লাইলাতুল কদর এর ফজিলত ও করনীয়

নামকরণ:

লাইলাতুল কদর-এর নামকরণ নিয়ে ‘উলামাগণের মাঝে দুটি মত প্রদিদ্ধ। আরবি শব্দ একটি হল (لیل) ‘লাইলাতুন’ অর্থ যার অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী আর অপরটি হল (القدر‎‎) ‘কদর’ যার অর্থ হল সম্মান, মর্যাদা, মহাসম্মান। এ হিসাবে লাইলাতুল কদর এর অর্থ অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা পবিত্র রজনী। এ রাতের বিরাট মাহাত্ম্য ও অপরিসীম মর্যাদার কারণে এ রাতকে ‘লায়লাতুল কদর’ তথা মহিমান্বিত রাত বলা হয়। গবেষক আবু বকর ওররাক (রহঃ) বলেন, এ রাতকে ‘লায়লাতুল কদর’ বলার কারণ হচ্ছে, এ রাতের পূর্বে আমল না করার কারণে যাদের কোনো সম্মান মর্যাদা, মূল্যায়ন ছিল না তারাও তাওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে এ রাতে সম্মানিত ও মহিমান্বিত হয়ে যান। (তাফসির মারিফুল কোরআন)

আরবি ভাষায় এ ছাড়া কদর অন্য আর একটি অর্থ হলোঃ ভাগ্য, পরিমাণ ও তাকদির নির্ধারণ করা। ভাগ্য অর্থে লাইলাতুল কদর এর অর্থ হবে ভাগ্য রজনী। সংক্ষেপে বলতে গেলে লাইলাতুল কদর এর অর্থ হলোঃ ভাগ্য রজনী। এই অর্থে এ রাতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক, বৃষ্টি ইত্যাদির ফরমান নির্দিষ্ট ফেরেশতাগণকে লিখে দেওয়া হয়। এমনকি এ বছর কে হজ্জ করবে তাও লিখে দেওয়া হয়। হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর বক্তব্য মতে, চার ফেরেশতাকে এসব কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তারা হলেন— ইসরাফিল, মিকাইল, আজরাইল ও জিবরাইল (আঃ)। (কুরতুরি)

একটি ভুল সংশোধনঃ অনেক মুসলিককে বলতে শুনা যায়, সাবান মাসের পনের তারিখ হল ভাগ্য রজনী। তাদের কথার কোন দলীল নেই। কিন্ত লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রাতটি যে ভাগ্য রজনী এ সম্পর্ক কুরআনের ষ্পষ্ট দলীল বিদ্যামান। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,

 إِنَّآ أَنزَلۡنَـٰهُ فِى لَيۡلَةٍ۬ مُّبَـٰرَكَةٍ‌ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ (٣) فِيہَا يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ (٤)

অর্থঃ আমি এটি (কুরআন) এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাযিল করেছি৷ কারণ, আমি মানুষকে সতর্ক করতে চেয়েছিলাম৷ এটা ছিল সেই রাত যে রাতে আমার নির্দেশে প্রতিটি বিষয়ে বিজ্ঞোচিত ফায়সালা দেয়া হয়ে থাকে৷  (সুরা দুখান ৪৪:৩-৪)।

এই আয়াতের আলোকে দেখা যায়, কুরআন যে বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাযিল হয়েছে এবং সেই রাত্রেই ভাগ্য নির্ধারণ হয়। এক কথায় বলা যায়, যে রাতে কুরআন নাজিল হয়েছিল, সে রাতেই ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে থাকে। আর কুরআন নাজিল হয়েছে রমজান মাসে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,

*شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ

অর্থঃ রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। (সুরা বাকারা ২:১৮৫)।

উপরের আয়াতের ঘোষনা হলোঃ রমজান মাসেই কুরআন নাজিল হয়। সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত লাইলাতুল কদর বা ভাগ্য রজনী রমজানের শেষ দশকেই তাকে। ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর, মুজাহিদ, কাতাদা, হাসান বাসারী, সাঈদ ইবনে জুবাইর, ইবনে যায়েদ, আবু সালেক, দাহ্‌হাক এবং আরো অনেক মুফাসসির এ ব্যাপারে একমত যে, এটা রমযানের সেই রাত যাকে “লাইলাতুল কদর” বলা হয়েছে। কারণ, কুরআন মজীদ নিজেই সুস্পষ্ট করে তা বলছে। ইবনের কাসীর বলেনঃ এক শা’বান থেকে অন্য শা’বান পর্যন্ত ভাগ্যের ফায়সালা হওয়া সম্পর্কে উসমান ইবনে মুহাম্মাদ বর্ণিত যে হাদীস ইমাম যুহরী উদ্ধৃত করেছেন তা একটি ‘মুরসাল’’ হাদীস। কুরআনের সুস্পষ্ট উক্তির বিরুদ্ধে এ ধরনের হাদীস পেশ করা যায় না। কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী বলেন, শা’বানের পনের তারিখের রাত সম্পর্কে কোন হাদীসই নির্ভরযোগ্য নয়, না তার ফযীলত সম্পর্কে, না ঐ রাতে ভাগ্যের ফয়সালা হওয়া সম্পর্কে। তাই সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করা উচিত। (আহকামুল কুরআন, তাফহীমূল কুরআন)

তাই বলা যায় এই মহিমান্বিত রাত্রিতে মুসলিমদের সম্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং মানবজাতির ভাগ্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়। তাই মুসলমানদের কাছে এই রাত অত্যন্ত পুণ্যময় ও মহাসম্মানিত হিসেবে পরিগণিত। কুরানের ঘোষণা অনুসারে, আল্লাহ এই রাত্রিকে অনন্য সকল রাত্রির উপর মর্যাদা দিয়েছেন। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন নাজিল হওয়ার কারণে অন্যসব মাস ও দিনের চেয়ে রমজান মাসের ফজিলত বেশী। আর রমজানের রাতগুলোর মধ্যে কোরআন নাজিলের রাত, লাইলাতুল কদর সবচেয়ে তাত্পর্যমণ্ডিত একটি রাত। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন,

إِنَّآ أَنزَلۡنَـٰهُ فِى لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ (١) وَمَآ أَدۡرَٮٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ (٢) لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٌ۬ مِّنۡ أَلۡفِ شَہۡرٍ۬ (٣) 

অর্থঃ আমি একে নাজিল করেছি কদরের রাতে। তুমি কি জান কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। (সূরা কদর : ১-৩।)

এ আয়াতের ব্যাখায় মুফাসসির সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘এ রাতের ইবাদত অন্য হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। (তানবিরুল মিকবাস মিন তাফসিরে ইবনে আব্বাস : ৬৫৪ পৃষ্ঠা।)

তাবেয়ি মুজাহিদ (র.) বলেন, এর ভাবার্থ হলো, ‘এ রাতের ইবাদত, তেলাওয়াত, কিয়াম ও অন্যান্য আমল লাইলাতুল কদর ছাড়া হাজার মাস ইবাদতের চেয়েও উত্তম।’ মুফাসসিগণ এমনই ব্যাখ্যা করেছেন। আর এটিই সঠিক ব্যাখ্যা। (ইবনে কাসির : ১৮ খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা।) 

এই একটি মাত্র রজনীর উপাসনা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর মাহে রমজানে এই মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল কদর মুসলিমদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে বলে তারা বিশ্বাস করে। এই রজনী অনুসন্ধানের জন্য তারা রমজানের শেষ দশকে মসজিদে মসজিদে ইতিকাফ করে।

 

লাইলাতুল কদর এর সময় নির্ধারণঃ

লাইলাতুল কদর এর নির্দিষ্ট কোন রাত কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমানিত নয়। নির্দিষ্ট না করার মাধ্যমে কল্যান নিহীত আছে বলে মহান আল্লাহ নির্দিষ্ট করেন নি। আবার রাতটি জন্য সারা বছর বা পুর রমজান মাসও নির্দিষ্ট করেন নি। হাদিসসমূহের ভাষ্য মতে বুঝা যায়, রমজানের শেষ দশকেই লাইলাতুল কদর নির্দিষ্ট আছে। মাত্র এই দশটি দিন অনুসন্ধান করলেই নিশ্চিতভাবে এই ফজিলতপূর্ন কল্যায়কর রজণী পাওয়া যাবে। এই রমজানের শেষ দশকে মাঝে আবার কোন কোন দিনকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। নিম্ম এমনই কিছু হাদিস তুলে ধরলাম।

১। লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ সাত দিনেঃ

ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কতিপয় সাহাবীকে স্বপ্নযোগে রমযানের শেষের সাত রাতে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়। (এ কথা শুনে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমাকেও তোমাদের স্বপ্নের অনুরূপ দেখানো হয়েছে। (তোমাদের দেখা ও আমার দেখা) শেষ সাত দিনের ক্ষেত্রে মিলে গেছে। অতএব যে ব্যাক্তি এর সন্ধান প্রত্যাশী, সে যেন শেষ সাত রাতে সন্ধান করে। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৮৮ ইঃ ফাঃ)

আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কতিপয় সাহাবীকে স্বপ্নে দেখান হল যে, (রমযানের) শেষ সাত দিনের মধ্যে কদরের রাত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি মনে করি যে, শেষের সাতদিন সম্পর্কে তোমাদের সকলের স্বপ্ন পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতএব যে ব্যাক্তি তা অন্বেষণ করবে, সে যেন রমযানের শেষ সাতদিনের রাতগুলোতে তা অন্বেষণ করে। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৩২ ইঃফাঃ)

আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) সুত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্নিত। তিনি বলেন, (রমযানের) শেষ সাতদিনের রাতগুলোতে লায়লাতুল কদর অন্বেষণ কর। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৩৩ ইঃফাঃ, বুখারী ২০১৫, মুয়াত্ত্বা মালিক ১১৪৪, আহমাদ ৪৪৯৯, মু‘জামুল আওসাত ৩৮৩, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৫৪৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৬৭৫, সহীহ আল জামি‘ ৮৬৭)।

উকবা ইবনু হুরায়স (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবনু উমর (রাঃ) কে বলতে শুনেছি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা রমযানের শেষ দশদিনে কদরের রাত অনুসন্ধান কর। তোমাদের কেউ যদি দূর্বল অথবা অপারগ হয়ে পড়ে, তবে সে যেন শেষ সাত রাতে অলসতা না করে। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৩৬ ইঃফাঃ)

২। লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশকেঃ

‘আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেনঃ তোমরা শেষ দশকে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৯৩ ইঃ ফাঃ)

সালিম ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তার পিতা [আবদুল্লাহ (রাঃ)] বলেছেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে লায়লাতুল কদর সম্পর্কে বলতে শুনেছি, তোমাদের কতিপয় লোককে দেখান হল যে, তা রমযানের প্রথম সাতদিনের মধ্যে, আবার কতিপয় লোককে দেখান হয়েছে যে, তা শেষ সাতদিনের মধ্যে। অতএব (রমযানের) শেষ দশকেরে মধ্যে তা অন্বেষণ কর।(সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৩৫ ইঃফাঃ)

জাবালা (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবনু উমর (রাঃ) কে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর থেকে বর্ণনা করতে শুনেছি যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যাক্তি কদরের রাত অনুসন্ধান করতে চায় সে যেন (রমযানের) শেষ দশকে তা অনুসন্ধান করে।(সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৩৭ ইঃফাঃ)

৩। লাইলাতুল কদর রমজানের ২১ তারিখেঃ

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসের প্রথম দশকে ইতিকাফ করলেন। এরপর তিনি মাঝের দশকেও একটি তাঁবুর মধ্যে ইতিকাফ করলেন এবং তাবুর দরজায় একটি চাটাই ঝূলান ছিল। রাবী বলেন, তিনি নিজ হাতে চাটাই ধরে তা তাঁবুর কোণে রাখলেন এরপর নিজের মাথা বাইরে এনে লোকদের সাথে কথা বললেন এবং তারাও তাঁর নিকট এগিয়ে এল। তিনি বললেন, এই রাতের অনুসন্ধানকল্পে আমি (রমযানের) প্রথম দশকে ইতিকাফ করলাম। অতঃপর মাঝের দশকে ইতিকাফ করলাম। এরপর আমার নিকট একজন আগন্তুক (ফিরিশতা) এসে আমাকে বলল, লায়লাতুল কদর শেষ দশকে নিহিত আছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি ইতিকাফ করতে চায়, সে যেন ইতিকাফ করে।

লোকেরা তাঁর সঙ্গে (শেষ দশকে) ইতিকাফ করল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বললেন, স্বপ্নে আমাকে তা কোন এক বেজোড় রাতে দেখনো হয়েছে এবং আমি যেন সেই রাতে কাদা ও পানির মধ্যে ফজরের সিজদা করছি। (রাবী বলেন) তিনি ২১তম রাতের ভোরে উপনীত হয়ে ফজরের সালাতে দাঁড়ালেন এবং আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হল। ফলে ছাদ থেকে মসজিদে পানি বর্ষিত হল এবং আমি কাদা ও পানি দেখতে পেলাম। তিনি ফজরের সালাত শেষে যখন বের হয়ে এলেন তখন তাঁর কপাল ও নাকের ডগা সিক্ত ও কর্দমাক্ত ছিল। আর তা ছিল রমযানের শেষ দশকের প্রথম (বা ২১তম) রাত।(সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৪২ ইঃফাঃ)

৪। লাইলাতুল কদর রমজানের ২৩ তারিখেঃ

আবদুল্লাহ ইবনু উনায়স (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাকে কদরের রাত দেখান হয়েছিল। অতঃপর তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। আমাকে ঐ রাতের ভোর সম্পর্কে স্বপ্নে আরও দেখান হয়েছে যে, আমি পানি ও কাদার মধ্যে সিজদা করছি। রাবী বলেন, অতএব ২৩তম রাতে বৃষ্টি হল এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সাথে (ফজরের) সালাত আদায় করে যখন ফিরলেন, তখন আমরা তাঁর কপাল ও নাকের ডগায় কাদা ও পানির চিহ্ন দেখতে পেলাম। রাবী বলেন, আবদুল্লাহ ইবনু উনায়স (রাঃ) বলতেন, তা ছিল ২৩তম। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৪৬ ইঃফাঃ)

‘আবদুল্লাহ ইবনু উনায়স (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! গ্রামে-গঞ্জে আমার বাড়ী। ওখানেই আমি বসবাস করি। আলহামদুলিল্লাহ্‌ ওখানেই সলাতও আদায় করি। অতএব রমাযানের একটি নির্দিষ্ট রাতের কথা বলে দিন, (যে রাতে আমি সে রাত খুঁজতে) আপনার এ মাসজিদে আসতে পারি। এ কথা শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আচ্ছা তুমি তবে (রমাযান (রমজান) মাসের) ২৩ তারিখ দিবাগত রাতে এসো। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর কেউ তাঁর ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, আপনার পিতা তখন কি করতেন? ছেলে উত্তরে বলল, তিনি ‘আসরের সলাত আদায়ের সময় মাসজিদে প্রবেশ করতেন ফজরের সলাত আদায়ের আগে (প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া) কোন কাজে বের হতেন না। ফজরের সলাত শেষে মাসজিদের দরজায় নিজের বাহনটি প্রস্তুত পেতেন। এরপর বাহনটিতে বসতেন এবং নিজের গ্রামে চলে যেতেন। ( হাদিসের মান হাসান সহিহ, রিয়াদুস সালেহীণ ২০৯৪, আবূ দাঊদ ১৩৮০, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৫৩৮, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২২০০)।

৫। লাইলাতুল কদর রমজানের ২৭ তারিখেঃ

যির ইবনু হুবায়শ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) কে বললাম, আপনার ভাই আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, যে ব্যাক্তি গোটা বছর রাত জাগরণ করে, সে কদরের রাতের সন্ধান পাবে। তিনি (উবাই) বললেন, আল্লাহ তাকে রহম করুন, এর দ্বারা তিনি একথা বুঝাতে চাচ্ছেন যে লোকেরা যেন কেবল একটি রাতের উপর ভরসা করে বসে না থাকে। অথচ তিনি অবশ্যই জানেন যে, তা রমযনি মাসে শেষের দশ দিনের মধ্যে এবং ২৭তম রজনী। অতঃপর তিনি শপথ করে বললেন, তা ২৭তম রজনী। আমি (যির) বললাম, হে আবূল মুনযির! আপনি কিসের ভিত্তিতে তা বলছেন? তিনি বললেন, বিভিন্ন আলামত ও নিদর্শনের ভিত্তিতে যে সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের অবহিত করেছেন। যেমন, সেদিন সূর্য উঠবে কিন্তু তার আলোতে তেজ থাকবে না। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৪৮ ইঃফাঃ)

উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) কদরের রাত সম্পর্কে বলেন, আল্লাহর শপথ! কদরের রাত সম্পর্কে আমি খুব ভাল করেই জানি। শু’বা বলেন, আমার জানামতে তা হচ্ছে সেই রাত যে রাতে জেগে ইবাদত করার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তা হচ্ছে রমযানের ২৭তম রজনী। “তা হচ্ছে সেই রাত যে রাতে আমাদেরকে ইবাদত করার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন।” এই বাক্যটুকু সম্পর্কে শু’বা সন্দেহে পতিত হয়েছেন এবং বলেছেন, আমার এক বন্ধু তার শায়খের সুত্রে আমার নিকট ঐ কথা বর্ণনা করেছেন। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৪৯ ইঃফাঃ)

৬। লাইলাতুল কদর রমজানের বিজোড় তারিখেঃ

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা তা (লাইলাতুল কদর) রমযানের শেষ দশকে তালাশ কর। লাইলাতুল কদর (শেষ দিক হতে গনণায়) নবম, সপ্তম বা পঞ্চম রাত অবশিষ্ট থাকে। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৯১ ইঃ ফাঃ)

সালিম (রহঃ) থেকে তার পিতার সুত্রে বর্ণিত। তিনি (পিতা) বলেন, এক ব্যাক্তি (রমযানের) ২৭ তম রাতে লায়লাতুল কদর দেখতে পেল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমাকেও তোমাদের মত স্বপ্ন দেখান হয়েছে যে, তা রমযানের শেষ দশকে নিহিত আছে। অতএব এর বেজোড় রাতগুলোতে তা অনুসন্ধান কর। কর।

আবূ সাঈদ খূদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (রমযানের) মাঝের দশকে ইতিকাফ করেন। অতঃপর ২০তম দিন অতিবাহিত হওয়ার পর এবং ২১তম দিনের সূচনাতে তিনি নিজ বাসস্থানে ফিরে আসেন এবং তাঁর সঙ্গে যারা ইতিকাফ করেন, তারাও নিজ নিজ আবাসে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর একবার রমযান মাসের মাঝের দশকে ইতিকাফ করলেন। যে রাতে তাঁর ইতিকাফ হতে ফিরে আসার কথা, সে রাতে (পূনরায়) ইতিকাফ আরম্ভ করলেন ও লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন এবং তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন।

এরপর তিনি বললেন, আমি সাধারণত এই (মধ্যম) দশকে ইতিকাফ করতাম। এরপর শেষ দশকেও ইতিকাফ করা আমার কাছে সমীচীন মনে হল। অতএব যে ব্যাক্তি আমার সাথে ইতিকাফ করতে চায়, সে যেন নিজ ইতিকাফের স্থানে অবস্থান করে। আমি এই (কদরের) রাত স্বপ্নে দেখেছিলাম কিন্তু আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোত তা অনুসন্ধান কর। আমি স্বপ্নে নিজেকে পানি ও কাদার মধ্যে সিজদা করতে দেখেছি।

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, ২১তম রাতে আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়। তিনি যখন ফজরের সালাত থেকে ফিরলেন, তখন আমি তাঁর মুখমন্ডল কাদা ও পানিতে সিক্ত দেখলাম। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৩৭ ইঃফাঃ, (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৯১ ইঃ ফাঃ, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২২১৯, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৫৬৭, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩৬৮৪)।

আবূ সালামা (রাঃ) বলেন, আমরা পরস্পর কদরের রাত সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। এরপর আমি আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) এর নিকট এলাম এবং তিনি ছিলেন আমার বন্ধু। আমি তাকে বললাম, আপনি কি আমাদের সাথে খেজুর বাগানে যাবেন না? তিনি একটি চাঁদর পরিহিত অবস্থায় বের হলেন। আমি তাকে বললাম, আপনি কি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে লায়লাতূল কদর সম্পর্কে কিছু বলতে শুনেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমরা রমযান মাসের মাঝের দশকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সংগে ইতিকাফ করলাম। আমরা ২১তম দিন ভোরে (ইতিকাফ থেকে) বের হলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বললেন, আমাকে স্বপ্নযোগে কদরের রাত দেখান হয়েছিল, কিন্তু আমি তা ভুলে গেছি অথবা আমাকে তা ভূলানো হয়েছে। তোমরা শেষ দশ দিনের প্রতিটি বেজোড় রাতে তা অম্বেষণ কর। আমি আরও দেখেছি যে, আমি কাদা ও পানির মধ্যে সিজদা করছি। অতএব যে ব্যাক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে ইতিকাফ করেছে, সে যেন পূনরায় তার ইতিকাফে ফিরে যায়।

আবূ সাঈদ (রাঃ) বলেন, আমরা (ইতিকাফের অবস্থায়) ফিরে গেলাম। আমরা আকাশে কোন মেঘ দেখতে পাইনি। ইতিমধ্যে একখণ্ড মেঘ এল এবং আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হল, এমন কি মসজিদের ছাদ হতে পানি প্রবাহিত হল। মসজিদের ছাদ খেজুর ডাটার ছাউনিযুক্ত ছিল। ফজরের সালাত আদায় করা হল এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কাদা ও পানির মধ্যে সিজদা দিতে দেখলাম, এমনকি আমি তাঁর কপালে কাদার চিহ্ন দেখতে পেলাম। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৩৭ ইঃফাঃ)

লাইলাতুল কদরের দুটি লক্ষনঃ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে কদরের রাত সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কে সেই (রাত) স্মরণ রাখবে, যখন চাঁদ উদিত হবে থালার একটি টুকরার ন্যায়। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৫০ ইঃফাঃ)

যির ইবনু হুবায়শ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) কে বললাম, আপনার ভাই আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, যে ব্যাক্তি গোটা বছর রাত জাগরণ করে, সে কদরের রাতের সন্ধান পাবে। তিনি (উবাই) বললেন, আল্লাহ তাকে রহম করুন, এর দ্বারা তিনি একথা বুঝাতে চাচ্ছেন যে লোকেরা যেন কেবল একটি রাতের উপর ভরসা করে বসে না থাকে। অথচ তিনি অবশ্যই জানেন যে, তা রমযনি মাসে শেষের দশ দিনের মধ্যে এবং ২৭তম রজনী। অতঃপর তিনি শপথ করে বললেন, তা ২৭তম রজনী। আমি (যির) বললাম, হে আবূল মুনযির! আপনি কিসের ভিত্তিতে তা বলছেন? তিনি বললেন, বিভিন্ন আলামত ও নিদর্শনের ভিত্তিতে যে সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের অবহিত করেছেন। যেমন, সেদিন সূর্য উঠবে কিন্তু তার আলোতে তেজ থাকবে না। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ২৬৪৮ ইঃফাঃ)

মন্তব্যঃ উপরের হাদিসগুলোর আলোক বুঝা যায় লাইলাতুল কদর নির্ধারিত নয়। তবে এ কথা ষ্পষ্ট জোর দিয়ে বলা যায় যে, রমজানের শেষ দশকেই লাইলাতুল কদর নির্ধারিত। একদল মুজতাহীদ আলেম জোর দিয়ে বলেছেন, নিশ্চয়ই লাইলাতুল কদর রমাজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে হতে পারে। তরে নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে প্রতি বছর একই তারিখেই হবে। কোন বছর তা ২১তম রাতে হতে পারে, আবার কখনো ২৫শে কখনো ২৭শে এবং কখনো ২৯শে রাতে হতে পারে।

 

রাত গোপন করার হিকমাতঃ

‘উবাদা ইবনুস সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে লাইলাতুল কদরের (নির্দিষ্ট তারিখের) অবহিত করার জন্য বের হয়েছিলেন। তখন দু’জন মুসলমান ঝগড়া করছিল। তা দেখে তিনি বললেনঃ আমি তোমাদেরকে লাইলাতুল কদরের সংবাদ দিবার জন্য বের হয়েছিলাম, তখন অমুক অমুক ঝগড়া করছিল, ফলে তার (নির্দিষ্ট তারিখের) পরিচয় হারিয়ে যায়। সম্ভবতঃ এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যান নিহিত রয়েছে। তোমরা নবম, সপ্তম ও পঞ্চম রাতে তা তালাশ কর। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৯১ ইঃ ফাঃ)

মন্তব্যঃ লাইলাতুল কদরের রাতকে গোপন করার হিকমাত প্রসঙ্গে ‘উলামাগণ বলেন, এটি গোপন রাখা হয়েছে এ কারণে যে, যাতে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধানের জন্য সকলে প্রচেষ্টা করা যায়। এর বিপরীতে যদি তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হত তাহলে মানুষ শুধু ওই নির্ধারিত রাতটির মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকত। (আল্লাহ ভালো জানেন)

লাইলাতুল কদর ফজিলতঃ

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। এই রাতে কুরআন অবতীর্ণ আরম্ভ করেছেন এবং তা একসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছিল এ রাতেই। অথবা কুরআন ‘লাওহে মাহ্ফূয’ হতে দুনিয়ার আসমানে অবস্থিত ‘বাইতুল ইযযাহ’তে এক দফায় অবতীর্ণ করেছেন। আর সেখান থেকে প্রয়োজন মোতাবেক নবী (সাঃ) এর উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তা ২৩ বছরে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। জ্ঞাতব্য যে, ‘লাইলাতুল কদর’ রমযান মাসেই হয়ে থাকে, অন্য কোন মাসে নয়। এর প্রমাণ, মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘‘রমযান মাস; যাতে কুরআনকে অবতীর্ণ করা হয়েছে, (২:১৮৫)। এ রাতের ফজিলত ও মর্যাদার বিষয়ে মহান আল্লাহ ‘সূরাতুল কদর’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরাই অবতীর্ণ করে দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় মাহাত্ম্য ও মর্যাদা আর কি হতে পারে? মহান আল্লাহ নিজেই এ রাতের মহিমা বর্ণনায় ইরশাদ করেছেন, কদরের রাত এক হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ (৯৭:০৩)। অর্থাৎ  কারও একনাগাড়ে এক হাজার মাস বা ৮৩ বছর ৪ মাস পর্যন্ত ইবাদত করার যে ফজিলত বা সওয়াব পাওয়া যায় তা এ এক রাতের ইবাদতের দ্বারাই মহান আল্লাহ প্রদান করে থাকেন। সুবহানাল্লাহ। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম শরিফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে— ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে (ইমানসহ) এবং সওয়াব প্রাপ্তির প্রত্যাশায় এ রাতে জেগে ইবাদত বন্দেগি করবে, তার পূর্ববর্তী জীবনের সব পাপ মোচন করে দেওয়া হবে।

সূরা কদরের শানে নুজুল সম্পর্কে ইবনে কাসির রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আলী ইবনে উরওয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বনি ইসরাইলের চারজন আবেদ সম্পর্কে বলছিলেন, তারা আশি বছর ধরে অনবরত আল্লাহর ইবাদত করছিল। এর মধ্যে মুহূর্ত সময়ের জন্যও ইবাদত থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হননি। বিখ্যাত এ চারজন আবেদ হলো আল্লাহর নবী জাকারিয়া আলাইহিস সালাম, আইউব আলাইহিস সালাম, হাজকিল ইবনে আজূজ আলাইহিস সালাম, এবং ইউশা ইবনে নূহ আলাইহিস সালাম। এমনটি শুনে সাহাবিরা (রা.) রীতিমতো অবাক হলেন। এ সময় জিবরাইল আলাইহিস সালাম, এসে বললেন, ‘হে মোহাম্মদ (সাঃ)! আপনার উম্মতরা এ কথা শুনে অবাক হচ্ছে? তাদের জন্য আল্লাহতায়ালা এর চেয়ে উত্তম কিছু রেখেছেন। এরপর সূরা কদর পাঠ করা হয়। (ইবনে কাসরি : ১৮ খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা।)

সুরা ক্বদরে মহান আল্লাহ এরশাদ করেনঃ

إِنَّآ أَنزَلۡنَـٰهُ فِى لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ (١) وَمَآ أَدۡرَٮٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ (٢) لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٌ۬ مِّنۡ أَلۡفِ شَہۡرٍ۬ (٣) تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَـٰٓٮِٕكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيہَا بِإِذۡنِ رَبِّہِم مِّن كُلِّ أَمۡرٍ۬ (٤) سَلَـٰمٌ هِىَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ (٥)

অর্থঃ আমি একে নাযিল করেছি শবে-কদরে। শবে-কদর সমন্ধে আপনি কি জানেন? শবে-কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। (সুরা ক্বদর ৯৭:১-৫)।

এই সুরার আলোকে জানা যায় এ রাতে ফিরিশতাগণ ঈমানদার ব্যক্তিদেরকে সালাম পেশ করেন। কিংবা ফিরিশতাগণ আপোসে এক অপরকে সালাম দিয়ে থাকেন। এতে কোন প্রকার অমঙ্গল নেই। এ রাত শুধুই ‘শান্তিময়’ যার ফলে মুমিন এই রাতে শয়তানের অনিষ্ট থেকে নিরাপদে থাকে।

লাইলাতুল কদরের মর্যাদা সম্পর্কে অনেক সহি হাদিস রয়েছে। যেমনঃ

ক। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রমজান মাস এলে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, ‘হে জনমণ্ডলী! তোমাদের কাছে মহিমান্বিত রমজান এসে পড়েছে। এ মাস খুবই বরকতময়। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ মাসে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়, সে প্রকৃতপক্ষেই হতভাগ্য। (মুসনাদে আহমাদ – ৭১০৮; সুনানে নাসায়ি – ২১০৬।)

খ। আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি রমযানে ঈমানের সাথে ও সাওয়াব লাভের আশায় সিয়াম পালন করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয় এবং যে ব্যাক্তি ঈমানের সাথে, সাওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়। সুলায়মান ইবনু কাসীর (রহঃ) যুহরী (রহঃ) থেকে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৮৭ ইঃ ফাঃ)

গ। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রমাযান (রমজান) মাস এলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, রমাযান (রমজান) মাস তোমাদের মাঝে উপস্থিত। এ মাসে রয়েছে এমন এক রাত, যা হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের (কল্যাণ হতে) বঞ্চিত রয়েছে। সে এর সকল কল্যাণ হতেই বঞ্চিত। শুধু হতভাগ্যরাই এ রাতের কল্যাণ লাভ হতে বঞ্চিত থাকে। (হাদিসের মান হাসান, মিশকাত -১৯৬৪, ইবনু মাজাহ ১৬৪৪, সহীহ আত্ তারগীব ১৪২৯, আহমাদ ৬৬২৬, সহীহ আল জামি‘ ৩৮৮২, হাকিম ২০৩৬, মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৮৮। তবে ইমাম আহমাদ-এর সানাদটি দুর্বল। যেহেতু তাতে ইবনু লাহ্ই‘আহ্ রয়েছে)।

 

কদরের আমলঃ

 লাইলাতুল কদর এই উম্মতের জন্য বড় নেয়ামত। মহান আল্লাহর অশেষ নেয়ামত মধ্যে এটি একটি বড় নেয়ামত। এই নেয়ামতের হক হল, আল্লাহ প্রদত্ত বিধান মোতাবেগ তার ইবাদাত তার সন্ত্বষ্টি অর্জন করা। আমাদের প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাই এই রাতের সন্দানে রমজানের শেষ দশকে ইবাদতের জন্য কোমর বেধে আমল করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযানে শেষ দশকে যত বেশি পরিশ্রম করতেন অন্য কখনো করতেন না।  যেমনঃ

আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রমযানের শেষ দশক আসত তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশী বেশী ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্রে জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। (সহিহ বুখারী হাদিস নম্বর ১৮৯৭ ইঃ ফাঃ, মুসলিম ১১৭৪, সহীহ আল জামি‘ ৪৭১৩, আবূ দাঊদ ১৩৭৬, নাসায়ী ১৬৩৯, ইবনু মাজাহ ১৭৬৮, আহমাদ ২৪১৩১, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ২২১৪, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮৪৬০, ইবনু হিব্বান ৩৪৩৭।)

আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযানের শেষ দশকে (ইবাদত-বন্দেগীতে) যে পরিমাণ পরিশ্রম করতেন অন্য কখনো করতেন না। (সহিহ মুসলীম)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখান পথ ধরে আমরাও রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধানের নিমিত্তে প্রতি রাতে নিম্মের  ইবাদতগুলোর মাধ্যমে রাত কাটাতে পারি, যাতে লাইলাতুল কদর কোনভাবেই মিস না হয়। ইবাতদগুলি হলঃ

১। শেষ দশকে ইতিকাফ করা

২। তারাবিহ সালাত আদায় করা

৩। তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করা

৪। নফল সালাত আদায় করা

৫। কুরআন বুঝে তিলওয়াত করা

৬। তাজবিহ তাহলীল পড়া

৭। ইতিকাফ করা সম্ভব না হলেও মসজিদে রাত কাটানঃ

৮।  ফরয নামায সমূহ ঠিক সময়ে জামাআ’তের সাথে আদায় করা। 

৯। সাধ্যমত আল্লাহর রাস্তায় কিছু দান-সাদকা করা।

১০। পরিবার ও প্রতিবেশীদের এ রাত সম্পর্কে সচেতন করা

১১। এই সকল আমলের মাঝে মাঝে দুয়া করা

১। শেষ দশকে ইতিকাফ করাঃ

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসের প্রথম দশকে ইতিকাফ করলেন। এরপর তিনি মাঝের দশকেও একটি তাঁবুর মধ্যে ইতিকাফ করলেন এবং তাবুর দরজায় একটি চাটাই ঝূলান ছিল। রাবী বলেন, তিনি নিজ হাতে চাটাই ধরে তা তাঁবুর কোণে রাখলেন এরপর নিজের মাথা বাইরে এনে লোকদের সাথে কথা বললেন এবং তারাও তাঁর নিকট এগিয়ে এল। তিনি বললেন, এই রাতের অনুসন্ধানকল্পে আমি (রমযানের) প্রথম দশকে ইতিকাফ করলাম। অতঃপর মাঝের দশকে ইতিকাফ করলাম। এরপর আমার নিকট একজন আগন্তুক (ফিরিশতা) এসে আমাকে বলল, লায়লাতুল কদর শেষ দশকে নিহিত আছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যাক্তি ইতিকাফ করতে চায়, সে যেন ইতিকাফ করে।

লোকেরা তাঁর সঙ্গে (শেষ দশকে) ইতিকাফ করল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বললেন, স্বপ্নে আমাকে তা কোন এক বেজোড় রাতে দেখনো হয়েছে এবং আমি যেন সেই রাতে কাদা ও পানির মধ্যে ফজরের সিজদা করছি। (রাবী বলেন) তিনি ২১তম রাতের ভোরে উপনীত হয়ে ফজরের সালাতে দাঁড়ালেন এবং আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হল। ফলে ছাদ থেকে মসজিদে পানি বর্ষিত হল এবং আমি কাদা ও পানি দেখতে পেলাম। তিনি ফজরের সালাত শেষে যখন বের হয়ে এলেন তখন তাঁর কপাল ও নাকের ডগা সিক্ত ও কর্দমাক্ত ছিল। আর তা ছিল রমযানের শেষ দশকের প্রথম (বা ২১তম) রাত। (সহিহ মুসলীম হাদিস নম্বর ২৬৪২ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

মন্তব্যঃ লাইলাতুল কদর অনুসন্ধানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে ইতকাফ করছেন। কাজেই সময় ও সুযোগ হলে আমাদের প্রথম কাজই হবে রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধানে মসজিদে ইতিকাফ করা।

২। তারাবিহ সালাত আদায় করাঃ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রমযান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যাক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় কিয়ামে রমযান অর্থাৎ তারাবীহর সালাত আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে। (সহিহ বুখারি হাদিস নম্বর ১৮৮২ ইসলামি ফাউন্ডেশন)।

মন্তব্যঃ কাজেই লাইলাতুল কদর এর প্রধান আমল হল তারাবিহ সালাত আদায় করা। কোন অবস্থায় এই সালাত যেন বাদ না পড়ে। ইফতারি করার পর পর সামান্য বিশ্রাম নিয়েই এই সালাত আদায়ের উদ্দেশ্য মসজিদে গমন করতে হবে।

৩। তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করাঃ

তারাবীহ সালাতের রাকাতের সংখ্যা নিয়ে যেমন মতভেদ আছে ঠিক তেমনি তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ সালাত নিয়েও মহভেদ আছে। কেউ বলে দুটি সালাত একই আবার কেউ বরে দুটি সালাত ভিন্ন।

মহান আল্লাহ নফলের (তাহাজ্জুদ) কোন সীমা নির্ধারণ করে নাই। ঠিক তেমনি তারাবীহ এর সীমা নির্ধারণ করে দিলে বা ফরজ করে দিলে উম্মত আদায় করতে পারত না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশঙ্কা করে ছিল যে, উম্মতের মাঝে এই সালাতের সীমা নির্ধারণ দিলে কষ্ট হবে। কাজেই উম্মার ঐক্যের স্বার্থ যে সমাজে বিশ রাকাত চালু আছে সেখানে বিশ পড়ে, আর সে সমাজে আট রাকাত চালু আছে সেখানে আট পড়ে একটু বিশ্রম নিয়ে তাহাজ্জুদ সালাত দাড়াই যেন আমার কদর রাত আমল বিহীন অতিবাহিত না হয়।  

৪। নফল সালাত আদায় করাঃ

সময় সুযোগ হলে মাগরিবের পর কিছু নফল সালাত আদয় করা যায়। কারন সূর্য অন্ত যাওয়ার সাথে সাথেই কদরের রাত্রি শুরু হয়। এই রাতের প্রতিটি মুহুর্তই খুব দামি। কাজেই এই রাতে হয় বিশ্রাসের জন্য ঘুমে থাকবে, না হয় ইবাদতের মাধ্যে থাকবে।

৫। কুরআন বুঝে তিলওয়াত করাঃ

আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ ٱلَّذِينَ يَتۡلُونَ كِتَـٰبَ ٱللَّهِ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنفَقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَـٰهُمۡ سِرًّ۬ا وَعَلَانِيَةً۬ يَرۡجُونَ تِجَـٰرَةً۬ لَّن تَبُورَ (٢٩) لِيُوَفِّيَهُمۡ أُجُورَهُمۡ وَيَزِيدَهُم مِّن فَضۡلِهِۚۦۤ إِنَّهُ ۥ غَفُورٌ۬ شَڪُورٌ۬ (٣٠) 

অর্থঃ যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরো অধিক দান করবেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান। সুরা ফাতির ৩৫:২৯-৩০)।

মন্তব্যঃ লাইলাতুল কদরের রাতে প্রতিটি মুহুর্তে ইবাদাতের মাধ্যমে অতিবাহিত করাই হল আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। যতগুলো নফল ইবাদাত আছে তার মধ্য কুরআন তিলওয়াত হল সর্বত্তোম। মহান আল্লাহ নিজে কুরআনে বলছেন, আল্লাহর কিতাব পাঠকারী কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এবং নিজ অনুগ্রহে তিনি কুরআন পাঠকারীকে অধিক দান করবেন। কাজেই এই রাত্রে যেন কুরআন হাত ছাড়া না হয়।

৬। তাজবিহ তাহলীল পড়াঃ

একাধারে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা কার পক্ষ সম্বব নয়। তাই প্রতি চার রাকাত পর পর বিশ্রাম নিতে হয়। এই বিশ্রামের মুহূর্তে অন্তর ও ঠোট মহান আল্লাহর স্মরনে কাটাতে হবে। এই তজবিহ তাহলীলের শব্দ ও বাক্য সমূহকে যিকর বলে, যার মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করা হয়। যেমন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, “আল-হামদুল্লিল্লাহ” “সুবহানাল্লাহ”, “আল্লাহু আকবার” “আস্তাগ ফিরুল্লাহ”, “লা হাওলা ওয়ালা কুউআতা ইল্লাবিল্লাহ”। ইত্যাদি।

৭। ইতিকাফ করা সম্ভব না হলেও মসজিদে রাত কাটানঃ

রমজানে মসজিদে ইতিকাফ করা খুবই ফজিলতের কাজ। কিন্তু সময় ও সুযোগের অভাবে অনেকে এই ফজিলত পূর্ণ ইবাদাত করতে পারে না। যারা শেষ দশকে ইতকাফ করতে পারে না, তারা ইচ্ছা করলে  এই রাতের সন্ধানে মসজিদে রাত কাটাতে পারে। দিনে বেলায় আয় রোজগারের জন্য সময় ব্যয় করে অথবা চাকুরীজীবিগন অফিসের কাজ শেষ করে, বিকালে ইফতারী নিয়ে মসজিদে গিয়ে অবস্থান করা। ফজরের পর সূর্য উঠার পর ইশরাক আদায় করে ঘরে ফিরে আসা। এভাবে শেষ দশকে আমল করলে লাইলাতুল কদর মিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা কারন এই মহিমান্বিত সময় রাতেই হয়ে থাকে। তাই শিরোনামের সাথে তাল মিলিয়ে বলা যায়, ইতিকাফ করা সম্ভব না হলেও মসজিদে রাত কাটান।

৮।  ফরয নামায সমূহ ঠিক সময়ে জামাআ’তের সাথে আদায় করাঃ

সারা জীবনের নফল সালাত এক ওয়াক্ত ফরজের সমান হতে পারে না। কাজেই এই রাতের নফলের প্রস্তিতে যেন কোন অবস্তায় আমার ফরজ আমলের কমতি না হয়। যথাযথ ভাবে ফরজ আদায় করার পর যতটুকু সম্বব ঠিক ততটুকু নফল ইবাদতে মসগুল হওয়া। সুন্নতে মুআক্কাদা, তাহিয়্যাতুল মসজিদ সহ অন্যান্য মাসনূন সালাত আদায় করা। তাই মাগরিব, ইশা এবং ফজরের সালাত জামাতে আদায় করি। সারারাত নফল সালাত আদায় করে রাতের শেষ দিকে ঘুমের ঘরে ফজরের জামাত ছুটে গেলে আমার নফলের আর কোন দাম থাকলো না।

৯। সাধ্যমত আল্লাহর রাস্তায় কিছু দান-সাদকা করাঃ

এই রাতের সব প্রকারের আমলই করা যায়। যে কোন আমলই এই রাতে উত্তম। দান সদকা করা যেহেতু অন্যতম একটা নেক আমল, তাই এই রাতে গুনাহ মাপের নিয়তে কিছু দান সদকা করা যায়। নিজের পক্ষ থেকে মৃত মাতা পিতার পক্ষ থেকেও দান করা যায়।  যেমনঃ  মহান আল্লাহ বলেন,

وَأَنفِقُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ وَلاَ تُلْقُواْ بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوَاْ إِنَّ اللّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ

অর্থঃ আর ব্যয় কর আল্লাহর পথে, তবে নিজের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন করো না। আর মানুষের প্রতি অনুগ্রহ কর। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদেরকে ভালবাসেন। (সুরা বাকারা ২:১৯৫)। ]

আল্লাহতায়ালা আরও বলেনঃ

إِن تُبْدُواْ الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِن تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاء فَهُوَ خَيْرٌ لُّكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنكُم مِّن سَيِّئَاتِكُمْ وَاللّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতইনা উত্তম। আর যদি খয়রাত গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্যে আরও উত্তম। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের কিছু গোনাহ দূর করে দিবেন। আল্লাহ তোমাদের কাজ কর্মের খুব খবর রাখেন। (সুরা বাকারা ২:২৭১)। ]

দান সদকার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘খেজুরের একটি টুকরা দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা কর।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)।

হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘দান সম্পদ কমায় না, দান দ্বারা আল্লাহপাক বান্দার সম্মান বৃদ্ধি ছাড়া কমায় না। কেউ আল্লাহর ওয়াস্তে বিনয় প্রকাশ করলে আল্লাহতায়ালা তাকে বড় করেন (সহিহ মুসলিম)।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “দান-ছাদকা গুনাহ মিটিয়ে ফেলে যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে।” (সহীহুল জামে/৫১৩৬)

১০। পরিবার ও প্রতিবেশীদের এ রাত সম্পর্কে সচেতন করাঃ

এই তারটি যেহেতু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তাই এই সৌভাগ্যবান রাতে যেমন নিজে সৌভাগ্য অর্জণ করতে হতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে অন্যদেরও এ সম্পর্কে সচেতন করে সৌভাগ্য লাভের চেষ্টা করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا قُوْا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيْكُمْ نَاراً وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ

অর্থঃ হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও স্বীয় পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) হ’তে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।  (তাহরীম ৬৬:৬)।

কাজেই গুনাহ মাপের রজনীতে নিজের পাশাপাশি পরিবারের সকলেও সচেতন করতে হবে, যাতে তারাও গুনাহ পাপ করে নিতে পার।

পরিবারের পাশাপাশি যদি প্রতিবেশীদেরকেও এ রাত সম্পর্কে সচেতন করতে পারি তবে তারাও সৌভাগ্য লাভ করতে পারবে। তারা আমার চেষ্টা যদি সচেতন হয়ে এ রাতের সৌভাগ্য লাভ করে তবে আমিও তাদের সওয়াবের একটা অংশ পাব। তাই নিজের ও পরিবারের সকলের মঙ্গলের জন্য সকলকে এ রাত সম্পর্কে সচেতন করি।


১১। এই সকল আমলের মাঝে মাঝে দুয়া করাঃ

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহ আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি যদি জানতে পারি যে, কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তাহলে তখন কোন দুয়াটি পাঠ করব? তিনি বললেন, তুমি বলঃ اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّى

(আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল্ আফওয়া ফা’ফু আন্নী)। (অর্থ) “হে আল্লাহ, আপনি মহানুভব ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন। অতঃএব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।” (আহমদ, ইবনু মাজাহ, আর ইমাম তিরমিযী এটিকে সহীহ বলেছেন, তিরমিযী ৩৫১৩, ইবনু মাজাহ ৩৮৫০, আহমাদ ২৫৩৮৪, মুসতাদারাক লিল হাকিম ১৯৪২, সহীহাহ্ ৩৩৩৭, সহীহ আল জামি‘ ৩৩৯১।

এছাড়া বান্দা পছন্দ মত দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর যাবতীয় দুআ করবে। সে গুলো প্রমাণিত আরবী ভাষায় দুয়া হোক কিংবা নিজ ভাষায় হোক। এ ক্ষেত্রে ইবাদতকারী একটি সুন্দর সহীহ দুআ সংকলিত দুয়ার বইয়ের সাহায্য নিতে পারে। সালাফে সালেহীনদের অনেকে এই রাতে অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে দুয়া করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কারণ এতে বান্দার মুক্ষাপেক্ষীতা, প্রয়োজনীয়তা ও বিনম্রতা প্রকাশ পায়, যা আল্লাহ পছন্দ করেন।

Leave a comment