শবে বরাতের আমল ও বিদআত

শবে বরাতের সুচনা ও শব্দার্থঃ

শবে বরাত নামটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। এই দিন সরকরি ছুটির দিন বলে সকল নাগরিকই জানে এটি একটি ইসলমি দিবস। আমরাও দেখে থাকি এই রাতে প্রতিটি মসজিদে বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে রাতটি অতিবাহিত করে। আবার কিছু লোককে দেখা যায় তারা এ রাতের বিশেষ ইবাদতকে বিদআত হবে। আলোচনা সমালোচায় এক পর্যায় শবে বরাত বা মধ্য শাবানের রজনীর এই আমলকে মুরুব্বিদের দোহাই ও সমাজে প্রচলিত বলে দাবি করে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হলোঃ শবে বরাত বা মধ্য শাবানের রজনীর আমল, বিশেষ নামায পড়া, রোযা রাখা, মিলাদ পড়া, মিষ্টি মিঠায় বিলি করা, আলোক সজ্জা করা ইত্যাদি ইসলামি শরীআতে একটা নব আবিস্কার বিষয়। এই ধরনের কোন আমল বা অনুষ্ঠান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে কিংবা সাহাবাগণের যুগে ছিল না। পরবর্তীতে আব্বাসীয় খেলাফতের একজন শিয়া মতাদর্শী মন্ত্রী মুহাম্মাদ বিন আলী বিন খলফ এ দিনকে বিশেষ ঈদ বা অনুষ্ঠান হিসেবে পালন করা, মিষ্টি মিঠায় বিলি করা শুরু করেন এবং ৪৪৮ হিজরীতে এক ব্যক্তি বায়তুল মুকাদ্দস মসজিদে বিশেষ নামাযের আয়োজন করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

হাফেয ইবনে রজব (রহঃ) তার কিতাব লাতায়িফুল মায়ারিফে লিখেছেনঃ “তাবেয়ীদের যুগে সিরিয়ায় খালিদ ইবনে মা’দান, মকহুল, লুকমান ইবনে আমের প্রমুখ আলিম এ রাতকে মর্যাদা দিতে শুরু করেন এবং এ রাতে বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। তখন লোকেরা তাদের থেকে এটা অনুসরণ করতে আরম্ভ করল। এরপর লোকদের মধ্যে মতানৈক্য শুরু হল। বসরা অঞ্চলের অনেক আবেদগণ এ রাতকে গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু মক্কা ও মদীনার আলিমগণ এটাকে বিদ‘আত বলে প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর সিরিয়াবাসী আলিমগণ দুই ভাগ হয়ে গেলেন। একদল এ রাতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। এদের মধ্যে ছিলেন খালেদ ইবনে মা’দান, লোকমান ইবনে আমের। ইসহাক ইবনে রাহভিয়াহও তাদের অনুরূপ মত পোষণ করতেন।

            শবে বরাত দুটি ফারসী শব্দের সমন্নয় গঠিত হয়ছে। একটি হল শব অপরটি বরাত। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত এবং ‘বরাত’ শব্দের অর্থ সৌভাগ্য বা ভাগ্য। এই অর্থ অনুসারে শবে বরাত শব্দটির অর্থ হল, সৌভাগ্য রজনী বা ভাগ্য রজনী। অনেক বলে থাকে শব ফারসী শব্দ হলেও বরাত শব্দটি আবরি যার অর্থ হল, সম্পর্কচ্ছেদ, পরোক্ষ অর্থে মুক্তি। সে অর্থে শবে বলাতের অর্থ হয় মুক্তির রজনী। কেউ কেউ আবার শবে বরাত কে লাইলাতুল বরাত বলে থাকে। এই ক্ষেত্রে দুটি শব্দই আবরি যার অর্থ হল, মুক্তির রজনী। যেমন কুরআন মাজীদে সূরা বারাত রয়েছে যা সূরা তাওবা নামেও পরিচিত। ইরশাদ হয়েছেঃ

بَرَآءَةٌ۬ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۤ إِلَى ٱلَّذِينَ عَـٰهَدتُّم مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ (١)

অর্থঃ সম্পর্কচ্ছেদ করা হল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে সেই মুশরিকদের সাথে, যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে। (সূরা তাওবা ৯:১)
এখানে বারাতের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা। ‘

আরার বারাত’ মুক্তি অর্থেও আল-কুরআনে এসেছে। যেমনঃ সুরা কামারে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন।

 أَكُفَّارُكُمۡ خَيۡرٌ۬ مِّنۡ أُوْلَـٰٓٮِٕكُمۡ أَمۡ لَكُم بَرَآءَةٌ۬ فِى ٱلزُّبُرِ (٤٣)

অর্থঃ তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? না কি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাব সমূহে? (সূরা কামার ৫৪:৪৩)

অতএব শবে বরাত শব্দটার অর্থ দাড়ায় মুক্তির রজনী, সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী। অথবা সৌভাগ্যের রাত, যদি ‘বরাত’ শব্দটিকে ফার্সী শব্দ ধরা হয়। শবে বরাত শব্দটাকে যদি আরবীতে তর্জমা করতে চান তাহলে বলতে হবে ‘লাইলাতুল বারায়াত’। বরায়াত শব্দটি এর রূপ বা উচ্চারণ আরবী ও ফারসী ভাষায় একই রকম কিন্তু এর অর্থ ভিন্ন। সার কথা হল ‘বারায়াত’ শব্দটিকে আরবী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফারসী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য। যেহেতু কুরআন সুন্নাহতে এই শব্দের বা এই রাতের কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। আর অনাবর ভাষাভাষীদের এই রাতের আমলে প্রতি ঝোক বেশি, তাই শবে বারাত দুটি ফারসী শব্দ ধরে নেয়াই যুক্তি যুক্ত। তা হলে একে ‘সৌভাগ্য রজনী’ বলাই অধিক শ্রেয়।

 

কখন এই রাত আসেঃ

প্রতি বছর হিজরি সালের শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রে মুসলিম উম্মাহ কিছু বিদআতী এই রাতকে সৌভাগ্যের রজনী হিসেবে পালন করে বহু মনগড়া আমল করে থাকে। তারা এর সমর্থনে একটি হাদিস পেশ করে থাকে। হাদিসটি হলঃ

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে না পেয়ে ঘর থেকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম। হঠাৎ তাকে বাকী গোরস্তানে যেয়ে পেলাম। তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি আশংকা করো আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর কোন অন্যায় করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রী কাছে চলে গিয়েছেন বলে আমার ধারণা হয়েছিল। তিনি বলেন, শোন, আল্লাহ তা‘আলার মধ্য শাবানের রাত্রিতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে নেমে আসেন। অনন্তর বানূ কালব গোত্রের বকরী পালের লোমের সংখ্যার চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে তিনি ক্ষমা করে দেন। (সুনানে তিরমীজি হাদিস নম্বর ৭৩৭ ইসলামি ফাউন্ডেশন এবং ৭৩৯ মাদানী প্রকাশনী; ইবনু মাজাহ ১৩৮৯)

তিরমীজির টিকাঃ ইমাম ঈসা (রহঃ) বলেন, হাজ্জাতের বরাতে এই সূত্রটি ছাড়া আয়িশা (রাঃ) এর হাদীসটি সম্পর্কে কোন কিছু আমাদের জানা নাই। এই হাদীসটিকে দুর্বল বলতে আমি মুহাম্মদ আল-বুখারীকে শুনেছি। তিনি বলেন, রাবী ইয়াহইয়া ইবনু আবূ কাসীর উরওয়া (রহঃ) থেকে কোন রিওয়ায়াত শোনেননি। মুহাম্মদ আল-বুখারী বলেন, এমনিভাবে হাজ্জাজ ইয়াহইয়া ইবনু আবূ কাসীরের নিকট থেকে কিছুই শোনেননি। এই হাদিসটি মানঃ যঈফ।

শবে বরাত অনুসারীদের দলীল ও পর্যালোচনাঃ

কোন সত্য পন্থী আলেম পবিত্র কুরআনের কোন আয়াত শবে বরাত সম্পর্কে দলীল হিসাবে পেশ করেন না কারন শবে বরাত কিংবা লাইলাতুল বারায়াতের নামে কোন শব্দ কুরআন মাজীদে খুজে পাবেন না, আয়াততো অনেক দুরের কথা। সত্য কথাটাকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় পবিত্র কুরআন মাজীদে শবে বরাতের কোন আলোচনা নেই। সরাসরি তো দূরের কথা আকার ইংগিতেও নেই। শবে বরাত নামটি হাদীসের কোথাও উল্লেখ হয়নি। তবে হাদিসের গ্রন্থ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রাত সম্পর্কে বেশ কয়েকটি যঈফ হাদিস উল্লেখ আছে। এই সকল যঈফ হাদিসগুলিতে কোন প্রকার আমল করার কথা বলা হয়নি। ফিকহের কিতাবেও এ রাত সম্পর্কে কিছু বলা হয় নাই। কিন্তু কিছু কিছু অখ্যাত বইয়ে এ সম্পর্কি আলোচনা পাওয়া যায়। শবে বরাতের পক্ষে যারা কথা বলেন যারা কুরআন সুন্নাহ থেকে দলীল পেশ করা চেষ্টা করেন। তাদের দেয়া কিছু দলীল পর্যালোচনা করব, ইনশাল্লাহ।

কুরআন থেকে তাদের দলীল ও পর্যালোচনাঃ

যারা শবে বরাতে পক্ষে কথা বলেন তাদের দেখা যায় শবে বরাতের গুরুত্ব আলোচনা করতে যেয়ে সূরা দুখানের প্রথম চারটি আয়াত পাঠ করেন। আয়াতসমূহ হলঃ

حمٓ (١) وَٱلۡڪِتَـٰبِ ٱلۡمُبِينِ (٢) إِنَّآ أَنزَلۡنَـٰهُ فِى لَيۡلَةٍ۬ مُّبَـٰرَكَةٍ‌ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ (٣) فِيہَا يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ (٤)

অর্থঃ হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিতো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা দুখান ৪৪:১-৪)।

শবে বরাতের পক্ষের ব্যাখ্যাঃ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় শবে বরতা পন্থী আলেমগন অনেক মিথ্যা, ভুয়া ও মনগড়া তথ্য দিয়ে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে থাকে। তাদের প্রথম দাবি সুরা দখানে উল্লেখিত এই বরকতময় রজনী হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত বা শবে বরাতের রাত। তাদের দাবী, মধ্য শাবানের রাত্রিতে বছরের সকল ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়, জীবিত ও মৃতদের তালিকা লেখা হয় এবং হাজিদের তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকা থেকে পরবর্তীতে একজনও কমবেশি হয় না। মহান আল্লাহ শবে বরাতের রাতে সকল বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববান ফেরেশতাদের কাছে ন্যস্ত করে থাকেন। তাদের এই কথা স্পষ্টভাবেই কুরআনের অপব্যাখ্যা। তাদের এ ব্যাখ্যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয় বরং এখানে বরকতপূর্ণ রাত বলতে লাইলাতুল ক্বদর উদ্দেশ্য।

তাদের ব্যাখ্যার জবাবঃ আল্লামা ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, অত্র বরকতপূর্ণ রাতই হল লাইলাতুল ক্বদর বা ক্বদরের রাত। যেমন অন্যত্র সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। কুরআনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য কথা হল, কুরআনের কোন অস্পষ্ট আয়াতের ব্যাখ্যা যদি অন্য কোন আয়াতে সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়, তাহলে কুরআনের ব্যাখ্যাই গ্রহণ করতে হবে। আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ সূরা কদরের শুরুতে বলেন, মহান আল্লাহ এই আয়াত দ্বারা বরকতময় রাতের অর্থ পনের শাবানের রাতকে বুঝান নাই। তিনি এই আয়াত দ্বারা যে বরকতময় রাতের কথা বলছেন তা হল, লাইলাতুল কদর। যদি কেউ এই আয়াত দ্বারা শাবানের পনের তারিখ বুঝিয়ে থাকেন তবে তা হবে মারাত্বক অন্যায় এবং মহান আল্লাহর কালাম বিকৃত করার মত অপরাধ।  কুরআনের এই আয়াতগুল লক্ষ করুন। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّآ أَنزَلۡنَـٰهُ فِى لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ (١) وَمَآ أَدۡرَٮٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ (٢) لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٌ۬ مِّنۡ أَلۡفِ شَہۡرٍ۬ (٣) تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَـٰٓٮِٕكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيہَا بِإِذۡنِ رَبِّہِم مِّن كُلِّ أَمۡرٍ۬ (٤) سَلَـٰمٌ هِىَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ (٥)

অর্থঃ আমি এই কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি জানেন লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্য মালাইকা ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশে। এই শান্তি ও নিরাপত্তা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সূরা কাদর ৯৭:১-৫)।

পূর্বে উল্লেখিত সুরা দুখানের আয়াত থেকে স্পষ্ট দুটি ধারনা পাওয়া যায়।

প্রথমটি হলোঃ মহান আল্লাহ বরকতময় একটি রজনীতে কুরআন নাজিল করেছেন।

দ্বিতীয়টি হলোঃ এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত করা হয়।

বিদআতীগন বলে থাকেন, এই বরকতময় রজণী হল শবে বরাত বা লাইলাতুর বরাত। আর আমরা বলছি এই বরকতময় রজণী হল লাইলাতুল করদ বা করদের রাত্রী। তাহলে কে সঠিক? একটু লক্ষ করুন, সুরা দুখানের ঐ আয়াতে বলা হয়ে, এই বরকতময় রজনীতে কুরআন নাজিল হয়েছে। তাহলে একটা বিষয় শতভাগ নিশ্চত যে, কুরআন যে রাত্রে নাজিল হয়েছে সেই রাতই হল এই বরকতময় রজণী। এবার দেখুন, সুরা কাদরে মহান আল্লাহ বলেন, আমি এই কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। দুটি আয়াতের সমন্নয় করলে দাড়ায়, কুরআন নাজিল হয়েছে এক বরকতময় রাতে আর সে রাতের নাম হল লাইলাতুল কদর। কাজেই মহান আল্লাহর কুরআনের বাণীর পর আর কারও ব্যাখ্যা বিশ্লষন গ্রহন করা হারাম। একটি স্পষ্ট দলীলের বিপরীত কোন প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লষন করা যাবে না। তবে বলতে পারেন লাইতাতুল কদর কখন হয়। এ প্রশ্নের জবাব ও মহান  আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরঅনে দিয়ে এরশাদ করছেন,

*شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ*

অর্থঃ রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন। (সুরা বাকারা ২:১৮৫)।

এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলে দিলেন, কুরআন নাজিল হয়েছে রমজান মাসে। কাজেই এই বরকতময় রজণী হল লাইলাতুল কদর অবশ্যই রমজান মাসে। কুনআনে এই স্পষ্ট দলীল বলে দিচ্ছে লাইলাতুল কদর হল রমজান মাসে। তাই যারা সুরা দুখানের ঐ আয়াত দ্বারা শবে বরাতের দলীল দেন তারা কুনআনেরই অবমাননা করছেন।

এক কথায় বলা যায় সূরা দুখানের প্রথম চার আয়াতের ব্যাখ্যা হল সূরা কদর। আল কুরআনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করা হল সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। কিন্তু সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকার অর্থ যদি শবে বরাত হয় তাহলে এ আয়াতের অর্থ দাড়ায় আল কুরআন শাবান মাসের শবে বরাতে নাযিল হয়েছে। অথচ উপরের আলোচনায় থেকে কুরআনের দলীল দ্বারা সহজে অনুমেয় কুরআন নাযিল হয়েছে রামাযান মাসের লাইলাতুল কদরে।

আপনি যদি তাফসীর থেকে এর ব্যাখ্যার আলোচনা দেখেন তবে দেখবেন, অধিকাংশ মুফাচ্ছিরে কিরামের মত হল উক্ত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। শুধু মাত্র তাবেয়ী ইকরামা (রহঃ) এর একটা মত উল্লেখ করে বলা হয় যে, তিনি বলেছেন বরকতময় রাত বলতে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতকেও বুঝানো যেতে পারে।  তিনি বরকতময় রজনীর যে ব্যাখ্যা শাবানের ১৫ তারিখ দ্বারা করেছেন, তা ভুল হওয়া সত্ত্বেও প্রচার করতে হবে এমন কোন নিয়ম-কানুন নেই। বরং তা প্রত্যাখ্যান করাই হল হকের দাবী। তিনি যেমন ভুলের উর্ধ্বে নন, তেমনি যারা তার থেকে বর্ণনা করেছেন তারা ভুল শুনে থাকতে পারেন অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বানোয়াট বর্ণনা দেয়াও অসম্ভব নয়। এমন কথা বলার অধিকার কুরআন দিয়েছেন তার স্পষ্ট বর্ণনা দ্বারা। তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। যা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য। এ বরকতময় রাতের দ্বারা উদ্দেশ্য যদি শবে বরাত হয় তাহলে শবে কদর অর্থ নেয়া চলবেনা।

       আর একটু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, সুরা দুখানে চার নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয় (৪৪:৪)। কাজেই ভাগ্য রজনী বলতে যা বুঝায় তাও হবে লাইলাতুল কদরে, শবে কদরে নয়। কিন্তু বিআদতীদের বাদী হল, শবে বরাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মাউত, রিয্‌ক-দৌলত সম্পর্কে সিদ্ধান- নেয়া হয় ও লিপিবদ্ধ করা হয়। তাদের এই বাদী সরাসরি কুরআন বিরোধী। তাদের প্রচারনার ফলে অনেক অজ্ঞ মুসলিম শবে বরাতের গুরুত্ব বর্ণনায় সূরা দুখানের উক্ত আয়াত উল্লেখ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এ আকীদাহ বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, শবে বরাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মাউত, রিয্‌ক-দৌলত সম্পর্কে সিদ্ধান নেয়া হয় ও লিপিবদ্ধ করা হয়। আর শবে বরাত উদযাপনকারীদের শতকরা নিরানব্বই জনের বেশী এ ধারণাই পোষণ করেন। তারা এর উপর ভিত্তি করে লাইলাতুল কদরের চেয়ে ১৫ শাবানের রাতকে বেশী গুরুত্ব দেয়। অথচ কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ বিষয়গুলি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত। তাই যারা শবে বরাতের গুরুত্ব বুঝাতে উক্ত আয়াত যারা উল্লেখ করেন তারা মানুষকে সঠিক ইসলামী আকীদাহ থেকে দূরে সরানোর কাজে লিপ্ত, যদিও মনে-প্রাণে তারা তা ইচ্ছা করেন না।

ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর তাফসীরে বলেছেনঃ কোন কোন আলেমের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত)। কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা।”

হাদিস থেকে তাদের দলীল ও পর্যালোচনাঃ

আলোচনা শুরুতে শবে বরাত সম্পর্কিত তাদের ব্যবহৃত কয়েকটি হাদিস উল্লখ করছি। সাথে সাথে হাদিসের মানও উল্লেখ করব যাতে সহজে এ সম্পর্কে একটি ষ্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়।

হাদিস নম্বরঃ-১

মুয়াজ বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ “লাইলাতুল নিসফে মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতে রাহমাতের দৄষ্টি দান করেন। মুশরিক ও হিংসুক ব্যতিত সবাইকে মাফ করে দেন।

হাদিসের মানঃ হাদিসটি সহিহ। ইমাম ইবনে হিব্বান তার ছহিহ, ইমাম বায়হাক্বী তার শুয়াবুল ইমান, ইমাম তাবরানী আল মু’জামুল কাবীর এবং আবু নায়ী’ম আল হুলয়ার মধ্যে এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম হাইসামী এই হাদিসটি বর্ণনা করারপর বলেন, এই হাদিসটির সকল বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত এবং হাদিসটি সহিহ। এছাড়া ইমাম মুনজারী আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব গ্রন্থে, ইমাম সুয়ুতী দুররুল মানসুরে উল্লেখ করেছেন। শাইখ ‎আলবানী তার সিলসিলাতুস সহিহ এর ৩ নং খন্ডের ১৩৫ নং পৃষ্ঠায় বলেন। “এই হাদিসটি সহীহ” এটি ‎সাহাবাদের এক জামাত বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন সূত্রে যার একটি অন্যটিকে শক্তিশালী করেছে। তাদের ‎মাঝে রয়েছেন বিশষ্ট সাহাবী মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ), আবু সা’লাবা (রাঃ), আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ), আবু মুসা ‎আশয়ারী (রাঃ), আবু হুরায়রা (রাঃ), আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ), আউফ বিন মালিক (রাঃ),  আয়েশা (রাঃ) প্রমুখ ‎সাহাবাগণ। উপরে বর্ণিত সবক’টি বর্ণনাকারীর হাদিস তিনি তার কিতাবে আনার মাধ্যমে সুদীর্ঘ আলোচনার পর শেষে ‎তিনি বলেন, সারকথা হল এই যে, নিশ্চয় এই হাদিসটি এই সকল সূত্র পরম্পরা দ্বারা সহিহ, এতে কোন ‎সন্দেহ নেই। আর সহিহ হওয়া এর থেকে কম সংখ্যক বর্ণনার দ্বারাও প্রমাণিত হয়ে যায়, যতক্ষণ ‎না মারাত্মক কোন দুর্বলতা থেকে বেঁচে যায়, যেমন এই হাদিসটি হয়েছে। এমনই কয়েকটি সনদ উল্লেখ করছি।

*** আবি সা’লাবাহ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন নিসফে মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাত আসে তখন, আল্লাহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতে রাহমাতের দৄষ্টি দান করেন। মুশরিক ও হিংসুক ব্যতিত সবাইকে মাফকরে দেন। এবং তিনি তাদেরকে তাদের শত্রুতার মধ্যে রেখে দেন।
(ইমাম বায়হাক্বী তার শুয়াবুল ইমান, ইমাম সুয়ুতী দুররুল মানসুরে ও হাফিজ বিন আছিম কিতাবুস সুন্নাহয় উল্লেখ করেছেন)।

*** অব্দুল্লাহ বিন আ’মর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ যখন নিসফে মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সমস্ত সৃষ্টি জগতে রাহমাতের দৄষ্টি দান করেন। দুই ব্যক্তি, খুনি ও হিংসুক ব্যতিত সবাইকে মাফ করেদেন। (ইমাম আহমদ তার মুসনাদে ও ইমাম হাইসামী মাজমাউজ জাওয়াইদে ও ইমাম মুনজারী আত- তারগীব ওয়াত-তারহীব গ্রন্থে বর্ননা করেছেন)।

মন্তব্যঃ আল্লামা শায়েখ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ এর বিশ্লেষণ থেকে একথা নির্ধিদ্ধায় আমরা বলতে পারি হাদিস দ্বারা ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাতটি প্রমানিত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাবানের মধ্য রাতের ক্ষমার বিষয়টিও এই হাদিসে উল্লেখ করছেন। ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাত বাক্যটি হাদিসে আসলেও শবে ‎বারাআত নামের কোন শব্দ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এই হাদিস দ্বারা শাবানের মধ্য রাত্রির ফজিলতের সম্পর্কে জানা যায় কিন্তু কোন আমলের প্রমান পাওয়া যায় না।

হাদিস নম্বরঃ-২

আবু মূসা আল আশ’আরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ‘আল্লাহ তা‘আলা শাবানের মধ্যরাত্রিতে আগমণ করে, মুশরিক ও ঝগড়ায় লিপ্ত ব্যক্তিদের ব্যতীত, তাঁর সমস্ত সৃষ্টিজগতকে ক্ষমা করে দেন। হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে (১/৪৫৫, হাদীস নং ১৩৯০),এবং তাবরানী তার মু’জামুল কাবীর (২০/১০৭,১০৮) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

মন্তব্যঃ হদিসের মান যইফ। আল্লামা বুছীরি বলেন, ইবনে মাজাহ বর্ণিত হাদীসটির সনদ দুর্বল। তাবরানী বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে আল্লামা হাইসামী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মাজমা‘ আয যাওয়ায়েদ (৮/৬৫) গ্রন্থে বলেনঃ ত্বাবরানী বর্ণিত হাদীসটির সনদের সমস্ত বর্ণনাকারী শক্তিশালী। হাদীসটি ইবনে হিব্বানও তার সহীহতে বর্ণনা করেছেন। এ ব্যাপারে দেখুন, মাওয়ারেদুজ জাম‘আন, হাদীস নং ১৯৮০)।

এ হাদীসটি দুর্বল। খুব দুর্বল বা বানোয়াট নয়। সে হিসেবে এ রাতের ফজিলত প্রমানিত কিন্তু আমল প্রমানিত নয়। এই সূত্রেই অনেক হাদীসবিদ শাবানের মধ্যরাতের ফযীলত রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেনঃ ইমাম আহমাদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। (ইবনে তাইমিয়া তার ইকতিদায়ে ছিরাতে মুস্তাকীমে (২/৬২৬) তা উল্লেখ করেছেন)।

ইমাম আওযায়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। (ইমাম ইবনে রাজাব তার ‘লাতায়েফুল মা‘আরিফ’ গ্রন্থে (পৃঃ১৪৪) তার থেকে তা বর্ণনা করেছেন)।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। (ইকতিদায়ে ছিরাতে মুস্তাকীম ২/৬২৬,৬২৭, মাজমু‘ ফাতাওয়া ২৩/১২৩, ১৩১,১৩৩,১৩৪)।

ইমাম ইবনে রাজাব আল হাম্বলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। (তার লাতায়েফুল মা‘আরিফ পৃঃ১৪৪ দ্রষ্টব্য]। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দিন আল-আলবানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। (ছিলছিলাতুল আহাদীস আস্‌সাহীহা ৩/১৩৫-১৩৯)

মন্তব্যঃ এই সকল হাদিসে ফজিলত বর্ননা করা হলেও আমল বর্ণনা করা হয় নাই। তাই এই রাতের বিশেষ নিয়মে ইবাদত করার পদ্ধতি আবিস্কারের করানে অনেক মুহাদ্দিস বিদআত বলেছেন। আমাদের কোন সলফে সালেহিন ফজিলত জানার পরও এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে ইবাদত করেন নাই। এজন্যই শাইখ আব্দুল আজীজ ইবনে বায রাহমাতুল্লাহি আলাইহি সহ আরো অনেকে এ রাত্রির অতিরিক্ত ফযীলত অস্বীকার করেছেন এবং বিষেশ নিয়মে সারা রাত সালাত আদায় ও পরের দিন সিয়াম পালন করাকে বিদআত বলেছেন।

হাদিস নম্বরঃ-৩

উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেয়। আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কেহ কিছু চাইবার আমি তাকে তা দিয়ে দিব। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ মুশরিক ও ব্যভিচারী বাদে সকল প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হয়। (বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান)

মন্তব্যঃ হদিসের মান যইফ। বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) হাদীসটিকে তার সংকলন ‘যয়ীফ আল-জামে’ নামক কিতাবের ৬৫২ নং ক্রমিকে দুর্বল প্রমাণ করেছেন। শবে বরাত সম্পর্কে এ ছাড়া বর্ণিত অন্যান্য সকল হাদীস সম্পর্কে ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ) বলেনঃ এ মর্মে বর্ণিত অন্য সকল হাদীসই দুর্বল।

হাদিস নম্বরঃ-৪

ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন, আমাদের কাছে আহমাদ ইবনে মুনী’ হাদীস বর্ণনা করেছেন যে তিনি ইয়াযীদ ইবনে হারূন থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ থেকে, তিনি ইয়াহইয়া ইবনে আবি কাসির থেকে, তিনি উরওয়াহ থেকে, তিনি উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেনঃ আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না তাই আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম, ‘বাকী’ নামক কবরস্থানে তাকে পেলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তুমি কি আশংকা করেছো যে আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন? আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন, অতঃপর কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন।

হাদিসের মানঃ হাদিসের মান যঈফ। ইমাম তিরমিযী বলেন, আয়িশা (রাঃ) এর এই হাদীস আমি হাজ্জাজের বর্ণিত সনদ (সূত্র) ছাড়া অন্য কোনভাবে চিনি না। আমি মুহাম্মাদকে (ইমাম বুখারী) বলতে শুনেছি যে, তিনি হাদীসটিকে দুর্বল বলতেন। তিরমিযী (রহঃ) বলেন,  ইয়াহ্‌ইয়া ইবনে কাসীর উরওয়াহ থেকে হাদীস শুনেননি। এবং মুহাম্মদ (ইমাম বুখারী) বলেছেনঃ হাজ্জাজ ইয়াহ্‌ইয়াহ ইবনে কাসীর থেকে শুনেননি। এ হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম বুখারী ও ইমাম তিরমিযীর মন্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাদীসটি দুটো দিক থেকে মুনকাতি অর্থাৎ উহার সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন। অপর দিকে এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ মুহাদ্দিসীনদের নিকট দুর্বল বলে পরিচিত। শায়খ বাজ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত অর্থ বহনকারী হাদীছটি কয়েকটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সকল বর্ণনাই যঈফ বা দূর্বল। দেখুনঃ ইমাম আলবানীর তাহ্কীকসহ মিশকাত (১/২৮৯) হাদীছ নং- ১২৯৯। নির্দিষ্টভাবে এ রাতে আল্লাহর দুনিয়ার আকাশে নেমে আসার এবং সকল বান্দাকে ক্ষমা চাওয়ার প্রতি আহবান জানানোর হাদীছটি সুনানের কিতাবে যঈফ ও জাল সনদে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া হাদীছটি বুখারীসহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত সহীহ হাদীছের কিছুটা বিরোধী। সহিহ হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন এবং বলতে থাকেনঃ কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি ক্ষমা করে দিব। অমুক আছে কি? অমুক আছে কি? এভাবে প্রতি রাতেই ঘোষণা করতে থাকেন। দেখুন বুখারী, হাদীছ নং- ১০৯৪, মুসলিম, হাদীছ নং- ১৬৮।

মন্তব্যঃ উপরের আলোচনায় থেকে জানতে পেরেছি হাদিসটির মান যইফ। তারপরও যদি হাদীসটিকে সহিহ বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলেও কি কোন প্রকার আমল প্রমাণিত। না, এ হাদিস দ্বারা কোন আমল প্রমানিত হয় না। এই হাদিসে দ্বারা তিনটি বিষয় পরিস্কার।

১। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক করব জিয়ারত করা

২। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন।

৩। কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন।

যদি কেউ এই হাদিসের আলোকে এই রাতে কবর জিয়ারত করে করতে পারে কিন্তু এই কবর জিয়ারত হবে একাকি, যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন। তিনি সময় সুযোগ থাকা সত্বেও নিজের স্ত্রী বা সাহাবী কাউকে এ আমলে শরীক করান নাই। এ হাদীসে দেখা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানা ছেড়ে চলে গেলেন, আর পাশে শায়িত আয়িশা (রাঃ) কে ডাকলেন না। ডাকলেন না অন্য কাউকে। তাকে জাগালেন না বা সালাত আদায় করতে বললেন না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, রামাযানের শেষ দশকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতে বলতেন। যদি ১৫ শাবানের রাতে কোন ইবাদাত করার ফাযীলাত থাকত তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন আয়িশাকে (রাঃ) বললেন না? কেন রামাযানের শেষ দশকের মত সকলকে জাগিয়ে দিলেন না, তিনি তো নেক কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। কাজেই সম্মিলিতভাবে করব জিয়ারত এই রাতের আমল নয় বিদআত। কিন্তু যারা ঢাকঢোল পিটিয়ে মাসজিদে একত্র হয়ে নানান প্রকারের ইবাদতের মাধ্যমে এই যেভাবে উদযাপন করে, তারা কিভাবে এই হাদিস দিয়ে আমলের পক্ষে দলীল দেয়।

মহান আল্লাহ শুধু মধ্য শাবানের রাত্রি বান্দাদের নিকটবর্তী আকাশে আবির্ভূত এমনটি নয় বরং তিনি প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। যেমন সহিহ হাদিসে এসেছে।

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমাদের রব মহান আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন ও বলতে থাকেনঃ কে আছ আমার কাছে দু‘আ করবে আমি কবুল করব। কে আছ আমার কাছে চাইবে আমি দান করব। কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব। (সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম)

উল্লিখিত হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা মধ্য শাবানের রাতে নিকটতম আকাশে আসেন ও বান্দাদের দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। কিন্তু সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম বর্ণিত এই সহীহ হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষের দিকে নিকটতম আকাশে অবতরণ করে দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। আর এ হাদীসটি সর্বমোট ৩০ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী এবং মুসলিম ও সুনানের প্রায় সকল কিতাবে এসেছে। হাদীসটি প্রসিদ্ধ এবং অনেক আলেম মনে করেন মশহুর হাদীসের বিরোধী বক্তের অংশটুকু সঠিক নয়। কারণ এ হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন মধ্য শাবানের রাতের শুরু থেকে এবং অন্য হাদিসের বক্তব্য হল প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। প্রতি রাতের মধ্যে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতও অনর্ভুক্ত। কাজেই আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ শুধু শাবান মাসের জন্য খাস করা ঠিক হবে না।

এই রাতে ফজিলত আছে, তা হলে আমল করলে ক্ষতি কি?

ফজিলত থাকলেই আমল করার প্রমান বহন করে না। কোন কাজ করলে ইবাদত হবে আর কোন কাজ করলে ইবাদত হবে এর মান দন্ড দিয়েছেন আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কাজেই কোন আমল দ্বারা মহান আল্লাহকে রাজি খুসি করতে হলে সে আমল অবশ্য রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহিহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত হতে হবে। নিজের খেয়াল খুসিমত ইবাদতের পদ্ধতি, সময় সংখ্যা দ্বারা নির্দিষ্ট করা যাবে না। কোন ইবাদাতের ক্ষেত্রে কোন আলেমের মন্তব্য দলীল নয়, বরং দলীল হল আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বানী ও কাজ (সহিহ হাদিস), যদি এই দু’ইয়ের মধ্যে দলীল থাকে তাহলেই আমল অথবা ইবাদাত করা যাবে আর না থাকলে করা যাবে না।

কোন দিন অথবা রাতের ফযিলত থাকলেই তাতে ইবাদাতকরা যাবে বা করতে হবে এরূপ কোন বিধান ইসলামে নেই। যেমনঃ শুক্রবারের ফজিলত সম্পর্কে কয়েকটি সহিহ হাদিসের দিকে লক্ষ করি।।

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যার ওপর সূর্য উদিত হয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল জুমার দিন। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাঁকে জান্নাতে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং এই দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম ১৮৫০ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমরা শেষে এসেছি কিন্তু কেয়ামতের দিন সকলের আগে থাকবো। যদিও অন্য সব জাতিকে (ইহুদি ও খ্রিস্টান) গ্রন্থ দেয়া হয়েছে আমাদের পূর্বে, আমাদের গ্রন্থ দেয়া হয়েছে তাদের পরে। অতপর জেনে রাখো এ দিনটি আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে আমাদের সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। আর অন্য লোকেরা এ ব্যাপারে আমাদের পেছনে আছে। ইহুদিরা জুমার পরের দিন (শনিবার) উদযাপন করে আর খ্রিস্টানেরা তার পরের দিন (রবিবার) উদযাপন করে।’ (সহিহ মুসলিম ১৮৫৪ ইসলামি ফাউন্ডেশন)

এই হাদিস দ্বারা জুমআর দিনের ফযিলত প্রমানিত। ফযিলত প্রমানিত হলে কি আমল প্রমানিত হয় নিম্মের হাদিস দুটি লক্ষ করি।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কোন ব্যক্তি যেন শুধু জুমার দিন সিয়াম না রাখে। হ্যাঁ, জুমার আগের অথবা পরের দিনসহ সিয়াম রাখতে পারে।

হাদিসের মানঃ হাদিসের মান সহিহ। মিশকাত-২০৫১, সহিহ বুখারী ১৯৮৫, সহিহ মুসলিম ১১৪৪, তিরমিযী ৭৪৩, আবূ দাঊদ ২০৯১)।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ অন্যান্য রাতগুলোর মধ্যে লায়লাতুল জুমাকে ‘ইবাদাত বন্দেগীর জন্য খাস করো না। আর ইয়াওমুল জুমাকেও (জুমার দিন) অন্যান্য দিনের মধ্যে সিয়াম জন্য নির্দিষ্ট করে নিও না। তবে তোমাদের কেউ যদি আগে থেকেই অভ্যস্ত থাকে, জুমাহও এর মধ্যে পড়ে যায়, তাহলে জুমার দিন সিয়ামে অসুবিধা নেই।

হাদিসের মানঃ হাদিসের মান সহিহ। (মিশকাত-২০৫২, মুসলিম ১১৪৪, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৪৯০, সহীহাহ্ ৯৮০, সহীহ আল জামি‘ ৭২৫৪)।

উপরের হাদীস থেকে প্রমানিত হয় যে জুমআর দিন খাস করে কোন প্রকার সিয়াম পালন করা যাবে না। তবে হ্যা, যারা নিয়মিত সিয়াম আদায় করে তারা রাখতে পারে বা এর সাথে আরেক দিন বাড়িয়ে সিয়াম পালনের নির্দেষ প্রদান করে। ঠিক তেমনিভাবে এ উপলক্ষে কোন ইবাদাত করা যাবে না, কিন্তু জুম’আর দিনের ফযিলত তো রয়েছে। তার পরও জুম’আর দিন উপলক্ষে ইবাদাত করা যাবে না।

এছাড়াও ফযিলতের সাথে ইবাদাতের কোন সম্পর্ক নেই, এর আরেকটা উদাহরন হল লাইলাতুল ক্বাদর।
আমরা জানি যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাইলাতুল ক্বাদর এর ফযিলত সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং ইবাদাত সম্পর্কেও বর্ণনা করেছেন। যদি এমনটি হত যে ফযিলত থাকলেই ইবাদাত করতে হবে বা করা যাবে তাহলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাইলাতুল ক্বাদর এর ইবাদাতের ব্যাপারে কিছু বলতেন না শুধু মাত্র ফযিলতের কথাই বলতেন, কেননা ফযিলতের কথা বললে ইবাদাত এমনিতেই করবে, কিন্তু তিনি এমনটি করেন নি বরং ফযিলতের সাথে সাথে ইবাদাতের কথাও বলেছেন, এটাই প্রমান করে যে ফযিলতের সাথে ইবাদাত সম্পৃক্ত নয়। কেননা যদি সম্পৃক্ত থাকতো তাহলে ইবাদাতের কথা আর বর্ণনা করার প্রয়োজন পড়তো না কারন ফযিলতের বিষয় তো বর্ণনা করা হয়েছে। ফযিলত থাকলেই ইবাদাত থাকবে এমন কোন কথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময় ছিল না, এটাই তার প্রমান।

জুম’আর দিনের তো ফযিলত রয়েছে তার পরও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুম’আর দিন উপলক্ষে বাড়তি ইবাদাত করতে নিষেধ করাতে এটাই প্রমান হয় যে ফযিলত থাকলেই ইবাদাত করা বৈধ হবে না, বরং ইবাদাত করার জন্য ইবাদাতের নির্দেশ থাকতে হবে।

সুতরাং ফযিলত থাকলেই ইবাদাত করা যাবে না, বরং ইবাদাত করার জন্য কুরআন ও সহিহ হাদিস থেকে দলীল প্রয়োজন। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাবে যা এর মধ্যে নেই, তা তার উপর নিক্ষিপ্ত হবে। (সহিহ বুখালী ২৬৯৭)।

সুতরাং প্রকৃত পক্ষেই লাইলাতুর নিসফে মিন শাবার বা মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ পাক মুশরিক ও সুন্নত বিরোধী অথবা বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যাক্তি ব্যাতিত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। এই রাতের ফযিলত স্বীকার করেছেনঃ

১। ইমাম শাফেঈ রাহমাতুল্লাহিআলাইহি। (কিতাবুল উম্ম, ১মখণ্ড, পৃঃ ২৩১)

২। ইমাম আহমাদ রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।(ইবনে তাইমিয়া তার ইকতিদায়ে ছিরাতেমুস্তাকীমে (২/৬২৬) তা উল্লেখ করেছেন)

৩। ইমাম আওযায়ী রাহমাতুল্লাহিআলাইহি। (ইমাম ইবনে রাজাব তার ‘লাতায়েফুল মা‘আরিফ’ গ্রন্থে (পৃঃ১৪৪) তার থেকে তা বর্ণনা করেছেন)

৪। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহিআলাইহি। (ইকতিদায়ে ছিরাতেমুস্তাকীম ২/৬২৬,৬২৭, মাজমু‘ ফাতাওয়া ২৩/১২৩, ১৩১,১৩৩,১৩৪)।

৫। ইমাম ইবনে রাজাব আল হাম্বলী রাহমাতুল্লাহিআলাইহি। [তার লাতায়েফুল মা‘আরিফ পৃঃ১৪৪ দ্রষ্টব্য]।
৬।প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দিন আল-আলবানী রাহমাতুল্লাহিআলাইহি। (ছিলছিলাতুল আহাদীস আসসাহীহা ৩/১৩৫-১৩৯)

৭। বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেম মুফতি কাজী ইবরাহিম

সুতরাং লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান অথবা শবে বরাতের ফযিলত প্রমানিত। যারা এই রাতে ইবাদাতের পক্ষে কথা বলেন তারা এই বলে যুক্তি দেন যে, ফযিলতপূর্ণ রাত কি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিব? এটা তো অযৌক্তিক। এছাড়া তাদের আর কোন দলীল ও যুক্তি নেই।

এই রাতে ব্যাক্তিগত ইবাদাত করার পক্ষে মত দিয়েছেনঃ

১। ইমাম আওযা‘য়ী রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

২। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

৩। আল্লামা ইবনে রজব রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

এইরাত উপলক্ষে যে কোন ইবাদাত করা কে বিদ’আত বলেছেনঃ

১। প্রখ্যাত তাবেয়ী ইমাম ‘আতা ইবনে আবি রাবাহ রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

২। ইবনে আবি মুলাইকা রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

৩। মদীনার ফুকাহাগণ

৪। প্রখ্যাত তাবে-তাবেয়ী আব্দুর রাহমান ইবনু যায়েদ ইবনু আসলাম রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

৫। ইমাম মালেকের ছাত্রগণ

৬। শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে বায রাহমাতুল্লাহিআলাইহি।

তবে ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ এই রাতকে কেন্দ্র করে কোন ইবাদাত এর পক্ষে বা বিপক্ষে মত দিয়েছেন বলে যানা যায় না।

হাদিস নম্বরঃ-৫

আলা ইবনে হারিস থেকে বর্ণিত, আয়িশা (রাঃ) বলেনঃ এক রাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। সিজদাহ এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ধারণা করলাম তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আমি এ অবস্থা দেখে দাড়িয়ে তার বৃদ্ধাঙ্গুল ধরে নাড়া দিলাম, আঙ্গুলটি নড়ে উঠল। আমি চলে এলাম। সালাত শেষ করে তিনি বললেন, হে আয়িশা অথবা হে হুমায়রা! তুমি কি মনে করেছ আল্লাহর নবী তোমার সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন? আমি বললামঃ আল্লাহর কসম হে রাসূল! আমি এমন ধারণা করিনি। বরং আমি ধারণা করেছি আপনি না জানি ইন্তেকাল করলেন! অতঃপর তিনি বললেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললামঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। তিনি বললেন, এটা “লাইলতুল নিসফে মিন শাবান” বা মধ্য শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং রাহমাত প্রার্থনাকারীদের রহম করেন। আর হিংসুকদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন। (বাইহাকী তার শুয়াবুল ঈমান কিতাবে বর্ণনা করেছেন)

মন্তব্যঃ হাদীসটি মুরসাল। সহীহ বা বিশুদ্ধ নয়। হাদিসের বর্ণনা সাহাবী পর্যান্ত পৌছায় নই। বর্ননাকারী ‘আলা’ আয়িশা (রাঃ) থেকে শুনেননি।

হাদিস নম্বরঃ-৬

শবে বরাত পালনকারীগন যে হাদিসের আলোকে রাতে সালাত আয়াদ করে দিনে সিয়াম পালন করে তা হল, আলী ইবনে আবী তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সূর্য অস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিজিক প্রার্থনাকারী আমি রিজিক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যান্ত বলা হয়ে থাকে। (হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে ১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৮; বর্ণনা করেছেন; বাইহাকীদে হাদিসটি আছে)

মন্তব্যঃ এই হাদিসটি জাল। আল্লামা বুছীরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তার যাওয়ায়েদে ইবনে মাজাহ (২/১০) গ্রন্থে বলেন, অধিকাংশ হাদীস বিশারদের নিকট হাদীসটির বর্ণনাকারী হিসাবে ইবনে আবি সুবরাহ রয়েছেন যিনি হাদীস বানাতেন বা জাল করতেন। এ যুগের বিখ্যাত মুহাদ্দিস নাসিরুদ্দীন আল-বানী (রহঃ) বলেছেন, হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে একেবারেই দুর্বল বা যইফ। অপর পক্ষে একটি সহীহ হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে এ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়। সে সহিহ হাদীসটি হাদীসে নুযুল নামে পরিচিত, যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন। তাই হাদীসটি বানোয়াট। হাদিস জাল রচনাকারী একজন রাবী থেকে এরূপ আরেকটি হাদিস ইবনে মাজাহ উল্লেখ করেছেন। হাদিসটি হলঃ শাবান মাসের মধ্যরাত এলে তোমরা রাতে কিয়াম কর এবং দিনে ছিয়াম পালন কর। এই হাদীছের সনদে ইবনে আবু সাবরাহ নামক একজন জাল হাদীছ রচনাকারী রাবী থাকার কারণে হাদীছটি গ্রহণযোগ্য নয়। (দেখুনঃ সিলসিলায়ে যাঈফা, হাদীছ নং- ২১৩২)

মন্তব্যঃ এই হাদিসটি জাল বিধান এর কোন প্রকার হুকুম মানা যাবে না। উম্মতের মাঝে ঐক্যমত আছে কোন প্রকারের জাল হাদিসের উপর আমল করা যাবে না। এই হাদিসে বলা  হয়েছে, যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এত আত্মভোলা নয় যে তিনি সালাত ও সিয়ামের কথা বলবেন বলতে ভুলে গেলের।

হাদিস নম্বরঃ-৭

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন হে আলী, যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের রাত্রিতে এমনভাবে একশত রাকাত নামায আদায় করবে যে, প্রতি রাকাআতে সূরা ফাতিহার পরে দশবার কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’সূরা পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তার সে রাত্রির যাবতীয় প্রার্থনা পূরণ করবেন।

মন্তব্যঃ  হাদিসটির মান জাল। ইব্‌নুল জাওযী উক্ত হাদীসটি মাওয়ুআত কিতাবে তিনটি সনদে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি যে বানোয়াট তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনটি সনদেই এমন সব বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের অধিাকংশরই পরিচয় অজ্ঞাত। আরও কতিপয় বর্ণনাকারী খুব দূর্বল। সুতরাং হাদীসটি নিশ্চিতভাবে জাল। ইব্‌নুল কায়্যেম জাওযিয়াহ আল মানারুল মুনীফ কিতাবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন: জাল হাদীস সমূহের মধ্যে অর্ধ শাবানের রাত্রের নামায পড়া সম্পর্কীত উক্ত হাদীসটি অন্যতম। এর পর তিনি বলেন: আজব ব্যাপার হল, কিছু মানুষ যারা হাদীসের কিছু ঘ্রাণ পেয়েছে তারাও এ সকল উদ্ভট হাদীস দেখে প্রতারিত হয়ে শবে বরাতের নামায পড়া শুরু করে দেয়। অনুরূপভাবে ইমাম সুয়ূতী রা. উপরোক্ত হাদীসটি আল লাআলী আল মাসনূআ ’ কিতাবে উল্লেখ করে সেটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তদ্রুপ ইমাম শাওকানী রা. এটিকে আল ফাওয়ায়েদুল মাজমূআহ কিতাবে জাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

হাদিস নম্বরঃ-৮

যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের রাতে বার রাকাত নামায পড়বে-প্রতি রাকাতে কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’সূরাটি পড়বে ত্রিশ বার তাহলে সে জান্নাতে তার আসন না দেখে বের হবে না।

হাদিসটির মানঃ হাদিসটির মান জাল। এ হাদীসটিও ইব্‌নুল জাওযী রা. তার আল মাওযূআত কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এ হাদীসটির সনদে এমন একদল বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের সকলের পরিচয় অজ্ঞাত। অনুরূপভাবে ইমাম সূয়ূতী রাহ. আল লাআলী কিতাবে এবং ইমাম ইব্‌নুল কয়্যেম (রাহ:) আল মানারুল মুনীফ কিতাবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে এটিকে জাল হাদীস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন)।

হাদিসে এই রাতের আমল সম্পর্কে কোন প্রমান আছে কি?

উপরের হাদিসগুলি থেকে এ কথা স্পষ্ট যে হাদিসের কোথাও শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাত নামের কোন রাতের কথা বলা হয়নি। কিন্তু কিছু হাদিসে‘ লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত্রি ফজিলত বর্নিত হয়েছে। ইহার মধ্য একটি যঈফ হাদিস কয়েকটি সনদের কারনে নাসিরউদ্দন আলবাণী রাহিমাহুল্লাহ হাদিসটি সহিহ বলেছেন (হাদিস নম্বর-১)। বাকি সবগুলি (হাদিস নম্বর ২-৮) হয় যঈফ না হয় জাল। বহু গবেষনার পর শাইখ বাজ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “শবে বরাত সম্পর্কিত সকল হাদিস হয় জাল, না হয় যঈফ”।  যে হাদিসে (৬ নম্বর) দিনে সিয়াম ও রাতে কিয়ামের কথা বলা হয়েছে সে হাদিসটি কিন্তু জাল। এই জাল হাদিসের উপর ভিত্তি করেই শবে বরাতের দিনে সিয়াম ও রাতে কিয়ামের আমল যুগ যুগ ধরে মুসলীম সমাজে চালু আছে। এই ব্যাপারের আলেমগন ঐক্যমত প্রষণ করেছেন যে, সকল প্রকারের সহিহ হাদিসের উপর আমল করা যাবে এবং কোন জাল হাদিসের উপর আমল করা যাবে না। কিন্ত যঈফ হাদিসের উপর আমলের ক্ষেত্র দুটি মত পাওয়া যায়। আলমদের একদল বলছেন, যঈফ হাদিস থেকে কোন প্রকার আমল করা যাবে না। অন্যদল বলছেন, যঈফ হাদিসের উপর আমল করা যাবে। কিন্তু লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত্রি ফজিলত বর্ণিত হাদিস দ্বারা আমলের রেওয়াজ চালু করার কোন যুক্ত নেই। যদি কোন আমল করা খাস হত তবে আমাদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও ছাড়তেন না। কমছে কম কোন সাহাবি দ্বারা এর প্রমান পাওয়া যেত। অথচ কোন সহিহ বা যঈফ হাদিসে আমলের কোন প্রমান পাওয়া যায় না। যে সকল হাদিসে আমলের ঘ্রান পেলাম তা জাল। আর উম্মতের মাঝে ইজমা বা ঐক্যমত হল জাল হাদিসের উপর আমল করা জায়েয নয়। আমারা হাদিসের বর্ণার ক্ষেতে সহিহ, যঈফ, হাসান ও জাল কথাগুলি ব্যবহার করছি। তাই বিষয়টি ভালভাবে বুঝার জন্য সহিহ হাদিস, হাসান হাদিস, জাল হাদিস ও যঈফ হাদিস সম্পর্কে একটু ধারনা থাকা দরকার। তাই খুবই সংক্ষেপে এই সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা হল।

সহিহ হাদিসঃ মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় যে হাদিসের মধ্যে পাঁচটি শর্ত পূরণ হয়েছে তাকে সহিহ হাদিস বলা হয়। শর্ত পাঁচট হলোঃ

১। আদালত  (হাদীসের সকল রাবী পরিপূর্ণ সৎ ও বিশ্বস্ত বলে প্রমাণিত)

২। যাবত (সকল রাবীর ‘নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা’ পূর্ণরূপে বিদ্যমান বলে প্রমাণিত)

৩। ইত্তিসাল (সনদের প্রত্যেক রাবী তাঁর উর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেছেন বলে প্রমাণিত)।

৪। শুযূয মুক্তি (হাদীসটি অন্যান্য প্রামাণ্য বর্ণনার বিপরীত বলে প্রমাণিত নয়)। এবং

৫। ইল্লাত মুক্তি (হাদীসটির মধ্যে সূক্ষ্ম কোনো সনদগত বা অর্থগত ত্রুটি নেই বলে প্রমাণিত)।

(ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ. ২৩-২৫; ফাতহুল মুগীস, পৃ. ৭-৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/২৫-৩১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/৬৩-৭৪; মাহমুদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৩৪-৩৬, উত্সগুলি হাদিসের নামে জালিয়াতি নামক গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে)।

হাসান হাদিসঃ উপরোক্ত ৫টি শর্তের বিদ্যমানতা অপরিহার্য। তবে দ্বিতীয় শর্তের মধ্যে যদি সামান্যতম দূর্বলতা দেখা যায় তবে হাদীসটিকে ‘হাসান’ (সুন্দর বা গ্রহণযোগ্য হাদীস) বলা হয়। অর্থাৎ হাদীসের সনদের রাবীগণ ব্যক্তিগতভাবে সৎ, প্রত্যেকে হাদীসটি উর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে শুনেছেন বলে প্রমাণিত, হাদীসটির মধ্যে ‘শুযূয’ বা ‘ইল্লাত’ নেই। তবে সনদের কোনো রাবীর নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা বা ‘যাবত’ কিছুটা দুর্বল বলে বুঝা যায়। তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। এইরূপ ‘রাবী’র বর্ণিত হাদীস ‘হাসান’ বলে গণ্য। (ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ. ৪৫-৬১; ফাতহুল মুগীস, পৃ.৩২-৪৮; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/৭৬-১১০; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৫৩-১৭৮; মাহমূদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৪৫-৫০)।

যঈফ বা দুর্বল হাদীসঃ যে ‘হাদীসের’ মধ্যে হাসান হাদীসের শর্তগুলির মধ্যে কোনো একটি অবিদ্যমান থাকে, মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে ‘যয়ীফ’ হাদীস বলা হয়। অর্থাৎ রাবীর বিশ্বস্ততার ঘাটতি, তাঁর বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা বা স্মৃতির ঘাটতি, সনদের মধ্যে কোনো একজন রাবী বা তাঁর উর্ধ্বতন রাবী থেকে থেকে সরাসরি বা স্বকর্ণে হাদীসটি শুনেননি বলে প্রমাণিত হওয়া বা দৃঢ় সন্দেহ হওয়া, হাদীসটির মধ্যে ‘শুযূয’ বা ‘ইল্লাত’ বিদ্যমান থাকা…..ইত্যাদি যে কোনো একটি বিষয় কোনো হাদীসে বিদ্যমান থাকলে হাদীসটি ‘যয়ীফ’ বলে গণ্য। (ইরাকী, আত তাকয়ীদ, পৃ.৬২; ফাতহুর মুগীস পৃ.৪৯; সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ১/১১১; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/১৭৯; মাহমুদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহ, পৃ. ৬২-৬৩)।

মাউযূ বা জাল হাদীসঃ যদি প্রমাণিত হয় যে, এরূপ দুর্বল হাদীস বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূলুল্লাহ (স) এর নামে সমাজে প্রচার করতেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে হাদীসের সূত্র (সনদ) বা মূল বাক্যের মধ্যে কম বেশি করতেন, তবে তার বর্ণিত হাদীসকে ‘মাউযূ’ বা বানোয়াট হাদীস বলে গণ্য করা হয়। বানোয়াট হাদীস জঘন্যতম দুর্বল হাদীস। (বিস্তারিত দেখুনঃ হাকিম নাইসাপুরী (৪০৫ হি), মারি’ফাতু উলুমিল হাদীস, পৃ. ১৪-১৭. ৩৬-৪০, ৫২-৬২, ১১২-১৫১, আল ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ. ৭-৫১, ১৩৮-১৭৮, আত তাকয়ীদ ওয়াল ইদাহ, পৃ.২৩-৬৩, ১৩৩-১৫৭, ৪২০-৪২১, ড. মাহমুদ তাহহান, তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস, পৃ. ৩৩-১২৫, ১৪৪-১৫৫)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন নাম ব্যবহার করে প্রচারিত বানোয়াট হাদিস। এধরনের হাদিসের বর্ণনাকারিদের মধ্যে এক বা একাধিক জন প্রতারক এবং কুখ্যাত হাদিস জালকারি বলে স্বীকৃত। অনেক সময় বর্ণনাকারিদের নামগুলোও মিথ্যা বানানো। এছাড়াও হাদিসটি কোন স্বীকৃত হাদিস গ্রন্থে পাওয়া যায়নি। অনেক সময় এধরনের হাদিস পীর, দরবেশ, আলেমরা নিজেরাই বানিয়ে প্রচার করেছেন কোন বিশেষ স্বার্থে। মাউযূ বা জাল হাদীস হাদিস গ্রহনের ফলে যুগে যুগে মুসলীমদের আকিদা ও আমলের ক্ষেত্রে বহু বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়েছে।

দুর্বল বা যঈফ হাদিসে কি সত্যিই আমল করা যায় না?

প্রাজ্ঞ আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, দুর্বল হাদীস দ্বারা কোন আহকাম বিধান প্রমাণ করা যায় না। যঈফ বা দুর্বল হাদীসের উপর আমল করার জন্য কয়েকটি শর্ত লাগিয়েছেন তারা। শর্তগুলো নিম্নরূপঃ

১. হাদীসটির মূল বক্তব্য অন্য কোন সহীহ হাদীসের বিরোধীতা করবেনা, বরং কোন শুদ্ধ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

২. হাদীসটি একেবারেই দুর্বল অথবা বানোয়াট হলে চলবে না।

৩. হাদীসটির উপর আমল করার সময় এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত বলে বিশ্বাস করা যাবে না। কারণ রাসূল থেকে প্রমাণিত বলে বিশ্বাস করলে রাসূলের উপর মিথ্যাচারিতার পাপ হবে, ফলে জাহান্নাম অবধারিত হয়ে পড়বে।

৪. হাদীসটি ফাদায়িল তথা কোন আমলের ফযীলত বর্ণনা সংক্রান্ত হতে হবে। আহকাম (ওয়াজিব, মুস্তাহাব, হারাম, মাকরূহ) ইত্যাদি সাব্যস্তকারী না হতে হবে।

৫. বান্দা ও তার প্রভুর মাঝে একান্ত ব্যক্তিগত কোন আমলের ক্ষেত্রে হাদীসটির নির্ভরতা নেয়া যাবে। তবে এ হাদীসের উপর আমল করার জন্য একে অপরকে আহবান করতে পারবে না।

মন্তব্যঃ এই শর্তাবলীর আলোকে যদি উপরোক্ত হাদীসগুলো পরীক্ষা করে দেখি তাহলে দেখতে পাই যে, উপরোক্ত হাদীসসমূহের মধ্যে ৬ নম্বরে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসটিসহ ৭ এবং ৮ নম্বর হাদিস দুটি জাল বা বানোয়াট। সুতরাং তার উপর আমল করা উম্মাতের আলেমদের ঐক্যমতে জায়েয হবে না। আর ১ নম্বর থেকে ৫ নম্বর পর্যান্ত হাদিসে মধ্য শাবানের ফজিলত বর্ণনা করলেও কোন প্রমান আমলের কথা নেই। তাই নির্দিধায় বলা যায় শবে বরাত তথা মধ্য শাবান রাতের কোন আমল নেই। যদি কেউ অন্য রাতের মত এ রাতেও আমল করে ক্ষতি নেই। কিন্তু ঢাকঢোল পিটিয়ে সম্মিলীতভাবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করা বিদআত হবে।

 

৩। ফিকহের কিতাব থেকে দলীলঃ  

শুধু আল-কুরআনে কিংবা সহিহ হাদীসে নেই, বরং ফিক্‌হের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলো পড়েও শবে বরাত সম্পর্কে কিছু পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলো ফিকহের সিলেবাস হিসাবে মালাবুদ্দা মিনহু, নুরুল ইজাহ, মুখতাসাতুল কুদুরী, কানযুদ দাকায়েক, শরহে বিকায়া, হিদায়াহ ইত্যাদি কিতাবগুলি পড়ে থাকে। এই সকল কিতাবেগুল খুলে দেখুন না, কোথাও শবে বরাত নামের কিছু পাওয়া যায় কিনা। অথচ আমাদের পূর্বসূরী ফিকাহবিদগণ ইসলামের অতি সামান্য বিষয়গুলো আলোচনা করতেও কোন ধরনের কার্পণ্যতা দেখাননি। তারা সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণের সালাত সম্পর্কেও অধ্যায় রচনা করেছেন। অনুচ্ছেদ তৈরী করেছেন কবর যিয়ারতের মত বিষয়েরও। শবে বরাতের ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহর সামান্যতম ইশারা থাকলেও ফিকাহবিদগণ এর আলোচনা মাসয়ালা-মাসায়েল অবশ্যই বর্ণনা করতেন।

আমাদের সালাফদের কিছু বক্তব্য অবশ্য অনুধাপন যোগ্যঃ

এ সম্পর্কে সাহাবীদের কোন বক্তব্য বা আসার পাওয়া যায় না। তাবেয়ী যুগ থেকেই কোন কোন তাবেয়ী গুরুত্ব না দিয়ে লাইলাতুল নিসফে মিন শাবান বা শাবানের মধ্য রাতে কিছু ইবাদত করতে থাকে এবং তখনই আবার অনেক তাবেয়ী এর প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু তারা লাইলাতুল কদর বা ভাগ্য রজনী বলে কিছু বলেন নাই বা তারা জানতেনও না। লাইলাতুল নিসফে মিন শাবান বা শাবানের মধ্য রাতের ইবাদাত সম্পর্কে দু ধরনের মতামত পাওয়া যায়। আলোচনায় নিরপেক্ষ রাখার শার্থে দু ধরনের (পক্ষে এ বিপক্ষে) আলেমদের মতামতই তুলে ধরব।

যারা শবে বরাতে ফজিলতের পক্ষ কথা বলেছেনঃ

১। প্রখ্যাত ফকীহ আল্লামা ইবন আবেদীন শামী বলেন, “নির্দিষ্ট সংখ্যার হিসাব না করে একাকি নফল নামায আদায় করা, কুরআন-হাদিস পাঠ ও শ্রবণ করা, তাসবিহ,আল্লাহর প্রশংসা এবং নবীর ওপর দরূদ শরিফ পাঠের মাধ্যমে লাইলাতুল বরাত উদ্যাপন করা হয়ে থাকে।”(ইবন আবেদীন শামী, রাদ্দুল মুহতার, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৪২১ হিজরী, খ. ২য়, পৃ: ২৬)

২। ইমাম হাসান শুরুনবুলালি বলেন, “লাইলাতুল বরাত উদ্যাপন করা মুস্তাহাব। কেননা এ রাত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং এ রাতে রিযিক বন্টন করা হয় আর মৃত্যু নির্ধারণ করা হয়।”(ইমাম হাসান শুরুনবুলালি, মারাকিল ফালাহ,আল-মাকতাবাতুল আসরিয়্যাহ,বৈরুত, ১৪২৫হি,খ.১,পৃ.৭৩)

৩। ফকীহ মনসুর বিন ইউনুস বুহুতী হাম্বলী বলেন, “শাবান মাসের পনের তারিখ কিয়ামুল লাইল তথা ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপন করা মুস্তাহাব।”(ইমাম বহুতী, কাশফুল ক্বিনা ১/২, দারুল ফিকর, বৈরুত)।

৪। আল্লামা রুহায়বানী হাম্বলী বলেন, “শাবান মাসের পনের তারিখ রাত ঈদের রাতের মত কিয়ামুল লাইল তথা ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপন করা মুস্তাহাব।”(রুহায়বানী, মাতালিবু উলির নেহী, আলমাকতাবাতুল ইসলামী, দামেস্ক, ১৯৬১ ইং, খ: ১ম, পৃ: ৫৮১)

৫। আব্দুল কাদের জিলানি হাম্বলী আলাইহির রাহমাহ বলেন, “কতিপয় আলেম ওই চৌদ্দটি রাতকে একত্রে করে লিখেছেন, যেগুলো কে ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপন করা মুস্তাহাব। তিনি বলেন, এ রাতগুলোর সংখ্যা হচ্ছে বছরে চৌদ্দটি। এর মাঝে তিনি শাবানের মধ্য রাতের কথাও বলেছেন। (আব্দুল

৬। ইবন রজব হাম্বলীর মতেও এ রাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব। এ রাতে রাসূলুল্লাহ্ পরিপূর্ণ রাত ইবাদত করতেন।( ইবনু রজব হাম্বলি,প্রাগুক্ত,পৃ.১৩৮)

৭। আল্লামা ইবনুল হাজ্ব মালেকী বলেন, শাবান মাসের পনের তারিখের রাতটি যদিও লাইলাতুল কদর নয়, তথাপি অত্যাধিক সম্মানিত ও বরকতময়। সলফে সালেহীনরা এ রাতকে খুব সম্মান করতেন এবং এ রাত আগমণ করার পূর্বে এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। আগমনের পর শরিয়ত সমর্থিত বিষয়ের মাধ্যমে এর সম্মান করতেন।”(ইবনুল হাজ্ব মালেকী, আল-মাদহাল, দারুল ফিকর,১৪০১ হিজরী, খ: ১ম, পৃ: ২৯৯)

৮। দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া : “এ রাত অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ। এ রাতে একাকী নামাজ পড়া, কুরআন তিলাওয়াত করা, যিকির করা, কবর যিয়ারত করা, দোয়া এবং ক্ষমা চাওয়া মুস্তাহাব। তবে সম্মিলিতভাবে মসজিদে নয়।”(ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ,ভারত,খ.১,পৃ.১০২ ও ২৯৩)

৯। আশরাফ আলী থানভী বলেন, ‘১৫ শাবান রাত জেগে ইবাদত করা উত্তম। প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক। (মাওলানা আখতারুজ্জমান,লাইলাতুম মুবারাকাহ্,আজিমপুর দায়রা শরিখ খানকা, ঢাকা, ২য় সংস্করণ,২০০৭ইং,পৃ,৫২)

১০। আব্দুল হাই লাকনভী বলেন“লাইলাতুল বরাতে জাগ্রত থেকে ইবাদতে মশগুল থাকার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। এ ব্যাপারে ইমাম ইবন মাজাহ এবং ইমাম বায়হাকি হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণনা করেন,রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন-“শা’বান মাসের পনের তারিখ উপনীত হলে তোমরা ইবাদতের মাধ্যমে রাত উদ্যাপন কর এবং দিনে রোযা রাখ। কেননা, মহান রাব্বুল আলামীন সূর্য অস্তমিত হবার পর প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়ে বলেন, ক্ষমা প্রার্থনা করার কে আছে, যাকে আমি ক্ষমা করব? রিযিক প্রার্থনা করার কে আছে, যাকে আমি রিযিক প্রদান করব? কে বিপদগ্রস্ত আছে, যাকে আমি বিপদ মুক্ত করব? এভাবে ফজর পর্যন্ত বিভিন্ন কিছু প্রার্থনার জন্য আহ্বান করতে থাকবেন।”…উল্লিখিত বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই রাতে অধিক ইবাদত,দুয়া,কবর যিয়ারত এবং মৃতদের জন্য দুয়া করতেন। সকল প্রকার হাদিসে কাওলি এবং হাদিসে ফে’লি দ্বারা ঐ রাতে অধিক পরিমাণে ইবাদত করা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়েছে। নামায বা অন্য ইবাদত করার ব্যাপারে সে স্বাধীন। যদি নামায পড়াকে সে গুরুত্ব দেয়, তাহলে সে যত রাকাত ইচ্ছা পড়তে পারবে। যে বিষয় নিষেধ হবার ব্যাপারে রাসূলের কোন নির্দেশ সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতে রয়েছে, তা অবশ্য বর্জনীয়।”(আব্দুল হাই লকনবী, আল-আছারুল মারফুয়াহ, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, খ. ১ম পৃ: ৮১-৮২)

১১।  নির্ভরযোগ্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ইবনে তাইমিয়া হাম্বলী বলেন-

শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের ফযিলত সম্পর্কে অসংখ্য শুদ্ধ হাদিস রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে এ রাতের মর্যাদা বোঝা যায়। সলফে সালেহীনগণ এ রাতে নামাজ পড়ার জন্য নির্ধারণ করে রাখতেন এবং দিনে রোজা রাখতেন। কেননা এ ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদিস রয়েছে। পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের কিছু আলেম এ রাতের মর্যাদাকে অস্বীকার করেছে এবং সহীহ হাদিসের ওপর অপবাদ দিয়েছে। কিন্তু আমাদের হাম্বলী মাযহাবসহ অন্যান্য মাযহাবের অধিকাংশ আলেমদের মতে এ রাতটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল এর মতও এটি। কেননা এ ব্যাপারে অসংখ্য হাদিস শরিফ রয়েছে।”(ইমাম ইবন তাইমিয়া,ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম,দারু আলামিন কুতুব, বৈরুত, ৭ম সংস্করণ, ১৪১৯হি, খ.২, পৃ.৯৭)

১২। প্রখ্যাত আলেম শায়খ আব্দুর রহমান মুবারকপুরী শবে বরাত উদযাপনের পক্ষে একাধিক হাদিস উল্লেখ করে বলেন, এ সকল হাদিস তাদের জন্য প্রমাণ,যারা মনে করে যে, শবে বরাতের কোন ফযিলত প্রমাণিত নয়।”(শায়খ মুবারকপুরী,তুহফাতুল আহওয়াযি,দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ,বৈরুত,খ.৩,পৃ.৩৬৭)

১৩। নির্ভযোগ্য ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানি স্বীয় কিতাব “সিলসিলাতুল আহাদীসিল সহিহা” গ্রন্থে লাইলাতুল বরাত সম্পর্কিত অনেক হাদিস উল্লেখ করত: এগুলোর মান যাচাই করার পর বলেন-“সার কথা হল (হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা থেকে বর্ণিত উপরিউক্ত) হাদিস শরিফটি (বর্ণিত) সকল সূত্রের সমন্বয়ে নি:সন্দেহে সহিহ। হাদিস অতিশয় দুর্বল না হলে আরো কম সংখ্যাক সূত্রে বর্ণিত হাদিস দ্বারা হাদিসের বিশুদ্ধতা প্রমাাণিত হয় তথা কোন দুর্বল হাদিসও অন্য সূত্রের কারণে সহিহ হয়ে যায় যেমন এ হাদিসে(শবে বরাত বিষয়ে হযরত আয়েশ সিদ্দিকা রা: থেকে বর্ণিত ) হয়েছে। শাইখ কাসেমি তাঁর ‘ইসলাহুল মাসাজিদ’ গ্রন্থের ১০৭ পৃষ্ঠায় হাদিস বিশারদগণের উদ্ধৃতিতে লিখেছেন যে, ‘শবে বরাতের ফযিলত সম্পর্কে কোন সহিহ হাদিস নেই।’ তাঁর এ কথার ওপর আস্থা রাখা উচিত নয়। আর যদি তাঁদের থেকে কেউ এ কথা বলেও ফেলে,তাহলে বুঝতে হবে যে,চিন্তা-ভাবনা ছাড়া অতি তাড়াহুড়া হেতু এবং বর্তমান পদ্ধতির ন্যায় হাদিসের বিভিন্ন সূত্র অন্বেষণের প্রচেষ্টা সীমিত হবার কারণেই এমনটা হয়েছে। তবে তিনি এ রাতে বিশেষ কোন এবাদত করাকে বিদআত বলে উল্লেখ করেছেন এবং কঠোর ভাষায় তার প্রতিবাদ করেছেন। মহান আল্লাহই তাওফিকদাতা।”(নাসিরুদ্দিন আলবানি,‘সিলসিলাতুল আহাদীসিল সহিহা’,দারুল মায়ারিফ,রিয়াদ,খ.৩,পৃ.২১৮ বা সিলসিলায়ে সহাহা, হাদীছ নং- ১১৪৪)

১৪। ইমাম আওযায়ীঃ এ রাতে মাসজিদে একত্র হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করা মাকরূহ, তবে কেহ ব্যক্তিগতভাবে ইবাদাত-বন্দেগী করলে তাতে দোষের কিছু নেই। এ মত পোষণ করে বর্তমনে আমাদের উপমহাদেশের দেওবন্দ অনুসারী আলেমগন। তারা বলেন এই রাতে ব্যক্তিগতভাবে কিছু ইবাদাত করা যায় কিন্তু সম্মিলিতভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে ইবাদাত করা যাবে না।

১৫। আল কাউসার সম্পাদক মাওলানা আব্দুল মালেকঃ তিনি বলেন, এক শ্রেণীর মানুষ বাড়াবাড়িতে লিপ্ত ছিল। তারা এ রাতটি উপলক্ষে নানা অনুচিত কাজকর্ম এবং রসম-রেওয়াজের অনুগামী হচ্ছিল। উলামায়ে কেরাম সবসময়ই সবের প্রতিবাদ করেছেন এবং এখনো করছেন। ইদানিং আবার এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ছাড়াছাড়ির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাদের দাবী হল ইসলামে শবে বরাতের কোন ধারণা নেই। এ ব্যাপারে যত রেওয়ায়েত আছে সব মওযু বা যয়ীফ। এসব অনুযায়ী আমল করা এবং শবে বরাতকে বিশেষ কোন ফযীলতপূর্ণ রাত মনে করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয নয়। তারা এসব বক্তব্য সম্বলিত ছোটখাট পুস্তিকা ও লিফলেট তৈরী করে মানুষের মধ্যে বিলি করে।

বাস্তব কথা হল, আগেকার সেই বাড়াবাড়ির পথটিও যেমন সঠিক ছিল না, এখনকার এই ছাড়াছাড়ির মতটিও শুদ্ধ নয়। ইসলাম ভারসাম্যতার দ্বীনএবং এর সকল শিক্ষাই প্রান্তকতা মুক্ত সরল পথের পথ নির্দেশ করে। শবে বরাতের ব্যপারে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান হল, এ রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোর রূপ না দিয়ে এবং এই রাত উদযাপনের বিশেষ কোন পন্থা উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য রেওয়াত দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্য সব সাধারণ রাতের মতো মনে করা এবং এই রাতের ফযীলতের ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে, তার সবগুলোকে মওযু বা যয়ীফ মনে করা ভুল যেমন অনুরূপ এ রাতকে শবে কদরের মত বা তার চেয়েও বেশি ফযীলতপূর্ণ মনে করাও ভিত্তিহীন ধারণা।

যারা শবে বরাতে বিপক্ষে কথা বলেছেনঃ

১। শাইখ আবদুল আজিজ আল বাজ রহিমকহুল্লাহঃ

বলেন,  বিশুদ্ধ কথা হল, এ রাতে ব্যক্তিগত ‘আমল সম্পর্কে ইমাম আওযায়ী ও ইবনে রজব (রহঃ) এর মতামত যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে তা তাদের ব্যক্তিগত অভিমত যা সহীহ নয়। আর এটাতো সকল আলেমে দ্বীনের সর্বসম্মত সিদ্ধান যে, শরয়ীভাবে প্রমাণিত নয় তা ব্যক্তিগত হোক বা সমষ্টিগত, প্রকাশ্যে হোক অথবা গোপনে হোক তা কোন মুসলিমের ধর্মীয় ‘আমল হিসাবে পালন করা জায়েয নয়। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত নিম্নের হাদীস হল আম তথা ব্যাপক অর্থবোধক। তিনি বলেছেন, যে কেহ এমন ‘আমল করবে যা করতে আমরা (ধর্মীয়ভাবে) নির্দেশ দেইনি তা প্রত্যাখ্যাত। (সহিহ মুসলিম)

২। ইমাম আবূ বকর আত-তারতূশী (রহঃ) তার কিতাব (الحوادث والبدع) ‘আল-হাওয়াদিছ ওয়াল বিদ’আ’তে উল্লেখ করেনঃ ইবনে ওয়াদ্দাহ যায়েদ বিন আসলাম সূত্রে বর্ণনা করে বলেনঃ আমাদের কোন উস্তাদ বা কোন ফকীহকে মধ্য শাবানের রাতকে কোন রকম গুরুত্ব দিতে দেখিনি। তারা মাকহূলের হাদীসের দিকেও তাকাননি এবং এ রাতকে অন্য রাতের চেয়ে ‘আমলের ক্ষেত্রে মর্যাদা সম্পন্ন মনে করতেন না।

৩। হাফেয ইরাকী (রহঃ) বলেনঃ মধ্য শাবানের রাতে সালাত আদায় সম্পর্কিত হাদীসগুলো বানোয়াট বা জাল এবং এটা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মিথ্যা আরোপের শামিল। এ সম্পর্কে সকল উলামাদের মতামত যদি উল্লেখ করতে যাই তাহলে বিরাট এক গ্রন্থ হয়ে যাবে। তবে সত্যানুরাগীদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যা ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

মন্তব্যঃ উপরের আলোচনা এ কথা ষ্পষ্ট যে, এই রাতের ফজিলত সম্পর্ক প্রায় সকলে একমত কিন্তু আমলের ব্যাপারে অধিকাংশ আলেম দ্বিমত প্রষণ করেন। কারন আমল নির্দিষ্ট করার জন্য কুরআন সুন্নাহ দলীল দরকার, আলেম বা জাহের যে কোন লোকের আহবানে সাড়া দিয় ইবাদাত করাই বিদআত।  কোন বিষয় বিদ‘আত হওয়ার ক্ষেত্রে উলামাদের বক্তব্য যথেষ্ট। কেননা কুরআন ও হাদীসে কোন বিষয়কে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি যে, অমুক কাজটি বিদ‘আত। তাই আলেমগণ যেটাকে বিদ‘আত বলে রায় দিবেন সেটা বিদ‘আতই হবে। বিদ‘আত নির্ধারণের দায়িত্ব আলেমদের। অপর পক্ষে ইবাদাত প্রমানে আলেমদের বক্তব্য যথেষ্ট নয় এ সম্পর্কে কুরআন ও সহিহ হাদিসের দলীল থাকতে হবে। যেমনঃ কেউ যদি কোন কিছুর নিজের বলে দাবি করে তবে তাকে তার মালিকানার পক্ষে দলীল দিতে হবে। আর যদি বলে এই বস্তু আমার নয় তবে তাকে কোন দলীল দিতে হবে না। কাজেই ইসলামী শরীয়ত পরিপূর্ণ বিধায় এখানে আমলের কোন পদ্ধতি আবিস্কারের সুযোগ নেই। যে আমল করা হবে তার দলীল কুরআন ও সহিহ হাদিসের মানদন্ডে উত্তির্ণ হতে হবে।

শবে বরাতের নামে বিদআত ও ভ্রান্ত আকিদাঃ

উপরের আলোচনায় দেখেছি শবে রবাতের রাতে নানা আয়োজনে নানান ইবাদাত করা হয়। এর মাঝে অনেকগুল সুন্নাহ সম্মত নফল ইবাদাত শুধু এই রাতের সাথে সম্পৃক্ত করা জন্য নফল ইবাদাতটি বিদআদ হিসাবে পরিগনিত হয়। আমাদের উপমহাদেশ ইবাদাত বহির্ভূত বিদআত ও করা হয় এবং বিদআতের   পাশাপাশি এই রাত সম্পর্কে অনেকে ভ্রান্ত আকিদা রাখে। শবে বরাতে বহির্ভূত বিদআত ও ভ্রান্ত আকিদা এই দুটি বিষয় সামান্য আলোকপাত করব।

 

শবে বরাত সম্পর্কে ভ্রান্ত আকিদাঃ

ইসলাম ধর্ম পৃথিবীতে আসার অনেক দিন পরে শবে বরাত পালন শুরু হলেও এর বয়স কম নয়। সময়ের সাথে সাথে শবে বরাত সম্পর্কে মানুষের মাঝে বিভিন্ন আকিদা বিশ্বাসের জম্ম দিয়েছে। এই সকল আকিদা বিশ্বাস কুনআন ও সহিহ হাদিসের সাথ সাংঘর

১। শবে-বরাতের রাতে আল্লাহ্ দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন।

২। শবে-বরাতের রাতে আল্লাহ্ মানুষের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেন।

৩। সৌভাগ্য রজনী হিসাবে বিশ্বাস করা

৪। মৃতদের আত্মার দুনিয়াতের পূণরাগমনের বিশ্বাস

১। শবে-বরাতের রাতে আল্লাহ্ দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেনঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “লাইলাতুল নিসফে মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের নিকটবর্তী আকাশে আবির্ভূত হন, তারপর ‎সকল সৃষ্টিকে মাফ করে দেন মুশরিক ও ঝগড়াকারী ছাড়া।

মন্তব্যঃ হাদিসের মান সহিহ। ‎আলবানী তার সিলসিলাতুস সহিহ এর ৩ নং খন্ডের ১৩৫ নং পৃষ্ঠায় বলেন। “এই হাদিসটি সহীহ” এটি ‎সাহাবাদের এক জামাত বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন সূত্রে যার একটি অন্যটিকে শক্তিশালী করেছে। তাদের ‎মাঝে রয়েছেন বিশষ্ট সাহাবী মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ), আবু সা’লাবা (রাঃ), আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ), আবু মুসা ‎আশয়ারী (রাঃ), আবু হুরায়রা (রাঃ), আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ), আউফ বিন মালিক (রাঃ),  আয়েশা (রাঃ) প্রমুখ ‎সাহাবাগণ। উপরে বর্ণিত সবক’টি বর্ণনাকারীর হাদিস তিনি তার কিতাবে আনার মাধ্যমে সুদীর্ঘ আলোচনার পর শেষে ‎তিনি বলেন, সারকথা হল এই যে, নিশ্চয় এই হাদিসটি এই সকল সূত্র পরম্পরা দ্বারা সহীহ, এতে কোন ‎সন্দেহ নেই। আর সহিহ হওয়া এর থেকে কম সংখ্যক বর্ণনার দ্বারাও প্রমাণিত হয়ে যায়, যতক্ষণ ‎না মারাত্মক কোন দুর্বলতা থেকে বেঁচে যায়, যেমন এই হাদিসটি হয়েছে। আল্লামা শায়েখ আলবানী রহঃ এর বিশ্লেষণ থেকে একথা নির্ধিদ্ধায় আমরা বলতে পারি হাদিস দ্বারা ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত্রি বাক্যটি হাদিসে আসলেও শবে ‎বারাআত নামের কোন শব্দ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। এই হাদিস দ্বারা ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত্রি ফজিলতের বর্ণনা পাওয়া যায় কিন্তু কোন আমলের প্রমান পাওয়া যায় না। মহান আল্লাহ শুধু মধ্য শাবানের রাত্রি বান্দাদের নিকটবর্তী আকাশে আবির্ভূত  এমনটি নয় বরং তিনি প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। যেমন সহিহ হাদিসে এসেছে।

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমাদের রব মহান আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন ও বলতে থাকেনঃ কে আছ আমার কাছে দু‘আ করবে আমি কবুল করব। কে আছ আমার কাছে চাইবে আমি দান করব। কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব। (সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম)

উল্লিখিত হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা মধ্য শাবানের রাতে নিকটতম আকাশে আসেন ও বান্দাদের দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। কিন্তু সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম বর্ণিত এই সহীহ হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষের দিকে নিকটতম আকাশে অবতরণ করে দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। আর এ হাদীসটি সর্বমোট ৩০ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন এবং বুখারী এবং মুসলিম ও সুনানের প্রায় সকল কিতাবে এসেছে। হাদীসটি প্রসিদ্ধ এবং অনেক আলেম মনে করেন মশহুর হাদীসের বিরোধী বক্তের অংশটুকু সঠিক নয়। কারণ এ হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন মধ্য শাবানের রাতের শুরু থেকে এবং অন্য হাদিসের বক্তব্য হল প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। প্রতি রাতের মধ্যে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতও অনর্ভুক্ত। কাজেই আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে অবতরণ শুধু শাবান মাসের জন্য খাস করা ঠিক হবে না।

২। শবে-বরাতের রাতে আল্লাহ্ মানুষের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেনঃ

এই সকল আকিদা ও আমল সরাসরি কুরআন ও সহিহ সুন্নাহ বিপরীত। সুরা দুখানে তিন ও চার নম্বর আয়াতে এসেছে, আমি একে নাযিল করেছি। এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ক কারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। বুঝা গেল কুরআন নাজিলের সাথে আল্লাহ্ মানুষের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেন। আর এ কথা শতভাগ সঠিক যে কুরআন নাজিল হয়েছে, লাইলাতুল কদরে। কাজেই আল্লাহ্ মানুষের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেন লাইলাতুল কদরে। কিন্ত জাল হাদিস প্রমান করে, শবে-বরাতের রাতে আল্লাহ্ মানুষের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেন। এমনি ভাবে জাল হাদীছের উপর ভিত্তি করে সহীহ হাদীছের মর্ম প্রত্যাখ্যান করে শবে বরাতের রাত সম্পর্কে ভ্রান্ত আকিদা রাখলে ইসলাম ছুটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল কুরআনের বিপরীতে অনেকে একটি মুনকার হাদিস বর্ণানা করেন। এই মুনকার হাদিসটি মিশকাতুল মাসাবীহ কিতাবে ‘রামাযান মাসে কিয়াম’ (রামাযান মাসের রাতের সালাত) অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে দাবি করা হয়েছে মানুষের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা হয় এই মর্মে যে হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে তা শবে বরাত সম্পর্কিত। হাদিসটি হলঃ

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তুমি কি জানো এটা (মধ্য শাবানের রাত) কোন রাত? তিনি বললেন করলেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ রাতে কি রয়েছে? তিনি বললেনঃ এ রাতে এই বছরে যে সকল মানব সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে তাদের ব্যাপারে লিপিবদ্ধ করা হয়, যারা মৃত্যু বরণ করবে তাদের তালিকা তৈরী হয়, এ রাতে ‘আমলসমূহ পেশ করা হয়, এ রাতে রিযক নাযিল করা হয়।

হাদিসের মানঃ হাদিসের মান মুনকার। এ হাদীসটি আল-মিশকাত আল-মাসাবীহর সংকলক উল্লেখ করার পর বলেছেন, তিনি হাদীসটি ইমাম বাইহাকীর ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ কিতাব থেকে নিয়েছেন। ইমাম বাইহাকী তার ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কে মাত্র দুটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। তার একটি হল এই হাদীস। তিনি তার ‘শুআ’বুল ঈমান’ গ্রন্থে শবে বরাত সম্পর্কিত হাদীস উল্লেখ করার পর লিখেছেন, “এ বিষয়ে বহু মুনকার হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যার বর্ণনাকারীরা অপরিচিত। আমি তা থেকে দু’টি হাদীস ‘আদ-দাওআত আল-কাবীর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। আলোচ্য হাদীসটি হাদীসে মুনকার। মুনকার হাদীস ‘আমলের জন্য গ্রহণ করা যায় না। যিনি হাদীসটি আমাদের কাছে পৌছিয়েছেন তিনি নিজেই যখন হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মতামত দিয়েছেন। কাজেই বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কোন অবস্থায়ই এই মুনকার হাদিস গ্রহণীয় নয়।

মন্তব্যঃ হাদীসের বিষয়বস্তুর দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, হাদীসে ভাগ্য লেখার বিষয়টি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত। কেননা জন্ম, মৃত্যু, ‘আমল পেশ, রিয্‌ক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী রামাযান মাসে লাইলাতুল কদরে সাথে সম্পৃক্ত। কুরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত তেমনি বহু সংখ্যক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ বলেন,

وَٱلۡڪِتَـٰبِ ٱلۡمُبِينِ (٢) إِنَّآ أَنزَلۡنَـٰهُ فِى لَيۡلَةٍ۬ مُّبَـٰرَكَةٍ‌ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ (٣) فِيہَا يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ (٤)

অর্থঃ শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিতো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা দুখান ৪৪:১-৪)।

কুরআন নাজিলের রাতে বা লাইলাতুল কদরের রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয় বা ভাগ্য লিপি বদ্ধ হয়। এ ছাড়া মিশকাত আল-মাসাবীহর সংকলক বিষয়টি ভালভাবে বুঝেছেন বলে তিনি হাদীসটিকে রামাযান মাসের সালাত (কিয়ামে শাহরি রামাযান) অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। বুঝা গেল যে, তার মত হল হাদীসটি রামাযান মাসের লাইলাতুল কদর সম্পর্কিত। হাদীসটিতে বর্ণিত “মধ্য শাবানের রাত” কথাটি আয়িশার (রাঃ) বক্তব্য নয়। কারণ তার বক্তব্য শুরু রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বক্তব্য শেষ হওয়ার পর। কিন্তু এখানে প্রশ্নের ভিতরেই আয়শা (রাঃ) এর বক্তব্য শুরু হয়েছে। যা আদবের খেলাপ। তাহলে এ বক্তব্যটি কার? এ বক্তব্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আয়িশা (রাঃ) ব্যতীত অন্য কোন বর্ণনাকারীর নিজস্ব মন্তব্য, যা মেনে নেয়া আমাদের জন্য যরুরী নয়।

৩। সৌভাগ্য রজনী হিসাবে বিশ্বাস করাঃ

একটি সহিহ হাদিসে লাইলাতুল নিসফে মিন শারান বা শাবানের মধ্য রজণীর ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও বলেন নাই যে এই রাতটি সৌভাগ্য রাত। আমাদের বিশ্বাস মহান আল্লাহ আমাদের প্রতিটি আমলেন প্রতিদান দিবেন, তার আমলের প্রতিদান প্রদানের জন্য কোন রাতকে সৌভাগ্য রজনী হিসাবে বিশ্বাস করার কোন কারন নেই কারন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এমটি করে নাই আর সাহাবীদের ও এমনটি করতে বলেন নাই।

নিজেদের সৌভাগ্য রচনার জন্য কোন অনুষ্ঠান বা ইবাদাত-বন্দেগী ইসলামে অনুমোদিত নয়। শবে বরাতকে সৌভাগ্য রজনী বলে বিশ্বাস করা একটি বিদ‘আত তথা ধর্মে বিকৃতি ঘটানোর শামিল। এ সৌভাগ্য অর্জন করতে হলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করতে হবে। কুরআন-সুন্নাহ বাদ দিয়ে এবং সারা জীবন সালাত-সিয়াম-যাকাত ত্যাগ করে শুধুমাত্র একটি রাতে মাসজিদে রাত জেগে ভাগ্য বদল করে সৌভাগ্য হাসিল করে নিবেন এমন ধারণা ইসলামে একটি হাস্যকর ব্যাপার। অনেক ঐতিহাসিক জ্ঞানী আলেমদের ধারনা, “শবে বরাত মত বিদআত প্রচলনের কৃতিত্ব সম্পূর্ণভাবে শীয়াদের। ধর্ম বিকৃতি করার জন্য শিয়াগণ এক নম্বর। তাদের। ফারসী ভাষার “শবে বরাত” নামটা থেকে এ বিষয়টা বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তারা এ দিনটাকে ইমাম মাহদীর জন্ম দিন হিসাবে পালন করে থাকে। তারা বিশ্বাস করে যে, এ রাতে ইমাম মাহদীর জন্ম হয়েছে। এ রাতে তারা এক বিশেষ ধরনের সালাত আদায় করে। যার নাম দিয়েছে “সালাতে জাফর”।

আরা জানি ফিকহী মাসয়ালা মাসায়েলে কুনআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস কে উৎস হিসাবে গ্রহন করা হয়। কিন্তু আকিদা বিশ্বাস হল গায়েবী বিষয় যা সরাসরি কুনআন ও সহিহ দ্বারা প্রমানিত হতে হবে। আকিদার ক্ষেত্র ইজমা, কিয়াস, যঈফ জাল হাদিস গ্রহন করা যাবে না। তাই শবে বরাতের যে সকল হাদিস যঈফ বা জাল তা দিয়ে ‘সৌভাগ্য রজনী হিসাবে বিশ্বাস করার কথা বলা হয়েছে তা কি করে বিশ্বাস করি। তাই যেহেতু বিষয়টি আকিদার সাথে সম্পর্কিত আমলের সাথে নয়।

শবে বরাত সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস পরিস্কার থাকতে হবে। যদি মিথ্যা বা জাল হাদিস দ্বারা আকিদা প্রমাণ করে বিশ্বাস করি তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি মিথ্যা আরোপ করার মত অন্যায় হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ

*وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ*

অর্থঃ তার চেয়ে বড় যালিম আর কে যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে? (সূরা সাফ ৬১:৭)

৪। মৃতদের আত্মার দুনিয়াতের পূণরাগমনের বিশ্বাসঃ

এ উপলক্ষ্যে দেখা যায় মহিলাগণ ঘর-বাড়ি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে আতর সুগন্ধি লাগিয়ে পরিপাটি করে রাখে। বিশেষ করে বিধবা মহিলাগণ এমনটি করেন। এমনকি তারা কিছু খাবার একটুকরো কাপড়ে পুরে ঘরে ঝুলিয়ে রাখে। কারণ, তাদের বিশ্বাস হল, তাদের মৃত স্বামী-স্বজনদের আত্মা এ রাতে ছাড়া পেয়ে নিজ নিজ পরিবারের সাথে দেখা করতে আসে। এটা যে কতবড় মূর্খতা তা একমাত্র আল্লাহ জানেন।
মানুষ মারা গেলে তাদের আত্মা বছরের কোন একটি সময় আবার দুনিয়াতে ফিরে আসা মুসলমানদের আকীদাহ নয়। বরং অনেকটা তা হিন্দুয়ানী আকীদার সাথে সাঞ্জস্যপূর্ণ।

শবে বরাত রাতের বিদআতঃ

১। শবে বরাত উপলক্ষে ১৪ শাবান দিনে রোযা রাখাঃ

এ সম্পর্কে শবে বরাত অনুসারীগণ নিম্মের হাদিসটি উল্লেখ করে থাকে।

আলী ইবনে আবী তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সূর্য অস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিজিক প্রার্থনাকারী আমি রিজিক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যান্ত বলা হয়ে থাকে। (হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ তার সুনানে ১/৪৪৪, হাদীস নং ১৩৮৮; বর্ণনা করেছেন; বাইহাকীতেও হাদিসটি আছে তবে এই হাদিসটি জাল। পূর্বে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে)।

মন্তব্যঃ জাল হাদিসের উপর ভিত্তি করে কোন আমল করা যাবে না বলে উম্মতের মুস্তাহীদ আলেমগণ এক মত আছে। যেহেতু এই হাদিসটি জাল তাই ও দ্বারাও কোন আমল সৃষ্ট করা যাবে না এবং লাইলাতুল নিসফে মিন শাবান বা শাবানের মধ্য রাতে কেন্দ্র করে সিয়াম পালন করা যাবে না। কিন্তু শাবান মান খুবই বরকতময় মাসে এই মাসে খুবই সিয়াম পালন করতেন। যেমন হাদিস এসেছেঃ

   ‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধারে (এত বেশী) সিয়াম পালন করতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর সিয়াম পরিত্যাগ করবেন না। (আবার কখনো এত বেশী) সিয়াম পালন না করা অবস্থায় একাধারে কাটাতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর (নফল) সিয়াম পালন করবেন না। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে রমজান ব্যতীত কোন পুরা মাসের সিয়াম পালন করতে দেখিনি এবং শা’বান মাসের চেয়ে কোন মাসে বেশী (নফল) সিয়াম পালন করতে দেখিনি। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৪৫ ইফাঃ)

‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা‘বান মাসের চেয়ে বেশী (নাফল) সিয়াম কোন মাসে পালন করতেন না। তিনি (প্রায়) পুরা শা’বান মাসই সিয়াম পালন করতেন এবং বলতেনঃ তোমাদের সাধ্যে যতটুকু কুলোয় ততটুকু (নফল) আমল কর, কারণ তোমরা (আমল করতে করতে) ক্লান্ত হয়ে না পড়া পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা (সওয়াব দান) বন্ধ করেন না। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় সালাতই ছিল তাই যা যথাযথ নিয়মে সর্বদা আদায় করা হত। যদিও তা পরিমানে কম হত এবং তিনি যখন কোন (নফল) সালাত আদায় করতেন পরবর্তীতে তা অব্যাহত রাখতেন। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৪৬ ইফাঃ)

শাবান মাসে বেশী থেকে বেশী সিয়াম পালন করা সুন্নাহ। তা হলে প্রশ্ন হল বেশী বেশী সিয়াম পালনেন সময় এর মাঝে যদি লাইলাতুল নিসফে মিন শাবান বা শাবানের মধ্য রাত হয় তবে কি সিয়াম আদায় করলে বিদআত হবে না। প্রতি চন্দ্রমাসে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে মোট ৩ দিনের সিয়াম পালনে করা সুন্নাত যা হাদিস দ্বারা প্রমানিত। এই তিন দিনকে শরীয়াতের পরিভাষায় “আইয়ামুল বীদ” বলা হয়। এই সিয়াম পালন সম্পর্কে হাদিসে এসেছেঃ

আবূ যার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হে আবূ যার! তুমি যখন কোন মাসে তিনদিন সওম পালন করতে চাও, তাহলে তেরো, চৌদ্দ ও পনের তারিখে করবে। (হাদিসের মান হাসান সহিহ: মিশকাত-২০৫৭, রিয়াযুস স্বা-লিহীন ১২৭০; তিরমিযী ৭৬১, নাসায়ী ২৪২৪)

আবু কাতাদাহ ইবনে মিলহান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শুক্লপক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার জন্য আদেশ করতেন।’ (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন ১২৭১; আবূ দাউদ ২৪৪৯, নাসায়ী ২৪৩২)।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে ও সফরে কোথাও শুক্লপক্ষের (তিন) দিনের রোযা ছাড়তেন না।’ (হাদিসের মান হাসান রিয়াযুস স্বা-লিহীন, ১২৭২, নাসায়ী ২৩৪৫)।

যদি কার প্রতি চন্দ্রমাসে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে সিয়াম পালন করে থাকে। তবে সেও শাবান মাসের এই তিন দিন সিয়াম পালন করতে বিদআত হবে না। কিন্তু যদি কেউ শুধু এই দিনকে ভীষন গুরুত্ব দিয়ে সিয়াম পালন করে তবে  তা  বিদআত হবে।  

২। বিশেষ নিয়মে সালাত আদায় করাঃ

এ রাতে এক অদ্ভূত পদ্ধতিতে একশত রাকাআত নামায আদায় করা হয়। যাকে বলা হয় সালাতুল আলাফিয়া। একশত রাকাআত নামায পড়ার পদ্ধতিটি হল নিম্নরূপঃ

মোট একশত রাকাআত নামায পড়তে হয়। প্রতি দু রাকাত পর সালাম ফিরাতে হবে। প্রতি রাকাআতে সূরা ফাতিহার পর দশ বার সূরা ইখলাস পাঠ করতে হবে। একশত রাকাআত নামাযে সূরা ইখলাস পাঠ করতে হয় মোট এক হাজার বার। তাই এ নামাযকে সালাতে আলফিয়া বলা হয়। (ইমাম গাযালী (রাহ.) এ পদ্ধতিটি এহিয়া উলুমুদ্দীন ১/২০৩)।

মন্তব্যঃ এই সালাত বিদআত কেননা, ইসলামে এ ধরণের নামায পড়ার নিয়ম সম্পূর্ণ নতুন আবিস্কৃত বিদআত। এ ব্যাপারে সর্ব যুগের সমস্ত আলেমগণ একমত। কারণ, তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদীন কখনো তা পড়েন নি। তাছাড়া ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, আহমদ বিন হাম্বল, সুফিয়ান সাওরী, আওযাঈ, লাইস প্রমূখ যুগ শ্রেষ্ঠ ইমামগণ কেউ এ ধরণের বিশেষ নামায পড়ার কথা বলেন নি। এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসটি হাদীস বিশেষজ্ঞদের মতে বানোয়াট এবং জাল। যেমন, ইব্‌নুল জাওযী উক্ত হাদীসটি মাওযু’আত (জাল হাদীস সংগ্রহ) কিতাবে তিনটি সনদে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি যে বানোয়াট তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনটি সনদেই এমন সব বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের অধিাকংশরই পরিচয় অজ্ঞাত। আরো কতিপয় বর্ণনাকারী খুব দূর্বল। সুতরাং হাদীসটি নিশ্চিতভাবে জাল। (আল মাউযূআত ২য় খন্ড ১২৭-১৩০ পৃষ্ঠা)।

এই সালাতের ইতিহাসঃ ইমাম ত্বরতূশী (রাহ:) বলেন, শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে একশত রাকআত নামায পড়ার পদ্ধতি সর্ব প্রথম যে ব্যক্তি চালু করে তার নাম হল ইব্‌ন আবুল হামরা। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের নাবলুস শহরের অধিবাসী। তিনি ৪৪৮ হিজরী সনে বাইতুল মাকদিসে আসেন। তার তেলাওয়াত ছিল খুব সুন্দর। তিনি শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে মসজিদুল আকসায় এসে নামায শুরু করে। আর এক লোক তার পেছনে এক্তেদা করে। অতঃপর আর একজন আসে। কিছুক্ষণপর আরে আরও একজন। এভাবে নামায শেষে দেখা গেল বিরাট জামাআতে পরিণত হয়েছে। পরিবর্তী বছর শবে বরাতে সে ব্যক্তির সাথে প্রচুর পরিমাণ মানুষ নামাযে শরীক হয়। এভাবে এ নামাযটি মসজিদে আক্বসা সহ বিভিন্ন মসজিদে পড়া আরম্ভ হয়ে গেল। কিছু মানুষ নিজেদের বাড়িতে এ নামায পড়া শুরু করে দিল। পরিশেষে এমন অবস্থা দাঁড়ালো যেন এটি একটি সুন্নাত। (আত্‌ ত্বারতুশী রচিত আত্‌তাহযীর মিনাল বিদা। পৃষ্টা: ১২১ ও ১২২)।

এ সম্পর্কে আরো দুটি জাল হাদিস নিম্মে উল্লেখ কার হলঃ

১। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “হে আলী, যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের রাত্রিতে এমনভাবে একশত রাকাত নামায আদায় করবে যে, প্রতি রাকাআতে সূরা ফাতিহার পরে দশবার কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’সূরা পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তার সে রাত্রির যাবতীয় প্রার্থনা পূরণ করবেন।

মন্তব্যঃ ইব্‌নুল জাওযী উক্ত হাদীসটি মাওয়ুআত কিতাবে তিনটি সনদে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি যে বানোয়াট তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনটি সনদেই এমন সব বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের অধিাকংশরই পরিচয় অজ্ঞাত। আরও কতিপয় বর্ণনাকারী খুব দূর্বল। সুতরাং হাদীসটি নিশ্চিতভাবে জাল। অথচ আমরা অনেক মানুষকে দেখি যারা এ সারা রাত ধরে নামায পড়ার পর এদের ফজর নামায ছুটে যায় কিংবা সকালে যখন উঠে অলসতা সহকারে উঠে। কিছু মসজিদের ইমাম শবে বরাতের এ সব নামাযকে সাধারণ জনগণকে একত্রিত করার এবং এর মাধ্যমে নিজেদের রুটি-রুযি ও উন্নতির মাধ্যমে হিসেবে গ্রহণ করেছে। এরা জনগণকে একত্রিক করে তাদের আলোচনা সভাগুলোতে বিভিন্ন কিচ্ছা-কাহিনী আলোচনা করে থাকে। মুলত এ সবই ভ্রান্ত এবং হকের সাথে সম্পর্ক হীন।

ইব্‌নুল কায়্যেম জাওযিয়াহ আল মানারুল মুনীফ কিতাবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন: জাল হাদীস সমূহের মধ্যে অর্ধ শাবানের রাত্রের নামায পড়া সম্পর্কীত উক্ত হাদীসটি অন্যতম। এর পর তিনি বলেন: আজব ব্যাপার হল, কিছু মানুষ যারা হাদীসের কিছু ঘ্রাণ পেয়েছে তারাও এ সকল উদ্ভট হাদীস দেখে প্রতারিত হয়ে শবে বরাতের নামায পড়া শুরু করে দেয়। অনুরূপভাবে ইমাম সুয়ূতী রা. উপরোক্ত হাদীসটি আল লাআলী আল মাসনূআ ’ কিতাবে উল্লেখ করে সেটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তদ্রুপ ইমাম শাওকানী রা. এটিকে আল ফাওয়ায়েদুল মাজমূআহ কিতাবে জাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

২। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি অর্ধ শাবানের রাতে বার রাকাত নামায পড়বে-প্রতি রাকাতে কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ সূরাটি পড়বে ত্রিশ বার-তাহলে সে জান্নাতে তার আসন না দেখে বের হবে না।

মন্তব্যঃ এ হাদীসটিও ইব্‌নুল জাওযী রা. তার আল মাওযূআত কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এ হাদীসটিও জাল। এ হাদীসটির সনদে এমন একদল বর্ণনাকারী রয়েছে যাদের সকলের পরিচয় অজ্ঞাত। অনুরূপভাবে ইমাম সূয়ূতী রাহ. আল লাআলী কিতাবে এবং ইমাম ইব্‌নুল কয়্যেম (রাহ:) আল মানারুল মুনীফ কিতাবে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে এটিকে জাল হাদীস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

এই রাতে নফল ইবাদাত করলে বিদআত হবে কেন?

 যে কোন রাতে বা দিনে যে কেউ ইচ্ছামত জিকির-আসগান, কুরআন তেলাওয়াত, নফল সালাত, দুয়া -মুনাজাত, ইস্তিগফার, কান্নাকাটি, কবর যিয়ারাত, দান-সাদকাহ, ওয়াজ-নাসীহাত প্রভৃতি নেক আমল আদায় করতে পার। এই সকল আমাদের সাথে সময় বা সংখ্যা নির্দিষ্ট করা যাবে না যা বিদআতের আলোচনা থেকে শিখেছি। কারন সংখ্যা ও সময় নির্দষ্ট করার একমাত্র ক্ষমতা হলো মহান আল্লাহর  আর তিনি তার রাসূল সাঃ মাধ্যমে আমাদের বিস্তারিত জানিয়েছেন। তিনি সামান্য কিছুই গোপন করেন নাই।  নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলার সন্ত্বষ্টি অর্জনের জন্য  দুয়া-মুনাজাত, সালাত, সিয়াম, দান-ছাদাকাহ, কুরআন তিলাওয়াত, রাত্রি জাগরণ খুবই ভাল কাজ। এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত করবে না এবং বিদআত ও বলবেনা। কিন্তু যখন কেউ কুনআন সুন্নাহর দলীল ব্যতিত একটি মাত্র রাতকে নির্দিষ্ট করে ইবাদাত করবে তখন তা বিদআত হয়ে যাবে। দলীলহীনভাবে একটি রাতের নাম শবে বরাত বা সৌভাগ্য রজনী অথবা মুক্তি রজনী রেখে তার উপর ভ্রান্ত বিশ্বাস রেখে আমল করলে ঐ সকল সুন্নাহ সম্মত ইবাদাতও বিদআতে পরিনত হবে। যদি কেউ নিয়মিত প্রতি রাতেই এই সকল নফল ইবাদাত করে থাকে তবে ঐ রাতেও সে নফল ইবাদাত করতে পারে বিদআত হবে না। যার সিয়াম পালনের অভ্যাস তিনি এ দিন সিয়াম পালন করতে পারেন। যেমন হাদিসে এসেছেঃ আবু কাতাদাহ ইবনে মিলহান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শুক্লপক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখার জন্য আদেশ করতেন।’ (হাদিসটি নেয়া হয়েছে রিয়াযুস স্বা-লিহীন-১২৭১; আবূ দাউদ ২৪৪৯; নাসায়ী ২৪৩২)।

তাই যদি কারও প্রত্যেক চদ্র মাসে শুক্ল পক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের সিয়াম পালন করার অভ্যাস থাকে আর সে এই দিন সিয়াম পালন করে তবে বিদআত হবে না। কিন্তু কোন ব্যাক্তি যদি বছরের কখনও সিয়ম পালন করেনা শুধু মিথ্যা বিশ্বাসের উপর শাবান মাসের ১৫ তারিখের সিয়াম পালন করে তবে তা নিঃসন্দেহে বিদআত হবে।

ঠিক তেমনিভাবে বছরের কোন সময় দুয়া-মুনাজাত, সালাত, দান-ছাদাকাহ, কুরআন তিলাওয়াত, রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে কাটালাম না শুধু মিথ্যা বিশ্বাসের উপর শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে কাটালাম তবে বিদআদ হবে। আমাদের একমাত্র আদর্শ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নবুওয়াতের তেইশ বছরের জীবনে কখনো তার সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মক্কায় মাসজিদুল হারামে অথবা মদীনায় মাসজিদে নবুবীতে কিংবা অন্য কোন মাসজিদে একত্র হয়ে উল্লিখিত ইবাদাত-বন্দেগীসমূহ করেছেন এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তথা খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে কেহ জানতো না শবে বরাত কি এবং এতে কি করতে হয়। তারা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ‘আমল প্রত্যক্ষ করেছেন। আমাদের চেয়ে উত্তম রূপে কুরআন অধ্যয়ন করেছেন। তারা তাতে শবে বরাত সম্পর্কে কোন দিক-নির্দেশনা পেলেন না। তারা তাদের জীবন কাটালেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে, অথচ জীবনের একটি বারও তাঁর কাছ থেকে শবে বরাত বা মুক্তির রজনীর ছবক পেলেন না? যা পালন করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে যাননি, যা কুরআনে নেই, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের তা’লীমে নেই, সাহাবীগণের ‘আমলে নেই, তাদের সোনালী যুগের বহু বছর পরে প্রচলন করা শবে বরাতকে নিঃসন্দেহে বিদআদ। হয়তো মনে প্রশ্ন হতে পারে এতদিন ধরে চলছে। মাদ্রাসার বড় হুজুরও আদায় করছে তা হলে বিদআত হয় কি করে? তারা কি কুনআন হাদিস কম বুঝে?

মনে রাখবেন ইসলাম ধর্মে যতগুলো বিদ‘আত চালু হয়েছে তার শতভাগই এক শ্রেনী আলেম দ্বারা। তারা মানুষের বেশী ভাল করতে গিয়ে, ইবাদাত পালনের প্রতি ঝোক সৃষ্ট করতে গিয়ে এই সকল বিদআতের প্রচলণ করেছেন। কোন কালেই কোন সাধারণ মানুষ বা কাফির মুশরিকদের মাধ্যমে বিদআত চালু হয়নি বা প্রসারও ঘটেনি। বিদআত সম্পর্কে ষ্পষ্ট ধারনা রাখতে হবে। কোন আলেমের অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণ করা যাবে না। সন্দেহ হলে ভাল মুহাক্কিক আলেমের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে। কারন কোন কারনে যদি আমি বিআদতি আমল করি বা আমার কারনে বিদআতের প্রসার ঘটে এ জন্য তাদেরকে আল্লাহর সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে। যে দিন বলা হবেঃ

*وَيَوْمَ يُنَادِيهِمْ فَيَقُولُ مَاذَا أَجَبْتُمُ الْمُرْسَلِينَ*

অর্থঃ আর সে দিন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা রাসূলদের আহ্বানে কিভাবে সাড়া দিয়েছিলে? (সূরা কাসাস ৬৫)

সে দিন তো এ প্রশ্ন করা হবে না যে, তোমরা অমুক বড় হুজুরের মত অনুযায়ী বা অমুক ইমামের মত অনুযায়ী ‘আমল করেছিলে কিনা। যারা কুরআন ও সহিহ সুন্নাহ মত ‘আমল করবে তারাই সে দিন সফল কাম হবে। কাজেই বিআদত সম্পর্কে শতর্ক হই। আমার আমলকে কেউ বিদআত বললে, সম্ভব হলে নিজের আমলের পক্ষের দলীল জেনে নেই। দলীল জানা থাকলে আমলেন প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় হয় এবং কিয়ামতের দিন (উপরের আয়াতে বর্ণিত) প্রশ্নের উত্তরে বলা যাবে। হ্যা, তোমার রাসূলের আহবানে সাড়া দিয়ে সুন্নাহ সম্মত আমল করেছি।

৩। হালুয়া-রুটি খাওয়াঃ

শবে বরাত উপলক্ষ্যে ঘরে ঘরে হালওয়া রুটি তৈরি ও খাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। শুধু তাই নয় বরং সে দিন গরীব মানুষও টাকা ধার করে হলেও এক বেলা গোস্ত কিনে খায়। কারণ, সে দিন যদি ভাল খাবার খাওয়া যায় তাহলে নাকি সারা বছর ভাল খাবার খাওয়া যাবে। এ সম্পর্কে আগে চরম কয়েকটি মিথ্যা কথা উল্লেখ করব। এই কথাগুলিকে জাল হাদিস বলতেও ঘৃনা হয়। অথচ যুগ যুগ ধরে অন্ধ ও অজ্ঞ মুসলীমদের মাঝে হাদিস হিসাবে প্রচলিত।

ক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাকি বলেছেন, শবে বরাতে হালুয়া-রুটি বানালে আরশের নিচে ছায়া পাওয়া যাবে।

সমাজে এটিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস হিসেবে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নেই। এটি এমন একটি ভিত্তিহীন কথা যার জাল হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি জাল হাদীসের উপর লেখা কিতাবাদিতেও এর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।

খ। কেউ কেউ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাকি বলেছেন, কেয়ামতের কঠিন দিনে রুটি বড় হয়ে বান্দার মাথার ছাতা হবে।

যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামে কথাগুলো বলা হয় তাহলে বোঝাই যায়, এ কথা হাদিসে বর্ণিত আছে। অথচ সত্যি কথা হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অজস্র হাদিসের কোথাও এমন কোনো বাক্যের উল্লেখ নেই। হাদিসের বর্ণনার সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নেই। সুতরাং নির্দ্বধায় বলা যায়, কথাটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন, জাল ও বানোয়াট। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

গ। কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, ওহুদ যুদ্ধে যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানদান মোবরক শহীদ হয়েছিল, তখন কিছুদিন কোনো প্রকার শক্ত খাবার খেতে পারতেন না। সেই ঘটনার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এই দিনে ঘটা করে হালুয়া রুটি খাওয়া হয়।

সকল মুসলিম জানেন যে, ওহুদ যুদ্ধ হয়েছিল তৃতীয় হিজরী শাওয়াল মাসের সাত তারিখে। এই রক্তক্ষয়ী ও অসম যুদ্ধে কাফেরদের আঘাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁত ভেঙ্গে দিয়ে ছিল যা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত। এরই সুযোগ নিয়ে অনেক বিদআতি জাহেল প্রচার করে কিছুদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো প্রকার শক্ত খাবার খেতে পারতেন না। তিনি এই সময়টা নরম বা হালুয়া রুটি খেতেন। তার সাথে সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য ঐ দিন হালূয়া রুটি খেতে হবে। দেখুন অপরাধী কিভাবে তার অপরাধের সাক্ষী রেখে যায়। ওহুদ যুদ্ধ হয়েছিল শাওয়াল মাসে ও এরা হালূয়া রুটি খায় শাবান মাসে। তিনি নরম খাবার কি শুধু একদিন খেয়ে ছিলেন? কুরআন সুন্নাহ সম্মত আমলেতো নয়ই বরং তাদের কথাগুলী সম্পূর্ণ অযৌক্তিও বটে। বিদআতীদের অবস্থা হল, আল্লাহর নবীর রেখে যাওয়া সাধারণ সুন্নতগুলোও পালন করে না সুবিধামত আমলের নামে বিদআতী কাজ করা। বিদআতী আমলের ভীরে তারা ফরজ সালাত, সিয়াম, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদির কথা ভূলে যায়।

মন্তব্যঃ তারপর সমাজের সুন্নীদাবিদার অজ্ঞদের দাবি, শবে বরাতে হালুয়া-রুটি অথবা অন্য কোনো বিশেষ খাবার তৈরি করা শরীয়তে নাজায়িয তো নয়ই বরং জায়িয এবং খাছ সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। শবে বরাতে হালুয়া-রুটি অথবা অন্য কোনো বিশেষ খাবার তৈরি করা শরীয়তে নাজায়িয তো নয়ই বরং জায়িয এবং খাছ সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। যারা এটাকে বিদয়াত বা নাজায়িয বলে থাকে তাদের কথা মোটেও শরীয়তসম্মত ও গ্রহণযোগ্য তো নয়ই বরং তা সম্পূর্ণরূপে কুফরী ও গুমরাহীতে পরিপূর্ণ যা সর্বতোভাবেই পরিত্যাজ্য।

এ সম্পর্কে তারা এক গল্প আবিস্কার করে ইতিহাস বলে প্রচার করছে। তাদের কল্পিত গল্পটির প্রতি একটু নজর দিন। তাদের দাবি হালূয়া রুটির পিছনে ইতিহাস আছে।  ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্ববর্তী যামানায় যখন বর্তমানের মতো বাজার, বন্দর, হোটেল-রেস্তোরাঁ ইত্যাদি সর্বত্র ছিল না তখন মানুষ সাধারণত সরাইখানা, লঙ্গরখানা, মুছাফিরখানা ইত্যাদিতে ছফর অবস্থায় প্রয়োজনে রাত্রিযাপন করতেন। অর্থাৎ মুছাফিরগণ তাদের ছফর অবস্থায় চলার পথে আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত জনের ঘর-বাড়ি না পেলে সাধারণত সরাইখানা, মুছাফিরখানা ও লঙ্গরখানায় রাত্রিযাপন করতেন। আর এ সমস্ত মুছাফিরখানা, লঙ্গরখানা ও সরাইখানার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত থাকতেন তারাই মুছাফিরদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। বিশেষ করে মুছাফিরগণ শবে বরাতে যখন উল্লিখিত স্থানসমূহে রাত্রি যাপন করতেন তাদের মধ্যে অনেকেই রাত্রিতে ইবাদত-বন্দেগী করতেন ও দিনে রোযা রাখতেন। যার কারণে উল্লিখিত স্থানসমূহের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ খাবারের ব্যবস্থা করতেন যাতে মুছাফিরদের রাত্রে ইবাদত-বন্দেগী করতে ও দিনে রোযা রাখতে অসুবিধা না হয়। আর যেহেতু হালুয়া- রুটি ও গোশত-রুটি খাওয়া সুন্নত, সেহেতু তারা হালুয়া-রুটি বা গোশত-রুটির ব্যবস্থা করতেন। এছাড়াও আরবীয় এলাকার লোকদের প্রধান খাদ্য রুটি-হালুয়া বা রুটি-গোশত। তারা ভাত, মাছ, ইত্যাদি খেতে অভ্যস্ত নয়। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে শবে বরাত উপলক্ষে হালুয়া রুটির প্রচলন আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

কি সুন্দর গল্প মনে রমাজান মাসে কেউ সফর করে না। রমজান মাসে কেউ সরাইখানা, মুছাফিরখানা ও লঙ্গরখানায় রাত্রিযাপন করে না। এই মাসে কেউ রাতে সালাত আদায় করে না। তাই রমাজান মাসে সরাইখানা, মুছাফিরখানা ও লঙ্গরখানায় কোন হালুয়া রুটি তৈরি হয়। এই গল্প সঠিক ভাবলে সম্পূর্ণ রমাজান হালূয়া রুটি তৈরিতে শেষ হয়ে যেন।

অসংখ্যা বার কুনআন ও হাদিসে মহান আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম, পথীক, অসহায় ও বন্দিদেরকে সাহায্যের তাগিদ প্রদান করেছেন। বিদআতি এই সকল আয়াত ও হাদিস কোট করে। প্রশ্ন করে শবে বরাতে এই সকল কাজ করা নাকি বিদআত? আসলে বিদআত সম্পর্কে এদের সামান্যতম ধারনা নেই। আপনি কোন বিদআতি আমলকে বিদআত বলবেন তো সে বললে ঠিক আছে বিদআত, তো এটা বিদআতে হাসান। অথচ বিদআতে কোন হাসানা ও শাইয়াহ নেই।

৪। ছবি ও মূর্তি আকৃতিতে মিষ্ট তৈরিঃ

উপমহাদেশের হিন্দুদের অন্যতম একটি সংস্কৃতি হল, বৈশাখ মাসে মেলার আয়োজন করা। তারা অনেক অসামাজিক কাজের মাধ্যমে মেলা উৎজাপন করে থাকে। মেলায় বিভিন্ন স্টোলে বাহারী জিনিসের সমাহার ঘটে যার মধ্য অন্যতম আকর্ষন হল মিষ্টির দোকাণ। তারা বিভিন্ন জীব জস্তু ও মুর্তির আকুতিতে মিষ্টি করে। আর হিন্দুগন তা মনের আনন্দে খরিদ করে নেয়। কিন্তু আজকাল আমাদের দেশে শবে বরাত উপলক্ষ্যে মিষ্টির দোকানে এই জীব জস্তু ও মুর্তির ছবি সম্বলিত মিষ্টি তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। অথচ ছবি ও মূর্তি-প্রকৃতি ইত্যাদি তৈরি করা ইসলামে হারাম। আবার আল্লাহর দেয়া রিযিক নিয়ে এভাবে খেল-তামাশা করা করা কত বড় জঘন্য অপরাদ।

৫। মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করাঃ 

উপমহাদেশে যারা বিদআতে ধারক বাহক তাদের অনুষ্ঠান হবে অথচ মিলাদ হবে না ভাবা যায় না। শবে বরাতের রাত আর মসজিদে এশার সালাত পর মিলাদ একটি রেওয়াজে পরিনত হয়েছে। আর ২০/২৫ বছর ঢাকা আছি অনেক মসজিদে সালাত আদায় করা সৌভাগ্য হয়েছে। মাজার পুজারী বিদআতী নয় অনেক দেওবন্দী ঘরানার আলেমও ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শবে বরাতের মিলাদে জিলাপি কেনার জন্য চাঁদা আদায় করতে দেখেছি। এই রাতকে সামনে রেখে ঘরে ঘরে গিয়ে মিলাদের জিলপি কেনার টাকা তোলা হয়। বলূত তো এটা কার সুন্নাহ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগন কি এইভাবে মিলাদের আয়োজন করেছেন। আমাদের চার মাযহাবের কোন ইমান কি এমন আমল করতে বলেছে। শবে বরাত উপলক্ষ্যে মসজিদ ছাড়াও বিদআতিদের খানকাহ ও দরগায়সমূহে বিশাল আয়োজনে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। মিলাদ শেষে চলে মিষ্টি খওয়ার ধুম। চলতে থাকে বিদআতী পন্থায় গরম যিকিরের মজলিশ। এ সব কাজ দ্বীনের মধ্যে বিদআত ছাড়া কিছু নয়।

৬। মসজিদে সম্মিলিতভাবে খাওয়ার আয়োজন করাঃ

বিদআতীদের অনেক মসজিদে মিলাদ উপলক্ষে রান্না করা খাবার যেমনঃ পায়েশ, ভাত-গোশতের তরকারী, হালূয়া-রুটি জমা করে এবং মিলাদের পরে সকলে মিলে খেয়ে থাকে। মনে হবে, কোন একটি অনুষ্ঠানের খাওয়া দাওয়া চলছে। এই কাজকে তারা ইসলামি কাজ মনে করে নেকীর জন্য করছে অথচ এর কোন দলীল প্রমান কুরআন সুন্নাহতে নেই। এই ভাবে খেতে অসুবিধা নেই কিন্তু নির্দষ্ট দিনে নেকী আশায় আমল করলে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমানিত হতে হবে নতুবা বিদআত হবে।

৭। ইসলামি বিষয় আলোচনা ও জিকির করাঃ

ইসলামি বিষয় আলোচনা ও জিকির করার জন্য কোন সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়। আমাদের মাঝে অনেকেই এই রাতে কিয়ামে ব্যস্ত থেকেছেন কিন্তু সহিহ বুঝ আসার পর এই আমল ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু কিছু মুসলীম ভাইকে দেখা যায় এই রাতের মায়া ছাড়তে পারে না। তারা এই রাতের নির্দিষ্ট সালাত ছেড়ে দিলেও এশা সালাতের পর ইসলামি বিষয় আলোচনা ও জিকিরের মাহফিল কায়েম করে থাকেন। প্রশ্ন হল এই আলোচনা ও জিকিরের এই রাতে কেন? যদি তারা বছরের বিভিন্ন সময় এই ধরনের মাহফিল করে থাকে তবে কোন সমস্যা নেই কিন্তু যদি তারা সমগ্র বছরের শুধু এই রাতটিক খাস মনে করে এমন আমল করারে জরুরী মনে করে তবে তা আমল নয় বিদআতে পরিনত হবে। কারন যখন কোন আমল সময়ে সাথে করা কে জরুরী মনে করা হবে তবে তার দলীল প্রয়োজন হবে। আমলটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীদের থেকে প্রমানিত হতে হবে।

অনেক মসজিদে আলোচনা করার পর আবার নির্দিষ্ট সংখ্যক (১২/২০ রাকাত) সালাত আদায় করার সময় প্রদান করেন। এরপর লম্বা একটি সম্মিলিত মুনাজানের মাধ্যমে শেষ করেন। কোন কোন মসজিদে আরার আলোচনা শেষ করে ব্যক্তিগত আমল জিকির, সালাত, তিলওয়াত করার সময় প্রদান করে। ফজর সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজানের মাধ্যমে শেষ করেন। ইসলামি আলোচনা, সালাত, তিলওয়াত, জিকির এবং সম্মিলিত মুনাজান কোনটিই বিদআত নয়। কিন্তু শুধু এই রাতটিক খাস মনে করে সময়ে সাথে নির্দষ্ট করার জন্য বিদআত পরিনত হবে।

৮। সম্মিলিতভাবে কবর যিয়ারতঃ

উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেনঃ আমি এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিছানায় পেলাম না তাই আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম, ‘বাকী’ নামক কবরস্থানে তাকে পেলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তুমি কি আশংকা করেছো যে আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার সাথে অন্যায় আচরণ করবেন? আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি মনে করেছি আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন, অতঃপর কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন।

মন্তব্যঃ হাদিসের মান যঈফ। পূর্বের আলোচনায় থেকে জানতে পেরেছি হাদিসটির মান যইফ। তারপরও যদি হাদীসটিকে সহিহ বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলেও কি কোন প্রকার আমল প্রমাণিত। না এ হাদিস দ্বারা কোন আমল প্রমানিত হয় না। এই হাদিসে দ্বারা তিনটি বিষয় পরিস্কার।

১। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক করব জিয়ারত করা

২। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন।

৩। কালব গোত্রের পালিত বকরীর পশমের পরিমানের চেয়েও অধিক পরিমান লোকদের ক্ষমা করেন।

যদি কেউ এই হাদিসের আলোকে এই রাতে কবর জিয়ারত করে করতে পারে কিন্তু এই কবর জিয়ারত হবে একাকি, যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন। তিনি সময় সুযোগ থাকা সত্বেও নিজের স্ত্রী বা সাহাবী কাউকে এ আমলে শরীক করান নাই। এ হাদীসে দেখা গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানা ছেড়ে চলে গেলেন, আর পাশে শায়িত আয়িশা (রাঃ) কে ডাকলেন না। ডাকলেন না অন্য কাউকে। তাকে জাগালেন না বা সালাত আদায় করতে বললেন না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, রামাযানের শেষ দশকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। বেশী পরিমাণে ইবাদাত-বন্দেগী করতে বলতেন। যদি ১৫ শাবানের রাতে কোন ইবাদাত করার ফাযীলাত থাকত তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন আয়িশাকে (রাঃ) বললেন না? কেন রামাযানের শেষ দশকের মত সকলকে জাগিয়ে দিলেন না, তিনি তো নেক কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। কাজেই সম্মিলিতভাবে করব জিয়ারত এই রাতের আমল নয় বিদআত। তারপরও এক শ্রেণীর মানুষ এ রাতে গোরস্থান বা মাযার জিয়ারতে বের হয়। এমনকি কোথাও কোথাও এ প্রথাও দেখা যায় যে, একদল মানুষ এ রাতে ধারাবাহিকভাবে এলাকার সকল কবর যিয়ারত করে থাকে। এদের দলীল হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যঈফ সনদের এই উপরের হাদিসটি।

৯। আলোক সজ্জা করা এবং আতশবাজী করা :

শবে বরাতকে কেন্দ্র করে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষেরা আতশবাজি ও আলোকসজ্জা করে থাকে। তারা এ রাত উপলক্ষ্যে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, মসজিদ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি আলোকসজ্জা করা হয়। সে রাতে আশ্চর্য জনকভাবে চলতে থাকে আতশবাজী বা পটকা ফুটানো। শরীয়তের দৃষ্টিতে শবে বরাতে আলোকসজ্জা ও আতশবাজি করা শরীয়তসম্মত নয়। ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আলোক সজ্জা হচ্ছে গ্রীক ধর্মের একটি প্রথা। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে হিন্দু ধর্মের প্রথা হিসেবে রূপ লাভ করে যা শেষ পর্যন্ত দেয়ালীপূজা নামে মশহুর হয়। আলোক সজ্জা সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে মুসলমানগণের মধ্যে প্রবেশ করে।যা আমাদের দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়।  আতশবাজিও দ্বীন ইসলামের দৃষ্টিতে অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে আতশবাজিও হিন্দু ধর্মের একটি প্রথা। কাজেই মুসলমানদের জন্য শুধু শবে বরাতকেই কেন্দ্র করে নয়, বরং কোনো অবস্থাতেই আতশবাজি ও আলোকসজ্জা ইত্যাদি করা শরীয়তসম্মত নয়। এসব কাজের মাধ্যমে একদিকে লক্ষ লক্ষ টাকা শুধু অপচয় করা হয় না বরং এগুলো অগ্নি পুজকদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন,

Leave a comment