সবর অর্জনের তেইশটি পদ্ধতিঃ প্রথম পর্ব

সবর অর্জনের তেইশটি পদ্ধতিঃ প্রথম পর্ব

সবর একটি কঠিন কাজ। একটি কঠিন কাজটি করতে হলে আমাদের কিছু গুন অর্জন করতে হবে। কুরআন সুন্নাহে সবর অর্জনের অনেক তাগিত প্রদান করেছেন। সবরের ফজিলত পূর্ণ বহু বর্ণনা কুরআনে বিদ্যমান। হাদিসে গুরুত্বসহকারে সবরের বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআনে বিভিন্ন নবী রাসূলদের সবর সম্বলিত অনেক ঘটতা বর্ণনা করা হয়েছে। তাই কুরআন হাদিসের আলোকে সবর হাদিলে পদ্ধতি জানতে পারলে। সবরের মত কঠিনগুনটি অর্জন করা সহজ হয়ে যাবে। সবরের মত মহৎগুনটি অর্জনের জন্য নিম্মের পদ্ধতিগুল অনুসরণ করা যেতে পারে।

১। সালাতের মাধ্যমে সবর মত মহৎগুনটি অর্জন করতে হবেঃ

যখন কোন বিপদ আসবে তখন  নামাজের দাড়িয়ে আল্লাহ কাছে সাহায্য চাইত হবে এবং সবর করতে হবে। বিপদের সময়ে দুই রাকাত সালাত পড়ে কেঁদে আল্লাহকে বলুন, হে আমার রব, তুমিই আমার মালিক। তুমি ছাড়া বিপদ থেকে আর কোন উদ্ধারকারী নাই। তুমি আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার কর। আমার পাপের ও ভুলের জন্য তাওবা করছি, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার কর। ইয়া রব, তুমি ফিরিয়ে দিলে কার কাছে যাব। আমার যাওয়ার তো একটাই জায়গা। তুমি আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার কর। কারন আল্লাহ নামাজ এবং সবর এর মাধ্যমে সাহায্য চাইতে বলেছেন।  আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

 **وَاسْتَعِينُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلاَّ عَلَى الْخَاشِعِينَ*

অর্থঃ ধৈর্য্যর সাথে সাহায্য প্রার্থনা কর নামাযের মাধ্যমে। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সে সমস্ত বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব। [ সুরা বাকারা ২:৪৫ ]

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

**يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اسْتَعِينُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ إِنَّ اللّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ*

অর্থঃ হে মুমিনগন! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিতই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন। [ সুরা বাকারা ২:১৫৩ ]

হুজাইফা (রাঃ) সুত্রে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ ”নবী (সাঃ) কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে সলাত আদায় করতেন’’ (আবু দাউদ ১৩১৯; মিশকাতুল মাসাবীহ ১৩২৫;(আলবানি হাদিসটিকে হাসান বলেছেন)G
মন্তব্যঃ আপনার বিপদ হয়েছে সবর করে সালাতে দাড়ান। আল্লাহর নিকট সাহায্য কামনা করুন দেখবে সবর অর্জন সহজ হয়েছে।

২। তাকদিরের উপর বিশ্বাসে করে সবর অর্জন করতে হবেঃ

 তাকদীরের ভালো মন্দের প্রতি বিশ্বাস ইমানের অংশ। তাই তাকদিরের ফয়সালার উপর সবর করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা ইমানের দাবি। অধিকন্তু এটা ইমানের ছয়টি রুকনেরও অন্তর্ভুক্ত। হাদিসে জিবরিলে এসেছে, ইমান হচ্ছে তোমার বিশ্বাস স্থাপন করা আল্লাহর ওপর, তার ফেরেশতাদের ওপর, তার কিতাবগুলোর ওপর, তার রাসুলদের ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর এবং বিশ্বাস স্থাপন করা ভালো-মন্দ তকদিরের ওপর। (সহিহ মুসলিম)

কুরআন ও হাদিস পর্যালোচনা করে বিদ্ধানগন ছয়টি বিষয় কে ঈমানের মূল ভিত্তি উল্লেখ করেছেন। যথাঃ

(১) আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস

(২) ফিরিশতাগণের প্রতি বিশ্বাস

(৩) কিতাব সমূহের প্রতি বিশ্বাস

(৪) রাছূলগণের প্রতি বিশ্বাস

(৫) শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস এবং

(৬) তাক্বদীরের ভালো মন্দের প্রতি বিশ্বাস।

তাক্বদীরের ভালো মন্দের প্রতি বিশ্বাস করা ফরজ। তাক্বদীরের ভালো মন্দের প্রতি বিশ্বাস না থাকলে তাকে আর মুসলিম বলা যাবেনা। কোন বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত থেকে বাচার যথাযথ চেষ্টা সাধনার পরও যদি বিপদ আসে তবে মনে করতে হবে ভাগ্য। মানুষ তার ভাগ্য সম্পর্কে কিছুই জানেন না। যে কাজটি মানুষ শতভাগ চেষ্টা করেও পরিহার করতে পারে নাই, সে কাজটিই হল তার ভাগ্য। তাই তাক্বদীরের ভালো মন্দের প্রতি বিশ্বাস মানুষ  ভাবতে থাকেন, তাকদিরের ফলেই তা পরির্তন করা সম্ভব হয়নি। এই ভাবনাই তাকে সবর করতে সাহায্য করবে। বলা হয়ে থাকে, একজন সত্যিকারের তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস ব্যাক্তির তাকদিরের প্রতি ঈমান হল তার শান্তি ও নিরাপত্তার ঠিকানা। তাকদিরই আল্লাহর কুদরতে মোমিনদের হৃদয়-আত্মা নৈরাশ্য ও হতাশা মুক্ত রাখে। আমাদের উচিত জীবনের ভালো-মন্দ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এ কথার দৃঢ় বিশ্বাস করা। এ বিশ্বাস ইমানের অংশ বিশেষও বটে। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَمَن يُؤْمِن بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

অর্থঃ আল্লাহর নির্দেশ ব্যতিরেকে কোন বিপদ আসে না এবং যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত। (সুরা তাগাবুন ৬৪:১১)।

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেনঃ

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوفْ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الأَمَوَالِ وَالأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ

অর্থঃ অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। (সুরা বাকারা ২:১৫৫)

কাজেই বিপদে পড়লে বিশ্বাস করে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। ফলে বিপদে পড়েও খুশি থাকতে হবে এবং সহজভাবে তাকে গ্রহণ করে। যে ব্যক্তি বিপদে পড়লে বিশ্বাস রাখে যে এটা আল্লাহর ফায়সালা মোতাবেক এসেছে। ফলে সে সবর করার পাশাপাশি পরকালে এর প্রতিদান পাওয়ার আশা রাখে এবং আল্লাহর ফয়সালার নিকট আত্মসমর্পণ করে আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন, আর দুনিয়ার যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে তার বিনিময়ে তিনি তার অন্তরে হেদায়াত এবং সত্যিকার মজবুত একীন দান করেন। বিপদে অবিচল থাকে আল্লাহ প্রতি কারন সে বিশ্বাস করে এ মুসিবত আল্লাহ দিয়েছেন তিনিই আবার বিপদ মুক্ত করবেন। এদের কথাই আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,।

الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُواْ إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعونَ

অর্থঃ যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো। (সুরা বাকারা ২:১৫৬)।

মন্তব্যঃ  উপরের আয়াতগুলিত আল্লাহ ঘোষনা বিপদ আপন আল্লাহ দের বান্দাকে পরীক্ষার জন্য এটা একটা পূর্ব নির্ধারিত বিষয়। দুনিয়াতে পরীক্ষার আগে পাঠ্যসুচি বা সিলেভাজ প্রদান করা হয় এবং এর উপরই পরীক্ষা নেয়া হয়। ঠিক তেমনিভাবে ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি, বিপদ আপদ এর মাধ্যমে পরীক্ষাকরাই আল্লাহ প্রদত্ত পাঠ্যসুচি বা সিলেভাজ আর এর উত্তর হল তাকদির কে মেনে নিয়ে সবর করা।

মহান আল্লাহ বলেন,

مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ

অর্থঃ পৃথিবীতে ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না। কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। (সুরা হাদীদ ৫৭:২২)।

এই আয়াত দ্বারা বুঝা যায় বিপদ সম্পর্কে জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। এ কথা মাথায় রাখরে সবর করা সহজ হবে। মনে মনে এ কথা ভাববে আমিতো বিপদে পড়তে চাইনি আমার ভাগ্যই আমাকে বিপদে ফেলেছে। চিন্তিত হবার কারণ নেই কারন যিনি বিপদ দান করেছেন তিনিই আবার উদ্ধার করবেন। কাজেই তাকদিরের বিধান মেনে নিলে সবর অর্জণ করা খুবই সহা হবে।

হাদিসে এসেছে, আবূ আব্বাস আব্দুল্লাহ্ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেছেন- একদিন আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর পিছনে ছিলাম, তিনি আমাকে বললেন: “হে যুবক! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শেখাবো- আল্লাহকে সংরক্ষণ করবে  তো তিনি তোমাকে সংরক্ষণ করবেন, আল্লাহকে স্মরণ করলে তাঁকে তোমার সামনেই পাবে। যখন কিছু চাইবে তো আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন সাহায্য চাইবে তো আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। জেনে রাখ, সমস্ত মানুষ যদি তোমার কোন উপকার করতে চায় তবে আল্লাহ্ তোমার জন্য যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তা ব্যতীত আর কোন উপকার করতে পারবে না। আর যদি সমস্ত মানুষ তোমার কোন অনিষ্ট করতে চায় তবে আল্লাহ্ তোমার জন্য যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তা ব্যতীত আর কোন অনিষ্ট করতে পারবে না। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং পৃষ্ঠা শুকিয়ে গেছে।” [তিরমিযী: ২৫১৬, হাদীসটি সহীহ্ (হাসান) বলেছেন।]

ইবন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কোনো এক সময়ে আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর পিছনে বসা ছিলাম। তিনি বললেনঃ ‘’হে তরুন! তুমি আল্লাহর বিধি-নিষেধের রক্ষা করবে, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখবে, আল্লাহ তায়ালাকে তুমি কাছে পাবে। তোমার কোন কিছুর চাওয়ার প্রয়োজন হলে আল্লাহ তায়ালার নিকট চাও, আর সাহায্য প্রার্থনা করতে হলে আল্লাহর নিকটেই করো।

আর জেনে রাখো, সকল মানুষ মিলে যদি তোমার সামান্যতম উপকার করতে চায় তোমার ভাগ্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নির্ধারণ করা হয়েছে তা ব্যতিত আর কোনই উপকার করতে পারবে না। আর তারা যদি সকলে মিলে তোমার কোন ক্ষতি করতে চায় তাহলেও তোমার ভাগ্যে আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তা ব্যতিত তোমার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং লিখিত কাগজসমূহও শুকিয়ে গেছে। (তিরমিযি ২৫১৬; মিশকাত ৫৩০২; আলবানি সহীহ বলেছেন)।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, জেনে রাখো, সমস্ত মানুষ জড়ো হয়ে যদি তোমার উপকার করতে চায়, তারা কোন উপকার করতে পারবে না, তবে ততটুকু ব্যতীত যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আবার তারা সকলে মিলে যদি তোমার ক্ষতি করতে চায়, তারা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না, তবে ততটুকু ব্যতীত-যা আল্লাহ তোমার কপালে লিখে রেখেছেন। কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এবং কিতাব শুকিয়ে গেছে।’ (সুনানে তিরমিজী, হাদিস নং-২৪৪০)।

মন্তব্যঃ কাজেই বিপদে আল্লাহর উপর ভরসা করে সবর করা মুমিন জন্য একান্ত কর্তব্য।

 

৩। মুত্যুর ভয়াবহতা ও কবরের আজাবের কথা স্বরণ করে সবর অর্জণ করা।

প্রতিটি মানুষই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ। দুনিয়াদার সকল মানুষ তাই মুসরিক হোক, কাফির হোক, নাস্তিক হোক আর মুসলিম হোক মৃত্যুকে বিশ্বাস করে। কিন্তু সকলের চেয়ে মুসলিমের বিশ্বস একটু আলাদা কারন সে  কবরের আজাব বিশ্বাস করে। মৃত্যুর এই সত্যতা সম্পর্কে আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

كُلُّ نَفۡسٍ۬ ذَآٮِٕقَةُ ٱلۡمَوۡتِ‌ۖ ثُمَّ إِلَيۡنَا تُرۡجَعُونَ (٥٧)

অর্থঃ প্রতিটি মানুষই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। সবশেষে তোমাদের আমার নিকট ফিরিয়ে আনা হবে। (সুরা আনকাবুদ ২৯:৫৭)।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা আরও বলেনঃ

 إِنَّكَ مَيِّتٌ۬ وَإِنَّہُم مَّيِّتُونَ (٣٠)

অর্থঃ নিশ্চয়ই তুমিও মারা যাবে, এবং নিশ্চয়ই তারাও মারা যাবে। (সুরা জুমার ৩৯:৩০)।

বিপদে আপদে সময় মুত্যুর ভয়াবহতা ও কবরের আজাবের কথা স্বরণ করলে দুনিয়ার বিপদ আপদ কে তুচ্ছ মনে হবে এবং সবর অর্জণ করা সহজ হবে। এই জন্য এ সম্পর্কিত হাদিস সমূহ মনযোগ দিয়ে অধ্যায়ন করলে মনের মাঝে মুত্যু ও কবর আজাবের চিত্র ফুটে উঠবে তখন দুনিয়ার বিপদে আপদ আর বিপদ মনে হবে না। উদাহরণ সরূপ এ সম্পর্কিত একটি সহিহ হাদিস তুলে ধরলাম। বিপদ আপদে এ হাদিসটি পড়লে সবর করা সহজ হবে।

বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, এক আনসারী ব্যক্তির দাফন-কাফনের জন্য আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বের হলাম। আমরা কবরের কাছে পৌছে গেলাম তখনও কবর খোড়া শেষ হয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে বসলেন। আমরা তাঁর চার পাশে এমনভাবে বসে গেলাম যেন আমাদের মাথার উপর পাখি বসেছে। আর তাঁর হাতে ছিল চন্দন কাঠ যা দিয়ে তিনি মাটির উপর মৃদু পিটাচ্ছিলেন। তিনি তখন মাথা জাগালেন আর বললেন, তোমরা কবরের শাস্তি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। কথাটি তিনি দু বার কিংবা তিন বার বললেন। এরপর তিনি আরো বললেন, যখন কোন ঈমানদার বান্দা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে আখেরাতের দিকে যাত্রা করে তখন আকাশ থেকে তার কাছে ফেরেশতা আসে। তাদের চেহারা থাকবে সূর্যের মত উজ্জল। তাদের সাথে থাকবে জান্নাতের কাফন ও সুগন্ধি। তারা তার চোখ বন্ধ করা পর্যন্ত তার কাছে বসে থাকবে। মৃত্যুর ফেরেশতা এসে তার মাথার কাছে বসবে। সে বলবে, হে সুন্দর আত্মা! তুমি আল্লাহ তাআলার ক্ষমা ও তার সন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এসো। আত্মা বেরিয়ে আসবে যেমন বেড়িয়ে আসে পান-পাত্র থেকে পানির ফোটা। সে আত্মাকে গ্রহণ করে এক মুহুর্তের জন্যেও ছাড়বে না। তাকে সেই জান্নাতের কাফন পরাবে ও সুগন্ধি লাগাবে। পৃথিবিতে যে মিশক আছে সে তার চেয়ে বেশী সুগন্ধি ছড়াবে। তাকে নিয়ে তারা আসমানের দিকে যেতে থাকবে। আর ফেরেশতাদের প্রতিটি দল বলবে, কে এই পবিত্র আত্মা? তাদের প্রশ্নের উত্তরে তারা তার সুন্দর নাম নিয়ে বলবে যে, অমুক অমুকের ছেলে। এমনিভাবে প্রথম আসমানে চলে যাবে। তার জন্য প্রথম আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হবে। এমনি করে প্রতিটি আসমান অতিক্রম করে যখন সপ্তম আসমানে যাবে তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলবেন, আমার বান্দা আমলনামাটা ইল্লিয়ীনে লিখে দাও। আর আত্মাটা দুনিয়াতে তার দেহের কাছে পাঠিয়ে দাও। এরপর কবরে প্রশ্নোত্তরের জন্য দুজন ফেরেশতা আসবে। তারা প্রশ্ন করবে, তোমার প্রভূ কে? সে বলবে আমার প্রভূ আল্লাহ। তারা প্রশ্ন করবে, তোমার ধর্ম কি? সে উত্তর দেবে, আমার ধর্ম ইসলাম। তারা প্রশ্ন করবে এই ব্যক্তিকে চেন, যাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে? সে উত্তরে বলবে, সে আল্লাহর রাসূ। তারা বলবে, তুমি কিভাবে জানলে? সে উত্তরে বলবে, আমি আল্লাহর কিতাব পাঠ করেছি।

তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। তাকে সত্য বলে স্বীকার করেছি। তখন আসমান থেকে একজন আহবানকারী বলবে, আমার বান্দা অবশ্যই সত্য বলেছে। তাকে জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও। তার কবর থেকে জান্নাতের একটি দরজা খুলে দাও। জান্নাতের সুঘ্রাণ ও বাতাস আসতে থাকবে। যতদূর চোখ যায় ততদূর কবর প্রশস্ত করে দেয়া হবে। তার কাছে সুন্দর চেহারার সুন্দর পোশাক পরিহিত  সুগন্ধি ছড়িয়ে এক ব্যক্তি আসবে। সে তাকে বলবে, তুমি সুসংবাদ নাও। সূখে থাকো। দুনিয়াতে এ দিনের ওয়াদা দেয়া হচ্ছিল তোমাকে।

মৃত ব্যক্তি সুসংবাদ দাতা এ ব্যক্তিকে সে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কে? সে উত্তরে বলবে, আমি তোমার নেক আমল (সৎকর্ম)। তখন সে বলবে, হে আমার রব! কেয়ামত সংঘটিত করুন! হে আমার রব! কেয়ামত সংঘটিত করুন!! যেন আমি আমার সম্পদ ও পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারি।

আর যখন কোন কাফের দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে আখেরাত পানে যাত্রা করে তখন তার কাছে কালো চেহারার ফেরেশতা আগমন করে। তার সাথে থাকে চুল দ্বারা তৈরী কষ্ট দায়ক কাপর। তারা চোখ বুজে যাওয়া পর্যন্ত তার কাছে বসে থাকে। এরপর আসে মৃত্যুর ফেরেশতা। তার মাথার কাছে বসে বলে, হে দুর্বিত্ত পাপিষ্ট আত্মা বের হয়ে আল্লাহর ক্রোধ ও গজবের দিকে চলো। তখন তার দেহে প্রচন্ড কম্পন শুরু হয়। তার আত্মা টেনে বের করা হয়, যেমন আদ্র রেশমের ভিতর থেকে লোহার ব্রাশ বের করা হয়। যখন আত্মা বের করা হয় তখন এক মুহুর্তের জন্যও ফেরেশতা তাকে ছেড়ে দেয় না। সেই কষ্টদায়ক কাপড় দিয়ে তাকে পেচিয়ে ধরে। তার লাশটি পৃথিবীতে পড়ে থাকে। আত্মাটি নিয়ে যখন উপরে উঠে তখন ফেরেশতারা বলতে থাকে কে এই পাপিষ্ট আত্মা? তাদের উত্তরে তার নাম উল্লেখ করে বলা হয় অমুক, অমুকের ছেলে। প্রথম আসমানে গেলে তার জন্য দরজা খোলার অনুরোধ করা হলে দরজা খোলা হয় না।

এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করলেন:

لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ

অর্থঃ তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না উট সূঁচের ছিদ্রতে প্রবেশ করে। (সূরা আরাফ ৭:৪০)

অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলবেন, তার আমলনামা সিজ্জীনে লিখে দাও  যা সর্ব নিম্ন স্তর। এরপর তার আত্মাকে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করা হবে। এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করেনঃ

**وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ *

অর্থঃ আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কিংবা বাতাস তাকে দূরের কোন জায়গায় নিক্ষেপ করল। (সূরা আল হজ, আয়াত : ৩১)

এরপর তার দেহে তার আত্মা চলে আসবে। দু ফেরেশতা আসবে। তাকে বসাবে। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করবে, তোমার প্রভূ কে? সে বলবে, হায়! হায়!! আমি জানি না। তারা তাকে আবার জিজ্ঞেস করবে, তোমার ধর্ম কি? সে বলবে, হায়! হায়!! আমি জানি না। তারপর জিজ্ঞেস করবে, এ ব্যক্তি কে যাকে তোমাদের মধ্যে পাঠানো হয়েছিল? সে উত্তর দেবে, হায়! হায়!! আমি জানি না। তখন আসমান থেকে এক আহবানকারী বলবে, সে মিথ্যা বলেছে। তাকে জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও। জাহান্নামের একটি দরজা তার জন্য খুলে দাও। জাহান্নামের তাপ ও বিষাক্ততা তার কাছে আসতে থাকবে। তার জন্য কবরকে এমন সঙ্কুচিত করে দেয়া হবে যাতে তার হাড্ডিগুলো আলাদা হয়ে যাবে। তার কাছে এক ব্যক্তি আসবে যার চেহার বিদঘুটে, পোশাক নিকৃষ্ট ও দুর্গন্ধময়।

সে তাকে বলবে, যে দিনের খারাপ পরিণতি সম্পর্কে তোমাকে বলা হয়েছিলো তা আজ উপভোগ করো। সে এই বিদঘুটে চেহারার লোকটিকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি কে? সে বলবে, আমি তোমার অসৎকর্ম। এরপর সে বলবে, হে প্রভূ! আপনি যেন কেয়ামত সংঘটিত না করেন। (বর্ণনায়, আহমদ, আবু দাউদ, হাকেম, আলবানী রহ. আহকামুল জানায়িয কিতাবে এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)।

মন্তব্যঃ এর থেকে বিপদ আর কি হতে পারে। দুনিয়ার সামান্য বিপদে সবর ধরতে পারলে এই ভয়াবহ বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

 

 

 

Leave a comment