মৃতের কাযা সালাতের জন্য কাফ্ফারা আদায় করার বিধান

হানাফি মাজহাবের একটি ফতওয়ার কিতাবের রেফারেন্সে বলা হলঃ

যদি মৃত ব্যক্তি তার সম্পদ থেকে তার নামাযের কাফফারা আদায়ের জন্য অসিয়ত করে যায়, আর তার নিজের মালও ছিল। তাহলে তার এক তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে কাফফারা আদায় করতে হবে। আর যদি তার কোন সম্পদ না থাকে, বা সে মাল রেখে গেছে কিন্তু কোন কাফফারা আদায়ের অসিয়ত করে যায়নি। তাহলে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কাফফারা আদায় করা আত্মীয়দের উপর জরুরী নয়। তবে স্বজনদের কাফফারা আদায় করে দেয়াই উত্তম। এর দ্বারা মৃত ব্যক্তি শান্তি পায়।

কাফফারার পরিমাণ হল, প্রতিদিন বিতরসহ ছয় ওয়াক্ত নামায হিসেব করে প্রত্যেক ওয়াক্তের জন্য পৌনে দুই সের গম বা আটা অথবা এর বাজার মূল্য গরীব মিসকিনকে মালিক বানিয়ে দিতে হবে। অথবা প্রতি ওয়াক্তের বদলে একজন গরীবকে দুই বেলা তৃপ্তি সহকারে খানা খাওয়াতে হবে। (ফতাওয়া শামী-২/৭২, লিখেছেনঃ লুৎফুর রহমান ফরায়েজী, পরিচালক, তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা)।

মুসলিম ইচ্ছা করে সালাত কাযা করবে ভাবা যায় না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে সালাত কাযাতো দুরের কথা প্রকাশ্য মুনাফিকও সালাতের জামাত ত্যাগ করার সাহস পেত না। কিন্তু ওজরের কারনে সাহাবীদেরও সালাত কাযা হয়েছে। যেমনঃ

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খন্দকের যুদ্ধকালে এক সময় উমর (রাঃ) কুরাইশ কাফিরদের ভর্ৎসনা করতে লাগলেন এবং বললেন, সূর্যাস্তের পূর্বে আমি আসরের সালাত আদায় করতে পরি নাই। তারপর আমার বুতহান উপত্যকায় উপস্থিত হলাম। সেখানে তিনি সূর্যাস্তের পর সে সালাত আদায় করলেন, তারপরে মাগরিবের সালাত আদায় করলেন। (সহিহ বুখারী ৫৭১ ইফাঃ)।

যদি কারও সালাত কাযা হয তা সাথে সাতে আদায় করাই সুন্নাহ সম্মত। সহিহ হাদিসে এসেছে সালাতের কাফফারার প্রয়োজন নাই। যেমনঃ

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যাক্তি সালাতের কথা ভুলে যায়, স্মরণ হওয়া মাত্র সে তা আদায় করে নেবে। এর কোন কাফফারার প্রয়োজন নেই। বরং আদায় করাই কাফফারা। কাতাদা (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, أَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي “আমার স্মরণে সালাত কায়েম কর। (সহিহ মুসলিম হাদিস নম্বর ১৪৩৯ইফাঃ)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন কাফফারা নাই আর আমরা বুঝলাম আছে। কাজেই যারা সালাতের কাফফারার কথা বলেন তাদের কথায় কর্নপাত করার দরকার নাই।

এ কথা সুস্পষ্ট হয় যে, মরণের সময় অথবা পরে বেনামাযী অথবা কিছু নামায ত্যাগকারীর তরফ থেকে নামায-খন্ডনের উদ্দেশ্যে রাকআত হিসাব করে কাফফারা স্বরূপ কিছু দান-খয়রাত ইত্যাদি করা নিরর্থক ও নিষ্ফল। বরং এই উদ্দেশ্যে পাপ-খন্ডনের ঐ অনুষ্ঠান ও প্রথা এক বিদআত।

(মুয়াত্তা ইমাম মালেক -২৯৬ পৃষ্ঠা, আহ্‌কামুল জানাইয, আলবানী ১৭৪, ২৭৫ পৃষ্ঠা, মুজামুল বিদা’ ১৬৪ পৃষ্ঠা)।

অনেক আলেম মনে করেন বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃত নামায ছেড়ে দিলে তার কাযা হয় না। কাযা হবে ওজরের কারনে সালাত ত্যাগ করলে। তাদের দাবি হল, বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃত সালাত ছেড়ে দিলে বা সুযোগ ও সময় থাকা সত্ত্বেও না পড়ে অন্য ওয়াক্ত এসে গেলে পাপ তো হবেই। পরন্তু সে সালাতের আর কাযা নেই। পড়লেও তা গ্রহণযোগ্য নয়। (কারণ এমন দৃষ্টান্ত, সাহাবায়ে কেরামগণ হতে প্রমাণিত নেই) বিনা ওজরে যথাসময়ে সালাত পড়ে অন্য সময়ে কাযা পড়ায় কোন লাভ নেই। বরং যে ব্যক্তি এমন করে ফেলেছে তার উচিৎ, বিশুদ্ধচিত্তে তওবা করা এবং তারপর যথাসময়ে নামায পড়ায় যত্নবান হওয়ার সাথে সাথে নফল নামায বেশী বেশী করে পড়া। (মুহাল্লা, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/২৪১-২৪৩, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ৭৮পৃ:, ১নং টীকা, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৫/৩০৬, ১৫/৭৭, ১৬/১০৫, ২০/১৭৪, মিশকাত ৬০৩ নংহাদীসের আলবানীর টীকা দ্র:)

প্রশ্ন হলঃ কেউ সালাত কাযা করে মারা গেলে তার বিধান কি?

যদি কেউ মারা যায়, আর জিম্মায় কোন ফরয নামায কিংবা একাধিক ফরয নামায বাকি থাকে, সেই ক্ষেত্রে তার এই নামাযের কাযা বা কাফফারার বিধান ইসলামে নেই। কেননা ইবাদাতের বেলায় নিয়ম হলো, কোন প্রতিনিধির দ্বার কোন ইবাদত আদায় করা জায়েয নেই। তবে হ্যাঁ শরীয়ত যেখানে প্রতিনিধির দ্বারা ইবাদত শুদ্ধ হওয়ার কথা প্রমাণিত আছে, একমাত্র সেই ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য হবে। যেমন হজ্জ বা মান্নাত রোযা। কিন্তু ফরজ সালাতের  বিষয়ে প্রতিনিধি বা কাফফারা দিয়ে আদায় হওয়ার বিষয়ে কোন প্রমাণ কুরআন বা হাদীসে বর্ণিত হয়নি। সালাত কখনই মাফ হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত তার হুঁশ জ্ঞান ঠিক থাকে। এমন অসুস্থ যে তার হুঁশ-জ্ঞান নাই, তখন তার সালাত এমনিতেই মাফ। কারন কাযা আদায় করার সময় ও সুযোগ না পেলে কোন পাপ হবে না। ধরূন কোন ব্যক্তির কাযা সালাত আদায় করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু পার নাই। কাযা আদায়ের পূর্বে হঠাৎ তিনি মারা গেলেন। তার কি হবে? মহান আল্লহ বলেন,

لاَ يُكَلِّفُ اللّهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا

অর্থঃ আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না। (সুরা বাকার ২:২৮৬)।

তাই যে ব্যক্তি বীনা ওজরে সালাত আদায় না করে মারা গেল, তার জন্য দোয়া, ইস্তেগফার করবে, তার কোন অসিয়ত থাকলে তা আদায় করবে, তার বন্ধু-বান্ধবের এবং আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়ন করবে। পিতা-মাতার জন্য সন্তানের প্রধান দায়িত্ব হলো, দোয়া করা, এবং সদকায়ে জারিয়া, বা ওয়াকফ জাতীয় দান করা। কারণ,  আবু হুরায়রা (রাঃ), নবী করীম (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, নবী (সাঃ) বলেন, “মানুষ যখন মারা যায়, তখন সমস্ত আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের দরজা বন্ধ হয়না। সাদকায়ে জারিয়া, যদি এমন সন্তান রেখে যায়, যে পিতার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবে, যদি এমন দ্বীনি শিক্ষা রেখে যায়, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। [সহিহ মুসলিম ৪৩১০]

এত গেলে মৃত ব্যক্তির বিধান। জীবিত কোন ব্যক্তি যদি অজ্ঞতার কারনে বা অলসতার করানে সালাত আদায় না করে থাকে, তবে তার কি করতে হবে?

আমাদের সমাজে অনেক আলেম বলে থাকেন যে, বহু দিনের কাযা সালাত তাকে আদায করতে হবে। প্রতি ওয়াক্তে এক এক ওয়াক্তের সালাত কাযা করতে হবে। তারা এর নাম দিয়েছেন উমরী কাযা। কারণ হাদিসে উমরী কাযা বলে কোন সালাতের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কাজেই সালাত ত্যাগ কারির একমাত্র বিধান খাটি মনে তওবা করা। উমরী বলে শরীয়তে কোন নামায নেই। এই বিধায় পালন করা বিদআত। অবশ্য এই তওবাকারী ব্যক্তির উচিৎ, বেশী বেশী করে নফল সালাত আদায় করতে হবে। কারন তার ফরজের ঘারতি নফল দ্বারা আদায় করা হবে।

একটি সহিহ হাদিসে উল্লখ আছে, আনাস ইবনু হাকীম আদ-দাব্বী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, তিনি যিয়াদ অথবা ইবনু যিয়াদের ভয়ে মদ্বীনায় চলে আসেন এবং আবূ হুরায়রা (রাঃ) এর সাথে সাক্ষাত করেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) আমাকে তাঁর বংশ-পরিচয় প্রদান করেন এবং আমি আমার পরিচয় প্রদান করি তিনি আমাকে বলেনঃ হে যুবক! আমি কি তোমার নিকট হাদীছ বর্ণনা করব না? জবাবে আমি বললাম, হ্যা। আল্লাহ্ আপনার উপর রহম করুন। রাবী ইউনুস বলেনঃ আমি মনে করি তিনি এই হাদীছটি সরাসরি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন লোকদের আমলসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম তাদের নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে তিনি বলেনঃ আমাদের মহান রব ফিরেস্তাদের বান্দার নামায সম্পর্কে স্বয়ং জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও জিজ্ঞাসা করা হবে। করবেন, দেখতো সে তা পূর্ণ রূপে আদায় করেছে না তাতে কোন ক্রটি আছে? অতঃপর বান্দার নামায পরিপূর্ণ হলে তা তদ্রুপই লিখিত হবে। অপর পক্ষে যদি তাতে কোন ক্রটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয় তবে তিনি (রব) ফেরেস্তাদের বলবেনঃ দেখতো আমার বান্দার কোন নফল নামায আছে কি? যদি থাকে তবে তিনি বলবেনঃ তোমরা তার নফল নামায দ্বারা তার ফরয নামাযের ক্রটি দূর কর। অতঃপর এইরূপে সমস্ত ফরয আমলের ক্রটি নফল দ্বারা দূরীভূত করা হবে। হাদিসের মানঃ সহিহ সূনান আবু দাউদ ইফাঃ, অধ্যায়ঃ সালাত হাদিস নম্বরঃ ৮৬৪, তিরমিযী-৩৩৭, ইবনে মাজাহ-১১৭, সহিহ তারগিব ১/১৮৫)

মন্তব্যঃ এক কথায় বলা যায় মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার কাযা করা সালাতের কোন কাফফারা দিতে হবে না। মৃত ব্যক্তির কাযা সালাতের কাফফারা বলে সমাজে যা প্রচলিত আছে তার পুরোটাই আন্দাসের উপর চালিয়ে দেয়া। কাজেই ধরনের সালাতের কাফফারা আদায় করা একটি বিদআতী কাজ।

সংকলেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

Leave a comment