ইংরেজী নববর্ষ ও নওরোজ

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

ইংরেজী নববর্ষ

আমাদের দেশে নববর্ষ হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। তেমনি ১ জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে উৎসবের মেজাজে সাড়ম্বরে পালিত হয়ে থাকে। কিছু জাতি যেমন চীনা, ইহুদি, মুসলমান প্রভৃতির মধ্যে নিজ নিজ ক্যালেন্ডার অনুসারে নববর্ষ পালন করতে দেখা যায়। আজ কাল ০১ জানুয়ারির যে ইংরেজী  নববর্ষ উদযাপন করা হয় তা নতুনই বলা চলে। কারণ বেশীদিন হয়নি যখন থেকে এই তারিখ সর্বজনীনভাবে নববর্ষ হিসেবে গৃহীত হয়ে আসছে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে বছরের শুরু হয় জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে।

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার হলোঃ

১৫৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পোপ ত্রয়োদশ গ্রোগোরির এক আদেশ অনুসারে এই বর্ষপঞ্জীর প্রচলন ঘটে। সেই বছর কিছু রোমান ক্যাথলিক দেশ গ্রেগোরিয় বর্ষপঞ্জী গ্রহণ করে এবং পরবর্তীকালে ক্রমশ অন্যান্য দেশসমূহেও এটি গৃহীত হয়। আর ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করে ১৭৫২ সালের সেপ্টেম্বরে। তখন তারা তাদের ক্যালেন্ডার থেকে ১১ দিন বাদ দেয়। তাই ১৭৫২ সালের ক্যালেন্ডারে ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর এই ১১ টি দিন পাওয়া যায় না।

বিশ্বের যে সকল দেশ এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে সিভিল ক্যালেন্ডার হিসেবে গ্রহণ করেছে, তারা সবাই ইংরেজি নববর্ষ পালন করে থাকে। তবে অনেক দেশই ক্যালেন্ডারটি গ্রহণ করার পূর্বে নববর্ষের রীতিটি গ্রহণ করেছে। যেমনঃ ১৫৫৬ সালে স্পেন, পর্তুগাল, ১৫৫৯ সালে সুইডেন, ১৫৬৪ সালে ফ্রান্স, ১৬০০ সালে স্কটল্যান্ড, ১৭০০ সাল রাশিয়া,  ১৭৫২ সাল ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ব্রিটিশ কলোনিগুলো, এই রীতি অনুসরণ শুরু করে। কিন্তু ইসরায়েল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে থাকলেও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। আবার কিছু কিছু দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণ করেনি। যেমনঃ সৌদি আরব, নেপাল, ইরান, ইথিওপিয়া এবং আফগানিস্তান। এসব দেশও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। আমাদের ব্যবহৃত বর্তমান ইংরেজী ক্যালেন্ডারটি ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’।

প্রায় সারাবিশ্বে প্রচলিত ইংরেজী ক্যালেন্ডার এখন ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’। ইংরেজী নববর্ষের শুরু হয় ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২-টা ০১ মিনিটে। আর তখন থেকেই শুরু হয় আতশবাজি, বাদ্য-বাজনা, নাচ-গান, যুবক-যুবতীর ফ্রি স্টাইল ফূর্তি। উল্লাস আর বেলেল্লাপনায় কেটে যায় সারাটি রাত। রাতের গুরুত্বপূর্ণ যে সময়টিকে তারা টগবগে যৌবনের লাগামছাড়া নেশা মেটানোর সময় হিসাবে বেছে নিয়েছে সে সময়টিতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে নেমে আসে।

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মহামহিম আল্লাহ্ তা’আলা প্রতি রাতে রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেনঃ কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছ এমন যে, আমার কাছে চাইবে? আমি তাকে তা দিব। কে আছ এমনে, আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব। (সহিহ বুখারী ১১৪৫ তাওহীদ, ১০৭৯ ইফাঃ)

মহান স্রষ্টার আহবানকে উপেক্ষা করে যারা শয়তানের আহবানে রাত জাগে, তাদের পরিণাম আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম। তিনিই সুক্ষ বিচারক।

বাংলা নববর্ষ এবং ইংরেজী নববর্ষ উদযাপনের মধ্য একটু পার্থক্য আছে। বাংলা সংস্কৃতির আবহে, বাংলা নববর্ষকে গানের মাধ্যমে দিনের শুরুতে আহবান করা হয়। আর ইংরেজী নববর্ষ শুরু হয় ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২-টা ০১ মিনিটে। এই রাতকে থার্টি ফাষ্ট নাইট হিসাবে পালন করা হয়। রাত বারটি বাজার সাথে সাথে বিশ্বের নাম করা সব শহরে আতঁশ বাজির ঝলসানিতে চোখ ঝাঝিয়ে দেয়। তারা এর জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে থাকে। পৃথিবীতে এক সাথে এত বেশী আতঁশ বাজি করা হয় না। ক্ষনিকের আনন্দ উপভোগে এত টাকা খরচ করাকে অপচয় ছাড়া কিছু নয়। বাংলা নববর্ষকে দিনের বেলায় স্বাগতম জানন হয় কিন্তু ইংরেজী নববর্ষ উদযাপনের সময়ই হল নিজ নিজ দেশের মধ্য রাত। এরপর যারা এই দিনটিকে ঘটা করে পালন কর তারা হল বিধর্মী। পর্দা কি, অশ্লীলতা কাকে বলে, যৌনতা কি? এসব তাদের ডিকসনারীতেই নাই। কাজেই ইংরেজী নববর্ষ মানে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেসা, সাথে মদের আসর। বড় বড় হোটেলে পার্টির আয়োজন বা ড্যান্স বারের নর্তকীদের উদ্দাম নাচ। যা হোন এ সব অশ্লীশ কাজতো আর আমাদের ধর্মের কোন সমস্যা করে না। তারা যে ধর্মের অনুসরণ করে সেই ধর্ম মতে কতটুকু শুদ্ধ আর কত টুকু অশুদ্ধ তা তাদের বিষয়। আমাদের নাক গলানোর কিছু নাই। কিন্তু বিষয়টি তা নয়। আজ কার ইংরেজী নববর্ষ উদযাপন আর তাদের বিষয় নয়। কারন আমাদের দেশে এখন ইংরেজী নববর্ষ বেশ জোর শোরে পালিত হচ্ছে।

মন্তব্যঃ বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলা নববর্ষ থেকে ইংরেজী নিউ ইয়ার উদযাপন একটু আলাদা। বাংলা দেশের অধিকাংশ মুসলিম হওয়াতে বাংলা নববর্ষ কিছুটা শালীনতা আছে। কিন্তু ইংরেজী নিউ ইয়ার উদযাপন করে থাকে অধিকাংশই বিধর্মী যাদের নিকটি অশ্লীলতা, যৌনতা ও মাদকতা কোন পাপ নয়। এই দৃষ্টি কোন থেকে বুঝা যায় ইসলামি শরীয়তের আলোকে বাংলা নববর্ষ থেকে ইংরেজী নিউ ইয়ার উদযাপনে কতটা বেশী অশ্লীলাতা থাকবে। ইংরেজী নিউ ইয়ার উদযাপনে অশ্লীলাতা থাকলে মুসলিমদের মাথা ব্যথার কারন নয় কারন এটাতো আর মুসলিমদের অনুষ্ঠান নয়। হ্যা, এই কথাটা সত্য হলে আমরা আর লেখার কোন প্রয়োজন ছিল না। বর্তমানে আমাদের দেশসহ সকল মডারেট মুসলিম দেশের মুসলিমগণ ইংরেজী নিউ ইয়ার কে খু্বই ধুমধামের সাথে উদযাপন করছে। শুধু একটি কথাই বলল যে, কম অশ্লীতায় উদযাপিত বাংলা নববর্ষ যদি উদযাপন ইসলাম সমর্থন না করে, তা হলে অশ্লীলতায় ভরা ইংরেজী নিউ ইয়ার উদযাপন করা কতটা মারাত্বক বুঝে নিন।

নওরোজ

নওরোজ একটি ফার্সি শব্দ যার বাংলা অর্থ ‘নতুন দিন’। ইরানি সৌর বর্ষপঞ্জী অনুসারে পালিত ইরানি নববর্ষ। ইহাকে ‘পারস্য নববর্ষ’ ও বলা হয়।  ইরানি শীয়া মতের অনুসরীগন এই উৎসবকে পালন করে থাকে। নওরোজ বিশ্বের প্রাচীনতম উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঠিক কবে এবং কে প্রথম নওরোজ উৎসব চালু করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়।

নওরোজের ইতিহাসঃ

১। কবি ফেরদৌসির অমর কাব্য শাহনামা ও ঐতিহাসিক তাবারির বর্ণনা অনুযায়ী ইরানের প্রাচীন কিংবদন্তীতে উল্লেখিত বাদশাহ জামশিদ ছিলেন এ উৎসবের প্রথম আয়োজক। কেউ কেউ বলেন, ইরানের হাখামানেশীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাস বা কুরুশ বাবেল বা ব্যাবিলন জয়ের বছর তথা খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে সর্বপ্রথম নওরোজকে জাতীয় উৎসব হিসেবে ঘোষণা ও পালন করেন।

২। আবু রায়হান আল বেরুনি তাঁর বিখ্যাত বই অসারুল বাকিয়্যাহ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। বিখ্যাত পারস্য লেখক তাকি যাদেহ মাদ রাজত্বকালে (৭০৮ খ্রিষ্টপূর্ব-৫৫০-৫২৯ খ্রিষ্টপূর্ব) বাবেল বা বর্তমান ইরাক, তুরস্ক, আজারবাইজান, আফগানিস্তান ও বর্তমান ইরানসহ এতদঞ্চলে তিনটি ঈদ পালনের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। ঈদে নওসারদ (নওরোজ উৎসব), তার ইয়াসকাই (তিরগান বা গ্রীষ্মকালীন উৎসব) ও মেহরানকাই (হেমন্তকালীন উৎসব)। তবে নওরোজ উৎসবটি অভিজাত, জাঁকজমকপূর্ণ ও চাকচিক্যময় আকার ধারণ করে হাখামানশি রাজত্বকালে (৫৫০ খ্রিষ্টপূর্ব-৩৩০-৩২৭ খ্রিষ্টপূর্ব)।
৩। আবার অনেক ঐতিহাসিকগনের মতে প্রাচীন পারস্যের পরাক্রমশালী সম্রাট জমশীদ খৃষ্টপূর্ব ৮০০ সালে এই নওরোজের প্রবর্তন করেছিলো। (ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামী ফাউন্ডেশন)

২। নওরোজ উপলক্ষে কি কি উৎসব রীতিনীত প্রচলিতঃ

নওরোজকে কেন্দ্র করে বর্তমান ইরানে বেশ কিছু বিদআতী উৎসব ও শির্কি রীতিনীত প্রচলিত আছে। নওরোজ পালনের উৎস পারস্যের অগ্নি উপাসক তথা মজুসীদের থেকেই প্রচলিত হয়েছে। সেই হতে যুগে যুগে নওরোজ উদযাপিত হইতেছে। এ ধারাবাহিকতা এখনো পারস্য তথা ইরানে নওরোজ ঐতিহ্যগত নববর্ষের জাতীয় উংসব। পারসিক কালচারে সমৃদ্ধ কাট্টা শিয়া রাষ্ট্র ইরানে এখনো ইহা জাতীয় দিবস এবং দেশের সকল অধিবাসীর মহা আনন্দ উৎসবের সঙ্গে উদযাপন করিয়া থাকে। সাধারণত বিশ বা একুশে মার্চ ফার্সি নববর্ষ শুরু হয়। এই দিন সমগ্র ইরানে ঈদ-ই নওরোজের রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে। বর্তমানে আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক, ইরাক, জর্জিয়া, পাকিস্তান ও ভারতেও কম বেশী নওরোজের উৎসব পালিত হয়।

নওরোজ উপলক্ষে কি কি উৎসব রীতিনীত প্রচলিত তার জানার ইচ্ছা সকলের। তাদের এই উৎসব রীতিনীত জানতে পারলে খুব সহজেই আপনি বুঝতে পারবের ইহার সাথে ইসলামি শরীয়তের সম্পর্ক কতটুকু।

৩। নওরোজ হলো শীয়াদের ঈদঃ

পারস্যের অগ্নি উপাসক তথা মজুসীদের নওরোজ হল শীয়াদের ঈদের দিন তারা এই দিনটি ঈদের চেয়েও বেশী মর্জাদা প্রদান করে থাকে। ইরানি শীয়াগণ এই উৎসবকে সবচেয়ে বড় ঈদ বলেও মনে করে। নববর্ষের প্রথম দিন থেকে ১৩ দিন পর্যন্ত তারা এই উৎসব পালন করে থাকে। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এই উৎসবের জন্য দেশটিতে অন্য যেকোন জাতীয় উৎসবের বেশী দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করে থাকে। প্রায় ১৫ দিন সরকারি ছুটি থাকে এবং দেশটির স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছুটি থাকে প্রায় দীর্ঘ এক মাস। জাতিসংঘের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো নওরোজ উৎসবকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।

৪।  হাজি ফিরুজ ও আমু নওরোজঃ

ঘরে ঘরে নওরোজের শুভেচ্ছা পৌছে দিতে উৎসব শুরুর ১৫ দিন আগে থেকেই এক ব্যক্তি অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে নতুন দিনের জয়গান গায়। পরনে থাকে লাল জামা ও লাল টুপি এবং মুখমণ্ডল কৃষ্ণকায়। এই ব্যাক্তি কে হাজি ফিরুজ হিসাবে নাম করন করা হয়। এই ব্যক্তিই হলো, আনন্দ, উৎসব ও নতুনের আগমনী প্রতীক। হাজি ফিরুজের পাশাপাশি আমু নওরোজ বা নববর্ষ চাচাও সমান জনপ্রিয়। আমু নওরোজ ঈদের রাতগুলোতে বাচ্চাদের জন্য উপহার নিয়ে আসেন। আমু নওরোজের পোশাকের রং হচ্ছে সাদার ওপরে বিভিন্ন কারুকার্য করা পোশাক, সাদা দাঁড়ি ও গোঁফ, মাথায় সাদা টুপি। আমু নওরোজের উৎস সন্ধানে দেখা যায় চমৎকার এক প্রেমকাহিনি। আমু নওরোজ এখনো তার প্রেমিকার অপেক্ষায় আছে এবং সে বিশ্বাস করে তার প্রেমিকার সঙ্গেই তার বিয়ে হবে।

নওরোজ উদযাপনের প্রস্ততিঃ

নওরোজের আগেই ইরানিরা ঘরদোর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে তারা পাড়া-পড়শী ও আপনজনদের সহায়তা করেন। অনেকে আগেই পুরোনো আসবাবপত্র বা জরাজীর্ণ জিনিষ ফেলে দিয়ে তারা নতুন জিনিষ কেনেন। আমাদের দেশের ঈদুল ফিতরের মত নতুন জামা, কাপড়, জুতা প্রভৃতি কেনার হিড়িক পড়ে যায়। নওরোজের মেহমানদারির জন্য তারা ব্যাপক পরিমান ফল, মিষ্টি ও অন্যান্য খাদ্য-সামগ্রী কিনে থাকেন। এ সময় স্থায়ী বাজার ছাড়াও অনেক অস্থায়ী বাজার বা মেলার আসর জমজমাট হয়ে ওঠে।

ইসলামে সাথে সম্পর্কঃ

যদিও শিয়াদের দাবী নওরোজ উৎসব পালনের জায়েয। আসলে ইসলামের সাথে এই উৎসবের কোন সম্পর্ক নাই। তারা এর সাথে শত শত বিদআত সৃষ্টি করে ইসলামের পোশাক দ্বারা আবৃত করছে মাত্র।  ইরানি জাতির নওরোজ উৎসব পালনের ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও ইসলামের আবির্ভাবের পর ইরানে নওরোজ উৎসবের রীতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। ইসলামী আচার অনুষ্ঠান যুক্ত হয় এ উৎসবের সাথে। নওরোজের প্রথম সেকেন্ডেই সবাই এ দোয়া পাঠ করেন। এ সময় তাদের সামনে টেবিলে বা দস্তরখানে থাকে পবিত্র কোরআন, তসবিহ এবং “হাফতসিন” নামে খ্যাত সাতটি বিশেষ সামগ্রীসহ আরো কিছু সামগ্রী।

হাফত সিন বা শিনঃ

হাফত সিন বা সাতটি জিনিস হল নওরোজের প্রধান আকর্ষণ। এটি ছাড়া নওরোজ কল্পনাও করা যায় না।

হাফত সিন হল একটি সুসজ্জিত টেবিল যাতে সাত প্রকার খাদ্য থাকবে যাদের প্রতিটির প্রথম অক্ষর ফারসি অক্ষর সিন (س) দ্বারা গঠিত। নওরোজ শুরুর দিন কয়েক দিন আগে থেকে ইরানের পথে-ঘাটে বেরোলেই চোখে পড়বে হাফত সিনের যাবতীয় জিনিসপত্র বিক্রয়ের দৃশ্য। নওরোজকালীন সময়ে এটি প্রায় প্রতিটি বাড়ির অভ্যর্থনা কক্ষ বা অফিস-আদালতে অপরিহার্য একটি অংশ।

 

যেমনঃ একটি টেবিলে শাম, শারাব, শিরিনি, শাহদ, শামশাদ, শারবাত ও শাকায়েক রাখা হল। এই টেবিলটিই হল হাফত সিন বা শিন এই দ্রব্যগুলিম নাম ফার্সিতে এর অর্থ হলোঃ শাম অর্থ মোমবাতি, শারাব অর্থ মদ, শিরিনি অর্থ মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য, শাহদ অর্থ মধু, শামশাদ অর্থ বৃক্ষ বিশেষ, শারবাত অর্থ  সরবত ও শাকায়েক অর্থ  লাল রঙের টিউলিপ জাতীয় ফুল গাছ বিশেষ।

ইসলাম আগমনের আগে নওরোজের টেবিলে সজ্জিতকরণে এগুলো ছিল অপরিহার্য উপাদান। ইসলাম আগমন করার পর লোকজন চেষ্টা করলেন প্রাচীন রীতিনীতিগুলোকে সংরক্ষণ করবেন এবং নওরোজের মত উসবকে টিকিয়ে রাখবেন। যেহেতু ইসলামে শরাব বা মদ হারাম তাই শরাবের স্থলে সেরকে নির্বাচিত করলেন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে শিন দ্বারা লিখিত ও সজ্জিত সাতটি বস্তুর বদলে সিন দ্বারা প্রচলিত সাতটি বস্তু নির্বাচন করলেন।

ইসলাম আগমনের পর বা বর্তমান হাফত সিনের মূল উপাদ্য হচ্ছে, সিব, সেরকে, সামানু, সোমাক, সির, সেঞ্জেদ, সাবযেহ, সেক্কে ও সঙ্গে একটি পবিত্র কোরআন।

এই দ্রব্যগুলিম নাম ফার্সিতে এর অর্থ হলোঃ সিব অর্থ আপেল, সেরকে অর্থ সিরকা, সামানু অর্থ অঙ্কুরিত গম, বালি বা অন্যান্য শস্যদানা আর আটা দিয়ে তৈরি মিষ্টান্ন বা হালুয়া বিশেষ, সোমাক অর্থ মধ্যমাকারের গাছ বিশেষ যার ফল দেখতে মসুরের ডালের মতো, তবে সামান্য বড় ও টক, সির অর্থ রসুন, সেঞ্জেদ  অর্থ দেখতে বরইয়ের মতো ফল, সাবযেহ অর্থ সবজি। সেক্কে অর্থ ধাতব কয়েন ও সঙ্গে একটি পবিত্র কোরআন। এ ছাড়া ডিম, মাছের উপস্থিতিও হাফত সিনে দেখা যায়।

মন্তব্যঃ যারা নওরোজ উদযাপন করে তাদের বিশ্বাস এগুলোর প্রত্যেকটির অভ্যন্তরে এক একটি পারিভাষিক অর্থ বিরাজমান রয়েছে, যেমন পরিপূর্ণ জীবন, সুস্থতা, বরকত, আরোগ্য লাভ ইত্যাদির প্রতীকী চিত্র। প্রথমত বুঝতেই পারছেন এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এটি কোন ধর্মীয় বিষয় নয়। যদি কেউ এর সাথে ইসলামি শরীয়তের কোন সম্পর্ক দাড় করায় তবে এই কাজ করা বিদআত। কিন্তু এ সম্পর্কে আকিদা রাখে যে, এইগুলি পরিপূর্ণ জীবন, সুস্থতা, বরকত, আরোগ্য লাভ ইত্যাদির প্রতীকী তাহলে আর বিদআত থাকবে না। এটি কুফরি কাজ হবে। কাজেই মুসলিম হিসাবে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ইরানের শিয়াগন এই আমলের সাথে ধর্মকে যোগ করে শির্ক ও বিদআতেমত কাজ কাজ করছে।

৮। চাহার শাম্বে সূরি বা অগ্নি প্রজ্বলন উৎসবঃ

ইসলাম আগমনের আগে পারশ্যবাসীর (ইরান) অধিকাংশ লোক অগ্নী পুজক ছিল। অপর পক্ষে নওরোজও তাদের বহু পুরা সংস্কৃতি। তাই অগ্নীপুজকগণ নওরোজকে স্বাগতম জানাতে চাহার শাম্বে সূরি বা অগ্নি প্রজ্বলন উৎসব উদযাপন করে থাকে। ফারসি সাহিত্যে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী আগুন হচ্ছে ঔজ্জ্বল্য, পবিত্রতা, আনন্দ ও উৎফুল্ল এবং জীবন ও সুস্থতার প্রতীক। প্রাচীন ইরানের জনগণ চাহার শাম্বে সূরিতে হলুদাভ বিবর্ণতা, অপবিত্রতা, নোংরা, দূষিত ও যাবতীয় রোগ-শোককে অগ্নিতে বিসর্জন দেন। ফলশ্রুতিতে রক্তিমতা, প্রফুল্লতা, বর্ণিলতা, সুস্থতা ও কর্মনিষ্ঠতা অগ্নি থেকে গ্রহণ করেন। আনন্দদায়ক এই অগ্নি উৎসবে রংবেরঙের বিস্ফোরকদ্রব্য ও আতশবাজি এবং শত শত ফানুশ রাতের ইরানকে আলোকিত করে।

মন্তব্যঃ এই ধরনের কুফরি আকিদা নিয়ে অগ্নীপুজকদের চাহার শাম্বে সূরি বা অগ্নি প্রজ্বলন উৎসব করা একজন মুসলিমের পক্ষে কিভাবে সম্ভব! ইসলাম সম্পর্কে যাদের সাধারণ ধারনা আছে তারাও বিষয়টি বুঝতে পারবে আশা করি।

 

৯। সিজদাহ বেদার বা প্রকৃতির দিনঃ

প্রাচীন ইরানে নওরোজ উৎসব পালনের পর ফারভারদিন মাসের ত্রয়োদশতম দিনে বৃষ্টির জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনায় নত হতেন। এই দিনটি কে বলা হয়ঃ সিজদাহ বেদার বা রুযে তাবিয়াত বা প্রকৃতির দিন। বর্তমান ইরানীরা এই দিনে মরুভূমি, উন্মুক্ত প্রান্তর, ঝরনার প্রান্ত, পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্রে অবস্থান করেন এবং অত্যন্ত আনন্দ-উৎফুল্লতা এবং হর্ষধ্বনিতে মেতে উঠতেন। সঙ্গে বৃষ্টির জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনায় নত হয়। আবার কোনো কোনো গবেষক ফারভারদিন মাসের ত্রয়োদশতম দিনকে বছরের প্রথম কৃষিকার্যের সূচনা দিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

১০। নওরোজ উপলক্ষে ভ্রমনঃ

এই উৎসব নববর্ষের প্রথম তারিখ থেকে শুরু হয় এক টানা  ১৩ দিন চলে। ১৩ তম দিনে ইরানিদের  কেউই ঘরে থাকে না। তারা সেদিন ঘরের বাইরে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও মনোরম প্রাকৃতিক স্পটে সময় কাটান। বিশেষ করে উদ্যান, ঝর্ণা, পাহাড়, পার্ক- এসব স্থানে তারা চাদর বিছিয়ে বা তাবু খাটিয়ে খোশ-গল্প করে এবং মজাদার খাবার খেয়ে সময় কাটান। আগেই উল্লেখ করেছি, নওরোচ উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইরানে ১৫ দিন সরকারি ছুটি থাকে এবং দেশটির স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছুটি থাকে এক মাস। এই সুযোগে ইরানিরা দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সফর করেন এবং কেউ কেউ বিদেশেও যান। অনেক ইরানি নওরোজের প্রথম প্রহর বা প্রথম দিনটি পবিত্র কোনো স্থানে কাটাতে পছন্দ করেন। অনেকে এ উপলক্ষে পবিত্র কোম শহরে তাদের ইমাম রেজার বোন হযরত মাসুমার মাজারে যান, কেউবা ইরাকে হযরত ইমাম হোসাইনর মাজারে বা আহলে বাইতের অন্য কোনো সদস্যের মাজারে নববর্ষ শুরু করেন।

১১। উপহার বা বখশিশের প্রচলনঃ

নওরোজের দিন অনেকেই একে-অপরকে উপহার বা বখশিশ দিয়ে থাকেন। ছোট শিশুরা বড়দের কাছ থেকে বখশিশ পেয়ে খুব খুশি হয়।

মন্তব্যঃ উপরের আলোচনা থেকে এ কথা ষ্পষ্ট যে বাংলা নববর্ষ যেমন বাঙ্গালী হিন্দুদের উৎসব, ইংরেজী নববর্ষ যেমন খৃষ্টানদের উৎসব ঠিক তেমনি নওরোজ হল প্রাচীর পারশ্যের অগ্নীপুজকদের উৎসব। ইরানের ইসলমি নামধারী শিয়ারা যতই ইসলামের লেবাস লাগিয় নওরোজ উদযাপন করুক না কেন কোন অবস্থায়ই ইসলামি শরীয়ত সমর্থন করবে না।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment