পঞ্চম কিস্তিঃ শবে বরাতের বিদআত

পঞ্চম কিস্তিঃ শবে বরাতের বিদআত

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

১। শবে বরাত উপলক্ষে ১৪ শাবান দিনে রোযা রাখাঃ

এ সম্পর্কে শবে বরাত অনুসারীগণ নিম্মের হাদিসটি উল্লেখ করে থাকে।

আলী ইবনে আবী তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সূর্য অস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিজিক প্রার্থনাকারী আমি রিজিক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যান্ত বলা হয়ে থাকে। (হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে ১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৮; বর্ণনা করেছেন; বাইহাকীতেও হাদিসটি আছে তবে এই হাদিসটি জাল। পূর্বে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে)।

মন্তব্যঃ জাল হাদিসের উপর ভিত্তি করে কোন আমল করা যাবে না বলে উম্মতের মুস্তাহীদ আলেমগণ এক মত আছে। যেহেতু এই হাদিসটি জাল তাই ও দ্বারাও কোন আমল সৃষ্ট করা যাবে না এবং লাইলাতুল নিসফে মিন শাবান বা শাবানের মধ্য রাতে কেন্দ্র করে সিয়াম পালন করা যাবে না। কিন্তু শাবান মান খুবই বরকতময় মাসে এই মাসে খুবই সিয়াম পালন করতেন। যেমন হাদিস এসেছেঃ

   ‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে (এত বেশী) সিয়াম পালন করতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর সিয়াম পরিত্যাগ করবেন না। (আবার কখনো এত বেশী) সিয়াম পালন না করা অবস্থায় একাধারে কাটাতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর (নফল) সিয়াম পালন করবেন না। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে রমজান ব্যতীত কোন পুরা মাসের সিয়াম পালন করতে দেখিনি এবং শা’বান মাসের চেয়ে কোন মাসে বেশী (নফল) সিয়াম পালন করতে দেখিনি। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৪৫ ইফাঃ)

‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা‘বান মাসের চেয়ে বেশী (নাফল) সিয়াম কোন মাসে পালন করতেন না। তিনি (প্রায়) পুরা শা’বান মাসই সিয়াম পালন করতেন এবং বলতেনঃ তোমাদের সাধ্যে যতটুকু কুলোয় ততটুকু (নফল) আমল কর, কারণ তোমরা (আমল করতে করতে) ক্লান্ত হয়ে না পড়া পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা (সওয়াব দান) বন্ধ করেন না। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় সালাতই ছিল তাই যা যথাযথ নিয়মে সর্বদা আদায় করা হত। যদিও তা পরিমানে কম হত এবং তিনি যখন কোন (নফল) সালাত আদায় করতেন পরবর্তীতে তা অব্যাহত রাখতেন। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৪৬ ইফাঃ)

শাবান মাসে বেশী থেকে বেশী সিয়াম পালন করা সুন্নাহ। তা হলে প্রশ্ন হল বেশী বেশী সিয়াম পালনেন সময় এর মাঝে যদি লাইলাতুল নিসফে মিন শাবান বা শাবানের মধ্য রাত হয় তবে কি সিয়াম আদায় করলে বিদআত হবে না। প্রতি চন্দ্রমাসে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে মোট ৩ দিনের সিয়াম পালনে করা সুন্নাত যা হাদিস দ্বারা প্রমানিত। এই তিন দিনকে শরীয়াতের পরিভাষায় “আইয়ামুল বীদ” বলা হয়। এই সিয়াম পালন সম্পর্কে হাদিসে এসেছেঃ

আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে আবূ যার! তুমি যখন কোন মাসে তিনদিন সওম পালন করতে চাও, তাহলে তেরো, চৌদ্দ ও পনের তারিখে করবে। (হাদিসের মান হাসান সহিহ: মিশকাত-২০৫৭, রিয়াযুস স্বা-লিহীন ১২৭০; তিরমিযী ৭৬১, নাসায়ী ২৪২৪)

আবু কাতাদাহ ইবনে মিলহান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শুক্লপক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার জন্য আদেশ করতেন।’ (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন ১২৭১; আবূ দাউদ ২৪৪৯, নাসায়ী ২৪৩২)।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে ও সফরে কোথাও শুক্লপক্ষের (তিন) দিনের রোযা ছাড়তেন না।’ (হাদিসের মান হাসান রিয়াযুস স্বা-লিহীন, ১২৭২, নাসায়ী ২৩৪৫)।

যদি কার প্রতি চন্দ্রমাসে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে সিয়াম পালন করে থাকে। তবে সেও শাবান মাসের এই তিন দিন সিয়াম পালন করতে বিদআত হবে না। কিন্তু যদি কেউ শুধু এই দিনকে ভীষন গুরুত্ব দিয়ে সিয়াম পালন করে তবে  তা  বিদআত হবে।  

 

২। বিশেষ নিয়মে সালাত আদায় করাঃ

এ রাতে এক অদ্ভূত পদ্ধতিতে একশত রাকাআত নামায আদায় করা হয়। যাকে বলা হয় সালাতুল আলাফিয়া। একশত রাকাআত নামায পড়ার পদ্ধতিটি হল নিম্নরূপঃ

মোট একশত রাকাআত নামায পড়তে হয়। প্রতি দু রাকাত পর সালাম ফিরাতে হবে। প্রতি রাকাআতে সূরা ফাতিহার পর দশ বার সূরা ইখলাস পাঠ করতে হবে। একশত রাকাআত নামাযে সূরা ইখলাস পাঠ করতে হয় মোট এক হাজার বার। তাই এ নামাযকে সালাতে আলফিয়া বলা হয়। (ইমাম গাযালী (রাহ.) এ পদ্ধতিটি এহিয়া উলুমুদ্দীন ১/২০৩)।

মন্তব্যঃ এই সালাত বিদআত কেননা, ইসলামে এ ধরণের নামায পড়ার নিয়ম সম্পূর্ণ নতুন আবিস্কৃত বিদআত। এ ব্যাপারে সর্ব যুগের সমস্ত আলেমগণ একমত। কারণ, তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদীন কখনো তা পড়েন নি। তাছাড়া ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, আহমদ বিন হাম্বল, সুফিয়ান সাওরী, আওযাঈ, লাইস প্রমূখ যুগ শ্রেষ্ঠ ইমামগণ কেউ এ ধরণের বিশেষ নামায পড়ার কথা বলেন নি। এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসটি হাদীস বিশেষজ্ঞদের মতে বানোয়াট এবং জাল। যেমন, ইব্‌নুল জাওযী উক্ত হাদীসটি মাওযু’আত (জাল হাদীস সংগ্রহ) কিতাবে তিনটি সনদে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি যে বানোয়াট তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনটি সনদেই এমন সব বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের অধিাকংশরই পরিচয় অজ্ঞাত। আরো কতিপয় বর্ণনাকারী খুব দূর্বল। সুতরাং হাদীসটি নিশ্চিতভাবে জাল। (আল মাউযূআত ২য় খন্ড ১২৭-১৩০ পৃষ্ঠা)।

এই সালাতের ইতিহাসঃ ইমাম ত্বরতূশী (রাহ:) বলেন, শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে একশত রাকআত নামায পড়ার পদ্ধতি সর্ব প্রথম যে ব্যক্তি চালু করে তার নাম হল ইব্‌ন আবুল হামরা। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের নাবলুস শহরের অধিবাসী। তিনি ৪৪৮ হিজরী সনে বাইতুল মাকদিসে আসেন। তার তেলাওয়াত ছিল খুব সুন্দর। তিনি শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে মসজিদুল আকসায় এসে নামায শুরু করে। আর এক লোক তার পেছনে এক্তেদা করে। অতঃপর আর একজন আসে। কিছুক্ষণপর আরে আরও একজন। এভাবে নামায শেষে দেখা গেল বিরাট জামাআতে পরিণত হয়েছে। পরিবর্তী বছর শবে বরাতে সে ব্যক্তির সাথে প্রচুর পরিমাণ মানুষ নামাযে শরীক হয়। এভাবে এ নামাযটি মসজিদে আক্বসা সহ বিভিন্ন মসজিদে পড়া আরম্ভ হয়ে গেল। কিছু মানুষ নিজেদের বাড়িতে এ নামায পড়া শুরু করে দিল। পরিশেষে এমন অবস্থা দাঁড়ালো যেন এটি একটি সুন্নাত। (আত্‌ ত্বারতুশী রচিত আত্‌তাহযীর মিনাল বিদা। পৃষ্টা: ১২১ ও ১২২)।

 

এ সম্পর্কে আরো দুটি জাল হাদিস নিম্মে উল্লেখ কার হলঃ

১। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “হে আলী, যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের রাত্রিতে এমনভাবে একশত রাকাত নামায আদায় করবে যে, প্রতি রাকাআতে সূরা ফাতিহার পরে দশবার কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’সূরা পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তার সে রাত্রির যাবতীয় প্রার্থনা পূরণ করবেন।

মন্তব্যঃ ইব্‌নুল জাওযী উক্ত হাদীসটি মাওয়ুআত কিতাবে তিনটি সনদে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি যে বানোয়াট তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনটি সনদেই এমন সব বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের অধিাকংশরই পরিচয় অজ্ঞাত। আরও কতিপয় বর্ণনাকারী খুব দূর্বল। সুতরাং হাদীসটি নিশ্চিতভাবে জাল। অথচ আমরা অনেক মানুষকে দেখি যারা এ সারা রাত ধরে নামায পড়ার পর এদের ফজর নামায ছুটে যায় কিংবা সকালে যখন উঠে অলসতা সহকারে উঠে। কিছু মসজিদের ইমাম শবে বরাতের এ সব নামাযকে সাধারণ জনগণকে একত্রিত করার এবং এর মাধ্যমে নিজেদের রুটি-রুযি ও উন্নতির মাধ্যমে হিসেবে গ্রহণ করেছে। এরা জনগণকে একত্রিক করে তাদের আলোচনা সভাগুলোতে বিভিন্ন কিচ্ছা-কাহিনী আলোচনা করে থাকে। মুলত এ সবই ভ্রান্ত এবং হকের সাথে সম্পর্ক হীন।

ইব্‌নুল কায়্যেম জাওযিয়াহ আল মানারুল মুনীফ কিতাবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন: জাল হাদীস সমূহের মধ্যে অর্ধ শাবানের রাত্রের নামায পড়া সম্পর্কীত উক্ত হাদীসটি অন্যতম। এর পর তিনি বলেন: আজব ব্যাপার হল, কিছু মানুষ যারা হাদীসের কিছু ঘ্রাণ পেয়েছে তারাও এ সকল উদ্ভট হাদীস দেখে প্রতারিত হয়ে শবে বরাতের নামায পড়া শুরু করে দেয়। অনুরূপভাবে ইমাম সুয়ূতী রা. উপরোক্ত হাদীসটি আল লাআলী আল মাসনূআ ’ কিতাবে উল্লেখ করে সেটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তদ্রুপ ইমাম শাওকানী রা. এটিকে আল ফাওয়ায়েদুল মাজমূআহ কিতাবে জাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

 

২। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের রাতে বার রাকাত নামায পড়বে-প্রতি রাকাতে কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ সূরাটি পড়বে ত্রিশ বার-তাহলে সে জান্নাতে তার আসন না দেখে বের হবে না।

মন্তব্যঃ এ হাদীসটিও ইব্‌নুল জাওযী রা. তার আল মাওযূআত কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এ হাদীসটিও জাল। এ হাদীসটির সনদে এমন একদল বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের সকলের পরিচয় অজ্ঞাত। অনুরূপভাবে ইমাম সূয়ূতী রাহ. আল লাআলী কিতাবে এবং ইমাম ইব্‌নুল কয়্যেম (রাহ:) আল মানারুল মুনীফ কিতাবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে এটিকে জাল হাদীস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। স
৩। রাতে নফল ইবাদাত করলে বিদআত হবে কেন?

 যে কোন রাতে বা দিনে যে কেউ ইচ্ছামত জিকির-আসগান, কুরআন তেলাওয়াত, নফল সালাত, দুয়া -মুনাজাত, ইস্তিগফার, কান্নাকাটি, কবর যিয়ারাত, দান-সাদকাহ, ওয়াজ-নাসীহাত প্রভৃতি নেক আমল আদায় করতে পার। এই সকল আমাদের সাথে সময় বা সংখ্যা নির্দিষ্ট করা যাবে না যা বিদআতের আলোচনা থেকে শিখেছি। কারন সংখ্যা ও সময় নির্দষ্ট করার একমাত্র ক্ষমতা হলো মহান আল্লাহর  আর তিনি তার রাসূল সাঃ মাধ্যমে আমাদের বিস্তারিত জানিয়েছেন। তিনি সামান্য কিছুই গোপন করেন নাই।  নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলার সন্ত্বষ্টি অর্জনের জন্য  দুয়া-মুনাজাত, সালাত, সিয়াম, দান-ছাদাকাহ, কুরআন তিলাওয়াত, রাত্রি জাগরণ খুবই ভাল কাজ। এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত করবে না এবং বিদআত ও বলবেনা। কিন্তু যখন কেউ কুনআন সুন্নাহর দলীল ব্যতিত একটি মাত্র রাতকে নির্দিষ্ট করে ইবাদাত করবে তখন তা বিদআত হয়ে যাবে। দলীলহীনভাবে একটি রাতের নাম শবে বরাত বা সৌভাগ্য রজনী অথবা মুক্তি রজনী রেখে তার উপর ভ্রান্ত বিশ্বাস রেখে আমল করলে ঐ সকল সুন্নাহ সম্মত ইবাদাতও বিদআতে পরিনত হবে। যদি কেউ নিয়মিত প্রতি রাতেই এই সকল নফল ইবাদাত করে থাকে তবে ঐ রাতেও সে নফল ইবাদাত করতে পারে বিদআত হবে না। যার সিয়াম পালনের অভ্যাস তিনি এ দিন সিয়াম পালন করতে পারেন। যেমন হাদিসে এসেছেঃ আবু কাতাদাহ ইবনে মিলহান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শুক্লপক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার জন্য আদেশ করতেন।’ (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন-১২৭১; আবূ দাউদ ২৪৪৯; নাসায়ী ২৪৩২)।

তাই যদি কারও প্রত্যেক চদ্র মাসে শুক্ল পক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের সিয়াম পালন করার অভ্যাস থাকে আর সে এই দিন সিয়াম পালন করে তবে বিদআত হবে না। কিন্তু কোন ব্যাক্তি যদি বছরের কখনও সিয়ম পালন করেনা শুধু মিথ্যা বিশ্বাসের উপর শাবান মাসের ১৫ তারিখের সিয়াম পালন করে তবে তা নিঃসন্দেহে বিদআত হবে।

ঠিক তেমনিভাবে বছরের কোন সময় দুয়া-মুনাজাত, সালাত, দান-ছাদাকাহ, কুরআন তিলাওয়াত, রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে কাটালাম না শুধু মিথ্যা বিশ্বাসের উপর শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে কাটালাম তবে বিদআদ হবে। আমাদের একমাত্র আদর্শ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নবুওয়াতের তেইশ বছরের জীবনে কখনো তার সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মক্কায় মাসজিদুল হারামে অথবা মদীনায় মাসজিদে নবুবীতে কিংবা অন্য কোন মাসজিদে একত্র হয়ে উল্লিখিত ইবাদাত-বন্দেগীসমূহ করেছেন এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তথা খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে কেহ জানতো না শবে বরাত কি এবং এতে কি করতে হয়। তারা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ‘আমল প্রত্যক্ষ করেছেন। আমাদের চেয়ে উত্তম রূপে কুরআন অধ্যয়ন করেছেন। তারা তাতে শবে বরাত সম্পর্কে কোন দিক-নির্দেশনা পেলেন না। তারা তাদের জীবন কাটালেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে, অথচ জীবনের একটি বারও তাঁর কাছ থেকে শবে বরাত বা মুক্তির রজনীর ছবক পেলেন না? যা পালন করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে যাননি, যা কুরআনে নেই, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের তা’লীমে নেই, সাহাবীগণের ‘আমলে নেই, তাদের সোনালী যুগের বহু বছর পরে প্রচলন করা শবে বরাতকে নিঃসন্দেহে বিদআদ। হয়তো মনে প্রশ্ন হতে পারে এতদিন ধরে চলছে। মাদ্রাসার বড় হুজুরও আদায় করছে তা হলে বিদআত হয় কি করে? তারা কি কুনআন হাদিস কম বুঝে?

মনে রাখবেন ইসলাম ধর্মে যতগুলো বিদ‘আত চালু হয়েছে তার শতভাগই এক শ্রেনী আলেম দ্বারা। তারা মানুষের বেশী ভাল করতে গিয়ে, ইবাদাত পালনের প্রতি ঝোক সৃষ্ট করতে গিয়ে এই সকল বিদআতের প্রচলণ করেছেন। কোন কালেই কোন সাধারণ মানুষ বা কাফির মুশরিকদের মাধ্যমে বিদআত চালু হয়নি বা প্রসারও ঘটেনি। বিদআত সম্পর্কে ষ্পষ্ট ধারনা রাখতে হবে। কোন আলেমের অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণ করা যাবে না। সন্দেহ হলে ভাল মুহাক্কিক আলেমের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে। কারন কোন কারনে যদি আমি বিআদতি আমল করি বা আমার কারনে বিদআতের প্রসার ঘটে এ জন্য তাদেরকে আল্লাহর সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে। যে দিন বলা হবেঃ

*وَيَوْمَ يُنَادِيهِمْ فَيَقُولُ مَاذَا أَجَبْتُمُ الْمُرْسَلِينَ*

অর্থঃ আর সে দিন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা রাসূলদের আহ্বানে কিভাবে সাড়া দিয়েছিলে? (সূরা কাসাস ৬৫)

সে দিন তো এ প্রশ্ন করা হবে না যে, তোমরা অমুক বড় হুজুরের মত অনুযায়ী বা অমুক ইমামের মত অনুযায়ী ‘আমল করেছিলে কিনা। যারা কুরআন ও সহিহ সুন্নাহ মত ‘আমল করবে তারাই সে দিন সফল কাম হবে। কাজেই বিআদত সম্পর্কে শতর্ক হই। আমার আমলকে কেউ বিদআত বললে, সম্ভব হলে নিজের আমলের পক্ষের দলীল জেনে নেই। দলীল জানা থাকলে আমলেন প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় হয় এবং কিয়ামতের দিন (উপরের আয়াতে বর্ণিত) প্রশ্নের উত্তরে বলা যাবে। হ্যা, তোমার রাসূলের আহবানে সাড়া দিয়ে সুন্নাহ সম্মত আমল করেছি।
৪। হালুয়া-রুটি খাওয়াঃ

শবে বরাত উপলক্ষ্যে ঘরে ঘরে হালওয়া রুটি তৈরি ও খাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। শুধু তাই নয় বরং সে দিন গরীব মানুষও টাকা ধার করে হলেও এক বেলা গোস্ত কিনে খায়। কারণ, সে দিন যদি ভাল খাবার খাওয়া যায় তাহলে নাকি সারা বছর ভাল খাবার খাওয়া যাবে। এ সম্পর্কে আগে চরম কয়েকটি মিথ্যা কথা উল্লেখ করব। এই কথাগুলিকে জাল হাদিস বলতেও ঘৃনা হয়। অথচ যুগ যুগ ধরে অন্ধ ও অজ্ঞ মুসলীমদের মাঝে হাদিস হিসাবে প্রচলিত।

ক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাকি বলেছেন, শবে বরাতে হালুয়া-রুটি বানালে আরশের নিচে ছায়া পাওয়া যাবে।

সমাজে এটিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস হিসেবে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নেই। এটি এমন একটি ভিত্তিহীন কথা যার জাল হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি জাল হাদীসের উপর লেখা কিতাবাদিতেও এর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।

খ। কেউ কেউ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাকি বলেছেন, কেয়ামতের কঠিন দিনে রুটি বড় হয়ে বান্দার মাথার ছাতা হবে।

যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামে কথাগুলো বলা হয় তাহলে বোঝাই যায়, এ কথা হাদিসে বর্ণিত আছে। অথচ সত্যি কথা হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অজস্র হাদিসের কোথাও এমন কোনো বাক্যের উল্লেখ নেই। হাদিসের বর্ণনার সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নেই। সুতরাং নির্দ্বধায় বলা যায়, কথাটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন, জাল ও বানোয়াট। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

গ। কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, ওহুদ যুদ্ধে যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানদান মোবরক শহীদ হয়েছিল, তখন কিছুদিন কোনো প্রকার শক্ত খাবার খেতে পারতেন না। সেই ঘটনার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এই দিনে ঘটা করে হালুয়া রুটি খাওয়া হয়।

সকল মুসলিম জানেন যে, ওহুদ যুদ্ধ হয়েছিল তৃতীয় হিজরী শাওয়াল মাসের সাত তারিখে। এই রক্তক্ষয়ী ও অসম যুদ্ধে কাফেরদের আঘাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁত ভেঙ্গে দিয়ে ছিল যা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত। এরই সুযোগ নিয়ে অনেক বিদআতি জাহেল প্রচার করে কিছুদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো প্রকার শক্ত খাবার খেতে পারতেন না। তিনি এই সময়টা নরম বা হালুয়া রুটি খেতেন। তার সাথে সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য ঐ দিন হালূয়া রুটি খেতে হবে। দেখুন অপরাধী কিভাবে তার অপরাধের সাক্ষী রেখে যায়। ওহুদ যুদ্ধ হয়েছিল শাওয়াল মাসে ও এরা হালূয়া রুটি খায় শাবান মাসে। তিনি নরম খাবার কি শুধু একদিন খেয়ে ছিলেন? কুরআন সুন্নাহ সম্মত আমলেতো নয়ই বরং তাদের কথাগুলী সম্পূর্ণ অযৌক্তিও বটে। বিদআতীদের অবস্থা হল, আল্লাহর নবীর রেখে যাওয়া সাধারণ সুন্নতগুলোও পালন করে না সুবিধামত আমলের নামে বিদআতী কাজ করা। বিদআতী আমলের ভীরে তারা ফরজ সালাত, সিয়াম, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদির কথা ভূলে যায়।

মন্তব্যঃ তারপর সমাজের সুন্নীদাবিদার অজ্ঞদের দাবি, শবে বরাতে হালুয়া-রুটি অথবা অন্য কোনো বিশেষ খাবার তৈরি করা শরীয়তে নাজায়িয তো নয়ই বরং জায়িয এবং খাছ সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। শবে বরাতে হালুয়া-রুটি অথবা অন্য কোনো বিশেষ খাবার তৈরি করা শরীয়তে নাজায়িয তো নয়ই বরং জায়িয এবং খাছ সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। যারা এটাকে বিদয়াত বা নাজায়িয বলে থাকে তাদের কথা মোটেও শরীয়তসম্মত ও গ্রহণযোগ্য তো নয়ই বরং তা সম্পূর্ণরূপে কুফরী ও গুমরাহীতে পরিপূর্ণ যা সর্বতোভাবেই পরিত্যাজ্য।

এ সম্পর্কে তারা এক গল্প আবিস্কার করে ইতিহাস বলে প্রচার করছে। তাদের কল্পিত গল্পটির প্রতি একটু নজর দিন। তাদের দাবি হালূয়া রুটির পিছনে ইতিহাস আছে।  ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্ববর্তী যামানায় যখন বর্তমানের মতো বাজার, বন্দর, হোটেল-রেস্তোরাঁ ইত্যাদি সর্বত্র ছিল না তখন মানুষ সাধারণত সরাইখানা, লঙ্গরখানা, মুছাফিরখানা ইত্যাদিতে ছফর অবস্থায় প্রয়োজনে রাত্রিযাপন করতেন। অর্থাৎ মুছাফিরগণ তাদের ছফর অবস্থায় চলার পথে আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত জনের ঘর-বাড়ি না পেলে সাধারণত সরাইখানা, মুছাফিরখানা ও লঙ্গরখানায় রাত্রিযাপন করতেন। আর এ সমস্ত মুছাফিরখানা, লঙ্গরখানা ও সরাইখানার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত থাকতেন তারাই মুছাফিরদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। বিশেষ করে মুছাফিরগণ শবে বরাতে যখন উল্লিখিত স্থানসমূহে রাত্রি যাপন করতেন তাদের মধ্যে অনেকেই রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করতেন ও দিনে রোযা রাখতেন। যার কারণে উল্লিখিত স্থানসমূহের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ খাবারের ব্যবস্থা করতেন যাতে মুছাফিরদের রাত্রে ইবাদত-বন্দেগী করতে ও দিনে রোযা রাখতে অসুবিধা না হয়। আর যেহেতু হালুয়া- রুটি ও গোশত-রুটি খাওয়া সুন্নত, সেহেতু তারা হালুয়া-রুটি বা গোশত-রুটির ব্যবস্থা করতেন। এছাড়াও আরবীয় এলাকার লোকদের প্রধান খাদ্য রুটি-হালুয়া বা রুটি-গোশত। তারা ভাত, মাছ, ইত্যাদি খেতে অভ্যস্ত নয়। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে শবে বরাত উপলক্ষে হালুয়া রুটির প্রচলন আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

কি সুন্দর গল্প মনে রমাজান মাসে কেউ সফর করে না। রমজান মাসে কেউ সরাইখানা, মুছাফিরখানা ও লঙ্গরখানায় রাত্রিযাপন করে না। এই মাসে কেউ রাতে সালাত আদায় করে না। তাই রমাজান মাসে সরাইখানা, মুছাফিরখানা ও লঙ্গরখানায় কোন হালুয়া রুটি তৈরি হয়। এই গল্প সঠিক ভাবলে সম্পূর্ণ রমাজান হালূয়া রুটি তৈরিতে শেষ হয়ে যেন।

অসংখ্যা বার কুনআন ও হাদিসে মহান আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম, পথীক, অসহায় ও বন্দিদেরকে সাহায্যের তাগিদ প্রদান করেছেন। বিদআতি এই সকল আয়াত ও হাদিস কোট করে। প্রশ্ন করে শবে বরাতে এই সকল কাজ করা নাকি বিদআত? আসলে বিদআত সম্পর্কে এদের সামান্যতম ধারনা নেই। আপনি কোন বিদআতি আমলকে বিদআত বলবেন তো সে বললে ঠিক আছে বিদআত, তো এটা বিদআতে হাসান। অথচ বিদআতে কোন হাসানা ও শাইয়াহ নেই।
৫। ছবি ও মূর্তি আকৃতিতে মিষ্ট তৈরিঃ

উপমহাদেশের হিন্দুদের অন্যতম একটি সংস্কৃতি হল, বৈশাখ মাসে মেলার আয়োজন করা। তারা অনেক অসামাজিক কাজের মাধ্যমে মেলা উৎজাপন করে থাকে। মেলায় বিভিন্ন স্টোলে বাহারী জিনিসের সমাহার ঘটে যার মধ্য অন্যতম আকর্ষন হল মিষ্টির দোকাণ। তারা বিভিন্ন জীব জস্তু ও মুর্তির আকুতিতে মিষ্টি করে। আর হিন্দুগন তা মনের আনন্দে খরিদ করে নেয়। কিন্তু আজকাল আমাদের দেশে শবে বরাত উপলক্ষ্যে মিষ্টির দোকানে এই জীব জস্তু ও মুর্তির ছবি সম্বলিত মিষ্টি তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। অথচ ছবি ও মূর্তি-প্রকৃতি ইত্যাদি তৈরি করা ইসলামে হারাম। আবার আল্লাহর দেয়া রিযিক নিয়ে এভাবে খেল-তামাশা করা করা কত বড় জঘন্য অপরাদ।

 

 

৬। মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করাঃ 

উপমহাদেশে যারা বিদআতে ধারক বাহক তাদের অনুষ্ঠান হবে অথচ মিলাদ হবে না ভাবা যায় না। শবে বরাতের রাত আর মসজিদে এশার সালাত পর মিলাদ একটি রেওয়াজে পরিনত হয়েছে। আর ২০/২৫ বছর ঢাকা আছি অনেক মসজিদে সালাত আদায় করা সৌভাগ্য হয়েছে। মাজার পুজারী বিদআতী নয় অনেক দেওবন্দী ঘরানার আলেমও ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শবে বরাতের মিলাদে জিলাপি কেনার জন্য চাঁদা আদায় করতে দেখেছি। এই রাতকে সামনে রেখে ঘরে ঘরে গিয়ে মিলাদের জিলপি কেনার টাকা তোলা হয়। বলূত তো এটা কার সুন্নাহ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগন কি এইভাবে মিলাদের আয়োজন করেছেন। আমাদের চার মাযহাবের কোন ইমান কি এমন আমল করতে বলেছে। শবে বরাত উপলক্ষ্যে মসজিদ ছাড়াও বিদআতিদের খানকাহ ও দরগায়সমূহে বিশাল আয়োজনে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। মিলাদ শেষে চলে মিষ্টি খওয়ার ধুম। চলতে থাকে বিদআতী পন্থায় গরম যিকিরের মজলিশ। এ সব কাজ দ্বীনের মধ্যে বিদআত ছাড়া কিছু নয়।\

৭। মসজিদে সম্মিলিতভাবে খাওয়ার আয়োজন করাঃ

বিদআতীদের অনেক মসজিদে মিলাদ উপলক্ষে রান্না করা খাবার যেমনঃ পায়েশ, ভাত-গোশতের তরকারী, হালূয়া-রুটি জমা করে এবং মিলাদের পরে সকলে মিলে খেয়ে থাকে। মনে হবে, কোন একটি অনুষ্ঠানের খাওয়া দাওয়া চলছে। এই কাজকে তারা ইসলামি কাজ মনে করে নেকীর জন্য করছে অথচ এর কোন দলীল প্রমান কুরআন সুন্নাহতে নেই। এই ভাবে খেতে অসুবিধা নেই কিন্তু নির্দষ্ট দিনে নেকী আশায় আমল করলে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমানিত হতে হবে নতুবা বিদআত হবে।

 

৮। ইসলামি বিষয় আলোচনা ও জিকির করাঃ

ইসলামি বিষয় আলোচনা ও জিকির করার জন্য কোন সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়। আমাদের মাঝে অনেকেই এই রাতে কিয়ামে ব্যস্ত থেকেছেন কিন্তু সহিহ বুঝ আসার পর এই আমল ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু কিছু মুসলীম ভাইকে দেখা যায় এই রাতের মায়া ছাড়তে পারে না। তারা এই রাতের নির্দিষ্ট সালাত ছেড়ে দিলেও এশা সালাতের পর ইসলামি বিষয় আলোচনা ও জিকিরের মাহফিল কায়েম করে থাকেন। প্রশ্ন হল এই আলোচনা ও জিকিরের এই রাতে কেন? যদি তারা বছরের বিভিন্ন সময় এই ধরনের মাহফিল করে থাকে তবে কোন সমস্যা নেই কিন্তু যদি তারা সমগ্র বছরের শুধু এই রাতটিক খাস মনে করে এমন আমল করারে জরুরী মনে করে তবে তা আমল নয় বিদআতে পরিনত হবে। কারন যখন কোন আমল সময়ে সাথে করা কে জরুরী মনে করা হবে তবে তার দলীল প্রয়োজন হবে। আমলটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীদের থেকে প্রমানিত হতে হবে।

অনেক মসজিদে আলোচনা করার পর আবার নির্দিষ্ট সংখ্যক (১২/২০ রাকাত) সালাত আদায় করার সময় প্রদান করেন। এরপর লম্বা একটি সম্মিলিত মুনাজানের মাধ্যমে শেষ করেন। কোন কোন মসজিদে আরার আলোচনা শেষ করে ব্যক্তিগত আমল জিকির, সালাত, তিলওয়াত করার সময় প্রদান করে। ফজর সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজানের মাধ্যমে শেষ করেন। ইসলামি আলোচনা, সালাত, তিলওয়াত, জিকির এবং সম্মিলিত মুনাজান কোনটিই বিদআত নয়। কিন্তু শুধু এই রাতটিক খাস মনে করে সময়ে সাথে নির্দষ্ট করার জন্য বিদআত পরিনত হবে।

 

৯। সম্মিলিতভাবে কবর যিয়ারতঃ

উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেনঃ আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না তাই আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম, ‘বাকী’ নামক কবরস্থানে তাকে পেলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তুমি কি আশংকা করেছো যে আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন? আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন, অতঃপর কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন।

মন্তব্যঃ হাদিসের মান যঈফ। পূর্বের আলোচনায় থেকে জানতে পেরেছি হাদিসটির মান যইফ। তারপরও যদি হাদীসটিকে সহিহ বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলেও কি কোন প্রকার আমল প্রমাণিত। না এ হাদিস দ্বারা কোন আমল প্রমানিত হয় না। এই হাদিসে দ্বারা তিনটি বিষয় পরিস্কার।

১। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক করব জিয়ারত করা

২। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন।

৩। কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন।

যদি কেউ এই হাদিসের আলোকে এই রাতে কবর জিয়ারত করে করতে পারে কিন্তু এই কবর জিয়ারত হবে একাকি, যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন। তিনি সময় সুযোগ থাকা সত্বেও নিজের স্ত্রী বা সাহাবী কাউকে এ আমলে শরীক করান নাই। এ হাদীসে দেখা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানা ছেড়ে চলে গেলেন, আর পাশে শায়িত আয়িশা (রাঃ) কে ডাকলেন না। ডাকলেন না অন্য কাউকে। তাকে জাগালেন না বা সালাত আদায় করতে বললেন না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, রামাযানের শেষ দশকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতে বলতেন। যদি ১৫ শাবানের রাতে কোন ইবাদাত করার ফাযীলাত থাকত তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন আয়িশাকে (রাঃ) বললেন না? কেন রামাযানের শেষ দশকের মত সকলকে জাগিয়ে দিলেন না, তিনি তো নেক কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। কাজেই সম্মিলিতভাবে করব জিয়ারত এই রাতের আমল নয় বিদআত। তারপরও এক শ্রেণীর মানুষ এ রাতে গোরস্থান বা মাযার জিয়ারতে বের হয়। এমনকি কোথাও কোথাও এ প্রথাও দেখা যায় যে, একদল মানুষ এ রাতে ধারাবাহিকভাবে এলাকার সকল কবর যিয়ারত করে থাকে। এদের দলীল হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যঈফ সনদের এই উপরের হাদিসটি।

 

১০। আলোক সজ্জা করা এবং আতশবাজী করা :

শবে বরাতকে কেন্দ্র করে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষেরা আতশবাজি ও আলোকসজ্জা করে থাকে। তারা এ রাত উপলক্ষ্যে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, মসজিদ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি আলোকসজ্জা করা হয়। সে রাতে আশ্চর্য জনকভাবে চলতে থাকে আতশবাজী বা পটকা ফুটানো। শরীয়তের দৃষ্টিতে শবে বরাতে আলোকসজ্জা ও আতশবাজি করা শরীয়তসম্মত নয়। ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আলোক সজ্জা হচ্ছে গ্রীক ধর্মের একটি প্রথা। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে হিন্দু ধর্মের প্রথা হিসেবে রূপ লাভ করে যা শেষ পর্যন্ত দেয়ালীপূজা নামে মশহুর হয়। আলোক সজ্জা সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে মুসলমানগণের মধ্যে প্রবেশ করে।যা আমাদের দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়।  আতশবাজিও দ্বীন ইসলামের দৃষ্টিতে অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে আতশবাজিও হিন্দু ধর্মের একটি প্রথা। কাজেই মুসলমানদের জন্য শুধু শবে বরাতকেই কেন্দ্র করে নয়, বরং কোনো অবস্থাতেই আতশবাজি ও আলোকসজ্জা ইত্যাদি করা শরীয়তসম্মত নয়। এসব কাজের মাধ্যমে একদিকে লক্ষ লক্ষ টাকা শুধু অপচয় করা হয় না বরং এগুলো অগ্নি পুজকদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a comment