ইছালে সাওয়াব কেন্দ্রিক বিদআত

ইছালে সাওয়াব কেন্দ্রিক বিদআত

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

***  ইছালে সাওয়াব কি?

ইছালে সাওয়াব একটা ফারসী শব্দ যার আরবি হবে ‘ঈসালুস সওয়াব’। আমাদের সমাজে মৃত ব্যক্তির জন্য সওয়াব পৌঁছে দেয়ার জন্য যে অনুষ্ঠান করা হয় তাকে ইছালে সাওয়াব বলা হয়। কাজেই মৃত ব্যক্তির সওয়াব পৌঁছে দেয়াকে ইছালে সাওয়াব। অনেকে ইহাকে ‘সওয়াব রেসানী বা সওয়াব বখশে দেয়াও বলে থাকে। 

পরিভাষায় ইছালে সাওয়াব হল, মৃত ব্যক্তির কল্যাণের জন্য কোন নেক আমল (সৎকর্ম) বা ইবাদত-বন্দেগী করে তা উক্ত ব্যক্তির জন্য উৎসর্গ করা। এ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে ইছালে সাওয়াব-মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এ জন্য তারা সমাজের নেত্রী স্থানীয় আলেমদের দাওয়াত দেন এবং খানা পিনার ব্যবস্থা করা হয়।  তারা এসে, সুরেল কন্ঠে আম্বিয়া, আউলিয়া, পীর-দরবেশসহ সকল মৃত মুসলমানের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এবং অনুষ্ঠাণ আয়োজন কারির মাতা পিতা বা যে উদ্দেশ্য ইছালে ছাওয়াব এ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে তার জন্য দোয়া করা হয়। সর্বশেষে, খানা দানার ব্যবস্থা করা হয় বা  তাবারুকের বিতরণ করা হয়।

ইছালে সাওয়াবের প্রচলিত পদ্ধতিসমূহঃ

১। মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে কুরআন পাঠ করা বা সূরা ইয়াসীন পড়াঃ

২। লাশের পাশে অথবা কবরের কাছে কুরআন তিলাওয়াত করা।

৩। জানাযা সালাত শেষে সম্মিলিতভাবে দুআ-মুনাজাত

৪। মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করা।

৫। কুলখানি

৬। চেহলাম

৭। সাধারণভোজ বা কাঙ্গালীভোজের আয়োজন করা

৮। বিভিন্ন প্রকারের খতম।

৯। ফাতেহা পাঠ।

১০। মৃত্যু-দিবস পালন

১। একাধিকবার জানাযা ‌আদায় করা

১।  মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে কুরআন পাঠ করা বা সূরা ইয়াসীন পড়াঃ

মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে কুরআন পাঠ করা আমদের সমাজের একটি ঐতিয্যবাহী বিদআত। কোন ব্যক্তি মারাত্বক অসুস্থ মানে তিনি মারা যাবেন। তার অর্থ হল তার সামনে এখন কবর, হাশর, মিজান ইত্যাদি কিন্তু যে আমল কর হয়েছে তা দিয়ে তো এই সকল ঘাঁটি পার হওয়া সহজ নয়। তাই এখই কিছু নেক কাজ করা দরকার কিন্তু সমস্যা যার দ্বারা নেক কাজ করাব তিনিতো মুমূর্ষু প্রান যায় যায়। তাই দেরি না  করে পাড়ার বা গ্রামের মোল্লাদের খবর দেও এখনই কুরআন খতমের ব্যবস্থা কর। কিন্তু একবার ও ভাবলাম না এর দ্বারা কি মুমূর্ষু ব্যক্তির কোন উপকার হবে? একবার ও চিন্তা করলাম না এখান কুরআন সুন্নাহ সম্মত আমল কি? রাসূলল্লাহ সাঃ বা সাহাবীগণ কি ধরনের আমল করছেন? সকলে মিলে ঐ ব্যক্তির চারপাশে বসে কুরআন তেলাওয়াত করার আমল সহিহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত নয়। তাই এটি একটি নব আবিস্কার এ বিদআত। অনেক সময় মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে সূরা ইয়াসীন কিংবা বিশেষ বিশেষ সূরা পাঠ করতে থাকে। অথচ উক্ত আমলের পক্ষে কোন সহিহ দলীল নেই। এ সময় সূরা ইয়াসীন পড়ার হাদীছ যঈফ। যেমনঃ মাকেল ইবনু ইয়াসার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা তোমাদের মৃতদের উপর সূরা ইয়াসীন তেলাওয়াত কর। (আবুদাঊদ-৩১২১; আহমাদ-২০৩১৬, উক্ত বর্ণনার সনদে আবু উছমান ও তার পিতা রয়েছে। তারা উভয়ে অপরিচিত রাবী। তাদের বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয় বলেছেন নাসিরউদ্দিন আলবানী, সিলসিলা যঈফাহ ৫৮৬১)।

অপর একটি জাল বর্ণনঃ উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন এবং তাকে প্রতিদান দান করবেন, যেন সে দশবার কুরআন তিলাওয়াত করল। কোন অসুস্থ ব্যক্তির কাছে সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত করা হলে তার উপর প্রত্যেক অক্ষরের পরিবর্তে দশজন ফেরেশতা নাযিল হয়। তারা তার সামনে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে তার জন্য দু‘আ করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন; যান কবয ও গোসল করার সময় উপস্থিত থাকেন, জানাযার সাথে গমন করেন। ছালাত আদায় করেন এবং দাফন কার্যে উপস্থিত থাকেন। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর এমন ব্যক্তির উপর যদি সূরা ইয়াসীন পাঠ করা হয়, তবে ‘মালাকুল মাউত’ ততক্ষণ তার রূহ কবয করবেন না, যতক্ষণ জান্নাতের তত্ত্বাবধায়ক জান্নাতের পানীয় না নিয়ে আসেন। অতঃপর বিছানায় থাকা অবস্থায় তাকে তা পান করাবেন। ঐ ব্যক্তি তখন পরিতৃপ্ত হবে। এমনকি নবীদের হাউযের পানিরও সে প্রয়োজন মনে করবে না। অবশেষে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তখনও সে পরিতৃপ্তই থাকবে।

হাদিসের মানঃ জাল হাদিস।  সম্পুর্ণ মিথ্যা বর্ণনা। এর সনদে উইসুফ ইবনু আতিইয়াহ নামে একজন মিথ্যুক রাবী আছে। এছাড়া সুওয়াইদ নামেও একজন দুর্বল রাবী আছে। উল্লেখ্য যে, সূরা ইয়াসীন সম্পর্কে যত ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, সবই যঈফ কিংবা জাল। ছহীহ কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। (সিলসিলা যঈফা-৬৬২৩-৬৬২৪)।

মন্তব্যঃ আমাদের দেশের অনেক আলেম যঈফ হাদিসের উপর আমল করে থাকে। পূর্বে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাই কেউ শুধু ইয়াছিন পড়লে মানা করা যাবে কিন্তু বিদআত বিদআত বলে তাকে অবজ্ঞা করা যাবে না। তবে সালাফি আলেমগন কুরআনের সাথে সুরা ইয়াছিনের তিলওয়াত কে ষ্পষ্ট বিদআত বলে উল্লেখ করছেন। সঠিক আমল থাকতে সন্দেহ পরিহার করাই সুন্নাহ।

২।  লাশের পাশে অথবা কবরের কাছে কুরআন তিলাওয়াত করাঃ

আমাদের সমাজে মৃত্যুকে নিয়ে প্রথম যে বিদআতি আমল হয় তা হল লাশের চার পাশে বসে কুরআত তেলওয়াত করা বা কুরআন খতম করা। অনেকে মনে করে এর দ্বারা মৃত্যু ব্যক্তির উপকার হয়। তাই তারা মৃত ব্যক্তির প্রতি সওয়াব পাঠানোর জন্য কুরআন খতম বা কুরআন খতমের অনুষ্ঠান করে। মৃতের জন্য কুরআন খতমের এ রেওয়াজ এত ব্যাপকভাবে প্রচলিত যে, দীন ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ বহু সংখ্যক মুসলমান মনে করেন, কুরআন নাযিল হয়েছে মৃত ব্যক্তিদের জন্য মুক্তি ও ক্ষমা প্রার্থনা করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। অথচ কুরআন নাযিল হয়েছে জীবিদ ব্যক্তিদের উপদেশ গ্রহনের জন্য। মাহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا عَلَّمۡنَـٰهُ ٱلشِّعۡرَ وَمَا يَنۢبَغِى لَهُ ۥۤ‌ۚ إِنۡ هُوَ إِلَّا ذِكۡرٌ۬ وَقُرۡءَانٌ۬ مُّبِينٌ۬ (٦٩) لِّيُنذِرَ مَن كَانَ حَيًّ۬ا وَيَحِقَّ ٱلۡقَوۡلُ عَلَى ٱلۡكَـٰفِرِينَ (٧٠)

অর্থঃ আমি এ (নবী) কে কবিতা শিখাইনি এবং কাব্য চর্চা তার জন্য শোভনীয়ও নয়৷  এ তো একটি উপদেশ এবং পরিস্কার পঠনযোগ্য কিতাব। যাতে সে প্রত্যেক জীবিত ব্যক্তিকে সতর্ক করে দিতে পারে এবং অস্বীকারকারীদের ওপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়৷  (সুরা ইয়াছিনস৩৬:৬৯-৭০)।

কিন্ত আমরা জীবিত কালে কুরআন বুঝে উপদেশ গ্রহন না করে। মৃত্যুর পর কাজা আদায়ের চেষ্টা করছি। তবে এ কথা নিশ্চিত মৃত্যুর পর সকলের আলম বদ্ধ হয়ে যায়।  তাছাড়া এই ধরনের কোন আমল কুরআন বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত নয়। আবার অনেক কে দেখা যায়, দাফনের পর কবরের পাশে ছামিয়ানা টানিয়ে মুন্সি মৌলভী দ্বারা কুরআন খতম করাচ্ছে।  আর এ কথা মনে করছে যে, যতক্ষণ কুরআন তেলওয়াত করা হবে ততক্ষন আযাব হবে না। এমনিভাবে কবর জিয়ারতের সময়ও এ কথা মনে করে কুরআন তেলওয়াত করা। কেউ সূরা ইয়াসীন পড়েন, কেউ পড়েন সূরা তাকাসুর। কেউ সূরা ফাতেহা পড়েন। আবার কেউ তিন বার সূরা ইখলাস পড়ে তার সওয়াব মৃত ব্যক্তির জন্য পাঠিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনে বহু বার কবর যিয়ারত করেছেন। তিনি কখনো কোন কবরের কাছে গিয়ে সূরা ফাতেহা, কুরআন থেকে কোন সূরা বা কোন আয়াত পাঠ করেননি। কুরআনের ফযীলত তার সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সকলের চেয়ে বেশি অবগত ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতকালে কবরবাসীকে সালাম দিয়েছেন, ও তাদের জন্য দুআ করেছেন। বহু হাদীসে কীভাবে তিনি সালাম দিয়েছেন ও দুআ করেছেন—তার বর্ণনা এসেছে। যেমন তিনি কবর যিয়ারতকালে বলতেনঃ

অর্থঃ হে মুমিন মুসলিম কবরবাসী! তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা তোমাদের সাথে মিলিত হব আল্লাহর কাছে আমাদের ও তোমাদের জন্য সুখ ও শান্তি প্রার্থনা করছি(সহীহ মুসলিম, জানাযা অধ্যায়; ইবনে মাজাহ হাদিস নং-১৫৩৬]

৩।  জানাযা সালাত শেষে সম্মিলিতভাবে দুআ-মুনাজাতঃ

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনে অনেক সাহাবির মৃত্যুর পর জানাযার সালাত আদায় করেছেন। সাহাবি, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীদের সময়কালে ও জানাযার সালাত হয়েছে। তার কেউ কোন কালে জানাযা সালাতের শেষে সম্মিলিতভাবে দুআ-মুনাজাত করেনি। জানাযার সালাতই এক ধরনের দুয়া। মনে রাখতে হবে, জানাযার সালাতের পর দুয়া আছে কিন্তু সম্মিলিতভাবে দুয়া নেই। এ সম্পর্কে আবু দাউদে একটি হাদিস এসেছে।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মৃত ব্যক্তির দাফন শেষ করতেন তখন তার কবরের কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেন এবং বলতেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা-প্রার্থনা কর এবং তার অবিচল থাকার জন্য দুআ কর কারণ এখন তাকে প্রশ্ন করা হবে (আবু দাউদ, জানাযা অধ্যায়)

যে কোন আমলের ফযীলত তার সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সকলের চেয়ে বেশি অবগত ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি দূয়ার কথা বললেন অথচ সম্মিলিতভাবে দুয়া করেনি। কিন্তু দুঃখ জনক সত্য কথা হল, আমাদের উপমহাদেশের প্রায় সকল স্থানে জানাযা নামাজ শেষে সম্মিলিতভাবে দুয়া করা হয়।    মৃত্যু ব্যক্তির দাফন সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে ইমাম সাহেব নামাজে অংশ গ্রহণকারীদের সাথে নিয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য দুয়া করেন। মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ-মুনাজাত করার যে পদ্ধতি আপনার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের শিখিয়ে গেছেন, তাতে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। তাই আমরা আবার আমাদের পছন্দ মত নিয়মানুসারে আমাদের মত করে দুআ-মুনাজাত করে নিলাম।

 

৪।  মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করাঃ

তবে ইছালে ছাওয়াবের একটি প্রচলিত বড় পদ্ধতি হিসেবে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। মীলাদ আরবী মাওলিদ শব্দ থেকে উদ্ভুত। মাওলিদ অর্থ হল কোন ব্যক্তির জন্ম,  বিশেষ করে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মকাল, জন্মস্থান এবং জন্মোৎসব। মিলাদ শুধু জম্ম অর্থেও ব্যবহার হয়। এই উপমহাদেশে বর্তমানে মীলাদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

উপমহাদেশে সাধারণত কোন নতুন কাজের শুরুতে, দোকান উদ্ভোদণ করতে, নতুন ঘর তুলতে, পরীক্ষায় অংশ গ্রহনের সময়, বিপদে পতিত হলে মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে  পর্যায় রয়েছে।

১. কুরআন থেকে বাচাই করে কিছু তেওয়াত করা।

২. নাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাঝে কিছু দুরুত পাঠ করা। (সাধারণত নাতে রসূল সাঃ বাংলা, উর্দ, ফারসীতে হয়ে থাকে যার অধিকাংশ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে অতিরঞ্জন বাড়াবাড়ি। এমনকি শির্কি কথা মিশ্রিত গান ও গাওয়া হয়। এক পর্যায় দাড়িয়ে বা বসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সালাম  পেশ করে।

৩. সম্মিলতভাবে দুয়া করেন।

৫. খানা পিনার ব্যবস্থা করে অথবা হালকা তাবারুকের বিতরণ করে।

মন্তব্যঃ এ সকল কাজ আমল মনে করে নেকির উদ্দেশ্যে করে থাকে অথচ এমন আমল সম্পর্কে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জানাই ছিল না মিলাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়. ৬০৪ হিজরী অর্থ্যাৎ ১২০৭ খৃষ্টাব্দে ইরাকের মুসেল শহরের কাছে আরবালা নামক স্থানে ১২ রবিউল আওয়াল তারিখে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মদিন উপলক্ষে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বারের মত আনুষ্ঠানিকভাবে মীলাদ শরীফ অনুষ্ঠিত হয়

 

৫।  কুলখানিঃ

কুলখানি বলতে বুঝায় কোন ব্যক্তির ইন্তেকালের তিন দিনের মাথায় তার মাগফিরাত ও আত্মার শান্তি কামনা করে মীলাদ বা কুরআন খতম অথবা অন্য কিছু পাঠের মাধ্যমে দুআ-মুনাজাতের অনুষ্ঠান করা। অনুষ্ঠান শেষে অংশে গ্রহণকারীদের জন্য খাবার বা মিষ্টি মুখের ব্যবস্থা করা হয়। কুলখানি ফারসি শব্দ। আভিধানিক অর্থ কুল পড়া।

মৃত ব্যক্তিদের নিকট জীবিতদের আমলের ছাওয়াব পৌছা্নোর জন্য তিন দিনের মাথায় বা কোন এক সময় কুরআনের শেষ পারার শেষের যে চারটি সুরা কুল দ্বারা শুরু হয়েছে (কাফিরুন, ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস) তার খতম করা বুঝায়। অথবা পবিত্র কুরআনের ত্রিশতম পারার যে সকল সূরার শুরুতে কুল শব্দ রয়েছে সেগুলো পাঠ করা। অনেক সময় এই অনুষ্ঠার পরিচালক ইমাম বলে থাকেন সুরা ফাতিহা এক বার, সুরা ইখলাস তিন, পাচ/সাত বার অথরা নাস ফালাক তিন বার করে পাঠ করবে। অনেক সময় অনুষ্ঠানটিকে সম্প্রসারিত করার জন্য বাংলা, উর্দো ও ফারসী ভাষয় কবিতা বা গান গেয়ে গেয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে দুরুত পাঠ করে সালাম প্রেরণ করে থাকে।

 

৬।  চেহলামঃ

চেহলাম ফারসি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ চল্লিশতম। অনেকে চেহলামকে চল্লিশা বলেন। কুলখানি আর চেহলামের মাঝে অনুষ্ঠাণ ও আমলের মাঝে তেমন কোন পার্থক্য নেই। কুলখানি সাধারণত মৃত্যুর তৃতীয় দিনে করা হয় আর চেহলাম মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর চল্লিশতম দিনে। কুলখানিতে যেমন মৃত্যুর আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মীলাদ, কুরআন খতম, দুআ-মুনাজাত ইত্যাদির অনুষ্ঠান করা হয় চেহলামে ও ঠিক তেমন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয় এবং অনুষ্ঠাণ শেষে অংশ গ্রহণকারীদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা থাকে।

৭।   সাধারণভোজ বা কাঙ্গালীভোজের আয়োজন করা

মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় আয়জন হল সাধারণভোজ বা কাঙ্গালীভোজের আয়োজন করা। সাধারণত কেউ মারা গেলে তার পক্ষ তার সন্তান সন্তত্বি এই ভোজের আয়জন করে। সমাজের একটু প্রভারশলী ও টাকা ওয়ালা হলে হাজার হাজার লোকের খানা পিনার ব্যবস্থা করা হয়। সমাজে এ বিদআত এত বেশী প্রভাব বিস্তার করছে যে, যদি কেউ এই ভোজের আয়োজন না করলে তাকে খারাপ চোখে দেখা হয়। মনে করে মৃত্যুর জন্য এদের মৃত্যু ব্যক্তির প্রতি কোন মায়া নেই। এই ভোজের মুল উৎস হল উপমহাদেশের হিন্দুদের কুপ্রথা। উপমহাদেশে কোন হিন্দু মারা গেলে তার শেষকৃত্যে যারা অংশ গ্রহন করত তাদের জন্য মৃত্যুর পরিবারের পক্ষ থেকে ভোজের আয়োজন করা হত। এটি ভোজকে হিন্দুরা ফয়তা বলে থাকে। মৃত ব্যক্তির মাগফিরাত কামনায় জন্য দরিদ্র অসহায় লোকদের পাশাপাশি আলেম, মৌলোভী, মুন্সি, মাওলানা, আত্মীয় স্বজনদের জন্য খাবারের আয়োজন করা। সামাজিকভাবে এই ভোজের এত বেশী প্রচলন যে, অনেক ইহাকে ইবাদাত মনে করে থাকে। আসলে এর সাথে কুরআন ও সুন্নাহ নুন্যতম কোন সম্পর্ক নেই। তবে হ্যা, কেউ যদি দিন ক্ষন নির্দিষ্ট না করে এতিম অসহায়দের খাবারের ব্যবস্থা করে, তাহলে তা সওয়াবের কাজ হবে এত কোন সন্দেহ নেই।

 

৮।  বিভিন্ন প্রকারের খতমঃ

খতম’ শব্দটি মূলত আরবী ‘ ختم ’  শব্দের বাংলা ব্যবহার। যার মূল অর্থ হলঃ কোনো বস্তুতে মোহর লাগানো বা তাকে সিলযুক্ত করা। কর্ম যুগে শব্দটির অর্থ হয়, কাজটি শেষ করা। আর আমরা বিভিন্ন খতম বলতে বুঝি বিভিন্ন আমল করে শেষ করা। মৃত্যুর জন্য সওয়াব পৌছানের মাধ্যম হিসাবে বিভিন্ন প্রকারের খতম আমাদের সমাজে খুবই জন প্রিয় আমল। যাদের টাকা আছে তারা কিছু টাকা বা খানার বিনিময় এই সকল খতম আদায় করে থাকে। এতে নিজের আমল করতে হয় না। অন্যেরা কষ্ট করে আয়োজন কারিকে এবং তার মৃত আত্মীয় স্বজনদের জন্য সওয়াব পৌছান।

 

আমাদের সমাজে প্রচলিত খতমগুলি হলঃ খতমে তাহলীল (এক লাখ বা সোয়া লাখ বার লা-ইলা ইল্লাল্লাহ), খতমে জালালী (এক লক্ষ বার কালেমায়ে তাইয়্যেবা), খতমে খাজেগান, খতমে ইউনূস (সোয়া লক্ষ বার দুআয়ে ইউনুস), খতমে তাসমিয়া, (ছমিল্লাহির রহমানির রহীম- ১,২৫,০০০ বার), খতমে রহমানি (ইয়া আল্লাহু, ইয়া রহমানু, ইয়া রাহীম- ১,২৫.০০০ বার), খতমে বুখারী, খতমে না-রী, খতমে ইয়াসিন, খতমে শিফা, খতমে দুরুদে মাহি

এই খতমগুলি একা একা আদায় করা সম্ভব নয় তাই কিছু সংখ্যক লোক একত্র হয়ে পাথর বা কোন দানা গুনে গুনে এ খতম আদায় করে থাকে। সাধারণত: কোন লোক ইন্তেকাল করলে তার আত্মার মাগফিরাতের জন্য এ ধরনের খতমের আয়োজন করা হয়। অনেকে আবার নিজেই মৃত্যুর পূর্বে নিজের খতমে তাহলীল (এক লক্ষ বা সোয়া লক্ষ বার লা-ইলা ইল্লাল্লাহ) পড়ে নেন।কেউ আবার বিপদ আপদ, বালা মুসিবত থেকে উদ্ধারের আশায় এই সকল খতম করে থাকে। যারা এই সকল খতম আদায় করে তাদের নিকট দলীল চাইলে বলে, এটা অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত।

বুযুর্গানে দ্বীন ও উলামায়ে কেরামের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে সোয়া লক্ষ বার দুআয়ে ইউনুস পাঠ করে দুআ করা হলে এই ওসীলায় আল্লাহ তাআলা রোগ-ব্যাধি ও বিপদ-আপদ থেকে হেফাজত করেন।  এ বিষয়ে হাদীস নামে প্রচলিত বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে: ‘‘হাদীস শরীফে আছে, হযরত সাঃ ফরমাইয়াছেন, যখন কেহ নিম্নোক্ত কলেমা (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বার পড়িয়া কোন মৃত ব্যক্তির রূহের উপর বখশিশ করিয়া দিবে, তখন নিশ্চয়ই খোদাতাআলা উহার উছিলায় তাহাকে মার্জনা করিয়া দিবেন ও বেহেশ্তে স্থান দিবেন।’’এগুলো সবই বানোয়াট কথা। (হাদিসের নামে জালিয়াতি, ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর)।

 

৯।  ফাতেহা পাঠঃ

মৃত ব্যক্তির জন্য দুয়া করার আকেটি বিদআতি রুপ হল ফাতিহা পাঠ। আমরা প্রায়ই খবরে শুনে থাকি, প্রেসিডেন্ট অমুক নেতার কবরে যেয়ে ফাতেহা পাঠ করেছেন। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট অমুক নেতার কবরে উপস্থিত হয়ে তার জন্য সূরা ফাতেহা পাঠ করে সংক্ষিপ্ত দুআ-প্রার্থনা করেছেন। আবার অনেক সময় ফাতিহা পাঠের নাম দিয়ে উদ্দেশ্যে মৃত অলী বা বুযুর্গের করবে হাজির হয়ে দুয়া কালাম করে খাবার খেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে। কবর জিয়ারত একটি বৈধ আমল হলেও এই ধরেন ফাতিহা পাঠের মাধ্যমে জিয়ারত করা নিষন্দেহে বিদআত।

 

১০।  কুরআন খতম করে বখশে দেয়াঃ

প্রতি জুমার দিন দেখা যায় জুমার সালাত শেষে সম্মিলিত মনাজাতের আগে ইমাম সাহেব ঘোষনা করেন। এক খতম বা দুই খতম কুরআন আছে। মুসল্লীগন বুঝে নেন কেউ হয়ত কুরআন খতম করছেন তাই এই খতম এখন বখশে দিতে হবে। সাধারণত মেয়েদের মাঝে এই রেওয়াজ আছে যে, রমযান মাসে বা অন্য সময় তারা কুরআন খতম সমাপ্ত করার পর মসজিদের ইমাম সাহেবকে তা জানিয়ে দেয়। ইমাম বলেন, অমুক কুরআন খতম করেছে, তা বখশে দিন! কোথাও কোথাও এ কথা জানানোর সাথে সাথে যিনি বখশে দেন তার জন্য কিছু হাদিয়া পাঠানো হয়। অনেক এলাকায় মেয়েলা তালিম করে তারা তালীম শেষে দুয়ার সময় বখশে দেয়ার জন্য বিশেষ দোয়ার ব্যবস্থা করে। এই আলটি বিদআত কারন।

কুরআন তিয়ওয়াত করা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নফল ইবাদত। এই নফল ইবাদাত করা সময় যে নিয়তে করা হবে মহান আল্লাহ তাই কবুল করবেন। ধরুন আমি নিয়ত করলাম, আপনি আপনার মৃত বাবা মায়ের নিকট সওয়ার পৌছানর জন্য এক খতম কুরআন পড়ার নিয়ত করলেন। যদিও মৃত্যুদের জন্য কুরআন পড়ান সুন্নাহ পাওয়া যায় যায় না। আপনি যখন নিয়ত করে পড়া শুরু করলেন আশা করি আমল করার সাথে সাথে আপনার ইখলাসের উপর ভিত্তি করে সওযাব পৌছান শুরু হবে। তা না হলে যে কুনআন হাদিস সবই মিথ্যা হবে। কিন্ত আপনি যদি ধারনআ করেন আমরা আমল কবুল হবে না, মহান আল্লাহ দরবারে পৌছাবে না, যতক্ষনা পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহের জুমার দিন বখশিয়ে না দিবেন!!

এমন কথা বললে মানুস আপনাকে পালগ বলবে। আসলে আমল নিয়ত করে শুরু করা সাথে সাথেই কবুল হয় কারো সুপারিসের জন্য বসিয় রাখা হয় না। নিয়তের উপরই আপনার আমল কবুল হবে ইমাম সাহেব বা কোন বুযুর্গের মাধ্যমে বখশানোর কোনো প্রয়োজন নেই। কোনো বুযুর্গের দ্বারা বখশানো ছাড়া ছওয়াব পৌঁছবে না এমন ধরণা একটি ভুল আকীদা, যা ত্যাগ করা জরুরি। বখশানোর জন্য হাদিয়া দেওয়া বা নেওয়ার বিষয়টি আরও মারাত্বক কারন যেখান আমল কবুলের জন্য বখশানই ঠিক নেই সেখনে হাদিয়ার বিনিমনে বখশান জায়েয নয়। দুআ একটি খালিস ইবাদত, যার বিনিময়ে হাদিয়ার আদান-প্রদান হারাম।

১১।  মৃত্যুর জন্য দৈহিক ইবাদত সমূহের হাদিয়া দেওয়াঃ

মহান আল্লাহ তাআলা মানুষকে এই পৃথিবীতে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। মানুষ পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে থাকে ততদিনই তার আমল করার সময়। মৃত্যু বরণ করার সাথে সাথে তার আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তাই অনেকেই তাদের মৃত মা-বাবার জন্য কিছু করতে চায়। কিন্তু জ্ঞান সল্পতার কানে সঠিক আমলটি করতে পারে না। আমাদের অনেকের জানাই নাই যে সালাত, কিরাআত ও অন্যান্য দৈহিক ইবাদত সমূহের নেকী মৃতদের জন্য হাদিয়া দেওয়া যায় না।  কিন্তু মৃত ব্যক্তির সাদকায়ে জারিয়ার আমল মৃত্যুর পরও সওয়াব পৌছাতে থাকে। মৃত ব্যক্তি রেখ যাওয়া নেক সন্তান, উপকারী কাজ যা থেকে এখনও মানুষ মরার পরও উপকার পাচ্ছে এবং এমন দ্বীনি শিক্ষা যা এখনও মানুষ উপকৃত হয়। (সহিহ মুসলিম)।

ব্যক্তির জন্য তার কর্মের ফল ভোগ করবে কিন্তু সদগায় জারিয়ার নেকী ছাড়াও যদি তার সন্তার বা নিকট আত্মীয়দের মধ্য থেকে তার দান করে বা দোয়া করে তবে তা তিনি পেয়ে যাবেন। এই কথার দলীল হল কুরআনতের আয়াত ও সহিহ হাদিস।নিম্মের দলীলগুলি একটু লক্ষ করিঃ

১। আল্লাহ তায়ালা মৃত বা জীবিত পিতা-মাতা ও মুমিদের জন্য দু‘আ করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে বলেনঃ

رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ

অর্থঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং সব মুমিনকে ক্ষমা করুন, যেদিন হিসাব কায়েম হবে। (সুরা ইবরাহীম ১৪:৪১)।

মহান আল্লহ আরও বলেন,

وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا

অর্থঃ তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলঃ হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। [ সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:২৪ ]

হাদিসঃ- আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ ‘‘জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমার মা হঠাৎ মৃতু বরণ করেছেন। তাই কোন অসিয়ত করতে পারেন নি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে দান-সাদকা করতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে সাদকা করলে তিনি কি এর সওয়াব পাবেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন।’’ [সহীহ মুসলিম:২৩৭৩]

মন্তব্যঃ সদগায় জারিয়া, দুয়া ও দান ছাড়া মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে অছিয়ত কৃত হজ্জ করা যায় এবং তার ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয় তার কৃত ভাল কাজ চালু রাখা, খারাজ কাজ বদ্ধ করে দেয়া, বন্ধুদের সম্মান এবং আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখলে তিনি উপকৃত হবেন 

ইহার বাহিরে কোন ব্যক্তি কোন দৈহিক আমল করে মৃত্যুর জন্য পৌছাতে পারবে না সালাত আদায় করে তার জন্য পৌছান যাবে না অনুরূপ তার অছিয়ত কৃত সিয়ামের কাফফারা আদায় কর ওয়াজিব হলেও তার জন্য আর সিয়াম রেখে সিয়ামের নেকী পৌছান যাবে না কাজেই দৈহিক আমল পৌছান একটা বিদআত মাত্র যার আমল তাকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে, তাকে আল্লাহ ব্যতিত কেউই উপকার করতে পারবে না

১২।  একধিকবার জানাযা ‌আদায় করাঃ

ইদানীং আমাদের সমাজে একটি প্রথা চালু হয়েছে যে, একজন মৃত ব্যক্তির জানাজা সালাত একাধিক বার আদায় করা। একজন মৃত ব্যক্তির জানাযার সালাত একাধিকবার পড়া যায় কিনা সে সম্পর্কে সকলের মতামতগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করব। ইনশাআল্লাহ।

একজন মৃত ব্যক্তির জানাজা সালাত একাধিক বার আদায় করার বিষয়টি একটি বিরোধপূর্ণ মাসায়েল। এ সম্পরকে তিনটি মত পাওয়া যায়।

ক। একাধিকবার জানাযা সালাত জায়েয।

খ। শর্ত সাপেক্ষে একাধিকবার জানাযা সালাত জায়েয।

গ। একাধিকবার জানাযা সালাত জায়েয নেই।

 ১৩।  একাধিকবার জানাযা সালাত জায়েযঃ 

একজন মৃত ব্যক্তির জানাযার ছালাত একাধিকবার পড়া যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জানাযার ছালাত একাধিক বার হয়েছিল (আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃঃ ৪৭১)। অনুরূপভাবে একই ব্যক্তির জানাযায় একজন একাধিকবারও শরীক হ’তে পারে। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৬৫৮, ৫৯; মির‘আত ৫/৩৯০পৃঃ; তিরমিযী হা/১০৩৭; তুহফাতুল আহওয়াযী ৪/১৩০পৃঃ)।

মন্তব্যঃ এ সবই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পরের ঘটনা প্রবাহ থেকে সাহাবিদের আমল। কিন্তু এর পরবর্তিতে খোলাফায়ে রাসেদীনদের ৩০ বছরে খেলাফতের সময় এই আমল আর দ্বিতীয়বার দেখা যায়নি।

 

১৪।  শর্ত সাপেক্ষে একাধিকবার জানাযা সালাত জায়েযঃ

একবার কারো জানাযা পড়া হলে পূণরায় তার জানাযা পড়া যাবে না। তবে মৃত ব্যক্তির অবিভাবকের অজ্ঞাতসারে তাদের ছাড়াই যদি অন্যরা জানাযা পড়ে ফেলে, তখন মৃত ব্যক্তির অবিভাবকদের জন্য দ্বিতীয়বার জানাযা পড়ার সুযোগ আছে। তখন যারা একবার জানাযা পড়েছে তারা দ্বিতীয়বার সে জানাযায় শরিক হবে না।

ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত ব্যক্তির অলী বা অবিভাবককে প্রথম জানাযা না পড়িয়ে দ্বিতীয়বার জানাযা পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা শরীয়ত সমর্থন করে না। আর প্রথম যারা আদায় করেছেন, তাদের প্রথম পড়ার দ্বারা তাদের ফরজ আদায় হয়ে গেছে। এখন দ্বিতীয়বার পড়ার দ্বারা ফরজ আর থাকছে না, বরং তা নফল হয়ে যাবে। আর জানাযা নামাযে নফল বলতে কিছু নেই। তাই প্রথমবার যারা শরীক হয়েছেন, তারা দ্বিতীয় জানাযায় আর শরীক হবে না।

মন্তব্যঃ অবিভাবকের অনুমতি না নিয়ে জানাযার সালাত আদায় করলে, অবিভাবকের ইচ্ছায়ই কেবল দ্বিতীয় জানাযা করা যাবে

 ১৫।  একাধিকবার জানাযা সালাত জায়েয নেইঃ

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের পাঁচটি অধিকার রয়েছেঃ সালামের জবাব দেওয়া, রোগী দেখতে যাওয়া, জানাযায় অংশ গ্রহণ করা,  দাওয়াত গ্রহণ করা এবং কেউ হাঁচি দিলে তার জবাব দেওয়া।’’ (বুখারী ১২৪০, মুসলিম ৫৭৭৬)

জানাযার সালাত আদায় করা প্রত্যেক মুসলীদের উপরে ফরজে কিফায়া। কিন্তু পৃথিবীর সব মুসলমানের জন্য প্রত্যেক মৃত মুসলিমের জানাজার নামাজ আদায় করার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ কিছু মানুষ আদায় করলে সবার ওপর থেকে ফরজ আদায় হয়ে যাবে। কোনো নির্দিষ্ট ফরজ আমল একাধিকবার করা যায় না। নফল বারবার করা যায়। যেহেতু ফরজ নামাজে জানাজা আদায় হয়ে গেছে সেহেতু আবার ফরজ নামাজে জানাজা আদায়ের সুযোগ নেই। এক ফরজ একাধিকবার আদায় করা যায় না। যেমনঃ আপনি আজকের জোহরের ফরজ নামাজ একবার পড়ার পর তা আর পড়তে পারবেন না। এর পরেও যদি আপনি নামাজ পড়েন, তা জোহরের ফরজ নামাজ হবে না বরং তা হবে নফল নামাজ। হজ জীবনে একবার ফরজ। একবার হজ করার পর আর কখনও ফরজ হজ করতে পারবেন না। যদি আবারও হজ করেন তা হবে নফল হজ্জ। সালাত, হজ্জ, সাওম, দান এমনি অনেক ইবাদাত ফরজ বা নফল উভয় সুরতে আদায় করা যায় কিন্তু জানাযার সালাত কখনও নফল হয় না। তাই, সালাত, হজ্জ, সাওম ও দানের মত জানাযা নফল হয়না তাই দ্বিতীয় বার ও আদায় কথা যায় না।

মন্তব্যঃ কোন বিখ্যাত নামি দামি ব্যক্তি মারা গেলে তার একাধিক জানাযা আদায় করা শহরে এখন একটা প্রথা হিসেবে চালু হয়েছে। এমনকি মৃতের নামাজে জানাজার একাধিক জামাত বর্তমান সময়ে সামাজিক প্রভাব ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একাধিকবার জানাযার সালাত আদায় করা কয়েক দশক আগেও মুসলীম সমাজে প্রচলিত ছিল না। অথচ এখন তো প্রায়ই দেখা যায়, কেউ শহরে মারা গেলে তার বসবাসের মহল্লার মসজিদ থেকে শুরু করে আরও বেশ কয়েক স্থানে মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। অনেক সময় তো জানাজার সংখ্যা হয়ে যায় ১০-১২টি।

এভাবে নামাজে জানাজার দৃষ্টান্ত মহানবী (সা.) ও তার অনুসারী সাহাবাদের জীবনে নেই। যারা রাসুল সাঃ এর জানাযার রেফারেন্স দিয়ে বলে থাকের একাধিক বার জায়েয তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের ঐ বিশেষ মুহুর্তের কথা ভুলে যান, যেখানে সাহাবিদের মাঝে ব্যাপক মতভেদ চলছিল। তাদের কোন আমির/খলিফা নির্দিষ্ট না থাকায় জানাযা নিয়ে এমনটা হয়েছে। কিন্ত পরে যখন আবার উম্মতের মাঝের মতভেদ দুর হল এবং খলিফা নির্বাচিত হল, তখন থেকে আর কোন জানাযা একধিকবার  আদায় করা হয়নি।

তাই একাধিকবার জানাযার সালাত আদায় করা বাড়াবাড়ি করা ছাড়া আর কিছুই না যদি ফজিলতপূর্ন হত তবে সাহাবিগন, তাবেয়ীগন ও তাবেতাবেয়ীগন এধারা চালু রাখতেন আমরাও হাজার হাজার সহিহ হাদিস পেয়ে যেতাম কাজেই এভাবে একাধিক জানা ছালাত আদায় করা ইসলামি শরিয়ত সম্মত সুন্নত নয়, কোন মতে জায়েয বলা যেতে পারে, কারন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের ঐ বিশেষ মুহুর্তের জানাযার সালাত বার বার আদায় করা হয়েছে অপর পক্ষে অবিভাবকের দাবিতে দ্বিতীয় জানাযা আদায় করা  ফিকহি পরিভাষায় শুদ্ধ আমল

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment