আকিদার বিদআতসমূহ নবম কিন্তি : অহেদাতুল অজুদ এবং হুলহুল আকিদা কি?

   আকিদার বিদআতসমূহ : নবম কিন্তি

অহেদাতুল অজুদ এবং হুলহুল আকিদা কি?

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

ইসলামি শরীয়তের প্রথম ও প্রধান বিষয় হল ইমান। আর খাটি ইমান হল, সঠিক আকিদা প্রষণ করা। কিন্তু খুবই দুঃখজনক বিষয় হল, আমরা সকলে মুসলিম দাবি করলেও শুধু আমাদের আকিদার কারনে আমরা মুসলিম নই। ইসলাম বহির্ভুত এই নতুত আকিদাকে বিদআতি আকিদা হিসাবে চিহিৃত করব। কুরআন সুন্নাহর বাহিরে যে আকিদা নতুন করে আবিস্কার হয়েছে তাই বিদআতি আকিদা। কাজেই যে কোন ভুল আকিদা যা কুরআন সুন্নাহের বাহিরে গিয়ে নতুত করে তৈরি হয়েছে তাই বিদআতি আকিদা। যার অর্থ হলো আকিদার ভূলভ্রান্তি মানেই বিদআত আকিদা। যৌক্তিক কোন কাজ সহজে যে কেউ মেনে নেন। আর বিজ্ঞান দ্বারা প্রমানিত কোন জ্ঞানতো সাথে সাথে মেনে নেয়। কিন্তু ইসলামি আকিদার মুল হল অদৃশ্যে বিশ্বাস এখানে জাগতিক কোন বিষয় থাকলে যুক্তি ও বিজ্ঞান দ্বারা পরীক্ষা করা যেত কিন্ত অদৃশ্যে বিশ্বাস করতে হলে অদৃশ্য থেকে প্রাপ্ত অহীর উপর নির্ভর করতে হবে। অহী ভিন্ন যে কোন উৎস থেকে আকিদা গ্রহন করলে শুদ্ধ ও অশুদ্ধ যে কোনটাই হতে পারে। ইসলামি আকিদা বিশ্বাস সব সময় আল্লাহকে কেন্দ্র অদৃশ্যের উপর নির্ভর করে থাকে। তাই ইসলামি আকিদার মুল উৎস হল কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ ভিত্ত্বিক। এই কুরআন সুন্নাহর বাহিরে যখনি নতুন করে আকিদা রচনা করা হবে তাই বিদআতি আকিদা।

যেমনঃ অদৃশ্যের একটি ব্যাপার হল কবরের আজাব। কবরে আজাব হবে এটাই সত্য। কিন্তু কাউকে যুক্তি দিয়ে কি কবরের আজাব বুঝাতে বা দেখাতে পাবর। কিংবা বিজ্ঞানের আবিস্কার ক্যামেরা দ্বারা কি এই আজাব দেখাতে পারব। অপর পক্ষে আমলের ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। এখানে কুরআন হাদিসের বাহিরে ইজমা কিয়াজের দরকার হয়। নতুন কোন সমস্যা আসলে কিয়াস করে মাসায়েল দিতে হয়। যেমনঃ মোবাইল, টিভি, ইন্টারনেট, শেয়ার বাজার ইত্যাদি ইসলামের প্রথমিক যুগে ছিলনা। তাই কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে কিয়াস করে সমাধান দিতে হয়। কজেই একটি কথা মনে রাখতে হবেঃ “আকিদা ও ফিকহের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো, ফিকহের ক্ষেত্রে ইসতিহাদ, কিয়াস, যুক্তি বা আকলি দলিলের প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে ইসতিহাদ, কিয়াস, যুক্তি বা আকলি দলিলের প্রয়োজন নেই”

এক কথায় বলে গেলে কুরআন হাদিসের ষ্পষ্ট কোন রেফারেন্স ছাড়া আকিদা গ্রহণীয় নয়। যদি কেউ যুক্তি দিয়ে আকিদা বুঝাতে আসে তাকে সালাম জানাতে হবে। 

কুনআন সুন্নাহকে উৎস হিসাবে না নিলে আকিদার ভিন্নতা তো থাকবেই। আর এই ভিন্ন আকিদা আসবে সম্পূর্ণ নতুন করে যা বিদআত বলা হয়। কুরআন হাদিসে ষ্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই, এমন ফিকহি মাসলা মাসায়েলের ক্ষেতে ইখতিলাফ বা মতভেদ করা জায়েয হলেও, আকিদার ক্ষেত্রে কোন প্রকার মতভেদ জায়েয নেই। কারন আকিদার ছয়টি বিষয় (আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস, ফিরিশতাগণের প্রতি বিশ্বাস, কিতার সমুহের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগনের প্রতি বিশ্বাস শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস, তাক্বদীরের  ভালো মন্দেন প্রতি বিশ্বাস) যার সবগুলিই গায়েবের সাথে সম্পৃক্ত এবং গায়েব জানার জন্য অহীর প্রয়োজন। যতি কেউ তার আকিদাকে অহী ভিত্তিক না করে, যুক্তি ভিত্তিক করে, তাহলে তার বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। অহী ভিত্তিক না হয়ে আকিদা যুক্তি ভিত্তিক হলেই বিদআতি আকিদা হবে।

আকিদার সম্পর্কে আলোচনার আগে একটা কথাকে মনে খোদাই করে লিখে রাখেন, “আকিদা গাইবের প্রতি বিশ্বাস, এই বিশ্বাস হবে অহী নির্ভর, কোন প্রকার যু্‌ক্তিতর্কের অবতারণা করা যাবেনা”। কাজেই আমি যে ভ্রান্ত আকিদাগুলি তুলে ধরব তার বিপক্ষে আন্ততো কুরআনের একটি আয়াত অথবা একটি সহিহ হাদিস উপস্থাপণ করব। এই সহিহ আকিদার বিপরীতে যে সকল বিদআতি আকিদা সবার সামনে তুলে ধরব, সেই সকল আকিদার কুরআন সুন্নাহতে কোন প্রমান পাওয়া যাবে না। কুরআন সুন্নাহ নাই বলেই আকিদার নাম দিলাম বিদআতি আকিদা। 

১। অহেদাতুল অজুদঃ

ওয়াহদাতুল ওজুদ দুটি আরবি শব্দের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে। আরবি শব্দ ওহেদ (এক) থেকে ওহেদা/ ওয়াহদাতুল, যার অর্থ এক হয়ে যাওয়া। আরবি শব্দ ওজুদ অর্থ অস্তিত্ব। ওয়াহদাতুল ওজুদ এর শাব্দিক অর্থ হলঃ সব কিছুর (সৃষ্টি ও স্রষ্টার) অস্তিত্ব এক হয়ে যাওয়া।

গ্রীস ও হিন্দুদের বিশ্বাস থেকে জানা যায়, এই পৃথিবীতে যা কিছুর অস্তিত্ব আছে, সব দেখতে ভিন্ন ভিন্ন রকন হলেও প্রকৃতপক্ষে সবকিছু অস্তিত্ব এক। তাই স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য নেই, যিনি ‘খালিক্ব’ তিনিই ‘মাখলুক’ অর্থাৎ যা সৃষ্টি তাই স্রষ্টা। এই আক্বীদাহ বা বিশ্বাস গ্রীকদের হলেও, এই আক্বীদার উপরে সবচেয়ে বেশী আমলকারী হচ্ছে হিন্দুরা। তাদের মতে পৃথিবীতে যা আছে সবই মাবুদ। অর্থাৎ সবই সৃষ্টি এবং সবই মাবুদ। এ অর্থে কুকুর, শুকর, বানর এবং অন্যান্য নাপাক সৃষ্টিও মাবুদ হতে কোন বাঁধা নেই। সুতরাং তাদের মতে যারা মূর্তি পূজা করে তারা ঈশ্বরেরই (আল্লাহরই) ইবাদত করে (নাউযুবিল্লাহ)।  তাই তারা পৃথিবীর প্রায় সবকিছুরই পূজা করে থাকে, যেমনঃ গাছ, পাথর, মাটি, সাপ-বিচ্ছু, হনুমান, হাতী, পশু, পাখি, নদ-নদী, সমুদ্র, নারী, এমনকি পরুষের লিঙ্গেরও পুজা করে। কারন তাদের বিশ্বাস সৃষ্টির মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।

ওয়াহদাতুল ওজুদ এর বাংলা হচ্ছে  ‘সর্বেশ্বরবাদ’।  অর্থাৎ সব কিছুর মাঝেই ঈশ্বর আছেন। মুসলিমগন ঈশ্বর শব্দকে মহান আল্লাহ সমান্তারাল ব্যবহার করেনা। তাই সম্ভবত ‘সর্বেশ্বরবাদ’ শব্দটি হিন্দু ধর্ম থেকে আগত, কারন অনেক হিন্দু আছে যারা অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী। ওয়াহদাতুল ওজুদ এর ইংরেজি পারিভাষিক শব্দ হল: Pantheism. Pantheism দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত একটি হল- Pan, অন্যটি হল- Theo. Pan শব্দের অর্থ হল All বা সব আর Theo শব্দের অর্থ হল- God বা ঈশ্বর। Pantheism এর সঙ্গায় বলা হয়: The doctrine that the whole universe is God (যে মতবাদে বিশ্বের সবকিছুতেই ঈশ্বর)। ইসলাম আসার আগেই এই Pantheism মতবাদটি এথেন্সের দার্শনিকদের মধ্যে লক্ষ করা যায়।  এথেন্সের দার্শনিক জেনো কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্টোয়িক দর্শনে সর্বেশ্বরবাদ তথা Pantheism মতবাদটি ছিল বলে জানা যায়। (সূত্র: “গ্রিস দর্শন প্রজ্ঞা ও প্রসার” বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত)।

প্রচীন কাল থেকে মানবীয় যুক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান বা দর্শন দ্বারা স্রষ্টা, সৃষ্টি, স্রষ্টার প্রকৃতি, সৃষ্টির প্রকৃতি ও কর্ম ইত্যাদি নিয়ে গবেষনা করছে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিতর্ক অত্যান্ত আকর্ষনীয় হলেও কোন চুড়ান্ত সত্যে পৌছাতে পারেনি। এই ধরনের যুক্তিভিত্তিক জ্ঞান চর্চাকে ইলমুল কালাম বা যুক্তিবিদ্যা বলে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই ইলমুল কালাম বা যুক্তিবিদ্যা ছিল না। দ্বিতীয় হিজরি শতকে মুসলিম উম্মার মধ্যে গ্রীস, ভারতীয় ও পারসিকদের দর্শন প্রচার লাভ করে। মুরধারার তাবেয়ীগন ও তাদের অনুসারীগন গাইবী বিষয়ে, দর্শন বিতর্ক কঠিনভাবে অপছন্দ করতেন। কারন তারা বিশ্বাস করতেন, গায়বি বিষয় সব সময় অহীর উপর নির্ভর করে, যুক্তির উপর নয় অহীর আদেশ মেনে নেয়াই মুমিনের কাজ। ইমাম আবু হানিফা ও তার অনুসারীগন ইলমুল কালাম শিক্ষা করতে ঘোর আতত্তি করতেন। কারন গায়েবের প্রতি বিশ্বাসে কোন যুক্তি খাটে না। এ জন্যই চার মাযহাবের ইমামদের মধ্যে ফিকহি মাসলা মাসায়েলে মতপার্থক্য থাকলেও আকিদার ব্যাপারে তেমন কোন পার্থক্য পাওয়া যায় না। খুলাফায়ে রাশিদার পর মুসলিম উম্মার মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্ধের প্রভাবে মুলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জাববিয়া, কাদরিয়া, মুরজিয়া, জাহমিয়া, মুতাজিলা ইত্যাদি দল সৃষ্টি হয়ে ছিল। এই সকল দল মানবীয় যুক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান বা দর্শন দ্বারা স্রষ্টা, সৃষ্টি, স্রষ্টার প্রকৃতি, সৃষ্টির প্রকৃতি বুজার চেষ্টা করে। গ্রীস, ভারতীয় ও পারসিকদের দর্শন লুফে নেয়। চতুর্থ হিজরি শতাব্দীতে আহলে সুনআহ ওয়ালজামাতের মুলধারা আলেমগন ইলমুল কালাম বা যুক্তিবিদ্যা চর্চা শুরু করে। এই সময়কার প্রখ্যাত ইলমুল কালামবীদ আবুল হাসান আল আশআরী ও আবু মানসুর মাতুরীদীর আবির্ভাব ঘটে। আবুল হাসান আল আশআরী প্রথমিক জীবনে মুতাজিলা মতাদর্শে বিশ্বাসি ছিল। পরবর্তিতে মুতাজিলা মতাদর্শন ত্যাগ করেন এবং মুলধারার ইলমুল কালামে অনেক অবদান রাখেন। চতুর্থ হিজরি শতাব্দীর পর ইসলাম আস্ত আস্তে সুফিবাদের দিকে ঝুকতে থাকে, সাথে সাথে যুক্তিবৃত্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শন প্রসার ঘটে। ষষ্ঠ হিজরি শতাব্দীতে ভারতীয়  ‘সর্বেশ্বরবাদ’ বা গ্রীসের ‘Pantheism’ মুসলিমগন “ওয়াহদাতুল ওজুদ” নামে গ্রহন করে। তার অর্থ দাড়ায় ইসলামের প্রথম পাঁচ শতাব্দীতে “ওয়াহদাতুল ওজুদ” নামে কোন আকিদা ছিল না। ( ‘আবু হানিফা রহ. রচিত ফিকহুল আকবর বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা’, “ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ”)।

প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দনের লেখা “ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” যা কওমি মাদ্রাসার লেসাবভূক্ত। উক্ত বই-এ তিনি একটা অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন ‘সর্বেশ্বরবাদ/সর্বখোদাবাদ’। ঐ অধ্যায়ের তিনি ওয়াহদাতুল ওজুদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, মুসলিম মনীষিদের মধ্যে সর্ব প্রথম শায়েখে আকবর ইবনুল আরাবী এই মতবাদটি উদ্ভাবন করেন এবং তার অনুসাবীগণ এটির প্রচার ও প্রসার ঘটান। ইবনে আরাবী এই মতবাদটি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, সমগ্র সৃষ্টির অস্তিত্ব হবহু আল্লাহ অস্তিত্ব”।

এখানে তিনি ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’  তথা স্রষ্টা ও সৃষ্টির অস্তিত্বের ঐক্য ও অভেদত্বকেই বুঝিয়েছেন। ফারসি কবি ফরিদ উদ্দিন আত্তার, সাদরুদ্দি, নাবলুসি প্রমুখ তাদের লেখায় ইবনুল আরাবীর এই ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ মতবাদটি তুলে ধরেছেন এবং ব্যাখ্যা করেছেন। নাবলুসি  ব্যাখ্যা করে বলেন, “আল্লাহই এক মাত্র  অস্তিত্ববান সত্বা, এই দৃষ্টি কোন থেকে যে, তিনি সার্বিক সমগ্র । অন্যের দ্বারা তিনি অস্তিত্ববান নন বরং তিনি স্বকীয় সত্তায় অস্তিত্ববান। নাবলুসি এই ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ আলোকে প্রদত্ত কালিমার ব্যাখ্যাকেই বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা বলে অভিহিত করছেন। তবে আহলে সুন্নত ওয়াল জামা’আতের উলামাগর তার এ অভিমত মেনে নেয় নি। (“ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” প্রকাশণায়ঃ মাকতাবাতুল আবরার; পৃষ্ঠা -৫৪৭)

এতক্ষনে জানতে পারলাম, যে মতবাদটি ইসলামেই নেই,  সেই মতবাদটির সৃষ্ট করল কে। তাহলে চলুন জেনে নেই, কে এই ইবনে আরাবী।

 

২। ইবনে আরাবীঃ  

তার মূল নাম মোহাম্মদ এবং পারিবারিক নাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ মোহম্মদ ইবনে আলী ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আরাবী। তিনি রমজান ১৭, ৫৬১ হিজরি মোতাবেক ২৭ অথবা ২৮ জুলাই ১১৬৫ খৃষ্টাব্দে তৎকালীন আন্দালুসিয়া বা বর্তমান স্পেনের মূর্সিয়া নগরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে প্রায় ছিয়াত্তর বছর বয়সে তিনি ২২ রবিউস সানি ৬৩৮ হিজরি মোতাবেক ১০ নভেম্বর, ১২৪০ খৃষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করে। তিনি ছিলেন একজন আরব ছুফি সাধক লেখক ও দার্শনিক। তিনি সূফীবাদের মুখ্য বুজুর্গদের একজন ছিলেন, যিনি পৃথিবীর সকল সূফীদের দ্বারা সম্মানিত। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘’স্রষ্টা মানুষের মাঝেই বিদ্যমান’’।

(ইবনে আরাবী, আল-ফুতুহাত আল-মাক্কিয়াহ ২য় খণ্ড; পৃষ্ঠা নঃ ৬০৪; আব্দুর রাহমান আল-ওয়াকিল, হাযিহী হিয়া আস-সুফীয়াহ পৃষ্ঠা নঃ ৩৫; বিলাল ফিলিপস, তাওহীদের মুল নীতিমালা; পৃষ্ঠা নঃ ১৫৩)।

ছুফিতত্ত্বে তার অনবদ্য অবদানের কারনে। তিনি শাইখে আকবর মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবী নামেই সমধিক পরিচিত। আন্দালুসিয়া বা বর্তমান স্পেনের মূর্সিয়া নগরীতে জন্ম গ্রহণ করায় তাকে আন্দালুসি ও বলা হয়। তিনি দামেস্কে মৃত্যু বরণ করায় তাকে দামেস্কিও বলে ডাকা হয়। অন্যদিকে ইয়েমেনের প্রসিদ্ধ দাতা হাতেমতাই তার পূর্ব পুরুষ হওয়ায় আল হাতেমী উপনামেও তার প্রসিদ্বি রয়েছে। (শিরোনাম: আধ্যাত্মিক সম্রাট ইবনুল আরাবী, লেখকঃ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান, প্রকাশনাঃ মাসিক দ্বীন দুনিয়া)।

তিনি সংসার ত্যাগী ছিলেন। যারা মনে করে পাপের অনিবার্য ফল দোজখের শাস্তি, আর এই শাস্তি হতে মুক্তি লাভের আশায় যারা পার্থিব সুখ ও ভোগকে পরিত্যাগ করতেন, তিনি তাদের দলভুক্ত ছিলেন। পরকালে স্বর্গীয় সুখের আশায় আল্লাহর দাসত্ব করার চাইতে তিনি খোদার প্রেমে বিলীন হয়ে যাওয়ার আসায় সবকিছুকে পরিত্যাগ করেন।

খোদার সান্নিধ্যেই বেহেশ্ত এটাই তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি সিরিয়ায় তার আদর্শ প্রচার করতেন। শ্রোতারা মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনত। কেউ তার কথা বুঝত, আবার কেউ বুঝত না। সিরিয়ার তার অনেক  প্রতিপক্ষ বা শত্রু তৈরি হয়ে যায়। তাই তিনি সিরিয়া ত্যাগ করে মক্কা নগরীতে চলে আসেন। সেখানে এসে তিনি সাধনার করতে থাকেন। এবং রচনা করলেন  পুস্তক ‘ফতুহাতে মক্কী’ বা ‘মক্কার প্রত্যাদেশ’। স্রষ্টার সাথে তার সংলাপ ফতুহাতে মক্কী পুস্তকে বর্ণনা করা হয়েছে। এই পুস্তকের মাধ্যমে তিনি তার মতবাদ তুলে ধরতে সমর্থ হয়।

এবং তিনি ওয়াহদাতুল ওজুদ মতবাদ প্রচার করেন। তার এই মতবাদ সবাই মেনে নিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি মক্কা থেকে সিরিয়ার আলেপ্প্য নগরীতে ফিরে আসেন।

তার সম্পর্কে বলা হয়, মক্কায় অবস্থান কালে তিনি দাবি করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ফিরিস্তা, নবীগণ ও আউলিয়াসহ আলমে মামুরে তখতে বসে থাকতে দেখেন এবং তার দ্বারা ইলাহী রহস্য উদঘাটন পূর্বক তত্ত্বকথা লিখতে আদিষ্ট হন। অর্থাৎ তাকে লিখতে নির্দেশ দান করা হয়।  অন্য একসময় তিনি কাবা শরীফ তাওয়াফ কারা সময় এক নূরানী চেহারার যুবককে ও তার সঙ্গে তাওয়াফ করতে দেখেন এবং তিনিই তাকে অনন্ত রহস্যময় চিরশ্বত আল্লাহর আরশ দেখান।  যার পর্দা চর্ম চক্ষু ভেদ করতে পারেন। সেই চির সুন্দরেরও রুপ দর্শণ তিনি করেন। তখন তিনি মুর্ছিত হয়ে পড়েন। এবং মুর্ছাভঙ্গে আদেশ পান। যেসব স্বর্গীয় দৃশ্য তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন সেসব যেন তিনি বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেন। (নাউহজুবিল্লাহ)। তিনি সৃষ্টি মাত্রই আল্লাহর সন্ধান করেছেন ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ বা স্ববেশ্বরবাদ প্রচার করে। এই আকিদা বিশ্বাসে খালিক (সৃষ্টিকর্তা) এবং মাখলুক (সৃষ্টি) আলাদা কোন কিছু নয় বরং এক। সৃষ্টিকর্তা এবং সমগ্র সৃষ্টির অস্বিত্ব এক ও অভিন্ন, স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মাঝেই অবস্থান করেন। তিনি এই আকিদা হাজার হাজার মুসলমানদেরকে এই শিরকি মতবাদ শিক্ষা দিয়ে তাদের ঈমান নষ্ট করেছে। ইবনে আরাবী বিশ্বাস করতো স্রষ্টা মানুষের মাঝে বসবাস করে। (ইবনে আরাবী, আল-ফুতুহাত আল-মাক্কিয়াহ ২য় খণ্ড; পৃষ্ঠা নঃ ৬০৪)

তিনি হুলুলিয়্যাহ বিশ্বাসি ছিলেন। আরবীতে বলা হয়, হুলুলিয়্যাহ, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে, ‘অনুপ্রবেশবাদ’। সুফিবাদের পরের আকদা হিসাবে হুলুলিয়্যাহ আকিদা আলাদাভাবে আলোচনা করব। ইনশাআল্লাহ।

ইবন আরাবি বলেনঃ নবুয়ত কেয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে। কিতাব দেয়া নবুওয়াতের একটা বিশিষ্ট কার্যমাত্র। এটা অসম্ভব যে, আল্লাহর সংবাদ ও সৃষ্টিলোকের জন্য তার চিন্তা ভাবনা শেষ হয়ে যাবে। যদি তা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সৃষ্টিলোক বেচে থাকার শক্তি বা আহার পাবে না। মানুষের জন্য উৎকর্ষের স্তর চারটিঃ ঈমান, ওলিয়াত, নবুওয়াত ও রেসালাত। তিনি সকল ধর্মেই আল্লাহর সন্ধান করতেন। তিনি তাকলীদকে একেবারে পরিত্যাগ করেন। তিনি বলতেন, যারা বলে ইবনে হাজম এরকম বলেছেন, আহমদ এরকম বলেছেন, নোমান এরকম বলেছেন আমি নিশ্চয়ই তাদের দলভুক্ত নই।

বহু শতাব্দি কেটে গেল, তবু ইবনুল আরাবীর এসব আশ্চার্য মতবাদ নিয়ে মুসলিম ধর্ম তাত্ত্বিকদের মধ্যে বদানুবাদের শেষ হয় নাই। তার অনুসারি অনেকে বলে থাকেন, ইবনে আরাবীর দুর্ভিদ্য মতবাদ সাধারন লোকের বোধগম্য নয়। এজন্য তার মতে আস্থা রেখেও তারা সেগুলির প্রচার নিসিদ্ধ করেছেন। তবু ইবনে আরাবীর রচনাবলী মুসলিম জগতের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত গোপনে প্রকাশ্যে পড়া হচ্ছে।

ওয়াহদাতুল ওয়াজুদের আকিদা প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে সুফিদের ভুমিকা প্রায় শত ভাগ। ইবনে আরাবীর  সময়কে সুফিবাদের সেরা সময় বলা হতো। তার সময় কার অন্যতম সুফি সাধক জালালউদ্দিন রুমির (রহ) পিতার সাথে ইবনে আরবীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। এক সময় তিনি জালালউদ্দিন রুমিকে (রহ) আশীর্বাদ করেন। সে  ইবনে আরবীর একজন একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে যায়। তার (রুমির) লেখা ফারসি কাব্যগ্রন্থ “মসনবী শরীফ” কে বলা হয় ইবনে আরাবীর মতবাদের কাব্য রূপ। আমাদের উপমাদেশে ইসলাম সাধারনত দুটি ধারায় প্রচার ও প্রসার ঘটে। একটি হল, আলেম সমাজ এবং অপরটি হল, সুফিয়ায়ে কেরাম। সুফিদের দ্বারা প্রচরিত ইসলামে আজও ইবনে আরাবীর “ওয়াহদাতুল ওজুদ” এর মত কুফরি আকিদার গন্ধ খুজে পাওয়া যায়।

৬৩৮ হিজরীর ২৮ শে রবিউস সানী পবিত্র জুম্মার রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আলেপ্প্যর কাসিয়ুন পাহাড়ের পাদদেশে আল আহমার নামক স্থানে তাকে কবর দেয়া হয়। সারা পৃথিবীর সুফিবাদে বিশ্বাসীরা যারা সিরিয়ায় যান তারা তার মাজার জিয়ারত করেন।

 

৩। উপমহাদেশের আলেম সমাজ কি বলে?

আলেম সমাজের দ্বারা প্রচরিত ইসলামে ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ” এর ভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তারা “ওয়াহদাতুল ওজুদ” এর অর্থ করছেন এক মাত্র আল্লাহই অস্তিত্ববান। দুনিয়ার সকল বস্তু নিজ ক্ষমতায়  ক্রিয়াশীল হলেও, তারা আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় ক্ষমতাধীন। সত্যিকার অর্থে প্রকৃত ক্রিয়াশীল শুধু আল্লাহ তায়ালা। সব কিছুর যে অস্তিত্বে দেখি তা সবই আল্লাহ তায়ালার দানে অস্তিত্ববান। তারা “ওয়াহদাতুল ওজুদ” এর শাব্দিক অর্থ না করে এই রুপক অর্থটি ব্যবহার করছেন।

এই পরিভাষার পাশাপাশি তারা আরো একটি পরিভাষার ব্যবহার করেছেন। সেটি হল “ওয়াহদাতুল শুহুদ” যার অর্থ হল সকল অস্তিত্ববান জিনিসের মধ্যে শুহুদ তথা দৃষ্টিপাত শুধু একটি সত্তার দিকে।  দুনিয়ার যাবতীয় জিনিস বাহ্যদৃষ্টিতে বিদ্যমান। কিন্তু মূলত কিছুই বিদ্যমান নেই। অর্থাৎ পূর্ণ সত্তা গুণে কিছুই গুণান্বিত নয়। এক আল্লাহ পাকের সত্তা ছাড়া। অহদাতুশ শুহুদের সারমর্মও এটাই। অর্থাৎ বাস্তাবে বহু সত্তা বিদ্যমান থাকলেও আল্লাহর পথের পথিক এক সত্তাকেই প্রত্যক্ষ করে। আর সকল সত্তা তার সামনে অস্তিত্বহীন বলে মনে হয়।

তারা উদাহরণ বর্ণনা করেঃ রাত্রিকালে যে জোনাকী প্রদীপের ন্যায় জ্বলে, তাকে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, দিনের বেলা তুমি বাহিরে আস না কেন? জোনাকী চমৎকার জবাব দিল, আমিতো দিবানিশি মাঠে প্রান্তরেই থাকি, কিন্তু সূর্যের দীপ্তির সামনে আমার আলো প্রকাশ পায় না। সূর্যের সামনে আমি অস্তিত্বহীন তাই আমাকে দেখনা।

 

৪। অহেদাতুল অজুদ সম্পর্কে আশরাফ আলী থানভ রাহিমাহুল্লাহঃ

হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহ) ‘অহেদাতুল অজুদ এর যে ব্যাখ্যা করেছেন তা সার সংক্ষেপ হলঃ এ কথা স্পষ্ট যে, সমস্ত পূর্ণাঙ্গতা বা বৈশিষ্ট্য প্রকৃতপক্ষে একমাত্র আল্লাহ পাকের জন্যই সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে সৃষ্টজীবদের ভেতর যাকিছু ক্ষমতা বা গুণ দেখা যায়, তা তাদের নিজস্ব নয়, অন্যের নিকট হতে ধার করা। এধরণের সত্তাকে “ছায়া সত্তা” বলা হয়। সাবধান! এখানে ছায়া দ্বারা কেউ এমন ধারণা যেন না করে যে, আল্লাহ তা’আলা দেহবিশিষ্ট সত্তা, আর এই জগত তার ছায়া। এখানে ছায়া শব্দ রূপক অর্থে ব্যবহৃত করা হয়েছে যার অর্থ হল দান, আশ্রয়, কৃপা বা অনুগ্রহ। যেমন, “আমি তো হুজুরেই ছায়ায় বাস করি”।এর অর্থ ছায়া নয় আশ্রয়। এরূপে আমাদের অস্তিত্ব আল্লাহ তা’আলার মেহেরবানীর দৌলতেই বিদ্যমান। এ জন্য এটাকে ছায়া অস্তিত্ব বলা হয়। অতএব, এ বিষয়টি নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হল যে, সৃষ্টির সত্তা প্রকৃত ও মৌল সত্তা নয়, অস্থায়ী ছায়া স্বরূপ। এখন যদি ছায়া সত্তাকে গণ্য করা না হয়, তবে একমাত্র প্রকৃত বা মূল সত্তার অস্তিত্বই প্রমাণিত হবে এবং সেই সত্তাকে একক সত্তা বলা যাবে। এটাই ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ।

  এটার প্রকৃত উদাহরন হলঃ চন্দ্রের আলো সূর্যের আলো থেকে আসে। এখন যদি এই প্রতিফলিত জ্যোতিকে আলো বলে গণ্য করা না হয়, তবে সূর্য দীপ্তিময় ও চন্দ্রকে অন্ধকার বলতে হবে। এটা অহদাতুল ওজুদের উদাহরণ। আর যদি চন্দ্রের আলোকেও আলো বলে গণ্য করা হয় এবং বলা হয় যে, তার কিছু প্রভাবতো আছে, যদিও সূর্যকিরণ প্রতিভাত হওয়ার সময় উহা একেবারেই নিষ্প্রভ হয়ে যায়। এটা ওহদাতুশ শুহুদ তথা সব কিছুই আল্লাহ সত্তা বিদ্যমান সেটার স্বাক্ষ্য দেয়। মূলত ওহদাতুশ শুহুদ ও অহদাতুল ওজুদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। দু’টোরই শেষ ফল এক।

যখন মাখলুকের এই আরেযী ওজুদকে হিসেবে না ধরা হয়, তখন একমাত্র আল্লাহরই অজুদ থাকে। একেই ওয়াহদাতুল ওজুদ বা ‘হামা-উস্ত’ (তিনিই সব) বা লা-মওজুদা ইল্লাল্লাহ ( আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো অস্তিত্ব নাই) বলে। অতএব, ‘তিনিই সব’ এর অর্থ এই নয় যে, মানুষ, পশু, বৃক্ষ, পর্বত সবই খোদা বা খোদার বিশ্লেষণ ও অংশ বের হযে এইসব হয়েছে। (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)। এই অর্থ সম্পূর্ণ ভুল। এই অর্থ নিয়েই অনেক লোক কাফির ও বেদ্বীন হয়ে গেছে। শুদ্ধ অর্থ এই যে, মানুষ, পশু, পর্বত ইত্যাদির অস্তিত্ব আসল নিজস্ব অস্তিত্ব নয়, আল্লাহর দান করা অস্হায়ী অস্তিত্ব মাত্র। (তা’লিমুদ্দীন, দ্বিতীয় খন্ড)।

 

৫। সুফি ও  মুহাক্কিক আলেমদের মাঝে ব্যাখ্যাগত পার্থক্যঃ

“ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ” সম্পর্কে মুহাক্কিক উলামা মাশায়েকদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষন না নিয়ে, প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে অনেকেই শির্কে লিপ্ত হয়েছে। মহান আল্লাহ তাওহীদের  কোন জ্ঞান না থাকায়, কোন সৃষ্টির মধ্যে কোন আকর্ষনীয় গুন দেখে, তার বিরাটত্ব দেখে কিম্বা তার কোন বিষেশ শক্তি দেখে, অনেক মানুষ তাতে মুগ্ধ হয়ে প্রভাবিত হয়। তাদের দৃষ্টি আল্লাহ পর্যান্ত পৌছেনা, সৃষ্টির প্রতি নিবন্ধ থাকে, ফলে তারা শির্কে লিপ্ত হয়। সূর্য, চন্দ্র, নদী, ইদুর, গাভী ইত্যাদির পুজা করে। মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দনের লেখা “ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ” বইটিতে, ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ ও ওয়াহদাতুল  শুহুদের প্রকৃত ব্যাখ্যা করার পর বলেন, মুহাক্কিক উলামা মাশায়েকদের কৃত সঠিক ব্যাখ্যা বিপরীতে কিছু অজ্ঞ সুফি তাদের অনুসারীগর কথাটিকে আবিধানিক অর্থে গ্রহন করে কোন কোন পীর সাহেব কে আল্লাহর স্থরে পৌছেদিয়েছেন এবং পীর ও সুফিকে আল্লাহর গুনে গুনান্নিত বলে ধারনা পোষন করেতে শুরু করছে। যেমনঃ মাইজ ভান্ডারী, এনায়েতপুরী ও আঠরশি পীরের আকিদা। (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা নম্বর-৫৫০)।

এখানে পরিস্কার ভাবে উঠ এসেছে। মুহাক্কিক উলামা মাশায়েকদের কৃত সঠিক ব্যাখ্যা বিপরীতে, অজ্ঞ সুফিদের ব্যাখ্যায় বিশাল ব্যবধান। সুতারং বলতে পারি, “ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ” সম্পর্কে উপমহদেশের আলেম ও সুফিদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষন আলাদা। সুফিদের কৃত ব্যাখ্যা বিশ্লেষন ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশী কারন তাদের আমল বেশী, ইলম কম। ইলম কম থাকায় পূর্বেকৃত ইবনে আরাবীর ব্যাখ্যা লুফেনেয়। বিশেষ করে তারা “ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ” পাশাপাশি তার হুলুলিয়্যাহ (‘অনুপ্রবেশবাদ’) মতবাদটিও আকিদা হিসাবে গ্রহন করে। সূফীরা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে কোন পার্থক্য করে না, সবাই সৃষ্টি, সবাই উপাস্য। তাদের বিশ্বাস স্রষ্টা সবকিছুতেই বিরাজমান এবং মানুষের  মাঝে স্ব-সত্তায় বিদ্যমান। কোন কোন সুফি এও  বিশ্বাস করে যে,  কোন ব্যাক্তি যখন সূফীবাদের চরম উন্নতি সাধন করে তখন সে আল্লাহর মাঝে বিলীন হয়ে যায়, তাকে আর শরীয়তের বিধি-বিধান পালন করা লাগে না।

৬। অহেদাতুর অজুদ এর অন্যতম প্রবক্তা মাওলানা রুমির বক্তব্য কি?

মিনা বুক হাউজ থেকে প্রকাশিত, (প্রকাশ কাল জুন ২০১০) মসনবী শরীফএর ৩৫ পৃষ্টায অহেদাতুর অজুদ বা পুর্ণ তাওহীদ শিরনামে এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লষণ করা হয়েছে। তার প্রধান প্রধান বাক্য তুলে ধরা হল সংক্ষেপ করার দরুর অর্থের বিকৃতি বা পরিবর্তন যাতে না হয় তার প্রতি শতভাগ লক্ষরাখা হয়েছে যেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর

কিতাবের ভাষায়ঃ তাসাউফ বা সুফীবাদ তথা আধ্যাত্মিক দর্শনের একটি মৌলিক বিষয় ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ তত্ত্ব। বস্তুত তা এক অপরিহর্য কল্যায়ণময় তত্ত্ব।

ওয়াহদাতুল ওজুদ বলতে বুঝায় একমাত্র আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বই বিদ্যমান। বাহ্যিক দৃষ্টিতে কথাটা বাস্তবের বিপরীত মনে হবে। কোটি কোটি সৃষ্টির সবই অস্তিত্ত্ববান দেখা যায় কিন্তু একটি সত্যের প্রতি লক্ষ করলে এ কথা অকাট্য বাস্তব প্রমানিত হয়। আল্লাহ তায়ালা হলেন অনাদি-অনন্ত, চিরস্থায়ী অস্তিত্বের অধিকারী, আর সৃষ্টি নিতান্তই ক্ষনকালীন। তাই এগুলোর অস্তিত্ব মোটেই ধর্তব্য নয়।
মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী বলেন,

“জুমলা মাশুকাস্তও আশেক পর্দায়ে, জেন্দা মাশুকাস্তও আশেক মুর্দায়ে”

অর্থাৎ সবকিছুর অস্তিত্বই অ-ধর্তব্য, অস্তিত্ববান একমাত্র আল্লাহ তায়ালা, সৃষ্টিজগত তো শুধু বাহ্যিক দৃষ্টিতে অস্তিত্ববান। সেমতে শুধু আল্লাহ অস্তিত্ববান হওয়ার অধিকারী, আর সমস্ত সৃষ্টি জগত অস্তিত্বহীন।  
যেমনঃ কাপড়ের পর্দার উপর সুন্দর নকশা ও কারুকাজ রয়েছে, প্রকৃত পক্ষে নকশা ও কারুকাজ পর্দার নিজের গুণ নয় বরং নকশা কারকের গুন, তেমনি সৃষ্টির মধ্যে যে গুন পরিদৃষ্ট হয়, সে গুনের প্রকৃত অধিকারী হলেন আল্লাহ। সৃষ্টি শুধু সে গুন বিকাশের পাত্র। অন্য কথায় তার উপর আল্লাহর গুনের বিকাশ হয় মাত্র। আশরাফ আলী থানবীর (রহ) পীর হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মাক্কি ওয়াহদাতুল ওজুদ সম্পর্কে তার অনুভূতি ও ভাবধারা ব্যক্ত করে বলেনঃ

“যে দিকে যে বস্তুর প্রতিই দৃষ্টি করি, তাতে তোমাকেই দেখতে পাই, অন্য আর কিছু দেখিনা।”
কিতাবে লেখা হয়েছেঃ তাই মাওলানা রুমীর কবিতার ব্যাখ্যা এভাবে করা যায়ঃ “সর্বত্রই মহান প্রেমাস্পদ আল্লাহ তায়ালার বিকাশ। আর সৃষ্টি সবই পর্দাস্বরূপ। সে হিসেবে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান।”

ওহাহদাতুল ওজুদ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে মানুষ, এরূপ হয়ে যায় সে শুধু আল্লাহকেই দেখে। তার দৃষ্টিতে নিজের গুণ-গরিমা থাকেনা, এমনকি নিজের সত্তাও তার দৃষ্টিতে থাকে না। যেমন আয়নার ভিতরে আলো জ্বলতে দেখলে দূর থেকে শুধু আলোই দেখা যায় আয়না দেখা যায়না তদ্রূপ একটি স্বচ্ছ কাচের গ্লাসে পানি পূর্ন থাকলে পানি দেখা যায়, গ্লাসের কাচ দেখা যায় না।

 এভাবে ওয়াহদাতুল ওজুদ বিশ্বাসের প্রভাবে মানুষ এক হয়ে যায়, তার নিজের গুন-গরিমা এমনকি অস্তিত্বেও আল্লাহ তায়ালার গুনাবলীর বিকাশ এতই প্রকট হয়ে যায় যে নিজের গুন-গরিমার সাথে সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে পড়ে এবং নিজের কিঞ্চিতকর অস্তিত্ব তার দৃষ্টিতে ধরাই পড়ে না। তার দৃষ্টি শুধু আল্লাহর প্রতিই নিবদ্ধ থাকে। এ ভাবাবেগের সম্মুখে দর্বল শ্রেণীর কোন মানুষ নিজের অস্তিত্ব অস্বীকার করে আনাল হক বা আমি খোদা উক্তি করে বসে। অর্থাৎ আমি এবং আমার সব কিছু আল্লাহ তায়ালার গুনাবলীতে বিকাশ মাত্র। আমি আমার মত ধর্তব্যের কিছু নয়। সে ঐ গুনাবলির বিকাশ পাত্র হয়ে থাকলেও স্বচ্ছ কাচের গ্লাসের মত পরিদৃষ্ট নয় তাতে শুধু পানিই দেখা যায়।  হুসেইন বিন মনসূর হাল্লাজের ‘আনাল হক’ বলার তাৎপর্য এটাই।

মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী বলেনঃ  মনসূর হাল্লাজ ‘আমি খোদা’ বলে আল্লাহর পাগল সাব্যস্ত হয়েছিল, আর ফেরাউন ‘আমি খোদা’ বলে ধ্বংশ হয়েছে। প্রথম ‘আনাল হক বা আমি খোদা’ আল্লাহর রহমত অনুগ্রহ করুনা; এর ভিত্তিছিল আল্লাহর তাবেদারীতে বিলীনতা। আর দ্বিতীয় ‘আনাল হক বা আমি খোদা’ উক্তিকারির উপর আল্লাহর লানত অভিশাপ। কারন, এর ভিত্তি আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকারের উপর।

লেখক আরো লিখেনঃ শির্কি আকিদা ও ভাবধারা এবং শির্কি অর্খ ছাড়া অন্য ভাল অর্থে এমন উক্তি করা, যার শির্কি অর্থ সুস্পষ্ট,  তা দ্বারা আখেরাতে কাফির সাব্যস্ত না হলেও বড় গুনাহএমনকি ক্ষেত্রবিশেষ, কাজীর বিচারে সে কাফির বা মুর্তাদ বিবেচিত হয়ে যাওয়ায় তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রয়োগ করতে পারে।

 

৭। তত্কালিন আলেম সমাজ ও উপমহাদেশের আলেম সমাজের মধ্যে পার্থক্য হলঃ

মনসূর হাল্লাজ ‘আমি খোদা’ বলে, একটি চরম শির্কি কথা উচ্চারন করছেন। এমন উক্তি করা যে, শির্কি তাতে কোন সন্দেহ করাও কুফরি। তাই তো, এ কারনে তত্কালীন সময়ে এই ধারণা গড়ে উঠে যে, তিনি খোদাত্ব দাবি করছেন। যেহেতু আনাল হক (প্রকৃত সত্য) মহান আল্লাহর একটি নাম। আরেকটি চরম বিতর্কের তৈরী হয় যখন তিনি (মানসুর হাল্লাজ) দাবি করেন যে, “আমার পাগড়িতে শুধু খোদা ছাড়া আর কোনো কিছুই প্যাঁচানো নেই” এবং একই ভাবে তিনি তার জামার দিকে ইশারা করে বলেন যে,  “আমার জামার ভিতরে খোদা ছাড়া আর কেউ নেই”। এই ধরনের কথা উচ্চারণের কারণে তিনি লম্বা বিচারকার্যের সম্মুখীন হন এবং দীর্ঘ ১১ বছর বাগদাদ নগরে কারাবাস করেন। অবশেষে উনাকে ৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে মার্চ জনসমক্ষে তত্কালীন সরকারি বিচারকদের নির্দেশে হত্যা করা হয়। তাহলে  বুঝতে পারলাম মনসূর হাল্লাজের ‘আনাল হক্ক’ বা আমি খোদা’ একটি চরম শির্কি কথাএ ব্যাপারে তত্কালিন আলেম সমাজ ও আমাদের উপমহাদেশের আলেম সমাজের ফাতওয়া একই। তত্কালিন আলেম সমাজ মনসূর হাল্লাজের ‘আনাল হক্ক’ বা আমি খোদা’ কথাটিকে আল্লাহর সাথে চরম বেয়াদবি হিসাবে গন্য করে এবং তারা তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। উপমহাদেশের আলেম সমাজের মতে কথাটি আল্লাহর সাথে চরম বেয়াদবি এতে কো সন্ধেহ নেই। তবে, সে যেহেতু নিজেকে আল্লাহতে বিলীন করে বা নিজের অস্বিত্ত্বকে অস্বীকার করে বলেছেন। তাই মানুষের বিচারে অপরাধী হলেও আল্লাহর দরবারে কোন অপরাধ নেই। মনসূর হাল্লাজের ‘আনাল হক্ক’ বা আমি খোদা’ বলা আর ফিরআউনের ‘আনাল হক্ক’ বা আমি খোদা’ বলার মধ্যে তত্কালিন আলেম সমাজ কোন পার্থক্য করেনি। উপমহাদেশের আলেম সমাজের মতে, ফিরআউনের ‘আনাল হক্ক’ বা আমি খোদা’ বলেছিল আল্লাহতায়ালাকে অস্বীকার করে, মনসূর হাল্লাজের ‘আনাল হক্ক’ বা আমি খোদা’ বলার আমিত্ব অস্বীকার করে নিজে সত্তা ও গুনাবলি সব আল্লাহর অর্থে। মনসূর হাল্লাজ আখেরাতে কাফির হওয়ার দোষ থেকে সম্পুর্ন মুক্ত কারন শুধু ভাল অর্থই তার উদ্দেশ্য ছিল। তা হচ্ছে আমি ও আমার সব কিছু আল্লাহর অসীম কুদরতের বিকাশ

সুফিরা আরো এগিয়ে বলে, কোন ব্যাক্তি যখন সূফীবাদের চরম উন্নতি সাধন করে তখন সে আল্লাহর মাঝে বিলীন হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালার গুনাবলীর বিকাশ এতই প্রকট হয় যে তার যে নিজের গুন-গরিমা এমনকি অস্তিত্বে ক্ষীণ হয়ে পড়ে এবং নিজের কিঞ্চিতকর অস্তিত্ব তার দৃষ্টিতে ধরাই পড়ে না। ফলে সে ‘আনাল হক্ক’ এর মত কুফরি কথা বলে এবং এতে দোষের কিছু নেই।

 

৮। এই আকিদা সম্পর্কে ইসলাম কি বলে?

সুফিদের এইসব কথা ইসলাম বহির্ভূত কারন ইসলামের প্রধান উত্স কুরআন ও হাদিস, যেখানে এই ধরনে কোন উটভট কথার নজির খুজে পাওয়া যাবেনা। ইসলামি শরীয়ত বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে যারা এই উম্মতের শ্রেষ্ট অলী হয়েছেন এবং জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন, সেই সব সাহাবিদের (রাজিঃ) জীবনে ভাবাবেগের কোন টাড়না সৃষ্টি হয়নি। ‘আনাল হক্ক’ এর মত কুফরি বাক্য মুখে নেন নি। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, এই সব নামধারী সুফিরা কি সাহাবিদের (রাজিঃ) চেয়েও শ্রেষ্ট!

তাহলে একনজর দেখি মহার আল্লাহ এসম্পর্কে কি বলেন। আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলে,:

اللَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلاَ نَوْمٌ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ 

অর্থঃ আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোন মাবুদ নাই। তিনি চিরঞ্জীব, স্ব-প্রতিষ্ঠিত বিশ্বধাতা। তাকে স্পর্শ করে না তন্ত্রা, না নিদ্রা। আসমান এবং জমিনে যা কিছু আছে সব তারই। (সুরা  বাকারা ২:২৫৫)।

আল্লাহ রব্বুল আলামিন আরও বলেন,

هُوَ الأَوَّلُ وَالآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

অর্থঃ তিনিই আদি, তিনিই অন্ত, তিনিই প্রকাশ্য, তিনিই গুপ্ত। তিনিই সর্ব বিষয়ে সম্মক জ্ঞাত। (সুরা হাদিদ ৫৭:৩)।

আল্লাহ রব্বুল আলামিন আরও বলেন:

كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلاَّ وَجْهَهُ لَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

অর্থঃ তাঁর সত্তা ব্যতীত সব কিছুই ধ্বংসশীল। (সূরা আনকাবুত-৮৮)।

আল্লাহ রব্বুল আলামিন আরও বলেন:

قُل لِّمَنِ ٱلۡأَرۡضُ وَمَن فِيهَآ إِن ڪُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ (٨٤) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ‌ۚ قُلۡ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ (٨٥) قُلۡ مَن رَّبُّ ٱلسَّمَـٰوَٲتِ ٱلسَّبۡعِ وَرَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِيمِ (٨٦) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ‌ۚ قُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ (٨٧) قُلۡ مَنۢ بِيَدِهِۦ مَلَكُوتُ ڪُلِّ شَىۡءٍ۬ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيۡهِ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ (٨٨) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ‌ۚ قُلۡ فَأَنَّىٰ تُسۡحَرُونَ (٨٩) 

অর্থঃ তাদেরকে জিজ্ঞেস করোঃ যদি তোমরা জানো তাহলে বলো এ পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা বাস করে তারা কার (অধিনে)? তারা নিশ্চয় বলবে, আল্লাহর। বলো, তাহলে তোমরা সচেতন হচ্ছো না কেন?

তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, সাত আসমান ও মহান আরশের অধিপতি কে? তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ।  বলো, তাহলে তোমরা ভয় করো না কেন? 

তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, বলো যদি তোমরা জেনে থাকো, কার কর্তৃত্ব চলছে প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর? আর কে তিনি যিনি আশ্রয় দেন এবং তাঁর মোকাবিলায় কেউ আশ্রয় দিতে পারে না? তারা নিশ্চয়ই বলবে, এ বিষয়টি তো আল্লাহরই জন্য নির্ধারিত। বলো,তাহলে তোমরা বিভ্রান্ত হচ্ছো কোথায় থেকে? (সুরা মুমিনুন ২৩:৮৪-৮৯)।

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেনঃ

 وَٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦۤ ءَالِهَةً۬ لَّا يَخۡلُقُونَ شَيۡـًٔ۬ا وَهُمۡ يُخۡلَقُونَ وَلَا يَمۡلِكُونَ لِأَنفُسِهِمۡ ضَرًّ۬ا وَلَا نَفۡعً۬ا وَلَا يَمۡلِكُونَ مَوۡتً۬ا وَلَا حَيٰوةً وَلَا نُشُورً۬ا (٣) 

অর্থঃ তবুও তারা তাঁকে ছেড়ে অন্য উপাস্য গ্রহণ করেছে যারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না বরং ওরা নিজেরাই সৃষ্ট হয়েছে। ওরা নিজেদের অপকার বা উপকার করার ক্ষমতা রাখে না। মৃত্যু, জীবন ও পুনরুত্থানের উপরে তাদের কোন ক্ষমতা নাই। (সুরা ফুরকান ২৫:৩)।

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেঃ:

إِنَّ هَـٰذَا لَهُوَ ٱلۡقَصَصُ ٱلۡحَقُّ‌ۚ وَمَا مِنۡ إِلَـٰهٍ إِلَّا ٱللَّهُ‌ۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ (٦٢) 

অর্থঃ নিঃসন্দেহে এটাই হলো সত্য ভাষণ। আর এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। আর আল্লাহ, তিনিই হলেন পরাক্রমশালী মহাপ্রাজ্ঞ।  (সুরা ইমরান ৩:৬২)।

আল্লাহ রব্বুল আলামিন আরও বলেনঃ

وَلَٮِٕن سَأَلۡتَهُم مَّنۡ خَلَقَ ٱلسَّمَـٰوَٲتِ وَٱلۡأَرۡضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡعَلِيمُ (٩) 

অর্থ: তোমরা যদি এসব লোকদের জিজ্ঞেস করো, যমীন ও আসমান কে সৃস্টি করেছে, তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, ঐগুলো সেই মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী সত্তা সৃষ্টি করেছেন৷  [জুকরূক-৪৩:৯]

আল্লাহ রব্বুল আলামিন আরও বলেনঃ

قُلْ مَن يَرْزُقُكُم مِّنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ أَمَّن يَمْلِكُ السَّمْعَ والأَبْصَارَ وَمَن يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيَّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ الأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللّهُ فَقُلْ أَفَلاَ تَتَّقُونَ

অর্থঃ তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, “কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিযিক দেয়? এই শুনার ও দেখার শক্তি কার কর্তৃত্বে আছে? কে প্রাণহীন থেকে সজীবকে এবং সজীব থেকে প্রাণহীনকে বের করে? কে চালাচ্ছে এই বিশ্ব ব্যবস্থাপনা? তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ৷ বলো, তবুও কি তোমরা (সত্যের বিরোধী পথে চলার ব্যাপারে) সতর্ক হচ্ছো না? (সুরা ইউনুস ১০:৩১)।

এমনিভাবে শত শত আয়াতে মহান আল্লাহ তার একক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করছেন। যেখানে বান্দা এবং আল্লাহর মাঝে বিরাট পার্থক্য করা হয়েছে। কারন মানুষ হল সৃষ্টি আর মহান আল্লাহ হলেন তাদের স্রষ্টা।  তাদের মাঝে ষ্পষ্ট আকাশ পাতালে পার্থক্য। এবং একথা সুস্পষ্ট প্রমানিত যে, আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র সত্বা, যিনি আদি, এবং অনন্ত। তিনি তন্দ্রাও যান না, যান না নিদ্রাও। সব কিছুই ধ্বংস হবে কিন্তু ধ্বংস হবে না আল্লাহ তায়ালার সত্বা। তাহলে কি দাঁড়াল? আল্লাহ তায়ালা ছাড়া সকল সৃষ্টির বিদ্যমানতা নশ্বর। একমাত্র অবিনশ্বর হলেন মহান রাব্বুল আলামীন। আর পৃথিবীতে যা কিছু আছে এগুলোর অস্তিত্বও আছে কেবল আল্লাহর ইচ্ছায়। তিনি যদি চান তাহলে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। সৃষ্টির নিজ ই্চ্ছায় বেঁচে থাকার কোন ক্ষমতা নেই। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর অস্তিত্বের জন্য তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। বাকি সবই ধ্বংসশীল। তাহলে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের বিপরীতে বাকি সকল সৃষ্টির অস্তিত্ব যেন নেই। এক জন কাফির যখন ইসলাম গ্রহন করে মুসলিম হন, তখন তাকে নিম্মের কলেমাটি পড়তে হয়।  

  أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُوَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ

যার অর্থঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোন উপাস্য (ইবাদাত পাওয়ার যোগ্য) নাই। মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।

ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য দেখুন, ইসলাম গ্রহন সময়ই ব্যাপারটি ষ্পষ্ট করে দেন, সৃষ্টি ও স্রষ্টা মাঝে বিশাল পার্থক্য। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষই যদি তার সৃষ্ট বান্দা বা দাস হন। তবে সাধারণেন অবস্থাতো আরও করুন। কাজেই অহেদাতুল অজুদে বা সর্বেঈশ্বরবাদের আকিদা কুফরি আকিদা তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ আকিদাটি আলোচনা করতে গিয়ে, সেই সময়কার তিন জন প্রখ্যাত সুফির নাম ঘুরে ফিরে বার বার আলোচনায় এসেছে। এদের মধ্যে এক জনের (ইবনে আরাবী) জীবনি আলোচনা হয়েছে। বাকি দুজন,  হুসেইন বিন মনসূর হাল্লাজের ও মাওলানা জালালুদ্দীন রুমীর জীবনি পাঠকদের  এই বইয়ের সপ্তম অধ্যায় আলোচনা করব।  

 বিদআতীদের আকিদা হলোঃ মহান আল্লার তার সৃষ্টির মধ্যে ‘হুলুল’ করে অর্থাৎ প্রবেশ করেন।

সঠিক আকিদা হলোঃ মহান আল্লাহর সাথে তার সৃষ্টির কোন তুলনা করা শির্কি, তিনি এই হুলুল বিশ্বাস থেকে পরিত্র।

সঠিক আকিদার দলীলঃ 

সুফিরা “হুলুল” বা ‘অনুপ্রবেশবাদ’ কি?

ইবনে আরাবী ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ আকিদার মত এই হুললিয়্যাহ আকিদার বিষ বাস্প মুসলিমদের মাঝে প্রচার করে। আরবীতে বলা হয়, হুলুলিয়্যাহ, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে, ‘অনুপ্রবেশবাদ’। হুলুল কথাটির সাধারণ ব্যাখ্যা হচ্ছেঃ আল্লাহ কোনো কিছুর মধ্যে ‘হুলুল’ করে অর্থাৎ প্রবেশ করেন। এই মতবাদ প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মাঝে বিদ্যমান, তবে বিশেষ করে খৃষ্টানদের মাঝে এই আক্বীদাহ লক্ষ্য করা যায়। খ্রীস্টানরা মনে করে আল্লাহ ঈসা আলাইহিস সালাম এর মধ্যে প্রবেশ করে এক হয়ে গেছেন। এই কারণে হুসাইন বিন মানসুর হাল্লাজ নামে একজন পথভ্রষ্ট সূফী যখন বলেছিল, আনাল হক্ব (আমিই আল্লাহ)। তখন এই কথাটিকে খৃষ্টানরাই বেশী পছন্দ করেছিল, কারণ এই কথার সাথে তাদের আক্বীদার মিল ছিলো। জালালুদ্দিন রুমিও হুলুল আকিদায় বিশ্বাসি ছিলেন। এই জন্য তিনি তার মছনবী শরীপে হুসাইন বিন মানসুর হাল্লাজ প্রসংশাসহ ঊল্লেখ করেছেন। যিনি হুলুল বা মানুষে ঐশীরুপ দেখেছেন। এবং বিশ্বাস করেছেন যে, ইলাহীয়তে বা ঐশী সত্তার বিকাশ স্ফুরন হয় আদামিয়াত বা মানবত্বে। তিনি আদম আলাইহিস সালাম কে সর্বপ্রথম আল্লাহর শারীরিক বিকাশ হিসাবে ধরেছেন। আরও বলেন, মানবীয় দৈহিক সত্তায় ঐশী সত্তার পূর্ণতম প্রকাশই আল্লাহর এক চিরন্তন রহস্য। এই ধরনের কথা উচ্চারণের কারণে তিনি লম্বা বিচারকার্যের সম্মুখীন হন এবং দীর্ঘ ১১ বছর বাগদাদ নগরে কারাবাস করেন. অবশেষে উনাকে ৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে মার্চ জনসমক্ষে তত্কালীন সরকারি বিচারকদের নির্দেশে হত্যা করা হয়।

সুফিদের মতেঃ মানবীয় দৈহিক সত্তায় ঐশী সত্তার পূর্ণতম প্রকাশই আল্লাহর এক চিরন্তন রহস্যের মানুষের মাঝে নিজেরই মধুরতম বিকাশ বাসনার খেয়ালে সৃষ্টি লোকের সম্ভব হয়েছে। আল্লাহর দীদার বা দর্শন অশরীরী অবস্থায় সম্ভব নয় এবং রমনী রুপে আল্লাহর বিকাশই সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ। (নাউজুবিল্লাহ)

কিছু পথভ্রষ্ট অজ্ঞ বাতিলপন্থি সুফি ব্যতিত কোন সাধারন মুসলিম হুলুলিয়্যায় বিশ্বাস করা না। এই জন্যই সুফিরা ফানাফিল্লায় বিশ্বাস করে। আল্লাহর ধ্যান আর আরাধনার মাধ্যমে আল্লাহয় বিলিন হয়ে যাওয়া। আল্লাহয় বিলিন হতে পারলে তার আর ইবাদাত প্রয়োজন হয় না। অথচ মুহম্মাদ সাল্লল্লাহু আলাইহিওয়া সল্লাম ধ্যান আর আরাধনার মাধ্যমে আল্লাহয় বিলিন হতে পারলেন না। তিনি মৃত্যুর পুর্বক্ষণ পর্যান্ত সালাত আদায় করছেন। তাই আলেমদের মতে, এই আকিদা একটি শির্কি আকিদা। বিশ্বাস কারি মুশরিক এতে কোন সন্দেহ নেই।

বিদআতি আকিদা হলোঃ ফানাফিল্লার বা আল্লাহয় বিলীন হওয়ায় বিশ্বাস করা।

সঠিক আকিদা হলোঃ মহান আল্লাহ সাথে এই সকল বাক্য যোগ করা শির্ক, মহান আল্লাহর মাঝে কেউ বিলীন হতে পারে না।

সঠিক আকিদার দলীলঃ

অনেক বিদআতিকে বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকে বুঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়িভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। ফানা ফিল্লাহ এবং বাকাবিল্লাহ হচ্ছে সুফি সাধনার সর্বোচ্চ স্তর। এ স্তরে সুফি নিজের ব্যক্তিগত চেতনা মুছে দিয়ে ঐশী চেতনায় উন্নিত হন। ব্যক্তিগত চৈতন্য খোদার ধ্যান ও প্রেমে সমাহিত হয়। তাই আত্মচেতনার অবলুপ্তিকেই বলা হয় ফানা। ফানার শেষ পর্যায়ে শুরি হয় বাকার বাকার প্রাথমিক পর্যায়। এ স্তরে সুফী সাধক আল্লাহর চিরন্তন সত্তার অবস্থান করেন। যেহেতু সুফিদের বিশ্বাস আল্লাহ নিরাকার। তাই তার মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। তাসাউফের দর্শণ অনুযায়ী এই সাধনাকে তরিকাকে আল্লাহ প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি দর্শন অনুযায়ী সুফি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন সুফির অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। যখন তারা ফানাফিল্লাহর স্থরে পৌছে যায় তখন আর তাদের ইবাদাত করার প্রয়োজন হয়না। তারা সুরা হিজরের ৯৯ নং আয়াতের রেফারেন্স দেয়। এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,

 وَٱعۡبُدۡ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأۡتِيَكَ ٱلۡيَقِينُ (٩٩)

অর্থঃ এবং যে চূড়ান্ত সময়টি (মৃত্যু) আসা পর্যন্ত নিজের রবের বন্দেগী করে যেতে থাকো৷ (সুরা হিজর-৯৯)।

সুফিদের অনুবাদ,  ইয়াকিন আসা পর্যন্ত নিজের রবের বন্দেগী করে যেতে থাকো”৷ তাদের দাবি যখন তারা ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হরে তখন তাদের ইয়াকিন এসে যায়।  তাই ইয়কির আসলে তারা আল্লাহর নির্দেশ মত ইবাদাত ছেড়ে দেয়।  (নাউজুবিল্লাহ)।

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন এ্যারাবিক লিটারেচার, ইসলামিক হিস্টরী এন্ড ইসলামিক স্টাডিস)

Leave a comment