বিভিন্ন দিবস কেন্দ্রিক বিদআত দ্বিতীয় কিস্তি

 পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

১। পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষঃ

        বাংলা সনের প্রথম দিন বা পহেলা বৈশাখ যাকে আমরা “বাংলা নববর্ষ” বলি। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শুভ নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে উদজাপিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যদোয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু হয়। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় পায় নাই।

ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি তার আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।

২। নববর্ষ উদযাপনঃ

নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও এখান শহরের কেন্দ্রিক হয়েছে। আধুনিক মিডিয়ার প্রচারের কারনে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই দিন উপলক্ষে বাঙ্গালীরা নতুন জামাকাপড় পড়ে রাস্তায় বাহির হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হলেও নিম্মের অনুষ্ঠানগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

৩। ঢাকায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণঃ

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে স্বাগতম জানায়। শত শত নারী পুরুষ এই অনুষ্ঠানে যোগদান করে। এখান থেকে একাধারে দুপুর পর্যান্ত নানা ধরনের গান গাওয়া হয়।

 

৪। মঙ্গল শোভাযাত্রাঃ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের সকালে একটি শোভাযাত্রা বের করে। এই শোভাযাত্রাটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের উৎসবের যুক্ত হয়। ঐ প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। শোভাযাত্রার অনতম আকর্ষণ  শোভাযাত্রায় সাধারণত স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম, বিশালকায় চারুকর্ম পুতুল, কুমীর, লক্ষ্মীপেঁচা, ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ এবং সাজসজ্জ্বা, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নাচে গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দ শোভাযাত্রার সম্মুখে রং বেরংয়ের পোশাক পরিহিত ছাত্র ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের কুমির। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। ২০১৮ সালের শোভাযাত্রার ছিল বিশাল আকৃতির মহিষ। মহিষের উপর বসে আছে কয়েকটি রঙ্গিন পাখি। শান্তির প্রতীক সাদা পায়রা উড়িয়ে দেয়া ভঙ্গিকে একজন নারীর প্রতিকৃতি ছিল শোভাযাত্রায়। বিশালাকায় কাঠামোয় তৈরি করা লাল-সাদা বক, বকের ঠোঁটের সামনে রাখা হয় সমান আকৃতির একটি মাছ। হলুদ-লাল হাতি ও জেলের প্রতিকৃতিও ছিল শোভাযাত্রায়। এছাড়া পোঁচা, টেপা পুতুল, সূর্য, রাজা-রানীসহ নানা আকৃতি ও রংয়ের মুখোশ ছিল শোভাযাত্রায়। এছাড়া ছিল রঙিন মা পাখি ও ছানার প্রতীকী কাঠামো। চারপাশে ফুলের মাঝে বড় একটি মুখের প্রতিকৃতিও ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রায়। বিষয়টি বুঝার জন্য কয়েকটি উদাহরণ দিলাম। এক কথায় ১৯৮৯ সালে আবিস্কৃত শোভাযাত্রায় থাকে বাহারি পোশাকে মুখোশধারী নারী পুরুষের মিছিল। ঢাক-ঢোল, কাঁসা, তবলার তালে তালে চলতে থাকে নারী পুরুষের আবাধ সঙ্গীতও নৃত্যের মাধ্যমে উম্মাদনা। এক কথায় শেভাযাত্রা মানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নারীদেহের সৌন্দর্য প্রদর্শনী, সহপাঠী সহপাঠিনীদের একে অপরের দেহে চিত্র, আলপনা ও উল্কি অংকন। এমনকি যৌন হয়রানির মত ঘটনা ঘটে এই শোভাযাত্রা থেকে।

৫।  হালখাতাঃ

বছরের প্রথম দিন বা নববর্ষে বাংলার ব্যবসায়ীগণ তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। ব্যবসায়ীগণ তাদের খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে “শুভ হালখাতা” নামের কার্ড এর মাধ্যমে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। এই হালখাতার দিন খদ্দেরগণও চেষ্টা করে কিছু বাকি টাকা পরিশোধের। উপলক্ষে  ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিস্টিমুখ করান। টাকা আদায়ের পর পুরান বাকির খাতা বাদ দিয়ে,  বৈশাখের প্রথম দিনে থেকে নতুন করে বাকির খাতা হালনাগাদ করা হয়। হিসাবের খাতা হাল নাগাদ করা থেকে “হালখাতা”-র উদ্ভব। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট বড় মাঝারি যেকোনো দোকানেই এটি পালন করা হয়ে থাকে।

৬। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পুজাঃ

পহেলা বৈশাখের সকালে সনাতন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দু ধর্মের দোকানী ও ব্যবসায়ীরা পুজা দান করেন। হিন্দুদের দাবী  করে থাকে যে লক্ষী হলো, বিত্তের দেবী। তাই তারা পহেলা বৈশাখের নববর্ষে  লক্ষ্মীর পূজা করে থাকেন। তারা এই দিন লক্ষীর নিকট দাবি করে যে, তাদের সারা বছর যেন ব্যবসা ভাল যায়। দেবতার পূজার্চনার পর তার পায়ে ছোঁয়ানো সিন্দুরে স্বস্তিকা চিহ্ন অঙ্কিত ও চন্দন চর্চিত খাতায় নতুন বছরের হিসেব নিকেশ আরম্ভ করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকরা গনেশকে সিদ্ধিদাতা হিসাবে বিশ্বাস করে বিধায় এই দিনে তাদের অনেকে গণেশের পুজাও  করে থাকে।

৭। বৈশাখী মেলাঃ

গ্রাম অঞ্চলের লোকেরা খোলা মাঠে বৈশাখী মেলার আয়োজন করে। মেলাতে থাকে নানা রকম কুঠির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন থাকে। নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন করে থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তির। এমন কোন জেলা নাই যেখানে পহেলা বেশাখ উপলক্ষে মেলার আয়োজন করা হয়না। বাংলাদেশের অসংখ্যা মেলার মাঝে উল্লেখযোগ্য দুটি মেলা হলোঃ

ক। বউমেলা

খ। ঘোড়ামেলা

বউমেলাঃ

ঈশা খাঁর সোনারগাঁয় ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম ‘বউমেলা’। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পয়লা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজো হিসেবে এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা। পাঁঠাবলির রেওয়াজও পুরনো। বদলে যাচ্ছে পুরনো অর্চনার পালা। এখন কপোত-কপোতি উড়িয়ে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা দেবীর কাছ থেকে। বউমেলায় কাঙ্ক্ষিত মানুষের খোঁজে কাঙ্ক্ষিত মানসীর প্রার্থনা কিংবা গান্ধর্ব প্রণয়ও যে ঘটে না সবার অলক্ষে, তা কে বলতে পারবে।

ঘোড়ামেলাঃ

এ ছাড়া সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ঘোড়ামেলা। লোকমুখে প্রচলিত জামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন এবং তিনি মারা যাওয়ার পর ওই স্থানেই তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কারণে এ মেলার আয়োজন করা হয়। তথাপি সব ধর্মের লোকজনেরই প্রাধান্য থাকে এ মেলায়। এ মেলায় শিশু-কিশোরদের ভিড় বেশি থাকে। মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আয়োজন করা হয়।

 

এই হলোঃ বাংলা নববর্ষের একটি নিরপেক্ষ ইতিহাস ও কর্মসুচি। এখন আলোচনা করা হবে এর সাথে ইসলামের বিরোধ কোথায়?

৮। সরাসরি সনাতন ধর্মের আদলে করাঃ

আধুনিক নববর্ষের প্রধান আকর্ষন হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে আয়োজিত বর্ণিল শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রায় বাঘ, হাতি, কুমির পেঁচাসহ বহু জীবজন্তুর মূর্তি বা প্রতিকৃতি প্রদর্ষণ করা হয়।  এই শোভাযাত্রার প্রচলন কারীগণ দাবি করে থাকে, এই জীবজন্তুর মূর্তি মাধ্যমে মানুষের মঙ্গল কামনা করা হয়। এই জন্য তারা এর নাম দিয়েছেন মঙ্গল শোভাযাত্রা। আমাদের প্রতিবেশী হিন্দুভাইদেরও দেখি নিজেদের মঙ্গল কামন করে তারা গাছ, পাথর, সাপ, সিংহ, মহিষ, ময়ুর, গাভী, নদীর পুঁজা করে থাকে।

সনাতন হিন্দু ধর্মমতেঃ দুর্গার বাহন হল সিংহ। কারন সিংহ হলো দুর্গার তেজ,  ক্রোধ ও হিংস্রতার প্রতীক। একথা বলা আছে পদ্মপুরানে। গনেশকে বিশ্বাস করা হয় সিদ্ধিদাতা হিসেবে এবং গনেশের সাথে থাকে ইঁদুর। কার্তিক হলো যুবক, যোদ্ধা ও সৌন্দর্যের প্রতীক। ময়ূর, কার্তিকের এই তিনটি গুণেরই প্রতিনিধিত্ব করে। কেননা, কার্তিক যেমন চিরযুবা, তেমনি মৃত্যু পর্যন্ত ময়ূরের সৌন্দর্য ও তারুণ্যও কখনো নষ্ট হয় না। সাপ হলো গোপন ষড়যন্ত্রের প্রতীক এবং যে কোনো যুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র থাকবেই। ময়ূরের পায়ের নিচে সাপের অর্থ হলো, শুধু যুদ্ধ করলেই হবে না, যুদ্ধের এই গোপন ষড়যন্ত্রকেও দমন করতে হবে, যেমন ময়ূর নিমিষের মধ্যে একটি সাপের দেহকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলতে পারে। সরস্বতীর সাথে থাকা রাজহাঁসের এই ক্ষমতা আছে যে, দুধ ও জল মিশিয়ে দিলেও সে শুধু দুধকেই পান করতে পারে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবী লক্ষ্মীর বাহন হচ্ছে লক্ষ্মীপেঁচা। লক্ষ্মী হলো ধন-সম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী। তাই অনেক হিন্দু গৃহস্থ ঘরে লক্ষ্মীপেঁচা ঢুকলে যেন উড়ে না যায় সে চেষ্টা করেন। তাদের বিশ্বাস, ঘরে লক্ষ্মীপেঁচা থাকলে ধন-সম্পদে পূর্ণ হবে। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে পেঁচার গুরুগম্ভীর ডাককে অশুভর প্রতীক বলে মনে করা হয়। পেঁচা ডাকলে ঘরে ওঠার সিঁড়িতে জল ঢেলে দেওয়া হয়। তাদের বিশ্বাস, এতে সব ধরনের অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ইহা ছাড়া তারা হাতিকে সাক্ষাৎ ভগবান মনে করে হাতির পূজার্চনা করে। হাতি মানুষের ফসল ঘরবাড়ি নষ্ট করবে না, হাতি যাতে রেগে না যায় সেজন্যই হিন্দুরা হাতির পুজা করে। পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের বর্ডার সংলগ্ন এলাকায় শত শত বছর ধরে বাস্তু দেবীর প্রতিক হিসাবে কুমিরের পূজা হয়ে আসছে। এই পূজায় মূল প্রতীকী কুমির হওয়ায় বর্তমানে কুমির পূজা নামে প্রচলিত থাকলেও আসলে এই পূজার মূল নাম বাস্তুপূজা। বিশেষ করে বাঘ, সাপ ও কুমিরের আক্রমণে নিয়মিত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তাই হিন্দুদের দৈব বিশ্বাস আর ধর্মীয় রীতি নির্ভর করে এদের পুঁজা করে থাকে।

মঙ্গল লাভের আশায় সনাতন ধর্মের হিন্দুরা এই দিনে সরাসরি লক্ষী ও গণেশের পুজা করে থাকে। বউমেলায় সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুঁজা করা হয়। ঘোড়ামেলায় এ হিন্দুরা পুজারমত প্রার্থান আয়োজন করে থাকে। এ থেকে প্রমানিত হয় যে, নববর্ষ সরাসরি সনাতন ধর্মের আদলে উদজাপন করা হয়।  

  মন্তব্যঃ নববর্ষে সনাতন ধর্মের লোকেরা সিদ্ধেশ্বরী দেবী, লক্ষীদেবী ও গণেশের পুঁজা করে থাকে।  মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত সিংহ, বাঘ, হাতি, লক্ষীপেঁচা, ময়ুর, কুমীর, সাপ ইত্যাদির প্রতিকৃতি যা সনাতন হিন্দু ধর্মের পুঁজায় ব্যবহৃত বা সরাসরি পুঁজা করে থাকে। এর একে বারে বীপরিত মেরুতে অবস্থান হল ইসলাম ধর্মে। ইসলাম ধর্মে একক ক্ষমতার একমাত্র মালিক হলো আল্লাহ তায়ালা। এই সকল জীবজন্তুর পুঁজাকে শির্ক কাজ বলা হয়। যা মহান আল্লাহ তাওয়া ছাড়া কখনও ক্ষমা করবেন না। মুসলিম হওয়ার জন্য আমরা যে কালিমা পড়ি তার শিক্ষাও এই সকল জীবজন্তুর পুঁজা সম্পর্ন বিরোধী। কালিমাটি হলোঃ

هوَرَسُولُاعَبْدُه مُحَمَّدً اَنَّ اَشْهَدُ وَ لَه، يْكَ شَرِلَا وَحْدَه لّهُ الاِلَّا اِلهَ لّآ انْ اشْهَدُ

আশ্‌হাদু আল-লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্‌দাহু-লা-শারীকালাহু ওয়া আশ্‌হাদু আন্না মুহাম্মাদান আ’বদুহু ওয়া রাসূলুহু।

অর্থঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন উপাস্য নাই। তিনি এক, অদ্বিতীয় এবং আরও সাক্ষ্য দিতেছি যে, মুহাম্মাদ তাঁহার বান্দা ও প্রেরিত রাসুল।

এই মহান কালিমা মুল দাবি ইবাদতে আল্লাহ্‌ ছাড়া কাউকে শরীক করা যাবে না। কিন্তু এই শোভা যাত্রা দ্বারা শিখান হয় জীবজন্তুর পুঁজার মাধ্যমে মঙ্গল কামনা। কাজেই এই ধরনের বড় বড় র‍্যালি বের করা যাকে মঙ্গল শুভ যাত্রা বলা হয়, এটা নিরেট হিন্দুদের ধর্মীয় কাজ। যা কোন মুসলমান কখনো করতে পারেনা৷ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেনঃ আল্লাহর কাছে সবচাইতে ঘৃণিত ব্যাক্তি হচ্ছে তিন জন। যে ব্যাক্তি হারাম শরীফে অন্যায় ও অপকর্মে লিপ্ত হয়। যে ব্যাক্তি ইসলামী যুগে জাহিলী যুগের প্রথা তালাশ করে। যে ব্যাক্তি যথার্থ কারণ ব্যতীত কারো রক্তপাত দাবি করে। (সহিহ বুখারী ৬৪১৬ ইফাঃ)

নববর্ষের নামে এই ধরনের শির্কি কাজে অংশ গহন করা যাবে না। ইসলামি শরীয়ত মতে কেউ এই ধরনের শির্কি কাজে অংশ গ্রহন করলে বা আয়জনে সাহায্য করলে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে।

৯। ইসলাম বিরোধী আকিদাঃ

নববর্ষ উপলক্ষে প্রচার কর হয় যে, নতুন বছরের সাথে মানুষের কল্যাণের সম্পর্ক, নতুন বছর নতুন কল্যাণ বয়ে আনে, দূরীভূত হয় পুরোনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানি। এই ধরনের কোন তত্ত্ব কথায় সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই। এই কথা বিশ্বাস করলে ইসলাম বিরোধী আকিদা হিসাবে চিহৃত হবে। নতুন বছরের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ধারণা আদিযুগের প্রকৃতি পুজারী মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার অবশিষ্টাংশ। ইসলামে এ ধরনের কুসংস্কারের কোন স্থান নেই। বরং মুসলিমের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই পরম মূল্যবান হীরকখন্ড, হয় সে এই মুহূর্তকে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করে আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করবে, নতুবা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে শাস্তির যোগ্য হয়ে উঠবে।  

ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস আমাদের সকল প্রকার শুভ অশুভের মালিক এক মাত্র মহান আল্লাহ। কিন্তু নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের শিক্ষা দেন আল্লাহ ছাড়াও শুভ অশুভ বা কল্যান অকল্যানের বহু মালিক আছে। এই প্রতি বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরুতে একটি করে কুফরী আকিদা প্রচার করে। যেনমঃ প্রচার করে থাকে এ বছর মা দূর্গা গজে বা হাতিতে চড়ে এসছেন তাই এ বছর ফসল ভাল হবে। তাছাড়া    নববর্ষকে আহবান করা হয় এই বলে যে, “এসো হে বৈশাখ”। এই ধরনের কোন আপেক্ষিত বন্তুকে আহবান করা নিষেধ ৷ কারন এর দ্বারা মাখলুকের নিকট কল্যাণ কামনা করা হয়৷ অথচ কল্যানের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা’লা।

مَّا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللّهِ وَمَا أَصَابَكَ مِن سَيِّئَةٍ فَمِن نَّفْسِكَ

আপনার যে কল্যাণ হয়, তা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে আর আপনার যে অকল্যাণ হয়, সেটা হয় আপনার নিজের কারণে। (সুরা নিসা ৪:৭৯)

১০। গান বাজনা মাধ্যমে নববর্ষ উদযাপন করাঃ

নববর্ষে ঢাক ঢোল পিটিয়ে, নেচে-গেয়ে শোভাযাত্রায় অংশ গ্রহন করা হয়। প্রথম কর্মসুচি হলো, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে স্বাগতম জানায়। শত শত নারী পুরুষ এই অনুষ্ঠানে যোগদান করে। এখান থেকে একাধারে দুপুর পর্যান্ত নানা ধরনের গান গাওয়া হয়। অথচ ইসলামি শরীয়তে এই ধরনের গান বাজনা হারাম করা হয়েছে। গানবাজনা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ষ্পষ্ট ঘোষনা এসেছে। সূরা আন-নাজম এর ৫৯-৬১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেনঃ

أَفَمِنۡ هَـٰذَا ٱلۡحَدِيثِ تَعۡجَبُونَ (٥٩) وَتَضۡحَكُونَ وَلَا تَبۡكُونَ (٦٠) وَأَنتُمۡ سَـٰمِدُونَ (٦١)

অর্থঃ তাহলে কি এসব কথা শুনেই তোমরা বিস্ময় প্রকাশ করছো? হাসছো কিন্তু কাঁদছো না? অথচ তোমরা সঙ্গীত বা গান-বাজনা করছো?” (সূরা আন-নাজম ৫৩:৫৯-৬১)।

গান-বাজনা হারাম হওয়া সম্পর্কিত কুরআনের আয়াত হচ্ছেঃ

*وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ*

অর্থঃ আর মানুষদেরই মধ্যে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষ কে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা (গান) খরিদ করে।  এবং তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসাবে গ্রহন করে। এ ধরনের লোকদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব৷ (সুরা লুকমান ৩১:৬)।

আবূ মালেক আশআরী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে শুনেছেন, ‘‘অবশ্যই আমার উম্মতের মধ্যে এমন এক সম্প্রদায় হবে; যারা ব্যভিচার, (পুরুষের জন্য) রেশমবস্ত্র, মদ এবং বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার (হারাম হওয়া সত্ত্বেও) হালাল মনে করবে।’’ (বুখারী ৫৫৯০, হাদিস সম্ভার ২৩০৭)।

উম্মে হাবীবাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘ফিরিশতা সেই কাফেলার সঙ্গী হন না। যে কাফেলায় ঘন্টার শব্দ থাকে।’’ (হাদিস সম্ভার ২৩১২,আহমাদ ২৬৭৭১, সহীহুল জামে’ ৭৩৪২)।

আবূ হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘ঘন্টা বা ঘুঙুর হল শয়তানের বাঁশি।’’  (মুসলিম ২১১৪, আবূ দাঊদ ২৫৫৬, আহমাদ ২/৩৬৬, ৩৭২, বাইহাকী ৫/২৫৩, হাদিস সম্ভার ২৩১৩)।

আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘অবশ্যই আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য মদ, জুয়া, ঢোল-তবলা এবং বীণা জাতীয় বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করেছেন।’’ (আহমাদ ৬৫৪৭, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৭০৮, হাদিস সম্ভার ২৩১০)

মন্তব্যঃ বাদ্যযন্ত্রসহ গান ইসলামে হারাম করা হয়েছে। ইসলামে বাদ্যযন্ত্র মাধ্যমে গান হারাম হওয়ার ব্যাপারে কিছু ভ্রান্ত সুফি ছাড়া করলে এক মত। কুনআন সহিহ  হাদিসের দলীলও ষ্পষ্ট। কাজেই এই দিনের প্রধান কাজ শুরু হয় হারাম দ্বারা।

১১। বিজাতির অনুসরণঃ

একটি সহহি হদিসে বর্ণিত হয়েছে,  প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মাক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আগমন করে দেখলেন, মদীনাবাসী খেলাধূলার মধ্য দিয়ে দুটি দিবস উদযাপন করে থাকে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন ও দুটি দিবস কি? তারা বলল, এ দুটি দিবস জাহেলী যুগে আমরা খেলাধূলার মধ্য দিয়ে উদযাপন করতাম তিনি বললেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য এর থেকে উত্তম দুটি দিবসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, একটি হল, ঈদুল আযহা এবং অপরটি হল, ঈদুল ফিতর।” (সুনান আবূদাঊদ, হাদীস নং ৯৫৯ সনদ সহিহ নাসির উদ্দিন আলবানী রহঃ)।

এই হাদিসের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ হাদিস বিশারত লিখেছেন, মদীনাবাসী যে দুটি দিবস উদযাপন করত তা ছিল তাদের নববর্ষ। হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, নববর্ষের বিকল্প হিসাবে আল্লাহ আমাদের দুটি উত্তম দিবসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অথচ আমরা আল্লাহ প্রদত্ত দিবস বাদ দিয়ে মনগড়া দিবস পালন করছি। ইদানিং পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে দুই ঈদের বিকল্প হিসাবে দাঁড় করানো হয়। যেমন গত কয়েক বৎসর পূর্বে প্রথম আলোর হেড লাইন ছিল, “বাংগালীদের সব চেয়ে বড় উৎসব” ব্যবধান হল। শুধু মাত্র ঈদ শব্দেটি বাদ দিছে। ঈদ শব্দ লিখলে মুসলিমদের মাঝে প্রতিক্রিয়া হবে তাই লিখছে না। কিন্তু মিডিয়ার প্রচারের ফলে, ঈদের মত দিনটি উৎসবে পরিনত করছে। ঈদের মত ভাল খাবার নতুন পোশাকের ব্যবস্থা করছে। সরকার বাহাদুরও ঈদের মত সরাকারী চাকুরি জীবিদের ঈদ বোনাসের মত বৈশাখী ভাতা প্রদান শুরু করছে। সরাকারী বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দিনটি উদযাপনের জন্য ছুটি ঘোষনা করে থাকে। তারা বিভিন্ন সামাজিক সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এই নববর্ষের অধিকাংশ অনুষ্ঠান করা হয় অমুসলিমদের অনুকরণে। আগের আলোচায় দেখেছি হিন্দুরা এই দিনে পুজাঁ করে। তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে কিন্তু আমরা কি করছি। আমরা কি হিন্দুদের দেবতাকে খুশি করতেছি? নাকি মানুষ জাতীর শত্রু ইবলিস শয়তানকে খুসি করছি।

বিজাতিদের যে জাহেলী উৎসব প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করতে নিষেধ করছেন। আমরা যেন সেই  উৎসবকেই আকড়ে ধরছি। অথচ বিজাতিদের অনুসরণ করা সহিহ হাদিসের আলোকে নিষেধ।

ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমি (কিয়ামতের পূর্বে) তরবারিসহ প্রেরিত হয়েছি, যাতে শরীকবিহীনভাবে আল্লাহর ইবাদত হয়। আমার জীবিকা রাখা হয়েছে আমার বর্শার ছায়াতলে। অপমান ও লাঞ্ছনা রাখা হয়েছে আমার আদেশের বিরোধীদের জন্য। আর যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদেরই দলভুক্ত।” (হাদিস সম্ভার ১৯০০, আহমাদ)

রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,  “যে ব্যক্তি অন্য কোন জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করল সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।” (সুনানে আবূ দাউদ ৪০৩১ ইফাঃ, সনদ সহিহ আলবানী, ৫১১৪, শুআবুল মান ৯৮)

১২। নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশাঃ

শয়তানের হাতিয়ার হল নগ্নতা, অশ্লীলতা, ব্যভিচারপূর্ণ অনুষ্ঠান। এই কাজটি সে আনজান দিয়ে থাকে নারী, পুরুষের অবাধ মেলামেশার মাধ্যমে। নববর্ষ মানে আনন্দ। এই আনন্দ হলো, সর্বস্থরের নারী পুরুষ একত্র হয়ে নগ্নতা, অশ্লিলত, বেহায়া পনার মাধ্যমে নিজকে প্রদর্শণ করান। নারী, পুরুষের অবাধ মেলামেশা আমাদের সমাজে এমনভাবে ছড়িয়ে আছে, মনে করা হয় এই বেপর্দা, বেহায়াপনা,  অশ্লীলতা, আমাদের দেশীয় আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির অংশ। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির অনেক ভাল দিক আছে। সামাজিক শিষ্টাচার, সৌহার্দ্য, জনকল্যাণ, মানবপ্রেম ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখের বিষয হলো, এসব বাদ দিয়ে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির নামে যুবক যুবতীদেরকে অবাধ মেলামেশা ও বেহায়াপনার সুযোগ করে দিয়ে অশ্লীলতার প্রসার ঘটাচ্ছি। আমরা এক বারের জন্যও চিন্তা করি না যে এই নববর্ষ উপলক্ষ্যে এক বারের জন্যও যদি আমাদের কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীরা অশ্লীলতায় মাঝে নিপতিত হয়, তবে তাদের আর বের করা সম্ভব হবে না। তারা ক্রমান্বয়ে আরো বেশি পাপ ও অপরাধের মধ্যে নিপতিত হতে থাকবে।

আমাদের ধারনা ব্যভিচার করা হয় শুধু বিশেষ অংগের দ্বারা। বাস্তবতা হলো, ব্যভিচার হতে পারে বিভিন্ন অঙ্গের দ্বারা। নববর্ষে নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে অনেক সময় অপ্রীতিকর ঘটনা সংঘটিত হয়। প্রায় প্রতি বছরই এই রকম অপ্রীতিকর ঘটনার কথা জাতীয় দৈনকে প্রকাশিত হয়। যার প্রধান কারন হল, নারীরা নববর্ষে তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শনের জন্য নিজেদের বিভিন্ন উপায় সাজায়। তাদের সাজানোর অন্যতম কারন পুষুরদের আকৃষ্ট করা। আর আস্তভোলা পুরুষ একটু আধটু বিয়াদবীতো করবেই। যদি নারী তার সৌন্দর্য ঢেকে রাখত তবে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটত না।

নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা সম্পর্কে কুরআন সুন্নাহ কি বলে?

আমাদের ইসলামি শরীয়তে এ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট বিধান রয়েছে। পাপাচারের প্রথার উৎস হলো, নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা। এই জন্য বিষয়টি খুবই ইসালাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَلاَ تَقْرَبُواْ الزِّنَى إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاء سَبِيلاً

অর্থঃ আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সুরা বনী ইসরাঈল ১৭:৩২)

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

*وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ*

অর্থঃ নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতার কাছেও যেও না, চাই তা প্রত্যক্ষ হোক আর পরোক্ষ হোক। (সূরা আনআম ১৫১)

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارٗا وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُ عَلَيۡهَا مَلَٰٓئِكَةٌ غِلَاظٞ شِدَادٞ لَّا يَعۡصُونَ ٱللَّهَ مَآ أَمَرَهُمۡ وَيَفۡعَلُونَ مَا يُؤۡمَرُونَ ٦ ﴾ 

অর্থঃ তোমরা নিজেরা জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা কর এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর। যার ইন্দন হবে মানুষ ও পাথর; যার উপর নিয়োজিত রয়েছেন কঠোর হৃদয় সম্পন্ন ফিরিশতাগণ, তারা আল্লাহ যা নির্দেশ করেন তা বাস্তবায়নে অবাধ্য হোন না, আর তাদের যা নির্দেশ প্রদান করা হয়, তা-ই তামিল করে’’। (সূরা তাহরীম: ৬৬:৬)

إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَن تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

অর্থঃ যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে ব্যভিচার প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্যে ইহাকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না। (সুরা নুর ২৪:১৯)

মন্তব্যঃ নববর্ষ উপলক্ষ্যে আমরা আমাদের কলিজার টুকরা ছেলে মেয়েদেরকে বেপর্দা ও বেহায়পনার সুযোগ দিয়ে থাকি। আমরা দিন পালন করার চেষ্টা করছি নিয়মিত সালাত আদায় করছি। অপর পক্ষে আমাদের স্ত্রী-সন্তানদের বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার সুযোগ দিচ্ছি। নিজে বুঝার চেষ্টা করি এবং তাদের  বুঝাই ও নিয়ন্ত্রণ করি। কারন ছেলেমেয়ের পাপের জন্য আপনার আমলনামায় গোনাহ জমা হচ্ছে। যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-সন্তানদের বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার সুযোগ দেয় তাকে ‘‘দাইউস’’ বলা হয় এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বারংবার বলেছেন যে, “তিন ব্যক্তি আল্লাহ তাদের জন্য জান্নাত হারাম করেছেন, মাদকাসক্ত, পিতা-মাতার অবাধ্য এবং দাইউস, যে তার পরিবারের মধ্যে ব্যভিচারকে প্রশ্রয় দেয়”। (মুসনাদে আহমাদ: ২/৬৯)  

অপর হাদিসে  রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, রাষ্ট্রনেতা তার প্রজাদের সম্পর্কে দায়িত্বশীল আর তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পুরুষ লোক তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন মহিলা তার স্বামীর ঘরের সার্বিক ব্যাপারে দায়িত্বশীলা, তাকে সেটার পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পরিচারক তার মালিকের সম্পদের সংরক্ষক, আর তাকে সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” (বুখারী : ৮৯৩; মুসলিম: ১৮২৯)

মন্তব্যঃ নববর্ষ যে আমাদের জাহান্নামে দিকে আহবান করছে এতে কোন প্রকার সন্দেহের কারণ নাই। এখনই এ সম্পর্কে সতর্ক হয়। নিজে বাচার চেষ্টা করি পরিবার, সমাজের সকলে বাচাতে চেষ্টা করি। দ্বীন বুঝে আমল করি।

১৩। সময় ও অর্থ অপচয়কারীঃ

নববর্ষ উপলক্ষে যে কোন সময় ও অর্থ অপচয় করা সঠিক কাজ হবে না।  এই দিবস উদযাপনের জন্য প্রধানত চারটি স্থান সময় ও অর্থ অপচয় করে থাকে।

ক। খাবারের পেছনে

খ। পোশাকের পেছনে

গ। বিভিন্ন অনিষ্ঠান আয়োজনের পেছনে

ঘ। শোভাযাত্রার আয়োজনের পেছনে

বর্তমানে নববর্ষে মুসলিমগন খাবারের পেছনে তেমন খরচ করেত দেখা না গেলেও হিন্দু ভাইয়েরা এই উৎসবে খাবারের পেছনে বেশ খরচ করে থাকে। কিন্তু নববর্ষে পোশাকের ক্ষেত্রে এখন হিন্দুদের মুসলিমরা পেছনে ফেলে দিয়েছেন। নববর্ষের গানের অনুষ্ঠানে ও শোভাযাত্রায় যারা অংশ গ্রহন করে তাদের পোশাক দেখলেই বিষয়টি বুঝে যাবেন। নববর্ষ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। ছায়ানট রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, সংঘ, সমিতি ইত্যাদি নানান অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে দেশের সব জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে বৈশাখী র‌্যালি আয়োজন করা হয়। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাসহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্ব-স্ব ব্যবস্থাপনায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনসমূহ এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। একটু চিন্তা করে সহজে অনুমান করতে পারবেন যে নববর্ষ উপলক্ষে যে কোন সময় ও অর্থ অপচয় করা। শোভাযাত্রার আয়োজনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট মাসের পর মাস করা করে। তারা প্রচুর সময় ও অর্থ অপচয় করে থাকে।

মন্তব্যঃ ইসলামি শরীয়তে উৎসব অয়োজন করার সুনির্দিষ্ট বীধি বিধান আছে। অনুষ্ঠান অয়োজনের ক্ষেত্রে সেই বীধি বিধানের বাহিরে যাওয়ার সুযোগ নাই। নববর্ষে ইসলাম বিরোধী কাজ থাকার কারনে এই অনুষ্ঠানে যাওয়া ও তাদের সাথে উৎসব অংশ গ্রহন করা ইসলাম বিরোধী কাজ হবে। কাজেই কোন প্রকার সন্দেহ ছাড়াই বলা যায় নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদযাপনে যা যা করা হয় তার পুরোটাই  ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। মুসলিম হিসেবে যা অবশ্যই বর্জন করতে হবে।

 

১৪। মুখোস এবং উল্কি আঁকা একটি ইসলামি বিরোধী সংস্কৃতিঃ

নববর্ষ উপলক্ষে হাজার হাজার যুবগ যুবতী তাদের গালে, কপালে, হাতে উল্কি আঁকাছে। তারা এ সব খুবই মজা করে আকঁছে। কিন্তু এই কাজ যে ইসলামি বিরোধী তারা হয়তো তা জানে না। মানুষের শরীরে উল্কি আঁকা হাদিসে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। নিম্মে এ সম্পর্কে কয়েকটি সহিহ হাদিস বর্ণনা করা হলঃ

১। আবূ জুহায়ফা (রাঃ) এর পিতা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন উল্কি অংকনকারিনা উল্কি গ্রহণকারিনা, সুদ গ্রহিতা ও সুদ দাতাকে। তিনি কুকুরের মূল্য ও বেশ্যার উপার্জন ভোগ করতে নিষেধ করেছেন। চিত্রকরদেরকেও তিনি অভিসম্পাত করেছেন। (সহিহ বুখারী ৪৯৫৬ ইফাঃ)

২। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বদ নযর লাগা সত্য। আর তিনি উল্কি আঁকতে (খোদাই করতে) নিষেধ করেছেন। (সহিহ বুখারী ৫৩২৯ ইফাঃ)

৩। ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ ঐ নারীর উপর অভিশাপ বর্ষণ করেন, যে পরচুলা লাগায়, আর অপরকে পরচুলা লাগিয়ে দেয়। আর যে নারী উল্কি উৎকীর্ণ করে এবং যে তা করায়। নাফি’ বলেনঃ উল্কি উৎকীর্ণ করা হয় (সাধারণত) উঁচু গোশতের উপরে। (সহিহ বুখারী ৫৫১২ ইফাঃ)

৪। আবদুল্লাহ ইবনু মাউসদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সৌন্দর্যের জন্য উল্কি উৎকীর্ণকারী ও উল্কি গ্রহণকারী, ভ্রু উত্তোলনকারী নারী এবং দাঁত চিকন করে মাঝে ফাঁক সৃষ্টিকারী নারী, যা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন সাধন করে, তাদের উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক। (রাবী বলেন) আমি কেন তাকে লানত করবো না, যাকে আল্লাহর রাসুল লানত করেছেন এবং তা আল্লাহর কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে। (সহিহ বুখারী ৫৫১৮ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ সহিহ হাদিসে আলোকে দেখা যায় উল্কি যারা তার শরীরে আঁকায় তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ। উল্কি আঁকার সময় শরীরে বিভিন্ন প্রকারের ক্যামিক্যালের ক্রিম ব্যবহার করে থাকে যা ত্বকের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর৷ উল্কি আকার সময় নারীকে পর পুরুষের সমনে বেপর্দা হতে হয়। উল্কি আকাঁর ফলে মহান আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন। মুখোশ ব্যবহার করে মানুষ একটি বিকৃত রুচির পরিচয়। মোখোশ তৈরি করাই হয় মানুষকে ধোকা প্রদানের জন্য। ইসলামে এই রকম কিছু করার বিধান নাই।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment