করল। কুরআন তেলাওয়াত  ইবাদাত আর গাইরুল্লার জন্য ইবাদাত শির্ক। অনেকের আবার কুরআন তেলাওয়াত খুবই সুমধুর। সবাই তাদের কুরআন তেলাওয়াত শুনেন আর প্রশংসা করে। প্রশংসা শুনে শ্রতাদের খুসি করার জন্য তেলাওয়াত করে। শ্রতাদের খুসি করার জন্য তেলাওয়াত নিশ্চই শির্ক হবে। ইদনিং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কুরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। কেউ যদি নিজের সুনাম সুখ্যাতি অর্জনের জন্য তেলাওয়াত করে তবে তাও শির্ক হবে। কাজেই কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতে নিয়ত খালেস করা। মহান আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য তিলাওয়াত করা।

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন,

 فَٱدۡعُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡكَـٰفِرُونَ (١٤) 

 “সুতরাং তোমরা আল্লাহকে একনিষ্ঠভাবে ইখলাসের সাথে ডাক, যদিও কাফিরেরা এটা অপছন্দ করে।। (সূরা মুমিন ৪০:১৪)।

কুরআন তিলায়াত যেহেতু ইবাদাত আর ইবাদাত হবে একমাত্র আল্লাহর। তার ইবাদতের সাথে আর কারো ইবাদতের মিশ্রণ ঘটানো যাবে না। সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এনে একমাত্র আল্লাহর পূজারী এবং তাঁর ফরমানের অনুগত হতে হবে। এ কথাই মহান আল্লাহ বলেছেন। তিনি এরশাদ করেন,   

إِنَّآ أَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلۡڪِتَـٰبَ بِٱلۡحَقِّ فَٱعۡبُدِ ٱللَّهَ مُخۡلِصً۬ا لَّهُ ٱلدِّينَ (٢)

আমি তোমার নিকট এই কিতাব সত্যসহ অবতীর্ণ করেছি; সুতরাং আল্লাহর ইবাদাত কর তাঁর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে। (সূরা যুমার ৩৯:২)।

আরো এরশাদ করেন,

 وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ

 “তাদের এ জন্যই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে খাঁটি মনে, এখলাসের সাথে।” (সূরা বাইয়েনা ৯৮:৫)।

গয়রুল্লাহর সন্তষ্টির জন্য তিলাওয়াত করলে রিয়া হবে। রিয়াকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোট শির্ক বলেছেন। কিয়ামতের দিন ‘রিয়াকারী’ বা লোক দেখানো আমলকারীর বিচার সবার প্রথম হবে। একটি সহিহ হাদিসে এসেছে।

কিয়ামতের দিন প্রথমে যেসব লোকের বিচার করা হবে তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে ‘শহীদ’ ব্যক্তি। তাকে উপস্থিত করে আল্লাহ তাঁর নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিবেন। সে তা স্বীকার করবে। অতঃপর, আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন আমার দেয়া নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ? উত্তরে সে বলবেঃ আমি আপনার দেওয়া নেয়ামতের বিনিময়ে আপনার রাস্তায় জিহাদ করে শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছে; বরং তুমি এই উদ্দেশ্যে জিহাদ করে শহীদ হয়েছিলে যাতে করে লোকেরা তোমাকে শহীদ বলে আখ্যায়িত করে। পৃথিবীতে তা বলা হয়ে গেছে। অতঃপর তাকে মুখের উপর উপুড় করে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

অতঃপর, এমন একজন ‘আলেমকে’ উপস্থিত করা হবে যে দ্বীনি ইলম অর্জন করেছে এবং মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন পাঠ করেছে। অতঃপর তাকে আল্লাহর নেয়ামতসমূহ স্মরণ করানো হবে। সেও তা স্বীকার করবে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেনঃ আমার দেয়া নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ? সে বলবেঃ আমি আপনার দেওয়া নেয়ামতের বিনিময়ে দ্বীনি ইল্ম অর্জন করেছি, অন্যকে তা শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার জন্যে কুরআন পাঠ করেছি। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো; বরং তুমি এই জন্যে বিদ্যা শিক্ষা করেছিলে যাতে করে মানুষ তোমাকে আলেম বলে। আর এই জন্যে কুরআন পাঠ করেছিলে যাতে লোকেরা তোমাকে কারী বলা হয়। পৃথিবীতে তোমাকে এই সব বলা হয়ে গেছে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপের আদেশ দেয়া হবে। অতঃপর নাক ও মুখের উপর উপুড় করে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এরপর ঐ ব্যক্তিকে আনা হবে যাকে আল্লাহ নানারকম ধন-সম্পদ দান করেছিলেন। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমার দেয়া নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছ? সে বলবেঃ আপনি যেসমস্ত পথে খরচ করা পছন্দ করেন তার কোন পথই আমি বাদ দেইনি, সকল পথেই খরচ করেছি। আল্লাহ বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো; বরং তুমি এই জন্য খরচ করেছো যাতে করে মানুষ তোমাকে ‘দানশীল’ বলে। পৃথিবীতে তোমাকে তা বলা হয়ে গেছে। অতঃপর তাকে মুখ ও নাকের উপর উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপের আদেশ দেয়া হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহ মুসলিম : কিতাবুল ইমারাহ)।

মাহমুদ ইবনে লাবিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আমি তোমাদের ওপর যা ভয় করি তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে শির্কে আসগর (ছোট শির্ক)। তারা বলল: হে আল্লাহর রাসূল শির্কে আসগর কি? তিনি বললেন: “রিয়া (লোক দেখানো আমল), আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তাদেরকে (রিয়াকারীদের) বলবেন, যখন মানুষকে তাদের আমলের বিনিময় দেয়া হবে: তোমরা তাদের কাছে যাও যাদেরকে তোমরা দুনিয়াতে দেখাতে, দেখ তাদের কাছে কোন প্রতিদান পাও কিনা”। (আহমদ, হাদিসটি সহিহ)।

 অতএব আমাদের রিয়া মুক্ত কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। এই লক্ষে কুরআন তিলাওয়াত করার আগে প্রথম আমাদের নিয়তকে বিশুদ্ধ করতে হবে। যদি রিয়া এসে যায় সাথে সাথে নিয়ত খালেস করতে হবে। 

আদব – ০২:: পবিত্রতা অর্জন করতে হবে।

মহান আল্লাহ বলেন,

لَّا يَمَسُّهُ ۥۤ إِلَّا ٱلۡمُطَهَّرُونَ (٧٩)

অর্থ: পবিত্র সত্তাগণ ছাড়া আর কেউ তা স্পর্শ করতে পারে না৷ (সুরা ওয়াকিয়া ৫৬:৭৯)।

যদিও আয়াতটিতে পবিত্র সত্তা বলতে ফেরেস্তাদের বুঝান হইয়াছে। কিন্তু আলেমদের মত হল, কোন মানুষের জুনুবি (বড় নাপাকি যা গোসল ফরজ করে) থাকলে তার জন্য তিলাওয়াত করা বৈধ নয়, এক আয়াতও নয়”। (আহমদ-৮৭৪)। জুনুবি ব্যক্তি মুসহাফ দেখে কিংবা মুখস্থ কোনো ভাবেই গোসল ব্যতীত কুরআন পড়বে না। আর ছোট নাপাকের কারণে নাপাক ব্যক্তি কুরআন মুখস্থ পড়বে, কিন্তু স্পর্শ করবে না। ছোট নাপাক সাধারনত অজু দ্বারা পাক হয়। তাই কুরআন স্পর্শ করে পড়লে অজু করে নিতে হবে।

তিলাওয়াতের আগে মিসওয়াক করা। আলী রা. থেকে বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মুখগুলো কুরআনের পথ। তাই সেগুলোকে মিসওয়াক দ্বারা সুরভিত করো। (ইবনে মাজা- ২৯১, শায়খ আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন)।

তিনি আরও ইরশাদ করেন, যখন কোনো বান্দা নামাজে দাঁড়ায়, তখন ফেরেশতা আগমন করেন এবং তার পেছনে দাঁড়িয়ে যান। তিনি মনোযোগসহ তিলাওয়াত শোনেন আর এগিয়ে আসেন। এভাবে সে পড়তে থাকে আর তিনি এগোতে থাকেন। এমনকি তিনি তাঁর মুখ স্থাপন করেন ওই তিলাওয়াতকারীর মুখের ওপর। সে একটি আয়াত তিলাওয়াত করে তা ফেরেশতার পেটে প্রবেশ করে। (বাইহাকী, সুনান আল-কুবরা-১৬৫)।

অতএব তিলাওয়াতকারীর উচিৎ মিসওয়াক করে তিলাওয়াত করা যাতে ফেরেশতা তার মুখের গন্ধে কষ্ট না পান।

সারকথাঃ গোসল ফরজ হলে গোসল করা। তা না হলে অজু করেই তিলাওয়াত করা। সময় সুযোগ থাকলে মিসওয়াক করে তিলাওয়াত শুরু করা।

আদব – ০৩ :: তিলাওয়াতের শুরুতে আউযুবিল্লাহ পড়া। অতঃপর সকল সূরার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ দিয়ে শুরু করা।

আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآَنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

অর্থঃ সুতরাং যখন তুমি কুরআন পড়বে তখন আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান হতে পানাহ চাও। (সূরা নাহল ১৬:৯৮)।

মুফাস্সিরগর আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছন, কুরআনের প্রত্যেকটি কথাকে তার সঠিক আলোকে দেখতে হবে এবং নিজের মনগড়া মতবাদ বা বাইর থেকে আমদানী করা চিন্তার মিশ্রণে কুরআনের শব্দাবলীর এমন অর্থ করা যাবে না, যা আল্লাহর ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। ইবলিশ শয়তায় আদম সন্তানে চিরশত্রু। তাই সে আল্লাহর বান্দাকে ভুল ও বিভ্রান্তিকর উপদেশ দিতে পারে। বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মহান আল্লাহ নিকট পানাহ চাইতে হবে। যাতে করে সে কুরআনের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। এই জন্য অনেক বিজ্ঞ আলিম মনে করেন, আয়াতের দাবী অনুযায়ী কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতে ‘আউযুবিল্লাহ’ পড়া ওয়াজিব। অবশ্য আলিমদের সর্বসম্মত মত হলো এটি মুস্তাহাব।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত যে তিনি এক সূরা শেষ করে বিসমিল্লাহ বলে আরেক সূরা শুরু করতেন। কেবল সূরা আনফাল শেষ করে তাওবা শুরু করার সময় বিসমিল্লাহ পড়তেন না। কাজেই প্রত্যেক তিলাওয়াতকারীর উচিত সূরা তাওবা ছাড়া সকল সূরার শুরুতে ‘আউযুবিল্লাহ’ পড়ার পর ‘বিসমিল্লাহ’ দিয়ে শুরু করা। কিন্তু এক সুরা শেষে সাথে সাথে অন্য সুরা শুরু করলে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ দিয়ে শুরু করা।

আদব – ০৪ :::  তারতীলের সঙ্গে কুরআন পড়া।

কুরআন তিলাওয়াত সময় তাড়াহুড়ু করে দ্রুতগতিতে পড়া যাবে না। তারতীলের সঙ্গে পড়তে হবে। থেমে থেমে  প্রতিটি শব্দ সুন্দরভাবে মুখে উচ্চারণ করে পড়তে হবে। এক একটি আয়াত পড়ে থেমে যেতে হবে, যাতে আল্লাহর বাণীর অর্থ ও তার দাবীকে পুরোপুরি হৃদয়ে সহজে উপলদ্ধি করতে পারে এবং তার বিষয়বস্তু দ্বারা প্রভাবিত হয়। কোন জায়গায় আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর উল্লেখ থাকলে তার মহত্ব শ্রেষ্ঠত্ব ও ভীতি যেন মনকে ঝাকুনি দেয়।কোন জায়গায় তার রহমত ও করুণার বর্ণনা আসলে হৃদয়-মন যেন কৃতজ্ঞতার আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে। কোন জায়গায় তাঁর গযব ও শাস্তির উল্লেখ থাকলে হৃদয় যেন তার ভয়ে প্রকম্পিত হয়। কোথাও কোন কিছু করার নির্দেশ থাকলে কিংবা কোন কাজ করতে নিষেধ করা হয়ে থাকলে কি কাজ করতে আদেশ করা হয়েছে এবং কোন কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে তা যেন ভালভাবে বুঝে নেয়া যায়। মোটকথা তারতীলের সঙ্গে কুরআন পড়রেই হৃদয়ে অনুভুতি জাগবে এবং গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ থাকবে। এর সমর্থনে কিছু কুরআন হাদিসের দলিল উপস্থাপন করা হল।

 আল্লাহ তা‘আলা বলেন, (وَرَتِّلِ الْقُرْآَنَ تَرْتِيلًا ) তোমরা তারতীলের সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াত কর। (সূরা আল-মুযাম্মিল ৭৩:৪)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক স্ত্রীকে তাঁর তিলাওয়াতের ধরন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তোমরা সেভাবে পড়তে পারবে না। বলা হলো, আপনি আমাদের তা কেমন বলুন। তখন তিনি একটি কির‌আত পড়লেন। তিনি স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে পড়লেন। (আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফ : ৮৮২৬)।

ইবন মাসউদ রা. কে এক ব্যক্তি বলল, আমি এক রাক‘আতে ‘মুফাসসালে’র একটি সূরা পড়ি। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বললেন, কাব্যের মতো স্বচ্ছন্দে!? (তিনি তার পড়ার দ্রুতগতির কথা ভেবে বিস্মিত হলেন।) নিশ্চয় একটি সম্প্রদায় কুরআন তিলাওয়াত করে অথচ সে তিলাওয়াত তাদের কণ্ঠাস্থি অতিক্রম করে না। কিন্তু তা যখন অন্তরে পতিত হয় এবং তাতে গেঁথে যায়, তখন তা উপকারে আসে।(মুসলিম-১৯৪৫; বাইহাকী, সুনান আল-কুবরা-৪৮৭৫)।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে ইবন মাসঊদ রা. বলেন, ‘তোমরা একে (কুরআন) নষ্ট খেজুরের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ো না কিংবা কবিতার মতো গতিময় ছন্দেও পড়ো না। বরং এর যেখানে বিস্ময়ের কথা আছে সেখানে থামো এবং তা দিয়ে হৃদয়কে আন্দোলিত করো। আর সূরার সমাপ্তিতে পৌঁছা যেন তোমাদের কারো লক্ষ্য না হয়। (ইবন আবি শাইবা, মুসান্নাফ -৮৭৩৩)।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘তিনি এক আয়াত এক আয়াত করে কেটে কেটে পড়তেন।  ( الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ) বলে ওয়াকফ করতেন। তারপর (الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ  ) বলে ওয়াকফ করতেন। (বুখারী-৫০৪৬)।

সালামা রা. কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিলাওয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘তিনি এক আয়াত এক আয়াত করে টুকরো টুকরো করে পড়তেন। মুসনাদ আহমদ – ২৬৬২৫)।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করছেন, তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর এবং এ তিলাওয়াত দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা কর। সে দলের আবির্ভাবের পূর্বে যারা কুরআনকে তীরের ন্যায় স্থাপন করবে। কুরআন দ্রুত পড়বে, ধীর স্থীরভাবে পড়বে না। ( আহমাদ)

 

আদব – ০৫ :::  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্দর সুরেলা কন্ঠে কুরআন পড়তে পছন্দ করতেন। 

১। বারা’ বিন আযেব থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নিজ কণ্ঠ দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্য দান করো। কারণ সুরেলা কণ্ঠ কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। (দারেমী, সুনান- ৩৫০১; শুয়াবুল ঈমান-১৯৫৫)। 

২। বারা’ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শুনেছি, তিনি এশার নামাজে সূরা তীন পড়েছেন। আমি তার চেয়ে সুন্দর কণ্ঠে আর কাউকে তিলাওয়াত করতে শুনিনি।(বুখারী-৭৫৪৬; মুসলিম-১০৬৭)।   

৩। অপর বর্ণনায় তিনি বলেন, নিশ্চয় সুকণ্ঠ কুরআনের সৌন্দর্য। (ইবনুল জা’দ, মুসনাদ-৩৪৫৬)।

৪। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সে আমার উম্মত নয় যে সুরসহযোগে কুরআন পড়ে না। (বুখারী-৭৫২৭; আবূ দাউদ-১৪৭১)।

৫। অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা কোনো নবীকে এতটুকু সুর দিয়ে পড়ার অনুমতি দেননি যতোটা দিয়েছেন নবীকে। কুরআন তিলাওয়াতে সুরারোপ করার অনুমতি, যা তিনি সরবে পড়েন। (আবূ দাউদ, সুনান-১৪৭৫; নাসায়ী, সুনান-১০১৭)।  

 ৬। আবূ মুসা আশারী (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বললেন, তোমাদের দাউদের সুললিত কণ্ঠের মত মধুর কণ্ঠ দান করা হয়েছে।” (সহীহুল বুখারী ৫০৪৮)।
৭। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, যদি তুমি আমাকে গত রাতে তোমার তেলাওয়াত শোনা অবস্থায় দেখতে (তাহলে তুমি কতই না খুশী হতে)! (মুসলিম)
৮। আবূ লুবাবাহ বাশীর ইবনে আব্দুল মুনযির (রাঃ) হতে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বললেন, ‘‘যে ব্যক্তি মিষ্ট স্বরে কুরআন পড়ে না, সে আমাদের মধ্যে নয়। (অর্থাৎ আমাদের তরীকা ও নীতি-আদর্শ বহিভূত)। (আবূ দাউদ ১৪৭১, উওম সূএে)।
 তাইতো আলেমগন সুর দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা কে মুস্তাহাব বলেছেন।

আদব – ০৬ :::  মধ্যম আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করা।

তবে মনে মনে পড়লে তিলাওয়াত হয় না। বিশুদ্ধ তিলাওয়াত জন্য চাই স্পষ্ট উচ্চারন। মেয়েরা মোলায়েম কন্ঠে আর পুরুষের হালকা উচ্চস্বরে পড়বে। প্রত্যেকে নিজের স্বাভাবিক স্বরে কুরআন পড়া উচিত। কারো নকল করা ঠিক নয়। সরবে কুরআন তিলাওয়াত সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

আল্লাহ তা‘আলা কোনো নবীকে এতটুকু সুর দিয়ে পড়ার অনুমতি দেননি যতোটা দিয়েছেন নবীকে। কুরআন তিলাওয়াতে সুরারোপ করার অনুমতি, যা তিনি সরবে পড়েন। (আবূ দাউদ, সুনান-১৪৭৫; নাসায়ী, সুনান- ১০১৭)।  

কুরআন তিলাওয়াত করারে উত্তম জিকির বলা হয়। কুরআন তিলাওয়াত ফাজায়েলের দিক দিয়ে উত্তম নফল। আর বান্দার হক নষ্টকরা হারাম। খুব জোরে তিলাওয়াত না করা যাতে কারো কোন অসুবিধা না হয়। উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করার ফলে অনেক সময় অসুস্থজনের কষ্ট হয়। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মনে রেখো, তোমরা সবাই আপন রবের সঙ্গে সঙ্গোপনে কথা বলছো। অতএব একে অপরকে কষ্ট দেবে না। একজন অপরের ওপর গলা চড়িয়ে তিলাওয়াত করবে না। (আবূ দাউদ – ১৩৩৪)।

আমাদের উপমহাদেশে একটা বিদাত চালু আছে। তাহল সবিনা খতম নামে মাইকে কুরআন পড়া। এই বিদাতে অনেক কুফল আছে, তার মধ্যে মাইকে উচ্চ স্বরে পড়ার দরুন, অসুস্থ রোগীর কষ্ট, সাধারনের ঘুমের বেঘাত। প্রসাব পায়খানায় বসেও শুনতে বাধ্য করা। সর্বপরি কুরআনের হক হল তিলাওয়াতের সময় চুপ থাকা ও শ্রবণ করা।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

  وَإِذَا قُرِئَ ٱلۡقُرۡءَانُ فَٱسۡتَمِعُواْ لَهُ ۥ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ (٢٠٤)

অর্থ: যখন কুরআন, তোমাদের সামনে পড়া হয়, তা শোনো মনোযোগ সহকারে এবং নীরব থাকো, হয়তো তোমাদের প্রতিও রহমত বর্ষিত হবে৷ (সুরা আরাফ ৭:২০৪)।

নিম্ম আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করার কথাও হাদিসে এসেছে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সরবে কুরআন তিলাওয়াত প্রকাশ্য সদকাকারীর ন্যায় এবং নিরবে কুরআন তিলাওয়াত গোপনে সদকাকারীর ন্যায়। (আবূ দাউদ-১৩৩৫; মুসনাদ আহমদ-১৮৩৬৮)।

আবূ বকর (রা:) নিরবে কুরআন তিলাওয়াত করতেন আর উমর (রা:) করতেন সরবে। উমর (রা:) কে সরবে পড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘সরবে পড়ে আমি শয়তানকে বিতাড়ন করি এবং ঝিমুনি তাড়াই।  অতপর আবূ বকর (রা:) কে নির্দেশ দেয়া হলো আওয়াজ একটু বাড়াতে আর উমর (রা:) কে নির্দেশ দেয়া হলো আওয়াজ একটু কমাতে। (আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফ-৪২১০)।

সারকথা: মধ্যম আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। রিয়া, ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম অসুবিধা হলে, নামাজরত ব্যক্তি নামাজে অসুবিধা হলে, অসুস্থ ব্যক্তির কষ্ট পাওয়ার আশঙ্কা থাকলে নিরবে পড়া উত্তম। তবে শয়তানকে বিতাড়ন করা, ঘুম তাড়ানো ও আশপাশের শব্দকে উপেক্ষা করার জন্য হালকা উচ্চ স্বরে তিলাওয়াত সহায়ক।

আদব – ০৬ :::    তিলাওয়াতের সময় সিজদার আয়াত এলে সিজদা দেয়া।

কুরআন মাজীদের সিজদার আয়াত তিলাঅত করলে অথবা শুনলে তকবীর দিয়ে একটি সিজদাহ করা এবং তকবীর দিয়ে মাথা তোলা মুস্তাহাব। এই সিজদার পর কোন তাশাহহুদ বা সালামনেই। তকবীরের ব্যাপারে মুসলিম বিন য়্যাসার, আবূ কিলাবাহ্‌ ও ইবনে সীরীন কর্তৃক আষার বর্ণিত হয়েছে। (ইবনে আবী শাইবা, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, বায়হাকী, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৬৯পৃষ্ঠা; স্বলা-তে মুবাশশির)।

এই সিজদাহ করার বড় ফযীলত ও মাহাত্ম রয়েছে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “আদম সন্তান যখন সিজদার আয়াত পাঠ করে সিজদাহ করে, তখন শয়তান দূরে সরে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, ‘হায় ধ্বংস আমার! ও সিজদাহ করতে আদেশ পেয়ে সিজদাহ করে, ফলে ওর জন্য রয়েছে জান্নাত। আর আমি সিজদার আদেশ পেয়ে তা অমান্য করেছি, ফলে আমার জন্য রয়েছে জাহান্নাম।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, সহীহ ৮৯৫নং, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

তিলাওয়াতের সিজদা কুরআন তেলাওয়াতকারী ও শ্রোতার জন্য সুন্নত। একদা হযরত উমার (রাঃ) জুমআর দিন মিম্বরের উপরে সূরা নাহল পাঠ করলেন। সিজদার আয়াত এলে তিনি মিম্বর থেকে নেমে সিজদাহ করলেন এবং লোকেরাও তাঁর সাথে সিজদাহ করল। অতঃপর পরবর্তী জুমআতেও তিনি ঐ সূরা পাঠ করলেন। যখন সিজদার আয়াত এল, তখন তিনি বললেন, ‘হে লোক সকল! আমরা (তিলাওয়াতের সিজদাহ করতে) আদিষ্ট নই। সুতরাং যে সিজদাহ করবে, সে ঠিক করবে। আর যে করবে না, তার কোন গুনাহ হবে না।’

অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের উপর (তিলাওয়াতের) সিজদাহ ফরয করেন নি। আমরা চাইলে তা করতে পারি।’ (বুখারী ১০৭৭নং)

যায়দ বিন সাবেত (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ)-এর কাছে সূরা নাজম পাঠ করলাম। তিনি সিজদাহ করলেন না।’ (বুখারী ১০৭৩, মুসলিম,  মিশকাত ১০২৬নং)।

তিলাওয়াতের সিজদার জন্য ওযূ শর্ত নয়। শরমগাহ্‌ ঢাকা থাকলে কেবলামুখে এই সিজদাহ করা যায়। যেহেতু ওযূ শর্ত হওয়ার ব্যাপারে কোন সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায় না। (নাইলুল আউতার, শাওকানী, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/১২৬, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ আরবী ১/১৯৬)। (স্বলা-তে মুবাশশির)

কুরআন মাজীদে মোট ১৫ জায়গায় সিজদাহ করা সুন্নত। তা যথাক্রমে নিম্নরুপ:-

  1. সূরা আ’রাফ ২০৬ নং আয়াত।
  2. সূরা রা’দ ১৫ নং আয়াত।
  3. সূরা নাহল ৫০ নং আয়াত।
  4. সূরা ইসরা’ (বানী ইসরাঈল) ১০৯ নং আয়াত।
  5. সূরা মারয়্যাম ৫৮ নং আয়াত।
  6. সূরাহাজ্জ ১৮ নং আয়াত।
  7. সূরাহাজ্জ ৭৭ নং আয়াত।
  8. সূরা ফুরক্বান ৬০ নং আয়াত।
  9. সূরা নামল ২৬ নং আয়াত।
  10. সূরা সাজদাহ ১৫ নং আয়াত।
  11. সূরা স্বা-দ ২৪ নং আয়াত।
  12. সূরা ফুস্‌সিলাত (হা-মিম সাজদাহ) ৩৮ নং আয়াত।
  13. সূরা নাজম ৬২ নং আয়াত।
  14. সূরা ইনশিক্বাক্ব ২১ নং আয়াত।
  15. সূরা আলাক্ব ১৯ নং আয়াত।

(স্বলা-তে মুবাশশির)

আদব – ০৭ :::  কুরআন তিলওয়াত শেষে “স্বাদাক্বাল্লাহুল আযীম” বলার বিধান কি?

কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে সাদাকাল্লাহুল আজিম বলা বিদআত। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদা ও কোনো সাহাবী থেকে এরূপ বলা প্রমাণিত নেই, পরবর্তী কোনো ইমাম থেকেও নয়। অথচ কুরআনুল কারিমের প্রতি তাদের আমল, ভালবাসা, গুরুত্ব আমাদের থেকে অনেক বেশী ছিল। তারা আমাদের চেয়ে বেশী তিলাওয়াত করতেন এবং কুরআন সম্পর্কে তারা বেশী জানতেন।

 নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে আমাদের দীনে নতুন কিছু সৃষ্টি করল, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা পরিত্যক্ত। (বুখারি-২৬৯৭)।
তিনি আরও বলেন, “যে ব্যক্তি এমন আমল করল, যার উপর আমাদের দীন নেই, তা পরিত্যক্ত। (মুসলিম-১৭২১)।

আব্দুল্লাহ ইবনে ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও’, তিনি বলেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমি আপনাকে কুরআন পড়ে শোনাব, অথচ আপনার উপর কুরআন নাযিল হয়েছে! তিনি বললেন: ‘আমি অপর থেকে কুরআন শুনা পছন্দ করি’। অতঃপর আমি তাকে সূরা নিসা পাঠ করে শুনাই, যখন নিম্নোক্ত আয়াতে পৌঁছি। 

 فَكَيۡفَ إِذَا جِئۡنَا مِن كُلِّ أُمَّةِۢ بِشَهِيدٖ وَجِئۡنَا بِكَ عَلَىٰ هَٰٓؤُلَآءِ شَهِيدٗا  

‘অতএব কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকে উপস্থিত করব তাদের উপর স্বাক্ষীরূপে?’ (সূরা নিসা ৪:৪১)।

 তিনি বললেন, ‘হাসবুক’ (তুমি এখানে পড়া ক্ষান্ত কর, এখানে পড়া শেষ কর)। আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখি, তার দু’চোখ অশ্রু ঝরাচ্ছে”। (বুখারি-৫০৪৯), মুসলিম:-৮০২)।

কই? এখানে তিনি “স্বাদাক্বাল্লাহুল আযীম” বলেননি। সুরা আল ইমরানের ৯৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, বল “স্বাদাক্বাল্লাহ”। পূর্ণ আয়াতটি হল:

 قُلۡ صَدَقَ ٱللَّهُۗ فَٱتَّبِعُواْ مِلَّةَ إِبۡرَٰهِيمَ حَنِيفٗاۖ ٩٥

“বল, আল্লাহ সত্য বলেছেন, সুতরাং তোমরা ইবরাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ কর একনিষ্ঠভাবে। (সুরা আল ইমরানের ৩:৯৫)। কিন্তু তিনি বলেননি যে, কুরআন পড়া শেষ হলে “স্বাদাক্বাল্লাহ” বল।  এখানে বলা  হয়েছে, কুরআনুল কারিমে তিনি যা বলেছেন তা সত্য বলেছেন। এর দ্বারা কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে ‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলার বৈধতা প্রমাণিত হয় না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিংবা তার কোনো সাহাবি কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে কখনো ‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলেননি, অথচ তারা এ আয়াতসমূহ আমাদের চেয়ে বেশী পড়তেন এবং বেশী বুঝতেন। যদি তার দাবি কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে ‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলা হত, তারা তার উপর আমল করতেন এবং আমরা তাদের অনুসরণ করতাম, তাদের অনুসরণ করাই আমাদের জন্য কল্যাণকর।

আল কুরআন তিলাওয়াত করার সময় নিম্ম লিখিত বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ রাখা:

১। কুরআন তিলাওয়াতের সময় লক্ষ রাখতে হবে আমার খতম যেন তিন দিনের কম সময়ে না হয়।

কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তিনদিনের কম সময়ে যে কুরআন খতম করবে, সে কুরআন বুঝবে না। (আবূ দাউদ-১৩৯৬)।

হযরত আবদুল্লাহ্ইব্ন আমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে বললেন, “এক মাসে কুরআন খতম কর”। আমি বললাম, আমি এর চেয়ে বেশী করার শক্তি রাখি। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তাহলে প্রতি সাত দিনে একবার খতম করো এবং এর চেয়ে কম সময়ের মধ্যে খতম করো না। (সহিহ বুখারী,খন্ড-৬, হাদিস – ৫৭৪)।

আবদুল্লাহ্ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:  যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করে সে তা বুঝবে না। (হাদীসটি হাসান সাহীহ আত্ তিরমিজি-২৯৪৯) ।

আবদুল্লাহ্  ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছেন: চল্লিশ দিনে কুরআন খতম করবে। (আত্ তিরমিজি-২৯৪৭ হাদীসটি হাসান-গারীব)।

 ২। রাতে ঘুম পেলে বা ঝিমুলি এলে তিলাওয়াত থেকে বিরত থাকা।

 আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন তোমাদের কেউ রাতে নামাজ পড়ে, ফলে তার জিহ্বায় কুরআন এমনভাবে জড়িয়ে আসে যে সে কী পড়ছে তা টের না পায়, তাহলে সে যেন শুয়ে পড়ে। (মুসলিম-১৮৭২; মুসনাদ আহমদ-৮২১৪)।

৩। উচ্চারনে কষ্ট হলেও ধৈর্য্য নিয়ে কুরআন তিলাওয়াত চালিয়ে যাওয়া।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কুরআন পাঠে যে অভিজ্ঞ ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করে সে সম্মানিত রাসূল ও পুণ্যত্মা ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকবে। আর যে ব্যক্তি তোতলাতে তোতলাতে সক্লেশে কুরআন তিলাওয়াত করবে তার জন্য দ্বিগুণ নেকী লেখা হবে। (বুখারী-৪৯৩৭; মুসলিম-১৮৯৮)।

 ৪। কুরআন মাজীদ সযত্নে নিয়মিত পড়া ও তা ভুলে যাওয়া থেকে সতর্ক থাকার নির্দেশঃ

আবূ মুসা আশারী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘এই কুরআনের প্রতি যত্ন নাও। (অর্থাৎ, নিয়মিত পড়তে থাকো ও তার চর্চা রাখো)। সেই মহান সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের (সাঃ) জীবন আছে, উট যেমন তার রশি থেকে অতর্কিতে বের হয়ে যায়, তার চেয়ে অধিক অতর্কিতে কুরআন (স্মৃতি থেকে) বের হয়ে (বিস্মৃতি হয়ে) যায়।” ( মুসলিম-৭৯১)।

 আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কুরআন-ওয়ালা হল বাঁধা উট-ওয়ালার মত। সে যদি তা বাঁধার পর তার যথারীতি দেখাশুনা করে, তাহলে বাঁধাই থাকবে। নচেৎ ঢিল দিলেই উট পালিয়ে যাবে। (সহীহুল বুখারি-৫০৩১)

২। রুকূ ও সিজদায় তিলাওয়াত না

 সহীহ হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে লোকসকল, নবুওয়াতের সুসংবাদের মধ্যে কেবল সুন্দর স্বপ্নগুলোই অবশিষ্ট আছে, যা একজন মুসলমান দেখে বা তাকে দেখানো হয়। জেনো রাখো,আমাকে রুকূ ও সিজদায় কুরআন পড়তে নিষেধ করা হয়েছে। রুকূতে রবের বড়ত্ব ও মহত্ব বর্ণনা করবে ( سبحان ربي العظيم পড়বে) আর সিজদায় বেশি বেশি দু‘আয় সচেষ্ট হবে। তবে তা কবূলের অধিক যোগ্য বিবেচিত হবে। (মুসলিম-১১০২; নাসায়ী- ১০৪৫)।

 

কুরআনের আলোকে কুরআন তিলাওয়াত ফজিলতঃ

আল্লাহ তাআলা বলেন,

 إِنَّ ٱلَّذِينَ يَتۡلُونَ كِتَـٰبَ ٱللَّهِ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنفَقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَـٰهُمۡ سِرًّ۬ا وَعَلَانِيَةً۬ يَرۡجُونَ تِجَـٰرَةً۬ لَّن تَبُورَ (٢٩) لِيُوَفِّيَهُمۡ أُجُورَهُمۡ وَيَزِيدَهُم مِّن فَضۡلِهِۚۦۤ إِنَّهُ ۥ غَفُورٌ۬ شَڪُورٌ۬ (٣٠) 

অর্থঃ যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরো অধিক দান করবেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান। সুরা ফাতির ৩৫:২৯-৩০)।

মন্তব্যঃ কুরআন তিলওয়াত এমন একটি ব্যবসা যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কাজেই এই ব্যবসার প্রতি গুরুত্ব আরফ করে নিয়মিত কুরআন তিলওয়াত করি। অপর পক্ষে কুরআন শিখা থেকে  থেকে বিমুখ হয়ে থাকল, সে কতইনা দুর্ভাগা! আল কুরআনে এসেছে,

 وَمَنۡ أَعۡرَضَ عَن ذِڪۡرِى فَإِنَّ لَهُ ۥ مَعِيشَةً۬ ضَنكً۬ا وَنَحۡشُرُهُ ۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَـٰمَةِ أَعۡمَىٰ (١٢٤) قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرۡتَنِىٓ أَعۡمَىٰ وَقَدۡ كُنتُ بَصِيرً۬ا (١٢٥) قَالَ كَذَٲلِكَ أَتَتۡكَ ءَايَـٰتُنَا فَنَسِيتَہَا‌ۖ وَكَذَٲلِكَ ٱلۡيَوۡمَ تُنسَىٰ (١٢٦

অর্থঃ আর যে আমার যিকর (কুরআন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে,  নিশচয় তার জীবন যাপন হবে  সংকুচিত এবং আমি কিয়ামতের দিন তাকে অন্ধ অবস্থয় উঠাবো। সে বলবে, হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমিতো ছিলাম দৃষ্টিশক্তিসম্পন্নণ?  তিনি বলবেন, অনুরুপভাবে তোমার নিকট আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, অত:পর তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল। (সূরা ত্বহা ২০:১২৪-১২৬)।

কুরআন তিলাওয়াত ঈমান বৃদ্ধি করেঃ

কুরআন তিলাওয়াত করা বান্দার জন্য এমন উপকারী। এবং কুরআন তিলাওয়াত করলে ঈমান বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ ٱللَّهُ وَجِلَتۡ قُلُوبُهُمۡ وَإِذَا تُلِيَتۡ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتُهُۥ زَادَتۡهُمۡ إِيمَٰنٗا وَعَلَىٰ رَبِّهِمۡ يَتَوَكَّلُونَ ٢ 

অর্থ: ‘মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের উপরই ভরসা করে’। (সুরা  আনফাল ০৮:২)।

সহিহ হাদিসের আলোকো কুরআন তিলাওয়াত ফজিলত:

আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে কোন সম্প্রদায় আল্লাহর কোন ঘরে একত্রিত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করে এবং নিজদের মাঝে তা পঠন ও পাঠন করে, তাদের উপর শান্তি অবতীর্ণ হয়, আল্লাহর রহমত তাদের ঢেকে রাখে, ফেরেশতারা তাদের বেষ্টন করে রাখে এবং আল্লাহ তাআলা নিকটস্থ ফেরেশতাদের সঙ্গে তাদের ব্যাপারে আলোচনা করেন। (মুসলিম-৭০২৮; আবুদাউদ- ১৪৫৫; আহমাদ-৭৪২৭;  ইবনে মাজাহ-২২৫; তিরমিজি-২৯৪৫; দামিরি-৩৪৪; তাহক্কীক আলবানী ; সহিহ)।

উম্মুল মোমেনিন আয়েশা সিদ্দিকা রাদিআল্লাহু আনহার সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল কুরআনে দক্ষ ও পণ্ডিত ব্যক্তি সম্মানিত পুণ্যবান ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। যে ব্যক্তি কুরআন আটকে আটকে তিলাওয়াত করে এবং তা তার জন্য কষ্টকর হয়, তার জন্য দু’টি প্রতিদান রয়েছে। প্রথমটি, তিলাওয়াতের প্রতিদান, দ্বিতীয়টি কষ্টের প্রতিদান। (বুখারি-৪৯৩৭ ও মুসলিম-৭৮৯)

 আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) কর্তক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুজনের ক্ষেত্রে ঈর্ষা করা জায়েয। ক. যাকে আল্লাহ কুরআন (মুখস্ত করার শক্তি) দান করেছেন, সুতরাং সে তার (আলোকে) দিবা-রাত্রি পড়ে ও আমল করে। খ. যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ দান করেছেন এবং সে (আল্লাহর পথে ) দিন-রাত ব্যয় করে’’। (বুখারী ৫০২৫)

ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্(সা) কে বলতে শুনেছি যে, দু’টি বিষয় ছাড়া অন্য কোন ব্যাপারে ঈর্ষা করা যায় না। প্রথমত, যাকে আল্লাহ্তা’আলা কিতাবের জ্ঞাণ দান করেছেন এবং তিনি তার থেকে গভীর রাতে তিলাওয়াত করে। দ্বিতীয়ত, যাকে আল্লাহ্তা’আলা সম্পদ দান করেছেন এবং তিনি সেই সম্পদ দিন-রাত দান-খয়রাত করতে থাকেন।(বুখারী, খন্ড-৬,হাদিস- ৫৪৩)।

আব্দল্লাহ ইবনে মাসাউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব (কুরআন মাজীদ) এর একটি বর্ণ পাঠ করবে, তার একটি নেকী হবে। আর একটি নেকি দশটি নেকীর সমান হয়। আমি বলছি না যে, ‘আলিফ-লাম-মীম’ একটি বর্ন; বরং আলিফ একটি বর্ন, লাম একটি বর্ন, মীম একটি বর্ন। (অর্থাৎ, তিনটি বর্ন দ্বারা গঠিত ‘আলিফ-লাম-মীম’, যার নেকীর সংখ্যা হবে তিরিশ)। (তিরমিযী-২৯১০, হাদিসের মান হাসান)
আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কুরআন পাঠকারী মুমিনের হচ্ছে ঠিক কমলা লেবুর মত; যার ঘ্রাণ উওম এবং স্বাদও উওম।আর যে মুমিন কুরআন পড়ে না তার উদাহরণ হচ্ছে ঠিক খেজুরের মত; যার (উওম) ঘ্রাণ তো নেই, তবে স্বাদ মিষ্ট। (অন্যদিকে) কুরআন পাঠকারী মুনাফিকের দৃষ্টান্ত হচ্ছে সুগন্ধিময় (তুলসি) গাছের মত; যার ঘ্রাণ উওম কিন্ত স্বাদ তিক্ত। আর যে মুনাফিক কুরআন পড়ে না তার উদাহরণ হচ্ছে ঠিক মাকাল ফলের মত; যার (উওম) ঘ্রাণ নেই, স্বাদও তিক্ত। (বুখারী ৫০২০, মুসলিম-৭৯৭)
আবূ উমামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, ‘তোমরা কুরআন মাজীদ পাঠ করো। কেননা, কিয়ামতের দিন কুরআন, তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে। (মুসলিম ৮০৪)।

উকবা বিন আমের রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে হতে যে ব্যক্তি সকালে মসজিদে দু’টি আয়াত পাঠ করে বা শিখে, তাকে দু’টি উট সদকা করার সওয়াব দেয়া হবে। এভাবে যত বেশি আয়াত তিলাওয়াত করবে, ততবেশি উট সদকা করার সওয়াব প্রদান করা হবে। (সহিহ মুসলিম)।

নাওয়াস ইবনে সামআন (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এ কথা বলতে শুনেছি যে,  ‘কুরআন ও ইহজগতে তার উপর আমলকারীদেরকে (বিচারের দিন মহান আল্লাহর সামনে) পেশ করা হবে। সূরা বাক্কারাহ ও সূরা আলে ইমরান তার আগে আগে থাকবে এবং তাদের পাঠকারির পক্ষে (প্রভুর সঙ্গে) বাদানুবাদে লিপ্ত হবে। (সহিহ মুসলিম ৮০৫)

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) কর্তক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেছেন, পবিত্র কুরআন পাঠক, হাফেয ও তার উপর আমলকারীকে ( কিয়ামতের দিন) বলা হবে, ‘তুমি কুরআন কারীম পড়তে থাকো ও চড়তে থাকো। আর ঠিক সেইভাবে স্পষ্ট ও ধীরে ধীরে পড়তে থাকো, যেভাবে দুনিয়াতে পড়তে। কেননা , (জান্নাতের ভিতর) তোমার স্থান ঠিক সেখানে হবে, যেখানে তোমার শেষ আয়াতটি খতম হবে।” ( আবূ দাউদ ১৮৬৮, তিরমীযি ২৯১৪ হাসান)

৫। কুরআনের সুরা/আয়াত কেন্দ্রিক ফজিলতঃ

সম্পুর্ন কুরআনই ফযীলতপূর্ণ তারপরও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ বিশেষ কিছু সুরা বা আয়াতে বিশেষভাবে ফজিলতের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো ভালোভাবে শিক্ষা করে নিয়মিত বেশি বেশি তিলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা (লোকজনকে) একত্রিত করো।  আমি তোমাদের সামনে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করবো। ফলে সাহাবীদের মধ্যে যারা ছিলেন সমবেত হলেন। অতপর তিনি তাঁদের সামনে   قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ (সূরা-ইখলাস) পড়লেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন আমরা একে অপরকে বলতে লাগলাম, এটা বোধ হয় আসমান থেকে আসা কোনো খবর, যা সংগ্রহ করতে তিনি ভেতরে প্রবেশ করেন। এক্ষণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বের হলেন। এবং বললেন, আমি তোমাদের বলেছি, তোমাদের সামনে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করবো। শুনে রাখো, সেটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান। (মুসলিম-১৯২৪; তিরমিযী-৩১৪৬)।

অতএব যেসব সূরা ও আয়াত সম্পর্কে অধিক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। যেগুলো ভালোভাবে শেখা ও বেশি বেশি তিলাওয়াত। এই বিষয়টির প্রতি লক্ষ রেখে, সহিহ হাসিসের কয়েকটি সুরা ও আয়াতের ফজিলত আলোচনা করা হল।

০১। সূরা ফাতিহা

আবু সাঈদ ইব্ন মু’আল্লা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সালাতরত ছিলাম। রাসূলুল্লাহ্(সা) আমাকে ডাকলেন; কিন্তু আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিলাম না। পরে আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্আমি সালাতরত ছিলাম। তিনি বললেন, আল্লাহ তা’আলা কি বলেননি, “হে মু’মিনগণ, আল্লাহ ও রাসূল যখন তোমাদেরকে আহবান করেন তখন আল্লাহ্ও রাসূলের আহবানে সাড়া দাও”। তারপর তিনি বললেন, মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বে আমি কি তোমাকে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা শিক্ষা দেব না? তখণ তিনি আমার হাত ধরলেন। যখন আমরা মসজিদ থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা করলাম তখন আমি বললাম, ইয়া, রাসূলাল্লাহ! আপনি তো বলেছেন মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বে আমাকে কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরার কথা বলবেন। তিনি বললেন, তা হলঃ “আল হামদুলিল্লাহ রাব্বিল আলামীন”। এটা বারবার পাঠিত সাতটি আয়াত (সাআ মাছানী) এবং কুরআন আজীম যা আমাকে দেয়া। (সহিহ বুখারী, খন্ড-৬, হাদিস -৫২৮)

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমরা সফরে চলছিলাম। (পথিমধ্যে) অবতরণ করলাম। তখন একটি বালিকা এসে বলল, এখানকার গোত্রপ্রধানকে সাপে কেটেছে। আমাদের পুরুষগণ অনুপস্থি। অতএব, আপনাদের মধ্যে এমন কেউ আছেন কি, যিনি ঝাড়-ফুঁক করতে পারেন? তখণ আমাদের মধ্য থেকে একজন ঐ বালকটির সঙ্গে গেলেন। যদিও আমরা ভাবিনি যে সে ঝাড়-ফুঁক জানে। এরপর সে ঝাড়-ফুঁক করল এবং গোত্রপ্রধান সুস্থ্য হয়ে উঠল। এতে সর্দার খুশী হয়ে তাকে ত্রিশটি বক্রী দান করলেন এবং আমাদের সকলকে দুধ পান করালেন। ফিরে আসার পথে আমরা জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ভালভাবে ঝাড়-ফুঁক করতে জান (অথবা রাবীর সন্দেহ) তুমি কি ঝাড়-ফুঁক করতে পার? সে উত্তর করল, না আমি তো কেবল উম্মুল কিতাব- সূরা ফাতিহা দিয়েই ঝাড়-ফুঁক করেছি। আমরা তখন বললাম, যতক্ষণ না আমরা রাসূলুল্লাহ্(সা) এর কাছে পৌঁছে তাঁকে জিজ্ঞেস করি ততক্ষণ কেউ কিছু বলবে না। এরপর আমরা মদীনায় পৌছে রাসূলুল্লাহ্(সা) এর কাছে ঘটনাটি তুলে ধরলাম। তিনি বললেন, সে কেমন করে জানল যে, তা (সূরা ফাতিহা) চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে? তোমরা নিজেদের মধ্যে এগুলো বন্টন করে নাও এবং আমার জন্যও একাংশ রাখো। আবু মা’মার—- আবু সাঈদ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।হয়েছে। (সহিহ বুখারী, খন্ড-৬, হাদিস -৫২৯)

আবু সাইদ রাফে’ ইবনে মুআল্লা (রাঃ) হতে বর্নিত, তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, “মসজিদ থেকে বের হবার পূর্বেই তোমাকে কি কুরআনের সব চেয়ে বড় (মাহাত্ম্যপূর্ণ) সূরা শিখিয়ে দেব না?” এই সাথে তিনি আমার হাত ধরলেন। অতঃপর যখন আমরা বাহিরে যাওয়ার ইচ্ছা করলাম, তখন আমি নিবেদন করলাম, “ইয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি যে আমাকে বললেন তোমাকে অবশ্যই কুরআনের সব চেয়ে বড় (মাহাত্ম্যপূর্ণ) সূরা শিখিয়ে দেব?’ সুতরাং তিনি বললেন, “(তা হচ্ছে) ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’ (সূরা ফাতেহা)। এটি হচ্ছে ‘সাবউ মাসানি (অর্থাৎ নামাযে বারংবার পঠিতব্য সপ্ত আয়াত ) এবং মহা কুরআন, যা আমাকে দান করা হয়েছে”। (সহীহুল বুখারি – ৪৪৭৪)।

০২। সূরা ইখলাস

আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি অন্য আরেক ব্যক্তিকে ‘কুল হুআল্লাহু আহাদ’ পড়তে শুনলেন। সে বার বার তা মুখে উচ্চারন করছিল। (তিনি মনে  করলেন এভাবে বারাবার পাঠ করা যথেষ্ট নয়) পরদিন সকালে তিনি রাসূলুল্লাহ্(সা) এর কাছে এসে এ সম্পর্কে বললেন। তখন রাসূলুল্লাহ্(সা) বললেন, সো সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন। এ সূরা হচ্ছে সমগ্র কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান। (সহিহ বুখারী, খন্ড-৬, হাদিস-৫৩৩)

উক্ত সাহাবী (রাঃ) আরো বর্ণনা করেন যে,  এক ব্যক্তি কোন লোককে সূরাটি বারবার পড়তে শুনল। অতঃপর সে সকালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিকট এসে তা ব্যক্ত করল। সে সূরাটিকে নগণ্য মনে করেছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ আছে, নিঃসন্দেহে এই সূরা (ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান”।(সহীহুল বুখারি ৫০১৫)

আনাস (রাঃ) হতে বর্নিত, এক ব্যক্তি নিবেদন করল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি এই (সূরা) ‘কূল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ ভালবাসি। তিনি বললেন, ‘ এর ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে’। (সহীহুল বুখারি ৭৭৪)।

আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্(সা) তাঁর সাহাবীদেরকে বলেছেন, তোমাদের কেউ কি এক রাতে কুরআনের এ-তৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করতে অসাধ্য মনে কর? এ প্রশ্ন তাদের জন্য কঠিন ছিল। এরপর তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে কার সাধ্য আছে যে, এমনটি পারবে? তখন তিনি বললেন, “কুল হুআল্লাহু আহাদ” অর্থাৎ সূরা ইখ্লাস কুরআন শরীফের এক-তৃতীয়াংশ। (সহিহ বুখারী, খন্ড-৬, হাদিস-৫৩৪)।

৩। সূরা ফালাক ও সূরা নাস

উকবাহ বিন আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদা বললেন, ‘তুমি কি দেখনি, আজ রাতে আমার উপর কতকগুলি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে; যার আনুরূপ আর কিছু দেখা যায়নি? (আর তা হল,) ‘কুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক্ক’ ও ‘কুল আউযু বিরাব্বিল নাস’। (মুসলিম ৮১৪)।

আবূ সাঈদ খুদরী ( রাঃ) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সূরা ফালাক্ক ও নাস অবতীর্ণ হবার পূর্ব পর্যন্ত নিজ ভাষাতে) জিন ও বদ নজর থেকে (আল্লাহর) আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। পরিশেষে যখন উক্ত সূরা দু’ টি অবতীর্ণ হল, তখন ঐ সূরা দু’টি দ্বারা আশ্রয় প্রার্থনা করতে লাগলেন এবং অন্যান্য সব পরিহার করলেন’। (তিরমিজী ২০৫৮)।

আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত যে, যখনই রাসূলুল্লাহ্(সা) অসুস্থ হতেন তখনই তিনি ‘ সূরায়ে মু’আবিযাত’ (সূরা ফালাক ও সূরা নাস) পাঠ করে নিজের উপর ফুঁক দিতেন। যখন তাঁর রোগ কঠিন আকার ধারন করল, তখন বরকত লাভের জন্য আমি এই সকল সূরা পাঠ করে হাত দিয়ে শরীর মসেহ করিয়ে দিতাম। (সহিহ বুখারী, খন্ড-৬, হাদিস-৫৩৫)।

আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত যে, প্রতি রাতে রাসূলুল্লাহ্(সা) শয্যা গ্রহনকালে সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করে দু’হাত একত্রিত করে হাতে ফুঁক দিয়ে সমস্ত শরীরে হাত বুলাতেন। মাথা ও মুখ থেকে শুরু করে তাঁর দেহের সম্মুখভাগের উপর হাত বুলাতেন এবং তিনবার করে এরূপ করতেন। (সহিহ বুখারী, খন্ড-৬, হাদিস-৫৩৬)।

ইমাম নাসায়ি রহ. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উকবা রাদিআল্লাহু আনহু কে নির্দেশ দিলেন, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করার জন্য। তারপর তিনি বললেন, এ দু’টি সুরার ন্যায় অন্য কোন জিনিসের মাধ্যমে কেউ প্রার্থনা করেনি, আর এ দু’টি সুরার ন্যায় অন্য কোন জিনিসের মাধ্যমে কেউ আশ্রয় প্রার্থনা করেনি।”

৪। সূরা মূলক

আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন ‘কুরআনের তিরিশ আয়াতবিশিষ্ট একটি সূরা এমন আছে , যা তার পাঠকারীর জন্য সুপারিশ করবে এবং শেষাবধি তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে,সেটা হচ্ছে ‘তাবা-রাকাল্লাযী বিয়্যাদিহিল মূলক’ (সূরা মূলক)। (আবূ দাউদ ১৪০০)

  1. ৫। সূরা বাক্বারা

 আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বললেন, একদা জিবরাইল (আঃ) নবী (সাঃ)-এর নিকট বসে ছিলেন। এমন সময় উপর থেকে একটি শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি (জিবরাইল) মাথা তুলে বললেন, ‘এটি আসমানের একটি দরজা, যা আজ খোলা হল। ইতোপূর্বে এটা কখনও খোলা হয় নাই। ওদিক দিয়ে একজন ফেরেশতা আবতির্ন হল। এই ফেরেশতা যে দুনিয়াতে অবতরণ করেছে, ইতোপূর্বে কখনও অবতরণ করেনি। সুতরাং তিনি এসে নবী (সাঃ)-কে সালাম জানিয়ে বললেন, ‘‘আপনি দুটি জ্যোতির সুসংবাদ নিন। যা আপনার আগে কোন নবীকে দেওয়া হই নাই। (সে দুটি হচ্ছে) সূরা ফাতেহা ও সূরা বাক্কারার শেষ আয়াতসমূহ । ওর মধ্যে হতে যে বর্নটিই পাঠ করবেন, তাই আপনাকে দেওয়া হবে।’’ (মুসলিম ৮০৬)

আবূ মাসাঊদ বদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাক্বারার শেষ আয়াত দু’টি পাঠ করবে, তার জন্য সেই দু’টি যথেষ্ট হবে’।(সহীহুল বুখারি হা/৪০০৮)

আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা নিজিদের ঘর-বাড়িগুলোকে কবরে পরিণত করো না। কেননা, যে বাড়িতে সূরা বাক্কারা পাঠ করা হয়, সে বাড়ি থেকে শয়তান পলায়ন করে’। (মুসলিম ৭৮)।

হযরত আবূ মাসউদ আনসারী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, যদি কোন ব্যক্তি সূরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত পাঠ করে, তবে এটাই তার জন্য যথেষ্ট।

আবু মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্(সা) বলেছেন, কেউ যদি রাতেসূরা বাকারার শেষ দু’টি আয়াত পাঠ করে, সেটাই তার জন্য যথেষ্ট। (সহিহ বুখারী)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন. “তোমরা দু’টি যাহরাবীন তথা পুষ্প পাঠ কর, যথা সূরা আল-বাকারা ও সূরা আলে ইমরান। কারণ এ দু’টি সূরা কেয়ামতের দিন মেঘমালার মত অথবা দু’দল পাখির ঝাঁকের ন্যায় সারিবদ্ধভাবে উড়বে। এরা উভয়ে পাঠকের পক্ষ গ্রহণ করবে। তোমরা সূরা বাকারা পাঠ কর। কারণ তার পাঠ করা বরকতের কারণ, তার পাঠ ত্যাগ করা হতাশা। অলসরা তা করতে পারবে না। মুআবিয়া বলেন, আমার শ্র“ত হয়েছে যে, বাতালার অর্থ জাদু।” (মুসলিম)

আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“যে ঘরে সূরা আল-বাকারা তিলাওয়াত করা হয়, সে ঘরে শয়তান প্রবেশ করে না।” (মুসলিম)

শয়তান ঘরে প্রবেশ না করার কারণ হচ্ছে তাতে আয়াতুল কুরসী রয়েছেঃ

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, জিব্রাইল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট থাকা অবস্থায় বলেন, দেখুন, এটা আকাশের একটি দরজা যা এই মাত্র খোলা হল। ইতিপূর্বে কখনো তা খোলা হয়নি। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর ঐ দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা রাসূলের নিকট এসে বললেন, আপনি দু’টি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন, যা আপনার পূর্বে কোন নবিকে দেয়া হয়নি। সেটা হল, সূরা ফাতেহা ও সূরা বাকারার শেষ আয়াতগুলোর সুসংবাদ। আপনি এ দু’টো তিলাওয়াত করে যে কোন হরফ দ্বারা যা চাইবেন, তা আপনাকে দেয়া হবে।” (মুসলিম)

৬। আয়াতুল কুরসী পড়ার ফযীলত

উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,  ‘হে আবূ মুনযির! তুমি কি জান, মহান আল্লাহর গ্রন্থ (আল-কুরাআন) এর ভিতর তোমার যা মুখস্থ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় (মর্যাদাপূর্ণ) আয়াত কোনটি?’ আমি বললাম, ‘সেটা হচ্ছে আয়াতুল কুরসী’। সুতরাং তিনি আমার বুকে চাপর মেরে বললেন, ‘আবুল মুনযির! তমার জ্ঞান তোমাকে ধন্য করুক’। (মুসলিম-৮১০)।

আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বললেন, (একবার) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে রমযানের জাকাত (ফিৎরার মাল-ধন) দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন। বস্তুতঃ ( আমি পাহারা দিচ্ছিলাম ইত্যবসরে) একজন আগমনকারী এসে আজঁলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল। আমি তাকে ধরলাম এবং বললাম, ‘তোকে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) –এর কাছে পেশ করব’; সে আবেদন করল, আমি একজন সত্যিকারের অভাবী। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার উপর, আমার দারুন অভাব’; কাজেই আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। সকালে (রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট হাযির হলাম) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘হে আবূ হুরাইরা! গত রাতে তোমার বন্দী কী আচারন করেছে’? আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সে তার অভাব ও (অসহায়) পরিবার-সন্তানের অভিযোগ জানাল। সুতরাংতার প্রতি আমার দয়া হলে আমি তাকে ছেরে দিলাম’। তিনি বললেন, ‘সতর্ক থেকো, সে আবার আসবে’।আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আনুরুপ উক্তি শুনে সুনিশ্চিত হলাম যে, সে আবার আসবে। কাজেই আমি তার প্রতীক্ষায় থাকলাম। সে (পুর্ববৎ) এসে আজঁলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল। আমি বললাম, ‘অবশ্যই তোকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) –এর কাছে পেশ করব’; সে বলল, ‘আমি অভাবী,পরিবারের দায়ত্ব আমার উপর, (আমাকে ছেড়ে দাও) আমি আর আসব না’;সুতরাং আমার মনে দয়া হল। আমি তাকে ছেরে দিলাম।
সকালে উঠে (যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে গেলাম তখন) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে বললেন, ‘‘আবূ হুরাইরা! গত রাতে তোমার বন্দী কী আচারন করেছে’? 

আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! সে তার অভাব ও অসহায় সন্তানের-পরিবারের অভিযোগ জানাল। সুতরাং আমার মনে দয়া হলে আমি তাকে ছেরে দিলাম’ তিনি বললেন, ‘ সতর্ক থেকো, সে আবার আসবে।
সুতরাং তৃতীয়বার তার প্রতীক্ষায় রইলাম। সে (এসে) আজঁলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল। আমি তাকে ধরে বললাম ‘‘এবারে তোকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) –এর দরবারে হাযির করবই’; এটা তিনবারের মধ্যে শেষবার । ‘ফিরে আসবো না’ বলে তুই আবার ফিরে এসেছিস’’; সে বলল ‘তুমি আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমাকে এমন কতকগুলি শব্দ শিখিয়ে দেব, যার দ্বারা আল্লাহ তোমার উপকার করবেন’; আমি বললাম ‘সেগুলি কী?’ সে বলল, ‘যখন তুমি (ঘুমাবার জন্য) বিছানাই যাবে, তখন আয়াতুল কুরসী পাঠ ক’রে (ঘুমাবে); তাহলে তোমার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রক্ষক নিযুক্ত হবে। আর সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান আসতে পারবে না’। সুতরাং আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। আবার সকালে (রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে গেলাম)। তিনি আমাকে বললেন, ‘‘তোমার বন্দী কী আচারন করেছে?’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সে বলল, ‘‘ আমি তোমাকে এমন কতিপয় শব্দ শিখিয়ে দেব, যার দ্বারা আল্লাহ আমার কল্যাণ করবেন’’; বিধায় আমি তাকে ছেড়ে দিলাম’। তিনি বললেন ‘‘সে শব্দগুলি কী?’’ আমি বললাম, ‘সে আমাকে বলল, ‘‘যখন তুমি বিছানাই (শোয়ার জন্য) যাবে, তখন আয়াতুল কুরসী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম’ পড়ে নেবে’’;সে আমাকে আর বলল, “তার কারনে আল্লাহর তরফ থেকে সর্বদা তোমার জন্য একজন রক্ষক নিযুক্ত থাকবে। আর সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান আসতে পারবে না’।(এ কথা শুনে) তিনি (সাঃ) বললেন, ‘‘শোনো ! সে নিজে ভীষণ মিথ্যাবাদী; কিন্তু তোমাকে সত্য কথা বলেছে। হে আবূ হুরাইরা! তুমি জান, তিন রাত ধরে তুমি কার সাথে কথা বলছিলে?’’ আমি বললাম, ‘জী না’; তিনি বললেন, ‘‘সে ছিল শয়তান’’। (সহীহুল বুখারী – ২৩১১)।

৭। সূরা কাহফ

আবূ দার্দা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দিক থেকে দশটি আয়াত মুখস্ত করবে,সে দাজ্জালের (ফিৎনা) থেকে পরিএাণ পাবে।’’ অন্য বর্ণনায় ‘কাহফ সূরার শেষ দিক থেকে’ উল্লেখ হয়েছে। (মুসলিম ৮০৯)

বারা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি “সূরা কাহ্ফ” তিলাওয়াত করেছিলেন। তার ঘোড়াটি দু’টি রশি দিয়ে তার পাশে বাঁধা ছিল। তখন এক খন্ড মেঘ এসে তার উপর ছায়া বিস্তার করল। মেঘখন্ড ক্রমশ নিচের দিকে নেমে আসতে লাগল। আর তার ঘোড়াটি ভয়ে লাফালাফি শুরু করে দিল। ভোর বেলা যখন লোকটি রাসূলুল্লাহ্(সা) এর কাছে উক্ত ঘটনার কথা বললেন, তখন তিনি বললেন, এ ছিল আস্সাকিনা (প্রশান্তি), যা কুরআন তিলাওয়াতের কারণে অবতীর্ণ হয়েছিল। (সহিহ বুখারী, খন্ড-৬, হাদিস-৫৩১)।

৮। সূরা ফাতহঃ

আবদুল্লাহ্ ইবনে মুগাফ্ফাল (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) উষ্ট্রির পিঠে অথবা উটের পিঠে আরোহণ করা অবস্থায় যখন উষ্ট্রটি চলছিল, তখন আমি তিলাওয়াত করতে দেখেছি। তিনি “সূরা ফাত্হ” এবং “সূরা ফাত্হ’র অংশ বিশেষ অত্যন্ত নরম এবং মধুর ছন্দোময় সুরে পাঠ করছিলেন।হয়েছে।(সহিহ বুখারী, খন্ড-৬, হাদিস -৫৬৭)

প্রত্যেক বছর রমজান মাসে জিব্রীল আলাইহিস সালাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একবার পুরো কুরআন দাউর (খতম) করতেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের বছর দু’ বার পুরো কুরআন দাউর (খতম) করেন। যাতে কুরআন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয়ে স্থায়ী ও স্থিরভাবে বদ্ধ মূল হয়ে যায়। উলামায়ে কেরাম, সালফে সালেহিন রমজান ও রমজান ছাড়া অন্য মাসে কুরআন বেশি বেশি তিলাওয়াত করতেন। ইমাম যুহরি রাদিআল্লাহু আনহু রমজান মাস আগমন করলে বলতেন, এটা কুরআন তিলাওয়াতের মাস এবং খাদ্য দানের মাস। রমজান মাসে ইমাম মালেক রাদিআল্লাহু আনহু হাদিস পাঠ ও এলমি আসর পরিত্যাগ করতেন এবং পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতে আত্মনিয়োগ করতেন।

কাতাদা রাদিআল্লাহু আনহু সপ্তাহে একবার কুরআন খতম করতেন। রমজানে প্রতি ৩ দিনে একবার খতম করতেন এবং রমজানের শেষ দশকে প্রতি দিন এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন।

প্রিয় পাঠক! আপনাদের উপর আল্লাহ রহম করুন, আপনারা এ সকল নেককারদের অনুসরণ করুন। মহা পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য দিন রাতের সদ্ব্যবহার করুন। কারণ, আয়ু খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

হে আল্লাহ! আমাদের এমন তিলাওয়াতের তওফিক দান করুন, যাতে আপনার সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হই। কুরআনকে আমাদের জন্য সুপথ ও সহজ-সরল নির্ভেজাল পথ প্রদর্শক রূপে বানিয়ে দিন। কুরআনের রশ্মি ও আলোর মাধ্যমে আমাদেরকে বক্রতা, পথভ্রষ্টতা ও অন্ধকারের অতল গহ্বর থেকে উজ্জ্বল জ্যোতিময় আলোর সন্ধান দিন। এ কুরআনের মাধ্যমে আমাদের সম্মান বৃদ্ধি করুন। আমাদেরকে গোপনীয় দোষ-ত্র“টি ও অপরের দোষ চর্চা করা থেকে বিরত রাখুন এবং আমাদের যাবতীয় গোপনীয় গুনাহ গোপন রাখুন। হে পরম করুণাময় ও দয়ালু প্রভু! আমাদের পিতা-মাতা ও শান্তি প্রিয় সকল মুসলমানকে ক্ষমা করুন। দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবি মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ও তার পরিবারসহ সকল সাহাবি ও অনুসরণকারীদের উপর।

এ হলো কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত। অল্প আমলে অধিক সওয়াব তার জন্যই যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সওয়াব আকাঙ্খা করে। সুতরাং যে কুরআনের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে, কুরআনের যথাযথ তদারকি করে না এবং তা দ্বারা উপকৃত না হয়, সে ক্ষতিগ্রস্ত। হে আল্লাহ! আমাদের হেফাজত করুন এবং নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করার তওফিক দান করুন।

Leave a comment