সফরের বিধি বিধান

সফরের বিধি বিধান

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

সফর বলতে আমরা বুঝি নিজের পরিবার ও জন্মভূমী ত্যাগ করে অন্য কোন অঞ্চলে গমন করা। সফর বিভিন্ন উদ্দেশ্যে হতে পারে। সাধারণত সফর দুনিয়াবী কারনে হয় থাকে তবে বহু মুসলিম দ্বীনের কারনেও সফর করে থাকে। কোন মুসলিমের সফর যখন দ্বীনের উদ্দেশ্যে হবে তখন তার সফর ইবাদাত হিসাবে গন্য হবে। হজ্জ মুলটি একটি বিশাল সফরের নাম। বিশ্বের প্রতিটি দেশ থেকে আল্লাহ পাগল সামর্থবান মুনিন হজ্জের জন্য সফর করে। যদিও সফর একটি কঠিন ও কষ্ট সাধ্য কাজ। ইসলামি শরীয়তে সফর একটি গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়। কেননা মুমিন মুসলিককে প্রতিটি মুহুর্তেই মহান আল্লাহকে স্মরন রেখে তার হুকুম মনে চলতে হয়। তাকে সার্বক্ষনই  কোন না কোন ইবাদের মাধ্যমে মহান আল্লাহকে খুসি করতে হয়। সফর একটি কঠিন ও কষ্ট সাধ্য কাজ বিধায় মহান আল্লাহ মানুষের প্রতি দয়া দেখিয়ে তার হুকুম আদায়ে জন্য একটু সিথিলতা প্রদান করছেন। তার প্রদানকৃত সিথিলতা গ্রহন করাও ফরজ করে দিয়েছেন। কাজেই প্রতিটি মুসলিমের জন্য সফর সংক্রান্ত বিধী বিধান জানা ফরজ। হজ্জ যেহেতু একটি বড়, কঠিন, কষ্ট সাধ্য কাজ তাই এই সময় মহান আল্লাহ বিধান মেনে আমল করা ফরজ। কিন্তু অনেক মুসলিম অজ্ঞতার কারনে সফরের বিধান সঠিক পালন করতে পারে না।

অনেক কারনে মানুষ সফর করে। প্রতি সফরের বিধান একই। হজ্জের সফর আর ব্যক্তিগত কারনে সফরের বিধানে কোন পার্থক্য নাই। যদিও সফর করা আগের দিনের তুলনায় অনেক কষ্ট এবং সময় কম লাগে।  আধুনিক এই যান্ত্রিক যুগে সফর বা ভ্রমণ মানুষের নিত্ত নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। আগে এক দেশ থেকে অন্য দেশে সফর করা কল্পনাতীত ছিল কিন্তু এখন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত এক নিমিসেই পাড়ি দিচ্ছে। মানুষ যেমন আল্লাহ হুকুমে হজ্জের জন্য সফর করে ঠিক তেমনি নিজের  প্রয়োজনে সফর করে থাকে। আবার কেউ আল্লাহর নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার জন্য প্রতিনিয়তই ভ্রমণ করে থাকে। বিভিন্ন স্থান দর্শনে অনেক জ্ঞানার্জন করা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর বিভিন্ন সৃষ্টিজীব, প্রকৃতি, নদী-নালা দেখার মাধ্যমে মুমিন বান্দাগণ আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার সূযোগ পায়। বিশেষ করে আল্লাহর দয়া, ক্ষমতা সর্ম্পকে জানতে পারে। এতে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। মহান আল্লাহ বলেনঃ

أَوَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ كَانُوا أَشَدَّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَأَثَارُوا الْأَرْضَ وَعَمَرُوهَا أَكْثَرَ مِمَّا عَمَرُوهَا وَجَاءتْهُمْ رُسُلُهُم بِالْبَيِّنَاتِ فَمَا كَانَ اللَّهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَكِن كَانُوا أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ

অর্থঃ তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? অতঃপর দেখে না যে, তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি কি হয়েছে? তারা তাদের চাইতে শক্তিশালী ছিল, তারা যমীন চাষ করত এবং তাদের চাইতে বেশী আবাদ করত। তাদের কাছে তাদের রসূলগণ সুস্পষ্ট নির্দেশ নিয়ে এসেছিল। বস্তুতঃ আল্লাহ তাদের প্রতি জুলুমকারী ছিলেন না। কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। [ সুরা রূম ৩০:৯ ]

মহান আল্লাহ আরও বলেনঃ

قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِكُمْ سُنَنٌ فَسِيرُواْ فِي الأَرْضِ فَانْظُرُواْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذَّبِينَ

অর্থঃ তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীবনাচরণ। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে। (সুরা ইমরান ৩:১৩৭)

মহান আল্লাহ এমনিভাবে বিভিন্ন জাতির ধ্বংসাবশেষ ও মিথ্যাবাদীদের অবস্থা দেখার জন্য আন‘আম (১১), ইউসুফ (১০৯), নাহল (৩৬), হাজ্জ (৪৬), নামল (৬৯), আনকাবূত (২০), ফাতির (৪৪), গাফির (২১) এবং মুহাম্মাদ (১০) -এ নির্দেষ দিয়েছেন।

২.১। সফর বা ভ্রমণের প্রকারভেদঃ

সফর বা ভ্রমণকে কুরআন-হাদীছের আলোকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়।

* হারাম বা নিষিদ্ধ সফর

* মাকরূহ বা অপসন্দনীয় সফর

* মুবাহ বা জায়েয সফর

* মুস্তাহাব বা পসন্দনীয় সফর

* ওয়াজিব বা আবশ্যকীয় সফর

১। হারাম বা নিষিদ্ধ সফরঃ  

ইসলাম বিরোধিতা বা নিষিদ্ধ কাজ সম্পন্ন করার জন্য সফর করা হারাম। কাজেই, হারাম কাজের উদ্দেশ্যে সফর করা হয় তাহলে সে সফরের হুকুমও হারাম হবে। যেমন, সমাজে ইসলাম বিরোধী উরসের জন্য সফর করা, মাজারের মানত পুরা কারার জন্য সফর করা। গান বাজনা, মেলা, আড়ং, পহেলা বৈশাখ, হিন্দুদের পুজা, ঝগড়া-বিবাদ, যে কোন পাপ কাজ ইত্যাদির জন্য সফর করা হারাম।

এমনকি যেখানে মহামারী আরম্ভ হয়েছে এমন স্থান থেকে সফর করাও নিষেধ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি তোমরা শুনতে পাও (কোন স্থানে মহামারী আক্রান্ত হয়েছে) তাহ’লে সেখানে যেয়ো না। আর তোমরা যেখানে আছ সেখানে আক্রান্ত হ’লে সেখান থেকে বের হয়ো না’। (বুখারী ৫৭২৮-৩০, মুসলিম ২১৮-১৯;  মিশকাত ১৫৪৮)।

এছাড়া কোন মহিলার মাহরাম ছাড়া সফর করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মহিলারা মাহরাম (যার সঙ্গে বিবাহ নিষিদ্ধ) ব্যতীত অন্য কারো সাথে সফর করবে না। মাহরাম কাছে নেই এমতাবস্থায় কোন মহিলার নিকট কোন পুরুষ গমন করতে পারবে না’। (বুখারী ১৮৬২; মুসলিম ১৩৪১)।

মাকরূহ বা অপসন্দনীয় সফরঃ

এটা হ’ল ইসলামী পদ্ধতি ছাড়া অন্য পদ্ধতিতে সফর করা। যেমনঃ একাকী রাতে সফর করা, তিন জনের অধিক হ’লে কাউকে আমীর নিযুক্ত না করে সফর করা।

ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি লোকেরা একা সফরে কি ক্ষতি আছে তা জানত, যা আমি জানি, তবে কোন আরোহী রাতে একাকী সফর করত না’। ( সহিহ বুখারী ২৯৯৮)।

.৩। মুবাহ বা বৈধ সফরঃ

 দুনিয়ার হালাল কোন কাজের প্রয়োজনে বা শখের বসে বিভিন্ন স্থানে সফর বা ভ্রমণ করা। কাজেই, কোন জায়েয কাজের উদ্দেশ্যে সফর করা হয় তবে উক্ত সফরও জায়েয বলে গণ্য হবে। যেমন, যারা ব্যবসা করে জীবন যাপন করে তারা ব্যবসার প্রয়োজনে সফর করে। চাকুরী জীবি চাকুরির জন্য সফর করে। কেউ শিক্ষা গ্রহনের জন্য সফর করে। কেউ শুধুই বিনোদনের জন্য সফর করে। আবার কেউ দর্শনীয় স্থান দেখার জন্য সফর করে। এই ধরনের সফর বৈধ সফর।

৪। মুস্তাহাব বা পসন্দনীয় সফরঃ

আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করা জন্য সফর করা। অসুস্থ মানুষের সাথে সাক্ষাতের জন্য সফর করা। ফরজ ইলমের অতিরিক্ত দ্বীন শিক্ষার জন্য সফর করা। কোন মানুষকে সাহায্য করা জন্য সফর করা। উপদেশ গ্রহণের জন্য, পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ধ্বংসাবশেষ ও তাদের স্মৃতিসমূহ দেখার জন্য সফর করা মুস্তাহাব। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ

أَوَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَكَانُوا أَشَدَّ مِنْهُمْ قُوَّةً

অর্থঃ তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? করলে দেখত তাদের পূর্ববর্তীদের কি পরিণাম হয়েছে। অথচ তারা তাদের অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী ছিল। (সুরা ফাতির ৩৫:৪৪)।

ইহা ছাড়া মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদে আক্বছার উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করা মুস্তাহার কারন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মসজিদুল হারাম, মসজিদুর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং মসজিদুল আক্বছা (বাইতুল মাক্বদিস) তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা যাবে না। (সহিহ বুখারী ১১৮৯; সহিহ মুসলিম ‘হজ্জ অধ্যায়’) ।

৫। ওয়াজিব বা অবশ্যিক সফরঃ

সফর যদি কোন ইবাদাতের উদ্দেশ্যে শুরু করা হয় তবে উক্ত সফরও ইবাদাত বলে গণ্য হবে। আর এই সফর যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কোন আদেশকে বাস্তবায়নের জন্য সফর করা। যেমন, হজ্জের জন্য মক্কা সফর করা এবং মুসলিম রাষ্ট্রনায়ক যুদ্ধের আদেশ দিলে যুদ্ধের জন্য সফর করা ইত্যাদি। যেমনঃ মহান আল্লাহ বলেন,

وَأَذِّن فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ

অর্থঃ এবং মানুষের মধ্যে হজ্বের জন্যে ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে।(সুরা হজ্জ ২২:২৭)।

ফরয ইলম অর্জন করার জন্য যে কোন স্থানে ভ্রমণ করা। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কোন ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য কোন পথ অবলম্বন করলে, আল্লাহ এই অসীলায় তার জন্য জান্নাতের একটি পথ সুগম করে দেন’। (ইবনু মাজাহ-২২৩, তিরমিযী-২৬৪৬, মিশকাত-২১২, ছহীহুল জামি ৬২৯৮, ৬৫৭৭)।

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৫১ হিঃ) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সফরসমূহ চার ধরনের ছিল। হিজরতের জন্য সফর, জিহাদের জন্য সফর, আর এটাই বেশী ছিল, ওমরাহ-এর জন্য এবং

 হজ্জের জন্য সফর।

 ইসলামে অন্যান্য বিধানের ন্যায় সফরের সময় পালনীয় সুন্দর নিয়ম-কানূন রয়েছে। আজ মুসলিম সমাজের অধিকাংশ ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ, তারা সফরের নির্দেষ ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানেনা বললেই চলে। মুসলমানের সকল কাজ ইবাদত এবং ভ্রমণও তার বাইরে নয়। প্রত্যেক মুসলিমকে যেহেতু মহান আল্লাহ এক মাত্র তার ইবাদতের জন্য সৃষ্ট করেছেন, (৫১:৫৬)। কাজেই তার প্রতিটি পদক্ষেপেই মহান আল্লাহ হুকুম জেনে নিতে হবে। যদি কোন মুসলিম প্রতি মুহুর্তে মহান আল্লাহ হুকুম ও তার হাবিব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশিত পথে অতিবাহিত করে তবে তার প্রতি মুহুর্তেই ইবাদত হিসাবে পরিগনিত হবে। তাই ইসলাম ভ্রমণের জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখা ও নিয়ম-কানূন নির্ধারণ করে দিয়েছে। রাসূল (ছাঃ) মাদানী জীবনের ১০ বছরের মধ্যে ৭৮১ দিনের অধিক অর্থাৎ দু’বছরের বেশী সময় যুদ্ধের ময়দানে (সফরে) অতিবাহিত করেছেন। এই অবস্থায় ইসলামের বহু বিধি-বিধান জারী হয়েছে। [মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)]।

সফরের সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় কাজঃ

যদি কেউ ইবাদাতের উদ্দেশ্যে সফর করে তবে তাকে সালত, সিয়ামের বিধানের পাশাপাশি নিম্নের বিষয়সমূহের প্রতি গুরুত্বারোপ করা আবশ্যকঃ

* ইবদতের জন্য সফর হলে নিয়্যাতকে বিশুদ্ধ করতে হবেঃ

* সফরে ফরজ হুকুবে অবহেলা না করা

* সৎ কাজের আদেশ প্রদান অসৎ কাজের নিষেধ করা

* সফরে অন্য সাথীদের কষ্টের কারন না হওয়া

* সাথীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে

* গীবত ও অযথা কথা থেকে জবান হিফাজত করা

* একাকী সফর না করা

* সফর সংশ্লিষ্ট দোয়াগুলো যথাসময় পাঠ করা

১। ইবদতের জন্য সফর হলে নিয়্যাতকে বিশুদ্ধ করতে হবেঃ

আমারা জানি যে কোন কাজের ফলাফল আল্লাহ তার নিয়তের উপরই দিয়ে থাকেন। কাজেই আমদের সফর সর্বাবস্থায় আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের এবং সৎ উদ্দেশ্যে হতে হবে। মহান আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্য সফর করলে, আমাদের যাবতীয় শ্রম ও টাকা পয়সা খরচ শুধু আমাদের নেকী বৃদ্ধি করা হবে না, আমাদের  গুনাহসমূহও ক্ষমা করা হবে এবং মর্যাদা সুউচ্চ হবে।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যাক্তি নেক কাজের ইচ্ছা করে অথচ সস্পাদন করে নি, তার জন্য একটি সাওয়াব লেখা হয়। আর যে ইচ্ছা করার পর কার্যত সস্পাদন করে, তবে তার ক্ষেত্রে দশ থেকে সাতশ, গুন পর্যন্ত সাওয়াব লেখা হয়। পক্ষান্তরে যে কোন মন্দ কাজের ইচ্ছা করে আর তা না করে তবে কোন গুনাহ লেখা হয় না। আর তা করলে (একটি) গুনাহ লেখা হয়। (সহিহ মুসলিম ২৩৭)

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ আমার বান্দা যখন কোন সৎকর্মের সংকল্প গ্রহণ করে অথচ এখনও তা সম্পাদন করে নি তখন আমি তার জন্য একটি সাওয়াব লিখি; আর যদি কার্যত সম্পাদন করে তবে দশ থেকে সাতশ- গুন পর্যন্ত সাওয়াব লিখি। পক্ষান্তরে যদি অসৎ কর্মের ইচ্ছা করে অথচ এখনো সম্পাদন করে নি তবে এর জন্য কিছুই লিখি না। আর তা কার্যে পরিণত করলে একটি মাত্র পাপ লিখি। (সহিহ মুসলিম ২৩৫)

২। সফরে ফরজ হুকুবে অবহেলা না করাঃ

সফর একটি কষ্টসাধ্য কাজ। সফল কালে সময়ের অভাবে সঠিকভাবে সালাত করা অনেকের পক্ষ সম্বব হয়ে উঠে না। যাদের ঈমান দুর্বল তারাতো সফরের সালাত ছেড়েই দেয়। সফরে যতই কষ্ট হোকনা কেন কোন অবস্থায়ই ফরজ হুকুবে অবহেলা করা যাবে না। সফরের সময় অনেক মহিলা পর্দার ব্যাপারে গুরত্ব প্রদান করে না। অথচ পর্দা করা প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক নর নারীর জন্য ফরজ। শুধু সালাত আর পর্দা নয় সফরের প্রতিটি ফরজই যথাযথভাবে আদায় করা উচিৎ।

সফরের সালাতগুলো কসর করে যথাযথ আদায় করতেই হবে। কোন অজুহাতে সালাত কাজা করা যাবে না।

৩। সৎ কাজের আদেশ প্রদান অসৎ কাজের নিষেধ করাঃ

সফর দীর্ঘ ও সময় সাপেক্ষ হলে সাধ্য মত সৎকাজের নির্দেশ দেয়া আর অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা উচিৎ। যদি সফর সঙ্গী বেশী থাকে তবে নিজেদের মাঝেও এই কাজ করা যায়। যেমন, হজ্জের সফরে দীর্ঘ দিন ধরে বহু সাথীকে একই সাথে সফর করতে হয়। এই সুযোগে সাধ্যমত সৎকাজের নির্দেশ ও অসৎকাজর নিষেধ করা। তাছাড়া চলাচলে পথেও সাধ্যমত এই কাজটি চালিয়ে যেতে হবে।

আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, একবার নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা রাস্তায় বসা থেকে বিরত থাকো। তারা বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের রাস্তায় বসা ব্যতীত গত্যন্তর নেই, আমরা সেখানে কথাবার্তা বলি। তখন তিনি বললেন, যদি তোমাদের রাস্তায় মজলিস করা ব্যতীত উপায় না থাকে, তবে তোমরা রাস্তার হক আদায় করবে। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! রাস্তার হক কী? তিনি বললেন, তা হলো চক্ষু অবনত রাখা, কাউকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা। সালামের জবাব দেয়া এবং সৎকাজের নির্দেশ দেয়া আর অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা। (সহিহ বুখরি ৬২২৯ তাওহীদ)

৪। সফরে অন্য সাথীদের কষ্টের কারন না হওয়াঃ

সফরের বিভিন্ন মন মানুষিকতার লোক থাকে। কেউ রাগি, কেউ স্বর্থপর, কেউ বদমেজাজি, কেউ খিটখিটে স্বভাবের আবার অনেক ভালো স্বভাবের ও আছে। একজন খারাপ সফর সঙ্গি সকলের কষ্টের কারণ হতে পারে। কাজেই সবার করা চিন্তা করে অন্তত এতটুকু ভাবা যে, আমি যেন অন্য সাথীদের কোন কষ্টের কারন না হই। তাই সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবসময় হাঁসিমুখে থাকতে হবে। নিচের উদারতা পরিচয় দিন। সকল সাথীদের খুশী রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করুন। প্রত্যকে এমনটি ভাবলে সফর খুবই সাফল্য মন্ডিত হবে।

আবূ সিরমা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক অন্য কারো ক্ষতিসাধন করে, আল্লাহ তা’আলা তা দিয়েই তার ক্ষতিসাধন করেন। যে লোক অন্যকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তা’আলা তাকে কষ্টের মধ্যে ফেলেন।(সুনানে তিরমিজ ১৯৪০, ইবনে মাজাহ ২৩৪২)

আবূ সিরমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করবে, আল্লাহ তার ক্ষতি করবেন এবং যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দিবে আল্লাহ তাকে কষ্ট দিবেন।(ইবনে মাজাহ ২৩৪২)

৫। সাথীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবেঃ

সফরের সময় থাকা খাওয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না, বিধায় অনেকের মেজাজ খারাপ থাকে। এই সময় যদি সকলেই ধৈর্যহীন হয়ে যায়, তবে পাপাচারে লিপ্ত হওয়া সম্ভাবনা থাকে। সবাই যদি সাথীদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকে তবে সফর সুন্দর হবে। এই জন্য সফরে বের হওয়ার পূর্বে কিছু বেশী টাকা এবং পর্যাপ্ত সফর সম্বল নিয়ে নেয়া উচিৎ। কারণ, হঠাৎ তার প্রয়োজন হতে পারে অথবা অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে এবং নিজ প্রয়োজনে এবং মুসলিম ভাইদের প্রয়োজনে ব্যয় করা যায়। যদি সফর সঙ্গীদের সহানুভূতি দেখান তবে দেখবের তারাও আপনাকে সহানুভূতি দেখাবে। সফর সঙ্গীদের পক্ষ হতে আপনার সাথে কোন রকম দুর্ব্যবহার করা হয় বা আপনার মতের উল্টো কাজ হয়, তাহলে তাতে ধৈর্য ধারণ করা এবং ভাল পন্থায় তার সমাধান করার চেষ্টা করুন। এরফলে, আপনি তাদের মাঝে মান সম্মান নিয়ে চলতে পারেন এবং তাদের মন জয় করতে সক্ষম হবেন। এ সম্পর্কিত কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করছি।

হজ্জরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা কোনো সফরে নবী (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি সওয়ারিতে আরোহণ করে আগমন করল। অতঃপর সে তার দৃষ্টি ডানে-বামে ফেরানো শুরু করল। তা দেখে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যার নিকট অতিরিক্ত বাহন আছে, যার নেই তার জন্য যেন নিয়ে আসে, আর যার নিকট নিজের পাথেয়ের অতিরিক্ত রয়েছে, যার নেই তার জন্য যেন নিয়ে আসে।’ (সহিহ মুসলিম ১৭২৮)

নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পারস্পরিক দয়া, ভালবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে তুমি মু’মিনদের একটি দেহের মত দেখবে। যখন শরীরের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত জাগে এবং জ্বরে অংশ নেয়। (সহিহ বুখারি ৬০১১)

জারীর ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে (সৃষ্টির প্রতি) দয়া করে না, (আল্লাহর পক্ষ থেকে) তার প্রতি দয়া করা হয় না। (সহিহ বুখারি ৬০১৩)

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা হাসান ইবনু ‘আলীকে চুম্বন করেন। সে সময় তাঁর নিকট আকরা‘ ইবনু হাবিস তামীমী উপবিষ্ট ছিলেন। আকরা‘ ইবনু হাবিস বললেনঃ আমার দশটি পুত্র আছে, আমি তাদের কাউকেই কোন দিন চুম্বন দেইনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পানে তাকালেন, অতঃপর বললেনঃ যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না। (সহিহ বুখারি ৫৯৯৭)

রাইরাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এবং (রাস্তার হক হলো পথ হারাকে) পথ দেখানো। (আবু দাউদ ৪৮১৬)

৬। গীবত ও অযথা কথা থেকে জবান হিফাজত করাঃ

দীর্ঘ সফরে অনেক সময় যানবাহনে অসল সময় কাটাতে হয়। আর কখন কখন বাহনের অপেক্ষায় যাত্রা বিরত করতে হয়। এই সময় সফরের হক আদায় না করে, অনেকেই বেহুদা কথায় লিপ্ত হয়ে থাকে। যার ফলে যা করার ছিলনা তা করে, যা বলার ছিলনা তাই বলে। অর্থাৎ গীবতে লিপ্ত হয়। গীবত সম্পর্কে জ্ঞান কম থাকার কারনে সফরের অসল সময় গীবতেই কেটে যায়। তাই সফরে গীবত ও অযথা কথা থেকে জবান হিফাজত করতে হবে। গীবত বা অযথা কথা বলে বলে ইসলামি শরীয়তে যে কোন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পার। আর সফর সঙ্গীদের মধ্যে যদি কোন আলেম থাকে তবে তার নিকট থেকে জ্ঞান অর্জন করা চেষ্টা করি আর নিজে আলেম হলে অন্যদের সঠিক ইসলামি জ্ঞান দিতে চেষ্টা করি।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন; আরবদের একে অন্যকে সফরের সময় সেবা (খেদমত) করত। আবূ বকর ও উমর (রাঃ)- এর সাথে এক ব্যক্তি ছিল যিনি তাদের খেদমত করত। তারা উভয়ে ঘুমিয়েছিল। অতঃপর তারা জাগ্রত হলেন। (কিন্তু খাদেম) তাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করেনি (বরং সে ঘুমিয়েছিল) তাদের একজন অন্যকে বলছিল, এ (খাদেম) তোমাদের নবীর ঘুমের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করেছে (অন্য এক রিওয়ায়াতে আছে, তোমাদের গৃহের ঘুমের সাথে সাদৃশ্যতা রেখেছে)। অতঃপর তারা তাকে (খাদেমকে) জাগিয়ে দিয়ে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট গিয়ে তাঁকে বল, যে আবূ বাকার ও উমার (রাঃ) আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং আপনার কাছে তরকারী (অর্থাৎ খাবার) চেয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তাদের সালাম জানাবে এবং বলবে যে, তারা উভয়েই খাবার গ্রহণ করেছে। (এ কথা শুনে) তারা ঘাবড়িয়ে গেলেন এবং (উভয়েই) নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার নিকট খাদেমকে খাবার চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। আপনি বলেছেন যে, আমরা খাবার খেয়েছি। তো আমরা কী দিয়ে খাবার খেলাম? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমাদের ভাইয়ের গোশ্‌ত দিয়ে। আল্লাহর শপথ! আমি তার গোশ্‌ত তোমাদের নখের মধ্যে দেখছি। তারা [আবূ বাকার ও উমার (রাঃ)] বললেন, আমাদের ক্ষমা করুন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সে তোমাদের ক্ষমা করবে। (আস সহীহাহ-২৬০৮)

৭। একাকী সফর না করাঃ

সফরকালীন সময়ে একাকী না গিয়ে তিনজন বা তার বেশি সফরসঙ্গী থাকা উত্তম। কেননা, একাকী সফর করতে সহিহ হাদিসে নিরুত্সাহিত করা হয়েছে। 

আমর ইবনু শুআইব (রহঃ) হতে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একা ভ্রমণকারী এক শাইতান, দুইজন ভ্রমণকারী দুই শাইতান এবং তিনজন ভ্রমণকারী একটি জামা’আত। (সুনানে তিরমিজি : ১৬৭৪)।

‘আমর ইবনু শু‘আইব (রাঃ) থেকে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও তার দাদার সূত্রে বর্ণিত। তিনি (দাদা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একাকী সফরকারী হচ্ছে একটি শয়তান, আর একত্রে দু’ জন সফরকারী দু’টি শয়তান। তবে একত্রে তিনজন সফরকারীই হচ্ছে প্রকৃত কাফেলা। (আবু দাউদ ২৬০৭)

ইবনু ‘উমার (রাঃ) সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যদি লোকেরা একা সফরে কী ক্ষতি আছে তা জানত, যা আমি জানি, তবে কোন আরোহী রাতে একাকী সফর করত না। (সহিহ বুখারি  ২৯৯৮ তাওহীদ)

৮। সফর সংশ্লিষ্ট দোয়াগুলো যথাসময় পাঠ করাঃ

সফরের শুরু থেকে সফর শেষ করা পর্যান্ত বহু মাসনুন দোয়া সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত। সফর শুরুর আগে এই সকল দোয়া মুখন্ত করা চেষ্টা করি। অতপর, যখন সফর শুরু হবে এই মাসনুন দোয়া যথাস্থানে যথাসময় পাঠ করা চেষ্টা করি। মাসনুন দোয়াগুলি অর্থ বুঝে পাঠ করলে আরো ভাল হয়। আমি কি করছি আর কি বলছি তা যদি নিজেই না যানি তাহলে ভারী অন্যায় হবে।

ক। বাড়ি থেকে বের হওয়ার দোয়াঃ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন কোনো ব্যক্তি তার ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলবেঃ

«بِسْمِ اللَّهِ، تَوَكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ، وَلَاَ حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ».

(বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ)

অর্থঃ আল্লাহর নামে, আল্লাহর উপর ভরসা করে (বের হচ্ছি)। আল্লাহ ছাড়া কোন উপায় ও শক্তি নাই।

তখন তাকে বলা হয়, তুমি হেদায়াত প্রাপ্ত হয়েছো, রক্ষা পেয়েছো ও নিরাপত্তা লাভ করেছো। সুতরাং শয়তানরা তার থেকে দূর হয়ে যায় এবং অন্য এক শয়তান বলে, তুমি ঐ ব্যক্তিকে কি করতে পারবে যাকে পথ দেখানো হয়েছে, নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে এবং রক্ষা করা হয়েছে। (সুনানে আবু দাউদ ৫০৯৫)

** উম্মু সালামাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, যখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘর হতে বাইরে রাওয়ানা হতেন তখন বলতেন,

 «اللّٰـهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَضِلَّ، أَوْ أُضَلَّ، أَوْ أَزِلَّ، أَوْ أُزَلَّ، أَوْ أَظْلِمَ، أَوْ أُظْلَمَ، أَوْ أَجْهَلَ، أَوْ يُجْهَلَ عَلَيَّ».

 (আল্লাহুম্মা ইন্নী আঊযু বিকা আন আদ্বিল্লা, আও উদ্বাল্লা, আও আযিল্লা, আও উযাল্লা, আও আযলিমা, আও উযলামা, আও আজহালা, আও ইয়ুজহালা আলাইয়্যা)

অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাই যেন নিজেকে বা অন্যকে পথভ্রষ্ট না করি, অথবা অন্যের দ্বারা পথভ্রষ্ট না হই; আমার নিজের বা অন্যের পদস্খলন না করি, অথবা আমায় যেন পদস্খলন করানো না হয়; আমি যেন নিজের বা অন্যের উপর যুলম না করি অথবা আমার প্রতি যুলম না করা হয়; আমি যেন নিজে মুর্খতা না করি, অথবা আমার উপর মূর্খতা করা না হয়। (সুনানে তিরমিজ ৩৪২৭)

খ। সফরে বের হলে যে দোয়া পড়তে হয়ঃ

আবুয যুবাইর (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। ‘আলী-আযদী (রাঃ) তাকে জানিয়েছেন, ইবনু ‘উমার তাকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে বের হওয়ার সময় উটের পিঠে সোজা হয়ে বসে তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলে এ আয়াত পড়তেনঃ

سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا، وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ، وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ

অর্থঃ ‘‘মহান পবিত্র তিনি, যিনি একে আমাদের অনুগত বানিয়েছেন, তা না হলে একে বশ করতে ‘আমরা সক্ষম ছিলাম না। নিশ্চয়ই আমাদেরকে আমাদের রবের নিকট ফিরে যেতে হবে।’’[সূরা আয-যুখরুফঃ আয়াত ১৩-১৪] অতঃপর এ দু‘আ পাঠ করতেনঃ

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ فِي سَفَرِنَا هَذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوَى، وَمِنِ الْعَمَلِ مَا تَرْضَى، اللَّهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا سَفَرَنَا هَذَا، اللَّهُمَّ اطْوِ لَنَا الْبُعْدَ، اللَّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِي السَّفَرِ، وَالْخَلِيفَةُ فِي الْأَهْلِ وَالْمَالِ

তিনি যখন ফিরে আসতেন, এ দু‘আই পাঠ করতেন, শুধু এটুকু বাড়িয়ে বলতেনঃ

 آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ لِرَبِّنَا حَامِدُونَ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সেনাবাহিনী কোনো উঁচু স্থানে উঠার সময় ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন এবং নীচে নামার সময় সুবহানাল্লাহ বলতেন। অতঃপর এভাবেই (শুকরিয়া) সালাতে নির্ধারণ হয়। (আবু দাউদ ২৫৯৯)

** আলী ইবনু রবী‘আহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দেখলাম, ‘আলী (রাঃ)-এর কাছে আরোহণের একটি পশু আনা হলে তিনি এর পা-দানিতে পা রাখতেই বললেন, ‘বিসমিল্লাহ’ এবং এর পিঠে চড়ে সোজা হয়ে বসে বললেন, আল-হামদুলিল্লাহ।’’ অতঃপর তিনি এ আয়াত পড়লেন,‘‘মহান পবিত্র তিনি, যিনি একে আমাদের অনুগত বানিয়েছেন, তা না হলে একে বশ করতে ‘আমরা সক্ষম ছিলাম না। নিশ্চয়ই আমাদেরকে আমাদের রবের নিকট ফিরে যেতে হবে।’’[সূরা আয-যুখরুকঃ আয়াত ১৩-১৪] পুনরায় তিনি তিনবার ‘আলহামদু লিল্লাহ’ এবং তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বললেন। অতঃপর বললেন, ‘‘(হে আল্লাহ!) আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, আমিই আমার উপর যুলুম করেছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আপনি ছাড়া কেউই গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না।’’ অতঃপর তিনি হেসে দিলেন।

তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আমীরুল মু‘মিনীন! আপনি কেন হাসলেন? তিনি বললেন, আমি যেরূপ করলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কেও এরূপ করতে দেখেছি। তিনি তখন হেসেছিলেন তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি হাসলেন কেন? তিনি বললেনঃ নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক তাঁর বান্দার উপর সন্তুষ্ট হন যখন সে বলেঃ ‘‘(হে আমার রব!) আপনি আমার গুনাহ ক্ষমা করুন।’’ আর বান্দা তো জানে যে, আমি (আল্লাহ) ছাড়া কেউই গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না। (আবু দাউদ ২৬০২)

*** বাহন হোঁচট খেলে পড়বে,

রেখে (بِسْمِ الله) বিসমিল্লাহ (আল্লাহর নামে) পাঠ করবে। (আবু দাউদ ৪৯৮)

গ। সফরের সময় উঁচু নিচু অতিক্রমকালে পাঠ করবেঃ

সফরের সময় উঁচু জায়গায় উঠার সময় তাকবীর পাঠ করবে এবং কোন নীচু জায়গায় অবতরণের সময় তাসবীহ পাঠ করবেন।

জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা যখন কোন উঁচু স্থানে আরোহণ করতাম, তখন তাকবীর তাকবীর (اَللهُ أَكْبَرُ – আল্লাহু আকবার) ধ্বনি উচ্চারণ করতাম আর যখন কোন উপত্যকায় অবতরণ করতাম, সে সময় তাসবীহ (سُبْحَانَ اللهِ সুবহানাল্লাহ) বলতাম। (সহিহ বুখারি ২৯৯৩)

ঘ। সফরে কোন স্থানে যাত্রা বিরতীতে পাঠ করবেঃ

খাওলা বিনতে হাকীম (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদের কেউ কোন গন্তব্যে পৌঁছে যদি এই দোয়া পড়েঃ ‘‘আউযু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন শাররি মা খালাক’’

أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ

[আউযু বিকালিমাতিল্লাহিত্ তা-ম্মা-তি মিন শার্‌রি মা খলাক্বা]

অর্থঃ আমি আল্লাহ পাকের কল্যাণকর বাক্যাবলীর উসীলায় তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

তাহলে সে স্থান থেকে বিদায় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোন কিছু তার ক্ষতি করতে পারবে না। (সহিহ মুসলিম ২৭০৮, সুনানে ইবনে মাজাহ ৩৫৪৭, তিরমিযী ৩৪৩৭)।

ঙ। ঘরে প্রবেশের দোয়াঃ

আবূ মালিক আল-আশ‘আরী (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন কেউ নিজ ঘরে প্রবেশ কররে তখন সে যেন বলে,

«بِسْمِ اللَّهِ وَلَجْنَا، وَبِسْمِ اللَّهِ خَرَجْنَا، وَعَلَى اللَّهِ رَبِّنَا تَوَكَّلْنَا»

(বিসমিল্লাহি ওয়ালাজনা, ওয়াবিস্‌মিল্লাহি খারাজনা, ওয়া আলাল্লাহি রাব্বিনা তাওয়াক্কালনা)

অর্থঃ আল্লাহ্‌র নামে আমরা প্রবেশ করলাম, আল্লাহ্‌র নামেই আমরা বের হলাম এবং আমাদের রব আল্লাহ্‌র উপরই আমরা ভরসা করলাম”। অতঃপর সে যেন তার পরিবারের লোকদের সালাম দেয়। (সুনানে আবু দাউদ ৫০৯৬)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “সফরের বিধি বিধান

Leave a comment