রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর যিয়ারতের ত্রুটিসমূহ চতুর্থ কিস্তি

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর যিয়ারতের ত্রুটিসমূহ চতুর্থ কিস্তি

সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন

২৮। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মত জীবিত মনে করে কিছু চাওয়াঃ

অনেক অজ্ঞ মুসলিম মনে কর থাকে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত পরবর্তী জীবন আমাদের দুনিয়ার জীবনের মত। আমাদের সমাজে বলেন, নবীগণ কবরে জীবিত বা মৃত দুটি বিশ্বাসই প্রচলিত। আবার কারো বিশ্বাস তিনি কবরে হুবহু দুনিয়ার মতই জীবিত যাপন করছেন। অনেকেরতো আবার বিশ্বাস করেন, তিনি মারাই যাননি। তবে মারা গেছেন এমন বিশ্বাস ও আছে। কাজেই বিষয়টি নিয়ে সাধারন মুসলিমদের মধ্যে মহাবিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। এই আকিদার কারনে অনেক মুসলিম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এর কবর জিয়ারত করতে গিয়ে এমন বিষয় চেয়ে বসেন যা মুলত আল্লাহ নিকট চাওয়া যায় ফলে তারা শির্কে আকবর করে বসেন। এই জন্য বিষয়টি একটি পরিস্কার করছি। মানুষ মাত্রই মরণশীল এমন কি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এর উর্দ্ধে নন। আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

 إِنَّكَ مَيِّتٌ۬ وَإِنَّہُم مَّيِّتُونَ (٣٠) 

অর্থ: নিশ্চয়ই তুমিও মারা যাবে, এবং নিশ্চয়ই তারাও মারা যাবে। (জুমার  ৩৯:৩০)।

২.      প্রতিটি মানুষই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আমাদের নবী মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মত একজন মানুষ ছিলেন। নিম্নের আয়াতট দুটি তার দলিলঃ। সুরা আনকাবুদের ৫৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন:

كُلُّ نَفۡسٍ۬ ذَآٮِٕقَةُ ٱلۡمَوۡتِ‌ۖ ثُمَّ إِلَيۡنَا تُرۡجَعُونَ (٥٧)

অর্থ: প্রতিটি মানুষই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। সবশেষে তোমাদের আমার নিকট ফিরিয়ে আনা হবে। (আনকাবুদ ২৯:৫৭)।

আর সূরা কাহাফে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, আমাদের নবী মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মত একজন মানুষ ছিলেন। এরশাদ হচ্ছ:

 قُلۡ إِنَّمَآ أَنَا۟ بَشَرٌ۬ مِّثۡلُكُمۡ يُوحَىٰٓ إِلَىَّ أَنَّمَآ إِلَـٰهُكُمۡ إِلَـٰهٌ۬ وَٲحِدٌ۬‌ۖ فَمَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ رَبِّهِۦ فَلۡيَعۡمَلۡ عَمَلاً۬ صَـٰلِحً۬ا وَلَا يُشۡرِكۡ بِعِبَادَةِ رَبِّهِۦۤ أَحَدَۢا (١١٠)

অর্থঃ (হে রাসুল) আপনি বলে দিন, আমি তো তোমাদেরই মত এক জন মানুষ, আমার নিকট এই মর্মে ওহী করা হয় যে, তোমাদের উপাস্য এক ও একক, অতএব যে নিজ প্রতিপালকের দিদার লাভের আশাবাদী সে যেন সৎকর্ম করে এবং নিজ প্রতিপালকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করে’। [সূরা আল্ কাহাব- ১৮:১১০]

৩.      জম্মিলে মৃত্যু আছে, একথটি সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য সে মানব শিশু হোক বা অন্য কিছু। যে দিন সে পৃথিবীতে জন্ম লাভ করে, তার পরের দিন থেকেই শুরু হয় তার মৃত্যুর দিকে পথযাত্রা। প্রতিটি জীবন মানেই মৃত্যু। নবী রসুলেরাও এর ব্যতিক্রম নয়। এর উর্দ্ধে নয় কোন অলী আওলিয়া বা কোন পূণ্যাত্মা মানুষ। পাপী ও পূণ্যাত্মা সকলেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে। পুর্বের কোন নবী বা রাসুল ও এর উর্দ্ধে ছিলন না। কাফেররা মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বিদ্রূপ করতো যে তিনি যদি সত্য নবী হন তবে মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করবে না। এরই প্রেক্ষিতে উক্ত আয়াত নাজেল হয়। আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা এরশাদ করেন:

وَمَا جَعَلۡنَا لِبَشَرٍ۬ مِّن قَبۡلِكَ ٱلۡخُلۡدَ‌ۖ أَفَإِيْن مِّتَّ فَهُمُ ٱلۡخَـٰلِدُونَ (٣٤) كُلُّ نَفۡسٍ۬ ذَآٮِٕقَةُ ٱلۡمَوۡتِ‌ۗ وَنَبۡلُوكُم بِٱلشَّرِّ وَٱلۡخَيۡرِ فِتۡنَةً۬‌ۖ وَإِلَيۡنَا تُرۡجَعُونَ (٣٥) 

অর্থ: (পৃথিবীতে) তোমার পূর্বেও কোন মানুষকে অনন্ত জীবন দান করা হয় নাই। সুতারাং তোমার মৃত্যু হলে ওরা কি চিরদিন বেঁচে থাকবে ? প্রতিটি আত্মাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি। আমারই নিকট তোমরা ফিরে আসবে, (আম্বিয়া ২১:৩৪-৩৫)।

আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, যে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকাল করলেন, তখন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, “কতকগুলো মুনাফিক বলে বেড়াচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেছেন। আল্লাহর কসম, তিনি মারা যাননি। তিনি কেবল মূসা আলাইহিস সালামের মত সাময়িকভাবে আল্লাহর কাছে গিয়েছেন। মূসা (আ) চল্লিশ দিনের জন্য আল্লাহর কাছে গিয়েছিলেন। তখন প্রচার করা হয়েছিল যে, তিনি মারা গেছেন। অথচ তার পরে তিনি ফিরে এসেছিলেন। আল্লাহর কসম, মূসার (আ) মত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার ফিরে আসবেন। এখন যারা বলছে যে তিনি মারা গেছেন, তাদের হাত পা কেটে দেয়া হবে।” আবু বাক্কর (রা:) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালেরর খবর জানতে পেরে ছুটে এলেন। উমার (রা) তখনও ঐ কথা বলে চলেছেন। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি আয়িশার (রা) ঘরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে গেলেন। তখন তাঁকে ইয়ামনী কাপড় দিয়ে ঘরের এক কোণে ঢেকে রাখা হয়েছিল। এগিয়ে গিয়ে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের কাপড় সরিয়ে চুমু খেলেন। অতঃপর বললেন, “আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক। আল্লাহ আপনার জন্য যে মৃত্যু নির্ধারিত করে রেখেছিলেন তা আপনি আস্বাদন করেছেন। এরপর আপনার কাছে আর কখনো মৃত্যু আসবে না।” অতঃপর মুখ ঢেকে দিলেন। তারপর বাহিরে বেরিয়ে দেখেন উমার (রা) সেই একই কথা বলে চলেছেন। তিনি বললেন, “উমার। তুমি ক্ষান্ত হও। চুপ কর।” উমার (রা) কছিুতেই থামতে রাজী হচ্ছিলেন না। এ অবস্থা দেখে আবু বাক্কর (রা:) জনগণকে লক্ষ্য করে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথা শুনে জনতা উমারকে (রা) রেখে তাঁর দিকে এগিয়ে এল। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করার পর বললেন,

“হে জনমন্ডলী, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের পূজা করতো সে জেনে রাখুক যে, মুহাম্মাদ মারা গেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদাত করতো সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ চিরঞ্জীব ও অবিনশ্বর।” তারপর তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন-

 وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ۬ قَدۡ خَلَتۡ مِن قَبۡلِهِ ٱلرُّسُلُ‌ۚ أَفَإِيْن مَّاتَ أَوۡ قُتِلَ ٱنقَلَبۡتُمۡ عَلَىٰٓ أَعۡقَـٰبِكُمۡ‌ۚ وَمَن يَنقَلِبۡ عَلَىٰ عَقِبَيۡهِ فَلَن يَضُرَّ ٱللَّهَ شَيۡـًٔ۬ا‌ۗ وَسَيَجۡزِى ٱللَّهُ ٱلشَّـٰڪِرِينَ (١٤٤) 

 অর্থ: মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল বৈ আর কিছুই নন। তার পূর্বে বহু রাসূলস অতিবাহিত হয়েছেন। তিনি যদি মারা যান কিংবা নিহত হন তাহলে কি তোমরা ইসলাম থেকে ফিরে যাবে? যে ফিরে যাবে সে আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কৃতজ্ঞ লোকদের আল্লাহ যথোচিত পুরস্কার দেবেন।” (আলে ইমরান-৩:১৪৪)।

এরপর মানুষের মধ্যে এমন ভাবান্তর ঘটলো যে, মনে হচ্ছিল তারা যেন আবু বাক্করের মুখে শোনার আগে এ আয়াত কখনো শোনেইনি। তার আয়াতটি আবু বাকরের কাছ থেকে মুখস্থ করে নিল এবং অনবরত তা আবৃত্তি করতে লাগলো। আবু হুরাইরা বলেন,, উমার (রা) বলেছেন, “আবু বাক্করের মুখে এ আয়াত শোনার পর আমি হতবাক ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে গেলাম। পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আমি তখনই অনুভব করলাম যে,, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যিই ইনতিকাল করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রকাশনীঃ বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মারা গেছেন কিনা এ সম্পর্কে আর কিছু কি বলার আছে। রেফারেন্সগলি তুলে ধরলাম, এখন সিদ্ধান্ত আপনাদের। এবার দেখা যাক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত পরবর্তী জীবন কেমন।

যারা বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মারা তারা দলিলঃ হিসাবে কুরআনের সুরা বাকারা ও সুরা আল- ইমরান দুটি আয়াত পেম করেন।  আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

وَلَا تَقُولُواْ لِمَن يُقۡتَلُ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ أَمۡوَٲتُۢ‌ۚ بَلۡ أَحۡيَآءٌ۬ وَلَـٰكِن لَّا تَشۡعُرُونَ (١٥٤) 

অর্থ: আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না৷ এই ধরনের লোকেরা আসলে জীবিত৷ কিন্তু  (তাদের জীবন সম্পর্কে) তোমারা কোন উপলব্ধি করতে পার না, (বাকারা ২:১৫৪)।

আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেনঃ

وَلَا تَحۡسَبَنَّ ٱلَّذِينَ قُتِلُواْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ أَمۡوَٲتَۢا‌ۚ بَلۡ أَحۡيَآءٌ عِندَ رَبِّهِمۡ يُرۡزَقُونَ (١٦٩) 

অর্থ: “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের কখনই মৃত মনে করো না, বরং তারা জীবিত, এবং তাদের রবের নিকট হতে তারা রিযিকপ্রাপ্ত। [আল- ইমরান ৩: ১৬৯]

কুরআনের আয়াতদুটিতে সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, শহীদগণ মৃত নন, তারা জীবিত ও রিযিক পাচ্ছেন। আমরা জানি, বারযাখে সমস্ত মানুষেরই এক ধরনের জীবন আছে। আপনি যদি মুসলিম হন তবে অবশ্যই কবরের ছওয়াল জওয়াব বিশ্বাস করেন, কবরের আযাব/শান্তি বিশ্বাস করেন। আর এসব কোন প্রানহীন মানুষর পক্ষে ঘটা সম্ভব নয়। কাজেই এটাও জীবন কিন্তু এই জীবন সাধারণ দুনিয়ার জীবনের মত নয়। এই জীবনটাকে বলা হয় “হায়াতুন বারযাখিয়া’। শহীদের এই বারযাখি জীবন সাধারণ লোকদের বারযাখি জীবনের চেয়ে ভিন্নতর কারন কুরআনে শহীদের সেই জীবন যেভাবে জীবিত ও রিজিক প্রাপ্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারন লোকের জীবনের কথা তেমনিভাবে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু এর অর্থ যদি আমরা এভাবে করি যে, শহীদগন দুনিয়ার জীবনের মত চলাফেরা করেন খাওয়া দাওয়া করেন, তবে নিতান্তই ভুল হবে। তাদের জীবন সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লষন করা খুবই নির্বুদ্ধিতার কাজ। কারন আয়াতের শেষ অংশে বলা হয়েছে (۬ وَلَـٰكِن لَّا تَشۡعُرُونَ) ‘তোমারা কোন উপলব্ধি করতে পার না’। এরপরও উপলব্ধি করার চেষ্টা করা বা ব্যাখ্যা বিশ্লষন করে সাধারন দুনিয়ার জীবনের মত মনে করা কত টুকু যুক্তি সংগত হবে। শহীদদের ওফাত পরবর্তী জীবন সাধারণের জীবনের চেয়ে ভিন্নতর কুরআনে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, নবীদের কথা তেমনিভাবে উল্লেখ করা হয়নি। যেহেতু আল্লাহর কাছে নবীদের মর্যাদা শহীদের চেয়েও অনেক বেশি। কাজেই ওফাত পরবর্তী জীবন শহীদের জীবনের চেয়ে নবীদের জীবন ভিন্নতর হওয়ার কথা অধিকাংশ আলেম উল্লেখ করেছেন। তাহলে বুঝতে পাররাম সাধারন মুসলিম, শহীদ ও নবীদের ওফাত পরবর্তী জীবনের (বারযাখি জীবনের) মধ্যে পার্থক্য আছে। ওফাত পরবর্তী জীবন বা বারযাখি জীবন সম্পর্কে হাদিসে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকায় জন্য কারো কোন মতভেদ নাই।

যেহেতু সাধারন মুসলিম, শহীদ ও নবীদের বারযাখি জীবনের মধ্যে পার্থক্য আছে। আর পার্থক্য না জানার জন্যই মুলত আমরা এ সম্পর্কে মহা বিভ্রান্তে পতিত হই। এই পার্থক্য নির্ণয় করতে গিয়ে কুরআন হাদিসের উপর নির্ভর না করে বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বারযাখি জীবনের কথা একটি গায়েবি বিষয় কাজেই অহী ছাড়া কথা বলা যাবে না। অহীর ব্যাখ্যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে করছেন, সাহাবিগন রাজি: যেভাবে বুঝছেন, সলফে সালেহীন যেভাবে পালন করছেন তার ব্যতিক্রম গ্রহনীয় নয়। মৃত্যু পরবর্তী জীবন বা বারযাখি জীবন তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়ঃ

১.  সাধারন মুসলিম বা অমুসলিমদের বারযাখি জীবন

২.  শহীদের বারযাখি জীবন

৩.  নবীদের বারযাখি জীবন

সকলের কাছে এ ব্যাপারটি স্পষ্ট যে মৃত্যুর পর সকলেনই বারযাখি জীবন ভোগ করতে হয়। সাধারন মুমিন, মুনফিক, কাফির ও ইয়াহুদীদের  বারযাখি জীবনে জীবিত থাবকে। মুমিনকে জান্নাত দেখান হবে, সামান্য অন্যায়ে আযাব দেওয়া হবে। মুনফিক ও কাফির আযাবে যন্ত্রনায় চিত্কার করবে।  ইয়াহুদী, খৃষ্টান ও কাফির সকলকেই আযাব ভোক করতে হবে। যার অর্থ হল এদের সললেরই বারযাখি জীবন আছে। যদি কেউ বলে, এরা সকলে আযাবে যন্ত্রনায় চিত্কার করছে, কাজেই দুনিয়ার জীবনের সাথে তাদের জীবনের সাদৃশ্য আছে। যেমনটি শহীদদের ব্যাপারে অনেকে বলে থাকেন:  আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালা বলেন, “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের কখনই মৃত মনে করো না, বরং তারা জীবিত, এবং তাদের রবের নিকট হতে তারা রিযিকপ্রাপ্ত, (আল- ইমরান ৩: ১৬৯)। আল্লাহ্‌ সুবাহানাহুয়াতালার স্পষ্ট ঘোষনা শহীদগন জীবিত ও রিজিক প্রাপ্ত। এ থেকেও বুঝা যায় দুনিয়ার জীবনের সাথে  শহীদদের বিশেষ জীবনের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। কারন দুনিয়ার জীবনে খাবার খেতে হয়। আর ও একটু বাড়িয়ে বলা যায়, নবীদের মর্যাদা শহীদের চেয়েও অনেক বেশি তাই দুনিয়ার জীবনের সাথে নবীদের জীবনের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। তাই তারা মরে নাই, তারা জীবিত, খাবার খায়, তারা হাজির নাজির ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই তাদের বারযাখি জীবন ও সাধারণের জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এভাবে যুক্তির দ্বারা মানুষকে ঘাস খাওয়ান যায় কিন্তু যুক্তির দ্বারা তৈরি আকিদা গ্রহনীয় নয়। যেমন: কেউ বলল মানুষ ঘাস খায়। আপনি বললেন কিভাবে? সে বলল, গরু ঘাস খায়। আর মানুষ গরু খায়। আপনি বললেন, না মানুষ মাংশ খায়। সে যুক্তি দিল মাংশতো ঘাস খাওয়ার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে। আপনি বললেন ও বুঝেছি, এভাবেই মানুষ ঘাস খায়। 

 বলেছিলাম যে, শহীদগন জীবিত ও রিজিক প্রাপ্ত। তাই  তাদের সাথে দুনিয়ার জীবনে সাদৃশ্য রয়েছে। সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য দেখানোর প্রয়োজন নেই। হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাত পরবর্তী জীবন সম্পর্কে যা বলছেন তা মোনে নেওয়াই মুমিদের কাজ।   

 সহীহ মুসলিম বর্নিত, হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:- ‘আমি মিরাজের রাতে (বাইতুল মাকদিসের পাশে) লাল বালুর ঢিবির কাছে মূসা আ.-এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছি। তখন তিনি তাঁর কবরে দাড়িয়ে নামায আদায় করছিলেন”।

এই হাদিসটি বর্ননা করে বলে, যেহেতু মুসা (আ:) কবরে দাড়িয়ে নামায আদায় করছিলেন, সুতারং তিনি জীবিত।  অথচ সহিহ মুসলিম, সহিহ বুখারি, নাসাঈ শরীফসহ অনেক গ্রন্থে পাওয়া যায় মিরাজের রাতে ষষ্ঠ আসমানের হযরত মুসা (আঃ)-এর সাক্ষাৎ পান। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মারহাবা দেন ও কল্যাণের জন্য দুআ করলেন। ফিরে আসার সময় মুসা (আঃ)-এর পরামর্শে আল্লাহর নিকট থেকে পঞ্চাশ ওয়াক্ত কমিয়ে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করে নিয়ে আসেন। তাই বলে কি তিনি ষষ্ঠ আসমানের থাকেন? আমাদের আকিদা হবে, মুসা (আ:) কবরে দাড়িয়ে নামায আদায় করেন আবার  আল্লাহর ইচ্ছায় ষষ্ঠ আসমানে ও থাকেন। বারযাখী হায়াত সম্পর্কে আল্লাহই ভাল জানেন।

এ হিসাবেতো মুমিন, মুনফিক, কাফির ও ইয়াহুদী এমনকি পরনিন্দাককারী, পেশাবের ব্যাপারে অসতর্কতা অবলম্বনকারি সকলেই জীবিত। এমনি ভাবে আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করে সাধারন মানুষকে মহাবিভ্রান্তিতর ফেলে দেয়। কাজেই কোন আকিদার প্রশ্ন আসলে, আপনি যুক্তি না খুজে দলিলঃ খুজবেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত পরবর্তী জীবন বা বারযাখি জীবন ও সাধারণের জীবনের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি নেই তার জন্য কোন ব্যাখ্যা প্রয়োজন নেই। দরকার শুধুই কুরআন হাদিসের মতামত। নবীগণের বিষয়ে কুরআন কারীমে কিছু না বলা হলেও সহীহ হাদীসে তাঁদের মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে এখন শুধু সহিহ হাদিসগুলি উল্লেখ করব। দেখবেন একজন বুদ্ধিমান জ্ঞানি মানুষ হিসাবে আপনি নিজেই বলতে পারবেন আসল ব্যাপারটি কি?

০১. আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘নবীগণ তাঁদের কবরের মধ্যে জীবিত, তাঁরা সালাত আদায় করেন।’’ (সিলসিলাতুস সহীহা, হাদীস ৬২১)

২. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকাল পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বিশেষভাবে কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আবু হুরাইরা (রা.) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যখনই যে কেউ আমাকে সালাম করে তখনই আল্লাহ আমার রূহকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন, যেন আমি তার সালামের উত্তর দিতে পারি।’’ (আবূ দাউদ ২০৪১)

৩. আউস (রা) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি হল জুমার দিন। এ দিনেই আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিনেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ দিনেই শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে, আর এ দিনেই সকল প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে। সুতরাং এ দিনে তোমরা আমার উপর বেশি করে ছালাত ও সালাম পাঠাও। তোমাদের ছালাত আমার কাছে পেশ করা হবে। সাহাবাগণ বললেন, আমাদের ছালাত আপনার কাছে কীভাবে পেশ করা হবে, তখন যে আপনি (মাটির সাথে মিশে) ক্ষয়প্রাপ্ত (নিঃশেষিত) হয়ে যাবেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মাটির জন্য নবীগণের দেহ খাওয়াকে হারাম করে দিয়েছেন’। (আলবানী, আস সহীহা  ১৫৩০; সুনানে আবু দাউদ ১০৪৭, মুসনাদে আহমাদ ১৬১৬২)

৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন। “আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত একদল ফেরেশতা রয়েছেন যারা দুনিয়াতে ঘুরে বেড়ান এবং আমার উম্মতের সালাম আমার কাছে পৌঁছে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯১৪)

উপরের সহিহ হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মৃত্যু পরবর্তী জীবন দান করা হয়েছে। এ জীবন হল, তার বারযাখী জীবন। যা সম্পর্কে মনগড়া ইচ্ছামতন বানিয়ে বানিয়ে বলা সম্পুর্ন হারাম।  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বারযাখী জীবনটা তার বিশেষ সম্মান ও মর্জাদার বহন করে। যেহেতু এটি গায়েবী জগতের খবর তই এ বিষয়ে হাদীসে যতটুকু বলা হয়েছে ততটুকুই বলতে হবে, এর বেশী বাড়ান বা কমান যাবে না। হাদীসের আলোকে বলা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অলৌকিক বারযাখী জীবন অনেক ঘটনা ঘটছে যা সাধারন মুমিন থেকে সম্পুর্ণ আলাদা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই অলৌকিক বারযাখী জীবনের বৈশিষ্ট হল;

১. তার এই জীবনে সালাত আদায়ের সুযোগ রয়েছে।

২. কেউ সালাম দিলে আল্লাহ তাঁর রূহ মুবারাককে ফিরিয়ে দেন সালামের জবাব দেয়ার জন্য।

৩.  নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মাটির জন্য তার দেহ খাওয়াকে হারাম করে দিয়েছেন।

মন্তব্যঃ হায়াতুন্নাবী বলতে অনেকে বুঝে থাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাত পরবর্তী জীবন জাগতিক জীবনের মতই। এ ধারণাটি ভুল এবং তা কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবীগণের রীতির পরিপন্থী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু পরবর্তী পরের ঘটনাগুলো হাদীসগ্রন্থগুলোতে পাঠ করলেই আমরা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে, সাহাবীগণ তাকে কখনোই জাগতিক জীবনের অধিকারী বলে মনে করেন নি। তাই তার ওফাতের পর একজন সাধারন মুমিনের মৃত্যর পর তার সাথে যে রকম করার আদেশ তিনি দিয়ে ছিলেন তার তার সাথেও ঠিক তেমনি আচরন করা হইয়াছে। যেমন গোসল করান, দাফন করা।

 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবদ্দশায় তার পরামর্শ, দোয়া ও অনুমতি ছাড়া কোন সাহাবি কিছু করছেন বলে প্রমান পাওয়া যায় না। কিন্তু তার ওফাতের পরে কখনো কোনো সাহাবী তার কবরে দোয়া, পরামর্শ বা অনুমতি গ্রহণের জন্য আসেন নাই।

ইতিহাস গ্রন্থ পড়লে দেখা যায় তার ওফাতের পরে খলীফা নির্বাচনের বিষয়সহ সাহাবীগণ বিভিন্ন সমস্যায় পড়েছেন। নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির জন্য যুদ্ধবিগ্রহ করেছেন। আবু বকর (রা)-এর খিলাফত গ্রহণের পরই অনেকে জাকাত দিতে অস্বীকার করে,  প্রায় আধা ডজন ভন্ড নবী দাবি করে বসে এবং আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ শুরু হয়। উম্মুল মুমিনীন আয়েশার (রা) সাথে আমীরুল মুমিনীন আলীর (রা) কঠিন যুদ্ধ হয়েছে, আমীর মুয়াবিয়ার (রা) সাথেও তার যুদ্ধ হয়েছে। হাজার হজার সাহাবি শহীদ হয়েছেন। তার কলিজার টুকরা ফাতিমর (রাদি:) পুত্র হোসাইন (রাদি:) কারবালায় নির্মমভাবে শহীদ হন। এই ভয়াবহ বিপদের সময় কোনো খলিফা (রা) বা  সাহাবী (রা) তার কবরে কাছে দোয়া বা পরামর্শের জন্য গিয়েছেন বলে জানা যায়না। আল্লাহর কাছে দোয়া করার জন্যও কবর শরীফে সমবেত হয়ে কোনো অনুষ্ঠান করেন নি। এমনকি কারো কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রূহানীভাবেও প্রকাশিত হয়ে কিছু বলেন নাই এবং কাউকে সপ্নের মধ্যে ও নির্দেশ দেন নাই। জালিয়াতগন হযরত ওমরের (রা) পক্ষে বিপক্ষে, হযরত আলীর (রা) পক্ষে বিপক্ষে হাদিস বানিয়েছেন। কিন্তু ওফাতের পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর থেকে বা রূহানীভাবেও প্রকাশিত হয়েছে অথবা সাহাবীগণের মাজলিসে এসে কোন পরামর্শ দিয়েছেন বলে হাদিস জাল করতে সাহস পাননি। সুতারং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাত পরবর্তী জীবন জাগতিক জীবনের মত মনে করা চরম বোকামি ছাড়া কিছু না।

এই ভ্রান্ত আকিদার ফলঃ

এই ভ্রান্ত আকিদা নিয়ে আমাদের উপমহাদেশ থেকে যারাই হজ্জের সফরে যান। তারা নিজে সালাম দেয়ার পাশাপাশি অন্যদের সালামও পৌছান। যার প্রমান আমাদের সালাফদের মাঝে ছিল না। অনেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জীবিত মনে করে দুনিয়ার হাজত পুরা করার জন্য দোয়া করে থাকে। অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেও তার নিজের হাজত সব সময় মহান আল্লাহর নিকট পেশ করতেন। তারা এই বিশ্বাস রাখে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখন সরাসরি তাদের দেখছেন এবং তাদের ফরিয়াদ শুনছেন। এহেন বিশ্বাস নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর জিয়ারত করতে গেলে সওয়াবতো অনেক দুরের কথা, মুসরীক হয়েই ফিরে আসার সম্ভাবনা  থাকে।   

 সংকলনেঃ মোহাম্মাদ ইস্রাফিল হোসাইন। (বিএ ইন আরবি সাহিত্য ও ইসলাম শিক্ষা)

One thought on “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর যিয়ারতের ত্রুটিসমূহ চতুর্থ কিস্তি

Leave a comment