আকিদার বিদআতসমূহ ষষ্ঠ কিস্তি : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লকহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নুরের তৈরি

আকিদার বিদআতসমূহ : ষষ্ঠ কিস্তি

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লকহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নুরের তৈরি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

ইসলামি শরীয়তের প্রথম ও প্রধান বিষয় হল ইমান। আর খাটি ইমান হল, সঠিক আকিদা প্রষণ করা। কিন্তু খুবই দুঃখজনক বিষয় হল, আমরা সকলে মুসলিম দাবি করলেও শুধু আমাদের আকিদার কারনে আমরা মুসলিম নই। ইসলাম বহির্ভুত এই নতুত আকিদাকে বিদআতি আকিদা হিসাবে চিহিৃত করব। কুরআন সুন্নাহর বাহিরে যে আকিদা নতুন করে আবিস্কার হয়েছে তাই বিদআতি আকিদা। কাজেই যে কোন ভুল আকিদা যা কুরআন সুন্নাহের বাহিরে গিয়ে নতুত করে তৈরি হয়েছে তাই বিদআতি আকিদা। যার অর্থ হলো আকিদার ভূলভ্রান্তি মানেই বিদআত আকিদা। যৌক্তিক কোন কাজ সহজে যে কেউ মেনে নেন। আর বিজ্ঞান দ্বারা প্রমানিত কোন জ্ঞানতো সাথে সাথে মেনে নেয়। কিন্তু ইসলামি আকিদার মুল হল অদৃশ্যে বিশ্বাস এখানে জাগতিক কোন বিষয় থাকলে যুক্তি ও বিজ্ঞান দ্বারা পরীক্ষা করা যেত কিন্ত অদৃশ্যে বিশ্বাস করতে হলে অদৃশ্য থেকে প্রাপ্ত অহীর উপর নির্ভর করতে হবে। অহী ভিন্ন যে কোন উৎস থেকে আকিদা গ্রহন করলে শুদ্ধ ও অশুদ্ধ যে কোনটাই হতে পারে। ইসলামি আকিদা বিশ্বাস সব সময় আল্লাহকে কেন্দ্র অদৃশ্যের উপর নির্ভর করে থাকে। তাই ইসলামি আকিদার মুল উৎস হল কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ ভিত্ত্বিক। এই কুরআন সুন্নাহর বাহিরে যখনি নতুন করে আকিদা রচনা করা হবে তাই বিদআতি আকিদা।

যেমনঃ অদৃশ্যের একটি ব্যাপার হল কবরের আজাব। কবরে আজাব হবে এটাই সত্য। কিন্তু কাউকে যুক্তি দিয়ে কি কবরের আজাব বুঝাতে বা দেখাতে পাবর। কিংবা বিজ্ঞানের আবিস্কার ক্যামেরা দ্বারা কি এই আজাব দেখাতে পারব। অপর পক্ষে আমলের ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। এখানে কুরআন হাদিসের বাহিরে ইজমা কিয়াজের দরকার হয়। নতুন কোন সমস্যা আসলে কিয়াস করে মাসায়েল দিতে হয়। যেমনঃ মোবাইল, টিভি, ইন্টারনেট, শেয়ার বাজার ইত্যাদি ইসলামের প্রথমিক যুগে ছিলনা। তাই কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে কিয়াস করে সমাধান দিতে হয়। কজেই একটি কথা মনে রাখতে হবেঃ “আকিদা ও ফিকহের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো, ফিকহের ক্ষেত্রে ইসতিহাদ, কিয়াস, যুক্তি বা আকলি দলিলের প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে ইসতিহাদ, কিয়াস, যুক্তি বা আকলি দলিলের প্রয়োজন নেই”

এক কথায় বলে গেলে কুরআন হাদিসের ষ্পষ্ট কোন রেফারেন্স ছাড়া আকিদা গ্রহণীয় নয়। যদি কেউ যুক্তি দিয়ে আকিদা বুঝাতে আসে তাকে সালাম জানাতে হবে।

কুনআন সুন্নাহকে উৎস হিসাবে না নিলে আকিদার ভিন্নতা তো থাকবেই। আর এই ভিন্ন আকিদা আসবে সম্পূর্ণ নতুন করে যা বিদআত বলা হয়। কুরআন হাদিসে ষ্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই, এমন ফিকহি মাসলা মাসায়েলের ক্ষেতে ইখতিলাফ বা মতভেদ করা জায়েয হলেও, আকিদার ক্ষেত্রে কোন প্রকার মতভেদ জায়েয নেই। কারন আকিদার ছয়টি বিষয় (আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস, ফিরিশতাগণের প্রতি বিশ্বাস, কিতার সমুহের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগনের প্রতি বিশ্বাস শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস, তাক্বদীরের  ভালো মন্দেন প্রতি বিশ্বাস) যার সবগুলিই গায়েবের সাথে সম্পৃক্ত এবং গায়েব জানার জন্য অহীর প্রয়োজন। যতি কেউ তার আকিদাকে অহী ভিত্তিক না করে, যুক্তি ভিত্তিক করে, তাহলে তার বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। অহী ভিত্তিক না হয়ে আকিদা যুক্তি ভিত্তিক হলেই বিদআতি আকিদা হবে।

আকিদার সম্পর্কে আলোচনার আগে একটা কথাকে মনে খোদাই করে লিখে রাখেন, “আকিদা গাইবের প্রতি বিশ্বাস, এই বিশ্বাস হবে অহী নির্ভর, কোন প্রকার যু্‌ক্তিতর্কের অবতারণা করা যাবেনা”। কাজেই আমি যে ভ্রান্ত আকিদাগুলি তুলে ধরব তার বিপক্ষে আন্ততো কুরআনের একটি আয়াত অথবা একটি সহিহ হাদিস উপস্থাপণ করব। এই সহিহ আকিদার বিপরীতে যে সকল বিদআতি আকিদা সবার সামনে তুলে ধরব, সেই সকল আকিদার কুরআন সুন্নাহতে কোন প্রমান পাওয়া যাবে না। কুরআন সুন্নাহ নাই বলেই আকিদার নাম দিলাম বিদআতি আকিদা।

সঠিক আকিদা হলোঃ সাধারন মানুষে যে উপাদান দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লকহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সেই উপাদান মাটি থেকে তৈরি।

 বিদআতীদের আকিদা আমাদের প্রিয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লকহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নুরের তৈরি ছিলেন। যদি কোন সাধারণ লোককে প্রশ্ন করা হয় নবী কিসের তৈরি ছিলেন। সমাজের অধিকাংশ মুসলিম এই প্রশ্নের উত্তরে দিধা বিভক্ত। কারন আমরা যে আলেমদের উপর নির্ভর করি, তারা ও ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করছে। বর্তমানে মিডিয়ার কল্যানে আরো বেশী বিভ্রান্ত। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদির মাধ্যমে অনায়সেই যে কেউ তার মতামত প্রকাশ করছে। যখন যার কথা শুনি এবং তার যুক্তি এবং রেফারেন্স দেখি তাকেই সঠিক মনে করি আর বিভ্রান্ত হই। বিভ্রান্ত হওয়ারই কথা কারন আমিতো ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ, রেফারেন্স খুজে আসল নকল বাহির করার ক্ষমতা নাই। তাই কোন না কোন আলেমকে অন্ধভাবে অনুসরন করি। কাজেই যিনি যে পরিবেশে  জম্মগ্রহন করছে এবং তার বাপ দাদা যে বিশ্বাস করত তিনি সেই আকিদাই পোষন করছে। এর ব্যাতিক্রম খুবই বিরল। যেহেতু বিষয়টি ইখতেলাফি বা মতবিরোধপূর্ন তাই একজন সত্যিকার মুসলিম হিসাবে আসল সত্যটা অনুসন্ধান করা ফরজ দায়িত্ব। কিন্তু কি ভাবে অনুসন্ধান করব?

অনুসন্ধানের পদ্দতি ও আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন। সুরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতে বলেন:

فَإِن تَنَـٰزَعۡتُمۡ فِى شَىۡءٍ۬ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأَخِرِ‌ۚ ذَٲلِكَ خَيۡرٌ۬ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلاً (٥٩)

অর্খঃ এরপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন ব্যাপারে মতবিরোধ দেখা দেয় তাহলে তাকে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও৷ যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান এনে থাকো ৷ এটিই একটি সঠিক কর্মপদ্ধতি এবং পরিণতির দিক দিয়েও এটিই উৎকৃষ্ট৷

উক্ত আয়াত কারিমা দ্বারা এ কথা স্পষ্ট যে, মতবিরোধের বিষয়টি প্রথম আল্লাহ তায়ালার দিকে ফিরতে হবে অর্থাৎ কুরআনুল কারিমে কি বলছে তার অনুসরন করতে হবে। কুরআনুল কারিমে না পেলে রাসুল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহের সরনাপন্ন হতে হবে।

ইসলামি আকিদার মুল উৎস বা ভিত্তি হল কুরআন ও সহিহ হাদিস। কুরআন ও হাদিস সাহাবিগন যেভাবে বুঝেছেন ঠিক তেমনিভাবে বুঝতে হবে। একটা কথা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছি, আকিদার ক্ষেত্র কোন ইজমা, কিয়াস, যুক্তি, আকলি দলীল ইত্যাদি পরিত্যাজ্য। নুরের তৈরি বিষয়টি আকিদার সাথে সংশ্লষ্ট তাই কুরআন হাদিসের আলোকে আলোচনা করা হবে। এবং আল্লাহর দেওয়া নির্দেশ মত কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দিয়েই সমাধানের পথ খুজব ইনশাআল্লাহর। প্রথমে কুরআনে মাধ্যমে প্রমান দিব আমাদের প্রিয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লকহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সকল নবী রাসূলগণ মানুষ ছিলেন, তার পর প্রমান করব সকল মানুষই মাটির তৈরি।

১। কুরআনের আলোকে মানুষ সৃষ্টির উপদানঃ

পূর্বের আলোচনা দ্বারা এ কথা স্পষ্ট ঘোষনা রাসুল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং অন্যান্য নবী রাসুলগন আমাদের মতই একজন মানুষ৷ সহিহ হদিসেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মতই মানবিয় বৈশিষ্ট সম্পন্ন  একজন মানুষ ছিলেন৷ কুরআনে একটা দুটি নয়, বহু আয়াতের আলোকে প্রমানিত হলঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবিয় বৈশিষ্ট সম্পন্ন একজন মানুষ। এবার দেখা যায মানুষ কে কোন উপদানে দ্বারা সৃষ্টি করা হইয়াছে।

কোন দ্রব্য কিনলে দেখবেন তার প্যাকেটের গায়ে নির্মাতা ঐ দ্রব্য তৈরির উপাদানগুরির তালিকা দিয়েছেন। কারন নির্মাতাই ভাল জানেন কি উপাদান দ্বারা দ্রব্যটি তৈরি হয়েছে। যে সৃষ্টি করে, সেই জানে কোন উপাদারন সৃষ্টি করা হইয়াছে। মহান আল্লাহ তায়ালা যেহেতু মানুষের সৃষ্টিকর্তা সেই হিসাবে একমাত্র তিনিই জানেন মানুষ কে কোন উপদানে সৃষ্টি করা হইয়াছিল। সুতারং আসুন মহান আল্লাহ তায়ালা কি বলে তাহার নাজিল কৃত আল কুরআর থেকে জেনে নেই।

১. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَمِنۡ ءَايَـٰتِهِۦۤ أَنۡ خَلَقَكُم مِّن تُرَابٍ۬ ثُمَّ إِذَآ أَنتُم بَشَرٌ۬ تَنتَشِرُونَ (٢٠)

অর্থঃ তাঁর  নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে তাঁরপর সহসা তোমরা হলে মানুষ, পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়ছো। (সুরা রুম-৩০:২০)।

২. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

إِنَّ مَثَلَ عِيسَىٰ عِندَ ٱللَّهِ كَمَثَلِ ءَادَمَ‌ۖ خَلَقَهُ ۥ مِن تُرَابٍ۬ ثُمَّ قَالَ لَهُ ۥ كُن فَيَكُونُ (٥٩)

অর্থঃ আল্লাহর কাছে ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের মতো৷ কেননা আল্লাহ তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেন এবং হুকুম দেন , হয়ে যাও, আর তা হয়ে যায়৷ (সুরা আল ইমরান-৩:৫৯)।

৩. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

هُوَ ٱلَّذِى خَلَقَكُم مِّن طِينٍ۬ ثُمَّ قَضَىٰٓ أَجَلاً۬‌ۖ وَأَجَلٌ۬ مُّسَمًّى عِندَهُ ۥ‌ۖ ثُمَّ أَنتُمۡ تَمۡتَرُونَ (٢)

অর্থ: তিনিই তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে ৷তারপর তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন জীবনের একটি সময়সীমা এবং আর একটি সময়সীমাও আছে, যা তাঁর কাছে স্থিরীকৃত, কিন্তু তোমরা কেবল সন্দেহেই লিপ্ত রয়েছে৷ (সুরা আনাম-৬:২)

৪. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

قَالَ مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسۡجُدَ إِذۡ أَمَرۡتُكَ‌ۖ قَالَ أَنَا۟ خَيۡرٌ۬ مِّنۡهُ خَلَقۡتَنِى مِن نَّارٍ۬ وَخَلَقۡتَهُ ۥ مِن طِينٍ۬ (١٢)

অর্থঃ আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, “আমি যখন তোকে হুকুম দিয়েছিলাম তখন সিজদা করতে তোকে বাধা দিয়েছিল কিসে”? সে জবাব দিলঃ “আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ৷ আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছো এবং ওকে সৃষ্টি করেছো মাটি থেকে। (সুরা আরাফ-৭:১২)।

৫. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَلَقَدۡ خَلَقۡنَا ٱلۡإِنسَـٰنَ مِن سُلَـٰلَةٍ۬ مِّن طِينٍ۬ (١٢)

অর্থঃ আমি মানুষকে তৈরী করেছি মাটির উপাদান থেকে। (সুরা মুমিনুন-২৩:১২)।

৬. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

فَٱسۡتَفۡتِہِمۡ أَهُمۡ أَشَدُّ خَلۡقًا أَم مَّنۡ خَلَقۡنَآ‌ۚ إِنَّا خَلَقۡنَـٰهُم مِّن طِينٍ۬ لَّازِبِۭ (١١)

অর্থঃ এখন এদেরকে জিজ্ঞেস করো, এদের সৃষ্টি বেশী কঠিন, না আমি যে জিনিসগুলো সৃষ্টি করে রেখেছি সেগুলোর? এদেরকে তো আমি সৃষ্টি করেছি আঠাল কাদামাটি দিয়ে৷ [সাফফাত-৩৭:১১]

৭. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

إِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلَـٰٓٮِٕكَةِ إِنِّى خَـٰلِقُۢ بَشَرً۬ا مِّن طِينٍ۬ (٧١)

অর্থঃ যখন তোমার রব ফেরশ্‌তাদেরকে বললো, “আমি মাটি দিয়ে একটি মানুষ তৈরি করবো৷[সোয়াদ- ৩৮:৭১]

৮. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

قَالَ يَـٰٓإِبۡلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسۡجُدَ لِمَا خَلَقۡتُ بِيَدَىَّ‌ۖ أَسۡتَكۡبَرۡتَ أَمۡ كُنتَ مِنَ ٱلۡعَالِينَ (٧٥) قَالَ أَنَا۟ خَيۡرٌ۬ مِّنۡهُ‌ۖ خَلَقۡتَنِى مِن نَّارٍ۬ وَخَلَقۡتَهُ ۥ مِن طِينٍ۬ (٧٦)

অর্থঃ রব বললেন, “হে ইবলিস আমি আমার দুই হাত দিয়ে যাকে তৈরি করেছি তাকে সিজদা করতে তোমাকে কিসে বাধা দিয়েছে?  তুমি কি বড়াই করছো, না তুমি কিছু উচ্চ মর্যাদার অধিকারী?” সে জবাব দিল, “আমি তার তুলনায় শ্রেষ্ঠ, তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো আগুন থেকে এবং তাকে মাটি থেকে৷”  (সুরা সোয়াদ- ৩৮:৭৫-৭৬)।

এই আয়াতগুলি ও আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল মানুষ মাটির তৈরি। আগের আকিদার আলোচনায় দেখেছি কুরআনে বহু আয়াতে বলা হয়েছে আমাদের নবী (সাঃ) মানুষ ছিলেন। আর কুরআনের ব্যাখ্যায় কুরআন থাকলে কোন যুক্তি, কিচ্ছা কাহিনী, বুজুর্গানের মতামত পরিত্যয্য।

২। নূর বলতে  আল কুরআনে কি বোঝান হইয়াছে?

ব্যপারটি আলোচনার আগে নূর কি, এ সম্পর্কে  কুরআন কি বলে তা বুঝা ও আলোচনার দাবি রাখে।

আরবী ভাষায় ‘নূর’ (نور) শব্দের অর্থ আলো, জ্যোতি, আগুনের শিখা, উজ্জ্বলতা,  ইত্যাদি। সকল ভাষাতেই নূর শব্দটি, শাব্দিক অর্থে ব্যবহৃত হয় আবার রূপক অর্থে ও ব্যবহৃত হয়। কুরআনে ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। যেমনঃ

৩। নূর বলতে আল কুরআনকে বোঝান হইয়াছে।

১. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

يَـٰٓأَيُّہَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَكُم بُرۡهَـٰنٌ۬ مِّن رَّبِّكُمۡ وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكُمۡ نُورً۬ا مُّبِينً۬ا (١٧٤)

অর্থঃ হে লোকেরা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে উজ্জল প্রমাণপত্র এসে গেছে এবং আমি তোমাদের কাছে এমন আলোক রশ্মি পাঠিয়েছি যা তোমাদের সুস্পষ্টভাবে পথ দেখিয়ে দেবে৷ [নিসা-৪:১৭৪]

২. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

. فَـَٔامِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَٱلنُّورِ ٱلَّذِىٓ أَنزَلۡنَا‌ۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٌ۬ (٨)

অর্থঃ তাই ঈমান আন আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং সেই ‘নূর’ বা আলোর প্রতি যা আমি নাযিল করেছি৷ আর তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত৷ [তাগাবুন- ৬৪:৮]

৩. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَٱتَّبَعُواْ ٱلنُّورَ ٱلَّذِىٓ أُنزِلَ مَعَهُ ۥۤ‌ۙ أُوْلَـٰٓٮِٕكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ (١٥٧)

অর্থঃ কাজেই যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সাহায্য সহায়তা দান করে এবং তার সাথে অবতীর্ণ আলোকে রশ্মির অনুসরণ করে তারাই সফলতা লাভের অধিকারী৷ [ আরাফ ৭:১৫৭]

৪. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَكَذَٲلِكَ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ رُوحً۬ا مِّنۡ أَمۡرِنَا‌ۚ مَا كُنتَ تَدۡرِى مَا ٱلۡكِتَـٰبُ وَلَا ٱلۡإِيمَـٰنُ وَلَـٰكِن جَعَلۡنَـٰهُ نُورً۬ا نَّہۡدِى بِهِۦ مَن نَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِنَا‌ۚ وَإِنَّكَ لَتَہۡدِىٓ إِلَىٰ صِرَٲطٍ۬ مُّسۡتَقِيمٍ۬ (٥٢)

অর্থঃ এভাবেই (হে মুহাম্মাদ), আমি আমার নির্দেশে তোমার কাছে এক রূহকে অহী করেছি৷ তুমি আদৌ জানতে না কিতাব কি এবং ঈমানই বা কি৷ কিন্তু সেই রূহকে আমি একটি আলো বানিয়ে দিয়েছি যা দিয়ে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ দেখিয়ে থাকি৷ নিশ্চিতভাবেই আমি তোমাকে সোজা পথের দিক নির্দেশনা দান করছি৷ (শুরা ৪২:৫২)।

৪। নুর বলতে আল্লাহর দেওয়া হেদায়েত বোঝান হইয়াছে।

১. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦۤ إِذۡ قَالُواْ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ عَلَىٰ بَشَرٍ۬ مِّن شَىۡءٍ۬‌ۗ قُلۡ مَنۡ أَنزَلَ ٱلۡكِتَـٰبَ ٱلَّذِى جَآءَ بِهِۦ مُوسَىٰ نُورً۬ا وَهُدً۬ى لِّلنَّاسِ‌ۖ تَجۡعَلُونَهُ ۥ قَرَاطِيسَ تُبۡدُونَہَا وَتُخۡفُونَ كَثِيرً۬ا‌ۖ وَعُلِّمۡتُم مَّا لَمۡ تَعۡلَمُوٓاْ أَنتُمۡ وَلَآ ءَابَآؤُكُمۡ‌ۖ قُلِ ٱللَّهُ‌ۖ ثُمَّ ذَرۡهُمۡ فِى خَوۡضِہِمۡ يَلۡعَبُونَ (٩١)

অর্থঃ তারা আল্লাহকে যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারেনি, যখন তারা বললঃ আল্লাহ কোন মানুষের প্রতি কোন কিছু অবতীর্ণ করেননি। আপনি জিজ্ঞেস করুনঃ ঐ গ্রন্থ কে নাযিল করেছে, যা মূসা নিয়ে এসেছিল? যা জ্যোতিবিশেষ এবং মানব মন্ডলীর জন্যে হোদায়েতস্বরূপ, যা তোমরা বিক্ষিপ্তপত্রে রেখে লোকদের জন্যে প্রকাশ করছ এবং বহুলাংশকে গোপন করছ। তোমাদেরকে এমন অনেক বিষয় শিক্ষা দেয়া হয়েছে, যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা জানতো না। আপনি বলে দিনঃ আল্লাহ নাযিল করেছেন। অতঃপর তাদেরকে তাদের ক্রীড়ামূলক বৃত্তিতে ব্যাপৃত থাকতে দিন। (সুরা আন’য়াম ৬:৯১)।

২. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

إِنَّآ أَنزَلۡنَا ٱلتَّوۡرَٮٰةَ فِيہَا هُدً۬ى وَنُورٌ۬‌ۚ يَحۡكُمُ بِہَا ٱلنَّبِيُّونَ ٱلَّذِينَ أَسۡلَمُواْ لِلَّذِينَ هَادُواْ

অর্থঃ  আমি তাওরাত নাযিল করেছি৷ তাতে ছিল পথ নির্দেশ ও আলো৷ সমস্ত নবী, যারা মুসলিম ছিল, সে অনুযায়ী এ ইহুদী হয়ে যাওয়া লোকদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা করতো৷ (সুরা মায়েদা ৫:৪৪)।

৩. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَقَفَّيۡنَا عَلَىٰٓ ءَاثَـٰرِهِم بِعِيسَى ٱبۡنِ مَرۡيَمَ مُصَدِّقً۬ا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ مِنَ ٱلتَّوۡرَٮٰةِ‌ۖ وَءَاتَيۡنَـٰهُ ٱلۡإِنجِيلَ فِيهِ هُدً۬ى وَنُورٌ۬ وَمُصَدِّقً۬ا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ مِنَ ٱلتَّوۡرَٮٰةِ وَهُدً۬ى وَمَوۡعِظَةً۬ لِّلۡمُتَّقِينَ (٤٦)

অর্থ: তারপর ঐ নবীদের পরে মারয়ামপুত্র ঈসাকে পাঠিয়েছি৷ তাওরাতের মধ্য থেকে যা কিছু তার সামনে ছিল সে তার সত্যতা প্রমাণকারী ছিল৷ আর তাকে ইনজিল দিয়েছি৷ তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো এবং তাওরাতের মধ্যে থেকে যা কিছু সে সময় বর্তমান ছিল তার সত্যতা প্রমাণকারী ছিল। (সুরা মায়েদা ৫:৪৬)।

৪. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

أَوَمَن كَانَ مَيۡتً۬ا فَأَحۡيَيۡنَـٰهُ وَجَعَلۡنَا لَهُ ۥ نُورً۬ا يَمۡشِى بِهِۦ فِى ٱلنَّاسِ كَمَن مَّثَلُهُ ۥ فِى ٱلظُّلُمَـٰتِ لَيۡسَ بِخَارِجٍ۬ مِّنۡہَا‌ۚ كَذَٲلِكَ زُيِّنَ لِلۡكَـٰفِرِينَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ (١٢٢)

অর্থ: যে ব্যক্তি প্রথমে মৃত ছিল, পরে আমি তাকে জীবন দিয়েছি  এবং তাকে এমন আলো দিয়েছি যার উজ্জ্বল আভায় সে মানুষের মধ্যে জীবন পথে চলতে পারে। সে কি এমন ব্যক্তির মতো হতে পারে, যে অন্ধকারের বুকে পড়ে আছে এবং কোনক্রমেই সেখানে বের হয় না ? (সুরা আনআম-৬:১২২)।

৫. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

يَـٰٓأَيُّہَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَءَامِنُواْ بِرَسُولِهِۦ يُؤۡتِكُمۡ كِفۡلَيۡنِ مِن رَّحۡمَتِهِۦ وَيَجۡعَل لَّڪُمۡ نُورً۬ا تَمۡشُونَ بِهِۦ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ‌ۚ وَٱللَّهُ غَفُورٌ۬ رَّحِيمٌ۬ (٢٨)

অর্থ: হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর রসুল (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ওপর ঈমান আনো৷  তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে দ্বিগুণ রহমত দান করবেন, তোমাদেরকে সেই জ্যোতি দান করবেন যার সাহায্যে তোমরা পথ চলবে এবং তোমাদের ত্রুটি -বিচ্যুতি মাফ করে দেবেন৷ আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু৷ (সুরা হাদিদ-৫৭:২৮)।

৬. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

ٱللَّهُ نُورُ ٱلسَّمَـٰوَٲتِ وَٱلۡأَرۡضِ‌ۚ مَثَلُ نُورِهِۦ كَمِشۡكَوٰةٍ۬ فِيہَا مِصۡبَاحٌ‌ۖ ٱلۡمِصۡبَاحُ فِى زُجَاجَةٍ‌ۖ ٱلزُّجَاجَةُ كَأَنَّہَا كَوۡكَبٌ۬ دُرِّىٌّ۬ يُوقَدُ مِن شَجَرَةٍ۬ مُّبَـٰرَڪَةٍ۬ زَيۡتُونَةٍ۬ لَّا شَرۡقِيَّةٍ۬ وَلَا غَرۡبِيَّةٍ۬ يَكَادُ زَيۡتُہَا يُضِىٓءُ وَلَوۡ لَمۡ تَمۡسَسۡهُ نَارٌ۬‌ۚ نُّورٌ عَلَىٰ نُورٍ۬‌ۗ يَہۡدِى ٱللَّهُ لِنُورِهِۦ مَن يَشَآءُ‌ۚ وَيَضۡرِبُ ٱللَّهُ ٱلۡأَمۡثَـٰلَ لِلنَّاسِ‌ۗ وَٱللَّهُ بِكُلِّ شَىۡءٍ عَلِيمٌ۬ (٣٥)

অর্থঃ আল্লাহ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের জ্যোতি, তাঁর জ্যোতির উদাহরণ যেন একটি কুলঙ্গি, যাতে আছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচপাত্রে স্থাপিত, কাঁচপাত্রটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ্য। তাতে পুতঃপবিত্র যয়তুন বৃক্ষের তৈল প্রজ্বলিত হয়, যা পূর্বমুখী নয় এবং পশ্চিমমুখীও নয়। অগ্নি স্পর্শ না করলেও তার তৈল যেন আলোকিত হওয়ার নিকটবর্তী। জ্যোতির উপর জ্যোতি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ দেখান তাঁর জ্যোতির দিকে। আল্লাহ মানুষের জন্যে দৃষ্টান্তসমূহ বর্ণনা করেন এবং আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত। (সুরা নুর ২৪:৩৫)।

 ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, আল্লাহ্‌ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর নূর অর্থাৎ আল্লাহ্‌ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর পথ প্রদর্শক। আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু নূর হল হেদায়েত(তাফসিরে ইবনে কাসির পঞ্চদশ খন্ড)

 ৫। নুর বলতে আল্লাহ দ্বীর ইসলাম কে বুঝিয়েছেন।

১. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

يُرِيدُونَ لِيُطۡفِـُٔواْ نُورَ ٱللَّهِ بِأَفۡوَٲهِهِمۡ وَٱللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِۦ وَلَوۡ ڪَرِهَ ٱلۡكَـٰفِرُونَ (٨)

অর্থ: এরা তাদের মুখের ফুঁ দিয়ে আল্লাহর নূরকে (দ্বীন কে) নিভিয়ে দিতে চায়৷ অথচ আল্লাহর ফায়সালা হলো তিনি তার নূরকে পূর্নরূপে বিকশিত করবেন৷ কাফেররা তা যতই অপছন্দ করুক না কেন। (সুরা সাফ ৬১:৮)।

২. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

يُرِيدُونَ أَن يُطۡفِـُٔواْ نُورَ ٱللَّهِ بِأَفۡوَٲهِهِمۡ وَيَأۡبَى ٱللَّهُ إِلَّآ أَن يُتِمَّ نُورَهُ ۥ وَلَوۡ ڪَرِهَ ٱلۡكَـٰفِرُونَ (٣٢)

অর্থঃ তারা চায় তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলো (দ্বীন)  নিভিয়ে দিতে ৷ কিন্তু আল্লাহ তার আলোকে পূর্ণতা দান না করে ক্ষান্ত হবেন না, তা কাফেরদের কাছে যতই অপ্রীতিকর হোক না কেন। (সুরা তাওবা ৯:৩২)।

৩. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

الٓر‌ۚ ڪِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ إِلَيۡكَ لِتُخۡرِجَ ٱلنَّاسَ مِنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِ رَبِّهِمۡ إِلَىٰ صِرَٲطِ ٱلۡعَزِيزِ ٱلۡحَمِيدِ (١)

অর্থঃ আলিফ-লাম-র৷ হে মুহাম্মদ৷ এটি একটি কিতাব, তোমার প্রতি এটি নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর মধ্যে নিয়ে আসো তাদের রবের প্রদত্ত সুযোগ ও সামর্থের ভিত্তিতে, এমন এক আল্লাহর পথে যিনি প্রবল প্রতাপান্বিত ও আপন সত্তায় আপনি প্রশংসিত। [ইবরাহীম ১৪:১]

৪ . মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

يَهۡدِى بِهِ ٱللَّهُ مَنِ ٱتَّبَعَ رِضۡوَٲنَهُ ۥ سُبُلَ ٱلسَّلَـٰمِ وَيُخۡرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِهِۦ وَيَهۡدِيهِمۡ إِلَىٰ صِرَٲطٍ۬ مُّسۡتَقِيمٍ۬ (١٦)

অর্থঃ যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর সন্তোষকামী লোকদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথপ্রদর্শন করেন এবং  নিজ ইচ্ছাক্রমে তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের দিকে নিয়ে আসেন এবং সরল-সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন৷[মায়েদা-৫:১৬]

৫. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

وَلَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا مُوسَىٰ بِـَٔايَـٰتِنَآ أَنۡ أَخۡرِجۡ قَوۡمَكَ مِنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ وَذَڪِّرۡهُم بِأَيَّٮٰمِ ٱللَّهِ‌ۚ إِنَّ فِى ذَٲلِكَ لَأَيَـٰتٍ۬ لِّكُلِّ صَبَّارٍ۬ شَكُورٍ۬ (٥)

অর্থঃ আমি এর আগে মূসাকেও নিজের নিদর্শনাবলী সহকারে পাঠিয়েছিলাম৷ তাকেও আমি হুকুম দিয়েছিলাম, নিজের সম্প্রদায়কে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের মধ্যে নিয়ে এসো এবং তাদেরকে ইতিহাসের  শিক্ষণীয় ঘটনাবলী শুনিয়ে উপদেশ দাও৷ এ ঘটনাবলীর মধ্যে বিরাট নির্দশণ  রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে সবর করে ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে৷ (ইবরাহীম ১৪:৫)।

৬. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

ٱللَّهُ وَلِىُّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ يُخۡرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ‌ۖ وَٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ أَوۡلِيَآؤُهُمُ ٱلطَّـٰغُوتُ يُخۡرِجُونَهُم مِّنَ ٱلنُّورِ إِلَى ٱلظُّلُمَـٰتِ‌ۗ أُوْلَـٰٓٮِٕكَ أَصۡحَـٰبُ ٱلنَّارِ‌ۖ هُمۡ فِيہَا خَـٰلِدُونَ (٢٥٧)

অর্থঃ যারা ঈমান আনে আল্লাহ তাদের সাহায্যকার ও সহায় ৷ তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর মধ্যে নিয়ে আসেন ৷ আর যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করে তাদের সাহায্যকারী ও সহায় হচ্ছে তাগুত ৷ সে তাদের আলোক থেকে অন্ধকারের মধ্যে টেনে নিয়ে যায় ৷ এরা আগুনের অধিবাসী ৷ সেখানে থাকবে এরা চিরকালের জন্য ৷ (বাকারা ২:২৫৭)।

৭. মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

هُوَ ٱلَّذِى يُصَلِّى عَلَيۡكُمۡ وَمَلَـٰٓٮِٕكَتُهُ ۥ لِيُخۡرِجَكُم مِّنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِۚ وَڪَانَ بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ رَحِيمً۬ا (٤٣)

অর্থঃ তিনিই তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতারা তোমাদের জন্য দোয়া করে, যাতে তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের মধ্যে নিয়ে আসেন, তিনি মুমিনদের প্রতি বড়ই মেহেরবান। (আহজাব- ৩৩:৪৩)।

উপরের সতেরটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা “নূর” শব্দটি ব্যবহার করছেন। নূর বলতে কোথাও কুরআনকে, কোথাও আল্লাহর দেওয়া হেদায়েতকে, আবার কোথাও দ্বীন ইসলামকে বোঝান হইয়াছে।

৬। যারা বিশ্বাস করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূরের তৈরী এ ব্যাপারে তাদের দলিল কি?

এ ব্যাপারে বিদাতি আলেমদের দেখা যায় দলিল হিসাবে আল কুরআনের সুরা মায়েদার পনের নম্বর  আয়াতটি ব্যবহার করে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

يَـٰٓأَهۡلَ ٱلۡڪِتَـٰبِ قَدۡ جَآءَڪُمۡ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمۡ ڪَثِيرً۬ا مِّمَّا ڪُنتُمۡ تُخۡفُونَ مِنَ ٱلۡڪِتَـٰبِ وَيَعۡفُواْ عَن ڪَثِيرٍ۬‌ۚ قَدۡ جَآءَڪُم مِّنَ ٱللَّهِ نُورٌ۬ وَڪِتَـٰبٌ۬ مُّبِينٌ۬ (١٥)

অর্থঃ হে আহলি কিতাব! আমার রসূল তোমাদের কাছে এসে গেছে৷ সে আল্লাহর কিতাবের এমন অনেক কথা তোমাদের কাছে প্রকাশ করছে যেগুলো তোমরা গোপন করে রাখতে এবং অনেক ব্যাপারে ক্ষমার চোখেও দেখছে৷ তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে গেছে এক নূর এবং আমি একখানি সত্য দিশারী কিতাব। (মায়েদা -৫:১৫)।

এই আয়াতের শেষাংশে বরা হইয়াছে: তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে গেছে এক নূর এবং আমি একখানি সত্য দিশারী কিতাব” কিতাব বলতে আল কুরআন কে বুঝান হইয়াছে কিন্তু নূর বলতে কি বুঝান হইয়াছে?  আগেই বলেছি, উপরের সতেরটি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা “নূর” শব্দটি ব্যবহার করছেন। নূর বলতে কোথাও আল কুরআনকে, কোথাও আল্লাহর দেওয়া হেদায়েতকে, আবার কোথাও ইসলামকে বোঝান হইয়াছে। আমাদের দেখতে হবে সলফে সালেহিন, তাবেইন, তাবে তাবেইন, বিশিষ্ট মুফাস্সিরগন এ আয়াতের তাফসির কি করছেন। কোনো কোনো মুফাস্সির নূর দ্বারা কুরআন বুঝুয়েছেন, কারন কুরআন মানুষ শির্ক বিদাতের অন্ধকার থেকে নূর বা আলোর দিকে নিয়ে যায়। কোনো মুফাস্সির নূর দ্বারা হেদায়েত বুঝিয়েছেন। আবার কোথাও নূর দ্বারা ইসলামকে বোঝান হইয়াছে। কেহ কেহ নূর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ও বুঝিয়েছেন। বিষেশ করে সুরা মায়েদা পনের নম্বর এ আয়াতটির ব্যাখ্যায় অনেকে মুফাস্সিরই বলেছেন যে, নূর বলতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে।  কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূর দ্বারা সৃষ্ট’ এরূপ কোনো আয়াত কুরআন কারীমে নেই। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ব্যবহৃত ‘নূর’ শব্দের ব্যাখ্যায় কোনো মুফাস্সিরই বলেনি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূর দ্বারা সৃষ্ট।

৭। নূর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝিয়েছেনঃ

যারা নূর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝিয়েছেন তাদের কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করলাম।

১. বিশ্ব বিখ্যাত মুফাসসিরে কোরআন হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) এর বিশ্ব বিখ্যাত তাফসির গ্রহন্থ ইবনে আব্বাসে আছে।

নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট হতে তোমাদের  কাছে নূর অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেছেন। (তাফসিরে ইবনে আব্বাস পৃষ্ঠা-৭২)।

২. ইমামুল মুতাকাল্লেমীন আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী (রহ) এই আয়াত প্রসঙ্গে বলঃ

নিশ্চয়ই নূর দ্বারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং কিতাব দ্বারা আল কোরআন মজীদকে বুঝানো হয়েছে।  (তাফসিরে কবীর খন্ড-৩, পৃষ্ঠ-৩৯৫)

৩. আল্লামা ইসমাঈল হক্কী রহ আলেনঃ

প্রথমটা অর্থাৎ নূর দ্বারা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বুঝানো হয়েছে এবং দ্বিতীয়টা অর্থাৎ কিতাবে মুবীন দ্বারা কুরআন কে বুঝানো হয়েছে। (তাফসিরে রুহুল বয়ান খন্ড-২, পৃষ্ঠ-২৬৯)।

৪. ইমাম মুহীউস সুন্নাহ আবু মু‏হাম্মদ আল হোসাইন আল ফারারা আল বাগাভী রহ. বলেনঃ

নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট হতে তোমাদের  কাছে নূর অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেছেন। (তাফসিরে মাআলিমুত তানীল)।

৮। নূর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নয় অন্য কিছু বুঝিয়েছেনঃ

আবার যারা নূর দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশাপাশি অন্য কিছু বুঝিয়েছেন তাদের ও কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করলাম।

১. ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জারীর আত তাবারী তার বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ইবনে জারীর এর মধ্যে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট হতে তোমাদের  কাছে নূর অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেছেন, যে নূর দ্বারা আল্লাহ সত্যকে উজ্জ্বল ও ইসলামকে প্রকাশ করেছেন এবং শিরিককে নিশ্চিহ্ন করেছেন। (তাফসিরে ইবনে জারির খন্ড-৬, পৃষ্ঠ-৮৬)।

 ২.  মুহীউস্সুন্নাহ আল্লামা আলাউদ্দীন আলী ইবনে মুহাম্মদ রহ. যিনি খাজিন নামে পরিচিত তিনি তাফসিরে খাজেনের মধ্যে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট হতে তোমাদের  কাছে নূর অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেছেন। আল্লাহ তায়া’লা তাঁর নামকরণ করেছেন নূর, কারণ তাঁর নূরেতে হেদায়ত লাভ করা যায়। যেভাবে অন্ধকারে নূর দ্বারা পথ পাওয়া যায়। তাফসিরে খাজেন পৃষ্ঠা -৪১৭)।

 ৩. ইমাম হাফেজ উদ্দীন আবুল বারাকাত আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ আন নাসাফী এই আয়াত প্রসঙ্গ বলেন,

আর নূর হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। কেননা তাঁর নূরেতে হেদায়ত লাভ করা যায়, যেমন তাঁকে উজ্জ্বল প্রদীপ বলা হয়েছে। (তাফসিরে মাদারিক প্রথম খন্ড পৃষ্ঠা-৪৭১)।

বিদআতি আলেমগন বলেন, “এখানে ‘নূর’ অর্থে মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝান হয়েছে অর্থাৎ তিনি নূরের তৈরি”। চট্রগ্রাম কাদেরিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল জলিল এক বিশাল ওয়াজ মাহফিলে এই তাফসিরই করলেন। আরেক বক্তা ‘জসিম উদ্দিন আজহারীএই উদ্দেশ্যে আঠার মিনিটের একটা ভিডিও তৈরি করে অন লাইনে ছেড়ে দিয়েছেন। বিশাল বিশাল তাফসির দেখিয়ে আরবি পড়ে অনুবাদ করলেন। এখানে ‘নূর’ দ্বারা মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝান হয়েছে। অতপর, নিজে যোগ করলেন অর্থাৎ তিনি নূরের তৈরি। দেখলেন জালিয়াতি কাকে বলে তাও আবার আকিদার বিষয় নিয়ে। এই ভাবে মিডিয়া ব্যক্তিত্ত্ব নুরুল ইসলাম ফারুকি এক বিশাল মাহফিলে  আটটি তাফসিরের রেফারেন্স দিয়া বললেন এখানে নূর বলতে হুজুরের নুর বুঝান হয়েছে। অতপর, আবার নিজে যোগ করলেন অর্থাৎ তিনি নূরের তৈরি। কি সুন্দর তাফসির কারক! আর কি সুন্দর দলিল! এই রকম মনমত তাফসির করলে ‌ইসলামের বারটা বাজবে এত কোন সন্দেহের অবকাস নেই।

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ) বলেন, তাফসীর গ্রন্থগুলোতে বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যায় অনেক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস আলোচনা করা হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, ইমাম তাবারী সূরা মায়েদার পনের আয়াতের ব্যাখ্যায় নূর বলতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু তিনি বা অন্য কোনো প্রাচীন মুফাস্সির রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূর থেকে সৃষ্ট বিষয়ক কোনো হাদীস এখানে উল্লেখ করেন নি। ইতিহাস ও সীরাত বিষয়ক বইগুলোতে অগণিত যয়ীফ ও ভিত্তিহীন রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে অনেক অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ রচনা করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের প্রথম ৫০০ বছরে লেখা কোনো একটি ইতিহাস বা সীরাত গ্রন্থে  ‘নূর মুহাম্মাদী’ বিষয়টি কোনোভাবে আলোচনা করা হয়নি। এখানে তিনটি বিষয় রয়েছে।

(১)  রাসূলুল্লাহ নূর প্রদানকারী প্রদীপ হিসেবে প্রেরিত এটি কুরআন দ্বারা প্রমাণিত

(২)  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘নূর’ এ কথা কোনো কোনো মুফাস্সির বলেছেন।

(২) রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘নূর’ দ্বারা সৃষ্ট’ এ কথা একেবারেই ভিত্তিহীন।

(সুত্র হাদিসের নামে জালিয়াতি, ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর)।

  

৯। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূরের তৈরী এ সম্পর্কে হাদিস কি বলে?

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূরের তৈরী এ সম্পর্কে অনেক জাল হাদিস তৈরি করা হইয়াছে। সবগুলি একত্র করলে একটা বিরাট বই হয়ে যাবে। নূর সম্পর্কিত হাদিসগুলি কে জাল হাদিস বলার কারন উল্লেখ করলে আর সংশয় তাকবে না ইনশাআল্লাহ। এই প্রযুক্তির যুগে যে কেউ ইচ্ছা করলেই অনায়াসে তার প্রয়োজন মাফিক হাদিস বা হাদিসের রেফারেন্স খুজে বের করতে পারে। অনেকের আবার এই সব প্রযুক্তি নির্ভর হাদিসের উপর আস্তা রাখতে পারছেন না। কারন যে যেভাবে পারছে প্রচার করছে, কোন বাচবিচর ছাড়াই। তবে স্কান করা বিভিন্ন পাবলিকেশনের বহু হাদিস গ্রন্থ আছে যা, অন লাইনে খু্বই সহজে পাওয়া যায় এবং এর উপর আস্তা ও করা যায়। যদি আর ও সংশয় মুক্ত ও সাবলিল হতে চান তবে অনুবাদসহ হার্ড কপি কিনে নিতে পারেন। সুপ্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদ আবী হানীফা, মুআত্তা মালিক, মুসনাদ আহমাদ, মেশকাত শরীফ, রিয়াদুস সালেহীন, বুলুগুল মারাম, সিলসিলা আহাদিস আস সহিফাসহ বহু হাদিস গ্রন্থ আজ বাংলায়। সকল হাদিস গ্রন্থই বিষয় ভিত্তিক সাজান তাই আপনাকে কোন বিষয় অনুসন্ধানের জন্য আধা ঘন্টার বেশী সময় লবগবেনা। কাজেই ধোকা খাবেন না যে, অমুক বুজুর্গ বলেছেন, অমুক অলী বলেছেন, অমুক হুজুর বলেছেন বলেই সত্য হবে। যাদের অনুসন্ধানের ক্ষমতা নেই তারা তো কোন না কোন আলেমের অনুসরন করবেই। তবে শর্থ থাকে যে, কোন বিষয় মতবিরোধ দেখা দিলে আরো দুই চার জন হক্কানি আলেমের মতামত নিবেন। তারপর যে মতটি কুরআন হাদিসের কাছাকাছি তারই অনুসরন করতে হবে। সুপ্রসিদ্ধ সিহাহ সিত্তাহ সহ যতগুলি হাদীসগ্রন্থ উল্লেখ করলাম তাদের মধ্যে নূর বিষয়ে কোনো হাদীসই পাওয়া যায় না।

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ, “হাদীসের নামে জালিয়াতি: প্রচলিত মিথ্যা হাদীস ও ভিত্তিহীন” বইটিতে এ বিষয়  তিনি লেখেন যে,

রাসূলুল্লাহ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নূর দ্বারা তৈরি করা হয়েছে অর্থে বর্ণিত ও প্রচলিত সকল হাদীসই বানোয়াট। পাঠক একটু খেয়াল করলেই বিষয়টি বুঝতে পারবেন। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতূর্থ হিজরী শতকে ‘সিহাহ সিত্তাহ’ সহ অনেক হাদীসের গ্রন্থ সংকলন করা হয়েছে। এ সকল গ্রন্থে অনেক সাধারণ বিষয়েও অনেক হাদীস সংকলন করা হয়েছে। সহীহ, হাসান, যয়ীফ হাদীসের পাশাপাশি অনেক জাল হাদীসও এ সকল গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। কিন্তু ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  নূর দ্বারা তৈরি অর্থে একটি হাদীসও কোনো পুস্তকে পাওয়া যায়না। মুহাদ্দিসগণ হাদীসের গ্রন্থসমূহে কত ছোটখাট বিষয়ে অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ লিখেছেন। অথচ ‘নূরে মোহাম্মদী’ বিষয়ে কোনো মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রন্থে একটি অনুচ্ছেদও লিখেননি। অনেক তাফসীরের গ্রন্থে বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যায় অনেক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু সূরা মায়েদার উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় কোনো প্রাচীন মুফাসসিরই রাসূলুল্লাহর নূর হতে সৃষ্টি বিষয়ক কোনো হাদীস উল্লেখ করেননি।

        ইতিহাস ও সীরাত বিষয়ক বইগুলোতে অগণিত যয়ীফ ও ভিত্তিহীন রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে অনেক অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ রচনা করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরে লেখা কোনো একটি ইতিহাস বা সীরাত গ্রন্থে ‘নূরে মুহাম্মাদী’ বিষয়টি কোনোভাবে আলোচনা করা হয়নি। আসলে রাসূলুল্লাহ যুগ হতে পরবর্তী পাচ/ছয় শত বৎসর পর্য্ন্ত মুসলিম উম্মাহর কোনো ব্যক্তি বা দল ‘নূরে মুহাম্মাদী’ তত্ত্বের কিছুই জানতেননা। এখন আমাদের সামনে শুধু থাকলো, সূরো মায়েদার উপরোক্ত আয়াতটি, যে আয়াতের তাফসীরে কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন যে, এখানে নূর বলতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বুঝান হয়েছে।

১০। এখন প্রশ্নহল তাহলে এই জাল হাদিসের উৎস কোথায়?

বুঝতেই পারছেন সুপ্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদ আবী হানীফা, মুআত্তা মালিক, মুসনাদ আহমাদ, মেশকাত শরীফসহ  কোন হাদিস গ্রন্থে নেই। চার ইমামসহ ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরের মধ্যে কেই কোন হাদিস গ্রন্থে লিপিব্ধ করলেনা। হাদিস সংকলনের ৫০০ বছরের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা লিখবেন অথচ পূর্বের কোন কিতবের রেফারেন্স দিবেন না, তা কি করে হয়? মনে রাখবেন হাদিস সংকলনের ৫০০ বছর পর কেউ কোন কথা লিখলে বা বললে তাকে অবশ্যই কিতবের রেফারেন্স দিতে হবে। তা না হলে সে যে কথাটি লিখল বা বলল তা অবশ্যই তার নিজস্ব মতামত বা জাল কথা।

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ উক্ত কিতাবে আরও লিখেনঃ নূরে মুহাম্মাদী বিষয়ে অনেক জাল ও সনদবিহীন কথা ইবনু আরাবীর পুস্তকাদি, সীরাহ হালাবিয়া, শারহুল মাওয়াহিব ও মীলাদুন্নবী বিষয়ক পুস্তকাদিতে বিদ্যমান। এসকল পুস্তকের উপর নির্ভর করে আমাদের দেশে ‘সাইয়েদুল মুরসালীন’ ও অন্যান্য সীরাতুন্নবী বিষয়ক পুস্তকে এগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা বলতে পারি যে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  নূর দ্বারা সৃষ্ট’ এ অর্থে বর্ণিত ও প্রচলিত সকল হাদীসই বানোয়াট। এর বড় প্রমাণ যে, ইসলামের ইতিহাসের প্রথম ৫০০ বৎসরে সংকলিত কোনো হাদীস, তাফসীর, সীরাত বা ফিকহের গ্রন্থে এ বিষয়ক একটি সহীহ বা যায়ীফ হাদীসও সনদসহ পাওয়া যায় না। আমদের দেশে প্রকাশিত অনেক বই যেমন: তাজকেরাতু আউলিয়া, নেয়ামুল কুরআন, বিশ্বনবী গোলাম মোস্তফা, বিষাদ সিন্ধু ইত্যাদি জাতীয় বই-এ নূরে মুহম্মাদী বিষয় পেয়ে ধোকা খাবেন না। বিভিন্ন সুফিদের লেখা বই যেমনঃ মানিক গঞ্জের পীর মাওলানা আজহারুল ইসলামের লেখা “মারেফতের ভেদতত্ত্ব”। এই বইটিতে দ্বিতীয় অধ্যয়ের নাম ‘নূরে মুহম্মাদী’ তৃতীয় অধ্যয়ের নাম ‘নূরে মুহম্মাদী সৃষ্টির আদি তত্ত্ব’। এই বইটিতে ছয় সাত টি জাল হাদিস উল্লেখ করে প্রমান করার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন যে ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  নূরের তৈরি। এ ছাড়া যারা ‘বেরেলভী’ মতবাদে বিশ্বাসি (রিজভী ও বলা হয়), মাজার পুজারি, পীর তন্ত্রে বিশ্বাসি ভ্রান্ত সুফিদের কিতাবাদিতে জাল রেফারেন্সসহ অসংখ্যা বই পাবেন।

একটি কথা না বললেই নয়, ‘জসিম উদ্দিন আজহারী’ ঐ আঠার মিনিটের ভিডিওটায়  বিভিন্ন তাফসিরের ভূয়া রেফারেন্সের পর একটা লাল কালারের ছোট একটা কিতাব দেখিয়ে দাবি করলেন এটি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাকের প্রথম খন্ডের হারানো অংশ’ নামে প্রকাশিত বই, আরব আমিরাতে ধর্ম মন্ত্রনালয় থেকে প্রকাশিত। ইহার লেখক ইমাম বুখারির উস্তাদ। এখানে ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নুরের তৈরি সম্পর্কে আঠারটি হাদিস আছে। আরও বললেন হয়তো পৃথিবীর কোন যাদুঘর বা লাইব্ররির মুল পান্ডলিপির সাথে এ অংশটুকু পাবেন না। তখনই বইটি সম্পর্কে সন্দেহ জাগে যে, লেখক ইমাম বুখারির উস্তাদ অথচ উক্ত কিতাবের আঠারটি হাদিসের একটা হাদিস ইমাম বুখারি পেলেন না। আবার ‘মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাকের’ মুল পান্ডলিপির সাথেও নেই। তখনই বিষয়টি অনুসন্ধানের ইচ্ছা করলাম আর অনুসন্ধান করে যে তথ্য পেলাম তা পাঠকদের সামনে পেশ করছি।

আলোচ্য ‘হারানো’ পুস্তকটির ৩-৪ পৃষ্ঠায় মিসরের নাগরিক ও আরব আমিরাতে অবস্থানাকরী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ড. মাহমুদ সায়ীদের একটি প্রশংসাপত্র বিদ্যমান। বস্ত্তত পুস্তকটির সম্পাদক শাইখ হিমইয়ারী তাঁর পান্ডুলিপি মাত্র দুজন আলিমকে দেখতে দেন, শাইখ আদীব কামাদানী ও ড. মাহমুদ সায়ীদ। শাইখ আদীব কামাদানী সিরিয়ার একজন মুহাদ্দিস ও পান্ডুলিপি বিশেষজ্ঞ হিসাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই প্রদেশে ওয়াকফ মন্ত্রলায়ে কর্মরত।এ সময়ে শাইখ হিমইয়ারীও একই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন ও উভয়ে বন্ধু ছিলেন।

তিনি বলেন, শাইখ হিমইয়ারী মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকের কোনো পান্ডুলিপি থেকে নূর মুহাম্মদী বিষয়টি প্রমাণ করতে অত্যন্ত অস্থির ছিলেন এবং সবাইকে বিষয়টি বলতেন। তাঁর এ অস্থিরতা দেখে ভারতের একজন ব্রেলবী পীর এ পান্ডুলিপিটি তাকে এনে দেন। পান্ডুলিটি পেয়ে হিমইয়ারী আনন্দ প্রকাশ করতে বিশাল মেজবানির আয়োজন করেন। হিমইয়ারী কামাদানী ও মাহমূদ সায়ীদকে পান্ডুলিপিটি দেখতে দেন। কামাদানী পান্ডুলিপির কাগজ, কালি ও লিখনপদ্ধতি দেখে প্রথম দৃষ্টিতেই এটিকে জাল বলেন। তিনি বলেন, পান্ডলিপির বয়স দুবছরের বেশী হতে পারে না। কিন্তু হিমউয়ারী এটিকে জাল মানতে কিছুতেই রাজি হন না। কামাদানী তাকে বলেন, আপনি দুবাইয়ের পান্ডুলিপি গবেষনা প্রতিষ্ঠান জুমুয়াতুল মাজিদ কেন্দ্রে প্রেরন করে এর বয়স, কাগজ, কালি ও লিখনির বিষয় যাচাই করুন এবং পান্ডুলিপির সংগ্রাহক কোথা থেকে তা অনুলিপি করেছে তা জানুন। হিমইয়ারী বলেন, পান্ডুলিপির সংগ্রাহক বলেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি লাইব্রেরি থেকে তারা পান্ডুলিপির অনুলিপি করে এনেছেন, কারন মূল পান্ডুলিপি যুদ্ধে নষ্ট হয়ে গিয়েছে! মুসান্নাফের অবশিষ্ট অংশের পান্ডুলিপি দেখতে বললে তারা অপরাগতা প্রকাশ করেন। (মুহাম্মদ যিয়াদ তুকলাহ মউসূআতুর রাদ্দি আলস সুফিয়্যাহ, শামিলা ৩.৫, ১১০/৬-৭)।

দ্বিতীয় ব্যক্তি ড. মাহমুদ সায়ীদ মুহম্মাদ মামদূ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও হাদিস গবেষক। তিনি পান্ডুলিপির সম্পাদক ড. শাইখ হিমইয়ারীর মত সুফি আকিদার অনুসারি এবং সালাফিদের বিরোধী। শাইখ আলবানী ও সালাফিগনের বিরুদ্ধে তার অবস্থান সুপরিচিত। আমরা দেখিছি তিনি এ হারানো’ পুস্তকের প্রশংসাপত্র লিখেন। কিন্তু দু বছর পরে ২০০৭ সালে তিনি তাঁর প্রশংসাপত্র প্রত্যাহার করে এবং বইটির অনির্ভরযোগ্যতা বর্ণনা করে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটির নাম “মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাকের হারানো অংশ” নামে যা ছাপা হয়েছে তার বিষয়ে শাইখ মাহমূদ সায়ীদের বক্তব্য’। এ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, আকীদা ও আমলে তিনি শাইখ হিমইয়ারীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন ও ভালবাসেন। হিমইয়ারী তাঁকে যখন এ পান্ডুলিপিটি দেখান তখন তিনি দুটি কারণে এর বিশুদ্ধতার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন।

১। পান্ডুলিপির কাগজ ও কালি নতুন এবং

২। পান্ডুলিপির উপর এর সনদ, শ্রবন, মালিকানা ইত্যাদির তথ্য লেখা নেই।

দুবাইয়ের জুমুআতুল মাজিদ কেন্দ্রে পান্ডুলিপিটি পাঠালে তারা বলে যে, পান্ডুলিপিটির বয়স সর্বোচ্চ ৫০ বা ৬০ বৎসর। হিমইয়ারী এ পুস্তকটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন এবং তাঁকে একটি প্রশংসাপত্র লিখে দিতে অনুরোধ করেন। তিনি পান্ডুলিপিটি পুরো না পড়ে, শুধু তার ভূমিকার উপর নির্ভর করে একটি প্রশংসাপত্র লিখেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে পান্ডুলিপিটি অনির্ভরযোগ্য। মুমিনের জন্য ভুলের পক্ষে হুজ্জতি না করে ভুল স্বীকার করে সত্য গ্রহণ উত্তম। এজন্য তিনি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাকের প্রথম খন্ডের হারান অংশ নামের পুস্তকটিতে তাঁর লেখা প্রশংসাপত্র প্রত্যাহার করলেন। এর সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আরো বলেন যে, আলোচিত পুস্তকের বাতিলকৃত প্রশংসাপত্রে তিনি ‘নূর মুহাম্মাদী’ বিষয়ক হাদীসটির প্রসঙ্গ মোটেও উল্লেখ করেন নি। কারণ তাঁর উস্তাদ আহমাদ গুমারী, আব্দুল্লাহ গুমারী ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস এ হাদীসটি জাল বলে নিশ্চিত করেছেন। একটি বইয়ের প্রশংসাপত্র লেখার জন্য বইটির মধ্যে বিদ্যমান সকল হাদীস বা জাল হাদীসের বিষয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজনীয় বলে তিনি মনে করেন নি। এজন্যই তিনি উক্ত প্রশংসাপত্রে হাদীসটির জালিয়াতির প্রসঙ্গ আলোচনা করেন নি। বিস্তারিত আলোচনার পর তিনি লিখেনঃ ‘‘মোট কথা ‘মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাকের প্রথম খন্ডের হারানো অংশ’ নামে প্রকাশিত বইটি একেবারেই অনির্ভরযোগ্য। এ বইটির রেফারেন্স দেওয়া বা অনুবাদ করা যাবে না।’’ ড. মাহমুদ সায়ীদ আল ইত্তিজাহাতল হাদীসিয়্যাহ ফিল কারনির রাবিয় আশারা ( কাইরো, দারুল বাসায়ির, ১৪৩০/২০০৯, পৃষ্ঠা-৭২৭-১৩০)।

কাজেই সম্মাতিত পাঠক! ধোকা বাজদের ধোকায় পড়বেন না। ‘মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাকের প্রথম খন্ডের হারানো অংশ নামে যে বইটি প্রকাশিত হয়েছে তা একেবারই বানোয়াট ও অনির্ভরযোগ্য। এই বই-এ নুর সংক্রান্ত আঠারটি হাদিস বর্নিত হয়েছে যার সবগুলিই জাল হাদিস।

১১। নূরের তৈরি সম্পর্কিত প্রচলিত জাল হাদিস কেন?

জাল হাদিসসমুহ উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল যাতে হাদিস শুনে কেউ ধোকা না খায়। যখন বিদাতীদের কোন ওয়াজ শুনবেন বা কোন বই পড়বেন তখন যেন বুঝতে পারেন যে এ কথাটি জাল।

নিম্ম লিখিত কারনে নূর বিষয়ক হাদিসগুলি জাল।

১.     রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূর দ্বারা সৃষ্ট এরূপ কোনো আয়াত কুরআনুল কারীমে নেই।

২.     সুপ্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদ আবী হানীফা, মুআত্তা মালিক, মুসনাদ আহমাদ, মেশকাত শরীফ, রিয়াদুস সালেহীন, বুলুগুল মারাম, সিলসিলা আহাদিস আস সহিফাসহ কোন হাদিস গ্রন্থেই নুর বিষয়ক হাদিস নেই।

৩.     চার মাজহাবের ইমামসহ কোন ইমামই ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূর দ্বারা সৃষ্ট’ এরূপ আকিদা প্রশন করতেন না। ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ)-এর “ফিকহুল আকবর” বইটি বাংলায় অনুবাদ হইয়াছে। এ বইটিতে আকিদার সব বিষয় উল্লেখ করলেও নুরে মুহম্মাদী উল্লেখ করলেন না। না কি এ বিষয় তিনি জানতেন না।

৪.     প্রথম পাঁচশত বৎসরে সংকলিত কোনো হাদীস, তাফসীর, সীরাত বা ফিকহের গ্রন্থে এ বিষয়ক একটি সহীহ বা যায়ীফ হাদীদ সনদসহ পাওয়া যায় না।

১২। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নুরের তৈরি সম্পর্কিত নয়টি জাল হাদিসঃ

জাল হাদিস নম্বর – ০১::        আল্লাহতা’লা সর্বপ্রথম বা সর্বাগ্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর  নূর সৃষ্টি করেন!

হযরত জাবের (রাজি:) হতে বর্নিত, তিনি বলেন, আমি আবেদন করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার মা বাবা আপনার কদম মোবারকে উত্সর্গিত, আপনি দয়া করে বলুন, সকল বস্ত্তর পূর্বে সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়া’লা কোন বস্ত্তটি সৃষ্টি করেছিলেন? নবীজী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়’লা সমস্ত কিছুর পূর্বে তোমার নবীর নুর মোরারক তারই নূর মোবারা হতে সৃষ্টি করেছেন। অত:পর ঐ নূর আল্লাহ তাআলারই মর্জি মুতাবেক তাঁরই কুদরতি শক্তিতে পরিভ্রমণ করতে লাগল। ওই সময় না ছিল বেহেশ্ত দোযখ, আর ছিলনা আসমান-যমীন, চন্দ্র-সূর্য, মানব ও দানব। এক পর্যায়ে মহান আল্লাহ যখন সৃষ্টিজগত পয়দা করার মনস্থ করেছিলেন, প্রথমেই ওই নূর মোবারককে চারভাগে বিভক্ত করে প্রথম অংশ দিয়ে কলম, দ্বিতীয় অংশ দিয়ে লওহ, তৃতীয় অংশ দিয়ে আরশ, সৃষ্টি করে চুতুর্থাংশকে পুণরায় চারভাগে বিভক্ত করে প্রথমাংশ দিয়ে আরশবহনকারী ফেরেশতাদের দ্বিতীয় অংশ দ্বারা কুরসী, তৃতীয় অংশ দ্বারা অন্যান্য ফেরেশতাদের সৃষ্টি করে চুতুর্থাংশকে আবারও  চারভাগে বিভক্ত করে প্রথম ভাগ দিয়ে সপ্ত আসমান, দ্বিতীয় ভাগ দিয়ে সপ্ত যমীন, তৃতীয় ভাগ দিয়ে বেহেশত দোযখ এবং পরবর্তী ভাগ দিয়ে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সকল বস্ত্ত সৃষ্টি করে।

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ এর লেখা হাদিসের নামে জালিয়াতি: প্রচলিত মিথ্যা হাদিস ও ভিত্তিহীন কথা বইটিতে এ বিষয় অনেকগুলি জাল বর্ননা বিস্তারিত তুলে ধরছেন পাঠকদের জন্য শুধু জাবের বিন আব্দিল্লাহ (রাদি:) হতে উপরে বর্ণিত সর্বাগ্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর সৃষ্টি করেন!”  হাদিসটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষন হুবহু তুলে ধরলাম।

লেখকের শীরনাম ::  নূর মুহাম্মাদীই সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  প্রথম সৃষ্টি:

‘নূর মুহাম্মাদী প্রথম সৃষ্টি’ অর্থে নিম্নের হাদীসটি সমাজে বহুল প্রচলিতলঃ

 ‘‘আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন’’

সুদীর্ঘ হাদীসটির সার সংক্ষেপ হলো, জাবির (রা) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে প্রশ্ন করেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করেন? উত্তরে তিনি বলেনঃ ‘‘সর্বপ্রথম আল্লাহ তোমার নবীর নূরকে তাঁর নূর থেকে সৃষ্টি করেন।’’ এরপর এ লম্বা হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ নূরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে তা থেকে আরশ, কুরসী, লাওহ, কলম, ফিরিশতা, জিন, ইনসান এবং সমগ্র বিশ্বকে সৃষ্টি করা হয়।….

এ হাদীসটির অর্থ ইতোপূর্বে উদ্ধৃত সহীহ মুসলিমের হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, তাতে বলা হয়েছে: ফিরিশতাগণ নূর থেকে, জীনগণ আগুন থেকে এবং মানুষ মাটি থেকে সৃষ্ট। আর এ হাদীসে বলা হচ্ছে যে, ফিরিশতা, জিন, ইনসান ও মহাবিশ্বের সব কিছুই নূর থেকে সৃষ্ট। তারপরও এ হাদীসটির বক্তব্য আমাদের কাছে আকর্ষণীয়। যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে মিথ্যা বলার বা যা শুনব তাই বলার অনুমতি থাকতো তবে আমরা তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতাম ও বলতাম। কিন্তু যেহেতু তা নিষিদ্ধ তাই কুরআন ও সুন্নাহ-এর নির্দেশ অনুসারে আমরা সনদ অনুসন্ধান করতে বাধ্য হই এবং নিম্নের বিষয়গুলি জানতে পারি:

()  বিশ্বে বিদ্যমান কোনো হাদীস গ্রন্থে হাদীসটি সনদ-সহ পাওয়া যায় না। আমরা বলেছি, একটি হাদীস সাধারণত অনেকগুলি হাদীসের গ্রন্থে সনদ-সহ সংকলিত থাকে। কিন্তু এ হাদীসটি কোনো হাদীস গ্রন্থেই সংকলিত হয় নি।

()  আমরা দেখেছি যে, ইতিহাস, সীরাত, আকীদা, তাসাউফ, ওয়ায ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থগুলিতেও বহুসংখ্যক সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস সনদবিহীন বা সনদ-সহ সংকলিত। ইসলামের প্রথম ৫০০ বৎসরের মধ্যে এ সকল বিষয়ক কোনো একটি গ্রন্থেও এ হাদীসটির কোনো উল্লেখ নেই।

()  যতটুকু জানা যায়, ৭ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ আলিম মুহিউদ্দীন ইবনু আরাবী আবূ বাক্র মুহাম্মাদ ইবনু আলী তাঈ হাতিমী (৫৬০-৬৩৮হি /১১৬৫-১২৪০খৃ) সর্বপ্রথম এ কথাগুলোকে ‘হাদীস’ হিসেবে উল্লেখ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইবনু আরাবী তাঁর পুস্তকাদিতে অগণিত জাল হাদীস ও বাহ্যত ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক অনেক কথা উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগে বুযুর্গগণ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বশত এ সকল কথার বিভিন্ন ওযর ও ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। আবার অনেকে কঠিনভাবে আপত্তি করেছেন। সর্বাবস্থায়, ইবনু আরাবী এ বাক্যটির কোনো সূত্র উল্লেখ করেন নি। কিন্তু তিনি এর উপরে তাঁর প্রসিদ্ধ সৃষ্টিতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন। খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের লগোস তত্ত্বের (Theory of Logos) আদলে তিনি ‘নূর মুহাম্মাদী তত্ত্ব’ প্রচার করেন। খৃস্টানগণ দাবি করেন যে, আল্লাহ সর্বপ্রথম তার নিজের ‘জাত’ বা সত্ত্বা থেকে ‘কালেমা’ বা পুত্রকে জন্মদান করেন, পুত্র ‘নূর থেকে জাত নূর’ (light of light) এবং পুত্র থেকেই আল্লাহ সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন। ইবনু আরাবী বলেন, আল্লাহ সর্বপ্রথম নূর মুহাম্মাদী সৃষ্টি করেন এবং তার থেকে সকল সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেন। ক্রমান্বয়ে কথাটি ছড়াতে থাকে। বিশেষত ৯/১০ম হিজরী শতক থেকে লেখকগণের মধ্যে যাচাই ছাড়াই অন্যের কথার উদ্ধৃতির প্রবণতা বাড়তে থাকে।

শ্রদ্ধাবশত, ব্যস্ততা হেতু অথবা অন্যান্য বিভিন্ন কারণে নির্বিচারে একজন লেখক আরেকজন লেখকের কাছ থেকে গ্রহণ করতে থাকেন। যে যা শুনেন বা পড়েন তাই লিখতে থাকেন, বিচার করার প্রবণতা কমতে থাকে। এভাবে বিগত কয়েক শতক যাবৎ সীরাত, মীলাদ, তাসাউফ, ওয়ায ইত্যাদি বিষয়ক অগণিত গ্রন্থে এ হাদীসটি উদ্ধৃত করা হয়।

 ()  যতদূর জানা যায় সর্বপ্রথম দশম হিজরী শতকের কোনো কোনো আলিম হাদীসটি মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক-এ বিদ্যমান বলে মন্তব্য করেন। অর্থাৎ ইবনু আরাবীর পূর্বে ইসলামের প্রথম ৬০০ বৎসর এ হাদীসটি কেউ উল্লেখই করেন নি। হাদীসটির অর্থ অত্যন্ত আকর্ষণীয় হওয়াতে পরবর্তী ৩০০ বৎসরে হাদীসটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। কিন্তু এর কোনো সনদ বলা তো দূরের কথা হাদীসটি কোন্ গ্রন্থে সংকলিত তাও কেউ বলতে পারেন নি। এরপর থেকে কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, হাদীসটি বাইহাকী বা আব্দুর রায্যাক সান‘আনী সংকলন করেছেন। এ দাবিটি ভিত্তিহীন। আব্দুর রায্যাক সান‘আনী বা বাইহাকী রচিত কোনো গ্রন্থে এ হাদীসটি নেই। দশম শতকের  প্রসিদ্ধ আলিম আল্লামা আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-কাসতালানী (৯২৩ হি) তাঁর রচিত প্রসিদ্ধ সীরাত-গ্রন্থ ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থে এ হাদীসটি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকে’ সংকলিত রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। (কাসতালানী, আল-মাহওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ ১/৩৬-৩৭)।

তার বক্তব্যের উপর নির্ভর করে এরপর অনেকেই লিখেছেন যে, হাদীসটি ‘মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকে’ সংকলিত। কিন্তু বিশ্বের সর্বত্র বিদ্যমান মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক গ্রন্থের প্রাচীন পান্ডুলিপি এবং ছাপানো গ্রন্থে কোথাও এ হাদীসটি নেই। লক্ষণীয় যে, যারা হাদীসটি মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাকে সংকলিত বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা কেউই হাদীসটির কোনো সনদ উল্লেখ করেন নি, সনদ বিচার তো দূরের কথা।

()  দশম শতক থেকেই অনেক আলিম নিশ্চিত করেছেন যে, এ হাদীসটি ভিত্তিহীন, মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক বা অন্য কোনো গ্রন্থে তা নেই। ইমাম সুয়ূতী, শাইখ আব্দুল্লাহ গুমারী, শাইখ আহমাদ গুমারী, শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী, শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ ও অন্যান্য প্রাচীন, সমকালীন, সালাফী ও সূফী সকল মতের মুহাদ্দিস একমত যে, এ কথাটি হাদীস নয়; কোনো হাদীসের গ্রন্থে এর অস্তিত্ব নেই। ইমাম কাসতালানীর সমসাময়িক প্রসিদ্ধ আলিম ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৯১১ হি)। তিনি এ হাদীসটির কোনো সনদ খুঁজে না পেয়ে লিখেনঃ

‘‘এ হাদীসটির কোনো সনদ নেই যার উপর নির্ভর করা যায়।’’ (সুয়ূতী, আল-হাবী ১/৩৮৪-৩৮৬)।

()  বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সূফী ও মুহাদ্দিস আল্লামা শাইখ আবুল ফাইয আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুস সিদ্দীক গুমারী (১৩৮০/১৯৬০) এবং আল্লামা শাইখ আবুল ফাদল আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনুস সিদ্দীক গুমারী (১৪১৩/১৯৯৩)। তাঁদের দাদা সাইয়িদ মুহাম্মাদ সিদ্দীক ইবন আহমাদ হাসানী মরোক্কোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সূফী, পীর ও ওলী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁদের পিতা মুহাম্মাদ ইবনুস সিদ্দীক পিতার স্থলাভিষিক্ত প্রসিদ্ধ পীর, মুহাদ্দিস এবং ‘যাবিয়া সিদ্দীকিয়া’ বা ‘সিদ্দীকিয়া খানকা’-র পরিচালক ছিলেন। তাঁরা উভয়েই  মুহাদ্দিস, ফকীহ ও তাসাউফের ইমাম বলে সুপরিচিত। তাঁরা সকলেই তাসাউফ, আকীদা, হাদীস ও ফিকহে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। সালাফীগণ ও শাইখ আলবানীর বিরুদ্ধে তাঁরা অনেক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তবে এ হাদীসের জালিয়াতির বিষয়ে তাঁরা ঐকমত্য পোষণ করেছেন। শাইখ আহমাদ গুমারী ইমাম সুয়ূতীর ‘জামি-সাগীর’ গ্রন্থে বিদ্যমান জাল হাদীস বিষয়ে ‘আল-মুগীর আলাল আহাদীসিল মাউদূআতি ফিল জামিয়িস সাগীর’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি এ হাদীসটি প্রসঙ্গে বলেনঃ‘‘‘হাদীসটি জাল।

যদি পুরো হাদীসটি উল্লেখ করা হয় তবে পাঠক হাদীসটির জালিয়াতি সম্পর্কে কোনো সন্দেহ করবেন না। হাদীসের অবশিষ্ট বক্তব্য বৃহদাকৃতির প্রায় দু পৃষ্ঠা, যার মধ্যে অনেক অসংলগ্ন ফালতু কথা এবং আপত্তিকর অর্থ বিদ্যমান।’’ (আহমাদ গুমারী, আল-মুগীর, বৈরুত, দারুর রায়িদ আল-আরাবী, ভূমিকা: পৃষ্ঠা ৬-৭)।

জাল হাদিস নম্বর – ০২:: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  যে নূরের তৈরি তার একটি বর্ননা এমন:

“আমাকে ও আলীকে নূর থেকে সুষ্টি করা হয়েছে্ আদম সৃষ্টির দুই হাজার বছর পুর্বে আমরা আরশের ডান পার্শ্বে ছিলাম। অতপর আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করলেন তখন আমরা মানুষদের ঔরসে ঘুরতে লাগলাম”।

মুহাদ্দিসগন একমত যে, কথাটি মিথ্যা ও জাল হাদিস। জাফর ইবনু আহমদ ইবনু আলী আল গাফিকী একজন মিথ্যাবাদি জালিয়াত এই হাদিসটি বানিয়েছে।

(ইবনুল জাওযী আল-মাউদুয়াত ১/১৫৪; সুয়ুতী আল লাআলী ১/৩২০; ইবনু ইরাক তানজীহ ১/৩৫১)।

জাল হাদিস নম্বর – ০৩::  ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নূর, আবূ বকরকে তার নূর… থেকে সৃষ্টি।

 ‘‘আল্লাহ আমাকে তাঁর নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন, আবূ বক্করকে আমার নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন, উমারকে আবূ বাক্করের নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমার উম্মাতকে উমারের নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন…।’’

এটি একটি সনদ-সহ জাল হাদীস। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, কথাটি মিথ্যা ও বানোয়াট। আহমাদ ইবনু ইউসূফ আল-মানবিযী নামক এক ব্যক্তি এ মিথ্যা কথাটির প্রচারক। সে এ কথাটির একটি সুন্দর সনদও বানিয়েছে। [যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ১/৩১৪; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ১/৩২৮; সুয়ূতী, যাইলুল লাআলী, পৃ. ৫০; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/৩৩৭]।

জাল হাদিস নম্বর – ০৪:: আল্লাহর মুখমন্ডলের নূরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  সৃষ্টি:

 ‘‘আমি মুহাম্মাদকে আমার মুখমন্ডলের নূর থেকে সৃষ্টি করেছি।

সম্পূর্ণ সনদবিহীন একটি জাল কথা: (আব্দুল কাদের জীলানি (রহ) নামে প্রচলিত সিররুল আসরার নামক কিতাবে; পৃষ্ঠা-১০)।

জাল হাদিস নম্বর – ০৫:: শাজারাতুল ইয়াকীন নামক একটি বৃক্ষ সৃষ্টি করেন ও ময়ুরের মত আকারে হযরতের নুর কে সৃস্টি করলেন।

শাজারাতুল ইয়াকীন নামক চারটি শাখা যুক্ত একটি বৃক্ষ সৃষ্টি করেন। ময়ুরের মত আকারে হযরতের নুর কে সৃস্টি করলেন সাদা মুক্তার ফানুসের মধ্যে এবং এই মুক্তার ফানুস সেই গাছের উপর স্থাপন করলেন। সেই মুক্তার ফানুসের মধ্যে এবং সেই গাছের উপর ৭০ হাজার বছর এবাদাত করলেন। অতঃপর ময়ূরাকৃতির নূরে মোহাম্মদির সামনে আয়না ধরলে নিজ রূপমুগ্ধ ময়ূর এই ভেবে কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়, যে তাকে সৃষ্টি করেছে সে কত সুন্দর! অহংকারী না হয়ে স্রষ্টার প্রতি বিনয়াবনত হয়ে ময়ূরাকৃতির নূরে মোহাম্মদি পাঁচবার মাথা নুইয়ে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। (এ পাঁচবার মাথা নোয়ানোই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আদি ইতিহাস)। অতপর আল্লাহ যখন ময়ূররূপি নবীর নূরের দিকে নজর করলেন তখন সেই নজরে আপ্লুত হয়ে সমস্ত অবময় ঘামাতে লাগল। সেই  ঘাম দিয়ে সমস্ত ফিরেস্তা, চেয়ারার ঘাম দিয়ে আরশ, কুরসি, ল ওহ কলম,চন্দ্র, সূর্য,যাবতীয় আসমানি জিনিস সৃষ্টি করেন। বুকের ঘাম দিয়ে সকল নবী, রাসুল, আলেন,  শহীদ ও সকল নেক লোক,  সৃষ্টি করেন।  ভ্রুর ঘাম দিয়ে সকল ইমানদান নারী পুরুষ, মুসলমান নারী পুরুষ সৃষ্টি করেন। কর্নের ঘাম দিয়ে ইহুদি খৃষ্টান মুসরিক ও অন্যান্য জাতী সৃষ্টি করেন।

—————————————————————————————————-

অন্যান্য সকল রুহগন ঐ দন্ডায়মানরত নূরে মুহম্মাদীর চারপাশে তাওয়াব করতে লাগল, এই ভাবে সমস্ত রুহ প্রায় এক লক্ষ বছর ধরে নূরে মুহম্মাদীর চারপাশে তাওয়াব করতে থাকল এবং তাসবি করতে লাগল।

এটি একটি প্রচলিত মিথ্যা কাহিনী যার সকল কথাই ভিত্তিহীন। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ হাদীসের গ্রন্থে এর কোনো প্রকার সনদ, ভিত্তি বা উল্লেখ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন ভাবে গল্পগুলো লেখা হয়েছে।  জাল হাদীসের জাল বই ছাড়া কোথাও এর সনদ পাওয়া যায় না। [ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ) –এর লেখা; হাদিসের নামে জালিয়াতি: প্রচলিত মিথ্যা হাদিস ও ভিত্তিহীন কথা ]

জাল হাদিস নম্বর – ০৬:: রাসূলুল্লাহ আদম সৃষ্টির পূর্বে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারকারূপে বিদ্যমান ছিলেন

হযরত আবু হুরায়রা (রাদি) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা জিবা্রঈল আলায়হিস সালামকে জিজ্ঞেসা করলেন , ওহে জিব্রাঈল তোমার বয়স কত? উত্তরে জিব্রাঈল বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমিতো সঠিক জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি। জগত সমুহ সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তায়ালা নূরানি আজমতের পর্দা সমুহের চতুর্থ পর্দায় একটি নূরানী তারকা সত্তর হাজার বছর পরপর উদিত হত। আমি আমার জীবনে সেই নূরানী তারকা বাহাত্তর হাজার বার উদিত হতে দেখেছি। অতঃপর নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম ইরশাদ  করলেন মহান রাববুল আলামীনের ইজ্জতের কসম করে বলছি, সেই অত্যুজ্জ্বল নূরানী তারকা আমিই ছিলাম। (সীরাতে হালাভীয়া পৃষ্ঠা ৪৯, তাফসীরে রুহুল বয়ান পৃষ্ঠা ৫৪৩, শাহ মুহাম্মাদ মোহেববুল্লাহ, পীর সাহেব ছারছীনা শরীফ, খুতবায়ে ছালেহীয়া, পৃষ্ঠা ৪২)।

এ ধরনের সকল কথাই ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা যা হাদীস নামে প্রচলন করা হয়েছে। ইবনে তাইমুয়া, আল ইসতিগাসাহ ফির রাদ্দী আলাল বাকরী-১৩৮, মাজমূউল ফাতাওয়া ৩৬৭-৩৬৬। আব্দুল হাই লাখনবী, আল আসার, পৃষ্ঠ ৪২-৪৩। ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ) –এর লেখা; হাদিসের নামে জালিয়াতি: প্রচলিত মিথ্যা হাদিস ও ভিত্তিহীন কথা।

জাল হাদিস নম্বর – ০৭:: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চেহারা মোবারকের নূরের জ্যোতিতে আমার অন্ধকার ঘর আলোময় হয়ে গেল

‘হযরত আয়েশা রাদি) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাত্রে বাতির আলোতে বসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাপড় মোবারক সেলাই করেছিলাম। এমন সময় প্রদীপটি নিভে গেল আমি সুচটি হারিয়ে ফেললাম। এরপর (কোন কারনে) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করলেন। তার চেয়ারা মুবারকের নূরের জ্যেতিতে আমার অন্ধকার ঘর আলোময় হয়ে গেল আমি আমার সুচটি খুজে পেলাম। (ইমাম ইবনে হায়তামীর আননে-মাতুল কোবরা আলার আলম গ্রন্থের ৪১ পৃষ্ঠা)।

আব্দুল হাই লাখনাবী বলেন, এটি আরেকটি  প্রচলিত  মিথ্যা কাহিনী। (আব্দুল হাই লাখনাবী আসার পৃষ্ঠা-৪৫-৪৬)।

সমাজের অনেক লেখক ও আলেম তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থে সহীহ কথার পাশাপাশি অনেক বাতিল কথাও সংযোজন করেছেন। এতে অনেক সময় সাধারণ মুসলমানগণ বিভ্রান্ত হন। যেমন দশম হিজরী শতকের একজন মোল্লা মিসকীন মোহাম্মাদ আল ফিরাহী (৯৫৪ হি)  কর্তৃক ফার্সী ভাষায় লিখিত ‘মা’আরিজুন নব্যুয়ত’ নামক সিরাতুন্নবী বিষয়ক একটি পুস্তক এক সময় ভারতে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল। এই গ্রন্থে উপরের ঐ মিথ্যা হাদীসটি সংকলিত হয়েছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লামা লাখনবী বলেন, “এ কথা ঠিক যে, এই জাল ও মিথ্যা কথাটি ‘মা’আরিজুন নব্যুয়ত’ গ্রন্থে ও অন্যান্য সীরাতুন্নবী গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এ সকল গ্রন্থের লেখকগণ শুকনো ভিজে ভাল মন্দ সর কিছুই জমা করছেন। কাজেই এ সকল বইয়ের উপর কেবল ঘুমন্ত ও ক্লান্ত মানুষই (অজ্ঞ ও অসচেতন) নির্ভর করতে। (ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ) –এর লেখা; হাদিসের নামে জালিয়াতি: প্রচলিত মিথ্যা হাদিস ও ভিত্তিহীন কথা)।

জাল হাদিস নম্বর – ০৮:: আল্লাহর আপন নুর থেকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টি হয়েছে।

হযরত কাব আহবার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ পাক রাববুল আলামিন যখন সৃষ্টি জগত সৃজন করার ইচ্ছা করলেন তখন মাটিকে সস্প্রসারিত করলেন, আকাশকে উঁচু করলেন এবং আপন নূর হতে এক মুষ্ঠি নূর গ্রহন করলেন। তারপর উক্ত নূরকে নির্দেশ দিলেন‘ তুমি মুহাম্ম্দ হয়ে যাও।’ অতএব সে নূর স্তম্ভের ন্যায় উপরের দিকে উঠতে থাকল এবং মহত্বের পর্দা পর্যন্ত পৌছে সিজদায় পরে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ তখন আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে ইরশাদ হল, এজন্যই তোমাকে সৃষ্টি করেছি আর তোমার নাম মুহাম্ম্দ রেখেছি। তোমার হতেই সৃষ্টি কাজ শুরু করব এবং তোমাতেই রিসালাতের ধারা সমাপ্ত করব। সিরাতুল হালাভিয়া প্রথম খন্ড পৃষ্ঠা ৫০)।

জাল হাদিস নম্বর – ০৯:: মিথ্যার কথা তৈরি করে নুরের সৃষ্টি বলা।

সূর্য চন্দ্রের আলোতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেহ মোবারকের ছায়া পড়তোনা। কেননা, তিনি ছিলেন আপদমস্তক নূর’’।   (যুরকানী শরীফ ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ২২০]

মন্তব্যঃ সহিহ হাদিসে প্রমানিত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ছায়া ছিল।

১৩। সৃষ্টির উপাদানের উপর ভিত্তি করে কি কোন ব্যক্তির মর্যাদা নির্ণয় করা যায়?

সৃষ্টির উপাদানের উপর ভিত্তি করে কোন ব্যক্তির মর্যাদা নির্ণয় করা সরাসরি কুরআন ও হাদীছ বিরোধী কথা। নূরের উপদান শ্রেষ্ঠ না মটির উপদান শ্রেষ্ঠ এ সম্পর্কে তর্ক করা ও বোকামি। নুর, আগুন, মাটি, পানি ও বাতাম সবই আল্লাহন সৃষ্টি কিন্তু কে শ্রেষ্ঠ? মহান আল্লাহ যাকে শ্রেষ্ঠ বলবেন সেই শ্রেষ্ঠ। নুর কে শ্রষ্ঠ ভেবে আমরা বোকামি করি। আগুন কে শ্রষ্ঠ ভেবে আমরা বোকামি করি। এটাতো মুসরিকদের লক্ষন। তারা ফিরেস্তা ও আগুনের পুজা করে কারন তারা উহাদের শ্রেষ্ঠ মনে করে। যুক্তি দিয়া আগুন কে শ্রষ্ঠ বলা ইবলিশি কাজ। ‘সৃষ্টির উপাদানের ভিত্তিতে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠত্ব অজর্ন করে’ এটা ইবলীস শয়তানের ধারণা ও দাবী মাত্র। এই অলিক ধারণার জন্যাই আগুনের তৈরী বলে মাটির তৈরী আদমকে সিজদাহ করতে সে অহংকার বসত অস্বীকার করে ছিল। অথচ অন্যান্য ফেরেশত আল্লাহর হুকুমের  সাথে সাথে আদমকে সিজদা করে যদি ও তারা নূরের সৃষ্টি ছিল।

ইবলীস শয়তানের উচিত ছিল কোন যুক্তি না দিয়ে আদমকে সেজদা করা। কিন্তু সে নিজ সৃষ্টির উপাদানের খোড়া যুক্তি দেখিয়ে নিজেকে উত্তম ভাবল আর আদম কে অধম ভাবল এবং সিজদা দানে আল্লাহর আদেশকে অমান্য করল। আসলে আল্লাহর হুকুম অমান্যই ছিল ইবলিশের অন্যায়।

মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা আরাফে বলেন:

وَلَقَدۡ خَلَقۡنَـٰڪُمۡ ثُمَّ صَوَّرۡنَـٰكُمۡ ثُمَّ قُلۡنَا لِلۡمَلَـٰٓٮِٕكَةِ ٱسۡجُدُواْ لِأَدَمَ فَسَجَدُوٓاْ إِلَّآ إِبۡلِيسَ لَمۡ يَكُن مِّنَ ٱلسَّـٰجِدِينَ (١١) قَالَ مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسۡجُدَ إِذۡ أَمَرۡتُكَ‌ۖ قَالَ أَنَا۟ خَيۡرٌ۬ مِّنۡهُ خَلَقۡتَنِى مِن نَّارٍ۬ وَخَلَقۡتَهُ ۥ مِن طِينٍ۬ (١٢)

অর্থ: আর অবশ্যই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদের আকৃতি দিয়েছি। তারপর ফেরেশতাদেরকে বলেছি, ‘তোমরা আদমকে সিজদা কর’। অতঃপর তারা সিজদা করেছে, ইবলীস ছাড়া। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

আল্লাহ বললেন, ‘কিসে তোমাকে বাধা দিয়েছে যে, সিজদা করছ না, যখন আমি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছি’? সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি থেকে’। [সুরা আরাফ ৭:১১-১২]

অতএব যারা সৃষ্টির উপাদানের ভিত্তিতে ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব সাব্যস্ত করতে চায় তাদের উচিৎ উপরের আয়াত টি লক্ষ করা। আর অসত্য প্রত্যাখান করা। মনে মনে চিন্তা করা যিনি যুক্তির ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠ দাবি করলেন তিনি হলেন ইবলিশ।

আল্লাহর হুকুম মানা এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামের অনুসরন করাই একজন মুমিনের শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষন। মানুষ কখন সৃষ্টির উপদানে শ্রেষ্ট বা সম্মানিত হয়না। তার শ্রেষ্টত্ব বা সম্মানিত্ব থাকে তার ত্বাকওয়া বা পরহেজগারির উপর। কারন মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা হুজুরাতে বলেন:

يَـٰٓأَيُّہَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَـٰكُم مِّن ذَكَرٍ۬ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَـٰكُمۡ شُعُوبً۬ا وَقَبَآٮِٕلَ لِتَعَارَفُوٓاْ‌ۚ إِنَّ أَڪۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَٮٰكُمۡ‌ۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ۬ (١٣)

অর্থঃ হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি৷ তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার৷ তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত৷[ সুরা হুজুরাত :১৩]

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম বলেনঃ

হে মানব মণ্ডলি নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক এক। সাবধান! কোন আরবীর উপর আজমির (অনারব) প্রধান্য নেই। অনুরূপ ভাবে কোন আজমির উপর আরবীর প্রধান্য নেই। অনুরূপভাবে কোন লাল বর্ণের ব্যক্তির কালো ব্যক্তির উপর, কোন কালো ব্যক্তির লাল বর্ণের ব্যক্তির উপর প্রাধান্য নেই। প্রাধান্য একমাত্র তাকওয়া পরহেযগারিতার ভিত্তিতে হবে। ‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি বেশি সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে সর্বধিক তাক্বওয়াশীল’ পরহেযগার। (আহম্মদ সনদ সহিহ, দ্রঃ শাইখ আলবানীর গায়াতুল মারাম, পৃঃ১৯০)।

এ থেকেই অকাট্যভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার জন্মের উপাদানের উপর ভিত্তিশীল নয়। বরং এই শ্রেষ্টত্ব এবং সম্মান তাক্বওয়ার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। কাজেই তর্ক বাদ দিয়ে ত্বাকওয়া অর্জন করি। আমাদের প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম যে সত্যি সত্যিই শ্রেষ্ঠ তার কারন হলঃ

১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নিকট আল্লাহ তাঁর রিসালাতের মহান দায়িত্ব দিয়েছেন। (৬:১২৪)।

২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক চারিত্রিক সার্টিফিকেট দিয়েছেন। (৬৮:৪), (৩৬:২-৩) ও (৭:১৮৫)।

৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি উত্তম আদর্শ। (৩৩:২১)

৫.  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণ করলেই আল্লাহ ভালোবাসবেন এবং গোনাহ মাফ করে দেবেন।(৩:৩১)

৬. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আনুগত্য আল্লাহরই আনুগত্য। (৪:৮০)

৮. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাউযে কাউছারের অধিকারী।(১০৪:১)

৯. নবীকুল শিরোমণী।

১০. সর্বাধিক মুত্তাক্বী ও পরহেজগারদের হিসাবে পরিগনিত।

১১. সমস্ত বিশ্বজাহানের রহমত স্বরূপ তাকে প্রেরণ করা হইয়াছে।

১২.  মাক্বামে মাহমূদের অধিকারী করেছেন।

১৩. সমস্ত আদম জাতীর সর্দার বানিয়েছেন।

১৪.  আল্লাহর খালীল-অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসাবে গ্রহন করেছেন।

১৫. আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে হাশরের মাঠে মহান শাফাআতের অধিকারী।

১৬. সর্ব প্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী হিসাবে আল্লাহ মর্জাদা দিয়েছেন।

যার সম্মান ও  মর্জাদা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দান করলেন, তার মর্জাদা মানুষ কি করে কম বেশী করে। যাকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিগত উত্তম চরিত্রের অধিকারী করলেন ও প্রকৃতিগতভাবে পূর্ণতা দান করেছেন্ একথা আরবে মুসরিকরাও স্বীকার করত, তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সৃষ্টিগত উত্তম চরিত্রের অধিকরী। চরিত্রগতভাবে সবচেয়ে পরিপূর্ণ মানুষ বলে তিনি মহান রিসালাতের দায়িত্ব বহন করতে পেরেছেন।  তার এত মর্জাদা ও সম্মানের পর ও কি মিথ্যা মিথ্যা কথা বলে সম্মান বাড়ান প্রয়োজন আছে?

সুতারং আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার জন্মের উপাদানের উপর ভিত্তিশীল নয়। বরং এই শ্রেষ্টত্ব এবং সম্মান তাক্বওয়ার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। কাজেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর নূরে তৈরি না মাটির তৈরি তার জন্য এটা মোটেই মানহানীকর বিষয় নয়। বরং তার সম্মান ও  মর্জাদার পুরটাই স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামিনের অনুগ্রহ বা দান।

১৪। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যদি আল্লাহর নূরে তৈরি হলে সমস্যা কী?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর নূরে তৈরি হয়েছে এ কথাটা খুবই বিপদ জনক, ইসলামে থাকা না থাকার প্রশ্ন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নূর যদি এ অর্থে বলা হয় যে, তিনি আল্লাহর জাতি ও সত্ত্বাগত নূর, তাহলে তা কুরআন বিরোধী, কারণ কুরআনে তাকে মানুষ বলা হয়েছে। কুরআনুল কারীমে ও সহিহ হাদিসে কিন্তু কোথাও বলা হয়নি যে, আল্লাহর জাত বা সত্তাই নূর। তাহলে রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর জাতি নূর বা আল্লাহর জাত বা সত্বাগত নূর হওয়ার তো কোন প্রশ্ন আসে না।

যদি কেউ বলে রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে  আল্লাহর জাতি নূর বা আল্লাহর জাত বা সত্বাগত নূর থেকে সৃষ্টি করা হইয়াছে। তাহলে তো বলা হল  রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং আল্লাহর জাত বা সত্বা। যদি তাই হয়, তাহলে এর সুস্পষ্ট মর্ম দাঁড়ায় আল্লাহই রাসূল এবং রাসূলই আল্লাহ। আর এটা যে প্রকাশ্য ‍কুফর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর যদি বলা হয় রাসূল আল্লাহর জাতি নূর মানে হুবহু আল্লাহর সত্ত্বা নন, বরং তাঁর সত্ত্বার অংশ বিশেষ, তাহলে এর পরিস্কার মর্ম দাড়ায় আল্লাহর জাত বা সত্তায় রাসূল অংশীদার। অথচ এটা যে প্রকাশ্য শিরক তা বলাই বাহুল্য।

আর যদি তাকে এ অর্থে নূর বলা হয় যে, তার নিকট আল্লাহর কাছ থেকে নূর বা ওহী এসেছে, যা মানুষের হিদায়েতের উসিলা, যা দ্বারা আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিদায়েত করেন, তাহলে এ অর্থ ঠিক আছে।

পরিশেষ একটা হাদিস দিয়ে শেষ করছি:

ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহ আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি করার ব্যাপারে তোমাদেরকে সাবধান করছি। তোমাদের পূর্ববর্তী যারা বাড়াবাড়ি করেছিল তারা ধ্বংস হয়ে গেছে’’।(সনাদে আহমাদ ১/২১৫, নাসায়ী ৫/২৬৮, ইবনে মাজাহ; ৩০২৯)

নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতকে সতর্ক করে দিয়েছেন যেন তারা পূর্ববর্তী উম্মতের মত নবী ও নেককার লোকদেরকে ভক্তি শ্রদ্ধায় অতিরঞ্জন করে পথ ভ্রষ্টদের দলভূক্ত না হই। কেননা তারা উম্মতের কতিপয় লোক নবী ও নেক ব্যক্তিদের ভক্তি, শ্রদ্ধা, সম্মানের ক্ষেত্র অতিরঞ্জন করে সীমালঙ্ঘন করেছে। ফলে ধ্বংশের মধ্যে নিপতিত হয়েছে।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment