হজ্জের ভুলভ্রান্তী ও বিদআত তৃতীয় কিস্তি : সাঈ, আরাফা ও মুসদালিফা

হজ্জের ভুলভ্রান্তী ও বিদআত তৃতীয় কিস্তি : সাঈ, আরাফা ও মুসদালিফা

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

১। সাঈ করার সময় ভুলত্রুটিঃ

নাফি’ (রহঃ) থেকে বর্ণিত। ‘আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিঃ) হাঙ্গামা (হাজ্জাজ ইবনু ইউসুফ ও ‘আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাযিঃ) এর মধ্যকার সংঘাত চলাকালীন সময়ে উমরাহ করার উদ্দেশে রওনা হন। তিনি বলেন, বায়তুল্লাহ পৌছতে আমরা যদি বাধাপ্রাপ্ত হই তবে (অনুরূপ পরিস্থিতিতে) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে যেরূপ করেছিলাম, এখনও তদ্রুপ করব। অতএব তিনি রওনা হলেন এবং উমরার ইহরাম বাঁধলেন, তিনি সফর অব্যাহত রাখলেন; যতক্ষণ না আল বায়দা নামক স্থানে পৌছলেন। এখানে তিনি নিজের সঙ্গীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, হাজ্জ ও উমরাহ উভয়ের নিয়ম একই। আমি তোমাদের সাক্ষী করছি যে, আমি নিজের জন্য হজ্জ-কে উমরার সাথে বাধ্যতামূলক করলাম। (রাবী বলেন) অতএব তিনি রওনা হয়ে বায়তুল্লাহ পৌছলেন, সাতবার তাওয়াফ করলেন এবং সাফা-মারওয়ার মাঝে সাতবার সাঈ করলেন, এর অতিরিক্ত কিছু করেননি এবং নিজের হজ ও উমরার) জন্য এটাই (এক ত্বওয়াফ (তাওয়াফ/তওয়াফ) ও এক সাঈ) যথেষ্ট বিবেচনা করলেন এবং কুরবানী করলেন। (সহহি মুসলিম ৫৮৭৯ হাদিস একাডেমি)

 

২। সাঈয়ের ভুলভ্রান্তিসমূহঃ

অনেক সাঈ আরার পূর্বে গদবাধা নিয়ত মুখে উচ্চারণ করে পড়ে থাকে। অন্য নিয়তের মত শুধু মনে মনে নিয়্যাত করতে হবে। সাফা পাহাড় থেকে সাঈ শুরু করতে হবে। অনেক না জেনে মারওয়া পাহাড় থেকে সাঈ শুরু করে, এটা তাদের একটি ভুল আমল। হাদিসে এসেছে,

জাবির ইব্‌ন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সাফা থেকে অবতরন করতেন তখন (স্বাভাবিক) হাঁটতেন, এমনকি তাঁর পদদ্বয় উপত্যকার নিম্নভুমিতে অবতরিত হলে তিনি সা’ঈ করে তা পার হতেন। (সুনানে নাসাঈ ২৯৮১)

অনেক মনে করে এই স্থানে দুটি শুধু সাঈ করতে হবে। হ্যা, সাঈতো করবই সাথে সাথে এখনে এসে দু’হাত তুলে শুধু দোয়া করা। অনেক মনে করেন হাত তুলে দোয়া নাই। এই সেই স্থানগুলির একটি যেখানে হাত তুলে দোয়া করা সুন্নাহ। সাঈ করার সময় প্রতি চক্করের জন্য আলাদা দুআ পাঠ করা। বরং প্রতি চক্কর শেষেই চাহিদামত দু’আ করবে। কেউ কেউ সাঈ করার সময়ও ইযতিবা (ইহরামের কাপড় কাদের নিচে নামিয়ে দেয় ) করে থাকে। এটা ভুল। ইযতিবা কেবল তাওয়াফে কুদুমের সময় করতে হয়।

সাফা থেকে মারওয়া এবং মারওয়া থেকে সাফা পর্যন্ত সাঈ করার পুরো সময়টাতে আস্তে আস্তে চলাচল করা সুন্নাহ। দ্রুত চলে সাঈ সম্মন্ন করা একটি ভুল আমল। হাদিসে এসেছে। 

‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়তুল্লাহ পৌঁছে প্রথম তাওয়াফ করার সময় প্রথম তিন চক্করে রামল করতেন এবং পরবর্তী চার চক্করে স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে চলতেন। সাফা ও মারওয়ায় সা‘ঈ করার সময় উভয় টিলার মধ্যবর্তী নিচু স্থানটুকু দ্রুতগতিতে চলতেন। (সহিহ বুখারী ১৬১৭ আধুঃ)

উভয় টিলার মধ্যবর্তী নিচু স্থানটি এখন সবুজ আলো দ্বারা আলোকিত করা হয়েছে। তাই সাঈ করার সময় কেবল সবুজ দুই চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থানে দ্রুত চলতে হবে। পুরুষদের জন্য সবুজ চিহ্নের মাঝে সাঈ তথা দৌড়ে না চলা একটি ভুল আমল। তবে মহিলাদের দৌড়াতে হবে না। কেউ কেউ মনে করেন, সাফা থেকে মারওয়া এবং মারওয়া থেকে সাফায় ফিরে এলে সাঈর এক চক্কর সম্পূর্ণ হয়। এ ধারণা ভুল। বরং সাফা থেকে মারওয়া পর্যন্ত গেলেই এক চক্কর সম্পূর্ণ হয়ে যায়।

৩। যিলহাজের আট তারিখের একটি ভুলত্রুটিঃ

আবদুল ‘আযীয ইবনু রুফাইয়‘ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আপনি যা উত্তমরূপে স্মরণ রেখেছেন তার কিছুটা বলুন। বলুন, যিলহাজ্জ মাসের আট তারিখে যুহর ও ‘আসরের সালাত তিনি কোথায় আদায় করতেন? তিনি বললেন, মিনায়। আমি বললাম, মিনা হতে ফিরার দিন ‘আসরের সালাত তিনি কোথায় আদায় করেছেন? তিনি বললেন, মুহাস্সাবে। এরপর আনাস (রাঃ) বললেন, তোমাদের আমীরগণ যেরূপ করবে, তোমরাও অনুরূপ কর। (সহিহ বুখারী ১৬৫৩ আধুনিক)

মন্তব্যঃ এই হাদিসে দেখা যায় যিলহজ্জের আট তারিখ মিনায় গিয়েছিলেন এবং নয় তারিখ সকালে আরাফায় গিয়েছেন। কিন্তু অনেকে একটা ভুল করে থাকে যে, তারা আট তারিখে মিনাতে না এসে সরাসরি আরাফায় চলে যাওয়া। আবার অনেক মিনায় যায় ঠিকই কিন্তু মিনায় পর্যাপ্ত স্থান থাকা সত্ত্বেও মিনার বাইরে অবস্থান করা। সুন্নাহ হল সকালে মসজিদে হারমে ফজরের সালাত আদায় করে বাসায় এসে গোসল করে, পরিস্কার পরিছন্ন হয়ে, ইহবার বেঁধে, তারবিয়া পাঠ করতে করতে মিয়ার চলে যাওয়া।

৪। আরাফা দিবসের ভুল-ত্রুটিঃ 

আরাফার ময়দানে অবস্থান করা হজ্জের অন্যতম ফরজ কাজ। আরাফাতে ঠিক মত আস্থান না হলে তার হজ্জ হবে না। কাজেই এই স্থানে ভূলত্রুটিগুলির প্রতি একটু বেশী খেয়াল রাখতে হবে।

৫। আরাফার ময়দানে অবস্থানঃ

আবদুর রহমান ইবন ইয়ামুর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় তাঁর কাছে কয়েকজন লোক এসে তাকে হজ্জ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেনঃ হজ্জ হলো আরাফায়। অতএব যে ব্যক্তি আরাফার রাত পেয়েছে মুযদালাফার রাতের পূর্বে, তার হজ্জ পূর্ণ হয়েছে। (সুনানে নাসাঈ ৩০১৯)

এ কারনে যদি কেউ আরাফার সীমানায় প্রবেশ না করে তার হজ্জ হবে না। ঠিক তেমনিভাবে কেউ যদি যথাযথ ইহরান বেধে মিনায় না গিয়েও সরাসরি সূর্যাস্তের আগে আরাফায় ময়দানে ঢুকতে পারে এবং বাকি কাজে ঠিক মত আদায় করে তবে তার হজ্জ আদায় হবে বলে ধরা হয়। আলাফার ময়দান থেকে সূর্যাস্তের পর মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে। কিন্তু কেউ যদি সূর্যাস্তের আগে আরাফায় ময়দান ত্যাগ করে তবে তার হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে। কোন প্রকার দম দিলেও হজ্জ আদায় হবে না। কারন ফরজ ছুটে গেলে দম দ্বারা পূর্ণ হয় না। আরাফার অবস্থান করা ছিল ফরজ। হজ্জের ফরজ কখনও দম দ্বারা আদায় হয় না। এখান আর একটি কথা মনে রাখতে হবে মাসজিদে নামিরার সম্মুখভাগের অংশটি আরাফার সীমানার বাইরে। কাজেই এখান অবস্থান করলে ফরজ আদায় কবে না। তাই আগে ভাগে আরাফার ম্যাপ দেখে নিজের অবস্থান ঠিক করে নিবেন। না বুঝলে অন্যের দ্বারা হলেও বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

৬। আরাফার ময়দানে দোয়াঃ

জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃরাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “যিলহজ মাসের দশ দিন থেকে উত্তম আল্লাহর নিকট কোন দিন নেই”। তিনি বলেনঃ এক ব্যক্তি বলেঃ হে আল্লাহর রাসূল, এ দিনগুলোই উত্তম, না এ দিনগুলো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদসহ উত্তম? তিনি বললেনঃ “জিহাদ ছাড়াই এগুলো উত্তম। আল্লাহর নিকট আরাফার দিন থেকে উত্তম কোন দিন নেই, আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন অতঃপর জমিনে বাসকারীদের নিয়ে আসমানে বাসকারীদের সাথে গর্ব করেন। তিনি বলেনঃ আমার বান্দাদের দেখ, তারা হজ্জের জন্য এলোমেলো চুল ও ধূলিময় অবস্থায় দূর-দিগন্ত থেকে এসেছে। তারা আমার রহমত আশা করে, অথচ তারা আমার আযাব দেখে নি। সুতরাং এমন কোনো দিন দেখা যায় না যাতে আরাফার দিনের তুলনায় জাহান্নাম থেকে অধিক মুক্তি পায়”। (সহিহ হাদিসে কুরসি হাদিস নম্বর ১০১ এবং ইবনে হিব্বান)

উসামা ইবন যায়দ (রাঃ) বলেন, আমি আরাফায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে একই বাহনে সাওয়ার ছিলাম। তিনি দু‘আয় উভয় হাত উত্তোলন করলেন এমন সময় তার উট তাঁকে নিয়ে একদিকে হেলে গেল, ফলে তার নাকের রশি পড়ে যেতে লাগলো, তিনি তাঁর এক হাতে তা ধরে ফেললেন, এ সময় তাঁর অন্য হাত উঠানোই ছিল। (সুনানে নাসাঈ ৩০১৪)

আরাফার ময়দানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত তুলে দোয়া করেছেন। এই স্থান অনেক কে দেখা যায় দোয়া না করে নফল সালাত আদায় করে যা মুলত একটি ভুল আমন। এখানে জোহর ও আসর সালাত কে জমা করে আদায় করার বিধান দেয়া হয়েছে। তাই নফল সালাত আদায় করা ঠিন নয়। আরাফা হল দোয়া কবুলের স্থান তাই এখানে হাত তুলে একাকী দোয়া করতে হবে। এখানে তাবলীগের বিশ্ব ইজতিমার মত সম্মিলিত দোয়া কোন ব্যবস্থা করা হয় না কারন এখান একাকী দোয়া করাই সুন্নাহ সম্মত আমল। কিন্তু দোয়ার সময় একটি বিষয় খুব লক্ষ করবেন। যেন কোন অবস্থায়ই কিবলাকে পিছনে রেখে জাবালে আরাফার দিকে মুখ করে দুআ করা যাবে না।

 

৭। আরাফার দিনে সিয়ামঃ

আবূ ক্বাতাদাহহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “আরাফার দিনের রোযা রাখলে আল্লাহ্‌র নিকট আশা রাখি যে তিনি বিগত এক বছরের ও আগামী এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন।” (সহিহ মুসলিম ১১৬২)

মন্তব্যঃ আরাফার দিনের সিয়াম পালন একটি সুন্নাহ সম্মত ও ফজিলত পূর্ণ আমল কিন্তু এই দিনের সিয়ামের অনেক ফজিলত হলেও হাজিগণ যারা এই দিন আরাফার ময়দানে অবস্থান করবেন তারা রাখতে পারবেন না। নিম্মের হাদিসটি একটু লক্ষ করুন।

উম্মু ফাযল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আরাফার দিনে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সিয়াম এর ব্যাপারে লোকজন সন্দেহ করতে লাগলেন। তাই আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট শরবত পাঠিয়ে দিলাম। তিনি তা পান করলেন। (সহিহ বুখারী ১৫৫৫ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ আরাফার দিনে হাজিদের সিয়াম পালণ একটি ভুল আমল।

 

৮। জাবালে রহমত থেকে পাথর সংগ্রহঃ

আরাফাতের ময়দানে অনেক পাহাড় আছে। একটি পাহাড়ের পাদদেশে বিদায় হজের খুতবা দিয়েছিলেন। সেই পাহাড়টি যাতে সহজে চিনতে পারেন এজন্য এই চিহ্ন সেখানে স্থাপন করা হয়েছে। এই পাহাড়ের নাম জাবালে রহমত বা রহমতের পাহাড়। জাবালে রহমত তাৎপর্যপূর্ণ হলেও এর বিশেষ কোন ফজিলত বর্ণিত হয়নি। তারপরও অনেক হাজি জাবালে রহমত কে তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতময় মনে করে সেখান থেকে বরকতের আশায় পাথর সংগ্রহ করা। যা একটি ভূল ধারন ও কাজ।

 

৯। মুজদালিফার ভুল-ত্রুটিঃ

সারা দিন আরাফাতে অবস্থানের পর মুজদালিফা যেতে প্রান আনচান করতে থাকে। আগেই বলেছি, যদি সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে আরাফাহ থেকে মুজদালিফায় যায় তবে হজ্জ হবে না। কাজেই আরাফাতের ময়দানে বসে, সূর্য অস্ত দেখে, ধীর স্থির ও শান্ত ভাব বজায় রেখে মুযদালিফার পথে রওয়ানা দিতে হবে। মুজদালিফায় পৌছে মাগরিব ও এশার সালাত একত্র আদায় করে জমিনে ঘুমিয়ে পরা। এখানে ঘুমই ইবাদাত। কিছু কিছু মানুষ মুযদালিফার রাত নামায আদায়, কুরআন তেলাওয়াত ও যিকিরের মাধ্যমে কাটায়। এটি সুন্নাহ বিরোধী। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ রাতে এ ধরণের কোন ইবাদত করেননি। নিম্মে সুনানে আবু দাউদে সহিহ সনদে বর্ণিত একটি বিশাল হাদিসের অংশ বিশেষ উল্লেখ করছি।

জা‘ফর ইবনু মুহাম্মাদ (রহঃ) হতে তাঁর পিতার থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, একদা আমরা জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) এর নিকট যাই। আমরা তার নিকটবর্তী হলে তিনি (অন্ধ হওয়ার কারণে) আগন্তুকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন এবং এক পর্যায়ে আমার কাছাকাছি এলে আমি বললাম, আমি মুহাম্মাদ ইবনু ‘আলী ইবনু হুসাইন ইবনু ‘আলী (রাঃ)। আমার কথা শুনে তিনি আমার মাথার দিকে হাত বাড়ান, আমার জামার উপরের ও নিচের বোতাম খুলে তার হাতের তালু আমার বুকের উপর রাখলেন। …………………

অতঃপর বিলাল (রাঃ) (আরাফায়) আযান অতঃপর ইক্বামাত দিলেন। তিনি যুহরের সলাত আদায় করলেন, পুনরায় ইক্বামাত দিলে ‘আসরের সলাত আদায় করলেন। কিন্তু এ দুইয়ের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি অন্য (নফল) সলাত পড়েননি। অতঃপর তিনি কাসওয়া উষ্ট্রীতে আরোহণ করে আরাফাতে অবস্থানের স্থানে এলেন এবং কাসওয়া উষ্ট্রীকে ‘জাবালে রহমাতের’ পাদদেশে ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে তিনি পাহাড়কে সামনে রেখে ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালেন। সূর্য ডুবে আকাশের লালিমা কিছুটা মুছে যাওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করলেন। সূর্যের লালিমা বিলুপ্ত হওয়ার পর তিনি ‘উসামাকে তাঁর পেছনে সওয়ারীতে বসিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখান থেকে রওয়ানা হলেন এবং উষ্ট্রীর লাগাম শক্ত করে ধরলেন, ফলে উটের মাথা হাওদার সম্মুখভাগের সাথে ছুটতে লাগলো। এ সময় তিনি ডান হাতের ইশারায় বলতে লাগলেন : ধীরস্থিরভাবে পথ চলো, হে লোকেরা, ধীরস্থিরভাবে চলো, হে লোকজন! তিনি কোন বালির টিলার নিকট এলে উষ্ট্রীর লাগাম সামান্য ঢিলা করতেন যাতে তা সহজে টিলায় উঠে সামনে অগ্রসর হতে পারে। অবশেষে তিনি ‘মুযদালিফায়’ উপস্থিত হলেন। এখানে এসে এক আযান ও দুই ইক্বামাতে মাগরিব ও ‘ইশার সলাত একত্রে আদায় করেন। এ দুই সলাতের মাঝখানে তিনি অন্য কোনো (নফল) সলাত পড়েননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ স্থানে ভোর পর্যন্ত বিশ্রামকরেন। ফাজ্‌রের সময় হলে তিনি ফাজ্‌রের সলাত আদায় করেন। তিনি এ সলাত আদায় করেছেন এক আযান ও এক ইক্বামাতে। (সুনানে আবু দাউদ ১৯০৫)

মন্তব্যঃ এই সহহি হাদিসে দেখা যায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এশার নামায আদায় করার পর ফজর হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম করেছেন। ফজর হওয়ার পর তিনি ফজরের নামায আদায় করেছেন। তিনি এই রাতে কোন তাহাজ্জুদের নামায, ইবাদত বন্দেগী, তাসবিহ, যিকির-আযকার বা কুরআন তেলাওয়াত নেই।

 

১০। মুজদালিফায় আসার জন্য তাড়াহুড়া করাঃ

 হিশাম (রহঃ) থেকে তার পিতার হতে বর্ণিত। তিনি (উরওয়া) বলেন, উসামা (রাঃ) কে আমার উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসা করা হল অথবা আমি উসামা ইবনু যায়দ (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাকে তাঁর সওয়ারীর পেছনে বসিয়েছিলেন, তখন তিনি কিভাবে চলেছিলেন? তিনি বললেন, তিনি ধীর গতিতে সওয়ারী চলছিলেন, যখন খোলা জায়গা পেলেন, তখন দ্রুতগতিতে চলতেন। (সহিহ মুসলিম ২৯৭৬ ইফাঃ}

মন্তব্যঃ আরাফা থেকে মুযদালিফাতে আসার সময় হাজীসাহেবগণ খুই তাড়াতাড়ি করে থাকেন। সূর্য ডোবার সাথে সাথে সবাই তাড়াহুড়ো করে মুজদালিফার পানে ছুটতে থাকেন। তারা একে অপরের সাথে ধাক্কাধাক্কি করা। এমনকি গাড়িগুলোও ছুটতে থাকে, যার ফলে কখনও কখনও এক্সিডেন্ট হয়। অথচ উপরের হাদিস থেকে বুঝা যায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফার ময়দান থেকে ধীর গতিতে চলছেন শুধু খোলা জায়গা পেলে দ্রুত গতিতে চলতেন।  অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চলার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখতেন। আমাদেরও পরিস্থিতি বিবেচনা করে চলা উচিত।

১১। মুজদালিফার বাহিরে অবস্থান করাঃ

ইবনু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় মাগরিব ও ‘ইশা একসাথে আদায় করেন। প্রত্যেকটির জন্য আলাদা ইকামত দেওয়া হয়। তবে উভয়ের মধ্যে বা পরে তিনি কোন নফল সালাত আদায় করেননি। (সহিহ বুখারী ১৫৬৮ ইফাঃ)

আবূ আইয়ূব আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হাজ্জের (হজ্জ) সময় মুযদালিফায় মাগরিব এবং ‘ইশা একত্রে আদায় করেছেন। (সহিহ বুখারী ১৫৬৯ ইফাঃ)

আমর ইবনু মায়মূন (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ‘উমর (রাঃ)-এর সাথে ছিলাম। তিনি মুযদালিফাতে ফজরের সালাত আদায় করে (মাশা’আরে হারামে) উকুফ করলেন এবং তিনি বললেন, মুশরিকরা সূর্য না উঠা পর্যন্ত রওয়ানা হত না। তাঁরা বলত, হে সাবীর! আলোকিত হও! নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের বিপরীত করলেন এবং তিনি সূর্য উঠার আগেই রওয়ানা হলেন। (সহিহ বুখারী ১৫৭৯ ইফাঃ)

কেউ যদি মুজদালিফায় রাত্রি জাপন না করে সরাসরি মিনায চলে যায় তবে তার ওয়াজিব ছুটে যাবে। তাকে দম দিতে হবে। কাজেই মুযদালিফায় অবস্থান না করে মিনায় চলে যাওয়া যানে না। যারা হেঁটে হেঁটে আরাফার ময়দান থেকে মুজদালিফায় যান, তারা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে অক্ষম হয়ে পড়েন। ফলে তারা মুযদালিফাতে পৌঁছার আগেই অবস্থান গ্রহণ করেন এবং সেখান থেকেই ফজরের সালাত আদায় করে মীনার উদ্দেশ্যে গমন করেন। যে ব্যক্তি এমনটি করেছে তার মুযদালিফাতে রাত্রি যাপন ছুটে গেছে। এর ফলে হাজি সাহেবদের রুকন ছুটে যাবে। কারণ মুযদালিফাতে রাত্রি যাপন কোন কোন আলেমের মতে, হজ্জের একটি রুকন। এই জন্য হাজীসাহেবের কর্তব্য হচ্ছে, নিজে না জানলে বা না বুঝলে মুয়াল্লিমের মাধ্যমের মুযদালিফাতে রাত্রি নিশ্চিত করা এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগে মুযদালিফা ত্যাগ ত্যাগ না করা।  কিন্তু অনেকে আছেন যারা মুজদালিফার সীমানাই জনেন না। অনেক গাড়িতে থাকে বিদেশী ড্রাইভার তারাও মুজদালিফার সীমান জানেন না। ফলে না জেনে, মুজদালিফার সীমানার বাইরে অবস্থান করে। এই জন্য হাজি সাহেব ও ড্রাইভার উভয়ের জন্য জরুরী হল মুজদালিফার সীমান জানা। কিন্তু অপারগতা কারনে ভুল হলে মহান আল্লাহ নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি কারও উপর তার সাধ্যের চেয়ে বেশী বোঝা চাপিয়ে দেন না। (২:২৮৬)। আল্লাহু আলাম।

১২। মুজদালিফাতে পৌঁছার আগেই পথিমধ্যে মাগরিব ও এশার সালাত আদায়ঃ

উসামাহ ইবনু যায়েদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘আরাফা হতে সওয়ারীতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পেছনে আরোহণ করলাম। মুযদালিফার নিকটবর্তী বামপার্শ্বের গিরিপথে পৌঁছলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উটটি বসালেন। এরপর পেশাব করে আসলেন। আমি তাঁকে উযূর পানি ঢেলে দিলাম। আর তিনি হালকাভাবে উযূ করে নিলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সালাত? তিনি বললেনঃ সালাত তোমার আরো সামনে। এ কথা বলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সওয়ারীতে আরোহণ করে মুযদালিফা আসলেন এবং সালাত আদায় করলেন। মুযদালিফার ভোরে ফযল [ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)] আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর পিছনে আরোহণ করলেন।  (সহিহ বুখারী ১৬৬৯ তাওহীদ প্রকাশনী, সহিহ মুসলিম ২৯৬৯ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ এই সহিহ হাদিসটি থেকে বুঝা যায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুযদালিফাতে পৌঁছেই সালাত আদায় করেছিলেন। এশার নামাযের ওয়াক্ত প্রবেশ করার পর তিনি মাগরিব ও এশার নামায জমা করে আদায় করেছেন। তাই কোন ওজর বা অসুবিধা ছাড়াই মুজদালিফাতে পৌঁছার আগে পথিমধ্যে সাধারণ অবস্থার মত মাগরিব ও এশার নামায আদায় করা একটি ভুল আমল। যা সুন্নাতে খেলাপ।

১৩।  মুজদালিফায় পৌছাতে সালাত কাজা করাঃ

বর্তমানে অনেকই হাঁটার পাশাপাশি গাড়ি করে আরাফা থেকে মুজদালিফায় যায়। কোন কোন গাড়ি মুজদালিফায় হাজিদের নামিয়ে দিয়ে আবার আরাফার ময়দানে হাজিদের নিতে আসে। এই সকল গাড়ি দুই তিন বার আরাফা ও মুজদালিফায় যাতায়াত করে। প্রচন্ড যানজটের কারনে বা বিদেশী অপরিচিত ড্রাইভারের ভুলের কারন আরাফা থেতে মুজদালিফায় যেতে অনেক সময় রাত ৩/৪ টা পর্যান্ত বেজে যায়। যার প্রমান আমি নিজে। আমাদের জামাতে প্রায় ৫০ জনের মত লোক ছিলাম। আমাদের মত পাকিস্থানি ও কয়েকটি জামাত ছিল। আমাদের মত তাদের সাথেও নারী ও শিশু ছিল। আমরা সবাই গাড়ির জন্য অপেক্ষা থাকলাম রাত ১১ টার পর গাড়ি পেলাম রাস্তায় প্রচন্ড যানজট। তাই মুজদালিফায় পৌছাতে আমাদের প্রায় রাত  ৩ টা থেকে ৪ টা বেজে যায়। অর্থৎ আমরা এশার নামাযের ওয়াক্ত পার হয়ে গেলে মুযদালিফাতে পৌঁছেছিলাম। এখানে মনে রাখতে হবে যদি কোন কারনে এশার সালাতে সময় মুজদালিফায় পৌছাতে না পারি সে ক্ষেত্রে পথিমধ্যেই এশার ও মাগরিবের সালাত আদায় করতে হবে। মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব হলেও, এখানে এসে সালাত জমা করে আদায় করা একটি সুন্নাহ আমল। একটি সুন্নাহকে বাস্তবায়ন করেতে গিয়ে সালাত কাজা করা যাবে না। করন আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন,

 إِنَّ الصَّلاَةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَّوْقُوتًا

অর্থঃ নিশ্চয় নামায মুসলমানদের উপর ফরয নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। (সুরা নিসা ৪:১০৩)

এই কারনে সালাত কাজা করে মুজদালিফায় আদায় করা জায়েয নয়। বরং হারাম ও কবিরা গুনাহ। কুরআন সহহি হাদিসের দলিলের ভিত্তিতে, সালাতকে নির্দিষ্ট সময় থেকে বিলম্বে আদায় করা হারাম। সকল মুসলিমকে সালাতের সময়সীমা সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। 

অতএব, হাজীসাহেব যদি এই আশংকা করেন যে, মুযদালিফাতে পৌঁছার আগেই এশার নামাযের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাবে সেক্ষেত্রে তাঁর উপর আবশ্যক হচ্ছে- নামায আদায় করে নেয়া। এমনকি মুযদালিফাতে না পৌঁছলেও; তিনি যে অবস্থায় আছেন সে অবস্থাতেই নামায আদায় করে নিবেন। যদি তিনি পদব্রজী হন তাহলে দাঁড়িয়ে কিয়াম ও রুক-সিজদাসহ নামায আদায় করে নিবেন। আর যদি আরোহী হন এবং নামা সম্ভবপর না হয় তাহলে গাড়ীতে থেকে হলেও নামায আদায় করে নিবেন। এর দলিল হচ্ছে আল্লাহ্‌ তাআলার বলেন,

فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوا وَأَطِيعُوا وَأَنفِقُوا خَيْرًا لِّأَنفُسِكُمْ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

অতএব তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর, শুন, আনুগত্য কর এবং ব্যয় কর। এটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। যারা মনের কার্পন্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম। (সুরা তাগাবুন ৬৪:১৬ )

যদিও গাড়ী থেকে নামতে না পারার সম্ভাবনাটি একেবারেই দূরবর্তী। কারণ প্রত্যেক মানুষই রাস্তার ডানপার্শ্বে বা বামপার্শ্বে নেমে নামায পড়তে পারেন। কারো জন্য মাগরিব ও এশার নামায আদায়ে এত বিলম্ব করা জায়েয হবে না যাতে করে এশার ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায়।

 

১৪। ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আগেই সালাত আদায় না করাঃ

আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কোন সালাত তার নির্ধারিত ওয়াক্ত ছাড়া আদায় করতে দেখেনি। তবে মুযদালিফায় মাগরিব ও ইশার সালাত ব্যতিক্রম এবং পরবর্তী ভোরে ফজরের সালাত নির্ধারিত সময়ের পূর্বে অর্থাৎ ওয়াক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আদায় করেছেন। (সহিহ মুসলিম ২৯৮৬ ইফাঃ)

মুযদালিফাতে ফজরের সালাত আগে আগে আদায় করা বাঞ্ছনীয়। এর অর্থ এই নয় যে, ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আগেই সালাত আদায় করা। হাজীসাহেবের উপর আবশ্যক হলো, ফজরের ওয়াক্ত হওয়া নিশ্চিত হওয়ার পর বা প্রবল ধারণা হওয়ার পর ফজরের নামায আদায় করা। হাদিসের ভাষ্য মতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগে আগে আদায় করেছেন। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, ওয়াক্ত হওয়ার আগে নামায পড়া হবে।  তিনি সাধারনত ফজর ওয়াক্ত হওয়ার একটু পরে সালাত আদায় করেতেন কিন্তু মুজদালিফায় তার সালাত আদায়ের নির্ধারিত সময়ের পূর্বে অর্থাৎ ওয়াক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আদায় করেছেন।  কিন্তু এ সম্পর্কে ভুল আমল হলোঃ কিছু কিছু হাজীসাহেব ফজরের নামাযের ওয়াক্ত হওয়ার আগেই নামায পড়ে ফেলেন। নামায পড়েই তারা রওয়ানা হয়ে যান। ওয়াক্ত হওয়ার আগে নামায আদায় করলে নামায কবুল হবে না। বরং তা হারাম কাজ। কেননা সেটি আল্লাহ্‌র সীমারেখার লঙ্ঘন। যেহেতু নামাযের ওয়াক্ত নির্ধারিত। শরিয়ত ওয়াক্তের শুরু ও শেষ নির্ধারণ করে দিয়েছে। অতএব, কারো জন্য ওয়াক্ত হওয়ার আগে নামায আদায় করা জায়েয নয়।

১৫। সূর্যোদয় পর্যন্ত মুযদালিফাতে অবস্থান না করাঃ

আমর ইবন মায়মূন (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, উমার ইবন খাত্তাব (রাঃ) বলেছেন যে, জাহিলিয়াতের যুগে লোকেরা সূর্যোদয়ের পূর্বে মুযদালিফা হতে প্রত্যাবর্তন করতো না, যতক্ষণ না সূর্য ‘সাবীর’ পর্বতের উপর দেখা যেত। অতঃপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহার বিপরীত করেন এবং সূর্যোদয়ের পূর্বেই মুযদালিফা হতে প্রতাবর্তন করেন। (সুনানে আবু দাউদ ১৯৩৬ ইফাঃ)

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ সূর্য উঠার আগেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম (মুযদালিফা হতে) যাত্রা করেন। (সুনানে তিরমিজি ৮৯৫)

অনেক হাজীসাহেব সূর্যোদয় পর্যন্ত মুযদালিফাতে অবস্থান করে ইশরাকের সালাত আদায় করেন। ইশরাকের সালাত আদায়ের পর মিনার দিকে রওয়ানা হন। এই আমলটি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের খেলাফ। হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুযদালিফা থেকে আকাশ ভালভাবে ফর্সা হওয়ার পর সূর্যোদয়ের আগেই রওয়ানা হয়েছেন আর জাহিলিয়াতের যুগে লোকেরা সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করত। অতএব, আমাদের আমলকে ত্রুটি মুক্ত করতে চাইলে অবশ্যই ফজরের সালত আদায় করে সূর্যোদয়ের আগেই রওয়ানা দিতে হবে।

একটি সংশয়ের নিরশনঃ  যারা শারীরিকভাবে দুর্বল (নারী ও শিশু) ও মাজুর তারা কি ফজরের আগে রওয়ানা দিতে পারবে?

উত্তরঃ হ্যা, যারা শারীরিকভাবে দুর্বল (নারী ও শিশু) ও মাজুর তারা ফজরের আগে রওয়ানা দিতে পারবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরিবারের মধ্যে যারা শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন তাদেরকে রাত থাকতেই মুযদালিফা ত্যাগ করার অনুমতি দিয়েছেন। দলীল নিম্মের হাদিসগুলঃ

ইবন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরিবারের দুর্বল শ্রেণীকে (নারী ও শিশু) অন্ধকার থাকতে (মুযদালিফা) হতে পাঠিয়ে দিতেন এবং তাদেরকে এরূপ নির্দেশ দিতেন যে, তাঁরা যেন (মিনায় পৌঁছে) সূর্যোদয়ের পূর্বে কংকর নিক্ষেপ না করে। (সুনানে আবু দাউদ ১৯৩৯ ইফাঃ)

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পরিবারের মধ্যে দুর্বলদের (মুযদালিফা হতে মিনায়) আগেই পাঠিয়ে দেন। আর তিনি বলে দেনঃ তোমরা সূর্য না উঠা পর্যন্ত (জামরায়) কংকর নিক্ষেপ করবে না। (সুনানে তিরমিজি ৮৯৩, ইবনে মাজাহ ৩০২৫)

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সওদা (রাঃ) ছিলেন ভারী ও স্থুলদেহী। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট মুযদালিফা থেকে রাত থাকতেই প্রস্থান করার অনুমতি চাইলেন। তিনি তাকে অনুমতি দিলেন। আয়িশা (রাঃ) আরও বলেন, হায়! যদি সওদা (রাঃ) এর মত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আমিও অনুমতি প্রার্থনা করতাম! আয়িশা (রাঃ) ইমামের সাথে মুযদালিফা হতে রওনা হতেন। (সহিহ মুসলিম ২৯৮৯ ইফাঃ)

আয়িশা (রাঃ) বলেন, আমার আকাঙ্ক্ষা, আমিও যদি সওদা (রাঃ) এর অনুরূপ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করতাম! তিনি মিনায় পৌছে ফজরের সালাত আদায় করেন এবং লোকদের পৌঁছার পূর্বেই জামরায় পাথর নিক্ষেপ করেন। আয়িশা (রাঃ) কে বলা হল, সওদা (রাঃ) কি তাঁর নিকট অনুমতি চেয়েছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তিনি ছিলেন স্থুলদেহী এবং ভারী, তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট অনুমতি চেয়েছিলেন এবং তিনি তাকে অনুমতি দিয়েছিলেন। (সহিহ মুসলিম ২৯৯০ ইফাঃ)

এখন প্রশ্ন হল, ফজরের ওয়াক্ত এর কত আগে রওয়ানা দেয়া যাবে?

প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে হাদিসটি মনযোগ দিয়ে পড়ি।

আসমা (রাঃ) এর আযাদকৃত গোলাম আবদুল্লাহ (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে আসমা (রাঃ) মুযদালিফা অবস্থানকালে জিজ্ঞাসা করলেন, চাঁদ ডুবেছে কি? আমি বললাম, না। অতঃপর তিনি কিছুক্ষণ সালাত আদায় করলেন। পরে পূনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, হে বৎস! চাঁদ ডুবেছে কি? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমার সাথে রওনা হও। আমরা রওনা হলাম এবং জামরা (পৌঁছে) তিনি কাঁকর নিক্ষেপ করলেন, এরপর নিজের তাঁবুতে সালাত আদায় করলেন। আমি তাকে বললাম, হে সম্মানিত মহিলা! আমরা খুব ভোরে রওনা হয়েছিলাম। তিনি বললেন, কোন অসুবিধা নেই হে বৎস! নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের খুব ভোরে রওনা হওযার অনুমতি দিয়েছিলেন। (সহিহ মুসলিম ২৯৯২ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ কাজেই শারীরিকভাবে দুর্বল (নারী ও শিশু) ও মাজুর ব্যাক্তিগণ আরাফা থেকে মুজদালিফায় নাম মাত্র অবস্থান করে মধ্যরাতের আগেই মিনার দিকে রওয়ানা দেয়া যাবে না। আরাফার ময়দানে হাজিদের অবস্থান হল জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ। ঐ রাতের চন্দ্র নিশ্চিতভাবে মধ্যরাতের পরেই অস্ত যাবে এবং তখন রাতের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ কেটে যায়। আসমা (রাঃ) সময় সুযোগ থাকা সত্বেও  চন্দ্র অস্ত যাওয়ার পরই মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কাজেই মাজুর হিসাবে মিনায় আগে চলে যাওয়ার সময়টা চন্দ্র অস্ত যাওয়ার সাথে নির্দিষ্ট করা বাঞ্ছনীয়। কেননা এটা একজন সাহাবীর আমল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরিবারের যারা দুর্বল ছিলেন তাদেরকে রাতে মুযদালিফা ত্যাগ করার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু রাতের কখন তারা মুযদালিফা ত্যাগ করবে সেটা তিনি স্পষ্ট করেননি। এ সাহাবীর এ আমল সে অস্পষ্টতাকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে। তাই দুর্বল ও অন্য যাদের জন্য মানুষের ভিড়ে গমন করা কষ্টকর তাদের মুযদালিফা ত্যাগ করার জন্য এ সময়টিকে তথা চন্দ্র অস্ত যাওয়াকে নির্দিষ্ট করা বাঞ্ছনীয়।

১৬। মুযদালিফার উপর দিয়ে যায় কিন্তু কিছু সময়ের জন্যও অবস্থান করে নাঃ

সুনানে আবু দাউদ এর একটি সহিহ দীর্ঘ হাদিসের শেষে উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ স্থানে ভোর পর্যন্ত বিশ্রামকরেন। ফাজ্‌রের সময় হলে তিনি ফাজ্‌রের সলাত আদায় করেন। তিনি এ সলাত আদায় করেছেন এক আযান ও এক ইক্বামাতে। (সুনানে আবু দাউদ ১৯০৫)

অনেক হাজি সাহেব আছেন যারা আরাফা থেকে যাত্রা শুরু করে মুজদালিফার উপর দিয়ে মিনায় চলে যান। তিনি চলার মধ্যেই আছেন এবং অতিক্রম করে যাচ্ছেন; থামছেন না। তিনি বলেন: অতিক্রম করে যাওয়াই তো যথেষ্ট। এটি মহা ভুল। কারণ অতিক্রম করা যথেষ্ট নয়। বরং সুন্নাহ্‌ প্রমাণ করে যে, হাজীসাহেব মুযদালিফাতে ফজরের নামায পড়া পর্যন্ত অব্স্থান করবেন।

সারকথা হলোঃ আল মাশআরুল হারামের নিকটে অবস্থান করে ফজরের শেষ ওয়াক্তে যখন ফর্সা হবে অর্থা  সূর্যোদয়ের পূর্বে, দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই, মিনার উদ্দেশ্যে মুযদালিফা ত্যাগ করবেন।

 সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment