কুরআনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিদআত

কুরআনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিদআত

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন।

বর্তমান বিশ্বে একমাত্র নির্ভুল ধর্মীয় গ্রন্থ হলো কুরআন। এই কথাটি প্রত্যেক মুসলিম স্বীকরা কবলেও তারা কুনআনকে কেন্দ্র করে নানান প্রকারের বিদআতি আমল চালু করছে। এ পর্যায় কুরআনের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু বিদআত নিয়ে আলোচনা কবরঃ

১। কুরআন খতম করাঃ 

কুরআন খতম করা নিঃসন্দেহ একটি বিদআত কাজ। এ সম্পর্কে তৃতীয় অধ্যায়ের নবম পরিচ্ছেদে ‘বিভিন্ন প্রকারের খতম’ শিরোনামে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ঐ আলোচনায় কুরআন খতম করা যে বিদআত তার দশটি কারন উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন খতম করার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। কুরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করাই হলো কুরআন খতম করা। খতম করার সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই যে সেই নিয়ম অনুযায়ী তিলওয়াত করা হবে। কুরআন তিলওয়াত করা নেকীর কাজ। তাই কুরআনের যে কোন অংশ থেকেই পড়া হোক না কেন। কুরআন খতম করলে যে আলাদা নেকী হবে এমনটি নয়। তবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করলে মনে মাঝে একটা প্রশান্তি আসতে পারে। কুরআন সাধারণত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বা মৃত পিতা মাতার নিকট সওয়াব পৌছানোর জন্য করা হয়। সমাজে প্রচলিত সর্বাধীক আমলটি হলো, কোন মুন্সী বা মৌলভীকে টাকার বিনীময়ে কুরআন খতম করিয়ে মৃত্যুর জন্য সওয়াব পৌছান। এর মাধ্যমে মুলত কেউই লাভবান হতে পাবে না। কারণ, যিনি খতম পড়াচ্ছেন তিনি ভাবছেন, তাঁদের দিয়ে টাকার বিনিময়ে আমি কুরআন পড়াচ্ছি। তিনি মনে করছেন, এ পদ্ধতিতে কোরআন পড়ানো সওয়াবের কাজ। এই পদ্ধতি নবীর (সা.) কাছ থেকে ইবাদত বা সওয়াবের কাজ হিসেবে সাব্যস্ত না হওয়ার কারণে এটি একটি বিদাতি তরিকা। বিদাত হওয়ার কারণে এখানে কোনো সওয়াব নেই, যতই আপনি ভালো কাজ করুন না কেন, পদ্ধতি ভুল হওয়ার কারণে এই তরিকার মধ্যে কোনো সওয়াব নেই। সুতরাং যিনি পড়ছেন, তিনি সওয়াব পাবেন না, সেটি মৃত ব্যক্তিও পাবেন না, আর যিনি কোরআন পড়াচ্ছেন তিনিও পাবেন না।

এ ছাড়া যাঁরা কোরআন পড়ছেন, তাঁরাও সওয়াব পাবেন না, যেহেতু তাঁরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরআন পড়ছেন না, তাঁরা কোরআন পড়ছেন মূলত টাকার বিনিময়ে। এ জন্য তাঁদের কাজটি মূলত ইবাদত হচ্ছে না, বরং ইবাদতটি তাঁরা দুনিয়ার স্বার্থে বিক্রি করে দিচ্ছেন। তাই তাঁদের এই ইবাদতটুকু সওয়াবের জন্য হবে না, কারণ দুনিয়ার স্বার্থে যদি কেউ ইবাদত করে থাকেন এবং সেটি যদি শুধু দুনিয়ার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই হয়ে থাকে, তাহলে এটি শিরক হয়ে যাবে। কিন্তু এর মাধ্যমে যদি দুনিয়ার কোনো উপকার হয়ে থাকে, তাহলে সেটি শিরক হবে না, তবে তাঁরা সওয়াব থেকে মাহরুম হয়ে যাবে। এই কাজটি ইবাদতের যে বিধান রয়েছে, সেই বিধানের মধ্যে আসবে না, যেহেতু এখানে বড় ধরনের ভুল আছে।

মৃত্যু ব্যক্তির নিকট কুরআন খতমের মাধ্যমে সওয়াব পৌছানোর একটি বিদআতী আমল। কিভাবে মৃত্যু ব্যক্তির নিকট সওয়াব পৌছানো যায় তার ১০ টি মাধ্যম এই পুস্তকে আলোচনা করা হয়েছে যার মাঝে কুনআত খতম করার মত কোন আমল নাই। কাজেই কুরআন খতমের মাধ্যমে সওয়াব পৌছানোর মত বিদআতী কাজ থেকে বিরত থাকি।

২। কুরআনের আয়াত দ্বারা তাবিজ কবজ ব্যবহার করাঃ

কুরআনের আয়াত দ্বারা তাবিজ কবজ ব্যবহার সম্পর্কে মতভেদ আছে। বর্তমান যুগের আহলে হাদিস এবং সৌদী আরবের সালাফি আলেমগণ সকল প্রকারের তাবিজ কবজের ব্যবহার কে ছোট শির্ক মনে করে এবং ইহার উপর তাওয়াক্কুল করাকে বড় শির্ক মনে করে, যা কোন মুসলিম ব্যক্তি কে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। আমাদের দেশের দেওবন্দ অনুসারী আলেমগণ কুরআন দ্বারা তাবিজ দেয়াকে জায়েয মনে করা করে এবং ইহার উপর তাওয়াক্কুল করা কে বড় শির্ক মনে করে। কিছু বিদআতী আলেম সকল প্রকারের তাবিজ কবজের ব্যবহার জায়েয মনে করে থাকে। তাই আসুন আগে জেনে নেই, তাবিজ কবজের ব্যবহার সম্পর্কে ইসলাম কি বলে?

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

من علق شيئا وكل إليه

যে ব্যক্তি কোন জিনিষ লটকাবে, তাকে ঐ জিনিষের দিকেই সোপর্দ করে দেয়া হবে, (তিরমিযী, অধ্যায়ঃ কিতাবুত্‌ তিব্ব। শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানী (রঃ) হাসান বলেছেন, সহীহুত তিরমিযী হা নং- ২০৭২ )

কোন এক সফরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন লোক পাঠিয়ে বলে দিলেন যেঃ

أَنْ لاَ يَبْقَيَنَّ فِي رَقَبَةِ بَعِيرٍ قِلاَدَةٌ مِنْ وَتَرٍ أَوْ قِلاَدَةٌ إِلاَّ قُطِعَتْ

কোন উটের গলায় ধনুকের রশি বা গাছের ছাল দিয়ে তৈরী হার ঝুলানো থাকলে অথবা যে কোন মালা থাকলে সেটি যেন অবশ্যই কেটে ফেলা হয়। (বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুত্‌ তিব্ব)।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,  (إِنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ)

“ঝাড়-ফুঁক করা, তাবীজ লটকানো এবং স্বামী বা স্ত্রীর মাঝে ভালবাসা সৃষ্টির জন্যে যাদুমন্ত্রের আশ্রয় নেয়া শির্ক”। (আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ কিতাবুত তিব্ব। শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানী হাদীছ সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা হাদীছ নং- ৬/১১৬১)।

মন্তব্যঃ এখানে যে ঝাড়ফুঁক করাকে শির্ক বলা হয়েছে, তা দ্বারা শির্কী কালামের মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক উদ্দেশ্য। তবে ঝাড়ফুঁক যদি আল্লাহর কালাম, আল্লাহর সিফাত বা সহীহ হাদীছে বর্ণিত কোন বাক্যের মাধ্যমে হয়, তাতে কোন অসুবিধা নেই। কারণ সহিহ হাদিস দ্বারা ঝাড়ফুঁক করাকে শরিয়ত সম্মত বলা হয়েছে। এই সম্পর্কে উম্মতে ইজমা হয়েছে এবং এই আমলে কারো কোন দ্বিমত নাই। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য এক হাদীছে বলেনঃ

مَنْ تَعَلَّقَ تَمِيمَةً فلا أتم الله له ومن علق ودعة فلا ودع الله له

“যে ব্যক্তি তাবীজ লটকালো, আল্লাহ্‌ যেন তার উদ্দেশ্য পূর্ণ না করেন। আর যে ব্যক্তি রুগমক্তির জন্যে শামুক বা ঝিনুকের মালা লটকালো, আল্লাহ্‌ যেন তাকে শিফা না দেন”। (হাকেম, (৪/২১৯। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে যঈফা, (৩/৪২৭)।

তিনি অন্য এক হাদীছে বলেনঃ

مَنْ تَعَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ

“যে ব্যক্তি তাবীজ লটকালো সে শির্ক করল”। (মুসনাদে আহমাদ, (৪/১৫৬) ইমাম আলবানী সহিহ বলেছেন, দেখুন সিলসিলায়ে সহিহা হাদীছ নং- (১/৮০৯)।

নবী (সাঃ) এক ব্যক্তির হাতে পিতলের একটি আংটা দেখে বললেনঃ এটি কী? সে বললঃ এটি দুর্বলতা দূর করার জন্যে পরিধান করেছি। তিনি বললেনঃ

انْزِعْهَا فَإِنَّهَا لَا تَزِيدُكَ إِلَّا وَهْنًا فَإِنَّكَ لَوْ مِتَّ وَهِيَ عَلَيْكَ مَا أَفْلَحْتَ أَبَدًا

“তুমি এটি খুলে ফেল। কারণ এটি তোমার দুর্বলতা আরো বাড়িয়ে দিবে। আর তুমি যদি এটি পরিহিত অবস্থায় মৃত্যু বরণ কর, তাহলে তুমি কখনই সফলতা অর্জন করতে পারবে না”। (মুসনাদে আহমাদ, দেখুনঃ আহমাদ শাকেরের তাহকীক, (১৭/৪৩৫) তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)।

 হুজায়ফা (রাঃ) দেখলেন এক ব্যক্তির হাতে একটি সুতা বাঁধা আছে। তিনি তা কেটে ফেললেন এবং কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করলেনঃ

وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إلاَّ وَهُمْ مُشْرِكُونَ

অর্থঃ “তাদের অধিকাংশই আল্লাহকে বিশ্বাস করে; কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে”(সূরা ইউসুফঃ ১০৬)

সাঈদ বিন জুবায়ের (রাঃ) বলেনঃ যে ব্যক্তি কোন মানুষের শরীর থেকে একটি তাবীজ কেটে ফেলল, সে একটি গোলাম আযাদ করার ছাওয়াব পেল। সাঈদ বিন জুবায়েরের এই কথাটি নবী (সাঃ) হতে বর্ণিত মারফু হাদীছের পর্যায়র্ভূক্ত।

ইহা ছাড়া তাবিজ ব্যবহার করা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহিহ বা যঈফ সনদে হোন হাদিস বর্ণিত হয় নাই যে, তিনি তার জীবন দসায় তাবিজ কবর ব্যবহার করছেন বা সাহাবিদের ব্যবহার করতে বলেছেন। এমন কি পৃথিবীর কোন হাদিস জাল কারীও তাবিজ কবজ ব্যবহার করা সম্পর্কে কোন হাদিস জাল করে নাই। অর্থাৎ তাবিজ কবজ সম্পর্কে কোন জাল বা মিথ্যা হাদিসও বর্ণিত হয় নাই। তাই আমাদের উপমহাদের দেওবন্দী ও সৌদি আরবের সালাফি আলেমগন নিম্ম লিখিত কারনে তাবিজ-করজের ব্যবহার হারাম বলেছেন।

ক। যে কালামের ভাষা বুঝা যায় না, তা দ্বারা কোন প্রকার তাবিজ কবজ বা ঝাড়-ফুক করা হারাম।

খ। সংখ্যা সম্ভলিত তাবিজ-কবজ জায়েজ নাই কারন ইহা অনেকটা জ্যেতিষীদের রাশি এবং ভাগ্য গনণার মত। তাছাড়া ইহার আবিস্কারক হল গ্রীসের জ্যতিষীগণ যা পরে আরবদের মাঝে প্রসার লাভ করে। ইসলামের মুল উত্স কুরআন হাদিসে এর অস্তিস্থ খুজেও পাবে না।

গ। শির্ক যুক্ত কালাম বা আল্লাহ ছাড়া অন্যের আশ্রায় খোজা। যেমন: ইয়া ফিরাউন, ইয়া হামান, ইয়া কিতমির (জিনের সর্দার) ইত্যাদি লিখে তাবিজ দেওয়া।

ঘ। নকসা সম্ভলিত তাবিজ। যেমনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জুতার নকসা, আলির (রাঃ) তলোযারের নকসা, কাবার নকসা ইত্যাদি।

ঙ। আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায়।

চ। যদি কেউ এ বিশ্বাস করে যে, তাবিজ-কবজ বা ঝাড়-ফুকের নিজস্ব ক্ষমতা আছে তবে শির্ক এবং হারাম।

৩। সালাফি ও দেওবন্দীদের মাঝে পার্কথ্য কোথায়?

দেওবন্দীদের মাদ্রাসার নেসাফ ভুক্ত “ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” কিতাবে বলা হয়েছে, “কুরআনের আয়াত, আল্লাহ নাম ও মাসনুন দোয়া দ্বারা ঝাড়-ফুক জায়েজ। আর যা দ্বারা ঝাড়-ফুক জায়েজ তা দ্বারা তাবিজ-কবজ ব্যবহার করাও জায়েজ’। কারন সকলের নিকট ঝাড়-ফুক ও তাবিজ-কবজ হুকুম একই। পক্ষান্তরে আর যা দ্বারা ঝাড়-ফুক জায়েজ নেই, তা দ্বারা তাবিজ-কবজ ব্যবহার করাও জায়েজ নয়। তাদের রেফারেন্স হল, আদ্বুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাদিঃ) কর্তৃক অবুঝ বাচ্চাদের কুরআন দিয়ে তাবিজ লিখে দেওয়া। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; “ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” পৃষ্ঠা –৪৫৯)।

সালাফীদের দাবি এই হাদিসের সনদ অত্যন্ত দুর্বল। পক্ষান্তরে হাদিস লক্ষাধীক সাহাবীদের (রাঃ) আমলের বিপরীত একজন সাহাবির আমল যা আবার দুর্বণ সনদে বর্ণিত তার উপর আমল করা যাবেনা। আর যদি এই হাদিসের সনদ সহিহ ধরে আমল করতে হয় তবে আদ্বুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাদিঃ) কর্তৃক যেখাবে অবুঝ বাচ্চাদের সুরা নাস ও সুরা ফালাক লিখে তাবিজ দিয়েছেন বলে দাবি করা হয়, শুধু তার করা আমলের মত অবুঝ বাচ্চা যাদের পাক নাপাকের জ্ঞান নেই, তাদেরই সুরা নাস ও সুরা ফালাক লিখে তাবিজ দেয়া জায়েয। পক্ষান্তরে, যে সকল যুবগ যুবতী যাদের শরীর অপবিত্র হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অবথা বিবাহীত নারী পুরুষ যাদের গোশল ফরজ হয়, তাদের কুরআনের সূরা সম্বলিত তাবিজ ব্যবহার করা হামার কাজ বলে উল্লে করেছেন। তাদের যুক্তি প্রথমত কোন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার সাহাবী (রাঃ), তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী বা আমাদের সালাফগনের মাঝে তাবিজের ব্যবহার ছিল না। দ্বিতীয়ত কুনআন অপবিত্র অবস্থায় ষ্পর্স করা হারাম। যিনি কুরআন সম্বলিত তাবিজ ব্যবহার করবেন তাকে সর্বক্ষনই পবিত্র থাকতে হবে কিন্তু কোন মানুষের পক্ষেই সর্বক্ষন পবিত্র থাকা সম্ভব নয়। তাই অবুঝ বাচ্চার উপর কিয়াস করে অবাধে নারী পুরুষ সকলে কুনআন সম্বিলত তাবিজ ব্যবহার সঠিক হবে না। তাদের অনেকে বলেছেন এতে দ্বিগুন গুনা হবে, এক হল তাবিজ ব্যবহার করা জন্য। আর দ্বিতীয় হল কুনআন অবমাননার জন্য। আল্লাহু আলাম। 

মন্তব্যঃ উপরের আলোচনা থেকে এ কথা ষ্পষ্ট যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা তার সাহাবীদের (রাঃ) সময় সুযোগ থাকা সত্বেও কুনআন সম্বলিত কোন তাবিজ ব্যবহারের নজীর পাওয়া যায় না (একজন সাহবীর দুর্বল সনদে অবুঝ বাচ্চাদের)। এর বিপরীতে কুনআনের দ্বারা ঝাড় ফুক করার বহু সহিহ হাদিস পাওয়া যায়। কাজেই তাবিজ ব্যবহার করার মত, এই জায়েয (দেওবন্দী) অথবা হারাম (সালাফি) কাজ করতে গিয়ে অনেক অজ্ঞ মুসলিম তাবিজের উপর তাওয়াক্কুল করে থাকে যা তাকে শির্কে পতিত করে এবং তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। অপর পক্ষে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, যারা তাবিজ লিখেন তারা শুধু কুরআনে সীমবদ্ধ থাকেন না, তারা শির্ক মিশ্রিত তাবিজও লিখে থাকেন। যেমনঃ এমন কালামের তাবিজ লিখেন তার ভাষা বুঝা যায়না, আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় তাবিজ লিখেন, আল্লাহ ছাড়া অন্যের আশ্রায় চেয়ে তাবিজ লিখেন, নকসা সম্ভলিত তাবিজ লিখেন, সংখ্যা সম্ভলিত তাবিজ লিখেন। কাজেই তাবিজ শুধু বিদআতই নয়, ইহা শির্কি কাজও। এই সকল শির্ক মিশ্রিত বিদআত থেকে বেচে থাকার যথাসম্ভর চেষ্টা করতে হবে। আর সুন্নাহ সম্মত চিকিত্সা নিতে হবে। বর্তমানে আধুনিক সময় প্রায় সকল প্রকার রোগেই বিজ্ঞান সম্মত ঔষধ আবিস্কার হয়ছেন। তাই মহান আল্লাহর উপর তাওযাক্কুল করে ঝাড় ফুকের পাশাপাশি এই বিজ্ঞান সম্মত চিকিত্সা পদ্ধতি গ্রহন করতে হবে।

৪। কুরআনকে সব সময় চুমু খাওয়াঃ 

কুরআন মানব জাতীর একমাত্র জীবন বিধান। মহান আল্লাহ তরফ থেকে এক মহান দান। কুরআন নাজিলের কারন মহান আল্লাহ পরিচয় দানের মাধ্যমে তাকে মেনে চলা এবং একমাত্র তারই ইবাদাত করা। এই বাদাতে কাউকে তার সাথে শরীক না করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

 يَـٰٓأَهۡلَ ٱلۡڪِتَـٰبِ قَدۡ جَآءَڪُمۡ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمۡ ڪَثِيرً۬ا مِّمَّا ڪُنتُمۡ تُخۡفُونَ مِنَ ٱلۡڪِتَـٰبِ وَيَعۡفُواْ عَن ڪَثِيرٍ۬‌ۚ قَدۡ جَآءَڪُم مِّنَ ٱللَّهِ نُورٌ۬ وَڪِتَـٰبٌ۬ مُّبِينٌ۬ (١٥) يَهۡدِى بِهِ ٱللَّهُ مَنِ ٱتَّبَعَ رِضۡوَٲنَهُ ۥ سُبُلَ ٱلسَّلَـٰمِ وَيُخۡرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَـٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِهِۦ وَيَهۡدِيهِمۡ إِلَىٰ صِرَٲطٍ۬ مُّسۡتَقِيمٍ۬ (١٦)

অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে এক নূর এবং উজ্জ্বল কিতাবও। এর মাধ্যমে আল্লাহ সেসব লোককে শান্তির পথে পরিচালিত করেন, যারা তার সন্তুষ্টির পথে চলে। আর তিনি নিজ আদেশে তাদের অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান এবং সরল সুদৃঢ় পথে তাদের পরিচালিত করেন’ (সূরা মায়েদা ৫:১৫-১৬)।

পবিত্র কোরআন বিশ্ব মানবতার আলোর দিশারী। ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় সৌহার্দ্য ও সহিষ্ণুতার এক মূর্তিমান প্রতীক। তাই স্বাভাবিকভাবেই কুরআনের প্রতি প্রতিটি মুসলমান ভক্তি ও শ্রদ্ধা থাকা স্বাভাবিক। এই ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিয়ে যখন কোন বান্দা কুরাআন ষ্পর্ষ করে, তখন তার অন্তরেন অজান্তে চুমু খায়। সাধারণত মুসলিমগণ কুরাআন তিলাওয়াতের আগে পরে চুমু দেয়। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে কুরআনের সাথে অসম্মানজনক আচরণ হয়ে গেলে বা হাত থেকে পড়ে গেলে। তখন তুলে কুরআনের প্রতি সম্মান দেখানে অনেক চুমু খায়। তবে আমাদের চুমু দেয়ার জরুরী কাজ নয় বরং জরুরী হলো, অসম্মানজনক কাজের জন্য আল্লাহর নিকট তাওবা ইস্তিগফার করা এবং অসতর্কতাবশত কুনআন পড়ে গেলেও আল্লাহর কাছে পানাহ চাই আর ভবিশ্যতে অসতর্কতাবশত কুনআন যাতে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখি। 

চুমু দেয়ার সপক্ষে অনেক সুনান আদ দামেরীতে ইকরিমা ইবনে আবু জাহেলের (রাঃ) একটি হাদিস নকল করে বলেন, ইকরিমা (রাঃ) কুরআন তার চেহারায় লাগাতো ও চুমু খেত। আসল তাদের কথা ঠিক নয়। সুনান আদ দামেরীতে একটি যঈফ হাদিসে এসেছে, ইকরিমা ইবনে আবু জাহেলের (রাঃ) কুরআকর তার মুখের উপর রেখে বলতেন, আমরা রবের কিতাব, আমরা রবের কিতাব। (সুনান আদ দামেরী হাদিস নম্বর ৩৩৮৯ বাংলা হাদিসের এ্যাপ)

মন্তব্যঃ যদি কারো ঘরে কুরআন থাকে এবং মাঝে মাঝে বের করে চুমু দেয়া হয় কিন্তু জীবন শেষ হয়ে গেল, কোন দিন সে কুরআন তিলওয়াত করা শিখতে পারল না বা তিলওয়াত শেখার চেষ্টা করল না। তা হলে তার এই চুমু খাওয়ার দ্বারা কোন লাভ হবে না। আবার অনেকে আছি একটু আধটু তিলওয়াত করতে পারি, তাই মাঝে মাঝে তিলওয়াতের সময় বাহির করে চুমু খাই। তিলওয়াত করতে পারলাম কিন্তু মহান আল্লাত কুরআনে কি বলল তা বুঝলাম না। শুধু তিলওয়াত করলাম কিন্তু কুরআনের আদেশ নিষেধ বুঝলাম না। তাদের এই চুমু দ্বারা ভালবান কতটুকু হবে। ধরুন, একটি চিঠি বা মেইলের মাধ্যমে অফিসের বস একটি জরুরী কাজ করতে বলেছেন। সঠিক সময় না করলে শান্তির ও ঘোষনা আছে। আপনি পড়লেন না, অফিসের বসের চিঠি মনে করে ভক্তি আর শ্রদ্ধার খাতিরে চিঠি বা মেইরটিকে শুধু কয়েটা চুমু দিয়ে রেখে দিলেন। আপনার চুমুর দ্বারা কি শাস্তি মাপ হবে? অবথা পড়লেন কিন্তু বুঝতে পারলেন না বা বুঝার চেষ্টাও করলেন না। তাহলে আপনার অবস্থা একটু চিন্তা করুন। শুধু চুমু দ্বারা কি মাপ হবে। এই চুমু খাওয়া তখই শার্থক হবে যখন, কুরআনের তিলওয়াত পাবর, অর্থ বুঝে পড়ব এবং এর হুকুম জীবনের প্রতিটি ক্ষত্রে বাস্তবায়ন করব। কাজেই যারা কুরআনের তিলওয়াত শিখলেন না, কুরআন বুঝার চেষ্টা করলেন না, এর উপর আমলও করলেন না, তাদের কুরআনের উপর চুমু খাওয়া একটি বিদআতি কাজ হবে।

৫। কুরাআন খতম করার পর কারো মাধ্যমে বখশে দেয়াঃ

আমাদের দেশের অধিকাংশ মসজিদে দেখা যায় যে, জুম্মার দিনে ইমাম সাহেবের কাছে মৌখিকভাবে বা লিখিত আকারে এই আবেদন এসে থাকে যে, ‘অমুক ব্যক্তি কুরআন মজীদ খতম করেছেন, তা বখশে দিবেন।’ ইমাম সাহেবও জুম্মার সালাত শেষে মুনাজাতের পূর্বে ঘোষণা করে আজ দুই/তিন খতম কুরআন আছে। খতমকারী কুরআন খতম বখশাতে বলেছেন। ইমাম ও মুসল্লীদের আবেদনের ভঙ্গি থেকে অনুমিত হয় যে, কুরআন মজীদ খতম করার পর ইমাম ছাহেবের মাধ্যমে বা কোনো বুযুর্গের মাধ্যমে তা বখশানোকে তারা জরুরি মনে করেন। তাদের এই ধারনা একটি বিদআতি কাজ। কুরআন মজীদ খতম করা অনেক বড় ইবাদত, যা মূলত একটি ব্যক্তিগত ইবাদত। ব্যক্তগত নফল আমল কাউকে জানালে রিয়া এসে যায়। তাই প্রয়োজন ছাড়া অন্যকে এ বিষয়ে অবগত করাও সঠিক নয়। আল্লাহর জন্য পড়া হয়েছে, আল্লাহ তাআলা দেখেছেন, এই যথেষ্ট। যদি এই খতমের ছওয়াব কবরবাসীকে পৌঁছাতে হয় তবে মুখে বলারও প্রয়োজন নেই, শুধু মনে মনে এটুকু বললেই হবে যে, ইয়া আল্লাহ, এর ছওয়াব সকল মুসলিম কবরবাসীর আমলনামা বা অমুক অমুকের আমলনামায় পৌঁছে দিন। ছওয়াব বখশানোর জিনিস নয়, যা অন্যের মাধ্যমে বখশাতে হবে। শুধু ছওয়াব রেসানী অর্থাৎ ছওয়াব পৌঁছে দেওয়ার নিয়ত করাই যথেষ্ট।

কোন আমল করার পূর্বে যে নিয়ত করা হয়, সেই অনুপাতেই মহান আল্লাহ কবুল করেন। নিয়তে সমস্যা হলে অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে খুশি করার জন্য ইবাদাত করা শির্কি কাজ। মৃত্যুর জন্য কুরআন খতম করে ছওয়াব রেসানী করা সুন্নাহ সম্মত ইবাদাত নয়। এই কাজকে অনেক আলেমই বিদআত বলেছেন। তার পরও মুসলিম সমাজের অনেক লোক তার কোন মৃত্যু আত্মীয়ের জন্য কুরআন খতম করা নিয়ত করে থাকে। একটু লক্ষ করুন নিয়ত করে পড়া শুরু করার সাথে সাথে তার নেকী পাওয়া শুরু হয়ে যাবে বা মৃত্যুর জন্য সওয়াব পৌছান শুরু হয়ে যাবে। তিনি যে দিন যত টুকু কুরআন তিলওয়াত করবে সে দিন ঠিক তত টুকুর জন্য সওয়াব পাবেন। পড়ের দিন বা খতম করা জন্য সওয়াব পৌছান বদ্ধ থাকবে না। ঠিক এমনিভাবে তার পরের দিন তিনি যতটুকু কুরআন তিলওয়াত করবে, ঠিক তত টুকুর জন্য সওয়াব পাবেন। এমনিভাবে আলম করার সাথে সওয়াব লেখা হয়। শ্রমিকের শ্রম শেষ করার সাথে সাথে তার মজুরী প্রদান করা হয়। মহান আল্লাহ জন্য ইবাদাত করলে তিনি সাথে সাথে সওয়াব দেন। মহান আল্লাহর জন্য ইবাদাত করা নয়, শুধু ইবাদতের নিয়ত করলেই একটি নেকী প্রদান করে থাকেন। তিনি আমল কবুলের জন্য কারো সুপারিসের জন্য অপেক্ষা করে না। একটু বিবেগ দ্বারা চিন্তা করে দেখুন, আপনি ইবাদাত করবেন, নিয়ত ঠিক আছে অথচ আল্লাহ কবুল করবেন না। কবুল করবেন যখন মসজিদের ইমার বখশে দিবেন। ইমামের বখশে দেয়ার জন্য আমল কারীর আমল কবুল করার জন্য আল্লাহ অপেক্ষা করবেন। এই সকল ধারন শুধু বিদআত নয়, মহান আল্লাহ রহমতের সাথে চরম দৃষ্টতা মাত্র। এছাড়া এভাবে ইমাম সাহেবের দ্বারা আমল বখশানোর রীতির কারণে মেয়েদের নাম এবং তাদের খতম বা খতমের সংখ্যা ইত্যাদি গোপন বিষয় মানুষের সামনে আসে। কোনো প্রয়োজন ছাড়া এমনটি করার কী যুক্তি? তো সব বিচারেই এই রসম বর্জনীয়।

গ্রাম অঞ্চলে এর সাথে আরও একটি বিদআত চালু আছে তা হল, খতম বখশে দেওয়ার জন্য মহিলারা একত্র হয়ে দোয়ার মাহফিলের আয়োজন করে। এই দোয়া পরিচালনাকারী মহিলাকে আবার হাদিয়া প্রদান করা হয়। বখশানোর জন্য হাদিয়া দেওয়া বা নেওয়ার বিষয়টিও বর্জনীয়। আমল বখশানো অর্থ দুআ করা। আর দুআ একটি খালিস ইবাদত, যার বিনিময়ে হাদিয়ার আদান-প্রদান জায়েয নয়। একটি বিদআত থেকে আরও বিদআতের জম্ম হয়। যেহেতু কুরআন তিলওয়াত একটি স্বয়ংসম্পুর্ণ ইবাদাত তাই এই নিয়তই সওয়াব বখশে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কাজেই ইমাম বা কোন নেককার লোকের মাধ্যমে পৌছান একটি বিদআতী কাজ যা পরিহার করা খুবই জরুরী।

   

 ৬। কুরআনের সাথে সম্মান সুচক নাম ব্যবহার করাঃ

কুরআন খুবই সম্মানিত একটি ঔশী গ্রন্থ। মহান আল্লাহ কুরআনকে, কুরাআনেরই বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন নামে অবিহিত করেছেন। গবেষকগন গবেষনা করে দেখেছনেন কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা কুনআনকে বাহত্তরটি নামে উল্লেখ করেছেন। যেমনঃ

১. আল কিতাব (মহাগ্রন্থ) ২. কিতাবুল্লাহ (আল্লাহর কিতাব) ৩. আল কোরআন (অধিক পঠিত) ৪. আল ফুরকান (মানদন্ড) ৫. আন নুর (জ্যোতি) ৬. আল হুদা (পথ নির্দেশক) ৭. আয যিকর (স্মারক) ৮.আল কওল (কথা) ৯. কালামুল্লাহ (আল্লাহর বাণী) ১০. মুবারক (মহিমান্বিত) ১১. রহমাত (অনুকম্পা) ১২. হিকমাতুল বালিগাহ (পরিপূর্ণ) ১৩. আল হাকিম (প্রজ্ঞাময়) ১৪. হাবলুল্লাহ (আল্লাহর রজ্জু) ১৫. রুহ (প্রেরণা) ১৬. আল ওয়াহহী (প্রত্যাদেশ) ১৭. আল ইলম (পরমজ্ঞান) ১৮. আল হাক্ক (মহাসত্য) ১৯. আল বাশির (সুসংবাদদাতা) ২০. আন নাযির (সতর্ককারী) ২১. আল মাজিদ (মর্যাদাবান) ২২. আদল (সুষম) ২৩. আমরুল্লাহ (আল্লাহর নির্দেশ) ২৪. মুহাইমনি (সংরক্ষক) ২৫. বুরহান (প্রমাণ) ২৬. মুবিন (সুস্পষ্ট) ২৭. শিফা (নিরাময়) ২৮. মাওইয়া (উপদেশ) ২৯. আলী (সুউচ্চ) ৩০. রিছালাতুল্লাহ (আল্লাহর বার্তা) ৩১. হুজ্জাতুল্লাহ (আল্লাহর প্রমাণ) ৩২. আল মুসাদ্দিক (সত্যয়নকারী) ৩৩. আল আযীয় (শক্তিময়) ৩৪. ছিরাতুল মুস্তাকিম (সঠিকপথ) ৩৫. কাইয়ূম (সুদৃঢ়) ৩৬. আল ফাঝল (মীমাংসাকারী) ৩৭. আল হাদিছ (বাণী) ৩৮. আহছানুল হাদিছ (সর্বোত্তম উক্তি) ৩৯. নাবাউল আযীম ৪০. মহাসংবাদ ৪১. মুতাশাবিহা (সাদুশ্যময়) ৪২. মাছানী (পুনরাবৃত) ৪৩. তানযীল (অবতীর্ণ) ৪৪. আরবী (আরব্য) ৪৫. বাছিয়ার (প্রজ্ঞা) ৪৬. বায়ান (বিবরণ) ৪৭. আয়াতুল্লাহ (আল্লাহর নির্দেশ) ৪৮. আজব (চমৎকার) ৪৯. তযকিরাহ (স্মারক) ৫০. উরত্তয়াতুল উছকা (দৃড় অবলম্বন) ৫১. আছ ছিদক (অতীব সত্য) ৫২. মুনাদী (আহ্বানকারী) ৫৩. আলবুশরা (আনন্দবার্তা) ৫৪. বাইয়িনাত (প্রমাণপঞ্জি) ৫৫. বালাগ (বার্তা) ৫৬. আল কারীম (মর্যাদাবান) ৫৭. আলমীযান (ন্যায়দ-) ৫৮. নিয়ামাতুল্লাহ (আল্লাহর অনুগ্রহ) ৫৯. হুদালাহ (আল্লাহর নির্দেশ) ৬০. কিতাবুয মুবীন (সুস্পষ্ট কিতাব) ৬১. কিতাবুন হাকীম (বিজ্ঞানময় কিতাব) ৬২. কুরআনুল মুবীন (উজ্জাল কোরআন) ৬৩. কিতাবুম মাছতুর (ছত্রলিপি গ্রন্থ) ৬৪. কিতাবুমন আযীয (প্রিয় পুস্তক) ৬৫. যিকরুল হাকীম (কৌশলপূর্ণ) ৬৬. মাতলু (অধিক অধ্যয়নযোগ্য) ৬৭. হুদাল লিন নাছ (মানবজাতির দিশারী) ৬৮. যিকরুল্লাহ (আল্লাহর স্মরণ) ৬৯. যিকরুল লিল আল আমিন (জগৎসমূহের জন্য স্মারক) ৭০. নুরুল্লাহ (আল্লাহর আলো) ৭১. নুরুল মুবীন (সুস্পষ্ট আলো) ৭২. কালিমাতুল্লাহ (আল্লাহর বাণী)

আল্লাহ তাআলা কুরআনকে যে সব শব্দ দ্বারা বিশেষিত করেছেন আমাদেরও উচিৎ ঐ সকল শব্দ ব্যবহার করা। ইহা ছাড়াও কুরআনের সাথে বিশেষণ লাগিয়ে কুরআনের নাম উল্লেখ করা হয়।

যেমনঃ কুরআনুল মাজীদ (মর্যাদাবান কুরআন), কুরআনুল কারীম (সম্মানিত কুরআন), কুরআনুল হাকীম (প্রজ্ঞাময় কুরআন), কুরআনুল মুবিন (সুস্পষ্ট কুরআন), কুরআনুল শিফা (নিরাময় কুরআন), কুরআনুল হাক্ক (মহাসত্য কুরআন), কুরআনুল বাশির (সুসংবাদদাতা কুরআন), কুরআনুল নাযির (সতর্ককারী কুরআন) ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের সমাজে কুরআনে বর্ণিত নামের পাশাপাশি আরও কিছু নাম প্রচলিত আছে। যেমনঃ অনেকে বলে থাকের কুরআন শরীফ। গবেষণা করে দেখা যায় কুরআন ও হাদীসে কুরআনের সাথে ‘শরীফ’ শব্দটির ব্যবহার পাওয়া হয় নাই। শরীফ শব্দের অর্থ উচ্চ-মর্যাদা সম্পন্ন, সম্মানিত। তাই অর্থের দিক দিয়ে শরীফ শব্দ যোগ করায় কোন সমস্যা নাই। কিন্তু কুরআনের বিভিন্ন বিশেষন থাকা সত্বেও তা ব্যবহার না করে শুধু এই শরীফ বিশেষন ব্যবহার না করা ভাল। যেহেতু ‘কুরআন শরীফ’ ব্যবহার করায় অর্থগতভাবে কোন সমস্যা নেই। তাই এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করাও ঠিক নয়। তবে মনে রাখতে হবে কুরআনের সম্মানে আল্লাহর দেয়া নাম ব্যবহারের চেয়ে উত্তম আর কিছু হতে পারে না। আল্লাহ তাওফিক দান করুন।

৭। খুব উচু আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করাঃ

তবে মনে মনে পড়লে তিলাওয়াত হয় না। বিশুদ্ধ তিলাওয়াত জন্য চাই স্পষ্ট উচ্চারন। মেয়েরা মোলায়েম কন্ঠে আর পুরুষের হালকা উচ্চস্বরে পড়বে। প্রত্যেকে নিজের স্বাভাবিক স্বরে কুরআন পড়া উচিত। কারো নকল করা ঠিক নয়। সরবে কুরআন তিলাওয়াত সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

আল্লাহ তা‘আলা কোনো নবীকে এতটুকু সুর দিয়ে পড়ার অনুমতি দেননি যতোটা দিয়েছেন নবীকে। কুরআন তিলাওয়াতে সুরারোপ করার অনুমতি, যা তিনি সরবে পড়েন। (আবূ দাউদ, সুনান-১৪৭৫; নাসায়ী, সুনান- ১০১৭)।  

কুরআন তিলাওয়াত করারে উত্তম জিকির বলা হয়। কুরআন তিলাওয়াত ফাজায়েলের দিক দিয়ে উত্তম নফল। আর বান্দার হক নষ্টকরা হারাম। খুব জোরে তিলাওয়াত না করা যাতে কারো কোন অসুবিধা না হয়। উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করার ফলে অনেক সময় অসুস্থজনের কষ্ট হয়। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মনে রেখো, তোমরা সবাই আপন রবের সঙ্গে সঙ্গোপনে কথা বলছো। অতএব একে অপরকে কষ্ট দেবে না। একজন অপরের ওপর গলা চড়িয়ে তিলাওয়াত করবে না। (আবূ দাউদ – ১৩৩৪)।

আমাদের উপমহাদেশে একটা বিদাত চালু আছে। তাহল সবিনা খতম নামে মাইকে কুরআন পড়া। এই বিদাতে অনেক কুফল আছে, তার মধ্যে মাইকে উচ্চ স্বরে পড়ার দরুন, অসুস্থ রোগীর কষ্ট, সাধারনের ঘুমের বেঘাত। প্রসাব পায়খানায় বসেও শুনতে বাধ্য করা। সর্বপরি কুরআনের হক হল তিলাওয়াতের সময় চুপ থাকা ও শ্রবণ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

  وَإِذَا قُرِئَ ٱلۡقُرۡءَانُ فَٱسۡتَمِعُواْ لَهُ ۥ وَأَنصِتُواْ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ (٢٠٤)

অর্থ: যখন কুরআন, তোমাদের সামনে পড়া হয়, তা শোনো মনোযোগ সহকারে এবং নীরব থাকো, হয়তো তোমাদের প্রতিও রহমত বর্ষিত হবে৷ (সুরা আরাফ ৭:২০৪)।

নিম্ম আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করার কথাও হাদিসে এসেছে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সরবে কুরআন তিলাওয়াত প্রকাশ্য সদকাকারীর ন্যায় এবং নিরবে কুরআন তিলাওয়াত গোপনে সদকাকারীর ন্যায়। (আবূ দাউদ-১৩৩৫; মুসনাদ আহমদ-১৮৩৬৮)।

আবূ বকর (রা:) নিরবে কুরআন তিলাওয়াত করতেন আর উমর (রা:) করতেন সরবে। উমর (রা:) কে সরবে পড়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘সরবে পড়ে আমি শয়তানকে বিতাড়ন করি এবং ঝিমুনি তাড়াই।  অতপর আবূ বকর (রা:) কে নির্দেশ দেয়া হলো আওয়াজ একটু বাড়াতে আর উমর (রা:) কে নির্দেশ দেয়া হলো আওয়াজ একটু কমাতে। (আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফ-৪২১০)।

সারকথা: মধ্যম আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। রিয়া, ঘুমন্ত ব্যক্তির ঘুম অসুবিধা হলে, নামাজরত ব্যক্তি নামাজে অসুবিধা হলে, অসুস্থ ব্যক্তির কষ্ট পাওয়ার আশঙ্কা থাকলে নিরবে পড়া উত্তম। তবে শয়তানকে বিতাড়ন করা, ঘুম তাড়ানো ও আশপাশের শব্দকে উপেক্ষা করার জন্য হালকা উচ্চ স্বরে তিলাওয়াত সহায়ক।

৮। কুরআন তিলাওয়াতের সময় কানে মুখে হাত দিয়ে চেহারা বিকৃত করে তিলওয়াত করাঃ

আমাদের সমাজে অনেক মুসলিমকে দেখা যায় কুরআন তিলাওয়াতের সময় কানে মুখে হাত দিয়ে তিলওয়াত করে থাকেন। তারা ইচ্ছা করলে সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি কম আওয়াজে তিলওয়াত করতে পারেন। এত তাদের মুখে বা কানে হাত দেয়ার দরকার পড়ে না। কিন্ত তারা ইচ্ছা করেই জোরে বা স্টাইল করা কারনে মুখে হাত দেন যা সুন্নাহর খেলাপ। আবার কিছু তিলওয়াত কারীকে দেখা যায় কুনআন তিলওয়াতের সময় চেহারা বিকৃত করে ফেলে। যদি সে সাবলিল বা স্বাভাবিত তিলওয়াত করে তবে তার চেহারা বিকৃত হয় না। কিন্তু যখন তিনি কোন প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রনন করেন বা বিশেষ কোন স্টাইলে তিলওয়াত করতে চান তবে তাকে চেহারা বিকৃত করতে হয়। এই ধরনের চেহারা বিকৃত করে কুনআন তিলওয়াত করা সুন্নাহর খেলাপ।

৯। কুরআন তিলওয়াত শেষে স্বাদাক্বাল্লাহুল আযীম বলাঃ

কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে সাদাকাল্লাহুল আজিম বলা বিদআত। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদা ও কোনো সাহাবী থেকে এরূপ বলা প্রমাণিত নেই, পরবর্তী কোনো ইমাম থেকেও নয়।  অথচ কুরআনুল কারিমের প্রতি তাদের আমল, ভালবাসা, গুরুত্ব আমাদের থেকে অনেক বেশী ছিল। তারা আমাদের চেয়ে বেশী তিলাওয়াত করতেন এবং কুরআন সম্পর্কে তারা বেশী জানতেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে আমাদের দীনে নতুন কিছু সৃষ্টি করল, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা পরিত্যক্ত। (বুখারি-২৬৯৭)।

তিনি আরও বলেন, “যে ব্যক্তি এমন আমল করল, যার উপর আমাদের দীন নেই, তা পরিত্যক্ত। (মুসলিম-১৭২১)।

আব্দুল্লাহ ইবনে ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমাকে কুরআন পড়ে শুনাও’, তিনি বলেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমি আপনাকে কুরআন পড়ে শোনাব, অথচ আপনার উপর কুরআন নাযিল হয়েছে! তিনি বললেন: ‘আমি অপর থেকে কুরআন শুনা পছন্দ করি’। অতঃপর আমি তাকে সূরা নিসা পাঠ করে শুনাই, যখন নিম্নোক্ত আয়াতে পৌঁছি। 

 فَكَيۡفَ إِذَا جِئۡنَا مِن كُلِّ أُمَّةِۢ بِشَهِيدٖ وَجِئۡنَا بِكَ عَلَىٰ هَٰٓؤُلَآءِ شَهِيدٗا **

অতএব কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং তোমাকে উপস্থিত করব তাদের উপর স্বাক্ষীরূপে?’ (সূরা নিসা ৪:৪১)। তিনি বললেন, ‘হাসবুক’ (তুমি এখানে পড়া ক্ষান্ত কর, এখানে পড়া শেষ কর)। আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখি, তার দু’চোখ অশ্রু ঝরাচ্ছে”। (সহিহ বুখরি – ৫০৪৯, সহিহ মুসলিম-৮০২)।

কই? এখানে তিনি “স্বাদাক্বাল্লাহুল আযীম” বলেননি। সুরা আল ইমরানের ৯৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, বল “স্বাদাক্বাল্লাহ”। পূর্ণ আয়াতটি হল:

 قُلۡ صَدَقَ ٱللَّهُۗ فَٱتَّبِعُواْ مِلَّةَ إِبۡرَٰهِيمَ حَنِيفٗاۖ ٩٥

“বল, আল্লাহ সত্য বলেছেন, সুতরাং তোমরা ইবরাহীমের মিল্লাতের অনুসরণ কর একনিষ্ঠভাবে। (সুরা আল ইমরানের ৩:৯৫)। কিন্তু তিনি বলেননি যে, কুরআন পড়া শেষ হলে “স্বাদাক্বাল্লাহ” বল।  এখানে বলা  হয়েছে, কুরআনুল কারিমে তিনি যা বলেছেন তা সত্য বলেছেন। এর দ্বারা কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে ‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলার বৈধতা প্রমাণিত হয় না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিংবা তার কোনো সাহাবি কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে কখনো ‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলেননি, অথচ তারা এ আয়াতসমূহ আমাদের চেয়ে বেশী পড়তেন এবং বেশী বুঝতেন। যদি তার দাবি কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত শেষে ‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’ বলা হত, তারা তার উপর আমল করতেন এবং আমরা তাদের অনুসরণ করতাম, তাদের অনুসরণ করাই আমাদের জন্য কল্যাণকর। কাজেই এই সকল বিদআত পরিহার করে চলি।

১০। সারা জীবন অর্থ না বুঝে শুধু তিলওয়াত করাঃ

পৃথিবীর সকল মুসলিম এ কথা স্বীকার করে যে, আল কুরআন হল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশিগ্রন্থ। বর্তমান বিশ্বে বিদ্যসান একমাত্র মানবতার মুক্তির সনদ। এই ঐশিগ্রন্থে রয়েছে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট হিদায়াত ও দিক নির্দেশনা। এই গ্রন্থেই আছে কি ভাবে আল্লাহ আইন কানুন মান্য করে আখেরাতে মুক্তি পাওয়া যাবে, তারই বিশদ বিবরণ। কুরআন থেকেই আমরা আল্লাহ প্রদত্ত আদেশ নিষেধ সরাসরি জানতে পাই। এখানেই আছে পরকাল, জান্নাত, জাহান্নাম সম্পর্কে শত শত সুস্পষ্ট বর্ণনার সমাহার। কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, পূর্ববর্তী জাতীর সাফল্য ও ব্যর্থতার খতিয়ান। ইসলাম সার্বজনিন, ইহার সকল আমলগুলি সকল মুসলিমের নিকট সমান ভাবে পালনীয়। আমলের জন্য করার জন্য আমলকে বুঝা ও উপলব্ধির করা প্রয়োজন। আমল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা না থাকলে কারো পক্ষে আমল করা সম্ভব নয়। আর আমাদের আমলের ধরন কেমন? কখন করতে হবে? কি ভাবে করতে হবে? তার বিধি বিধান দেওয়ার একমাত্র কর্তৃত্ব হল আল্লাহ। আর কুরআন হল বিদিবিধান প্রদান কারি এক মাত্র আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব।

** মহান আল্লাহ কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহন করার জন্য আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ কি উপদেশ দিয়েছেন তা জানতে না পারলে, কখনও মানা সম্ভব নয়। তার উপদেশ জানতে হলে আপনাকে বুঝে বুঝে কুরআন পড়তে হবে। আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

 نَّحۡنُ أَعۡلَمُ بِمَا يَقُولُونَ‌ۖ وَمَآ أَنتَ عَلَيۡہِم بِجَبَّارٍ۬‌ۖ فَذَكِّرۡ بِٱلۡقُرۡءَانِ مَن يَخَافُ وَعِيدِ (٤٥)

অর্থ: ওরা যা বলে তা আমি ভালোভাবেই জানি। তুমি ওদের উপরে জবরদস্তিকারী নও। সুতারাং যে আমার শাস্তিকে ভয় করে তাকে কুরআনের সাহায্যে উপদেশ দান কর। (সুরা ক্বাফ ৫০:৪৫)।

 ** মহার আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে অনেক দৃষ্টান্ত, উপমা, নিদর্শন, কাহিনী উপস্তাপন করেছেন মানুষকে বুঝানোর জন্য। অথচ আমরা বলি তিলায়াত কর নেকি পাবে, বুঝতে গেলে গোমড়া বা পথভ্রষ্ট হবে। আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

 لَوۡ أَنزَلۡنَا هَـٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ عَلَىٰ جَبَلٍ۬ لَّرَأَيۡتَهُ ۥ خَـٰشِعً۬ا مُّتَصَدِّعً۬ا مِّنۡ خَشۡيَةِ ٱللَّهِ‌ۚ وَتِلۡكَ ٱلۡأَمۡثَـٰلُ نَضۡرِبُہَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ (٢١) 

যদি আমি এই কুর-আন পর্বতের উপরে অবতীর্ণ করতাম, তবে তুমি উহাকে আল্লাহ্‌র ভয়ে বিনীত এবং বিদীর্ণ হতে দেখতে। এই সকল দৃষ্টান্ত আমি মানুষের জন্য বর্ণনা করছি যেনো তারা চিন্তা করে।  (সুরা হাসর ৫৯:২১)।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা আরও বলেনঃ

وَتِلۡكَ ٱلۡأَمۡثَـٰلُ نَضۡرِبُهَا لِلنَّاسِ‌ۖ وَمَا يَعۡقِلُهَآ إِلَّا ٱلۡعَـٰلِمُونَ (٤٣)

এ ভাবেই আমি মানব সম্প্রদায়ের জন্য উপমা, উপস্থাপন করে থাকি। কিন্তু শুধু তারাই তা বুঝতে পারে যারা জ্ঞানী। (আনকাবুত ২৯:৪৩)।

** কুরআন মজীদ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং তা থেকে শিক্ষা নেওয়া। কুরআন মজীদ একটি বরকত সম্পন্ন কিতাব। আর বরকত হাসিলের মাধ্যম হিসাবে আল্লাহ বলেছেন  চিন্তা-ভাবনা করতে। আর যারা জ্ঞানী তারা চিন্তা-ভাবনা করে এবং তা থেকে শিক্ষা নেয়। কুরআন থেকে সেই উপকৃত হতে পারবে, যে আল্লাহ তা‘আলার মহান বাণী নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করবে। আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্ব ও মহিমার কথা ভেবে ভেবে তার আদেশ উপদেশ গ্রহন করেবে। কুরআনের উপদেশ বুঝতে পারলে আমল করা সহজ হবে। তাই কেউ যদি মুখে কুরআন পড়ে আর এর ভাষা না বুঝে তার পড়া দ্বারা সে কাঙ্ক্ষিত ফায়দা অর্জন করতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

 كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ إِلَيۡكَ مُبَـٰرَكٌ۬ لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَـٰتِهِۦ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَـٰبِ (٢٩)

অর্থ: ‘আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে’। (সূরা সোয়াদ ৩৮:২৯)।
আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন,

 كِتَـٰبٌ أَنزَلۡنَـٰهُ إِلَيۡكَ مُبَـٰرَكٌ۬ لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَـٰتِهِۦ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَـٰبِ (٢٩)

অর্থ: এটি একটি অত্যন্ত বরকতপূর্ন কিতাব, যা (হে মুহাম্মদ!) আমি তোমার প্রতি নাযল করেছি, যাতে এরা তার (কুরআন) আয়াত সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে এবং জ্ঞানী ও চিন্তাশীশরা তা থেকে শিক্ষা নেয়৷  (সুরা সাদ ৩৮:২৯)।

** কারো কাছ থেকে জ্ঞান আহরন করতে হলে, আদেশ পালন করতে হলে, সুসংবাদ বা সতর্ক বাণী শুনতে হলে প্রথমেই তার ভাষা বুঝতে হবে। সে কি বলছে বা কি বুঝাতে চাচ্ছে তাও স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে। যদি শুধুই কুরআনর তিলাওয়াত করি আর খতমের পর খতম দেই। অর্থ না বুঝলে কি জ্ঞান আহরন করতে পারব? আদেশ পালন (আল্লাহর ইবাদাত) করতে পারব? এমন কি আল্লাহর সুসংবাদ ও সতর্ক বাণী থেকেও বঞ্চিত থাকব। কুরআনের দাবি বুঝে পড়া ধোকা খাবেন না।  মহান আল্লাহ কুরআনে সকল জিনিস পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে এবং যা সঠিক পথ নির্দেশনা করেছেন তারই অনুসরণ করতে বলেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,

وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَـٰبَ تِبۡيَـٰنً۬ا لِّكُلِّ شَىۡءٍ۬ وَهُدً۬ى وَرَحۡمَةً۬ وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُسۡلِمِينَ (٨٩) 

 অর্থ: আমি এ কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যা সব জিনিস পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে এবং যা সঠিক পথ নির্দেশনা, রহমত ও সুসংবাদ বহন করে তাদের জন্য যারা আনুগত্যের শীর নত করে দিয়েছে৷ (সুরা নাহল ১৬:৮৯)। 

উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহর ঘোসনা করেন, কুরআনে প্রতিটি জিনিস সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন যাতে তার বান্দা সহজে বুঝতে পারে কোন পথে হিদায়েত আর কোন পথে গোমরাহী, কোন কাজে লাভ আর কোন কাজে ক্ষতি। আর বান্দা এসব জানার পর আল্লাহ অনুগত হয়ে সঠিক পথে চলতে থাকে। অর্খ না বুঝে পড়লে আল্লাহ দেখান পথ পাওয়া দুস্কর। কোন বিদেশির ভাষা না বুঝে তার আদেশ, নিষেধ, অনুরোধ মান্য করা যেমন কঠিন কাজ, ঠিক তেমনি ভাবে আল্লাহ আদেশ, নিষেধ না জেনে মান্য করা খুবই কঠিন। আর যখনই অর্থ বুঝে বুঝে পড়বে তখনই বান্দা তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবন কীভাবে পরিচালিত হবে তার প্রতিটি বিষয় কুরআনে আলোকে জানতে পারবে। যদি আজীবন শুধু তিলওয়াত করে যাই কোন দিন অর্থ না বুঝি অথবা অর্থ বুঝার চেষ্টা না করি। তাহলে মহান আল্লাহর নিকটি কি জবাব দিব।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment