কঙ্কর নিক্ষেপের ভুলত্রুটিসমূহ

কঙ্কর নিক্ষেপের ভুলত্রুটিসমূহ

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

১। মুজদালিফায়ই কঙ্কর সংগ্রহ করতে হবেঃ

২। জমরাতগুলো শয়তান মনে করাঃ

৩। কঙ্কর নিক্ষেপের কয়েকটি ভুল পদ্ধতিঃ

৪। তাওয়াফে যিয়ারাতের পূর্বে ইহরাম ত্যাগ করা যায়ঃ

১। মুজদালিফায়ই কঙ্কর সংগ্রহ করতে হবেঃ

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জমরাতুল আকাবাতে কঙ্কর নিক্ষেপের দিন ভোরে তাঁর সওয়ারীর পিঠে আরোহিত অবস্থায় আমাকে বললেন, আমার জন্য (কঙ্কর) কুড়িয়ে আন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমি তাঁর জন্য কঙ্কর কুড়িয়ে আনলাম। সেগুলো আঙ্গুলের অগ্রভাগ দিয়ে ছুড়ে মারা যায় এমন। তিনি সেগুলো নিজের হাতে রেখে বললেন: আপনারা এগুলোর মত কঙ্কর নিক্ষেপ করুন…। দ্বীনের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে সাবধান থাকুন। কেননা আপনাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণ দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে ধ্বংস হয়েছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ ৩০২৯),

অনেক ধারনা করে থাকে মুজদালিফা থেকে কঙ্কর সংগ্রহ করত হবে। তারা মনে করে মুজদালিফা থেকে কঙ্কর সংগ্রহ করা সুন্নাহ। আসলে আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এমন কোন বর্ণনা আসেনি যে, তিনি মুযদালিফা থেকে কঙ্কর সংগ্রহ করেছেন বা তার উম্মতকে সংগ্রহ করতে বলেছেন। তাই এই কাজটি সুন্নাহ নয় ওয়াজিবতো অনেক দুরের কথা। সুন্নাহ হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা, কাজ বা অনুমোদন। এর কোনটি মুযদালিফা থেকে কঙ্কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি। কাজেই আমরা কঙ্কর যে কোন স্থান থেকে সংগ্রহ করা যাবে, মুযদালিফা থেকে, মীনা থেকে, কিংবা অন্য যে কোন স্থান থেকে। উদ্দেশ্য হচ্ছে কঙ্কর হওয়া।

২। জমরাতগুলো শয়তান মনে করাঃ

আমাদের সমাজে ‘জামারাগুলোকে’ শয়তান অর্থে ব্যবহারের একটা প্রচলন আছে। অর্থাৎ বড় শয়তান, মধ্যম শয়তান ও ছোট শয়তান বলা হয়। এরূপ নামকরণ কোন অবস্থায়ই ঠিক নয়। এ ৩টি জামারা শয়তানের প্রতিকি চিহ্নও নয়। এগুলোকে কঙ্কর নিক্ষেপ করলে শয়তানকে কঙ্কর মারা হয়, এ কথাও ঠিক নয়। এটা একটা ভুল ধারণা ও বিভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস। এই আকিদা বা ধারণা করে যে, এ জমরাতগুলো শয়তান মনে করে তারা ভাবে যে, শয়তানকেই কঙ্কর নিক্ষেপ করছে। এ কারণে আপনি দেখবেন যে, কেউ কেউ তীব্র রাগ, ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়াশীল আসে। যেন শয়তান তার সামনে। এরপর এই জমরাতগুলোতে কঙ্কর নিক্ষেপ করে। যার ফলে নিম্নোক্ত অনিষ্টগুলো ঘটে থাকেঃ

১। এই জমরাতগুলোতে কঙ্কর নিক্ষেপ করি আল্লাহ্‌র যিকিরকে বুলন্দ করার জন্য, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করে এবং ইবাদত হিসেবে। কেননা কোন মানুষ যদি কোন নেকীর কাজের উপকারিতা না জানা সত্ত্বেও সেটা পালন করে. সে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র ইবাদত হিসেবেই সেটা করে। এটি আল্লাহ্‌র প্রতি তার পরিপূর্ণ নতিস্বীকার ও পূর্ণ আনুগত্যের প্রমাণ।

২। কেউ কেউ তীব্র প্রতিক্রিয়া, ক্রোধ, রাগ, শক্তি ও আবেগ তাড়িত হয়ে কঙ্কর মারতে আসে। এরফলে সে ব্যক্তি অন্য মানুষকে কঠিন কষ্ট দেয়। সে কোন মানুষ আর মানুষ করে না, দুর্বলদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না।

৩। এই কঙ্কর নিক্ষেপের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র জন্য একটি ইবাদত পালন করছে। এ কারণে সে ব্যক্তি শরিয়ত অনুমোদিত যিকির-আযকার বাদ দিয়ে শরিয়তে অনুমোদন নেই এমন কথাবার্তা বলে। আপনি দেখবেন যে, কঙ্কর মারার সময় সে ব্যক্তি বলছে: ‘হে আল্লাহ্‌! শয়তানকে অসন্তুষ্টকরণ ও রহমানকে সন্তুষ্ট করণস্বরূপ’। অথচ কঙ্কর মারার সময় এমন কথা বলা শরিয়তসম্মত নয়। বরং শরিয়তের বিধান হচ্ছে- তাকবীর বলা, যেভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন।

নিম্মের হাদিস দুটি লক্ষ করিঃ

১. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর ঘরে তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার সাঈ এবং জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপ আল্লাহ তা‘আলার যিকর প্রতিষ্ঠা করার জন্যই করা হয়েছে। (তিরমিযী)

একটা ভুল অনুভূতি নিয়ে জামারাগুলোকে কঙ্কর নিক্ষেপের ক্ষেত্রে মানুষের ভাবাবেগের পরিবর্তন হয়ে যায়, বাড়াবাড়ি করে ফেলে। ফলে নানা অঘটনও ঘটে যায়। আসুন আমরা ভুল আকীদা পরিহার করি।

২. ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি প্রথম জামরায় সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন এবং প্রতিটি কঙ্কর নিক্ষেপের সাথে তাকবীর বলতেন। তারপর সামনে অগ্রসর হয়ে সমতল ভূমিতে এসে কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াতেন এবং উভয় হাত তুলে দু‘আ করতেন। অতঃপর মধ্যবর্তী জামরায় কঙ্কর মারতেন এবং একটু বাঁ দিকে চলে সমতল ভূমিতে এসে কিবলামুখী দাঁড়িয়ে উভয় হাত উঠিয়ে দু‘আ করতেন এবং দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন। এরপর বাতন ওয়াদী হতে জামরায়ে ‘আকাবায় কঙ্কর মারতেন। এর কাছে তিনি বিলম্ব না করে ফিরে আসতেন এবং বলতেন, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এরূপ করতে দেখেছি। (সহিহ বুখারি ১৭৫১ তাওহীদ প্রকাশনী)

মন্তব্যঃ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঙ্কর নিক্ষেপের সাথে তাকবীর বলতেন (জিকির করতেন) এবং এর পর কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াতেন এবং উভয় হাত তুলে দু‘আ করতেন। কিন্তু অনেকে ধারণা করে, এই জামারাতগুলো শয়তান এবং তারা শয়তানকেই কঙ্কর নিক্ষেপ করছে। যার ফলে কেউ কেউ তীব্র রাগ, ক্ষোভ কারনে কঙ্করের পাশাপাশি ছাতা, জুতা, বড় কঙ্কর ইত্যাদি নিক্ষেপ করে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে থাকে। যেন শয়তান তার সামনে।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা হলো, জমরাতগুলোতে কঙ্কর নিক্ষেপ করার মাধ্যমে  আল্লাহ্‌র যিকিরকে বুলন্দ করব। আর আমরা কঙ্কর নিক্ষেপ করছি ক্ষোপ প্রকাশের জন্য। যদি আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করে কঙ্কর নিক্ষপ করি তবে তা ইবাদত হবে। আর যদি শয়তায় মনে করে তীব্র প্রতিক্রিয়া বা ক্রোধের সাথে কঙ্কর নিক্ষপ করি তাহলে ইবাদাত হবে? যখন কেউ কঙ্কর নিক্ষেপের সময় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় তখনজামারার সামনে অবস্থানরত হাজিদের শুধু  কষ্টই হয়। জামারাকে শয়তার মনে করা একটি ভ্রান্ত আকিদার। যার ফলে সে একটি সুন্নাহ সম্মত ইবাদাত কে বড় বড় কঙ্কর, ছাতা, কাষ্ঠখণ্ড, জুতা ইত্যাদি নিক্ষেপ করে শয়তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার দাবি করে থাকে। জামারাগুলোতে কঙ্কর নিক্ষেপের ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বাস রাখব যে, আমরা আল্লাহ্‌র মহত্ব প্রকাশ ও আল্লাহ্‌র ইবাদত পালন করছি। যেহেতু আমলটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুকরণ হিসেবে করছি তাই মহান আল্লাহ পুরস্কারের আশা করছি।

৩। কঙ্কর নিক্ষেপের কয়েকটি ভুল পদ্ধতিঃ

১। অনেকে জামারার সামনে এতো জোরে কঙ্কর নিক্ষেপ করে যে, কঙ্কর জামারায় লেগে আবার স্বজোরে ফিরে আসে। যার ফলে অন্য হাজিদের গায় লাগে এবং তারা কষ্ট পায়। কাজেই জামারা লক্ষ করে আস্তে নিক্ষেপ করেত হবে। 

২। নিক্ষিপ্ত কঙ্করটি নির্ধারিত স্থানে ফেলার চেষ্টা করেত হবে, তা না হলে নিক্ষেপ করা সহিহ হবে না। কিন্তু অনেক হাজি আছে তারা কঙ্কর নিক্ষেপ করার বিষয়টি ততটা গুরুত্ব দেন না। নির্ধারিত স্থানে পড়ল, নাকি পড়ল না, তারা তার প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ করেন না। যাহোক চেষ্টা থাকবে কঙ্করগুলো যেন জামারার হাউজের ভিতরে পড়ে এতেই ব্যক্তির দায়িত্ব মুক্ত হবে। আবার অনেকে মনে করে যে, কঙ্কর নিক্ষেপ সহিহ হওয়ার জন্য কঙ্করটি পিলারের গায়ে লাগাতে হবে। এটা ভুল ধারনা, কেননা এই পিলার নির্মাণ করা হয়েছে নিক্ষেপের জায়গাটি নির্দিষ্ট বা চিহ্নিত করার আলামত হিসেবে। কঙ্করটি যদি নিক্ষেপের জায়গায় গিয়ে পড়ে তাহলে সেটাই যথেষ্ট।

৩।  প্রতি জামারায় সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করেত হবে। একটি একটি করে আলাদা আলাদা করে নিক্ষেপ করতে হবে। এক সাথে সাতটি কঙ্কর একবার মুষ্টিবদ্ধ করে নিক্ষেপ করা একটি ভুল আমল।

৪। শারীরিক সক্ষমতা থাকা সত্ত্বে অন্যকে দিয়ে কঙ্কর নিক্ষেপ করা যাবে না। কারণ কঙ্কর নিক্ষেপ হজ্জের অন্যতম একটি আমল। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “তোমরা হজ্জ ও উমরা আল্লাহ্‌র জন্য পরিপূর্ণ কর”। (সুরা বাকারা ২:১৯৬) এ আয়াতটির বিধান যাবতীয় কর্মসহ হজ্জ সম্পন্ন করাকে অন্তর্ভুক্ত করে। তাই মানুষের উপর ওয়াজিব হচ্ছে হজ্জের কার্যাবলী নিজেই পালন করা এবং অন্য কাউকে দায়িত্ব না দেয়া।

৫।  ১১, ১২ ও ১৩ই যিলহজ্জ দুপুরের আগেই কঙ্কর নিক্ষেপ করে থাকে। এ কাজটা ভুল। সময় শুরু হয় দুপুরের পর থেকে।

৬।  কেউ কেউ কঙ্কর ধৌত করে থাকে। এ কাজ ঠিক না।

৭। ধাক্কাধাক্কি করে অন্য হাজীদেরকে কষ্ট দিয়ে কঙ্কর নিক্ষেপ করে থাকে। এরূপ করা অন্যায়।

৪। তাওয়াফে যিয়ারাতের পূর্বে ইহরাম ত্যাগ করা যায়ঃ

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি আমার এ দু’হাত দিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে খুশবু লাগিয়েছি, যখন তিনি ইহ্‌রাম বাঁধার ইচ্ছা করেছেন এবং তাওয়াফে যিয়ারাহ্‌র পূর্বে যখন তিনি ইহ্‌রাম খুলে হালাল হয়েছেন। এ কথা বলে তিনি তাঁর উভয় হাত প্রসারিত করলেন। (সহিহ বুখারি ১৭৬৪)

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- কে তাঁর ইহ্‌রামের সময় এবং তাঁর ইহ্‌রাম খোলার জন্যও, জামরাতুল আকাবায় (বড় শয়তানকে) কঙ্কর নিক্ষেপের পর এবং বায়তুল্লাহর তাওয়াফের পুর্বে সুগন্ধি লাগিয়েছি। (সুনানে নাসাঈ ২৬৮৭)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “কঙ্কর নিক্ষেপের ভুলত্রুটিসমূহ

Leave a comment