হজ্জ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা

হজ্জ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

হজ্জ উম্মতে মুহাম্মাদির প্রত্যেক বিবেক সম্পন্ন ও সাবালক নর-নারী যাদের পথ খরচের পরিমান অর্থ আছে তার উপর ফরজ। নবম হিজরিতে হজ্জ ফরজ করা হয়। হজ্জ সম্পর্কে কুরআনে আল্লাহ তায়ালা যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নির্দেশনা তুলে ধরা হলো। মহান আল্লাহ বলেন,

فِيهِ آيَاتٌ بَيِّـنَاتٌ مَّقَامُ إِبْرَاهِيمَ وَمَن دَخَلَهُ كَانَ آمِنًا وَلِلّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاً وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ الله غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ

অর্থঃ এতে রয়েছে মকামে ইব্রাহীমের মত প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে, লোক এর ভেতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ্ব করা হলো মানুষের উপর আল্লাহর প্রাপ্য, যে লোকের সামর্থ রয়েছে এ পর্যন্ত পৌছার। আর যে লোক তা মানে না। আল্লাহ সারা বিশ্বের কোন কিছুরই পরোয়া করেন না। ( সুরা ইমরান ৩:৯৭)

মহান আল্লাহ বলেন,

وَأَذِّن فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ

অর্থঃ এবং মানুষের মধ্যে হজ্বের জন্যে ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে। (সুরা হাজ্জ্ব ২২:২৭)

 إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَآئِرِ اللّهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَن تَطَوَّعَ خَيْرًا فَإِنَّ اللّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ

অর্থঃ নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তা’আলার নিদর্শন গুলোর অন্যতম। সুতরাং যারা কা’বা ঘরে হজ্ব বা ওমরাহ পালন করে, তাদের পক্ষে এ দুটিতে প্রদক্ষিণ করাতে কোন দোষ নেই। বরং কেউ যদি স্বেচ্ছায় কিছু নেকীর কাজ করে, তবে আল্লাহ তা’আলার অবশ্যই তা অবগত হবেন এবং তার সে আমলের সঠিক মুল্য দেবেন। (সুরা বাকারা ২:১৫৮)

মহান আল্লহ কুরআনে হজ্জের বিধান বর্ণনা করে বলেন,

আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ্ব ওমরাহ পরিপূর্ণ ভাবে পালন কর। যদি তোমরা বাধা প্রাপ্ত হও, তাহলে কোরবানীর জন্য যাকিছু সহজলভ্য, তাই তোমাদের উপর ধার্য। আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা মুন্ডন করবে না, যতক্ষণ না কোরবাণী যথাস্থানে পৌছে যাবে। যারা তোমাদের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়বে কিংবা মাথায় যদি কোন কষ্ট থাকে, তাহলে তার পরিবর্তে রোজা করবে কিংবা খয়রাত দেবে অথবা কুরবানী করবে। আর তোমাদের মধ্যে যারা হজ্জ্ব ওমরাহ একত্রে একই সাথে পালন করতে চাও, তবে যাকিছু সহজলভ্য, তা দিয়ে কুরবানী করাই তার উপর কর্তব্য। বস্তুতঃ যারা কোরবানীর পশু পাবে না, তারা হজ্জ্বের দিনগুলোর মধ্যে রোজা রাখবে তিনটি আর সাতটি রোযা রাখবে ফিরে যাবার পর। এভাবে দশটি রোযা পূর্ণ হয়ে যাবে। এ নির্দেশটি তাদের জন্য, যাদের পরিবার পরিজন মসজিদুল হারামের আশে-পাশে বসবাস করে না। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক। সন্দেহাতীতভাবে জেনো যে, আল্লাহর আযাব বড়ই কঠিন। ( সুরা বাকারা ২:১৯৬)

ইহা ছাড়াও পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারা ১২৫, ১৯৮ ও ১৯৯ নম্বর আয়াতে হজ্জের কথা উল্লেখ করেছেন।

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যাক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হাজ্জ (হজ্জ) করলো এবং অশালীন কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে বিরত রইল, সে নবজাতক শিশু, যাকে তাঁর মা এ মুহূর্তেই প্রসব করেছে, তার ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে ফিরবে। (সহিহ বুখারী ১৪৩১ ইফাঃ)

হজ্জের বিধীবিধান বর্ণনা করে প্রতিটি হাদিস গ্রন্থ আলাদা অধ্যায় রচনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থে হজ্জের বিধী বিধান আলোচন করা উদ্দেশ্য নয়, শুধু হজ্জ করতে গিয়ে আমরা বিদআত ও ভুলভ্রান্তির শিকার হই তাই তুলে করব। ইনশাল্লাহ। তারপরও হজ্জের ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নাহগুলি খুবই সংঙ্কেপে তুলে ধরছি। হজ্জে গমনের সাথে সাথে সময় সুযোগ থাকলে উমরা করা ওয়াজিব। তাই হজ্জের আগেই উমরার ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নাহসমূহত লিখছি।

উমরার ফরজঃ– উমরার ফরজ কাজ দুটি

১. মিকাতের আগেই ইহরামের কাপড় পরে উমরার নিয়ত করা

২. তাওয়াফ করা

উমরার ওয়াজিবঃ- উমরার ওয়াজিব দুটিঃ

১. সাফা ও মারওয়া’ মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ করা। (অনেক আলেম সাফা ও মারওয়ার সাঈ করাকে ফরয বলেছেন।
২. চুল কাটা (মাথার চুল মুণ্ডানো বা ছোট করা)।

উমরা করার হুকুমঃ হানাফী ও মালেকী মাযহাবে উমরা করা সুন্নাত। আর শাফী ও হাম্বলী মাযহাবে উমরা করা ফরয। অর্থাৎ যার উপর হজ্জ ফরয তার উপর উমরাও ফরয।

 

হজ্জের ফরজঃ– হজ্জের ফরজ তিনটি যথাঃ

১. ইহরাম বাঁধা (ইহরামের কাপড় পরে হজ্জের নিয়ত করা)।

২. ৯ই যিলহজ্জে আরাফাতে অবস্থান করা।

৩. তাওয়াফ করা।

উল্লেখ্যঃ হজ্জের এই ফরজ থেকে যে কোন একটি ছুটে গেলে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।

হজ্জের ওয়াজিবঃ– হজ্জের ওয়াজিব নয়টি যথাঃ

১. সাফা ও মারওয়ার সাঈ করা। (অনেকের মতে এটা হজ্জের ফরজ)

২. ইহরাম বাঁধার কাজটি মীকাত পার হওয়ার পূর্বেই সম্পন্ন করা।

৩. আরাফাতে অবস্থান সূর্যাস্ত পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা।

৪. মুযদালিফায় রাত্রি যাপন।

৫. মুযদালিফার পর কমপক্ষে দুই রাত্রি মিনায় যাপন করা।

৬. কঙ্কর নিক্ষেপ করা।

৭. হাদী (পশু) জবাই করা (তামাত্তু ও কেরান হাজীদের জন্য)

৮. চুল কাটা।

৯. বিদায়ী তাওয়াফ।

উল্লেখ্যঃ যে কোন কারণেই হোক উপরে বর্ণিত কোন একটি ওয়াজিব ছুটে গেলে দম (পশু জবাই) দেয়া ওয়াজিব হয়ে যায়। দম দিতে সমর্থ না হলে বিধী মোতাবেক সিয়াম পালন করতে হবে।

হজ্জের সুন্নতঃ

হজ্জের সুন্নত অনেক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ

১. ইহরামের পূর্বে গোসল করা

২. পুরুষদের সাদা রঙের ইহরামের কাপড় পরিধান করা।

৩. তালবিয়াহ পাঠ করা

৪. ৮ই যিলহজ্জ দিবাগত রাত মিনায় অবস্থান করা

৫. ছোট ও মধ্যম জামারায় কংকর নিক্ষেপের পর দু‘আ করা

৬. কেরান ও ইফরাদ হাজীদের তাওয়াফে কুদূম করা।

উল্লেখঃ তবে কোন কারণে সুন্নত ছুটে গেলে দম দিতে হয় না।

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজঃ

যে সব কাজ হাজ্জ বা উমরাহ অবস্থায় নিষেধ করা হয়েছে তা হলঃ

১. মাথার চুল মুণ্ডন করা বা ছোট করা কিংবা উঠিয়ে ফেলা। 

২. ইহরামের অবস্থায় নখ কাটা বা নখ উঠিয়ে ফেলা।

৩. ইহরাম করার পর ইহরামের কাপড়ে কিংবা শরীরে অথবা এমন কিছুতে যা শরীরের সাথে লেগে তাকে তাতে সুগন্ধি ব্যবহার করা।

৪. নিজের অথবা অপরের বিবাহ বন্ধন করা।

৫. যৌন কামনার সাথে স্ত্রীকে চুম্বন দেয়া, স্পর্শ করা কিংবা জড়িয়ে ধরা ইত্যাদি।

৬. সহবাস করা।

৭. ইহরামের নিষিদ্ধ কাজ হল, শিকার করা।

এ সাতটি নিষিদ্ধ কাজ পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্য ইহরাম অবস্থায় হারাম। দু’টি বিষয় এমন রয়েছে যা ইহরাম অবস্থায় শুধু মাত্র পুরুষদের জন্য হারাম। আর তা হলো:

১. মাথা ঢাকা।

২. ইহরাম অবস্থায় সেলাইকৃত কাপড় পরিধান করা।

হজ্জের ধারাবাহিক কাজঃ

তারিখ স্থান করনীয় ইবাদত
৮ই যিলহজ্জ  এবং এর আগে যারা বাহির থেকে মক্কায় প্রবেশ করবেন) মীকাত ১) মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধবেন।
মক্কা ২) কাবা ঘরে উমরার তাওয়াফ করবেন।

৩) সাঈ করবেন।

৪) চুল কেটে হালাল হয়ে যাবেন।

৮ই যিলহজ্জ নিজ বাসস্থান  এবং মিনা নিজ বাসস্থান থেকে ইহরাম বেঁধে হজ্জের নিয়ত করে সূর্যোদয়ের পর মিনায় রওয়ানা হবেন। সেখানে যুহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজরের সালাত আদায় করবেন।
৯ই যিলহজ্জ আরাফা ময়দান ১) সূর্যোদয়ের পর মিনা অথবা নিজ বাসস্থান থেকে আরাফাতে রওয়ানা হবেন।

২) যুহরের প্রথম ওয়াক্তে যুহর ও আসর পড়বেন একত্রে পরপর দুই দুই রাকআত করে।

৩) আরাফায় দোয়া, দুরুদ ও জিকির করে সময় পার করতে হবে।

৪) সূর্যাস্ত পর্যান্ত অবস্থান করতে হবে। সূর্যাস্তের আগে আরাফার ময়দান ত্যাগ করলে হজ্জ শুদ্ধ হবে না।

১০ই যিলহজ্জ (৯ই যিলহজ্জ সূর্যাস্তের পর) মুজদালীফা ১) সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দান থেকে মুযদালিফায় রওয়ানা করবেন। মুযদালিফার পৌছে মাগরিব এশা জমা করে একত্রে পড়বেন।

২) সেখানে রাত্রি যাপন করে প্রথম ওয়াক্তে অন্ধকার থাকতেই ফজর পড়বেন।

৩) আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত কেবলামুখী হয়ে হাত তুলে দীর্ঘ সময় দোয়া ও মোনাজাতে মশগুল থাকবেন।

৪) বড় জামারায় নিক্ষেপের জন্য ৭টি কংকর এখান থেকে কুড়াতে পারেন।

১০ ই যিলহজ্জ মিনা ১) বড় জামরায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করবেন।
২) কুরবানী করবেন, সমস্যা হলে পরে করা যাবে।

৩) চুল কাটাবেন। (কুরবানি না হলে চুল কাটা যাবে না)।

৪) চুল কাটার পর ইহরামের কাপড় বদলিয়ে সাধারণ পোষাক পরে হালাল হতে হবে।

মক্কা ১) তাওয়াফে ইফাদা করবেন। এই দিন না পারলে এটি ১১ বা ১২ তারিখেও করতে পারবেন।

২। তাওয়াফের পর সাথে সাথে সাঈও করবেন।

১১ ই যিলহজ্জ (আইয়ামে তাশরীক)
১ম দিন
মিনা ১) দুপুরের পর সিরিয়াল ঠিক রেখে প্রথমে ছোট, মধ্যম ও এর পরে বড় জামরায় প্রত্যেকটিতে ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করবেন।

২) মিনায় রাত্রি যাপন করবেন।

১২ ই যিলহজ্জ (আইয়ামে তাশরীক)

২য় দিন

মিনা ১) পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী ৩টি জামরায় ৭+৭+৭=২১টি কংকর নিক্ষেপ করবেন। দুপুরের আগে কংকর নিক্ষেপ করবেন না।

২) সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করবেন। তা না পারলে আজ দিবাগত রাতও মিনায় কাটাবেন।

১৩ ই যিলহজ্জ (আইয়ামে তাশরীক)

৩য় দিন

মিনা ১) যারা গত রাত মিনায় কাটিয়েছেন তারা আজ দুপুরের পর পূর্ব দিনের নিয়মেই ৭টি করে মোট ২১ টি কংকর মারবেন। অতঃপর মিনা ত্যাগ করবেন।
১৪ যিলহজ্জ বা তার পরের যে কোন দিন মক্কা দেশে ফেরার পূর্বে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment