ইহরাম এবং ইহরামের ধারাবাহিক কাজ

ইহরাম এবং ইহরামের ধারাবাহিক কাজ

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

১। ইহরাম কি?

আবরী ইহরাম (اَلْاِحْرَامُ) শব্দটি (حَرَامٌ) হারাম শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ হলো কোনো জিনিসকে নিজের ওপর হারাম বা নিষিদ্ধ করে নেয়া। আর এই ইহরাম বাঁধাই হলো, হজ্জ ও উরার প্রথম ফরজ কাজ। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে হাজ্জ বা উমরার মত ফরজ ইবাদাতের সুচনা হয়। এর মাধ্যমেই উরমা বা হজ্জের ইবাদাতে প্রবেশ করা হয়। হজ্জযাত্রী যখন হজ্জ বা উমরা কিংবা উভয়টি পালনের উদ্দেশ্যে নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করে, তখন তার ওপর কতিপয় হালাল ও জায়েয বস্তুও হারাম হয়ে যায়। এ কারণেই এ প্রক্রিয়াটিকে ইহরাম বা নিষিদ্ধ করে নেয়া। তাই বলা যায়, যে কার্যাবলীর মাধ্যমে হাজ্জ বা উমরার ইবাদাত শুরু করা হয় তাকেই ইহরাম বলা হয়।

অন্যভাবে বলা যায়ঃ- পুরুষদের জন্য সেলাইবিহীন দুই টুকরো সাদা কাপড় আর মহিলাগন স্বাচ্ছন্দ্যময় শালীন পোশাক পরিধান করে, তালবিয়া পাঠ করে, আনুষ্ঠানিকভাবে হাজ্জ বা উমরার আদায়ের উদ্দেশ্য কাবা অভিমুখে রওয়ানা দেয়াই হলো ইহরাম বাঁধা। ইহরাম বাঁধার মাধ্যমের একজন হজ্জ ও উমরা আদায়কারী যাত্রী তার নিজের উপর স্ত্রী সহবাস, মাথার চুল, হাতের নখ, গোঁফ, বগল ও নাভির নিচের ক্ষৌর কর্যাদি, সুগন্ধি ব্যবহার, সেলাই করা পোশাক পরিধান এবং শিকার করাসহ কিছু বিষয়কে হারাম করে নেয়। শুধু হজ্জ বা উমরার সংকল্প করলেই কেউ মুহরিম হবে না। যদিও সে নিজ দেশ থেকে সফর শুরুর সময় হজ্জের সংকল্প করে। তেমনি শুধু সুগন্ধি ত্যাগ অথবা তালবিয়া পাঠ আরম্ভ করলেই মুহরিম হবে না। এ জন্য বরং তাকে হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করার নিয়ত করতে হবে। এই লক্ষে তাকে হজ্জ ও উমরা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি গোসল ও পবিত্রতা অর্জন সম্পন্ন করে ইহরামের কাপড় পরিধান করবেন, অতঃপর হজ্জ অথবা উমরা কিংবা উভয়টি শুরুর নিয়ত করবেন।

২। ইহরামের ওয়াজিব তিনটি যথাঃ

১। মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা

২। সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করা

৩। তালবিয়াহ পাঠ করা (নিয়ত করার পর তালবিয়া পাঠ করা ওয়াজিব)

মীকাত অতিক্রম করার আগেই, মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধাতে হবে। এই কাজটি ওয়াজিব বিধায় বাদ দিলে হজ্জ হবে না। তবে ফিদইয়া বা গুনাহ হতে মুক্তিপণ দিয়ে করে ক্ষতি পূরণ আদায় করা যায়। ইহরামের সময় বা আগে পরে কয়েটি ওয়াজির কাজ আছে আবার অনেকগুল সুন্নাহ সম্মত কাজ আছে। সবগুলি কাজ ধারা বাহিকভাবে আদায় করলে ভুল হওয়ার সম্বাবনা থাকে না। তাই এ পর্যায় ইহরামের কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে আলোচন করা হলো। এর মাধ্যমে ওয়াজ বা সুন্নাহ কোনটিই বাদ পড়ার সম্ভাবনা থাকবে না।

ইহরামের ধারাবাহিক কাজগুলো হলোঃ

১। গোসল করা

২। সুগন্ধি লাগান

৩। ইহরামের পোশাক পরা

৪। সালাত আদায় করা (ইহরামের জন্য বিশেষ কোন সালাত নাই)

৫। নিয়ত করা

৬। তালবিয়া পড়া

৭। ঋতুবতী অবস্থায় মহিলাদের ইহরাম বাধার নিয়ম

১। গোসল করাঃ

আর ইহরামের পূর্বে গোসল করা পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্য সুন্নাত। এমনকি ঋতুবতি এবং নিফাস অবস্থায় থাকা মহিলাও গোসল করবে। কেননা, আবূ বাকর সিদ্দীক (রা.) এর স্ত্রী আসমা বিনতে উমায়স বিদায় হাজ্জের বছর যুলহুলাইফা নামক স্থানে মুহাম্মাদ বিন আবু বাকর ভূমিষ্ট করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে গোসল করা নির্দেশ প্রদান করেন।

১. যাইদ ইবনু সাবিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে তিনি ইহরামের উদ্দেশ্যে (সেলাই করা) পোশাক খুলতে ও গোসল করতে দেখেছেন। (সুনানে তিরমিজ ৮৩০ হাদিসের মান সহহি)

২. জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি আসমা বিনতে উমায়স (রাঃ) এর হাদীসে বর্ণনা করেন যে, তিনি যখন যুল হুলায়ফা নামক স্থানে নিফাসগ্রস্ত হলেন, তখন রাসুলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ বকর (রাঃ) কে বললেনঃ তাকে (আসমা বিনতে উমায়স) গোসল করে ইহরাম বাঁধতে বল। (সহিহ মুসলিম ২৭৯৯, সুনান নাসাঈ ২১৫)

৩. জা’ফর ইব্ন মুহাম্মদ (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেনঃ আমাকে আমার পিতা বলেছেন, আমরা জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ (রাঃ) এর নিকট গমন করে তাকে রাসূলুল্লাহ (স)-এর বিদায় হজ্জ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি আমাদের নিকট বর্ণনা করেন যে, রাসূলূল্লাহ (স) যুলক্বা’দা মাসের পাঁচ দিন অবশিষ্ট থাকতে হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হলেন। আমরাও তাঁর সাথে বের হলাম। যখন তিনি যুল-হুলায়ফা পৌঁছলেন, তখন আসমা বিন্তে উমায়স (রাঃ) মুহাম্মদ ইব্ন আবূ বকরকে প্রসব করলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (স)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করে পাঠালেনঃ আমি এখন কি করব? তিনি বললেনঃ তুমি গোসল কর তারপর পট্টি পরে নাও এবং ইহরাম বাঁধ। (সুনান নাসাঈ ২৯১)

৪. আবু বকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হলেন। তখন তাঁর সাথে তার সহধর্মিণী আসমা বিনীত উমায়স খাছ’আমীয়্যাও ছিলেন। যখন তাঁরা যুলহুলায়ফায় ছিলেন, তখন আসমা মুহাম্মদ ইবন আবু বকরকে প্রসব করেন। আবু বকর (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এ সংবাদ দিলে রাসূলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকরকে বলেন, তাকে গোসল করে হজের ইহরাম বাঁধতে আদেশ করুন। এরপর অন্যান্য লোক যা করে সেও তা করবে। কিন্তু সে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না। (সুনান নাসাঈ ২৬৬৬, ইবনে মাজাহ ২৯১২)

৫. আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি যখন ইহরাম বাঁধার ইচ্ছা করবে, তখন তার জন্য গোসল করা সুন্নত। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৫৮৪৭)

মন্তব্যঃ ইহরামের পূর্বে গোসল করা একটি মুস্তাহাব আমল। অনেক আলেম ইহাকে সুন্নাহও বলছেন। তবে, সময় সুযোগ না হলে হলে গোসল করা জরুরী নয়। এই ক্ষেত্র পবিত্র থেকে অজু করে দুই রাকাত তাইহিয়্যাতুল অজুর সালাত আদায় করা যেতে পারে। কিন্তু ঋতুবতি এবং নিফাস অবস্থায় থাকা মহিলা গোসল করে, নিজেদের প্রস্তত করেই ইহরাম বাঁধবে।

ক। ইহরাম বাঁধার পরও গোসল করা যাবেঃ

আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস এবং মিসওয়ার ইবন মাখরামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তারা উভয়ে আবওয়া নামক স্থানে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। ইবন আব্বাস বললেনঃ মুহরিম ব্যক্তি তার মাথা ধুইবে, আর মিসওয়ার বললেনঃ সে মাথা ধুইবে না। এরপর আবদুল্লাহ ইবদ আব্বাস আমাকে আবু আইয়ুব আনসরী বাঃ এর নিকট পাঠালেন যেন, আমি তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। আমি তাকে পেলাম, তিনি কূপের পার্শ্বে দু’টি কাঠের মধ্যস্থলে গোসল করছিলেন। আর তিনি ছিলেন এক কাপড়ের পর্দার আড়ালে। আমি তাঁকে সালাম দিয়ে বললামঃ কিরূপে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় মাথা ধৌত করতেন, তা আপনার নিকট জিজ্ঞাসা করার জন্য আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) আমাকে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। আমার কথা শুনে আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) কাপড়ের উপর হাত রেখে তা সরিয়ে দিলেন, তাতে তার মাথা দৃশ্যমান হলো। তিনি একজন লোককে তার মাথায় পানি ঢালতে বললেন, তারপর দু’হাত দ্বারা তিনি মাথা ঝাড়া দিলেন, পরে উভয় হাতকে একবার সামনের দিকে একবার পেছনের দিকে নিলেন, তারপর তিনি বললেনঃ এভাবে আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গোসল করতে দেখেছি। (সহিহ বুখারি ১৮৪০, সুনানে নাসাঈ ২৬৬৭, ইবনে মাজাহ ২৯৩৪)

২। সুগন্ধি লাগানঃ

গোসল করার পর ইহরাম বাঁধার আগে সুগন্ধি মাখা যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমল থেকে তার প্রমান পাওয়া যায়। কিন্তু ইহরামের কাপড় পরিধানের পর সুগন্ধি মাখা চলবে না। ইহরামের নিয়ত করার পূর্বে মাখা সুগন্ধি মুহরিমের চেহারায় দৃশ্যমান হতে পারে বা তা থেকে সুগন্ধ আসতে পারে। এরপর যখন আবার ইহরাম থেকে মুক্ত হবে, তখন আবার সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে। 

দলিলঃ

১. আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইহরাম বাধার সময় এবং (হজ্জ সমাপনান্তে) ইহরামমুক্ত হওয়ার পর বায়তুল্লাহ তাওয়াফের পুর্বেও আমি তাঁকে সুগন্ধি মেখে দিয়েছি। (সহিহ মুসলিম ২৬৯৫ ইফাঃ)

২. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইহরাম বাঁধার ইচ্ছা করিলেন, তখন তঁর ইহরামের সময় আমি তাঁর গায়ে নিজ হাতে সুগন্ধি লাগিয়েছি। আর যখন তিনি ইহরাম খুলছিলেন, তাঁর ইহরাম খোলার পূর্বে আমার নিজ হাতে সুগন্ধি মাখিয়েছি। সুনানে নাসাঈ ২৬৮৬)

৩. আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি যেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাথার সিঁথিতে কস্তুরীর ঔজ্জ্বল্য দেখতে পাচ্ছি, তিনি তখন তালবিয়া পাঠ করছিলেন। (সহিহ মুসলিম (২৭০৪ ইফাঃ)

৪. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ইহ্‌রাম বাঁধা অবস্থায় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সিঁথিতে যে সুগন্ধি তেল চকচক করছিল তা যেন আজও আমি দেখতে পাচ্ছি। (সহিহ বুখারি ১৫৩৮ তাওহীদ)

৩। ইহরামের জন্য পোশাক পরাঃ

গোসল করে সুগন্ধী লাগানোর পর ইহরামের কাপড় পরিধান করবে। আর তা হলো পুরুষদের জন্য সেলাই বিহীন লুঙ্গী ও চাদর। আর মহিলারা সাজ সজ্জা ব্যতীত যে কোন রকম কাপড় পরিধান করতে পারবে। এই কথার দলিল হল নিম্মের হাদিসসমূহঃ

১. আবদুল্লাহ ইব্‌নু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! মুহরিম ব্যক্তি কী প্রকারের কাপড় পরবে? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ সে জামা, পাগড়ী, পায়জামা, টুপি ও মোজা পরিধান করবে না। তবে কারো জুতা না থাকলে সে টাখ্‌নুর নিচ পর্যন্ত মোজা কেটে (জুতার ন্যায়) পরবে। তোমরা জা’ফরান বা ওয়ার্‌স (এক প্রকার খুশবু) রঞ্জিত কোন কাপড় পরবে না। [আবূ ‘আবদুল্লাহ (রহঃ) বলেন, মুহরিম ব্যক্তি মাথা ধুতে পারবে। চুল আঁচড়াবে না, শরীর চুলকাবে না। মাথা ও শরীর হতে উকুন যমীনে ফেলে দিবে। (সহিহ বুখারি ১৫৪২ তাওহীদ)

মন্তব্যঃ জুতা না পেলে মোজাকে টাখনুর নীচ থেকে কেটে তা পরার বিধানটি রহিত হয়ে গেছে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোজা কাটার কথা পূর্বে বলেছিলেন এবং এটা তিনি বলেছিলেন মদীনায় থাকাকালীন। নিচের হাদিসটি লক্ষ করুনঃ

ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃএক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলোঃ হে আল্লাহ্‌র রসূল! মুহ্‌রিম কি কাপড় পরবে? নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, মুহ্‌রিম জামা, পায়জামা, টুপি এবং মোজা পরবে না। তবে যদি সে জুতা না পায়, তা হলে পায়ের গোড়ালির নীচে পর্যান্ত (মোজা) পরতে পারবে। (সহিহ বুখারী ৫৭৯৪ তাওহীদ, সহিহ মুসলিম ২৬৮২)

২. ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট জানতে চাইল যে, মুহরিম ব্যক্তি কী ধরনের পোশাক পরবে? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলছেন, মুহরিম ব্যক্তি জামা, পাগড়ী, পায়জামা, টুপি ও মোজা পরিধান করতে পারবে না। তবে কোন ব্যক্তি চপ্পলের অভাবে মোজা পরিধান করলে তাকে পায়ের গোছার নীচ বরাবর মোজার উপরিভাগ কেটে ফেলতে হবে। তোমরা এমন কাপড় পরিধান কর না যা জাফরান বা ওয়ারস রঙ্গে রঞ্জিত করা হয়েছে। (সহিহ মুসলিম ২৬৮১, সুনানে নাসাঈ ২৬৭১)

৩. ইবন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। একদা এক ব্যক্তি বললোঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আমরা যখন ইহরাম অবস্থায় থাকি তখন আমরা কোন কোন কাপড় পরিধান করবো? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা জামা পরিধান করবে না। আমাদের আরো বললেন, তোমরা জামা পাগড়ী পায়জামা পরিধান করবে না এবং মোজা, ওড়না কিন্তু যদি তোমাদের কারো জুতা না থাকে, তাহলে তা গ্রস্থির নীচ থেকে কেটে নেবে। আর পরিধান করবে না এমন কাপড় যাতে ওয়ারস ও জাফরান রং লেগেঝে। (সুনানে নাসাঈ ২৬৭২)

৪. সালিম (রহঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে জিজ্ঞেস করা হ‘ল যে, মুহরিম ব্যক্তি ইহরাম অবস্থায় কী পরিধান করবে? তিনি বললেন, মুহরিম ব্যক্তি জামা, পাগড়ী, টুপী, পায়জামা, জাফরান বা ওয়ারস দ্বারা রঞ্জিত কাপড় এবং মোজা পরিধান করবে না। কিন্তু তার চপ্পল না থাকলে সে পায়ের গোছার নিম্নাংশ বরাবর মোজার উপরিভাগ কেটে ফেলে তা পরিধান করতে পারবে। (সহিহ মুসলিম ২৬৮২)

৫. ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, এক লোক দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহ্‌র রাসূল ! আমাদেরকে ইহরাম অবস্থায় আপনি কি ধরণের পোশাক পরার নির্দেশ দেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ জামা, পাজামা, টুপি, পাগড়ী ও মোজা পরবে না। তবে কোন লোকের জুতা না থাকলে সে চামড়ার মোজা পরবে যা পায়ের গোছার নিচে থাকে। যাফরান ও ওয়ারাস রং-এ রঙ করা কোন পোশাক তোমরা পরবে না। ইহরামধারী মহিলারা মুখ ঢাকবে না এবং হাতে দস্তানা (হাত মোজা) পরবে না। (সুনানে তিরমিজি ৮৩৩)

৬. ‘আয়েশা (রাঃ) ইহ্‌রাম অবস্থায় কুসুমীর রঙ্গে রঞ্জিত কাপড় পরেন এবং তিনি বলেন, নারীগণ ঠোঁট মুখমন্ডল আবৃত করবে না। ওয়ার্‌স ও জাফরান রঙে রঞ্জিত কাপড়ও পরবে না। জাবির (রাঃ) বলেন, আমি উসফুরী (কুসুমী) রঙকে সুগন্ধি মনে করি না। ‘আয়েশা (রাঃ) (ইহ্‌রাম অবস্থায়) নারীদের জন্য অলংকার পরা এবং কালো ও গোলাপী রং-এর কাপড় ও মোজা পরা দূষণীয় মনে করেননি। ইব্রাহীম (নাখ্‌’য়ী) (রহঃ) বলেন, (ইহ্‌রাম অবস্থায়) পরনের কাপড় পরিবর্তন করায় কোন দোষ নেই। সহিহ বুখারি ১৫৪৪ তাওহীদ)

৭. আবদুল্লাহ ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবীগণ চুল আঁচড়িয়ে, তেল মেখে, লুঙ্গি ও চাদর পরে ( হজ্জের উদ্দেশ্যে) মদীনা হতে রওয়ানা হন। তিনি কোন প্রকার চাদর বা লুঙ্গি পরতে নিষেধ করেননি, তবে শরীরের চামড়া রঞ্জিত হয়ে যেতে পারে এরূপ জাফরানী রঙের কাপড় পরতে নিষেধ করেছেন। যুল-হুলাইফা হতে সওয়ারীতে আরোহণ করে বায়দা নামক স্থানে পৌঁছে তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ তালবিয়া পাঠ করেন এবং কুরবানীর উটের গলায় মালা ঝুলিয়ে দেন, তখন যুলকা’দা মাসের পাঁচদিন অবশিষ্ট ছিল। যিলহজ্জ মাসের চতুর্থ দিনে মক্কায় উপনীত হয়ে সর্বপ্রথম কা’বাঘরের তাওয়াফ করে সাফা ও মারওয়ার মাঝে সা’য়ী করেন। তাঁর কুরবানীর উটের গলায় মালা পরিয়েছেন বলে তিনি ইহ্‌রাম খুলেননি। অতঃপর মক্কার উঁচু ভূমিতে হাজূন নামক স্থানের নিকটে অবস্থান করেন, তখন তিনি হজ্জের ইহরামের অবস্থায় ছিলেন। (প্রথমবার) তাওয়াফ করার পর ‘আরাফাহ হতে ফিরে আসার পূর্বে আর কা’বার নিকটবর্তী হননি। অবশ্য তিনি সাহাবাগণকে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ও সাফা মারওয়ার সা’য়ী সম্পাদন করে মাথার চুল ছেঁটে হালাল হতে নির্দেশ দেন। কেননা যাদের সাথে কুরবানীর জানোয়ার নেই, এ বিধানটি কেবল তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর যার সাথে তার স্ত্রী রয়েছে তার জন্য স্ত্রী-সহবাস, সুগন্ধি ব্যবহার ও যে কোন ধরনের কাপড় পরা জায়িয। (সহিহ বুখারি ১৫৪৫ তাওহীদ)

৮.  ইয়ালা ইবনু উমাইয়্যা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক বেদুঈনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহরাম অবস্থায় জুব্বা পরিহিত দেখলেন। তিনি তাকে তা খুলার নির্দেশ দিলেন।(সুনানে তিরমিজি ৮৩৫ হাদিসের মান সহিহ)

৯. ইবন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহরিমকে যা’ফরান ও ওয়ারস দ্বারা রঞ্জিত কাপড় পরিধান করতে নিষেধ করেছেন। (সুনানে নাসাঈ ২৬৬৮)

১০. ইবন উমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তোমরা ইহরাম অবস্থায় জামা, পায়জামা, পাগড়ী, বুরনুস এবং মোজা পরিধান করবে না। (সুনানে নাসাঈ ২৬৮০)

ক। মহিলাগন নিকাব ও হাত মোজা পরিধান করবে নাঃ

ইবন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললোঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্! ইহরাম অবস্থায় আমাদেরকে কাপড় পরিধান করতে আদেশ করেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জামা,পায়জামা, পাগড়ী এবং বুরনুস পরবে না, আর মোজা পরিধান করবে না। কিন্তু যদি কারো জুতা না থাকে, তবে সে পায়ের গ্রস্থির নিম্ন পর্যন্ত মোজা পরিধান করতে পারে। আর যে কাপড়ে যাফরান বা ওয়ারস রং লেগেছে ঐ সকল কাপড় তোমরা পরিধান করবে না, আর মুহরিম নারী নিকাব পরিধান করবে না। আর হাত মোজাও পরিধান করবে না। (সুনানে নাসাঈ ২৬৭৫ এবং ২৬৮৩)

খ। হাদিসের আলোকে ইহরাম বাধার পর পোশাক পরিধান হবে নিম্মরূপঃ

১। মুহরিম ব্যক্তি জামা এবং পায়জামা পরিধান করতে পারবে না।

২। মুহরিম ব্যক্তি মাথায় পাগড়ী বা টুপি পরিধান করতে পারবে না।

৩। হাতে ও পায়ে মুজা ব্যবহার করতে পাবরে না তবে চপ্পল ব্যবহার করতে পারবে।

৪।  মুহরিম নারী মুখ ঢাকবে না এবং হাত মোজাও পরবে না।

৫।  মুহরিম নারীদের বুরনুস (টুপির মত এক প্রকার কাপড় যা মহিলারা পরিধান করে) পরিধান করতে পারবে না।

৬। জাফরান বা ওয়ারস রঙ্গে রঞ্জিত কাপড় পরিধান করা যাবে না

৭। মুহরিম চুল আঁচড়াবে না, শরীর চুলকাবে না।

মন্তব্যঃ এই সকল বিষয় বিবেচনা করে হজ্জযাত্রীগন সেলাই বিহীন দুটি সাদা চাদরের মত কাপড় ব্যবহার করে। আর মহিলাগন সুবিধামত সাবলিল পোশাক পরিধান করে থাকে।

৪। সালাত আদায় করাঃ

আমদের সমাজের অনেকের বিশ্বাস ইহরাম বাঁধার প্রাক কালে দুই রাকাত সালাত আদায় করা ওয়াজিব। ইবনে তাইমিয়ার মতে, ইহরামের বিশেষ কোন নামায নেই। কেননা, এ ধরণের কোন নামায নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়নি। ইহরামকালে দুই রাকাত নামায পড়া ওয়াজিব নয়।

        হজ্জযাত্রীগন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে গোসল করার পর ইহরামের কাপড় পরে ইহরাম বাঁধবে। এই সময় কোন প্রকার সালাত আদায় জরুরী নয়। তবে, যদি কোন নামাযের ওয়াক্ত হয়, যেমনঃ ফরয নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেছে, কিংবা ওয়াক্ত হওয়ার সময় কাছাকাছি এবং সে ব্যক্তি নামায পড়া পর্যন্ত মীকাতে অবস্থান করতে চায় এক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে, নামাযের পর ইহরাম বাঁধা। কাজেই ঋতুবতী এবং নিফাস অবস্থায় থাকা মহিলা ব্যতীত অন্যরা ফরয সলাতের সময় হলে (মীক্বাতে) ফরয সলাত আদায় করবে। যদি ফরয সলাতের সময় না হয়, সে ক্ষেত্রে কোন কোন আলেম ইহরানের নিয়ত না করে, তাহইয়্যাতুল উযূর নিয়তে দু’রাক‘আত সালাত আদায় করার কথা বলেছেন।

৫। নিয়ত করাঃ

সকল ইবাদতের আগে নিয়ত ঠিক করা ফরজ। নিয়তে কারনেই আমলটি কবুল হয়ে থাকে। আবার ভুল নিয়তের কারনে আমলটি শির্কে পরিনত হয়। এই জন্য হয়তো ইমাম বুখারী তার গ্রন্থের প্রথম হাদিসটি নিয়ত সম্পর্কে লিখেছেন। হজ্জ একটি অন্যতাম ফরজ ইবাদাত শুধু নিয়তের কারনেই হজ্জ বাতিল হয়ে যায়। এই ইবাদতের সাথে আর্থিক ও শারীরিক সম্পর্ক থাকার করানে অনেকেরই ফরজ হয় না। যাদের ফরজ হয় তারা কষ্ট স্বীকার করে আদায় করে অথচ নিয়তের কারনে বাতিল হয়ে যায়। প্রথমত না জানার কারনে নিয়তের পদ্ধতিতে ভুল ভুল করে। অশুদ্ধ নিয়তের করার মধ্য অন্যতম হলো, লোক দেখান হজ্জ করা,  মক্কা মদিনা দেখার জন্য, অর্থের লোভে হজ্জ করা, সমাজ ও লোক চক্ষু ভয়ে, হাজ্জি উপাধী গ্রহনের জন্য, খ্যাতি অর্জনের জন্য, মদিন রাসূল (সাঃ) কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্য করে হজ্জে গমন করা ইত্যাদি।

ক। নিয়তের সঠিক পদ্ধতি হলোঃ

নিয়ত আরবী শব্দ। যার অর্থ হল, ইচ্ছা বা সংকল্প। আর ইচ্ছার স্থান হচ্ছে অন্তর। তা মুখে উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। মহান আল্লাহ বলেন,

*قُلْ إِن تُخْفُواْ مَا فِي صُدُورِكُمْ أَوْ تُبْدُوهُ يَعْلَمْهُ اللّهُ وَيَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأرْضِ وَاللّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ*

অর্থঃ বলে দিন, তোমরা যদি মনের কথা গোপন করে রাখ অথবা প্রকাশ করে দাও, আল্লাহ সে সবই জানতে পারেন। আর আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সেসব ও তিনি জানেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান। (সুরা ইমরান ৩:২৯)

উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের অথবা নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সেই উদ্দেশ্যেই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর -১)

একজন বিবেকবান, সুস্থ মস্তিষ্ক, বাধ্য করা হয়নি, এমন লোক কোনো কাজ করবে আর সেখানে তার কোনো নিয়ত বা ইচ্ছা থাকবে না সেটা সম্ভব নয়। হজ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল, সুতরাং হজ্জে যাত্রা করার পূর্বে সঠিক নিয়ত করা ফরজ। নিয়ত হল অন্তরের সাথে দৃঢ় সংকল্প, শব্দের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে হজ্জ ও উমরার শুরুতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উচ্চৈঃস্বরে হজ্জ ও ‘উমরাহ’র তালবিয়া পাঠ করছেন। এই জন্য অনেক আলেম মনে করে, ইহ্‌রাম ব্যতীত অন্য কোন ইবাদাতে মৌখিক নিয়তে শব্দ উচ্চারণ করা শরীয়তে বৈধ নয়। কেননা কেবল ইহরামের সময়ই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ওভাবে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করার কথা বর্ণিত আছে। অবশ্য তা প্রচলিত নাওয়াইতু আন…… বলে গদ বাধা নিয়মে নয়। আমাদের দেশে সালাতে যে গদবাধা নিয়ত বলে সালাত শুরু হয় তা একটি বিদআতি আমল। এমনিভাবে অনেক হজ্জের সময়ও নিয়ত মুখে উচ্চারণ করে জোরে জোরে বলতে থাকে। তাদের এই আমল সঠিক নয় কারন মনে মনে ওমরাহ বা হজ্জের সংকল্প করা ও তালবিয়াহ পাঠ করাই যথেষ্ট। এই কথার দলিল হলো, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই হাদিস।

আনাস ইব্‌নু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যোহরের সালাত মদীনায় চার রাক’আত আদায় করলেন এবং ‘আসরের সালাত যুল-হুলাইফায় দু’রাক’আত আদায় করেন। আমি শুনতে পেলাম তাঁরা সকলে উচ্চৈঃস্বরে হজ্জ ও ‘উমরাহ’র তালবিয়া পাঠ করছেন। (সহিহ বুখারি ১৫৪৮ তাওহীদ)

** সালাত শেষে অন্তরে হজ্জ বা উমরার নিয়ত করে ইহরাম বাঁধবে আর মুখে বলবেঃ

১। যদি তামাত্তুকারী হন, তাহলে বলবেনঃ

**لَبَّيْكَ عُمْرَةً**

লাব্বাইকা উমরাতান

অর্থঃ (হে আল্লাহ!) আমি হাজির হয়েছি উমরা উদ্দেশ্যে।

মন্তব্যঃ তামাত্তু হজ্জের নিয়তকারী যেহেতু উমরা করা পর হালাল হয়ে যায়। তাই তার মনে মনে এই সংকল্প থাকতে হবে যে, এই সপরে উমরা থেকে হালাল হবার পর আবার ইহরাম বেঁধে হজ্জ আদায় কবর।

 ২। যদি কিরানকারী হন, তাহলে বলবেনঃ

**لَبَّيْكَ عُمْرَةً وَحَجًّا**

লাব্বাইকা উমরাতান ও হাজ্জান

অর্থঃ (হে আল্লাহ!) আমি হাজির হয়েছি উমরা ও হজ্জের উদ্দেশ্যে।

দলিলঃ আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এভাবে হাজ্জ (হজ্জ) ও উমরা উভয়ের তালবিয়া  পাঠ করতে শুনেছিঃ (তিনি বলেছেন)

**لَبَّيْكَ عُمْرَةً وَحَجًّا**

লাব্বাইকা উমরাতান ও হাজ্জান

অর্থঃ (হে আল্লাহ!) আমি হাজির হয়েছি উমরা ও হজ্জের উদ্দেশ্যে। (সহিহ মুসলিম ২৮৯৮ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ কিরান হজ্জ কারীর সাথে হাদি থাকে তাই সে উমরার পর হালাল হতে পারে। এই কারনে কিরান হজ্জের নিয়তকারী কে একই ইহরামে হজ্জও উমরা আদায় করতে হয় বিধায় তিনি একই সাথে হজ্জ ও উমরার নিয়ত করবেন।

৩। আর যদি ইফরাদকারী হন, অর্থাৎ যিনি শুধু হজ্জের নিয়ত করবেন তিনি বলবেনঃ

**لَبَّيْكَ َحَجًّا. **

লাব্বাইকা হাজ্জান

অর্থঃ (হে আল্লাহ!) আমি হাজির হয়েছি হজ্জের উদ্দেশ্যে।

মন্তব্যঃ ইফরাত হজ্জের নিয়তকারী উমরা করার সুযোগ পায় না, তিনি সরাসরি হজ্জ আদায় করে থাকেন। তাই ইফরাতের হজ্জের জন্য গমন কারী হজ্জযাত্রী শুধু হজ্জের নিয়ত কবরে।

৪। পক্ষান্তরে যদি উমরা পালনকারী হন, অর্থাৎ যিনি শুধু উমরার নিয়ত করবেন তিনি বলবেনঃ

**لَبَّيْكَ عُمْرَةً. **

লাব্বাইকা উমরাতান

অর্থঃ (হে আল্লাহ!) আমি হাজির হয়েছি উমরার উদ্দেশ্যে।

মন্তব্যঃ ইহরামের নিয়ত মনে মনে করার পর এই চার প্রকারের কালিমা মৌখিকভাবে বলতে হবে। তার পর হাদিসে বর্ণিত তাবলিয়া পড়তে হবে।

খ। ওজরের কারণে শর্ত সাপেক্ষে নিয়তঃ

হজ্জ পালনকারী ব্যক্তি যদি অসুখ কিংবা শত্রু অথবা অন্য কোন কারণে হজ্জ সম্পন্ন করার ব্যাপারে শঙ্কা বোধ করেন, তাহলে নিজের ওপর শর্তারোপ করে বলবেন,

**اللَّهُمَّ مَحِلِّي حَيْثُ حَبَسْتَنِي **

আল্লাহুম্মা মাহিল্লী হাইছু হাবাসতানী

অর্থঃ হে আল্লাহ আপনি আমাকে যেখানে রুখে দেবেন, সেখানেই আমি হালাল হয়ে যাব।

এই কথার দলিলঃ

১. আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবা‘আ বিনতে যুবায়র-এর নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তোমার হাজ্জে যাবার ইচ্ছে আছে কি? সে উত্তর দিল, আল্লাহর কসম! আমি খুবই অসুস্থবোধ করছি (তবে হাজ্জে যাবার ইচ্ছে আছে)। তার উত্তরে বললেন, তুমি হাজ্জের নিয়্যতে বেরিয়ে যাও এবং আল্লাহর কাছে এই শর্তারোপ করে বল, হে আল্লাহ্! যেখানেই আমি বাধাগ্রস্ত হব, সেখানেই আমি আমার ইহরাম শেষ করে হালাল হয়ে যাব। সে ছিল মিকদাদ ইবনু আসওয়াদের সহধর্মিণী। (সহিহ বুখারী ৫০৮৯ তাওহীদ)

অথবা বলবে,

**لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ ، وَمَحِلِّي مِنَ الأَرْضِ حَيْثُ تَحْبِسُنِي.**

(লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, ওয়া মাহিল্লী মিনাল আরদি হাইছু তাহবিসুনী)

‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, যেখানে তুমি আমাকে আটকে দেবে, সেখানেই আমি হালাল হয়ে যাব।

এই কথার দলিলঃ

ইবন আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন ও দুবা’আ বিনত যুবায়র ইবন আবদুল মুত্তালিব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হজ্জের ইচ্ছা করেছি। এখন আমি কি বলবো? তিনি বললেনঃ তুমি বলবেঃ

*لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ وَمَحِلِّي مِنَ الأَرْضِ حَيْثُ تَحْبِسُنِي*

লাব্বায়ক আল্লাহুম্মা লাব্বায়ক, ‘অমাহিল্লি মিনাল আরদী হাইছু তাহবিসুনী” (অর্থঃ আপনি যেখানে আমাকে আটকে রাখেন আমি সেখানে হালাল হয়ে যাব)। কারণ তোমার জন্য তোমার রবের নিকট তাই রয়েছে, যা তুমি শর্ত করেছ। (সুনানে নাসাঈ ২৭৬৮ ইফাঃ)

মন্তব্যঃ ইহরাম বাধার সময় যদি ব্যাধি বা অন্য কোন বাধার কারণে নিজ হাজ্জের বা উমরার কার্যাবলী সম্পূর্ণ করতে অপারগ হওয়ার আশঙ্কা করে, তাহলে তার জন্য ইহরামের নিয়্যাত করার পূর্বে শর্ত লাগিয়ে নেয়া সুন্নাত। যেমনটি উপরের হাদিস দ্বারা প্রমানিত। এখানে মৌখিক উচ্চারণের বিষয়টি এসেছে যেহেতু হজ্জটা মানতের মত। মানত মৌখিক উচ্চারণের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। কেননা কোন লোক যদি অন্তরে মানতের নিয়ত করে তাহলে সে মানত সংঘটিত হবে না। যেহেতু হজ্জ পরিপূর্ণ করার দিক থেকে মানতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জ শুরু করার সময় এই বাক্য বলে মৌখিকভাবে শর্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।

পক্ষান্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিসে যে এসেছে, “আমার নিকটে জিব্রাইল এসে বলেন, আপনি এই মোবারকময় উপত্যকায় নামায আদায় করুন এবং বলুন, “উমরাতান ফি হাজ্জা” (উমরাসহ হজ্জ) কিংবা “উমরাতান ওয়া হাজ্জা” (হজ্জ ও উমরা)। এর মানে এ নয় যে, তিনি নিয়ত উচ্চারণ করেছেন। বরং এর অর্থ হচ্ছে, তিনি তাঁর তালবিয়ার মধ্যে হজ্জের প্রকারটি উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ত উচ্চারণ করেননি। (ইসলামী ফতোয়াসমগ্র ২/২১৬)। আল্লাহই ভাল জানেন।

কিন্তু মনে রাখতে হবে যারা হাজ্জ বা উমরা সম্পূর্ণ করতে অপারগ হওয়ার আশঙ্কা নেই, তার জন্য শর্ত করা ঠিক নয়। কারণ, নাবী (সা.) ইহরাম করার সময় কোন শর্ত করেননি। তিনি সকল সাহাবীকে সাধারণভাবে শর্ত করার নির্দেশ দেননি, বরং একমাত্র যুবাইরের-এর মেয়ে যুবাআ’হ-কে তাঁর ব্যধিগ্রস্ত হওয়ার কারণে হাজ্জ সম্পাদনে অপারগ হওয়ার আশঙ্কা থাকায় শর্ত করার নির্দেশ দেন।

গ। নাবালকের ইহরামঃ

মুহরিম ব্যক্তি যদি ভালো-মন্দ পার্থক্যকারী ও বোধসম্পন্ন বালক হয়, তাহলে সে সেলাইযুক্ত কাপড় পরিহার করে ইহরামের কাপড় পরিধান করে নিজেই ইহরাম বাঁধবে। হজ্জ বা উমরার যেসব আমল সে নিজে করতে পারে, নিজে করবে। অবশিষ্টগুলো অভিভাবক তার পক্ষ থেকে আদায় করবেন।

বালক যদি ভালো-মন্দ পার্থক্যকারী বা বোধসম্পন্ন না হয়, তাহলে অভিভাবক তার শরীর থেকে সেলাইযুক্ত কাপড় খুলে ইহরামের কাপড় পরিধান করাবেন। অতপর তার পক্ষ থেকে ইহরাম বাঁধবেন এবং তাকে নিয়ে হজের সকল আমল সম্পন্ন করবেন।

মন্তব্যঃ মুখে ‘নাওয়াইতুল উমরাতা’ বা ‘নাওয়াইতুল হজ্জা’  বলা বিদ‘আত।  উল্লেখ্য যে, হজ্জ বা উমরাহর জন্য ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করা ব্যতীত অন্য কোন ইবাদতের জন্য মুখে নিয়ত পাঠের কোন দলিল নেই। নিয়তের স্থান হচ্ছে, কলব বা অন্তর। নিয়ত উচ্চারণ করা বিদআত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি্ ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীবর্গ থেকে সাব্যস্ত হয়নি যে, তারা কোন ইবাদতের পূর্বে নিয়ত উচ্চারণ করেছেন। হজ্জ ও উমরার তালবিয়া নিয়ত নয়। শাইখ বিন বায (রহঃ) বলেনঃ

নিয়ত উচ্চারণ করা বিদআত। সজোরে নিয়ত পড়া কঠিন গুনাহ। সুন্নাহ হচ্ছে, মনে মনে নিয়ত করা। কারণ আল্লাহ তাআলা গোপন ও সঙ্গোপনের সবকিছু জানেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

*قُلْ أَتُعَلِّمُونَ اللَّهَ بِدِينِكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ*

অর্থঃ বলুন, তোমরা কি তোমাদের ধর্ম পরায়ণতা সম্পর্কে আল্লাহকে অবহিত করছ? অথচ আল্লাহ জানেন যা কিছু আছে ভূমন্ডলে এবং যা কিছু আছে নভোমন্ডলে। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত। (সুরা হুজুরাত ৪৯:১৬)।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, কিংবা তাঁর সাহাবীবর্গ কিংবা অনুসরণযোগ্য ইমামদের থেকে ‘নিয়ত উচ্চারণ করা’ সাব্যস্ত হয়নি। সুতরাং জানা গেল যে, এটি শরিয়তে সিদ্ধ নয়। বরং নবপ্রচলিত বিদআত। আল্লাহই তাওফিকদাতা। (ইসলামী ফতোয়াসমগ্র (২/৩১৫)

শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে নামায, তাহারাত (পবিত্রতা), রোজা কিংবা অন্য কোন ইবাদতের ক্ষেত্রে নিয়ত উচ্চারণ করা বর্ণিত হয়নি। এমনকি হজ্জ-উমরার ক্ষেত্রেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন না যে, ‘আল্লাহু্ম্মা ইন্নি উরিদু কাযা ওয়া কাযা…,,,,(অর্থে …হে আল্লাহ, আমি অমুক অমুক আমল করার সংকল্প করেছি…)।

৬। হজ্জের নিয়তে ভুলত্রুটিঃ

যারা হজ্জ করতে যান তাদের নিয়তে অনেক সমস্যা থাকে তার মধ্য নিম্মের ভুলত্রুটিগুলো অন্যতম।

ক।  লোক দেখান হজ্জ করা

খ। মক্কা মদিনা দেখার জন্য

গ। অর্থের লোভে হজ্জ করা

সমাজ ও লোক চক্ষু ভয়ে

ক। লোক দেখান হজ্জ করাঃ

আল্লাহ ছাড়া অন্যের সন্তুষ্টির বা লোক দেখান হজ্জ করলে তার কখনও করুল হবে না। বরং লোক দেখান হজ্জ করা একটি গুনাহের কাজ। এর পরিনতিও খুবই খারাপ। লোক দেখান কাজের পরিণতি কি হবে? এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক কোরআনুল কারীমে এরশাদ করেন,

وَقَدِمۡنَآ إِلَىٰ مَا عَمِلُواْ مِنۡ عَمَلٍ۬ فَجَعَلۡنَـٰهُ هَبَآءً۬ مَّنثُورًا (٢٣) 

অর্থ: (আমি ছাড়া অন্যের সন্তুষ্টির জন্য) আর তারা যে কাজ করেছে, আমি সেদিকে অগ্রসর হব। অতঃপর তাকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করে দেব। (সুরাহ আল-ফুরকান ২৫:২৩)।

হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ননা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের চেহারা ও দেহের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তোমাদের অন্তর ও কর্মের প্রতি লক্ষ্য আরোপ করেন। (সহহি মুসলিম, রিয়াযুস স্ব-লিহীন-৭)

আর এক শ্রেণীর লোকের হজ্জ্ব করার উদ্দেশ্য হল নামের পিছনে আলহাজ্ব লাগাবে। যদি আলহাজ্ব লাগানোর ইচ্ছায় হজ্জ্ব হয় তবে ছোট শির্কে হবে, এতে কোন সন্ধেহে নাই। কাজেই যারা লোক দেখান হজ্জ করেন। তাদের উচিত বার বার নিজের নিয়তকে সঠিক করে এক মাত্র মহান আল্লাহর সন্ত্বষ্টির জন্য হজ্জ করা।

। মক্কা মদিনা দেখার জন্যঃ

অনেক বিধর্মী পৃথিবীতে আনাচে কানাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা তারা জানা বা দেখার নেষা থেকেই করছে। কেউ তাদের বাধ্য করছে না। অনেক ভ্রমন পাগল মুসলিমও আছে যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দর্শণীয় স্থানে গমন করে জানা বা দেখার জন্য। এমন ভ্রমন পাগল বা সাধারণ যে কোন মুসলিম যদি মনে মনে এই নিয়ত করে যে, পৃথিবীল বিভিন্ন স্থানে তো বহু ভ্রমন করলাম কিন্তু আজও মক্কা মদিন ঘুরে আসতে পারলাম না। আগামি বছর মক্ক মদিনা দেখার জন্য হজ্জ গমন করব। এতে দুটি লাভ হবে প্রথমত মক্কা মনিদা দেখা। আর দ্বিতীয়ত হজ্জ ফরজ ছিল তাও আদায় হয়ে গেল। দেখুন আল্লাহর বান্দার নিয়ত কেমন? তার নিয়তই হল মক্কা মদিনার দেখা সাথে বাড়তি হজ্জ। সে মক্কা মদিনা গিয়েছিল জানা ও দেখান উদ্যেশ্য। যদি সে নিয়ত করত আমি মহান আল্লাহকে রাজি খুসি করার জন্য হজ্জে যাব। তালে তার হজ্জে যাওয়া ইবাদাত হত। কিন্তু তার সমান্য নিয়তের জন্য তার অসামান্য ক্ষতি হল। কাজেই যারা মক্কা মদিয়া দেখার উদ্দেশ্য হজ্জে যাবেন তাদের হজ্জ হবে না।

অর্থের লোভে হজ্জ করাঃ

অনেকের হজ্জ্ব করার উদ্দেশ্য হল ব্যবসা করা। হজ্জ্ব করবে সাথে সাথে স্বর্ন নিয়ে দেশে ফিরবে। এতে হজ্জ্ব ও হল আবার লাভও হল। বেশ তো একই সাথে দু্‌ই কাজ। কাজ দুটিই হল কিন্তু ছোট শির্ক হল নেকি পাবেন না। এসব আলম আল্লাহ প্রত্যাখ্যান করেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি লোকর নিকট ন্যায় পরায়ন সাজার জন্য বা স্বনামধন্য হবার জন্য হজ্জ্ব পারন করল সে শির্ক করল। (মুসনাদে আহম্মদ)।

সমাজ ও লোক চক্ষু ভয়েঃ

আমাদের দেশে অধিকাংশ লোকই সমাজ ও লোক চক্ষু ভয়ে হজ্জ্ব পালন করে। আল্লাহর রহমতে বান্দা যখন হজ্জ্ব করার যোগ্যতা অর্জন করে। অর্থাৎ যখন টাকা পয়সার মালিক হয়, তখন সে কার্পন্য করতে থাকে। মনে মনে ভাবে এত টাকা খরচ করে হজ্জ আদায় করব! পরক্ষণে আবার ভাবে, টাকা পয়সার মালিক হলাম কিন্তু হজ্জ আদায় না করলে সমাজে লোক ভারাপ চোখে দেখবে। সবাই ভাববে আমি কৃপণ। এই সকল ভাবতে ভাবতে এক সময় সমাজ ও লোক চক্ষু ভয়ে, সে অনেকটা বাধ্য হয়েই হজ্জ্বে গমন করে। বলুন এটা কি বিয়া নয়? তার প্রমান, হজ্জ্ব পালন করার পরও তাহার মুখে দাড়ি উঠেনি, সালাতে গর হাজির, অন্যান্য ইবাদাতের কথা না হয় বাদই দিলাম।

৭। তালবিয়া পড়াঃ

তালবিয়া’ শব্দটি ‘লাব্বা’ (لَبَّى) এর ক্রিয়ামূল। আর ‘লাব্বা’ অর্থ হচ্ছে, মুহরিম ব্যক্তি হজ্জ ও ওমরাতে ‘লাব্বাইক’ বলল। ইতোপূর্বে আমরা বলেছি যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ইহরাম বাঁধার সময় বলেছিলেন, ‘লাব্বাইক উমরাতান ওয়া হাজ্জাতান’। ‘লাব্বাইক’ (لَبَّيْكَ) শব্দটি কারো ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য সুন্দর একটি শব্দ। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতিপয় ছাহাবীকে ডেকেছেন এবং তাঁরা ‘লাব্বাইক’ বলে সাড়া দিয়েছেন মর্মে প্রমাণ পাওয়া যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ডাকে তাঁদের কেউ কেউ বলতেন, ‘লাব্বাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! (لَبَّيْكَ يَا رَسُوْلَ الله), আবার কেউ কেউ বলতেন, ‘লাব্বাইকা ওয়া সাদাইক’ (لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ)।

যে ব্যক্তি ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় লাব্বাইক বলবে। আর স্বয়ং মহান আল্লাহ মানুষদেরকে হজ্জ করতে ডেকেছেন। তিনি তাঁর নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কে বলেন,

*وَأَذِّن فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ*

‘আর মানুষের মধ্যে হজ্জের জন্য ঘোষণা দিয়ে দাও। তারা দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার হালকা-পাতলা উটের পিঠে সওয়ার হয়ে তোমার কাছে আসবে। (সুরা হাজ্জ্ব ২২:২৭)

মন্তব্যঃ অতএব, কোন মুসলিম যখন মীক্বাতে এসে ইহরাম বেঁধে ফেলবে, তখন তালবিয়া পড়বে।

ক। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তালবিয়া কেমন ছিল?

সহিহ হাদিসের আলোকে তালবিয়ার বাক্যগুলো হল নিম্ম রূপঃ

১. আবদুল্লাহ ইব্‌নু ‘উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর তালবিয়া নিম্নরূপঃ

*لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ*

(লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্‌নিমাতা লাকা ওয়ালমুল্‌ক লা শারি-কা লাকা)।

অর্থঃ আমি হাযির হে আল্লাহ, আমি হাযির, আমি হাযির; আপনার কোন অংশীদার নেই, আমি হাযির। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও সকল নি’আমত আপনার এবং কর্তৃত্ব আপনারই, আপনার কোন অংশীদার নেই। (সহিহ বুখারি ১৫৪৯ তাওহীদ)

২. উপরের বর্ণিত তালবিয়াই হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তালবিয়া। তবে কখনো কখনো কিছু অতিরিক্ত বলতেন। যেমনঃ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর তালবিয়ায় বলেনঃ

* لَبَّيْكَ إِلَهَ الْحَقِّ لَبَّيْكَ*

(লাব্বাইকা ইলাহাল হাক্কি লাব্বাইক)

আমি হাজির হয়েছি, হে সত্য মাবূদ! আমি হাজির হয়েছি। (ইবনে মাজাহ ২৯২০)

৩. উবায়দুল্লাহ্ ইবন আবদুল্লাহ্ ইবন উমর তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তালবিয়া ছিলঃ

لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ

ইবন উমর (রাঃ) তাতে আরও বাড়িয়ে বলেছেনঃ

لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ فِي يَدَيْكَ وَالرَّغْبَاءُ إِلَيْكَ وَالْعَمَلُ

(সুনান নাসাঈ ২৭৫২ হাদিসের মান সহিহ)

৪. আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তালবিয়া ছিলঃ

لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ

(সুনান নাসাঈ ২৭৫৩ হাদিসের মানসহিহ)

খ। তালবিয়ার ফজিলতঃ

১. সাহল ইবনে সাদ আস-সাইদী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তিই তালবিয়া পাঠ করে, সাথে সাথে তার ডান ও বাম দিকের পাথর, গাছপালা অথবা মাটি, এমনকি দুনিয়ার সর্বশেষ প্রান্ত উভয় দিকের সবকিছু তালবিয়া পাঠ করে। (সুনানে ইবনে মাজাহ ২৯২১)

২. আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, কোন ধরণের হজ্জ সবচেয়ে উত্তম? তিনি বললেনঃ “আল আজ্জু ওয়াচ্ছাজ্জু’’ উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ আর উট কুরবানী দেওয়া। (সুনানে তিরমিজি ৮২৮)

৩. সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যখন কোন মুসলিম তালবিয়া পাঠ করে তখন তার ডান ও বামে পাথর, বৃক্ষরাজি, মাটি সবকিছুই তার সাথে তালবিয়া পাঠ করে। এমনকি পৃথিবীর এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত পর্যন্ত (তালবিয়া পাঠকারীদের দ্বারা) পূর্ণ হয়ে যায়। ( মিশকাত ২৫৫০)।

৪. ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে আরাফাতে ওয়াকূফ কালে অকস্মাৎ সে তার সওয়ারী হতে পড়ে যান। যার ফলে তাঁর ঘাড় মটকে গেল অথবা রাবী বলেন, ঘাড় মটকে দিল। (যাতে তিনি মারা গেলেন)। তখন আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তাঁকে বরই পাতাসহ পানি দিয়ে গোসল দাও এবং দু’ কাপড়ে তাঁকে কাফন দাও; তাঁকে সুগন্ধি লাগাবে না এবং তাঁর মস্তক আবৃত করবে না। কেননা, আল্লাহ্‌ তা’আলা কিয়ামতের দিন তাঁকে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উত্থিত করবেন। (সহিহ বুখারি ১২৬৬)

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “ইহরাম এবং ইহরামের ধারাবাহিক কাজ

Leave a comment