পূর্ববর্তী নবী রাসূল কিভাবে সবর অর্জণ করেছেনঃ দ্বিতীয় পর্ব

পূর্ববর্তী নবী রাসূল কিভাবে সবর অর্জণ করেছেনঃ দ্বিতীয় পর্ব

হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালামঃ

পবিত্র কুরআনে ৪টি সূরার ৮টি আয়াতে আইয়ূব আলাইহিস এর কথা বলা হয়েছে।  নিসা (৪:১৬৩), আন‘আম (৬:৮৪), আম্বিয়া (২১:৮৩-৮৪) এবং ছোয়াদ (৩৮:৪১-৪৪)। মহান আল্লাহ বলেন,

وَأَيُّوبَ إِذۡ نَادَىٰ رَبَّهُ ۥۤ أَنِّى مَسَّنِىَ ٱلضُّرُّ وَأَنتَ أَرۡحَمُ ٱلرَّٲحِمِينَ (٨٣) فَٱسۡتَجَبۡنَا لَهُ ۥ فَكَشَفۡنَا مَا بِهِۦ مِن ضُرٍّ۬‌ۖ وَءَاتَيۡنَـٰهُ أَهۡلَهُ ۥ وَمِثۡلَهُم مَّعَهُمۡ رَحۡمَةً۬ مِّنۡ عِندِنَا وَذِڪۡرَىٰ لِلۡعَـٰبِدِينَ (٨٤)

অর্থঃ এবং স্মরণ করুন আইয়্যুবের কথা, যখন তিনি তাঁর পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেন, আমি দুঃখকষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি দয়াবানদের চাইতেও সর্বশ্রেষ্ট দয়াবান। অতঃপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁর দুঃখকষ্ট দূর করে দিলাম এবং তাঁর পরিবরাবর্গ ফিরিয়ে দিলাম, আর তাদের সাথে তাদের সমপরিমাণ আরও দিলাম আমার পক্ষ থেকে কৃপাবশতঃ আর এটা এবাদত কারীদের জন্যে উপদেশ স্বরূপ। [ সুরা আম্বিয়া ২১:৮৩-৮৪ ]

 وَٱذۡكُرۡ عَبۡدَنَآ أَيُّوبَ إِذۡ نَادَىٰ رَبَّهُ ۥۤ أَنِّى مَسَّنِىَ ٱلشَّيۡطَـٰنُ بِنُصۡبٍ۬ وَعَذَابٍ (٤١) ٱرۡكُضۡ بِرِجۡلِكَ‌ۖ هَـٰذَا مُغۡتَسَلُۢ بَارِدٌ۬ وَشَرَابٌ۬ (٤٢) وَوَهَبۡنَا لَهُ ۥۤ أَهۡلَهُ ۥ وَمِثۡلَهُم مَّعَهُمۡ رَحۡمَةً۬ مِّنَّا وَذِكۡرَىٰ لِأُوْلِى ٱلۡأَلۡبَـٰبِ (٤٣) وَخُذۡ بِيَدِكَ ضِغۡثً۬ا فَٱضۡرِب بِّهِۦ وَلَا تَحۡنَثۡ‌ۗ إِنَّا وَجَدۡنَـٰهُ صَابِرً۬ا‌ۚ نِّعۡمَ ٱلۡعَبۡدُ‌ۖ إِنَّهُ ۥۤ أَوَّابٌ۬ (٤٤)

আর স্মরণ করো আমার বান্দা আইয়ূবের কথা যখন সে তার রবকে ডাকলো এই বলে যে, শয়তান আমাকে কঠিন যন্ত্রণা ও কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে৷ (আমি তাকে হুকুম দিলাম) তোমার পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত করো, এ হচ্ছে ঠাণ্ডা পানি গোসল করার জন্য এবং পান করার জন্য৷ আমি তাকে ফিরিয়ে দিলাম তার পরিবার পরিজন এবং সেই সাথে তাদের মতো আরো, নিজের পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ এবং বুদ্ধি ও চিন্তাশীলদের জন্য শিক্ষণীয়। (আর আমি তাকে বললাম) এক আমি ঝাড়ু- নাও এবং তা দিয়ে আঘাত করো এবং নিজের কসম ভংগ করো না৷ আমি তাকে সবরকারী পেয়েছি,  উত্তম বান্দা ছিল সে,  নিজের রবের অভিমুখী৷ [সুরা ছোয়াদ ৩৮: ৪১-৪৪]।

মন্তব্যঃ কুরআনের আয়াত দ্বারা বুঝা যায় আইয়ূব আলাইহিস সালাম তার বিপদের সময় কঠোরভাবে সবর করে ছিলেন এবং তার এই সবর মহান আল্লাহ খুর খুসি হয়েছেন।  মহান আল্লাহর সুন্নাত হল প্রত্যেক নবীকেই কঠিন পরীক্ষা সম্মুখিন করা। তবে  সে পরীক্ষা এমন হ’তে পারে না, যা নবীর মর্যাদার খেলাফ ও স্বাভাবিক ভদ্রতার বিপরীত এবং যা ফাসেকদের হাসি-ঠাট্টার খোরাক হয়। যেমন তাকে কঠিন রোগে ফেলে দেহে পোকা ধরানো, দেহের সব মাংস খসে পড়া, পচে-গলে দুর্গন্ধময় হয়ে যাওয়ায় ঘর থেকে বের করে জঙ্গলে ফেলে আসা, ১৮ বা ৩০ বছর ধরে রোগ ভোগ করা, আত্মীয়-স্বজন সবাই তাকে ঘৃণাভরে ছেড়ে চলে যাওয়া ইত্যাদি সবই নবীবিদ্বেষী ও নবী হত্যাকারী ইহুদী গল্পকারদের বানোয়াট মিথ্যাচার বৈ কিছুই নয়।  ইহুদী নেতাদের কুকীর্তির বিরুদ্ধে যখনই নবীগণ কথা বলেছেন, তখনই তারা তাদের বিরুদ্ধে লেগেছে। এবং যা খুশী তাই লিখে কেতাব ভরেছে। ধর্ম ও সমাজ নেতারা তাদের অনুসারীদের বুঝাতে চেয়েছে যে, নবীরা সব পথভ্রষ্ট।  [সূত্রঃ নবীদের জীবনি, মুহাম্মাত আসাদুল্লাহ আল গালিব]

হযরত শোয়ায়েব আলাইহিস সালামঃ

মহান আল্লাহ বলেন,

وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُواْ اللّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ قَدْ جَاءتْكُم بَيِّنَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ فَأَوْفُواْ الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ وَلاَ تَبْخَسُواْ النَّاسَ أَشْيَاءهُمْ وَلاَ تُفْسِدُواْ فِي الأَرْضِ بَعْدَ إِصْلاَحِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ

অর্থঃ আমি মাদইয়ানের প্রতি তাদের ভাই শোয়ায়েবকে প্রেরণ করেছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর এবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রমাণ এসে গেছে। অতএব তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ন কর এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যদি কম দিয়ো না এবং ভুপৃষ্টের সংস্কার সাধন করার পর তাতে অনর্থ সৃষ্টি করো না। এই হল তোমাদের জন্যে কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। [ সুরা আরাফ ৭:৮৫ ]

মাদইয়ান বাসিদেরকে যখন হযরত শোয়ায়েব আলাইহিস সালাম তাওহীদ এবাদতের দাওয়াত দিলেন তখন মাদইয়ান বাসিগণ তাকে জাদুগ্রস্ত এবং মিথ্যাবাদী বল অপবাদ দেন। এই অপমানে সবর ধারণ করে তিনি তার দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান। মহান আল্লাহ বলেন,

 وَٱتَّقُواْ ٱلَّذِى خَلَقَكُمۡ وَٱلۡجِبِلَّةَ ٱلۡأَوَّلِينَ (١٨٤) قَالُوٓاْ إِنَّمَآ أَنتَ مِنَ ٱلۡمُسَحَّرِينَ (١٨٥)

অর্থঃ তারা বলল, তুমি তো জাদুগ্রস্তদের অন্যতম।তুমি আমাদের মত মানুষ বৈ তো নও। আমাদের ধারণা-তুমি মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত। [ সুরা শু’য়ারা ২৬:১৮৫-১৮৬ ]

শুধু মিথ্যা অপবাদ নয় তার অনুসরনেও বাধা দেন।মহান আল্লাহ বলেন,

*وَقَالَ الْمَلأُ الَّذِينَ كَفَرُواْ مِن قَوْمِهِ لَئِنِ اتَّبَعْتُمْ شُعَيْباً إِنَّكُمْ إِذاً لَّخَاسِرُونَ*

অর্থঃ তার সম্প্রদায়ের কাফের সর্দাররা বললঃ যদি তোমরা শোয়ায়েবের অনুসরণ কর, তবে নিশ্চিতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। [সুরা আরাফ ৭:৯০]

সম্প্রদায়ের দাম্ভিক সর্দারগন তাকে দেশ থেকে বাহিস্কার করার হুমকিএ প্রদান করেন। মহান আল্লাহ বলেন,

*قَالَ الْمَلأُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُواْ مِن قَوْمِهِ لَنُخْرِجَنَّكَ يَا شُعَيْبُ وَالَّذِينَ آمَنُواْ مَعَكَ مِن قَرْيَتِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا قَالَ أَوَلَوْ كُنَّا كَارِهِينَ*

অর্থঃ তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক সর্দাররা বললঃ হে শোয়ায়েব, আমরা অবশ্যই তোমাকে এবং তোমার সাথে বিশ্বাস স্থাপনকারীদেরকে শহর থেকে বের করে দেব অথবা তোমরা আমাদের ধর্মে প্রত্যাবর্তন করবে। শোয়ায়েব বললঃ আমরা অপছন্দ করলেও কি? (সুরা আরাফ ৭:৮৮)।

মন্তব্যঃ এভাবে দ্বীন প্রচারে বাধা প্রদানের পরও সবর করে জমিনে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।

 

১০। হযরত ইউনুস আলাইহিস সালামঃ

হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম তার কওমকে তাওহীদের দাওয়াত দেন। তারা তারে অস্বীকার করল এবং তাঁর প্রতি অবাধ্যতা। তার দাওয়াত কে প্রত্যাখ্যাত করল ফলে মহান আল্লাহ তাদের উপর আজাবের ফয়সারা করের। আল্লাহর হুকুমে তিনি এলাকা ত্যাগ করে চলে যান। তার কওমের লোকজন ভাবল নবী কখনো মিথ্যা বলেন না। ফলে তারা  ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে  কুফর ও শিরক হতে তাওবা করে। এবং  আল্লাহর দরবারে খুব কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।  আল্লাহ তাদের দোয়া করেন। এবং তাদের আজাব থেকে মুক্তি দান করে। কুরআনে এসেছে, মহান আল্লাহ এরশাদ করেন।

*فَلَوْلاَ كَانَتْ قَرْيَةٌ آمَنَتْ فَنَفَعَهَا إِيمَانُهَا إِلاَّ قَوْمَ يُونُسَ لَمَّا آمَنُواْ كَشَفْنَا عَنْهُمْ عَذَابَ الخِزْيِ فِي الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَمَتَّعْنَاهُمْ إِلَى حِينٍ**

সুতরাং কোন জনপদ কেন এমন হল না যা ঈমান এনেছে অতঃপর তার সে ঈমান গ্রহণ হয়েছে কল্যাণকর? অবশ্য ইউনুসের সম্প্রদায়ের কথা আলাদা। তারা যখন ঈমান আনে তখন আমি তুলে নেই তাদের উপর থেকে অপমানজনক আযাব-পার্থি ব জীবনে এবং তাদের কে কল্যাণ পৌছাই এক নিধারিত সময় পর্যন্ত। [ সুরা ইউনুস ১০:৯৮ ]

অপর পক্ষে আল্লাহ নবী  ইউনুস (আঃ) ভেবেছিলেন যে,তাঁর কওম আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু পরে যখন তিনি জানতে পারলেন যে,আদৌ গযব নাযিল হয়নি,তখন তিনি চিন্তায় পড়লেন যে,এখন তার কওম তাকে মিথ্যাবাদী ভাববে এবং মিথ্যাবাদীর শাস্তি হিসাবে প্রথা অনুযায়ী তাকে হত্যা করবে। তখন তিনি জনপদে ফিরে না গিয়ে অন্যত্র হিজরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। এ সময় আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি। (নবীদের জীবনি, আসাদুল্লাহ গালীব)

মহান আল্লাহ বলেঃ আর ইউনুসও ছিলেন পয়গম্বরগণের একজন। যখন পালিয়ে তিনি বোঝাই নৌকায় গিয়ে পৌঁছেছিলেন। অতঃপর লটারী করালে তিনি দোষী সাব্যস্ত হলেন। অতঃপর একটি মাছ তাঁকে গিলে ফেলল, তখন তিনি অপরাধী গণ্য হয়েছিলেন।যদি তিনি আল্লাহর তসবীহ পাঠ না করতেন, তবে তাঁকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত মাছের পেটেই থাকতে হত।অতঃপর আমি তাঁকে এক বিস্তীর্ণ-বিজন প্রান্তরে নিক্ষেপ করলাম, তখন তিনি ছিলেন রুগ্ন। আমি তাঁর উপর এক লতাবিশিষ্ট বৃক্ষ উদগত করলাম। [ সুরা সাফফাত ৩৭:১৩৯-১৪৬ ]

যখন হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম তার ভুল বুঝতে পারলেন তখন তিনি আল্লহ নিকট ক্ষমা চাইলেন এবং মহান আল্লাহ তাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলেন। মাহন আল্লাহর ভাষায়।

তিনি বলেনঃ এবং মাছওয়ালার কথা স্মরণ করুন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, অতঃপর মনে করেছিলেন যে, আমি তাঁকে ধৃত করতে পারব না। অতঃপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহবান করলেনঃ তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই; তুমি নির্দোষ আমি গুনাহগার। অতঃপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। আমি এমনি ভাবে বিশ্ববাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি। [ সুরা আম্বিয়া ২১:৭৭-৮৮ ]

মন্তব্যঃ এভাবেই মহান আ্ল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের মর্জাদা বৃদ্ধির জন্য বার বার পরীক্ষা নিয়েছে। আর তার সবর করে আল্লাহর রহমতে প্রতিটি পরীক্ষায পাশ করেছেন।

 

১১। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম

হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম অনেকগুলি মোজেযা ছিল। যা দেখে  এবং তাঁর মুখনিঃসৃত তাওহীদের বাণী শুনে অনেক গরীব শ্রেণীর লোক তাঁর প্রতি ঈনান আনে। কিন্তু সমাজ নেতাগছের লোকজন তার এই দাওয়াত গ্রহন করতে পারেনি কারন তাওহীদের এই  সাম্যের বাণী সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদী নেতাদের স্বার্থ বিরোধী হয়ে থাকে। তাই সমাজপতিগন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। এনকি তাকে যাদুকর বলে অপবাদ দান করেন। মহান আল্লাহ বলেন,

*إِذْ جِئْتَهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْهُمْ إِنْ هَـذَا إِلاَّ سِحْرٌ مُّبِيْنٌ *

যখন তুমি তাদের কাছে প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলে, অতঃপর তাদের মধ্যে যারা কাফের ছিল, তারা বললঃ এটা প্রকাশ্য জাদু ছাড়া কিছুই নয়। [ সুরা মায়েদা ৫:১১০ ]

তিনি তাদের অপবাদে সবর করে তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে যেতে থাকেন। তখন বিরোধীরা বেছে নেয় অতীব নোংরা পথ। তারা তাঁর মায়ের নামে অপবাদ রটাতে শুরু করে। যাতে ঈসা (আঃ) অত্যন্ত ব্যথা পেলেও নবুঅতের গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সবকিছু নীরবে সবর করতে থাকেন। তার দাওয়াতের কর্ম পন্থা ও সবরের কারনে সমর্থক সংখ্যা যতই বাড়তে থাকে,অবিশ্বাসী সমাজ নেতাদের চক্রান্ত ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবার তারা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল এবং সেজন্য দেশের বাদশাহকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে আল্লাহ দ্রোহী তার অভিযেগ আনল এবং তারা বলল যে, সে তাওরাত পরিবর্তন করে সবাইকে বিধর্মী করছে। এসব অভিযোগ শুনে অবশেষে বাদশাহ তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। গ্রেফতারের জন্য সরকারী বাহিনী ও ইহুদী চক্রান্তকারীরা তাঁর বাড়ী ঘেরাও করে। তারা জনৈক নরাধমকে ঈসা (আঃ) কে হত্যা করার জন্য পাঠায়। কিন্তু ইতিপূর্বে আল্লাহ ঈসা (আঃ) কে উঠিয়ে নেওয়ায় সে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যায়। কিন্তু এরি মধ্যে আল্লাহর হুকুমে তার চেহারা ঈসা (আঃ)-এর সদৃশ হয়ে যায়। ফলে ইহুদীরা তাকেই ঈসা ভেবে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করে।  মহান আল্লাহ  ইহুদীদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে স্বীয় কৌশল প্রেরণ করেন এবং ঈসা (আঃ) কে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন।

কুরআনের ভাষায়,

وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَـكِن شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُواْ فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِّنْهُ مَا لَهُم بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلاَّ اتِّبَاعَ الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا

আর তাদের একথা বলার কারণে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি যিনি ছিলেন আল্লাহর রসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না শুলীতে চড়িয়েছে, বরং তারা এরূপ ধাঁধায় পতিত হয়েছিল। বস্তুতঃ তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তাঁকে তারা হত্যা করেনি। [ সুরা নিসা ৪:১৫৭ ]

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

بَل رَّفَعَهُ اللّهُ إِلَيْهِ وَكَانَ اللّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا

বরং তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা নিজের কাছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। [সুরা নিসা ৪:১৫৮

খৃষ্টানদের দাবীঃ  হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সে যুগের ও পরবর্তী যুগের সকল খৃষ্টানের পাপের বোঝা নিজে কাঁধে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ শূলে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।  এসব কথার কোন ভিত্তিনেই এগুল স্রেফ অপপ্রচার এবং মিথ্যার কল্প কাহিনী মাত্র।

মন্তব্যঃ এ ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা মহান আল্লাহ তার একজন শ্রেষ্ঠ বান্দাকিভাবে মুত্যুর মুখমুখি দাড় করিয়ে সবরের পরীক্ষা নেন। তাই আমাদের বিপদে আপদে নবীদের এসকল ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে সবর করতে হবে।

       এখানে নয় জন নবীর জীবনি থেকে সবরের কিছু ধারনা নিলাম। এ ছাড়াও কুরাআনে বর্ণিত আদম আলাইহিস সালাম,  ইদরীস আলাইহিস সালাম, হূদ আলাইহিস সালাম,  লূত্ব  আলাইহিস সালাম, ইসহাক্ব আলাইহিস সালাম, শো‘আয়েব আলাইহিস সালাম, মূসা আলাইহিস সালাম, হারূণ আলাইহিমাস সালাম, দাঊদ আলাইহিস সালাম, সুলায়মান আলাইহিস সালাম, ইলিয়াস আলাইহিস সালাম, আল-ইয়াসা‘ আলাইহিস সালাম, যুল-কিফল আলাইহিস সালাম, যাকারিয়া ও ইয়াহ্ইয়া আলাইহিমাস সালাম সকলে জীবনিতেই দেখা যায় তারা যখন তাওহিদের দাওয়া দেন তখনই তাদের সমাজে কর্তা ব্যাক্তিগণ তাদের বিরোধীতা করে। তাদের উপর নির্জাতন করে। তাদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করে। এভাবে আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের পরীক্ষা করেন। এ সকল ঘটনা পড়লে বা জানলে ইমান মজবুতের  পাশাপাশি সবর অর্জনেও সহজ হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

حَتَّى إِذَا اسْتَيْأَسَ الرُّسُلُ وَظَنُّواْ أَنَّهُمْ قَدْ كُذِبُواْ جَاءهُمْ نَصْرُنَا فَنُجِّيَ مَن نَّشَاء وَلاَ يُرَدُّ بَأْسُنَا عَنِ الْقَوْمِ الْمُجْرِمِينَ

অর্থঃ এমনকি যখন পয়গম্বরগণ নৈরাশ্যে পতিত হয়ে যেতেন, এমনকি এরূপ ধারণা করতে শুরু করতেন যে, তাদের অনুমান বুঝি মিথ্যায় পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন তাদের কাছে আমার সাহায্য পৌছে। অতঃপর আমি যাদের চেয়েছি তারা উদ্ধার পেয়েছে। আমার শাস্তি অপরাধী সম্প্রদায় থেকে প্রতিহত হয় না। [ সুরা ইউসুফ ১২:১১০ 

 

১২হাদিসে আলোকে নবী রাসূলদের সবরঃ

উরওয়াহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীঃ حَتَّىٓ إِذَا اسْتَيْأَسَ الرُّسُلُ (এমনকি যখন রসূলগণ নিরাশ হয়ে গেলেন) এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম যে, এ আয়াতে শব্দটা (أَكُذِبُوْا) ‘না’ (كُذِّبُوْا) ‘আয়িশাহ (রাঃ) বললেন, اَكُذِّبُوْا আমি জিজ্ঞেস করলাম, যখন আম্বিয়ায়ে কিরাম পূর্ণ বিশ্বাস করে নিলেন, এখন তাদের সম্প্রদায় তাদের প্রতি মিথ্যারোপ করবে, তখন [الظَّن] ব্যবহারের উদ্দেশ্য কী? ‘আয়িশাহ (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ, আমার জীবনের কসম! তারা পূর্ণ বিশ্বাস করেই নিয়েছিলেন। আমি তাঁকে বললাম ظَنُّوْآ أَنَّهُمْ قَدْ كُذِبُوْا অর্থ কী দাঁড়ায়? ‘আয়িশাহ (রাঃ) বললেন, মা‘আযাল্লাহ! রাসূলগণ কখনও আল্লাহ্ সম্পর্কে মিথ্যা ধারণা করতে পারেন না। আমি বললাম, তবে আয়াতের অর্থ কী হবে? তিনি বললেন, তারা রাসূলদের অনুসারী, যারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছে এবং রাসূলদের সত্য বলে স্বীকার করেছে, তারপর তাদের প্রতি দীর্ঘকাল ধরে (কাফেরদের) নির্যাতন চলেছে এবং আল্লাহর সাহায্য আসতেও অনেক দেরী হয়েছে, এমনকি যখন রাসূলগণ তাঁদের সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে তাঁদের প্রতি মিথ্যারোপকারীদের ঈমান আনা সম্পর্কে নিরাশ হয়ে গেছেন এবং রাসূলদের এ ধারণা জন্মেছে যে, এখন তাঁদের অনুসারীরাও তাদের প্রতি মিথ্যারোপ করতে শুরু করবে, এমন সময় তাঁদের কাছে আল্লাহর সাহায্য এল। (সহিহ বুখানি আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৩৩৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৩৩৪)

একদা সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা) রাসূল (সা) কে জিজ্ঞেস করেন, “হে আল্লাহর রাসূল! দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত কে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত হলেন নবীগণ, তারপর যারা তাঁদের নিকটবর্তী, অতঃপর যারা তাঁদের নিকটবর্তী। মানুষকে তার দ্বীন অনুযায়ী পরীক্ষা করা হয়। দ্বীনী অবস্থান মজবুত হলে পরীক্ষা কঠিন হয়। দ্বীনী অবস্থান দুর্বল হলে পরীক্ষাও শিথিল হয়। মুসিবত মু’মিন ব্যক্তিকে পাপশূন্য করে দেয়, এক সময়ে দুনিয়াতে সে নিষ্পাপ অবস্থায় বিচরণ করতে থাকে।” (তিরমিযী ২৩৯৮; ইবন মাজাহ ৪০২৩; সহীহ জামে‘ ৯৯২)

খাব্বাব ইবনু আরাত্ত্ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অভিযোগ করলাম (এমতাবস্থায়) যে, তিনি কা‘বা ঘরের ছায়ায় একটি চাদরে ঠেস দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমরা বললাম যে, ‘আপনি কি আমাদের জন্য (আল্লাহর কাছে) সাহায্য চাইবেন না? আপনি কি আমাদের জন্য দো‘আ করবেন না?’ তিনি বললেন, ‘‘(তোমাদের জানা উচিত যে,) তোমাদের পূর্বেকার (মু’মিন) লোকেদের এই অবস্থা ছিল যে, একটি মানুষকে ধরে আনা হত, তার জন্য গর্ত খুঁড়ে তাকে তার মধ্যে (পুঁতে) রাখা হত। অতঃপর তার মাথার উপর করাত চালিয়ে তাকে দু’খণ্ড করে দেওয়া হত এবং দেহের গোশতের নিচে হাড় পর্যন্ত লোহার চিরুনী চালিয়ে শাস্তি দেওয়া হত। কিন্তু এই (কঠোর পরীক্ষা) তাকে তার দ্বীন থেকে ফেরাতে পারত না। আল্লাহর কসম! আল্লাহ নিশ্চয় এই ব্যাপারটিকে (দ্বীন ইসলামকে) এমন সুসম্পন্ন করবেন যে, একজন আরোহী সান‘আ’ থেকে হাযরামাউত একাই সফর করবে; কিন্তু সে (রাস্তায়) আল্লাহ এবং নিজ ছাগলের উপর নেকড়ের আক্রমণ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়ো করছ।’’  সহীহুল বুখারী ৩৬১৬, ৫৬৫৬, ৫৬৬২, ৭৪৭০,রিয়াযুস স্বালেহীন ১১/৩৬)।

ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি যেন আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নবীদের মধ্যে কোন এক নবীর ঘটনা বর্ণনা করতে দেখছি; (আলাইহিমুস স্বালাতু অসসালাম) যাঁকে তাঁর স্বজাতি প্রহার ক’রে রক্তাক্ত ক’রে দিয়েছে। আর তিনি নিজ চেহারা থেকে রক্ত পরিষ্কার করছেন আর বলছেন, ‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমার জাতিকে ক্ষমা ক’রে দাও। কেননা, তারা জ্ঞানহীন।’’ (বুখারী ৩৪৭৭, ৬৯২৯, মুসলিম ৪৭৪৭)

সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে একবার জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর নবী! কোন ধরনের লোককে বিপদাপদ দিয়ে সবচেয়ে বেশী পরীক্ষা করা হয়? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘’নবীদেরকে। তারপর তাদের পরে যারা উত্তম তাদেরকে। মানুষকে আপন আপন দ্বীনদারীর অনুপাতে পরীক্ষা করা হয়। দ্বীনদারীতে যে যত বেশী মজবুত হয় তার বিপর মুসিবত তত বেশী কঠিন হয়। দ্বীনের ব্যপারে যদি মানুষের দুর্বলতা থাকে, তার বিপদও ছোট ও সহজ হয়। এভাবে তার বিপদ হতে থাকে। এ নিয়েই সে মাটিতে চলাফেরা করতে থাকে। পরিশেষে তার কোনো গুনাহখাতা থাকে না’’ তিরমিযি ২৩৯৮; ইবন মাযাহ ৪০২৩; মিশকাতুল মাসাবীহ ১৫৬২ (আলবানি সহীহ বলেছেন)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

 

Leave a comment